চতুর্থ পরিচ্ছেদ : জেব-উন্নিসার দাহনারম্ভ
জেব-উন্নিসা একা বসিয়া আছেন। দুই একজন পরিচারিকা তাঁহার তত্ত্বাবধান করিতেছে। নির্মলকুমারীও দুই একবার তাঁহার খবর লইতেছেন। ক্রমশ: জেব-উন্নিসা উদিপুরীর বিভ্রাটবার্তা শুনিলেন। শুনিয়া তিনি নিজের জন্য চিন্তিত হইলেন।
পরিশেষে তাঁহাকেও নির্মলকুমারী চঞ্চলকুমারীর নিকট লইয়া গেলেন। তিনি না বিনীত, না গর্বিতভাবে চঞ্চলকুমারীর নিকট উপস্থিত হইলেন। মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, আমি যে আলমগীর বাদশাহের কন্যা, তাহা কিছুতেই ভুলিব না।
চঞ্চলকুমারী অতিশয় সমাদরের সহিত তাঁহাকে উপযুক্ত পৃথক আসনে বসাইলেন এবং নানাবিধ আলাপ করিলন। জেব-উন্নিসাও সৌজন্যের সহিত কথার উত্তর করিলেন। পরস্পরে বিদ্বেষ ভাব জন্মে, এমন কথা কেহই কিছুই বলিলেন না। পরিশেষে চঞ্চলকুমারী তাঁহার উপযুক্ত পরিচর্যার আদেশ দিলেন। এবং জেব-উন্নিসাকে আতর ও পান দিলেন।
কিন্তু জেব-উন্নিসা, না উঠিয়া বলিলেন, “মহারাণি! আমাকে কেন এখানে আনা হইয়াছে, আমি কিছু শুনিতে পাই কি?”
চঞ্চল। সে কথা আপনাকে বলা হয় নাই। না বলিলেও চলে। কোন দৈবজ্ঞের আদেশমত আপনাকে আনা হইয়াছে। আপনি অদ্য একা শয়ন করিবেন। দ্বার খুলিয়া রাখিবেন। প্রহরিণীগণ অলক্ষ্যে প্রহরা দিবে, আপনার কোন অনিষ্ট ঘটিবে না। দৈবজ্ঞ বলিয়াছেন, আপনি আজ রাত্রে কোন স্বপ্ন দেখিবেন। যদি স্বপ্ন দেখেন, তবে আমাকে কাল তাহা বলিবেন, ইহা আপনার নিকট প্রার্থনা।
শুনিয়া চিন্তিতভাবে জেব-উন্নিসা চঞ্চলকুমারীর নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন। নির্মলকুমারীর যত্নে তাঁহার আহার ও শয্যার পারিপাট্য যেমন দিল্লীর রঙ্মহালে ঘটিত, তেমনই ঘটিল। তিনি শয়ন করিলেন, কিন্তু নিদ্রা যাইলেন না। চঞ্চলকুমারীর আজ্ঞামত দ্বার খুলিয়া রাখিয়া একাই শয়ন করিলেন; কেন না, অবাধ্য হইলে চঞ্চলকুমারী উদিপুরীর দশার মত তাঁহারও কোন দুর্দশা ঘটান, সে ভয়ও ছিল। কিন্তু একা সমস্ত রাত্রি দ্বার খুলিয়া রাখাতেও অত্যন্ত শঙ্কা উপস্থিত হইল। মনে ভাবিলেন যে, ইহাই সম্ভব যে, গোপনে আমার উপর কোন অত্যাচার হইবে, এই জন্য এমন বন্দোবস্ত হইয়াছে। অতএব স্থির করিলেন, নিদ্রা যাইবেন না, সতর্ক থাকিবেন।
কিন্তু দিবসে অনেক কষ্ট গিয়াছিল, এজন্য নিদ্রা যাইব না, জেব-উন্নিসা এরূপ প্রতিজ্ঞা করিলেও, তন্দ্রা আসিয়া মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে অধিকার করিতে লাগিল। তন্দ্রাভিভূত হইলেও একটু বোধ থাকে যে, আমার ঘুমান হইবে না। জেব-উন্নিসা মধ্যে মধ্যে এইরূপ তন্দ্রাভিভূত হইতেছিলেন। কিন্তু মধ্যে মধ্যে চমকে চমকে ঘুম ভাঙ্গিতেছিল। ঘুম ভাঙ্গিলেই আপনার অবস্থা মনে পড়িতেছিল। কোথায় দিল্লীর বাদশাহজাদী, কোথায় উদয়পুরের বন্দিনী! কোথায় মোগল বাদশাহীর রঙ্গভূমির প্রধানা অভিনেত্রী, মোগল বাদশাহীর আকাশের পূর্ণচন্দ্র, তক্তে তাউসের সর্বোজ্জ্বল রত্ন, কাবুল হইতে বিজয়পুর গোলকুণ্ডা যাঁহার বাহুবলে শাসিত, তাঁহার দক্ষিণ বাহু,-আর কোথায় আজ গিরিগুহানিহিত উদয়পুরের কোটরে মূষিকবৎ পিঞ্জরাবদ্ধা, রূপনগরের ভুঁইঞার মেয়ের বন্দিনী, হিন্দুর ঘরে অস্পর্শীয়া শূকরী, হিন্দুপরিচারিকামণ্ডলীর চরণকলঙ্ককারী কীট! মরণ কি ইহার অপেক্ষা ভাল নহে? ভাল বৈ কি! যে মরণ তিনি প্রাণাধিক প্রিয় মবারককে দিয়াছেন, সে ভাল না ত কি? যা মবারককে দিয়াছেন, তাহা অমূল্য–নিজে কি তিনি সেই মরণের যোগ্য? হায় মবারক! মবারক! মবারক! তোমার অমোঘ বীরত্ব কি সামান্য ভুজঙ্গগরলকে জয় করিতে পারিল না? সে অনিন্দনীয় মনোহর মূর্তিও কি সাপের বিষে নীল হইয়া গেল! এখন উদয়পুরে কি এমন সাপ পাওয়া যায় না যে, এই কালভুজঙ্গীকে দংশন করে? মানুষী কালভুজঙ্গী কি ফণিনী কালভুজঙ্গীর দংশনে মরিবে না! হায় মবারক! মবারক! মবারক! তুমি একবার সশরীর দেখা দিয়া, কালভুজঙ্গী দিয়া আমায় দংশন করাও; আমি মরি কি না দেখ।
ঠিক এই কথা ভাবিয়া যেন মবারকরে সশরীর দর্শন করিবার মানসেই জেব-উন্নিসা নয়ন উন্মীলিত করিলেন। দেখিলেন, সম্মুখে সশরীর মবারক! জেব-উন্নিসা চীৎকার করিয়া, চক্ষু পুনর্নিমীলিত করিয়া অজ্ঞান হইলেন।
বালিকার প্রেমিক
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো খোঁপার বাঁধন।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো বুকের আঁচল।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো অবৈধ ইঙ্গিত।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো ময়ুর নাচার মৌনতা।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো দেহ মনের জানালা।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো উরুদ্বয়ের গুরু সর্বনাশ।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো পদতলের আঁচল নিয়ে টানাটানি।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো খোলা মেলা শরীরের কারুকাজ।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো দীর্ঘশ্বাস বুকের নিঃশ্বাস।
আমি কারো প্রেমিক হতে পারব না,
যতই তুমি আলগা করো আলো ছায়ার আঁধার।