রাজাবাহাদুরের রঙ্গমঞ্চ – ফণীন্দ্রনাথ পাল
১
কলিকাতার ক্রোশ দশেক দক্ষিণে আমার শ্বশুরবাড়ি। গ্রামটি বড় এবং প্রাচীন। এককালে খুবই বর্ধিষ্ণু ছিল। তাহার প্রমাণস্বরূপ বহু বড় বড় অট্টালিকা গ্রামের বুকের উপর আজও জাজ্বল্যমান রহিয়াছে। তাহার অধিকাংশই বহুদিন ধরিয়া পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল, সম্প্রতি কতকগুলি বাড়িতে আবার আলো জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কলিকাতা-উন্নতিকামী মহারথীদের তাড়া খাইয়া বোধ করি অনেকেই গ্রামের পরিত্যক্ত বাসভবনে আসিয়া আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছে এবং অত্যন্ত অনিচ্ছা সহকারে নিরুপায় হইয়াই সেখানে পাকাপাকি ভাবেই থাকিবার ব্যবস্থায় আত্মনিয়োগ করিয়াছে। তাহা ছাড়া গ্রামটি একটি নদীর উপর। ছোট নদী। বর্ষায় ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিলেও চৈত্র-বৈশাখে শীর্ণ হইয়া যায়; স্থানে স্থানে লোক হাঁটিয়াও পার হয়, কিন্তু নৌকা চলাচলের পথ একেবারে রুদ্ধ হইয়া যায় না, তাই ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা বুঝিয়া অনেক নূতন লোকও গ্রামে বসবাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ফলে পূর্বশ্রী ফিরিয়া না পাইলেও কতকটা শ্ৰী তাহার ফিরিয়া গিয়াছে।
আমার শ্বশুর মহাশয়ের বাড়িটি দীর্ঘ বিশ বৎসর এমনই পরিত্যক্ত। তিনি সুদূর রাওলপিণ্ডি অঞ্চলে চাকুরি করিতেন—পাঁচ বৎসর অন্তর দিন দুই তিনের জন্য বাড়িতে আসিয়া বাস করিয়া যাইতেন। প্রতি সন্ধ্যায় যাহাতে ভিটায় বাতি পড়ে, সেই জন্য এক দরিদ্র প্রতিবেশীকে তিনি একতলায় দুইটি ঘরে থাকিতে দিয়াছিলেন এবং বাড়ি মেরামতের জন্য তাহাকে মাসে মাসে কিছু পাঠাইয়াও দিতেন। কিন্তু বাড়ি আসিয়া লোকের মুখে শুনিতেন, প্রতিদিন দূরের কথা প্রতি সপ্তাহে দুইটি ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘরে বড় আলো পড়ে না, এবং মেরামতের জন্য প্রেরিত টাকার পনেরো আনা তিন পয়সা প্রতিবেশীটি নিজ তহবিল-ভুক্ত করেন এবং বাড়িটিকে বাকি এক পয়সায় কোন রকমে খাড়া করিয়া রাখেন। তবুও বলিবার উপায় নাই। থাক সে কথা।
পঁচিশ বৎসর চাকুরি পূর্ণ হইতেই শ্বশুর মহাশয় পেনসন লইয়া কলিকাতায় আসিলেন। মাস দুই সেখানে থাকিয়া গ্রামের বাড়িটিকে নিজের তত্ত্বাবধানে মেরামত করিয়া দীর্ঘকাল পরে সেই পরিত্যক্ত পল্লীভবনে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। পূজার ছুটিটা সেখানে অতিবাহিত করিবার জন্য আমি নিমন্ত্রিত হইলাম। সে গ্রামে ইতিপূর্বে আমি কোনদিন যাই নাই। গ্রামটি দেখিয়া আমার ভারি আনন্দ হইল।
এখানে আসিবার দিন প্রত্যূষে নিচে একটা গোলমালের শব্দ আমার কানে যাইতেই আমার ঘুমটা হঠাৎ ভাঙিয়া গেল। আমার স্ত্রী মনোরমা ইতিপূর্বেই শয্যা ত্যাগ করিয়া গিয়াছে। একবার শুন্য শয্যার দিকে চাহিয়া ব্যাপার কি জানিবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি নিচে নামিয়া দেখিলাম সেই প্রতিবেশীটি ও অবনীর মধ্যে খুব চিৎকার করিয়া বচসা চলিতেছে।
অবনী আমার জ্যেষ্ঠ শ্যালক, সে আর আমি প্রায় সমবয়সী। আমরা দুইজনই এম-এ পড়ি।
আমার দিকে চাহিয়া অবনী কহিল, ‘পাড়াগেঁয়ে লোকের আক্কেলটা একবার দেখ। ওঠবার নামটি নেই, চিরটা কাল বাড়িটি তো উনিইভোগকরে আসছেন—’
মধ্যপথে বাধা দিয়া প্রতিবেশী শ্লেষের সহিত বলিয়া উঠিল, ‘দু পাতা ইংরিজী পড়ে ভারি লম্বা লম্বা কথা হয়েছে—বুঝগে গিয়ে তোর বাপের সঙ্গে—সে জানে, আমায় খোসামোদ করে না রাখলে এ বাড়ির একখানা ইটও থাকত না। এখন কাজ ফুরিয়েছে কিনা, তাই আমি পাজি। যাব তোদের এ আস্তাকুঁড় থেকে আজই উঠে যাব। তবে বলে রাখছি কেমন করে এ বাড়ি তোরা ভোগ করিস তাও দেখব! এখন তাড়াচ্ছিস, পরে আবার এখানে এনে রাখবার জন্যে গুষ্টিবর্গকে নিয়ে আমার পায়ে ধরতে হবে। ওপর তলায় এই যে আরামে ঘুমোচ্ছিস, এটা কার দয়ায়? এই শর্মার! ব্ৰহ্মদত্যিটাকে আগলে আছি কিনা তাই কিছু বলে না, আজি তো আমি যাচ্ছি, গেলেই টের পাবি! এ গ্রামের মধ্যে গুণী আর কে আছে যে সেই ব্ৰহ্মদত্যিকে ঠেকিয়ে রাখবে। না হলে তোর বাবা এমনই দাতাকর্ণ কিনা যে শুধু শুধু আমায় দুটো ঘর ছেড়ে দিয়েছিল। কি দুর্দশা হয় তোদের তাও আমি দেখব, যাচ্ছি তো !’
হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া অবনী কহিল, ‘ফন্দিটা মন্দ বের কর নি! কিন্তু ব্ৰহ্মদৈত্য তাড়াবার মন্ত্র তোমার চেয়ে আমরাও বড় কম জানি না। এখন তুমি দয়া করে ঘাড় থেকে নামলে যে আমরা রেহাই পাই। উঠছি উঠছি করে দু মাস কাটিয়ে দিলে, ওঠার নাম পর্যন্ত নেই! এখন ভালয় ভালয় উঠবে, না অন্য ব্যবস্থা করতে হবে?’
প্রতিবেশী চিৎকার করিয়া কহিল, ‘তুই কি বাড়ির গুমোর দেখাচ্ছিস—দুখানা ভাঙা ইটের তো বাড়ি; জানিস আমি ইচ্ছে করলে এমন বাড়িতে থাকতে পারি, তোদের সমস্ত বাড়িখানা এক করলেও তার একটি ঘরের সমান হয় না! রাজবাহাদুর কত সাধ্য সাধনা করেন, তোর বাবার জন্যেই থাকিনি—বেচারা ধরে পড়ল। এই তো যাচ্ছি, গিয়ে দেখে আসিস্ একবার বাড়িটা, চোখ ঠিকরে যাবে। আমিও এসে দেখে যাব ব্রহ্মদৈত্য—’
অবনী কি বলিতে যাইতেছিল, আমার শাশুড়ী ঠাকরুণ দরজার আড়াল হইতে তাহাকে ডাকিলেন। অবনী তৎক্ষণাৎ কলহ বন্ধ করিয়া তাঁহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইয়া কহিল, ‘কেন ডাকছ মা—যেমন করে হোক ওকে আজ তাড়াবই।’
জননী কহিলেন, ‘ঝগড়া-ঝাটি কর না বাবা, উনি আসুন, এসে যা ভাল হয় করবেন।’
অবনী হাসিয়া কহিল, ‘ব্রহ্মদৈত্যের ভয় পেলে নাকি মা? ওর চালাকি আর বুঝতে পারলে না। এমনি তো আর থাকা চলে না, তাই মনে করেছে এই রকম ভয় দেখালে আর কেউ তাকে কিছু বলবে না, সে বেশ কায়েমী হয়ে বাড়ি দখল করে থাকবে।’
জননী কহিলেন, ‘না বাবা, ভয় পাওয়ার কথা হচ্ছে না। আমাদের এখানে বাড়ি হলেও আমরা এখন নতুন লোক হয়ে পড়েছি—কাজ কি পাড়াপড়শীর সঙ্গে ঝগড়া করে। উনি বেড়িয়ে ফিরে এসে যা হোক ব্যবস্থা করবেন।’
অবনী হাসিয়া উত্তর দিল, ‘বেশ, তাই হবে মা।’
আমরা দুইজনে উপরে চলিয়া গেলাম। আমি কহিলাম, ‘হ্যাঁ, লোকটা ধূর্ত বটে। মার মনে ভয় জাগিয়ে তুলেছে। না, ওকে আর তাড়াতে পাচ্ছ না।’
অবনী কহিল, ‘ওকে তাড়াতেই হবে। ওরকম লোকের সঙ্গে এক বাড়িতে কিছুতেই থাকা যেতে পারে না। আমরা যদি দু মাসের জন্যে বাড়িতে আসতুম, সে আলাদা কথা। তা ছাড়া কিরকম অসুবিধে হচ্ছে দেখছ তো!’
আমি হাসিয়া কহিলাম, ‘ওকে তাড়ালে ব্ৰহ্মদৈত্য ঘাড়ে চেপে বসবে যে!’
অবনী হাসিয়া কহিল, ‘তার ওষুধেরও ব্যবস্থা করা যাবে!’
শ্বশ্রু ঠাকুরাণী পরদিনই কিন্তু শাস্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করিলেন, তিনি বলিলেন, ‘ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করতে গেলে, সব জিনিস অমন হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
ইহারই দিন তিনেক পরে প্রতিবেশীটি তাহার নিজের বাড়িতেই উঠিয়া গেল, রাজাবাহাদুরের বাড়িতে নয়। তাহার জীর্ণ বাড়িটির মেরামতের খরচা অবশ্য সে জননীর নিকট হইতে আদায় করিয়া লইল। কিন্তু নিজের বাড়ি বসিয়া চিৎকার করিয়া ভয় দেখাইতেও ছাড়িল না।
প্রতিবেশীটি চলিয়া যাইবার পর দিন হইতে বাড়ির মেয়েরা বড় গোলযোগ আরম্ভ করিল। সন্ধ্যারাত্রিতে হঠাৎ কোন শব্দ হইলে মেয়েরা সব ছুটিয়া আসিয়া জননীর চারিধারে গিয়া জড়ো হইত এবং ভীতিব্যাকুল দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিত। তখনই সন্ধান লইয়া জানা হইত, একটা শৃগাল কিংবা গোসাপ পাঁচিলের পাশ দিয়া ছুটিয়া যাইতেছে। গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া পত্নী মনোরমা দুই কম্পিত বাহু দিয়া আমায় জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিত, ‘এই শোন, ছাদের ওপর পায়ের শব্দ!’ সঙ্গে সঙ্গে আমারও মনে হইত, সত্যই যেন কে ছাদের উপর পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছে। বুকের ভিতরটা হঠাৎ কি জানি কেন মুহূর্তের জন্যে ছাঁৎ করিয়া উঠিত, কিন্তু কান খাড়া করিয়া থাকিলে আর কিছু শুনিতে পাইতাম না। তখন স্পষ্ট বুঝিতে পারিতাম ইহা সহসা নিদ্রোথিত ব্যক্তির শ্রবণেন্দ্রিয়-বিকার মাত্র। এমনই ভাবে দিন চারেক চলিল। তারপর একদিন মনোরমার কম্পিত হস্তের ধাক্কায় সহসা জাগিয়া উঠিয়া বসিয়া ছাদের উপর মানুষের পায়ের শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম। মনোরমার সমস্ত দেহ তখন ঠক্ঠক্ করিয়া কাঁপিতেছিল, আমার দেহ না কাঁপিলেও আমি ভিতরে ভিতরে চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। কিন্তু মুহূর্তমধ্যে মনকে বশে আনিয়া মনোরমার হাত ধরিয়া কক্ষ হইতে বাহির হইলাম এবং জননীর নিকট তাহাকে বসাইয়া রাখিয়া ছাদের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হইলাম।
এমন সময় অবনী দ্বার খুলিয়া তাহার কক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া হাসিয়া কহিল, ‘কি হে, অত ছুটোছুটি করছ কেন? ছাদের ওপর পায়ের শব্দ শুনে বুঝি? তুমিও দেখছি মেয়েমানুষ হয়ে গেলে! কিন্তু ও ব্রহ্মদৈত্যের পায়ের শব্দ নয়, ও ভামের ছোটার শব্দ, দেখবে এস আমার সঙ্গে।’ আমরা দুইজনে ছাদে গিয়া উঠিলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেখিয়া কি একটা জানোয়ার সশব্দে ছুটিয়া পলাইয়া গেল। সেদিনকার মত মনোরমার ও অন্যান্য মেয়েদের ভয় ভাঙিল বটে, কিন্তু ব্রহ্মদৈত্যের অতর্কিত আবির্ভাবের ভীতি তাহাদের অন্তর হইতে কিছুতেই দূর করা গেল না।
এমনই ভাবে দিন চলিতে লাগিল। অবনী আর আমি দিনের বেলায় এবং রাত্রে নিত্য নূতন সাজে সজ্জিত হইয়া কণ্ঠস্বর নানারকম বিকৃত করিয়া ব্ৰহ্মদৈত্যের অভিনয় করিয়া তাহাদের ভয় দেখাইয়া পরম কৌতুক অনুভব করিতে লাগিলাম। তাহাদের বুঝাইয়া দিলাম, এই যে সমস্ত ভূতের গল্প শোন, তাহার কতক এই রকম সাজানো ভূতের অভিনয় আর কতক জীবজন্তুর, কতক বা গাছপালার নড়াচড়ার ব্যাপার! এমনই ভাবে তাহাদের মন হইতে একটু একটু করিয়া ভয়ও দূর হইয়া গেল।
২
সেদিন অবনী আর আমি বেড়াইতে বেড়াইতে গ্রামের অপর এক প্রান্তে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখন অপরাহ্ণ। সেখানে একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকা আমরা দেখিতে পাইলাম। তাহার প্রকাণ্ড জীর্ণ অবস্থা দেখিয়া মনে হইল বাড়িটি এককালে রাজভোগ্য প্রাসাদের মধ্যে পরিগণিত হইলেও অধুনা জনশূন্য, পরিত্যক্ত। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নাই, গভীর নিস্তব্ধতা যেন সমস্ত বাড়িখানিকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। কিন্তু মোড় ঘুরিয়া প্রকাণ্ড ফটকের সম্মুখে আসিতেই আমাদের সে ভুল ভাঙিয়া গেল। দেখিলাম ফটকে এক সশস্ত্র প্রহরী বন্দুক হস্তে পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছে! সে এত বৃদ্ধ যে কোমরটা তাহার বাঁকিয়া গিয়াছে। সাজ-পোশাকও তদধিক জীর্ণ, তবে এককালে যে বিশেষ জমকালো ছিল, শতছিন্ন পাগড়ি জামা ও পায়জামা সংযুক্ত জরির টুক্রাগুলো তাহা সপ্রমাণ করিয়া দিতেছে। আমাদের দেখিয়া প্রহরী বন্দুকটা শক্ত করিয়া ধরিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সিপাইজী এ বাড়ি কার? কেউ থাকে না কি এ বাড়িতে?’
প্রহরী বিস্মিত দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থাপিত করিয়া বেশ পরিষ্কার বাংলায় কহিল, ‘আপনারা কোন্ দেশের লোক বাবু যে রাজাবাহাদুরকে চেনেন না?’
রাজাবাহাদুর! আমরা একজন আর একজনের মুখের দিকে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিলাম। এমন প্রাসাদ, এমন প্রহরী, রাজাবাহাদুরটি কেমন তাহা জানিবার জন্য ভারি কৌতূহল হইল। প্রহরীকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ‘আমরা বিদেশী লোক, এখানে বেড়াতে এসেছি। এ কোন্ রাজাবাহাদুর তা তো আমরা জানি না। তুমি যদি মেহেরবানী করে তার পরিচয় দিয়ে দাও।’
সিপাইজী বোধ করি এইবার খুশি হইল, কহিল, ‘রাজা গোবর্ধন বাহাদুর।’
অবনীকে চুপি চুপি কহিলাম, ‘রাজাবাহাদুরের চেহারাটা একবার দেখে আসা যাক। কি্ বল হে?’
অবনী কহিল, ‘বেশ তো, চল না।’ তারপর একটু থামিয়া হাসিয়া আবার কহিল, ‘সেপাই সাহেবের হুকুম নাও।’
প্রহরীর দিকে চাহিয়া বলিলাম, ‘সিপাইজী আমাদের একবার রাজদর্শন করিয়ে দাও।’
‘কি!’ বলিয়া প্রহরী বন্দুকটিকে শক্ত করিয়া ধরিয়া কুব্জ দেহ কিঞ্চিৎ সোজা করিয়া কাঁধের উপর রাখিয়া তাহার কোটরগত চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থাপিত করিল।
তাহার রকম দেখিয়া আমার ভারি হাসি পাইল। কোনরকমে হাসি চাপিয়া কহিলাম, ‘রাগ করছ কেন সিপাইজী, রাজদর্শন করবার জন্য তোমার কুমই তো চেয়েছি।’
বুঝিলাম সিপাইজীর রাগ কতকটা শান্ত হইল। সে কহিল, ‘আপনাদের তো সাহস কম নয় যে আপনারা রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে চান! আর অমন কথা মুখে আনবেন না। এখনই চলে যান, এখানে আর আপনারা দাঁড়াবেন না, কেউ দেখলে, অনর্থ ঘটবে, পাহারা দেওয়া আমার কাজ, গল্প করা নয়।’ এই বলিয়াই প্রহরী অন্যদিকে মুখ করিয়া পায়চারি করিতে লাগিল।
অবনীকে কহিলাম, ‘রাজদর্শন-লাভের সৌভাগ্য যখন হল না, চল শুধু বাড়িটাই প্রদক্ষিণ করে দেখা যাক।’
অবনী কহিল, ‘তাই চল।’ পথ চলিতে চলিতে সে কহিল, ‘বাড়ি ফিরে বাবার কাছে রাজাবাহাদুরের পরিচয়টা একবার নিতে হবে। ভেতরে কিছু ব্যাপার আছে নিশ্চয়।’
আমি কহিলাম, ‘আমারও তাই মনে হয়।’
অল্প খানিকদূর যাইতে আর একটি বাড়ির উপর দৃষ্টি পড়িতেই হাসিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘ওহে, তোমাদের গ্রামে থিয়েটারও আছে দেখছি।’
অবনী কহিল, ‘আছে না, ছিল বল। দেখছ না বাড়ির অবস্থা, অনেক জায়গার বালিচুন তো খসেই পড়েছে, দুই একখানা ইটও খসতে আরম্ভ করছে।’
আমরা তখন রঙ্গমঞ্চের ঠিক সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। সত্যই বাড়িটির অবস্থা শোচনীয়। সুবৃহৎ ফটকটি মাকড়সার জালে আচ্ছন্ন, ভিতর হইতে লৌহ-শিকল দ্বারা দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। তবুও এককালে ইহা যে কারুকার্য-বিশিষ্ট সুদৃশ্য হর্ম্যের মধ্যে পরিগণিত ছিল, তাহার সমস্ত প্রমাণ এখনও বিলুপ্ত হইয়া যায় নাই। এখনও সে পূর্ব গৌরবের কিঞ্চিৎমাত্রও বজায় রাখিয়া মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
অবনী কহিল, ‘এ বাড়িও দেখছি রাজাবাহাদুরের ছাড়া আর কারু নয়।’
রঙ্গমঞ্চের পাশ দিয়া একটা রাস্তা ছিল। আমরা তখন সেই রাস্তা ধরিয়া চলিয়াছিলাম। রঙ্গমঞ্চের পিছনের ফটকে এক সশস্ত্র প্রহরীকে দেখিয়া হঠাৎ আমরা দাঁড়াইয়া পড়িলাম। চুপি চুপি অবনীকে কহিলাম, ‘ওহে, সিপাই যে,—সেই রকম ছেঁড়া পোশাক-পরা! তুমি ঠিকই ধরেছ এ রাজাবাহাদুরেরই কীর্তি। কিন্তু ব্যাপার কি বল দেখি—এখানে সিপাই পাহারা?’
অবনী কহিল, ‘দেখছি রহস্য যে ক্রমে জটিল হয়ে আসছে!’
আমি বলিলাম, ‘তা যা বলেছ।’
তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। পাখিরা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটাছুটি করিতেছে—দূরাগত শঙ্খধ্বনিও কানে আসিয়া বাজিতেছে। আমরা পিছনের ফটকের দিকে দুই এক পা অগ্রসর হইতেই দেখিলাম, সিপাইজী ক্ষিপ্রহস্তে তাহার তল্পিতল্পা বাঁধতেছে। আমি বলিলাম, ‘কি সিপাইজী, তোমার ছুটি হয়ে গেল নাকি?’
সিপাইজী বোধ করি এতক্ষণ আমাদের দেখিতে পায় নাই। আমার কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিয়া আমার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিল। ক্ষণকাল পরে ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘সন্ধে হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন না? এদিকে কি করতে এসেছেন, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, পালান পালান।’
আমরা পরস্পরের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাহিলাম।
বিস্ময়পূর্ণ কণ্ঠে প্রহরী আবার কহিল, ‘আপনারা তবু দাঁড়িয়ে রইলেন। পালান পালান, না হলে এখনই বিপদে পড়বেন। সন্ধে হলে এ পথে আর কেউ হাঁটে না।’
আমি বলিলাম, ‘সিপাইজী এ সব কি বলছ! এখানে কি বাঘের ভয় আছে নাকি?’
সিপাইজীর দুই ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। সে কহিল, ‘বাঘ নয়, বাঘের বাবা আছে। মনে করেছ তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছি! দেখতে পাচ্ছ না হাতে টোটা-ভরা বন্দুক রয়েছে—এর এক গুলিতে পাঁচটা বাঘ কাত হয়ে পড়ে, কিন্তু পাঁচশ গুলি মারলে ওঁর কিছু হয় না। রাম রাম!’ বলিতে বলিতে সে বন্দুক কাঁধের উপর ফেলিয়া দ্রুতপদে আমাদের অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছে।
অল্পক্ষণ নিঃশব্দে অতিবাহিত হইবার পর অবনী হাসিয়া কহিল, ‘এখানে তা হলে আর এক ব্রহ্মদৈত্য বাস করে দেখছি।’
আমিও হাসিয়া কহিলাম, ‘ব্ৰহ্মদৈত্য কি আর কোন দৈত্য তা তুমি জানলে কি করে? তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে, যা হোক কিছু একটা গুরুতর ব্যাপার আছে। এ ভাঙা বাড়িতে সিপাই-পাহারা, তা আবার সামনের ফটকে নয় পিছনের ফটকে!’
অবনী কহিল, ‘বোধ হয় কোন লুকোন বিদ্যাধরী আছে তাই এদিকে যাতে কেউ না আসে, সেইজন্যে এরকম ভয় দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজই গিয়ে সন্ধান নিতে হচ্ছে। চল, ফেরা যাক। পাড়াগাঁ, সাপখোপের ভয় তো আছে, সন্ধে হবে জানলে টর্চটা সঙ্গে করে আনতুম।’
আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ, তাই চল। কিন্তু তুমি রাত্রে সাপের নাম করলে?’
অবনীও হাসিয়া কহিল, ‘আমাকে কি মেয়েমানুষ পেলে না কি হে, এখন চল।’
উভয়ে চলিতে আরম্ভ করিলাম, তখন অন্ধকার সমস্ত গ্রামটিকে যেন গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। ভগ্নপ্রায় রঙ্গালয়টি অন্ধকারের গায়ে তখন একটা অস্পষ্ট ছায়ার মত দেখাইতেছিল। আমরা দ্রুতপদে রঙ্গালয়টি অতিক্রম করিয়া রাজবাড়ির সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। একবার বাড়ির দিকে চাহিলাম, কোথায় বাড়ি! একখণ্ড জমাট অন্ধকারের বুকের উপর মাত্র একটা ক্ষীণ আলোকরশ্মি দৃষ্টিপথে পতিত হইল। আমরা নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অল্প খানিকদূর যাইতেই লোকের বসতির ভিতর আসিয়া পৌঁছিলাম। কেমন যেন একটু স্বস্তি বোধ করিলাম।
৩
গৃহে পৌঁছাইয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া জলযোগ সারিয়া আমরা শ্বশুর মহাশয়ের নিকট গিয়া বসিলাম। একথা সেকথার পর অবনী রাজাবাহাদুরের কথা পাড়িল। উত্তরে শুনিলাম, রাজাবাহাদুর অতি অদ্ভুত প্রকৃতির লোক। এখন তিনি কপর্দকশূন্য, তবুও তিনি গ্রামের কোন লোকের সহিত কথা বলিতে ঘৃণা বোধ করেন। কেহ দেখা করিতে গেলে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেন। তিনি একাকী ওই প্রকাণ্ড বাড়ির মধ্যে বাস করেন। আপনার বলিতে তাঁহার আর কেহ নাই। বেশিদিনের কথা নয়, পঁচিশ বৎসর পূর্বেও তাঁহার প্রাসাদ লোকজনে পূর্ণ ছিল, সেখানে জাঁকজমকেরও অন্ত ছিল না। তাঁহার মত অত্যাচারী দুর্দান্ত লম্পট নৃশংস মদগর্বিত জমিদার খুব অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। তারপর বৎসর পাঁচেকের মধ্যে একে একে তিনি স্ত্রী-পুত্র সব হারাইলেন। এবং দেনদারে বিষয়সম্পত্তি সমস্তই নিলাম করিয়া লইল। এখন নিজস্ব বলিতে ওই বাড়িটি এবং সামান্য কিছু ভূ-সম্পত্তি। তাহাতেই কোনরকমে তাঁহার দিন গুজরান হয়। বাড়িতে একটি সরকার এবং দুইটি বন্দুকধারী বরকন্দাজ আছে। যে প্রতিবেশীটি আমার শ্বশুর-গৃহ দখল করিয়া এতদিন বসবাস করিতেছিল, তিনিই এই রাজাবাহাদুরের সরকার। দশ টাকা মাহিনা পান। সেই রাজপ্রাসাদের এক কোণে থাকিবার প্রার্থনা জানাইতে গিয়া তিনি রাজাবাহাদুরের নিকট একদিন এমনই ধমক খাইয়াছিলেন যে আর কখনও সে কথা মুখেও আনেন নাই। রাজাবাহাদুরের একটি থিয়েটারের দল ছিল। তিনি কলিকাতা হইতে মোটা মাহিনা দিয়া অভিনেতা ও অভিনেত্রী নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। প্রতি সপ্তাহে খুব ধূমধাম করিয়া অভিনয় হইত। উজ্জ্বল আলোকমালায় সুশোভিত হইয়া রঙ্গমঞ্চটি লোকে লোকারণ্য হইয়া যাইত।
অবনী প্রশ্ন করিল, ‘থিয়েটারের পিছনের ছোট ফটকে দেখলুম একজন বন্দুক ঘাড়ে করে পাহারা দিচ্ছে। এর কারণ তো কিছু বুঝলুম না?’
শ্বশুর মহাশয় বলিলেন, ‘ও রাজাবাহাদুরের এক অদ্ভুত খেয়াল। তবে সন্ধের পর আর কোন পাহারা সেখানে থাকে না—ভূতের ভয়ে নাকি কেউ থাকতে চায় না। হাজার কাজ থাকলেও গ্রামের কোন লোকই সন্ধের পর ও পথ মাড়ায় না, বলে নাকি ওই বাড়ির মধ্যে থেকে অনেক রকম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়! একদিন কে একজন স্পষ্ট শুনে এসেছে, ভিতরে মানুষের গলায় কে একজন কাতরাচ্ছে!’
আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘গ্রামের লোকেরা খুব ভীতু তো। একবার খোঁজ করে দেখলেই বুঝতে পারবেও সব কিছু নয়। তা হলেই তো লোকের এই মিথ্যা ভয় ভেঙে যায়।’
শ্বশুর মহাশয় কহিলেন, ‘তা যায়, কিন্তু লোকে ও রকম কষ্ট স্বীকার করতে চায় না।’
আমি বলিলাম, ‘আমার ভারি ইচ্ছে হচ্ছে গ্রামের লোকের এই মিথ্যে ভয় ভাঙিয়ে দিই!’
শ্বশুর মহাশয় বলিলেন, ‘কি দরকার। ও পথে লোক বড় কেউ চলে না, যাবার কোন দরকারও হয় না। যখন কারু কোন ক্ষতি হচ্ছে না, তখন কাজ কি পোড়ো বাড়ির মধ্যে গিয়ে। ভূতটুত ওসব আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু সাপ-খোপ, জন্তু-জানোয়ার তারা যে সেখানে আছে আর তারাই যে ওই রকম শব্দ করে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।’
আর কিছু বলিলাম না বটে, কিন্তু সেই পরিত্যক্ত রঙ্গমঞ্চের রহস্যটা জানিবার জন্য মনটা যেন চঞ্চল হইয়া রহিল। অবনীর সহিত নিভৃতে কথা বলিয়া দেখিলাম, তাহারও মন সেই দিকে টানিতেছে। অবশেষে আমরা গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির করিলাম, কালই সন্ধ্যার পর আমরা দুই জনে সেখানে যাইব।
প্রত্যূষে অবনীকে বলিলাম, ‘চল না, এখনই একবার থিয়েটারের ওদিকে বেড়িয়ে আসি। পারি তো একবার ভিতরটাও দেখে আসব। তারপর রাত্রে যাওয়া যাবে।’
অবনী উৎসাহভরে বলিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চল। পথঘাটটাও একবার ভাল করে দেখে আসি। আজ রাত্রে সেখানে নিশ্চয়ই যাব।’
আমরা দুইজনে তখনই বাহির হইয়া পড়িলাম। সমস্ত পথটা আমরা একরূপ নিঃশব্দে অতিবাহিত করিলাম। রাজবাড়ির সম্মুখে আসিয়া দেখিলাম ফটক ভিতর হইতে বন্ধ। আমরা রঙ্গমঞ্চের দিকে অগ্রসর হইলাম, রঙ্গমঞ্চটি তেমনই নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া আছে, আশেপাশে কোথাও জনমানবের সাড়াশব্দ নাই। কিন্তু পিছনের ফটকের কাছে গিয়া আমরা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। কল্যকার সেই প্রহরী বন্দুকহস্তে সেখানে পাহারা দিতেছে।
আমাদের পদশব্দ শুনিয়া সে বন্দুকটি সোজা করিয়া ধরিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের দিকে চাহিল। তারপর রুক্ষ স্বরে সে কহিল, ‘তোমরাই না কাল সন্ধের সময় এখানে এসেছিলে? আজ ভোর হতে না হতেই আবার এসে হাজির হয়েছ! কি মতলবে এখানে ঘুরছ?’
প্রহরীর এই অভদ্রোচিত কথা শুনিয়া আমার ভারি রাগ হইল, আমি তাহাকে কড়া কড়া জবাব দিতে যাইতেছিলাম, অবনী আমায় ইশারায় নিষেধ করিল।
অবনী কহিল, ‘দেখ সিপাইজী, আমরা বিদেশী লোক, এ গ্রামে বেড়াতে এসেছি। শুনলুম দেখবার মধ্যে এই রাজবাড়ি আর থিয়েটারটি আছে। কাল সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভাল করে দেখতে পাইনি, তাই আজ দেখতে এসেছি।’
বোধ করি এ কথায়ও প্রহরীর মন ভিজিল না। সে কহিল, ‘বেশ, দেখা তো হয়েছে। এখন চলে যাও।’
অবনী কহিল, ‘দেখা আর হয়েছে কই! খালি বাইরেটা দেখলুম, ভিতর তো দেখা হল না। তুমি যদি মেহেরবানি করে ভিতরটা একবার দেখিয়ে দাও।’
প্রহরী গর্জন করিয়া উঠিল, ‘খবরদার! খবরদার! এর ভিতর ঢোকবার চেষ্টা করবে তো গুলি করব। এখান থেকে চলে যাও বলছি।’ সঙ্গে সঙ্গে সে বন্দুক বাগাইয়া ধরিল।
আমরা বেগতিক বুঝিয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়িলাম। কিন্তু মনটা আমাদের সেইখানেই পড়িয়া রহিল। পথে যাইতে যাইতে আমরা স্থির করিলাম গ্রামের লোকের নিকট হইতে কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিয়া লইতে হইবে।
কিন্তু নূতন কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। সকলের মুখেই সেই এক কথা শুনিলাম, ওই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হয়, সন্ধ্যার পর কেহ ও পথ দিয়া চলাফেরা করে না। এমন কি সন্ধ্যা হইবার সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকধারী বরকন্দাজও তল্পিতল্পা গুটাইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করে, সারারাত্রির মধ্যে আর সেদিকে আসে না।
৪
সেদিন আমরা দুইজনেই ভাল করিয়া আহার করিতে পারিলাম না। সারা দিনটা যেন কেমন উদ্বেগ ও চাঞ্চল্যের মধ্যে কাটিল। বাড়িতে কাহাকেও কিছু বলিলাম না। বেলা পড়িতেই আমরা দুইটা মোটা লাঠি এবং একটা টর্চ লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া পড়িলাম। তখনও সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিবার কিছু বিলম্ব ছিল, তাই আমরা কিছুক্ষণ গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।
হঠাৎ রণজিতের সহিত দেখা হইয়া গেল। রণজিৎ আমার বিশেষ বন্ধু। আমারই সমবয়সী এবং সহপাঠী। আমাকে দেখিয়া সে আশ্চর্য হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘কি হে, রমেশ যে! এখানে?’
আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘তুমি এখানে?’
রণজিৎ কহিল, ‘আমার যে এখানে মামাবাড়ি।‘
আমি বলিলাম, ‘আমার যে শ্বশুরবাড়ি! ইনিই আমার বড় সম্বন্ধী। বুঝলে অবনী, রণজিৎ আমার অনেকদিনের বন্ধু, বি-এ পাশ করে এখন পশ্চিমে চাকুরি করছে।’ উভয়ের সহিত পরিচয় হইয়া গেল।
রণজিৎ কহিল, ‘বেড়াতে বেরিয়েছ বুঝি?’
‘বেড়াতে বৈকি।‘ আমি একবার অবনীর দিকে চাহিয়া বলিলাম, ‘একেও সঙ্গে নি, কি বল অবনী, দলে ভারী হওয়া যাবে?’
অবনী বলিল, ‘বেশ তো, চলুন না রণজিৎবাবু আমাদের সঙ্গে?’
আমি হাসিয়া বলিলাম, ‘কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি তা তো তোমায় এখনও বলা হয়নি। ভয় পাবে না তো? আমরা আজ ভূত দেখতে যাচ্ছি।’
রণজিৎ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল, ‘তাই নাকি! কোথায় হে? অনেকদিন থেকে ভূতের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হবার ইচ্ছে আমার রয়েছে, অনেকবার অনেক জায়গায় গেছিও কিন্তু অদৃষ্টে সাক্ষাৎলাভ ঘটে নি। এখন তোমার দৌলতে যদি হয়ে যায়! হ্যাঁ হে, সেই থিয়েটারে ভূত দেখতে যাচ্ছ না কি?’
আমি বলিলাম, ‘তাহলে তুমিও সে খবর জান দেখছি—’
রণজিৎ বলিল, ‘তা আর জানি না, মামাবাড়ি কতবার এসেছি—সে বাড়িটাও আমি ঘুরে গেছি। সবাইয়ের মুখে শুনি বটে সেখানে ভূত আছে। আসি আর চলে যাই, তাই আর ভূত দেখবার সুবিধা হয়ে ওঠে নি। বেশ হল, চল যাওয়া যাক।’
সন্ধ্যা তখন ধীরে ধীরে ধরণীর উপর নামিতে আরম্ভ করিয়াছে, আমরা তিনজনে রাজবাড়ির অভিমুখে চলিতে লাগিলাম। যখন আমরা রাজবাড়ির সম্মুখে গিয়া পৌঁছিলাম তখন গভীর অন্ধকারে পথঘাট বাড়িঘর গাছপালা সব প্রায় একাকার হইয়া গিয়াছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে আমরা অতি সন্তর্পণে রঙ্গমঞ্চের দিকে অগ্রসর হইয়া চলিলাম। টর্চ জ্বালিলে পাছে কেহ দেখিতে পায় সেই জন্য তাহা জ্বালা হইল না। এমনি ভাবে অন্ধকার ভেদ করিয়া আমরা পিছনের ফটকের সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিলাম । চাহিয়া দেখিলাম প্রহরীটি নাই।
চুপি চুপি বলিলাম, ‘বাঁচা গেল। ভূতের ভয়ে আর কেউ এদিকে আসবে না।’
অবনী কহিল, ‘এখন কি করবে হে রমেশ, ভিতরে ঢুকবে না বাইরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখবে?’
আমি বলিলাম, ‘এখানে খানিকটা দাঁড়িয়ে দেখা যাক না কান্নাটান্না কিছু শুনতে পাওয়া যায় কিনা। শব্দ পেলেই তিনজনে ঢুকে পড়া যাবে।’
তাহাই স্থির হইল, অবনী টর্চটা জ্বালিয়া ফেলিল। আমরা তিনজনে বাহিরে দাঁড়াইয়া গল্প করিতে লাগিলাম। এমনিভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক অতিবাহিত হইয়া গেল, ভিতরে ও বাহিরে কোথাও কোন সাড়া শব্দ ছিল না। সমস্ত যেন নিঝুম নিস্তব্ধ। এমন সময় হঠাৎ আমাদের চমকিত করিয়া রঙ্গমঞ্চের ভিতর হইতে শব্দ উত্থিত হইল—ঘড় ঘড় ঘড়! মরিচাধরা কপিকলের সাহায্যে কি যেন একটা টানিয়া তোলা হইতেছে।
ব্যাপার কি! আমরা এ উহার মুখের দিকে চাহিলাম।
অবনী কহিল, ‘ওই শোন, ঝপ্ করে আবার শব্দ হল ! সেটাকে ওপরে তুলেই দড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। চল আর দেরি করা নয়, এখনই ভিতরে ঢুকে পড়া যাক। এমনি করেই বদমায়েশেরা লোককে ভয় দেখায়। বেটাদের হাতে হাতে ধরতে হবে।’
আবার শব্দ হইল—ঘড় ঘড় ঘড়!
আমি হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম। বলিলাম, ‘আবার তুলছে, যেমন করে হোক ভিতরে ঢুকতে হবে। ভাঙো ফাটক।’ সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হইয়া গিয়া আমি ফটকের উপর সজোরে পদাঘাত করিলাম। খোলা ফটকটি উন্মুক্ত হইয়া গেল, পড়িতে পড়িতে কোনরকমে সোজা হইয়া দাঁড়াইতেই আবার সেই কি-একটা পড়ার শব্দ শুনিতে পাইলাম। আমি অধিকতর উত্তেজিত হইয়া প্রবেশদ্বারের অনুসন্ধানে ছুটিলাম।
অবনী টর্চটা উঁচু করিয়া ধরিল। ঠিক সম্মুখেই দেখিলাম প্রবেশদ্বার, ধাক্কা দিতেই তাহা খুলিয়া গেল। এইবার সেই ঘড় ঘড় শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম, মনে হইল যেন আরও জোরে জোরে তাহারা সেটাকে টানিয়া তুলিতেছে। ফটক খোলার শব্দ, দ্বার খোলার শব্দ কিছুই কি তাদের কানে যায় নাই? তাহারা কি এমনই স্থির-নিশ্চয় হইয়া আছে যে ভূতের ভয়ে কেহ এদিকে আসিবে না, দূর হইতে পলাইয়া যাইবে? না তাহারা আমাদের আগমন জানিতে পারিয়া ভয় দেখাইবার জন্যই জোরে শব্দ করিতেছে? তাহারা তো কম ধড়িবাজ নহে। আমরাও দলে তিনজন আছি, হাতে হাতে ধরিয়া তাদের চালাকি ভাঙিয়া দিব।
প্রবেশদ্বারটি রঙ্গমঞ্চের এক পাশে, আমরা ক্ষণবিলম্ব না করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করিয়া কি একটা ফেলার শব্দ হইল। আমরা ঘুরিয়া একেবারে ড্রপসিনের ঠিক সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম বহুকালের অব্যবহৃত ড্রপসিনটা পড়িয়া আছে, কিন্তু জোরে জোরে কাঁপিতেছে।
আমি চাপা গলায় বলিলাম, ‘ওরা আমাদের দেখতে পেয়ে নিশ্চয়ই স্টেজের ভিতর কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। বেগতিক দেখলে পালাবে। এখনই ওদের ধরে ফেলতে হবে।’
আবার শব্দ উত্থিত হইল, ঘড় ঘড় ঘড়! টর্চের উজ্জ্বল আলোকে সবিস্ময়ে দেখিলাম সেই শতচ্ছিন্ন ড্রপসিনটা ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহার ছিন্ন অংশগুলি শূন্যের উপর ফরফর করিয়া উড়িতেছে।
ক্রোধে আমার সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। কী, এতদূর স্পর্ধা। আমাদের গ্রাহ্যের মধ্যেই আনিতেছে না! অবনীর দিকে চাহিয়া বলিলাম, ‘তুমি টর্চ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমরা দুজনে ওপরে উঠে বেটাদের ধরছি। এস তো রণজিৎ।’
আমি একলাফে স্টেজের উপর গিয়া উঠিলাম। রণজিৎও আমার অনুসরণ করিল। টর্চের উজ্জ্বল আলোকে স্টেজের ভিতরটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাইতেছিল। আমরা দুইজনে বিভিন্ন উইংসের দিকে ছুটিয়া গেলাম। এদিক ওদিক চারিদিকে ঘুরিয়া দেখিলাম কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। অল্পক্ষণ পরে উভয়ে পূর্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, ড্রপসিনটা ঘড় ঘড় শব্দ করিতে করিতে স্টেজের মাথার কাছে গিয়া উঠিয়াছে।
রণজিৎ শুষ্কমুখে কহিল, ‘তাই তো হে! কাউকে তো দেখতে পেলাম না, অথচ ড্রপটাও উঠছে! ব্যাপার কি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি উত্তেজিতভাবে বলিলাম, ‘ড্রপটা তো আপনি উঠতে পারে না, নিশ্চয়ই লোক আছে। আর এও আমি বলছি, তারা স্টেজের নিচে লুকিয়ে বসে কপিকলের দড়ি টানছে। এস তো একবার দেখি, যাবে কোথা।’
সহসা ড্রপটা আমাদের দুইজনকে অবনীর দৃষ্টিপথের অন্তরাল করিয়া ঝপ্ করিয়া শব্দ করিয়া নিচে পড়িয়া গেল। অন্ধকার যেন অকস্মাৎ আমাদের গ্রাস করিয়া ফেলিল। কেমন যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। সমস্ত দেহটা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। মুহূর্ত পরে ড্রপসিনের ছিন্নাংশ দিয়া টর্চের আলো ভিতরে প্রবেশ করিল। আমিও নিজেকে প্রকৃতিস্থ করিয়া লইলাম। চিৎকার করিয়া বলিলাম, ‘দেখলে অবনী শয়তানী, ড্রপটা কি করে আমাদের মুখের ওপর ফেলে দিলে। স্টেজের নিচে বসে মনে করছে অন্ধকারে আমরা দেখতে পাব না, ওদের যা ইচ্ছে তাই করবে। তা হচ্ছে না, ওদের ধরতেই হবে।’
এমন সময় ঠিক পিছন দিকে হঠাৎ যেন ঘুঙুরের শব্দ শুনিতে পাইলাম। মনে হইল কে যেন ঘুঙুর পায়ে দিয়া নাচিতেছে। মুখ ফিরাইলাম, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তাই তো, এ কি হইল! ওই যে কে যেন আমার চারিদিকে মণ্ডলাকারে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমি চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইতে লাগিলাম কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। ড্রপসিনটা যে ইতিমধ্যে কখন আবার উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে তাহা লক্ষ্য করি নাই। ভিতরে টর্চের উজ্জ্বল আলো পড়িতেই চাহিয়া দেখিলাম, ড্রপটা অনেকখানি উপরে উঠিয়াছে। নাচও খুব জোরে চলিয়াছে। যেন স্পষ্ট অনুভব করিলাম কোন এক নৃত্যকুশলা নটী লীলায়িত ভঙ্গিতে মধুর ছন্দে আত্মহারা হইয়া নাচিতেছে। সে নৃত্যের যেন বিরাম নাই। কিছুক্ষণের জন্য আমিও কেমন যেন আত্মহারা হইয়া গেলাম। ইতিমধ্যে ড্রপটা উপরে উঠিয়া আবার ঝপ্ করিয়া নিচে পড়িয়া গিয়া সমস্ত স্থানটি যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল, তখন আমার চৈতন্য ফিরিয়া আসিল। ঘুঙুরের শব্দও আর শুনিতে পাইলাম না। এতক্ষণে আমার অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হইল। তবে কি জনশ্রুতিই সত্য? কিন্তু বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হইল না। ভ্ৰম, ভ্ৰম! এতক্ষণ রণজিতের দিকে চাহিবারও অবকাশ ছিল না, এইবার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, ‘রণজিৎ, তুমিও কি ঘুঙুরের শব্দ শুনেছ?’
রণজিৎ কম্পিকণ্ঠে কহিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ শুনেছি, খুব স্পষ্ট, কিন্তু কাউকে দেখতে পাই নি। রমেশ, কি করে এখান থেকে বেরুবে?’
দেখিলাম রণজিৎ অত্যন্ত ভয় পাইয়াছে। তাই তো! ভাবিতে লাগিলাম, দুইজনে একই ভ্ৰমে পতিত হওয়া কি সম্ভব? অবনীকে ডাকিয়া প্রশ্ন করিলাম, ‘তুমিও শুনেছ অবনী, ঘুঙুরের শব্দ?’
ড্রপটা তখন অবনীকে আড়াল করিয়া পড়িয়াছিল, কাজেই কেহ কাহাকেও দেখিতে পাইতেছিলাম না। বাহির হইতে সে টানিয়া টানিয়া উত্তর দিল, ‘শুনেছি রমেশ—শুনেছি। বেশ বুঝতে পারলুম একটি মেয়ে ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নাচছে, কিন্তু তার চেহারা তো দেখতে পেলুম না।’
তাই তো! তিনজনেই নাচের শব্দ শুনিয়াছি, কিন্তু কে নাচিতেছিল তাহা তো দেখিতে পাই নাই। আমার সারা দেহ কণ্টকিত হইয়া উঠিল। একি অদ্ভুত ব্যাপার! ড্রপসিনটা ঘড় ঘড় শব্দ করিয়া উঠিতেছে, আবার ঝপ্ করিয়া শব্দ করিয়া নিচে পড়িতেছে, স্টেজের উপর ঘুঙুর পায়ে নাচ চলিতেছে, অথচ কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না! মনে হইল ছুটিয়া পলাইয়া যাই। রণজিৎকে ডাকিয়া বলিলাম, ‘রণজিৎ, এখানে থেকে কাজ নেই, চল বেরিয়ে পড়ি।’
রণজিৎ ভগ্নকণ্ঠে কহিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই চল, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।’
কোনরকমে ড্রপটার পাশ দিয়া স্টেজের উপর হইতে উভয়ে নিচে লাফাইয়া পড়িলাম। দেখিলাম অবনীর হাতে টর্চটা ঠক্ঠক্ করিয়া কাঁপিতেছে, এখনই বুঝি হাত হইতে পড়িয়া যায়। আমি তাড়াতাড়ি গিয়া তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিলাম, ‘শিগ্গির বেরিয়ে পড়।’
কিন্তু বাহিরে যাওয়া আর হইল না। এক মনুষ্যমূর্তিকে সহসা আমাদের দিকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া আমরা তিনজনেই স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইলাম। একেবারে নিকটে আসিতেই দেখিলাম, লোকটির মুখ দীর্ঘ শ্বেত-শ্মশ্রুগুম্ফ-মণ্ডিত এবং কেশপাশ একেবারে শুভ্র উচ্ছৃঙ্খল, গলায় মোটা সোনার হার এবং গায়ে বহুমূল্য হাঁসিয়াদার শালের চোগা। দুই হাত অঞ্জলি-বদ্ধ, চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত। মনে হইল সে যেন আমাদের দেখিতে পায় নাই। আপন মনে কাতরকণ্ঠে সে বলিতে লাগিল, ‘আর যে পারি না। আর কতদিন এমনই ভাবে আমায় এখানে আকর্ষণ করে আনবে! আমাকে মরতেও দেবে না, মেরেও ফেলবে না। আবার ড্রপ তুলছ, আবার নাচ! থামাও থামাও। আমার এক একখানা পাঁজর যে খসে যাচ্ছে।’
তাই তো, ওই যে ড্রপটা তেমনই ঘড় ঘড় শব্দ করিয়া আবার উপরে উঠিতেছে। ওই যে সেই অদৃশ্য নৃত্য আবার আরম্ভ হইয়াছে! ওই যে সেই কায়াহীন নর্তকীর ঘুঙুরের শব্দ শোনা যাইতেছে! সেই বৃদ্ধ এতক্ষণ স্টেজের নিচে দাড়াইয়াছিল, কে যেন তাহাকে জোর করিয়া স্টেজের উপর টানিয়া তুলিয়া লইল। সে দুই হাত জোড় করিয়া জানু পাতিয়া সেই জীর্ণ মেজের উপর বসিয়া পড়িল এবং কাতরকণ্ঠে কাহার নিকট যেন করুণা ভিক্ষা করিতে লাগিল, আর তাহাকে ঘিরিয়া ঘুঙুরের শব্দের তালে তালে সেই অদৃশ্য নর্তকী উন্মত্ত হইয়া নাচিতে লাগিল! হঠাৎ বৃদ্ধ যেন মরিয়ার মত চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ধরা দেব, ফাঁসি যাব। খুন করেছি স্বীকার করব, দেখিয়ে দেব। তোমার দুজনের জীর্ণ কঙ্কাল এখান থেকে টেনে বের করে সবাইকে দেখিয়ে দেব। আর পারি না। একটা দিন রেহাই নেই, রোজ টেনে এনে এমনই করে দগ্ধে মারবে। উঃ কি অসহ্য যন্ত্রণা! ক্ষমা নেই ক্ষমা নেই!’ বলিতে বলিতে বৃদ্ধ ধড়াস্ করিয়া মেজের উপর পড়িয়া গেল। কে যেন তাড়াতাড়ি ড্রপটা ফেলিয়া দিল। নাচের শব্দও থামিয়া গেল।
আমার সমস্ত দেহ কাঁটা দিয়া উঠিয়াছিল, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ক্রমাগত আছাড় খাইতেছিল, চোখের দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল, নিশ্বাস যেন আর ফেলিতে পারিতেছিলাম না।
এমন সময়ে বাহিরে কাহার পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসিয়া প্রবেশ করিল। আমার অবশ দেহে যেন কথঞ্চিৎ বলসঞ্চার হইল। আমি কোনরকমে সোজা হইয়া দাঁড়াইলাম।
‘ওই যে ভিতরে আলো দেখা যাচ্ছে, ওরা ওখানেই আছে।’
এ কি! এ যে শ্বশুর মহাশয়ের কণ্ঠস্বর। আমার বুকের স্পন্দনও অনেকটা কমিয়া আসিল। এতক্ষণ পরে আমি এর অবনী ও রণজিতের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম। তাহাদের মুখ যেন মড়ার ন্যায় রক্তশূন্য। আমাদের কাহারও মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইল না।
দেখিতে দেখিতে শশুর মহাশয় তাঁহার পুরাতন ভৃত্যকে সঙ্গে লইয়া সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভূত্যের হাতে একটি লণ্ঠন ছিল। আমাদের বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘ছিঃ, তোমাদের কাল মানা করলুম, তবু তোমরা এখানে এসেছ! বেরিয়ে এস।’
আমরা নিঃশব্দে তাঁহার অনুসরণ করিয়া রঙ্গমঞ্চ হইতে বাহির হইলাম। এতক্ষণে যেন নিশ্বাস ছাড়িয়া বাঁচিলাম!
সে রাত্রি একেবারেই ঘুমাইতে পারিলাম না। ঘুমাইবার আশায় যেমনই চক্ষু বুজিয়াছি, অমনই কয়েক-ঘন্টা-পূর্বের সেই ভয়াবহ দৃশ্য চোখের সম্মুখে জ্বলজ্বল করিয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে। যখন ভোরের আলো কক্ষের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল, তখন ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়িলাম। ঘুম ভাঙিয়া যখন উঠিলাম, তখন বেলা নয়টা বাজিয়া গিয়াছে। অবনীর তখনও ঘুম ভাঙে নাই।
শ্বশুর মহাশয়ের সহিত দেখা হইতেই তিনি অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বলিলেন, ‘এইমাত্র শুনলুম খানিকক্ষণ আগে ওই ভাঙা স্টেজের ওপর রাজাবাহাদুরকে মৃতাবস্থায় পাওয়া গেছে।’
আমি চমকিয়া উঠিলাম। ব্যগ্রকন্ঠে প্রশ্ন করিলাম, ‘রাজাবাহাদুরের কি খুব লম্বা দাড়ি ছিল, আর এক মাথা সাদা চুল?’
শশুর মহাশয় বলিলেন, ‘হ্যাঁ, কেন বল দেখি?’
গভীর বিস্ময়ে দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমি বলিলাম, ‘অ্যাঁ, ওই রাজাবাহাদুর! ওই রকম চেহারারই এক বুড়োকে কাল আমরা স্টেজের ওপর টেনে তুলতে দেখেছি। আপনার সঙ্গে যখন আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসি সে লোকটা তখন ওই স্টেজের উপরই পড়েছিল।’
শ্বশুর মহাশয় শুষ্কমুখে বলিলেন, ‘ও কথা আর কেউ যেন না শুনতে পায়। পাড়াগাঁ জায়গা, এখনই হয়ত বিপদে ফেলে দেবে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এস। ব্যাপারটা কি হয়েছে, আমায় সব ভেঙে বল।’