রাজার গালে হাত, মন্ত্রীর কপালে ভাঁজ

রাজার গালে হাত, মন্ত্রীর কপালে ভাঁজ

কপট রাজ্য পড়েছে বিরাট বিপদে। ছোটখাটো বিপদ নয়। ভয়ংকর বিপদ। রাজার গালে হাত, মন্ত্রীর কপালে ভাঁজ, সেনাপতির চুল খাড়া, কোটালের গোঁফ ঝুলে পড়েছে, উজিরের কান কটকট করছে। উজিরমশাইয়ের এই একটা সমস্যা। মনে চাপ হলে শরীরে রিঅ্যাকশন হয়। সকলের চোখে ভয়। কী হবে?

ঘটনা কী?

ঘটনা মারাত্মক। উত্তরের পাহাড় ডিঙিয়ে শত্রুপক্ষ হঠাৎই ঢুকে পড়েছে। ঢুকে পড়েছে চুপিচুপি। জলের ধারে, বনের মাঝে, গাছের তলায় ঘাঁটি গেড়েছে। সে ঘাঁটি বেশি দূরে নয়। যে-কোনওদিন রাজধানীতে পৌঁছে যাবে। শত্রু সেনাদের হাতে তরবারি ঝলসাচ্ছে। লাঠি চলছে সাঁই সাঁই করে। চকচকে বল্লম আকাশে মারছে খোঁচা। ধনুক থেকে তির ছুটছে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। গভীর রাতে ভেসে আসছে বুক কাঁপানো দামামার আওয়াজ। গুম-গুম-গুম..। প্র্যাকটিশ চলছে। যুদ্ধের মহড়া।

রাজদরবারে বসেছে জরুরি মিটিং। জরুরি এবং গোপন। কপট রাজা গাল থেকে হাত সরিয়ে সিংহাসনে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘মন্ত্রী, আমাদের সৈন্যরা সব গেল কোথায়?’

মন্ত্রীমশাই বসে আছেন রাজার ডানপাশের আসনে। তিনি মাথা চুলকোতে লাগলেন। গত তিনদিনে এই নিয়ে একশো বিয়াল্লিশবার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই রাজামশাই প্রশ্নটা করে বসছেন এবং রেগে রেগে উঠছেন। অনেকটা হেঁচকি ওঠার মতো। এই মনে হচ্ছে, সেরে গেছে, আর হেঁচকি উঠবে না, পরক্ষণেই ‘কক’! আবার হেঁচকি। একশো বিয়াল্লিশবার জবাব পেয়েও রাজা খুশি নন। প্রশ্নের উত্তর মেনে নিতে পারছেন না। না পারলেও কিছু করবার নেই। ঘটনা যে সত্যি।

মন্ত্রীমশাই ঢোঁক গিলে বললেন, ‘মহারাজ, সৈন্যরা সব ছুটিতে আছে।’

রাজা তেড়েফুড়ে উঠে বললেন, ‘ছুটিতে আছে! কীসের ছুটি? রাজ্য কি বিদ্যালয় যে পুজোর ছুটি গরমের ছুটি, পাওয়া যাবে? কে তাদের ছুটি দিয়েছে? কে?’

মন্ত্রীমশাই দেখলেন এই সুযোগ। ঝামেলা ঘাড় থেকে ফেলে দেওয়া যাবে। তিনি চট করে বললেন, ‘এই বিষয়টাকে সেনাপতি সবথেকে ভালো বলতে পারবেন। সৈন্যদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ তো তারই। ছুটিছাটার বিষয়গুলো উনিই দেখেন।’

রাজামশাই হুংকার দিলেন, ‘সেনাপতি।’

সেনাপতি বসেন রাজার বাঁ-পাশে। তার তো কাঁপাকাঁপি অবস্থা। ক’দিন হল পেটের অবস্থা টাইট। বাড়িতে গিন্নি তালের ক্ষীর বানিয়েছিল। ক’দিন জামবাটি ভর্তি করে সেই ক্ষীর সাঁটিয়েছেন। মনে হয়েছে তালক্ষীর হল অমৃত। কাল রাত থেকে ক্ষীর বিট্রে করেছে। অমৃত হয়ে গেছে বিষ। প্রবল পেটের যন্ত্রণা। গোটা রাত কেটেছে বাথরুমে। সকালে রাজবৈদ্যের কাছ থেকে ওষুধ খেয়ে কোনওরকমে খানিকটা সামলে ছুটে এসেছেন। তার ওপর এই ভয়াবহ টেনশন। পেটে ক্ষীরের চাপের সঙ্গে টেনশনের চাপ। রাজদরবারেই কেলেঙ্কারি কিছু না হয়ে যায়। মিনমিনে গলায় সেনাপতি বললেন, ‘আদেশ করুন মহারাজ।’

রাজামশাই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘ধ্যাষ্টামো ছাড়ো। আদেশের কী আছে? আমাদের সৈন্যদের ছুটি দিল কে? এখন যুদ্ধ করবে কে? তুমি?’

সেনাপতি ঢোক গিলে, কোমোরের কাপড়ে গিঁট দিতে দিতে মিনমিনে গলায় বললেন, ‘মহারাজ ছুটি তো দেওয়া হয়নি। যারা ছুটির কথা বলছে তারা সত্য বলছে না। আমাদের সৈন্যদলকে হেয় করবার চেষ্টা করছে। বহুদিন যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছু নেই তো, তাই সৈন্যরা একটু বিশ্রামে আছে। যুদ্ধ শুরু হলেই ঠিক চলে আসবে।’

রাজা আর্তনাদ করে উঠলেন।

‘বিশ্রাম! রাজসৈন্যরা বিশ্রাম করছে! এ কি ফুটবল খেলা মন্ত্রী? হাফ টাইমে বিশ্রাম! ফাজলামি হচ্ছে?’

ধমক খেয়ে পেটে চাপ অনুভব করলেন সেনাপতি। অসহায়ভাবে তিনি মন্ত্রী, কোটাল, উজিরের দিকে তাকালেন। তারা সকলেই গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘ফাজলামি হচ্ছে? অ্যাঁ, ফাজলামি? ছি ছি। এটা কি ফুটবল খেলা?’

সেনাপতির মাথায় গেল আগুন জ্বলে। এতদিন আঙুল চুষেছ, এখন সব দোষ তার? সে হল ঠান্ডা আলুর চপ আর বাকিরা সবাই গরম বিরিয়ানি?

রাজামশাই কঠিন স্বরে বললেন, ‘আমি শুনলাম, গত কয়েকবছর ধরে সৈন্যরা সব নাকে সর্ষের তেল ঢেলে ঘুমোচ্ছে। একেকটা নাকের ফুটোয় একেক বাটি তেল ঢেলেছে। ঘটনা কি সত্য সেনাপতি?’

সেনাপতি দেখল এই মওকা। উজিরবেটাকে ফাঁসাতে হবে। সে হাত কচলে বলল, ‘ঘটনা সত্য মহারাজ।’

রাজামশাই চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ঘটনা সত্য! আমার মুখের ওপর এই কথা তুমি বলতে পারলে? সেনারা নাকে তেল ঢেলে ঘুমোচ্ছে!’

সেনাপতি বলল, ‘রাজামশাইয়ের সামনে আমি কখনোই মিথ্যে বলি না। সত্য গোপনও রাখি না।’

রাজামশাই ফোঁস আওয়াজ করে বললেন, ‘এত তেল তারা কোথা থেকে পেল? বলো কোথা থেকে পেল?’

এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও সেনাপতি এক গাল না হেসে পারল না। বলল, ‘সেটাই তো প্রশ্ন রাজামশাই, এই তেল তাদের কে সাপ্লাই করল? আজ যদি নাকে তেল না পড়ত, আমাদের সৈন্যরা কি এভাবে ভোঁস-ভোঁসিয়ে ঘুমিয়ে থাকত? সব ঘুম ভাঙানো যায়, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোলে ভাঙানো যায় না। তেল দেওয়া চাকার মতো গড়াতেই থাকে, গড়াতেই থাকে। রাজামশাই, আপনি আদেশ করলে আমি তদন্ত করে দেখতে পারি এত তেল এল কোথা থেকে। আমাদের সেনাদের ঘুমের দেশে পাঠানোর জন্য এটা কি শত্রুদের চক্রান্ত?’

কথা শেষ করে সেনাপতি আড়চোখে কোটালমশাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাবটা এমন যেন—’কেমন দিলাম? ফাজিল বলা ঘুচিয়ে দেব তোমার।’ কোটালমশাইয়ের মুখ ঝুলে গেছে। কারণ তেলকম্মের কালপ্রিট তিনি। তিনিই সৈন্যদের জন্য তেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে যেভাবে সেনাপতি বলছে সেভাবে নয়। অল্প কয়েকজন সৈন্য একদিন কোটালমশাইকে ধরেছিল।

‘হুজুর জীবনে একটাই শখ ছিল, নাকে তেল ঢেলে ঘুমোব।’

কোটালমশাই বলেছিলেন, ‘শখ যখন ঘুমোও। কে আপত্তি করেছে? সামনে তো যুদ্ধবিগ্রহ কিছু নেই। ক’দিন পড়ে পড়ে ঘুমোলে ক্ষতি কী? কোনও ক্ষতি নেই। বরং ভালো। ঘুম স্টক করে রাখতে পারবে।’

সৈন্যরা গদগদ গলায় বলল, ‘হুজুর, আপনাকে শতকোটি প্রণাম। কিন্তু হুজুর তেল পাই কোথায়? গরিব মানুষ আমরা। আমাদের কি নাকে ঢালার মতো তেল কেনবার মুরোদ আছে? আপনি হুজুর আমাদের ফাদার মাদার, অগতির গতি, অসহায়ের সহায়। আপনি যদি একটু বলেকয়ে রাজ-রন্ধনশালা থেকে এক ড্রাম খাঁটি সর্ষের তেল জোগাড় করে দেন…অন্যায় নেবেন না হুজুর…।’

এত ভক্তিতে গলে গেলেন কোটালমশাই। তৈলমর্দনে পা পিছলাল বলা যেতে পারে। বললেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করে দেব’ক্ষণ। এ আর এমন কী। মোটে তো এক ড্রাম তেল। রন্ধনশালায় আমার শ্যালক আছে। তাকে বললেই জোগাড় হয়ে যাবে।’

ব্যবস্থা করেও দিয়েছিলেন। এক ড্রাম পারেননি, হাফ ড্রাম। তবে সে আর কতজনের? মেরেকেটে শতখানেকের। বাকি সৈন্যরা সব গেল কোথায়?

কথাটা বলতে গিয়েও কোটালমশাই চুপ করে গেলেন। রাজামশাইকে এখন না ঘাঁটানোই ভালো। মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে আছে। দুম করে যদি তদন্ত-ফদন্তের অর্ডার দিয়ে বসেন তাহলে মুশকিল। সেনাপতি বেটাকে সুযোগ পেলেই ঝামেলায় ফেলতে হবে। এখন চুপ করে যাওয়াই ভালো। এই যুদ্ধের বাজারে রাজামশাই তেলকাণ্ড আর কতক্ষণ মনে রাখবেন?

এমন সময় পেয়াদা এসে কুর্নিশ করল।

রাজা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কী হয়েছে? কী চাই?’

পেয়াদা মাথা নামিয়ে বলল, ‘হুজুর, ভজকাঠি এসেছে। আপনার দর্শন চায়।’

ভজকাঠি এসেছে শুনে রাজামশাই নড়েচড়ে বসলেন। ভজকাঠি তাঁর ব্যক্তিগত অনুচর। তিনি ভজকাঠিকে রাজ্যের সেনাবাহিনীর বিষয়ে একটি গোপন রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছিলেন। মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল, উজিরদের তিনি পুরোটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যারা রাজ্যের সৈন্যদের নাকে তেল ঢেলে ঘুমোতে উৎসাহ দেয় তাদের বিশ্বাস করা কঠিন। রাজা পেয়াদাকে বললেন, ‘ভজকাঠিকে এখানে নিয়ে এসো’।

ভজকাঠি রাজদরবারে ঢুকে সবাইকে দেখে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। সে ভেবেছিল রাজামশাই একাই থাকবেন। সে যে রিপোর্ট পেয়েছে তা মারাত্মক। রাজামশাই এই রিপোর্ট শুনলে মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল, উজিরের গর্দান নিয়ে না বসেন। সে হল ডাইরেক্ট রাজামশাইয়ের লোক। রাজামশাই যখন অন্যের খবরে বিশ্বাস হারান, তখন ডাক পড়ে ভজকাঠির। সে অনেক খাটাখাটনি করে, সত্যি খবর নিয়ে আসে।

ভজকাঠি রাজামশাইকে প্রণাম করল। রাজামশাই বললেন, ‘রিপোর্ট এনেছ?’

ভজকাঠি পকেট থেকে খাম বের করে আমতা-আমতা করে বলল, ‘এনেছি রাজামশাই। এই যে খাম।’

রাজামশাই সিংহাসনে হেলান দিয়ে বললেন, ‘গুড। এবার খাম থেকে বের করে পড়ো। জোরে জোরে পড়বে। সবাই যেন শুনতে পায়।’

ভজকাঠি বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি পড়ব রাজামশাই!’

রাজামশাই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘তা নয় তো কী? আমি পড়ব? তোমার রিপোর্ট তুমি পড়বে।’

ভজকাঠির শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। রাজদরবারের সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো মুখ। কেউ কেউ কপালের ঘাম মুছছে। নিশ্চয় মনে-মনে বলছে ‘দাঁড়াও ভজকাঠি, আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। তোমার রিপোর্ট শুনে রাজামশাই যদি চটে যান তোমার রক্ষে নেই। বাইরে বেরোলে শূলে চড়াব।’ সত্যি কথা বলতে কী, ভজকাঠিকে শূলে চড়াবার অনেক গ্রাউন্ড আছে। সে আসলে একজন ছিঁচকে চোর। একবার রাজপ্রাসাদে ঢুকেছিল চুরি করতে। ধরাও পড়ে যায়। রাজপ্রাসাদে চুরি করতে আসা ভয়ংকর অপরাধ। রাজামশাই কিন্তু ভজকাঠিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ক্ষমা করবার কারণ সে কৌশলে রাজার বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পেয়াদার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, বোকা বানিয়ে রাজঅন্তঃপুরে ঢুকে যাওয়া সহজ কথা নয়। রাজা তার সাহস এবং বুদ্ধিতে খুশি হয়েছিলেন। সেই কারণে তাকে ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে সে হয়েছে রাজার ব্যক্তিগত অনুচর। সে তার দায়িত্ব অতি দক্ষতা এবং সততার সঙ্গে পালন করছে।

রাজা একবার হুংকার দিলেন।

‘কী হল ভজকাঠি? চুপ করে আছ কেন? এখন কি চুপ করে থাকবার সময়? দুয়ারে শত্রু, শিয়রে শমন।’

ভজকাঠি ঢোঁক গিলে বলল, ‘রাজামশাই এটা গোপন রিপোর্ট। কপট রাজ্যের নিরাপত্তা বিষয়। এই রিপোর্ট কি উচ্চকণ্ঠে পড়া উচিত হবে?’

রাজামশাই চোখ কটমট করে বললেন, ‘আলবাত হবে। আমি চাই সবাই শুনুক। তুমি যা যা তথ্য পেয়েছ সেকথা নির্ভয়ে জানাও। এখানে সবাই জানে তুমি আমার লোক। আমার আদেশে কাজ করো। তোমার কোনওরকম অনিষ্ট হলে কাউকে রক্ষে রাখব না।’

এরপর আর কী করা? স্বয়ং রাজামশাই যখন আশ্বাস দিয়েছেন, তখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভজকাঠি ইঙ্গিত করে পেয়াদাকে জল আনতে বলল। জল খেয়ে শুরু করল রিপোর্ট পড়তে।

সেই রিপোর্ট ভয়ংকরের থেকেও বেশি ভয়ংকর। সংক্ষেপে সেই ভয়ংকর রিপোর্ট তুলে ধরা হল—

কপট রাজ্যের সৈন্যদের একটা অংশ যেমন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে, অন্যদের অবস্থা আরও খারাপ। সেনাবাহিনীর রয়েছে চার রকম বাহিনী। হস্তিবাহিনী, অশ্বারোহী, পদাতিক আর নৌবাহিনী। যুদ্ধের কোনও ব্যাপার নেই দেখে হস্তিবাহিনীর হাতিদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সার্কাসে। অত বড় পশু বসিয়ে খাওয়ানোয় লাভ নেই। রাজস্বে ক্ষতি। তার থেকে ক’টাদিন সার্কাসে কাজ করে দু-পয়সা রোজগার করুক। এই পরিকল্পনায় যুদ্ধের হাতিরা সার্কাসে গানের তালে শুঁড় নাড়াচ্ছে। নৌবাহিনীর নৌকোগুলো বেরিয়ে পড়েছে মাছ ধরতে আর বাইচ খেলতে। শুধুমুদু নৌকো পড়ে থাকায় নাকি কাঠের পাটাতনে উই ধরছিল। পদাতিকবাহিনীর অধিকাংশ সেনা এখন ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বিশ্রাম করছে। ছুটির সময় তারা চট করে মাটিতে পা রাখতে চায় না। তাকিয়ায় শুয়ে একে-তাকে অর্ডার মারে আর ওজন বাড়ায়। যুদ্ধের সময় কম খেয়ে আর হেঁটে যা ল্যাকপ্যাকে সব চেহারা হয়, বাকি সময়টুকু রেস্ট না নিলে সমস্যা। রাজ্যের ঘোড়াবাহিনীর কথা শুনলে চমকে উঠতে হবে। ঘোড়ারা আছে পরম আনন্দে। নদীর পাড়ে ঘাস চিবোচ্ছে আর চিঁহি গলায় ডাকাডাকি করছে। তাদের মুখে না আছে লাগাম, পিঠে না আছে জিন। তারা দিব্যি গা-ঝাড়া দিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সৈন্যদের মধ্যে যারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে না, তারা অনেকেই চলে গেছে বেড়াতে। লম্বা ট্যুর। হস্তিবাহিনীর প্রধান নরহরি কবিরাজ সেই যে শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠী করতে গেছে, এখনও ফেরবার নামটি নেই। ছ’মাস ধরে জামাইষষ্ঠী চলছে! এরকম আরও আছে। যেমন ঘোড়াবাহিনীর মেজোকর্তা ভীমকান্ত পুণ্ডরিক। গেছে গ্রামের বাড়ি। চাষবাস সেরে ফিরবে। অথচ সৈন্যদের পার্টটাইম কাজ করবার নিয়ম নেই। কে নিয়মের ধার ধারে? অনেকেই ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, মন্দির দেখে বেড়াচ্ছে আর ফেসবুকে ফটো আপলোড করছে। এই অবস্থায় শত্রু আক্রমণ করলে ভরাডুবি তো কোন ছাড়, তার থেকেও বেশি। তাছাড়া শুধু তো আর সৈন্যদের অভাব নয়, অন্য সমস্যাও আছে। লোকজন না হয় টেনেটুনে খানিকটা জোগাড়যন্তর করা যাবে, কিন্তু যুদ্ধের পোশাক? তার কী হবে? কোথায় ঝলমলে জামা? কোথায় পাগড়ি? কোথায় কোমরবন্ধ, সব তো ধোপাবাড়িতে কাচতে গেছে। হাজার হাজার পোশাক কাচা কি চাট্টিখানি কথা! কয়েক বছর লেগে যায়। কাচার পর সেই কাপড় শুকোনো হয়, ইস্তিরি হয়। নিয়ম হল সৈন্যবাহিনীর দু-সেট করে কাপড় থাকবে। একসেট কাচাকুচিতে গেলে, আরেক সেট নিজের কাছে থাকবে। সেই দু-নম্বর সেটের টাকা এখন রাজকোষ থেকে বিলি হয়নি। তাহলে? সেনারা কি ধুতি-পাঞ্জাবি, প্যান্ট-শার্ট, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে যুদ্ধ করবে? আচ্ছা, তাও নয় বোঝা গেল। এমারজেন্সি টাইমে পোশাক নিয়ে অত মাথা ঘামানো নাই বা হল। কিন্তু অস্ত্র? তার কী হবে? সব তো পড়ে আছে অস্ত্রাগারে। মরচে ধরেছে, ধুলো জমেছে, ধার কমেছে। তরবারির অবস্থা খুবই দুঃখ জনক। কে একজন ছেলের স্কুলের খাতা বানাতে তরবারি দিয়ে ফুলস্কেপ কাগজ কাটতে গিয়েছিল, ফেল মেরেছে। ধনুকের টান নেই। তির লাগিয়ে ছুড়লে পায়ের কাছে পড়ে যাচ্ছে। বল্লমের খোঁচা শত্রুদের পেট ফাঁসা তো দূরের কথা, বেলুনও ফাটবে না। এই সব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে গেলে হাসাহাসি হবে।

রিপোর্টের শেষে ভজকাঠি যুদ্ধবাজনার কথাও বলেছে। যাকে বলে রণবাদ্য। এই জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দামামা, দুন্দুভি, ভেরি, শিঙা, মহানক, কলকচ, শঙ্খ, গোবিসান, ঝরঝর। এসব ছাড়া যুদ্ধই হয় না। সকালে শিঙা বাজিয়ে যুদ্ধ শুরু। সূর্যাস্তে শিঙা বাজিয়ে বিরতি ঘোষণা। মাঝপথে যুদ্ধগীতে সেনাদের টগবগিয়ে ফুটিয়ে তোলা। কপট রাজ্যের এই সব বাজনার অবস্থা খুবই টাইট। বহুদিন না ব্যবহারে দামামা ফ্যাঁসফ্যাঁস করছে। শঙ্খ বাজালে মনে হচ্ছে, কেউ কাঁদছে, শিঙা থেকে ভাঙা বাঁশির আওয়াজ বেরোচ্ছে।

ভজকাঠি তার রিপোর্টের শেষে লিখছে—

‘এই অবস্থায় যুদ্ধ হবে কী করিয়া তাহা রাজামশাই স্থির করিবেন।’

আর রাজামশাই স্থির করিবেন! ভজকাঠির রিপোর্ট শেষ হবার মুখে রাজা জ্ঞান হারালেন। হারানোরই কথা। নিজের সৈন্যবাহিনীর এই হাল হলে যে-কোনও রাজাই মূর্ছা যেত।

সভাসদরা নিজ নিজ আসন ছেড়ে ছুটে গেল। রাজবৈদ্য ছুটে এলেন। সঙ্গে বত্রিশজন সেবক-সেবিকা। গোলাপ জল মুখে ছিটিয়ে রাজার জ্ঞান ফেরানো হল অতি কষ্টে। রাজামশাই চোখ খুললেন।

‘যুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেছে? আমরা কি পরাজিত হয়ে গেলাম?’

ভজকাঠি ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। রাজার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে হাসি মুখে বলল, ‘রাজামশাই, আপনাকে রিপোর্টের শেষটুকুই তো বলা হয়নি। তার আগেই মুচ্ছে গেলেন। আপনি না বলা সত্ত্বেও আমি ওদিকের খবর এনেছি।’

রাজামশাই শুয়ে শুয়েই চোখ বড়বড় করলেন। বললেন, ‘ওদিকের খবর!’

ভজকাঠি একগাল হেসে বলল, ‘উত্তরের পাহাড় টপকে শত্রুপক্ষের সেনারা যুদ্ধ করতে আসেনি রাজামশাই। এসেছে পিকনিক করতে। যুদ্ধ-টুদ্ধ হয় না বলে ওদেরও ছুটি কিনা।’

রাজামশাই আবার মূর্ছা গেলেন। তবে ভয়ে নয়, খুশিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *