চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সমিধসংগ্রহ–উদিপুরী
রাত্রি একটু বেশী হইলে যোধপুরী বেগম নির্মলকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়া, একজন তুর্কী (তাতারী) প্রহরিণী সঙ্গে দিয়া জেব-উন্নিসার কাছে পাঠাইয়া দিলেন। নির্মল জেব-উন্নিসার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া আতর-গোলাপের, পুষ্পরাশির, এবং তামাকুর সদ্গন্ধে বিমুগ্ধ হইল। নানাবিধ রত্নরাজিখচিত হর্ম্যতলে, শয্যাভরণ এবং গৃহাভরণ দেখিয়া বিস্মিত হইল। সর্বাপেক্ষা জেব-উন্নিসার বিচিত্র, রত্নপুষ্পমিশ্রিত অলঙ্কারপ্রভায়, চন্দ্রসূর্যতুল্য উজ্জ্বল সৌন্দর্যপ্রভায় চমকিত হইল। এই সকলে সজ্জিতা পাপিষ্ঠা জেব-উন্নিসাকে দেবলোকবাসিনী অপ্সরা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
কিন্তু অপ্সরার তখন চক্ষু ঢুলু ঢুলু; মুখ রক্তবর্ণ; চিত্ত বিভ্রান্ত; দ্রাক্ষাসুধার তখন পূর্ণাধিকার। নির্মলকুমারী তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইলে, তিনি জড়িত রসনায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুই?”
নির্মলকুমারী বলিল, “আমি উদয়পুরের রাজমহিষীর দূতী |”
জে। মোগল বাদশাহের তক্তে তাউস লইয়া যাইতে আসিয়াছিস?
নি। না। চিঠি লইয়া আসিয়াছি।
জে। চিঠি কি হইবে? পুড়াইয়া রোশনাই করিবি?
নি । না। উদিপুরী বেগম সাহেবাকে দিব।
জে। সে বাঁচিয়া আছে, না মরিয়া গিয়াছে?
নি । বোধ হয় বাঁচিয়া আছেন।
জে। না। সে মরিয়া গিয়াছে। এ দাসীটিকে কেহ তাহার কাছে লইয়া যা।
জেব-উন্নিসার উন্মত্ত প্রলাপবাক্যের উদ্দেশ্য যে, ইহাকে যমের বাড়ী পাঠাইয়া দাও। কিন্তু তাতারী প্রহরিণী তাহা বুঝিল না। সাদা অর্থ বুঝিয়া নির্মলকুমারীকে উদিপুরী বেগমের কাছে লইয়া গেল।
সেখানে নির্মল দেখিল, উদিপুরীর চক্ষু উজ্জ্বল, হাস্য উচ্চ, মেজাজ বড় প্রফুল্ল। নির্মল খুব একটা বড় সেলাম করিল। উদিপুরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে আপনি?”
নির্মল উত্তর করিল, “আমি উদয়পুরের রাজমহিষীর দূতী। চিঠি লইয়া আসিয়াছি |”
উদিপুরী বলিল, “না। না। তুমি ফার্সী মুলুকের বাদশাহ। মোগল বাদশাহের হাত হইতে আমাকে কাড়িয়া লইতে আসিয়াছ |”
নির্মলকুমারী, হাসি সামলাইয়া চঞ্চলের পত্রখানি উদিপুরীর হাতে দিল। উদিপুরী তাহা পড়িবার ভাণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “কি লিখিতেছে? লিখিতেছে, ‘অয় নাজ্নী! পিয়ারী মেরে! তোমার সুরৎ ও দৌলত শুনিয়া একেবারেই বেহোস্ ও দেওয়ানা হইয়াছি। তুমি শীঘ্র আসিয়া আমার কলিজা ঠাণ্ডা করিবে |’ আচ্ছা, তা করিব। হুজুরের সঙ্গে আলবৎ যাইব। আপনি একটু অপেক্ষা করুন–আমি একটু শরাব খাইয়া লই। আপনি একটু শরাব মোলাহেজা করিবেন? আচ্ছা শরাব! ফেরেঙ্গের এল্চি ইহা নজর দিয়াছে। এমন শরাব আপনার মুলুকেও পয়দা হয় না |”
উদিপুরী পিয়ালা মুখে তুলিলেন, সেই অবসরে নির্মলকুমারী বহির্গত হইয়া যোধপুরী বেগমের কাছে উপস্থিত হইল। এবং যোধপুরীর জিজ্ঞাসামত যেমন যেমন ঘটিয়াছিল, তাহা বলিল। শুনিয়া যোধপুরী বেগম হাসিয়া বলিল, “কাল পত্রখানা ঠিক হইয়া পড়িবে। তুমি এই বেলা পলায়ন কর। নচেৎ কাল একটা গণ্ডগোল হইতে পারে। আমি তোমার সঙ্গে একজন বিশ্বাসী খোজা দিতেছি। সে তোমাকে মহালের বাহির করিয়া তোমার স্বামীর শিবিরে পৌঁছাইয়া দিবে। সেখানে যদি তোমার আত্মীয়-স্বজন কাহাকেও পাও, তার সঙ্গে আজই দিল্লীর বাহিরে চলিয়া যাইও। যদি শিবিরে কাহাকেও না পাও, তবে ইহার সঙ্গে দিল্লীর বাহিরে যাইও। তোমার স্বামী বোধ হয়, দিল্লী ছাড়াইয়া কোথাও তোমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। পথে তাঁহার সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ না হয়, তাহা হইলে এই খোজাই তোমাকে উদয়পুর পর্যন্ত রাখিয়া আসিবে। খরচ-পত্র তোমার কাছে না থাকে, তবে তাহাও আমি দিতেছি। কিন্তু সাবধান! আমি ধরা না পড়ি |”
নির্মল বলিল, “হজরৎ সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি রাজপুতের মেয়ে |”
তখন যোধপুরী বনাসী নামে তাঁহার বিশ্বাসী খোজাকে ডাকাইয়া যাহা করিতে হইবে, তাহা বুঝাইয়া বলিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখনই যাইতে পারিবে ত?”
বনাসী বলিল, “তা পারিব। কিন্তু বেগম সাহেবার দস্তখাতি একখানা পরওয়ানা না পাইলে এত করিতে সাহস হইতেছে না |”
যোধপুরী তখন বলিলেন, “যেরূপ পরওয়ানা চাহি, লিখাইয়া আন, আমি বেগম সাহেবার দস্তখত করাইতেছি |”
খোজা পরওয়ানা লিখাইয়া আনিল। তাহা সেই তাতারী প্রহরিণীর হাতে দিয়া রাজমহিষী বলিলেন, “ইহাতে বেগম সাহেবার দস্তখত করাইয়া আন |”
প্রহরিণী জিজ্ঞাসা করিল, “যদি জিজ্ঞাসা করে, কিসের পরওয়ানা?”
যোধপুরী বলিলেন, “বলিও, ‘আমার কোতলের পরওয়ানা |’ কিন্তু কালি কলম লইয়া যাইও। আর পাঞ্জা ছেপত করিতে ভুলিও না |”
প্রহরিণী কালি কলম সহিত পরওয়ানা লইয়া গিয়া জেব-উন্নিসার কাছে ধরিল। জেব-উন্নিসা পূর্বভাবাপন্ন জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের পরওয়ানা?”
প্রহরিণী বলিল, “আবার কোতলের পরওয়ানা |”
জে। কি চুরি করেছিস্?
প্রহরিণী। হজরৎ উদিপুরী বেগমের পেশওয়াজ।
জে। আচ্ছা করেছিস–কোতলের পর পরিস।
এই বলিয়া বেগম সাহেবা পরওয়ানা দস্তখত করিয়া দিলেন। প্রহরিণী মোহর ছেপত করিয়া লইয়া যোধপুরী বেগমকে দিল। বনসী সেই পরওয়ানা এবং নির্মল কে লইয়া যোধপুরী মহাল হইতে যাত্রা করিল। নির্মল কুমারী অতি প্রফুল্লমনে খোজার সঙ্গে চলিলেন।
কিন্তু সহসা সে প্রফুল্লতা দূর হইল–রঙমহালের ফটকের নিকট আসিয়া খোজা ভীত, স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। বলিল, “কি বিপদ্! পালাও! পালাও!” এই বলিয়া খোজা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলাইল।