পঞ্চম পরিচ্ছেদ : সমিধসংগ্রহ–স্বয়ং যম
নির্মল বুঝিল না যে, কেন পলাইতে হইবে। এদিক ওদিক নিরীক্ষণ করিল–পলাইবার কারণ কিছুই দেখিতে পাইল না। কেবল দেখিল, ফটকের নিকট পরিণতাবয়স্ক, শুভ্রবেশ একজন লোক দাঁড়াইয়া আছে। মনে করিল, এটা কি ভূত-প্রেত যে, তাই ভয় পাইয়া খোজা পলাইল? নির্মল নিজে ভূতের ভয় তেমন কাতর নহে। এ জন্য সে না পলাইয়া ইতস্তত: করিতেছিল,-ইতিমধ্যে সেই শুভ্রবেশ পুরুষ আসিয়া, নির্মলের নিকট দাঁড়াইল। নির্মলকে দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”
নির্মল বলিল, “আমি যে হই না কেন?”
শুভ্রবেশী পুরুষ জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা যাইতেছিলে?”
নি । বাহিরে।
পুরুষ। কেন?
নি। আমার দরকার আছে।
পু। দরকার ভিন্ন কেহ কিছু করে না, তাহা আমার জানা আছে। কি দরকার?
নি। আমি বলিব না।
পু। তোমার সঙ্গে কে আসিতেছিল?
নি। আমি বলিব না।
পু। তুমি হিন্দুর মেয়ে দেখিতেছি। কি জাতি?
নি। রাজপুত।
পু। তুমি কি যোধপুরী বেগমের কাছে থাক?
নির্মল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিল, যোধপুরী বেগমের নাম কাহারও সাক্ষাতে করিবে না–কি জানি, যদি তাঁহার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটে। অতএব বলিল, “আমি এখানে থাকি না। আজ আসিয়াছি |”
সে পুরুষ জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা হইতে আসিয়াছ?”
নির্মল মনে ভাবিল, মিথ্যা কথা কেন বলিব? এ ব্যক্তি আমার কি করিবে? কার ভয়ে রাজপুতের মেয়ে মিথ্যা বলিবে? অতএব উত্তর করিল, “আমি উদয়পুর হইতে আসিয়াছি |”
তখন সে পুরুষ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন আসিয়াছ?”
নির্মল ভাবিল, ইহাকে বা এত পরিচয় কেন দিব? বলিল, “আপনাকে অত পরিচয় দিয়া কি হইবে? এত জিজ্ঞাসাবাদ না করিয়া যদি আমাকে ফটক পার করিয়া দেন, তাহা হইলে বিশেষ উপকৃত হইব।
পুরুষ উত্তর করিল, “তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া উত্তরে যদি সন্তুষ্ট হই, তবে তোমাকে ফটক পার করিয়া দিতে পারি |”
নির্মল । আপনি কে, তাহা না জানিলে আমি সকল কথা আপনাকে বলিব না।
পুরুষ উত্তর করিল, “আমি আলমগীর বাদশাহ |”
তখন সেই তসবির, যাহা চঞ্চলকুমারী পদাঘাতে ভাঙ্গিয়াছিল, নির্মলকুমারীর মনে উদয় হইল। নির্মল একটু জিব কাটিয়া, মনে মনে বলিল, “হাঁ, সেই ত বটে!”
তখন নির্মলকুমারী ভূমি স্পর্শ করিয়া বাদশাহকে রীতিমত সেলাম করিল। যুক্তকরে বলিল, “হুকুম ফরমাউন |”
বাদশাহ বলিলেন, “এখানে কাহার কাছে আসিয়াছিলে?”
নির্মল । হজরৎ বাদশাহ বেগম উদিপুরী সাহেবার কাছে।
বাদশাহ। কি বলিলে? উদয়পুর হইতে উদিপুরীর কাছে? কেন?
নি। পত্র ছিল।
বাদ। কাহার পত্র?
নি। মহারাণার রাজমহিষীর।
বাদ। কৈ সে পত্র?
নি। হজরৎ বেগম সাহেবাকে তাহা দিয়াছি।
বাদশাহ বড় বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “আমার সঙ্গে এসো |”
নির্মলকে সঙ্গে লইয়া বাদশাহ উদিপুরীর মন্দিরে গমন করিলেন। দ্বারে নির্মলকে দাঁড় করাইয়া, তাতারী প্রহরিণীদিগকে বলিলেন, “ইহাকে ছাড়িও না |” নিজে উদিপুরীর শয্যাগৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, উদিপুরী ঘোর নিদ্রাভিভূত। তাহার বিছানায় পত্রখানা পড়িয়া আছে। ঔরঙ্গজেব তাহা লইয়া পাঠ করিলেন। পত্রখানা, তখনকার রীতিমত ফার্সীতে লেখা।
পত্র পাঠ করিয়া, নিদাঘসন্ধ্যাকাদম্বিনী তুল্য ভীষণ কান্তি লইয়া ঔরঙ্গজেব বাহিরে আসিলেন। নির্মলকে বলিলেন, “তুই কি প্রকারে এই মহাল মধ্যে প্রবেশ করিলি?”
নির্মল যুক্তকরে বলিল, “বাঁদীর অপরাধ মার্জনা হউক–আমি এ কথার উত্তর দিব না |”
ঔরঙ্গজেব বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “কি এত হেমাকৎ? আমি দুনিয়ার বাদশাহ–আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুই উত্তর দিবি না?”
নির্মল করজোড়ে বলিল, “দুনিয়া হুজুরের। কিন্তু রসনা আমার। আমি যাহা না বলিব, দুনিয়ার বাদশাহ তাহা কিছুতেই বলাইতে পারিবেন না |”
ঔ। তা না পারি, যে রসনার বড়াই করিতেছ, তা এখনই তাতারী প্রহরিণীর হাতে কাটিয়া ফেলিয়া কুকুরকে খাওয়াইতে পারি।
নি । দিল্লীশ্বরের মর্জি! কিন্তু তাহা হইলে, যে সংবাদ আপনি খুঁজিতেছেন, তা প্রকাশের পথ চিরকালের জন্য বন্ধ হইবে।
ঔ। সেই জন্য তোমার জিভ রাখিলাম। তোমার প্রতি এই হুকুম দিতেছি যে, আগুন জ্বালিয়া তোমাকে কাপড়ে মুড়িয়া, একটু একটু করিয়া তাতারীরা পোড়াইতে থাকুক। আমার কথায় যাহা বলিবে না, আগুনের জ্বালায় তাহা বলিবে।
নির্মলকুমারী হাসিল। বলিল, “হিন্দুর মেয়ে আগুনে পুড়িয়া মরিতে ভয় করে না। হিন্দুস্থানের বাদশাহ কি কখনও শুনেন নাই যে, হিন্দুর মেয়ে, হাসিতে হাসিতে স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়া মরে? আপনি যে মরণের ভয় দেখাইতেছেন, আমার মা মাতামহী প্রভৃতি পুরুষানুক্রমে সেই আগুনেই মরিয়াছেন। আমিও কামনা করি, যেন ঈশ্বরের কৃপায় আমিও স্বামীর পাশে স্থান পাইয়া আগুনেই জীবন্ত পুড়িয়া মরি |”
বাদশাহ মনে মনে বলিলেন, “বাহবা! বাহবা!” প্রকাশ্যে বলিলেন, “সে কথার মীমাংসা পরে করিব। আপাতত: তুমি এই মহালের একটা কামরার ভিতর চাবিবন্ধ থাক। ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হইলে কিছু খাইতে পারিবে না। তবে যখন নিতান্ত প্রাণ যায় বিবেচনা করিবে, তখন কবাটে ঘা মারিও, প্রহরীরা দ্বার খুলিয়া দিয়া আমার কাছে লইয়া যাইবে। তখন আমার নিকট সকল উত্তর দিলে, পান-আহার করিতে পাইবে |”
নি। শাহান-শাহ! আপনি কখনও কি শুনেন নাই যে, হিন্দু স্ত্রীলোকেরা ব্রত-নিয়ম করে? ব্রত-নিয়ম জন্য এক দিন, দুই দিন, তিন দিন নিরম্বু উপবাস করে? শুনেন নাই, শরণা ধরণার জন্য অনিয়মিতকাল উপবাস করে? শুনেন নাই, তারা কখন কখন উপবাস করিয়া ইচ্ছাপূর্বক প্রাণত্যাগ করে? জাঁহাপনা, এ দাসীও তা পারে। ইচ্ছা হয়, আমার মৃত্যু পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়া দেখুন।
ঔরঙ্গজেব দেখিলেন, এ মেয়েকে ভয় দেখাইয়া কিছু হইবে না। মারিয়া ফেলিলেও কিছু হইবে না। পীড়ন করিলে কি হয় বলা যায় না। কিন্তু তার পূর্বে একবার প্রলোভনের শক্তিটা পরীক্ষা করা ভাল। অতএব বলিলেন, “ভাল, নাই তোমাকে পীড়ন করিলাম। তোমাকে ধনদৌলত দিয়া বিদায় করিব। তুমি এ সকল কথা আমার নিকট যথার্থ প্রকাশ কর |”
নি। রাজপুতকন্যা যেমন মৃত্যুকে ঘৃণা করে, ধন-দৌলতকেও তেমনই। সামান্যা স্ত্রীলোক আমি–নিজগুণে আমাকে বিদায় দিন।
ঔরঙ্গ। দিল্লীর বাদশাহের অদেয় কিছু নাই। তাঁহার কাছে প্রার্থনীয় তোমার কি কিছুই নাই?
নি। আছে। নির্বিঘ্নে বিদায়।
ঔ। কেবল সেইটি এখন পাইতেছ না। তা ছাড়া আর জগতে তোমার প্রার্থনা করিবার, কি ভয় করিবার কিছু নাই?
নি। প্রার্থনার আছে বৈ কি? কিন্তু দিল্লীর বাদশাহের রত্নাগারে সে রত্ন নাই।
ঔ। এমন কি সামগ্রী?
নি। আমরা হিন্দু, আমরা জগতে কেবল ধর্মকেই ভয় করি, ধর্মই কামনা করি। দিল্লীর বাদশাহ ম্লেচ্ছ, আর দিল্লীর বাদশাহ ঐশ্বর্য্যশালী। দিল্লীর বাদশাহের সাধ্য কি যে, আমার কাম্য বস্তু দিতে পারেন, কি লইতে পারেন?
দিল্লীশ্বর নির্মলকুমারী সাহস ও চতুরতা দেখিয়া, ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন, কিন্তু এই কটূক্তিতে পুনর্বার ক্রুব্ধ হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বটে! বটে! ঐ কথাটা ভুলিয়া গিয়াছিলাম |” তখন তিনি একজন তাতারীকে আদেশ করিলেন, “যা! বাবর্চি মহল হইতে কিছু গোমাংস আনিয়া, দুই তিন জনে ধরিয়া ইহার মুখে গুঁজিয়া দে |”
নির্মল তাহাতেও টলিল না। বলিল, “জানি, আপনাদিগের সে বিদ্যা আছে। সে বিদ্যার জোরেই এই সোণার হিন্দুস্থান কাড়িয়া লইয়াছেন। জানি, গোরুর পাল সম্মুখে রাখিয়া লড়াই করিয়া মুসলমান হিন্দুকে পরাস্ত করিয়াছে–নহিলে রাজপুতের বাহুবলের কাছে মুসলমানের বাহুবল, সমুদ্রের কাছে গোষ্পদ। কিন্তু আবার একটা কথা আপনাকে মনে করিয়া দিতে হইল। শুনেন নাই যে, রাজপুতের মেয়ে বিষ না লইয়া এক পা চলে না? আমার নিকটে এমন তীব্র বিষ আছে যে, আপনার ভৃত্যগণ গোমাংস লইয়া এ ঘরে পা দেওয়ার পরেও যদি তাহা আমি মুখে দিই, তবে জীবন্তে আর আমার মুখে কেহ গোমাংস দিতে পারিবে না। জাঁহাপনা! আপনার বড় ভাই দারাশেকোকে বধ করিয়া তাহার দুইটা কবিলা কাড়িয়া আনিতে গিয়াছিলেন–পারিয়াছিলেন কি?–অধম খ্রিষ্টিয়ানীটা আসিয়াছিল জানি, রাজপুতানী দিল্লীর বাদশাহের মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বর্গে চলিয়া যায় নাই কি? আমিও এখনই তোমার মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বর্গে চলিয়া যাইব |”
বাদশাহ বাকশূন্য। যিনি পৃথিবীপতি বলিয়া খ্যাত, পৃথিবীময় যাঁহার গৌরব ঘোষিত, যিনি সমস্ত ভারতবর্ষের ত্রাস, তিনি আজ এই অনাথা, নি:সহায় অবলার নিকট অপমানিত–পরাস্ত। ঔরঙ্গজেব পরাজয় স্বীকার করিলেন। মনে মনে বলিলেন, “এ অমূল্য রত্ন, ইহাকে নষ্ট করা হইবে না। আমি ইহাকে বশীভূত করিব |” প্রকাশ্যে অতি মধুরস্বরে বলিলেন, “তোমার নাম কি, পিয়ারী?”
নির্মলকুমারী বলিল, “ও কি জাঁহাপনা! আরও রাজপুত-মহিষীতে সাধ আছে না কি? তা সে সাধও পরিত্যাগ করিতে হইতেছে। আমি বিবাহিতা, আমার হিন্দু স্বামী জীবিত আছেন |”
ঔ। সে কথা এখন থাক। এখন তুমি কিছু দিন আমার এই রঙমহাল মধ্যে বাস কর। এ হুকুম বোধ করি তুমি অমান্য করিবে না?
নি। কেন আমাকে আটক করিতেছেন?
ঔ। তুমি এখন দেশে গেলে, আমার বিস্তর নিন্দা করিবে। যাহাতে তুমি আমার প্রশংসা করিতে পার, এক্ষণে তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করিব। পরে তোমাকে ছাড়িয়া দিব।
নি। যদি আপনি না ছাড়েন, তবে আমার যাইবার সাধ্য নাই। কিন্তু আপনি কয়েকটি কথা প্রতিশ্রুত হইলেই আমি দিন কতক থাকিতে পারি।
ঔ। কি কি কথা?
নি। হিন্দুর অন্নজল ভিন্ন আমি স্পর্শ করিব না।
ঔ। তাহা স্বীকার করিলাম।
নি। কোন মুসলমান আমাকে স্পর্শ করিবে না।
ঔ। তাহাও স্বীকার করিলাম।
নি। আমি কোন রাজপুত বেগমের নিকটে থাকিব।
ঔ। তাহাও হইবে। আমি তোমাকে যোধপুরী বেগমের নিকট রাখিয়া দিব।
নির্মলকুমারীর জন্য বাদশাহ সেইরূপ বন্দোবস্ত করিলেন।
নজরুল রচনাবলী অনলাইনে দিয়ে ভাল করেছেন। সূত্র উল্লেখ করলে ভাল হতো।অর্থাৎ কবে কোন প্রেস থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়; কোনও ভূমিকা ছিল কিনা এবং মোট কতগুলো রচনা ছিল এ সব তথ্য থাকলে গবেষণার জন্য সুবিধা হতো।