দশম পরিচ্ছেদ : অগ্নিনির্বাণকালে উদিপুরী ভস্ম
কপোত শীঘ্রই ঔরঙ্গজেবের উত্তর লইয়া আসিল। রাজসিংহ যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, ঔরঙ্গজেব সকলেতেই সম্মত হইলেন। কেবল একটা গোলযোগ করিলেন, লিখিলেন, “চঞ্চলকুমারীকে দিতে হইবে |” রাজসিংহ বলিলেন, “তদপেক্ষা আপনাকে ঐখানে সসৈন্যে কবর দেওয়া আমার মনোমত |” কাজেই ঔরঙ্গজেবকে সে বাসনা ছাড়িতে হইল। তিনি সন্ধিতে সম্মত হইয়া মুনশীর দ্বারা সেই মর্মে সন্ধিপত্র লেখাইয়া আপনার পাঞ্জা অঙ্কিত করিয়া, স্বহস্তে তাহাতে “মঞ্জুর” লিখিয়া দিলেন। জেব-উন্নিসা ও মবারক সম্বন্ধে একখানি পৃথক পত্রে তাঁহাদিগকে মার্জনা করিতে স্বীকৃত হইলেন, কিন্তু একটি সর্ত এই করিলেন যে, এ বিবাহের কথা কাহারও সাক্ষাতে কখন প্রকাশ করিবে না। সেই সঙ্গে ইহাও স্বীকার করিলেন যে, কন্যা যাহাতে স্বামিসন্দর্শনে বঞ্চিত না হয়েন, সে উপায়ও বাদশাহ করিবেন।
রাজসিংহ সন্ধিপত্র পাইয়া, মোগল সেনা মুক্তি দিবার আজ্ঞা প্রচার করিলেন। রাজপুতেরা হাতী লাগাইয়া গাছ সকল টানিয়া বাহির করিল। মোগলেরা হঠাৎ আহার্য্য কোথায় পাইবে এই জন্য রাজসিংহ দয়া করিয়া বহুতর হাতীর পিঠে বোঝাই দিয়া, অনেক আহার্য্য বস্তু উপঢৌকন প্রেরণ করিলেন এবং শেষে উদিপুরী, জেব-উন্নিসা ও মবারককে তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য উদয়পুরে আদেশ পাঠাইলেন। তখন নির্মল , চঞ্চলকে ইঙ্গিত করিয়া কাণে কাণে বলিল, “বেগম, তোমার দাসীপনা করিল কৈ?” এই বলিয়া নির্মল উদিপুরীকে বলিল, “আমি যে নিমন্ত্রণ করিতে দিল্লী গিয়াছিলাম, সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিলেন না?”
উদিপুরী বলিল, “তোমার জিব আমি টুকরা টুকরা করিয়া কাটিব। তোমাদের সাধ্য কি যে, আমাকে দিয়া তামাকু সাজাও? তোমাদের মত ক্ষুদ্র লোকের সাধ্য কি যে, বাদশাহের বেগম আটক রাখ? কেমন, এখন ছাড়িতে হইল ত? কিন্তু যে অপমান করিয়াছ, তাহার প্রতিফল দিব। উদয়পুরের চিহ্ন মাত্র রাখিব না |”
তখন চঞ্চলকুমারী স্থিরভাবে বলিলেন, “শুনিয়াছি, মহারাণা বাদশাহকে দয়া করিয়া তোমাদের ছাড়িয়া দিয়াছেন। আপনি তাঁহার জন্য একটা মিষ্টি কথা বলিতে জানেন না। অতএব আপনাকে ছাড়া হইবে না। আপনি বাঁদী মহলে গিয়া আমার জন্য তামাকু প্রস্তুত করিয়া আনুন |”
জেব-উন্নিসা বলিল, “সে কি মহারাণি! আপনি এত নির্দয়?”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “আপনি যাইতে পারেন –কেহ বিঘ্ন করিবে না। ইহাকে আমি এক্ষণে যাইতে দিতেছি না |”
জেব-উন্নিসা অনেক অনুনয় করিল, শেষ উদিপুরীও কিছু বিনীত ভাব অবলম্বন করিল। কিন্তু চঞ্চলকুমারী বড় শক্ত। দয়া করিয়া কেবল এইটুকু বলিলেন, “আমার জন্য একবার তামাকু প্রস্তুত করুক, তবে যাইতে পারিবে |”
তখন উদিপুরী বলিল, “তামাকু প্রস্তুত করিতে আমি জানি না |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “বাঁদীরা দেখাইয়া দিবে |”
অগত্যা উদিপুরী স্বীকৃত হইল। বাঁদীরা দেখাইয়া দিল। উদিপুরী চঞ্চলকুমারীর জন্য তামাকু সাজিল।
তখন চঞ্চলকুমারী সেলাম করিয়া তাহাদের বিদায় করিলেন। বলিলেন, “এখানে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সমস্তই আপনি বাদশাহকে জানাইবেন, এবং তাঁহাকে স্মরণ করিয়া দিবেন যে, আমিই তসবিরে নাথি মারিয়া নাক ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলাম। আরও বলিবেন, পুনশ্চ যদি তিনি কোন হিন্দুবালার অপমানের ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি কেবল তসবিরে পদাঘাত করিয়া সন্তুষ্ট হইব না |”
তখন উদিপুরী নিদাঘের মেঘের মত সজলকান্তি হইয়া বিদায় লইল।
মহিষী, কন্যা ও খাদ্য পাইয়া ঔরঙ্গজেবের বেত্রাহত কুক্কুরের মত বদনে লাঙ্গুল নিহিত করিয়া রাজসিংহের সম্মুখ হইতে পলায়ন করিলেন।