রাজামশাইয়ের ছড়া

রাজামশাইয়ের ছড়া

রাজামশাইয়ের মন খারাপ।

তিনি রাজসভায় মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে, তাকে গরমের ছুটিতে গাদা খানেক হোমটাস্ক দেওয়া হয়েছে। একশো পাঁচটা অঙ্ক। একশোটা এমনি আর পাঁচটা ফাউ। হোমটাস্ক নিয়ে রাজামশাই নাজেহাল। ছুটি ফুরিয়ে এসেছে, এদিকে অঙ্ক শেষ হচ্ছে না! ফুটবল খেলা, গাছে চড়া, পুকুরে সাঁতার লাঠে উঠেছে। সকাল সন্ধেতে তো বটেই, এমনকী ফুরফুরে বিকেলেও রাজপ্রাসাদের ঘরে বন্দি থাকতে হয়। শ্বেতপাথরের টেবিল চেয়ারে বসে, সোনার দোয়াত কলম নিয়ে রাজামশাই পাটিগণিত করেন। রাজা বলে কথা, তিনি তো আর হাবিজাবি কলমে হোমটাস্ক করতে পারেন না, তাই সোনার কলম। তবে পাটিগণিতের ঝামেলা হল, একবার জট পাকিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি। সোনার কলমেও কোনও ছাড় নেই। তখন হাবিজাবি কলম, সোনার কলম সব সমান। কোনওটাতেই উত্তর মিলতে চায় না। রাজামশাই কি সেরকম কোনও ঝামেলায় পড়েছেন? সেই কারণে তার মেজাজ খারাপ?

তা কী করে হবে? রাজামশাই তো ক্লাস সিক্সের বিল্টু বা ক্লাস সেভেনের অর্ক নন। তার বয়স বিয়াল্লিশ। তিনি একটা মস্ত রাজ্যের রাজা। এই বয়েসে তাকে কে হোমটাস্ক দেবে? তাহলে ঘটনা কী? রাজামশাইয়ের মুখ কেন গোমড়া? জানতে হবে। কিন্তু জানা যাবে কী করে?

রাজসভায় নিয়ম হল, রাজামশাইয়ের মেজাজ যেমন হবে বাকিদের মেজাজও তেমন হবে। নইলে রাজামশাইকে অসম্মান করা হয়। সকলেই এই নিয়ম মেনে চলে। রাজামশাই যখন হাসিখুশি তখন সকলে হাসিখুশি, যখন গোমড়া তখন সবাই গোমড়া। আবার রাজামশাই যখন চনমনে হয়ে থাকেন, সবাই চনমনে হয়ে যাবে। তিনি যদি ঝিম মেরে যান, সবাইকে ঝিম মেরে থাকতে হয়।

রাজপ্রাসাদের ভিতরে রাজদরবার। এলাহি ব্যাপার। সবটা শ্বেতপাথরে মোড়া। দেয়ালে মিনার কারুকার্য। মাথার ওপর ইয়া বড় ঝাড়লণ্ঠন। সেই ঝাড়লণ্ঠন এতই সুন্দর যে না জ্বললেও ঝলমলে লাগে। একদিকে রাজার সিংহাসন, সিংহাসনের দু-পাশে বাকিদের বসবার জায়গায়। রাজসভায় সকলকেই থাকতে হয়। মহামন্ত্রী, মেজোমন্ত্রী, সেজোমন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল, রাজকোষের হিসেব রক্ষক, গনৎকার, রাজপুরোহিত, রাজকবি, লেঠেল সর্দার, রাজপণ্ডিত, রাজপ্রাসাদের হেডমালি, রাজমাহুত, বরকন্দাজ, সিপাই, রাজপেয়াদা। সবাই সকালবেলা থেকেই খোঁজ নিতে শুরু করে। রাজামশাইয়ের আজ মেজাজ কেমন? এই কাজ খুবই কঠিন। রাজার মেজাজের খবর পাওয়া মোটেই সহজ নয়। সকালবেলা রাজা থাকেন অন্দরমহলে। সেখানে তার বাড়ির লোক ছাড়া হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। যারা ঘরদোর ঝাড়পোঁচ করে, বেড টি, ব্রেকফাস্ট নিয়ে যায়, যে মালিকন্যা ঘরে ঘরে ফুল সাজায় এরকম কয়েকজন খুব ভোরে ঢুকতে পারে। আর পারে মহারাজের যোগ ব্যায়ামের ট্রেনার, মহারানির বাজার সরকার। বাজার সরকারের হাতে মহারানি বাজারের লিস্ট দেন। সেই লিস্ট দেখে রাজপ্রাসাদের বাজার হয়। বিয়াল্লিশ রকম অনাজপাতি, বাইশ রকম মাছ মাংস। এ ছাড়াও সকালে অন্দরমহলে যান রাজকুমারীর গানের মাস্টারমশাই। আট বছরের রাজকুমারী এখন ভজন শিখছে। রাজকুমারের প্রাইভেট টিউটরও সাড়ে ছ’টার মধ্যে পৌছে যান। তিনি যোগনাথ পণ্ডিত। বগলে পুঁথি, মাথায় টিকি। শাস্ত্র, ব্যাকারণ আর অঙ্ক শেখাতে আসেন। খুবই রাগি মানুষ। কথায় কথায় ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেন। কিন্তু এখানে রাগ দেখাতে পারেন না। রাজপুত্রকে রাগ দেখানো যায় না। ছাত্র হলেও নয়।

রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে এর বেশি কারও অ্যালাও নেই।

সকলেই ছোঁক ছোঁক করে এদের কারও কাছ থেকে যদি রাজার মনমেজাজের খবর সংগ্রহ করা যায়। এতে বহু সময়ে বিরাট গোলযোগ বাঁধে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

একদিন সকালে রাজামশাইয়ের মেজাজ ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছিল। এই ভালো তো, এই খারাপ। এই খুশি তো, এই রাগ। এই গম্ভীর তো, এই হাসি। এই বিরক্ত তো, এই ফুরফুরে।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেছে মেয়ের গান শুনে। রাজকন্যা মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শিখছে। রিনরিন করে তানপুরা বাজছে। মেয়ে ভারি মিষ্টি গলায় গাইছে। ঠুমকো চল তো রামচন্দ। আহা! ভোরের সিগ্ধ আলো বাতাসে মেয়ের মিষ্টি গলা শুনে মন ভরে গেল রাজামশাইয়ের। খুব খুশি হলেন। তিনি চোখ-মুখ ধুয়ে আগে মিউজিকরুমে গেলেন। রাজপ্রাসাদের ভাষায় সঙ্গীতকক্ষ। ঘরটি বড় চমৎকার। মেঝেতে বিরাট জাজিম পাতা। দুনিয়ার সবরকমের বাদ্যযন্ত্র ছড়ানো। পুব আর পশ্চিমে বড় বড় অলিন্দ। যাতে ভোরের সূর্যোদয়, আর সূর্যাস্তের আলো ঢুকতে পারে। রাজকন্যার গানের মাস্টারমশাইয়ের বয়স কম, কিন্তু রাজামশাই তাকে খুবই সম্মান করেন। ঘরে ঢুকে জোড় হাতে প্রণাম করলেন।

‘গুরুজি আপনি আমার মেয়েকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন তাতে আমিও খুবই প্রীত। তার গান শুনে আজ আমার ঘুম ভাঙল। মনে হল, কোনও উদ্যানে বসে আছি। পাখি ডাকছে।’

মাস্টারমশাইও প্রণাম জানিয়ে বললেন, ‘মহারাজ এর কৃতিত্ব আপনার কন্যার। সে কিন্নর কণ্ঠী। আমি তাকে গানের কথা শেখাই, সুর শেখাই, তালের শিক্ষা দিই, কণ্ঠ তার নিজের। রাজকন্যাকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতে পেরে আমি ধন্য।’

রাজামশাই সঙ্গীত গুরুর কথা শুনে আরও খুশি হলেন। বললেন, ‘ঝিনুকের ভিতর মুক্তো থাকে। তাকে চিনে, বাইরে নিয়ে এসে, ঝকমকে করে তোলার কাজ জুহুরির। আপনি সে কাজ করেন। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মিউজিকরুম থেকে বেরিয়ে প্রসন্ন মনে রাজামশাই নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন। আর তখনই সিঁড়ির কোণে জমে থাকা খানিকটা ধুলোময়লা চোখে পড়ল। ব্যস। রাজামশাইয়ের মেজাজ গেল বিগড়ে। রাজপ্রাসাদের সিঁড়িতে ঝাঁট পড়েনি! কী ভয়ংকর! কী স্পর্ধা। কী অপদার্থ! হুংকার দিলেন রাজামশাই। ঝাঁড়পোঁচের লোকজন কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির হল।

‘মহারাজ আপনি যে এই সাতসকালে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠবেন, বুঝতে পারেনি। মাপ করে দিন মহারাজ।’

রাজা গেলেন আরও রেগে।

‘আমি না উঠলে সিঁড়ি সাফ করা হবে না? এই নিয়ম কে তৈরি করল?’

ঝাঁড়পোচ টিমের হেড বলল, ‘মাপ করবেন রাজামশাই। অন্যায় হয়ে গেছে। আর কোনওদিন এ ভুল হবে না।’

রাজা আবার ধমক দিলেন, ‘অন্যায় হয়ে গেছে বললেই ছাড় পাবে ভেবেছ? সাতসকালে আমার মেজাজ নষ্ট করেছ, এর জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে।’

রাজা থমথখে মুখে ঘরে এলেন। ঘরের একপাশে শ্বেতপাথরের গোল টেবিলে মালিকন্যা একটা বড় মাটির পাত্রে অনেকগুলো পদ্মফুল সাজিয়ে গেছে। তাদের গোলাপি আর নীল আভায় ঘর আলো হয়ে আছে। রাজামশাই থমকে দাঁড়ালেন। ভারি চমৎকার! মনটা খুশিতে ভরে গেলে রাজামশাইয়ের। মনে হল, সকালবেলা ফুল দেখার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। তিনি ভাগ্যবান। মালিকন্যাকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনলেন রাজামশাই। তাকে এক জোড়া মুক্তোর দুল উপহার দিলেন। সেই মুক্তোতেও পদ্মের গোলাপি আভা।

‘কন্যা, তুমি আমাকে পদ্ম দিয়ে খুশি করেছ। আমার তো সে ক্ষমতা নেই। আমি তোমাকে সামান্য এই উপহারটুকু দিলাম। তোমার ফুল দেখা, তাকে যত্ন করে সাজানোর বিদ্যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমাকে আর্শীবাদ করি তুমিও ফুলের মতো সুন্দর হও মা।’

মালিকন্যার তো পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রাজামশাইকে বড় করে পেন্নাম ঠুকে সে সবাইকে মুক্তোর দুল দেখাতে পড়িমড়ি করে ছুটল। তার আনন্দ দেখে রাজামশাই হেসে ফেললেন। সেই হাসি মুছতে না মুছতে দ্বাররক্ষী এসে খবর দিল, পণ্ডিত যোগনাথ জরুরি কারণে দেখা করতে চান। রাজামশাই ভুরু কোঁচকালেন। সকালে তিনি এভাবে কারও সঙ্গে চট করে দেখা করেন না। কিন্তু প্রাইভেট টিউটর বলে কথা। তিনি তাকে আসতে অনুমতি দিলেন।

‘প্রণাম পণ্ডিতমশাই। কী বার্তা?’

পণ্ডিতমশাই করজোরে বললেন, ‘প্রণাম রাজাধিরাজ। বার্তা ভালো নয়।’

রাজা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন? বার্তা ভালো নয় কেন?’

পণ্ডিতমশাই টাক মাথা চুলকে বললেন, ‘বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনাকে সতর্ক করার প্রয়োজন। রাজপুত্র পড়াশোনায় মোটে মনোনিবেশ করছে না। সে পরীক্ষায় ফল খুবই খারাপ করেছে।’

রাজা সোজা হয়ে বসলেন। পুত্র যদি লেখাপড়া না শেখে তাহলে ভবিষ্যতে দেশ শাসন করবে কী করে? তার মাথায় রক্ত চড়তে লাগল। তিনি থমথমে গলায় বললেন, ‘পণ্ডিতমশাই, আপনি তাকে বোঝাচ্ছেন না?’

পণ্ডিতমশাই মাথা চুলকে বললেন, ‘চেষ্টা করছি, কিন্তু শুনছে না।’

রাজা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘শুনছে না! কত বড় আস্পর্ধা। পণ্ডিতমশাইয়ের কথা শুনছে না? তাকে আপনি শাসন করুন।’

‘রাজপুত্রকে কি শাসন করা যায় রাজামশাই? নাকি উচিত?’

ক্রুদ্ধ রাজা পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘অবশ্যই উচিত। আপনি কি চান, দেশের ভবিষ্যত রাজা একটা গণ্ডমূর্খ হোক? আমার মৃত্যুর পর তো এই ছেলেকেই সিংহাসনে বসতে হবে। সেই রাজা কি একটা গাধা হবে? তাহলে দেশের মানুষের মঙ্গল হবে?’

পণ্ডিতমশাই মিনমিন করে বললেন, ‘সবই বুঝতে পারছি রাজামশাই। তবু…।’

রাজা উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘কোনও তবু নেই। আপনি কড়া হাতে শাসন করুন। আমি অনুমতি দিচ্ছি। ছেলে পড়ায় মন না দিলে আপনি সাজা দিন।’

যোগনাথ পণ্ডিত মাথা কাত করে চলে গেলেন। রাজামশাইয়ের মেজাজটাই গেল বিগড়ে। তিনি দুধ কনফ্লেক্স, পাউরুটি, ডবল ডিমের পোচ নিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে লাগলেন। চোখ-মুখ কুঁচকে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাকে আজ ব্রেকফাস্টে শুধু নিমপাতার শরবত খেতে দেওয়া হয়েছে। মহারানি ঘরে এলেন। রাজামশাইয়ের সামনে বসলেন। বললেন, ‘একটা সুসংবাদ আছে।’

রাজামশাই রাগ রাগ গলায় বললেন, ‘কী সুসংবাদ? আমার রাজ্য আয়তনে বড় হয়েছে? শত্রুরা ফিনিশ? নাকি খাজনা বেশি জমা পড়েছে?’

মহারানি মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘তার থেকে বড় সুসংবাদ।’

রাজামশাই মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘আমি রেগে আছি। আমার এখন ছোট, বড়, মেজো কোনও সুসংবাদ ভালো লাগবে না। তুমি বিরক্ত কোরো না।’

মহারানি হাসিমুখে বললেন, ‘অবশ্যই লাগবে। একবার শুনে দ্যাখো না।’

রাজামশাই নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, ‘কী সংবাদ? তাড়াতাড়ি বলে আমাকে নিস্তার দাও। আমি এখন রেগে আছি।’

মহারানি খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘আজ তোমার ফেভারিট জিনিস রান্না হবে। সরকারবাবু বাজার থেকে টাটকা পুঁইশাক আর ইলিশ মাছের মুড়ো নিয়ে এসেছেন। আজ ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে আমি নিজের হাতে তোমার জন্য পুঁইশাকের ঘণ্ট বানাব। বাজার-সরকারবাবুকে বললাম, যাই এই সুসংবাদটা আপনার রাজামশাইকে দিয়ে আসি।’

নিমেষে রাগ, বিরক্তি ভুলে গেলেন রাজামশাই। ইলিশ মাছের মুড়ো দিয়ে পুঁইশাক রাজামশাইয়ের প্রিয় খাবারের একটা। তার ওপর যদি মহারানি নিজের হাতে রান্না করেন তাহলে তো কথাই নেই। রাজামশাইয়ের চোখ চকচক করে উঠল। তিনি হেসে বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! ঘণ্টতে, একটু কুমড়ো দিও। আহা! এখনই আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে।’

এর পরে ঘটনাটাই গোলমেলে।

রাজামশাইয়ের আজকের মেজাজ কেমন জানবার জন্য মহামন্ত্রী পাকড়াও করেছিলেন রাজকন্যার গানের মাস্টারমশাইকে। তিনি গদগদ ভাবে বললেন, ‘গত একবছরে রাজামশাইকে এমন খুশি দেখিনি। কন্যার গান শুনে তিনি আপ্লুত। রাজকুমারীর গানের তালিম শুনতে তিনি নিজে সঙ্গীতকক্ষে চলে এসেছিলেন। আগে কখনও এমন হয়নি।’

মহামন্ত্রী নিশ্চিন্ত হলেন। যাক বাবা, আজ তাহলে আর চিন্তা নেই। হাসি মুখে রাজদরবারে হাজির হওয়া যাবে।

সেনাপতি ধরেছিলেন রাজপ্রসাদের এক ঝাড়পোঁচ কর্মীকে। একপাশে ডেকে গলা নামিয়ে বললেন, ‘কী হে, আজ ভিতরের খবর কী?’

‘কোন খবর?’

সেনাপতি দাঁত কিড়মিড় করে, ‘কোন খবর আবার? রোজ যে খবর জানবার জন্য আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। রাজামশাইয়ের মেজাজের খবর কী?’

‘খুবই খারাপ। আমাদের মনে হয়, শূলে চড়াবেন। রাজপ্রসাদের সিঁড়িতে ধুলো দেখে মাথায় আগুন জ্বেলে বসে আছেন।’

সেনাপতি আঁতকে উঠলেন। এই রে! তাহলে আজ রাজদরবারে একটা কেলেঙ্কারি হবে।

রাজপেয়াদার সঙ্গে রাজমালির দেখা হয়েছিল বাজারে। রাজপেয়াদা তখন বেছেবেছে ঝিঙে কিনছিল। রাজমালি রাজপেয়াদাকে পিছন থেকে জাপটে ধরল। রাজপেয়াদা দিল এক ধমক।

‘অ্যাই হয়েছে কী! এত আদিখ্যেতা কীসের?’

রাজমালি একগাল হেসে বলল, ‘আজ দারুণ দিন! দারুণ খুশির দিন! আজ যাকেই দেখছি, খুশিতে জড়িয়ে ধরছি। বলা যায় না, রাজামশাইকেও জড়িয়ে ধরতে পারি। তাতে গর্দান যায় যাবে।’

রাজপেয়াদা মাথায় পাগড়ি ঠিক করে, গোঁফে তা দিয়ে বলল, ‘হুমম, বলি হলটা কী?’

রাজমালি বলল, ‘রাজামশাই আজ বেজায় খুশি। অন্দরমহলে ফুলসজ্জা দেখে আমার মেয়েকে দুল দিয়ে বসেছে।’ কথা শেষ করে একপাক নেচে নিল মালি।

রাজপেয়াদা বুঝল আজ রাজদরবারে খুশির বান ডাকবে।

রাজদরবারের হিসেবরক্ষক সবসময়েই ভয় ভয় থাকে। রাজামশাই কখন যে হিসেবপত্র চেয়ে বসেন তার ঠিক নেই। প্রতিদিনই চিন্তিত মুখে রাজদরবারে যান। যাওয়ার আগে রাজার মেজাজ সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। সবদিন যে পারেন এমন নয়। মাঝে মাঝে পারেন। সেদিন পেরেছিলেন। রাজদরবারে যাবার পথে পাঠশালার সামনে দেখা হল পণ্ডিত যোগনাথের সঙ্গে। যোগনাথ হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।

‘আজ সাবধানে থেকো ভায়া।’

হিসেবরক্ষকের বুক ধড়ফড় করে উঠল। হাঁটু কাপতে থাকল।

‘কেন? কী হয়েছে পণ্ডিতমশাই?’

পণ্ডিতমশাই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘রাজামশাইকে রাজপুত্রের নামে নালিশ করেছি। বাধ্য হয়েই করেছি। ছেলেটা মোটেই লেড়াপড়া শিখতে চায় না। রাজামশাই খেপে আগুন হয়ে আছেন।’

হিসেবরক্ষকের মনে হল, আজই তার শেষদিন। রাজামশাই আজ ঠিক তার হিসেবের গোলমাল ধরবেন। রেগেমেগে তাকে গারদে পুরবেন। নো ক্ষমা, নো মাপ। রাজরাজরাদের ক্ষমা নির্ভর করে তাদের মেজাজের ওপর। মেজাজ যত খারাপ, সাজা তত কঠিন। হিসেবরক্ষক মুখ চুন করে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটা দিলেন। খানিকটা যাওয়ার পরই দেখলেন, কোটালমশাইও চলছেন। চলেছেন হাসতে হাসতে। লাফাতে লাফাতে। হিসেবরক্ষক অবাক হলেন। কী ব্যাপার! কোটালের মুখে হাসি কেন? ও কি রাজার খবর কিছু পায়নি? আজ হাসিমুখে রাজদরবারে গেলে বেচারিকে তো বিপদে পড়তে হবে। পড়ুক। কোটাল বিপদে পড়লে তার কী? বেটা মহাপাজি। মাঝে মাঝেই টাকাপয়সা চেয়ে ঝামেলা করে।

ঘটনা তা নয়। কোটালমশাই রাজার মনের খবর নিয়েই রাজদরবারে চলেছেন। খানিক আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছে রাজপ্রাসাদের বাজার সরকারের। সে জানিয়েছে, ‘আজ রাজামশাই নাকি গত একমাসের মধ্যে সব থেকে খুশি। বাজারে তাজা পুঁইশাক আর ইলিশমাছ পাওয়া গেছে। রানিমা নিজে ইলিশমাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের ঘণ্ট রান্না করবেন। রাজপ্রসাদের লাঞ্চ আজ রাজামশাইয়ের প্রিয় খাবার। বলা যায় না, খুশির চোটে আজ হয়তো সবাইকে দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন করে ফেলতে পারেন।’

এর পরেও পেটুক কোটালমশাই হাসিহাসি মুখে থাকবেন না?

রাজদরবারে সেদিনে হল মহা গোলযোগ। একেকজন রাজার মনমেজাজের একেকরকম খবর পেয়েছে। তাই কারও মুখ থমথমে, কারও মুখ রাগি, কারও মুখ বেতের মতো চকচকে।

এতরকম মুখ দেখে রাজামশাই খুবই বিরক্ত হলেন। সেদিন রাজদরবার তাড়াতাড়ি মুলতুবি করে দিয়ে উঠে পড়লেন।

কিন্তু আজ? আজ কী হল? রাজার মুখ গোমড়া কেন?

মহামন্ত্রী, মেজো মন্ত্রী, কোটালমশাই, রাজপেয়াদা, রাজপণ্ডিত, হিসেবরক্ষক, রাজমহুত সবাই এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের কাছে খবর তো অন্যরকম রয়েছে! আজ তো রাজামশাইয়ের মনমেজাজ খুশি থাকবার কথা। সকলেই নিজের নিজের লোক মারফত খবর পেয়েছে, ক’দিন হল রাজামশাইকে ছড়া লেখার নেশায় পেয়েছে। তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাগজকলম নিয়ে লিখতে বসছেন। পাক্কা একঘণ্টা ছড়া লিখে তারপর অশি চালনার মহড়া, তির ছোঁড়বার মহড়া, ঘোড়ার চড়বার মহড়া, সন্তরণ, যোগব্যায়াম, স্নান ইত্যাদি। ভোরে ছড়া লেখবার কারণে গত কয়েকদিন রাজামশাইয়ের মনমেজাজ বেশ ভালো আছে। তাহলে? আজ হঠাৎ হল কী? কী ঘটেছে?

ঘটেছে অন্য কাণ্ড। আজ সকালে খুব সুন্দর ছড়া লিখে রাজামশাইয়ের মন খারাপ হয়ে গেছে। তাই মুখ গোমড়া। সুন্দর ছড়া লিখেও যে মন খারাপ হয় এই ‘উদ্ভট কথা’ কে বুঝবে? মহামন্ত্রী, রাজপেয়াদা, হিসেবরক্ষক কেউ বুঝবে না। দেখি তোমরা বোঝো কিনা। আমার বিশ্বাস, তোমরা পারবে। ছড়াটা নীচে লিখে দিলাম।

মনটা বড্ড ছটফটে আজ মনটা বড় অশান্ত

মনের এমন কাণ্ড ঘটবে সেই কথাটা কে জানত?

ইচ্ছে করে ছুঁড়ে ফেলে সব, পালাই ছুটে বনান্ত,

নদীর ধারে চিৎ হয়ে শুই, আকাশ দেখি অনন্ত

আমায় ছুটি কে দেবে ভাই, আমার ছুটি বারন তো।

কী ছড়াটা মন খারাপ করে দেয় না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *