রাজসিংহ – ৮.০৭

সপ্তম পরিচ্ছেদ : দগ্ধ বাদশাহের জলভিক্ষা

পরদিন পূর্‍বাহ্নকালে চঞ্চলকুমারীর নিকট জেব-উন্নিসা বসিয়া প্রফুল্লবদনে কথোপকথনে প্রবৃত্ত। দুই দিনের রাত্রিজাগরণে শরীর ম্লান–দুশ্চিন্তার দীর্ঘকাল ভোগে বিশীর্ণ। যে জেব-উন্নিসা রত্নরাশি, পুষ্পরাশিতে মণ্ডিত হইয়া শিশমহলের দর্‍পণে দর্‍পণে আপনার প্রতিমূর্‍তি দেখিয়া হাসিত, এ সে জেব-উন্নিসা নহে। যে জানিত যে, বাদশাহজাদীর জন্ম কেবল ভোগবিলাসের জন্য, এ সে বাদশাহজাদী নহে। জেব-উন্নিসা বুঝিয়াছে যে, বাদশাহজাদীও নারী, বাদশাহজাদীর হৃদয়ও নারীর হৃদয়; স্নেহশূন্য নারীহৃদয়, জলশূন্য নদী মাত্র–কেবল বালুকাময় অথবা জলশূন্য তড়াগের মত–কেবল পঙ্কময়।
জেব-উন্নিসা এক্ষণে অকপটে গর্‍ব পরিত্যাগ করিয়া, বিনীতভাবে চঞ্চলকুমারীর নিকট গত রাত্রির ঘটনা বিবৃত করিয়াছিলেন। চঞ্চলকুমারী সকলই জানিতেন। সকল বলিয়া, জেব-উন্নিসা যুক্তকরে চঞ্চলকুমারীকে বলিলেন, “মহারাণি! আমায় আর বন্দী রাখিয়া আপনার কি ফল? আমি যে আলম্‍গীর বাদশাহের কন্যা, তাহা আমি ভুলিয়াছি। আপনি তাঁহার কাছে পাঠাইলেও আমার আর যাইতে ইচ্ছা নাই। গেলেও বোধ করি, আমার প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা নাই। অতএব আমায় ছাড়িয়া দিন, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁহার স্বদেশ তুর্‍কস্থানে চলিয়া যাই |”
শুনিয়া চঞ্চলকুমারী বলিলেন, “এ সকল কথার উত্তর দিবার সাধ্য আমার নাই। কর্‍তা মহারাণা স্বয়ং। তিনি আপনাকে আমার কাছে রাখিতে পাঠাইয়াছেন, আমি আপনাকে রাখিতেছি। তবে এই যে ঘটনাটা ঘটিয়া গেল, ইহার জন্য মহারাণার সেনাপতি মাণিকলাল সিংহ দায়ী। আমি মাণিকলালের নিকট বিশেষ বাধিত, তাই তাঁহার কথায় এতটা করিয়াছি। কিন্তু ছাড়িয়া দিবার কোন উপদেশ পাই নাই। অতএব সে বিষয়ে কোন অঙ্গীকার করিতে পারিতেছি না |”
জেব-উন্নিসা বিষণ্ণভাবে বলিল, “মহারাণাকে আমার এ ভিক্ষা আপনি কি জানাইতে পারেন না? তাঁহার শিবির এমন অধিক দূরে ত নহে। কাল রাত্রে পর্‍বতের উপর তাঁহার শিবিরের আলো দেখিতে পাইয়াছিলাম |”
চঞ্চলকুমারী বলিলেন, “পাহাড় যত নিকট দেখায়, তত নিকট নয়। আমরা পাহাড়ে দেশে বাস করি, তাই জানি। আপনিও কাশ্মীর গিয়াছিলেন, এ কথা আপনার স্মরণ হইতে পারে। তা যাই হোক, লোক পাঠান কষ্টসাধ্য নহে। তবে, রাণা যে এ কথায় সম্মত হইবেন, এমন ভরসা করি না। যদি এমন সম্ভব হইত যে, উদয়পুরের ক্ষুদ্র সেনা মোগল রাজ্য এই এক যুদ্ধে একেবারে ধ্বংস করিতে পারিত, যদি বাদশাহের সঙ্গে আমাদের আর সন্ধিস্থাপনের সম্ভাবনা না থাকিত, তবে অবশ্য তিনি আপনাকে স্বামীর সঙ্গে যাইতে অনুমতি দিতে পারিতেন। কিন্তু যখন সন্ধি অবশ্য এক দিন না এক দিন করিতে হইবে, তখন আপনাদিগকেও বাদশাহের নিকট অবশ্য ফেরৎ দিতে হইবে |”
জেব। তাহা হইলে, আমাকে নিশ্চিন্ত মৃত্যুমুখে পাঠাইবেন। এ বিবাহের কথা জানিতে পারিলে, বাদশাহ আমাকে বিষভোজন করাইবেন। আর আমার স্বামীর ত কথাই নাই। তিনি আর কখনও দিল্লী যাইতে পারিবেন না। গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। এ বিবাহে কোন্ অভীষ্ট সিদ্ধ হইল, মহারাণি?
চঞ্চল। যাহাতে কোন উৎপাত না ঘটে, এমন উপায় করা যাইতে পারে, বোধ হয়।
এইরূপ কথোপকথন হইতেছিল, এমন সময়ে নির্‍মলকুমারী সেখানে কিছু ব্যস্তভাবে আসিয়া উপস্থিত হইল। নির্‍মল ,চঞ্চলকে প্রণাম করার পর, জেব-উন্নিসাকে অভিবাদন করিলেন। জেব-উন্নিসাও তাঁহাকে প্রত্যভিবাদন করিলেন। তার পর চঞ্চল জিজ্ঞাসা করিলেন, “নির্‍মল , এত ব্যস্তভাবে কেন?”
নি । বিশেষ সংবাদ আছে।
তখন জেব-উন্নিসা উঠিয়া গেলেন। চঞ্চল জিজ্ঞাসা করিলেন, “যুদ্ধের সংবাদ না কি?”
নি । আজ্ঞা হাঁ।
চ। তা ত লোকপরম্পরায় শুনিয়াছি। ইন্দুর গর্‍তের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। মহারাণার গর্‍তের মুখ বুজাইয়া দিয়াছেন। শুনিয়াছি, ইন্দুর না কি গর্‍তের ভিতর মরিয়া পচিয়া থাকিবার মত হইয়াছে।
নি। তার পর, আর একটা কথা আছে। ইন্দুর বড় ক্ষুধার্‍ত। আমার সেই পায়রাটি আজ ফিরিয়া আসিয়াছে। বাদশাহ ছাড়িয়া দিয়াছেন–তাহার পায়ে একখানি রোক্‍কা বাঁধিয়া দিয়াছেন।
চ। রোক‍কা দেখিয়াছ?
নি। দেখিয়াছি।
চ। কাহার বরাবর?
নি। ইমলি বেগম।
চ। কি লিখিয়াছে?
নির্‍মল পত্রখানি বাহির করিয়া কিয়দংশ এইরূপ পড়িয়া শুনাইলেন,-
“আমি তোমায় যেরূপ স্নেহ করিতাম, কোন মনুষ্যকে কখনও এমন স্নেহ করি নাই। তুমিও আমার অনুগত হইয়াছিলে। আজ পৃথিবীশ্বর দুর্‍দশাপন্ন–লোকের মুখে শুনিয়া থাকিবে। অনাহারে মরিতেছি। দিল্লীর বাদশাহ আজ এক টুকরা রুটির ভিখারী। কোন উপকার করিতে পার না কি? সাধ্য থাকে, করিও। এখনকার উপকার কখনও ভুলিব না |”
শুনিয়া চঞ্চলকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি উপকার করিবে?”
নির্‍মল বলিলেন, “তাহা বলিতে পারি না। আর কিছু না পারি, বাদশাহের জন্য আর যোধপুরী বেগমের জন্য কিছু খাদ্য পাঠাইয়া দিব |”
চ। কি রকমে? সেখানে ত মনুষ্য সমাগমের পথ নাই।
নি। তাহা এখন বলিতে পারি না। আমায় একবার শিবিরে যাইতে অনুমতি দিন। কি করিতে পারি, দেখিয়া আসি।
চঞ্চলকুমারী অনুমতি দিলেন। নির্‍মলকুমারী গজপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া, রক্ষিবর্‍গ পরিবেষ্টিত হইয়া, শিবিরে স্বামিসন্দর্শনে গেলেন। যাইবামাত্র মাণিকলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। মাণিকলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “যুদ্ধের অভিপ্রায়ে না কি?”
নি। কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? তুমি আমার যুদ্ধের যোগ্য?
মাণিক। তা ত নই। কিন্তু আলম‍‍গীর বাদশাহ?
নি। আমি তাঁর ইমলি বেগম–তাঁর সঙ্গে কি যুদ্ধের সম্বন্ধ? আমি তাঁর উদ্ধারের জন্য আসিয়াছি। আমি যাহা আজ্ঞা করি, তাহা মনোযোগপূর্‍বক শ্রবণ কর।
তার পর মাণিকলালে ও নির্‍মলকুমারীতে কি কথোপকথন হইল, তাহা আমরা জানি না। অনেক কথা হইল, ইহাই জানি।
মাণিকলাল নির্‍মলকুমারীকে উদয়পুরে প্রতিপ্রেরণ করিয়া, রাজসিংহের সাক্ষাৎকারলাভের অভিপ্রায়ে রাণার তাম্বুতে গেলেন।

1 Comment
Collapse Comments

এটি খুব চমৎকার উপন্যাস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *