চতুর্থ পরিচ্ছেদ : অগ্নিচক্র বড় ভীষণ হইল
তখন রাজসিংহ আর সকল পৌরাঙ্গনাগণকে–গজারূঢ়া, শিবিকারূঢ়া, এবং অশ্বারূঢ়া–সকলকেই, ঔরঙ্গজেবকে যে রন্ধ্রপথে প্রবেশ করাইয়াছিলেন, সেই পথে প্রবেশ করিতে দিলেন। তাহারা প্রবেশ করিলে পর, উভয় সেনা নিস্তব্ধ হইল। ঔরঙ্গজেবের অবশিষ্ট সেনা অগ্রসর হইতে পারিতেছে না–কেন না, রাজসিংহ পথ বন্ধ করিয়া বসিয়াছেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সাগরতুল্য অশ্বারোহী সেনা যুদ্ধের উদ্যোগ করিতে লাগিল। তাহারা ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া রাজপুতের সম্মুখীন হইল। তখন রাজসিংহ একটু হঠিয়া গিয়া তাহাদের পথ ছাড়িয়া দিলেন–তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন না। তাহারা “দীন্ দীন্” শব্দ করিতে করিতে বাদশাহের আজ্ঞানুসারে, বাদশাহ যে সংকীর্ণ রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সেই পথে প্রবেশ করিল। রাজসিংহ আবার আগু হইলেন। তারপর বাদশাহী তোষাখানা আসিয়া উপস্থিত হইল। রক্ষক নাই বলিলেই হয়, রাজপুতেরা তাহা লুঠিয়া লইল। তার পর খ্যাদ্যদ্রব্য । যাহা হিন্দুর ব্যাবহার্য, তাহা রাজসিংহের রসদের সামিল হইল। যাহা হিন্দুর অ ব্যাবহার্য, তাহা ডোম দোসাদে লইয়া গিয়া কতক খাইল, কতক পর্বতে ছড়াইল–শৃগাল-কুকুর এবং বন্য পশুতে খাইল। রাজপুতেরা দফতরখানা হাতীর উপর হইতে নামাইল–কতক বা পুড়াইয়া দিল, কতক বা ছাড়িয়া দিল। তার পর মালখানা; তাহাতে যে ধনরত্নরাশি আছে, পৃথিবীতে এমন আর কোথাও নাই,-জানিয়া রাজপুত সেনাপতিগণ লোভে উন্মত্ত হইল। তাহার পশ্চাতে বড় গোলন্দাজ সেনা। রাজসিংহ আপন সেনা সংযত করিলেন। বলিলেন, “তোমরা ব্যস্ত হইও না। ও সব তোমাদেরই। আজ ছাড়িয়া দাও। আজ এখন যুদ্ধের সময় নহে |” রাজসিংহ নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন। ঔরঙ্গজেবের সমস্ত সেনা রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিল।
তার পর মাণিকলালকে বিরলে লইয়া গিয়া বলিলেন, “আমি সেই মোগলের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি। এতটা সুবিধা হইবে, আমি মনে করি নাই। আমি যাহা অভিপ্রেত করিয়াছিলাম, তাহাতে যুদ্ধ করিয়া মোগলকে বিনষ্ট করিতে হইত। এক্ষণে বিনা যুদ্ধেই মোগলকে বিনষ্ট করিতে পারিব। মবারককে আমার নিকট লইয়া আসিবে। আমি তাহাকে সমাদর করিব |”
পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, মবারক মাণিকলালের হাতে জীবন পাইয়া তাহার সঙ্গে উদয়পুর আসিয়াছিলেন। রাজসিংহ তাহার বীরত্ব অবগত ছিলেন, অতএব তাহাকে নিজসেনা মধ্যে উপযুক্ত পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু মোগল বলিয়া তাহাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন না। তাহাতে মবারক কিছু দু:খিত ছিল। আজ সেই দু:খে গুরুতর কার্যের ভার লইয়াছিল। সে গুরুতর কার্য যদ সুসম্পন্ন হইয়াছে, তাহা পাঠক দেখিয়াছেন। পাঠক বুঝিয়া থাকিবেন যে, মবারকই ছদ্মবেশী মোগল সওদাগর।
মাণিকলাল আজ্ঞা পাইয়া মবারককে লইয়া আসিলেন। রাজসিংহ মবারকের অনেক প্রশংসা করিলেন। বলিলেন “তুমি এই সাহস ও চাতুর্য প্রকাশ করিয়া, মোগল সওদাগর সাজিয়া, মোগল সেনা রন্ধ্রপথে না লইয়া গেলে অনেক প্রাণহত্যা হইত। তোমাকে কেহ চিনিত পারিলে তোমারও মহাবিপদ উপস্থিত হইত |”
মবারক বলিল, “মহারাজ! যে ব্যক্তি সকলের সমক্ষে মরিয়াছে, যাহাকে সকলের সমক্ষে গোর দিয়াছে, তাহাকে কেহ চিনিতে পারিলেও চেনে না–মনে করে, ভ্রম হইতেছে। আমি এই সাহসেই গিয়াছিলাম |”
রাজসিংহ বলিলেন, “এক্ষণে যদি আমার কার্য সিদ্ধ না হয়, তবে সে আমার দোষ। তুমি যে পুরস্কার চাহিবে, আমি তাহাই তোমাকে দিব |”
মবারক কহিল, “মহারাজ! বে-আদবী মাফ হৌক! আমি মোগল হইয়া মোগলের রাজ্য ধ্বংসের উপায় করিয়া দিয়াছি। আমি মুসলমান হইয়া হিন্দুরাজ্য স্থাপনের কার্য করিয়াছি। আমি সত্যবাদী হইযা মিথ্যা প্রবঞ্চনা করিয়াছি। আমি বাদশাহের নেমক খাইয়া নেমকহারামী করিয়াছি। আমি মৃত্যুযন্ত্রণার অধিক কষ্ট পাইতেছি। আমার আর কোন পুরস্কারে সাধ নাই। আমি কেবল এক পুরস্কার আপনার নিকট ভিক্ষা করি। আমাকে তোপের মুখে রাখিয়া উড়াইয়া দিবার আদেশ করুন। আমার আর বাঁচিবার ইচ্ছা নাই |”
রাজসিংহ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “যদি এ কাজে তোমার এতই কষ্ট, তবে এমন কাজ কেন করিলে? আমাকে জানাইলে না কেন? আমি অন্য লোক নিযুক্ত করিতাম। আমি কাহাকেও এত দূর মন:পীড়া দিতে চাহি না |”
মবারক, মাণিকলালকে দেখাইয়া দিয়া বলিল, “এই মহাত্মা আমার জীবন দান করিয়াছিলেন। ইঁহার নিতান্ত অনুরোধ যে, আমি এই কার্য সিদ্ধ করি। আমি নহিলেও এ কাজ সিদ্ধ হইত না; কেন না, মোগল ভিন্ন হিন্দুকে মোগলেরা বিশ্বাস করিত না। আমি ইহা অস্বীকার করিলে অকৃতজ্ঞতা পাপে পড়িতাম। তাই এ কাজ করিয়াছি। এক্ষণে এ প্রাণ আর রক্ষা করিব না স্থির করিয়াছি। আমাকে তোপের মুখে উড়াইয়া দিতে আদেশ করুন। অথবা আমাকে বাঁধিয়া বাদশাহের নিকটে পাঠাইয়া দিন, অথবা অনুমতি দিন যে, আমি যে প্রকারে পারি, মোগল সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করি |”
রাজসিংহ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “কাল তোমাকে আমি মোগল সেনায় প্রবেশের অনুমতি দিব। আর একদিন মাত্র থাক। আমার কেবল এক্ষণে একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে। ঔরঙ্গজেব তোমাকে বধ করিয়াছিলেন কেন?”
ম। তাহা মহারাজের সাক্ষাৎ বক্তব্য নহে।
রা। মাণিকলালের সাক্ষাৎ?
ম। বলিয়াছি।
এই বলিয়া রাজসিংহ মবারককে বিদায় দিলেন।
তার পর, মাণিকলাল মবারককে নিভৃতে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব! যদি আপনার মরিবার ইচ্ছা, তবে শাহাজাদীকে ধরিতে আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলে কেন?”
মবারক বলিল, “ভুল! সিংহজী ভুল! আমি আর শাহজাদী লইয়া কি করিব? মনে করিয়াছিলাম বটে যে, যে শয়তানী আমার ভালবাসার বিনিময়ে আমাকে কালসাপের বিষদন্তে সমর্পণ করিয়া মারিয়াছিল, তাহাকে তাহার কর্মের প্রতিফল দিব। কিন্তু মানুষ যাহা আজ চাহে, কাল তাহার ইচ্ছা থাকে না। আমি এখন মরিব নিশ্চয় করিয়াছি–এখন আর শাহজাদী প্রতিফল পাইল না পাইল, তাহাতে আমার কি? আমি আর কিছুই দেখিতে আসিব না |”
মা। জেব-উন্নিসাকে রাখিতে যদি আপনি অনুমতি না করেন, তবে আমি বাদশাহের নিকট কিছু ঘুষ লইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিই।
মবারক। আর একবার তাহাকে আমার দেখিতে ইচ্ছা আছে। একবার জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা আছে যে, জগতে ধর্মাধর্মে তাহার কিছু বিশ্বাস আছে কি না? একবার শুনিবার ইচ্ছা আছে যে, সে আমায় দেখিয়া কি বলে? একবার জানিবার ইচ্ছা আছে যে, আমাকে দেখিয়া সে কি করে?
মা। তবে আপনি এখনও তাহার প্রতি অনুরক্ত?
ম। কিছুমাত্র না। একবার দেখিব মাত্র। আপনার কাছে এই পর্যন্ত ভিক্ষা।