পঞ্চম খণ্ড
অগ্নির আয়োজন
প্রথম পরিচ্ছেদ : শাহজাদী অপেক্ষা দুঃখী ভাল
বলিয়াছি, মবারক রণভূমিতে পর্বতের সানুদেশে সহসা অদৃশ্য হইলেন। অদৃশ্য হইবার কারণ, তিনি যে পথে অশ্বারোহণে সৈন্য লইয়া যাইতেছিলেন, তাহার মধ্যে একটা কূপ ছিল। কেহ পর্বতোপরি বাস করিবার অভিপ্রায়ে জলের জন্য এই কূপটি খনন করিয়াছিল। এক্ষণে চারি পাশের জঙ্গল কূপের মুখে পড়িয়া কূপটি আচ্ছাদন করিয়াছিল। মবারক তাহা না দেখিতে পাইয়া উপর দিয়া ঘোড়া চালাইলেন। ঘোড়া সমেত তাহার ভিতর পড়িয়া গিয়া অদৃশ্য হইলেন। তাহার ভিতর জল ছিল না। কিন্তু পতনের আঘাতেই ঘোড়াটি মরিয়া গেল। মবারক পতনকালে সতর্ক হইয়াছিলেন, তিনি বড় বেশী আঘাত পাইলেন না। কিন্তু কূপ হইতে উঠিবার কোন উপায় দেখিলেন না। যদি কেহ শব্দ শুনিয়া তাঁহার উদ্ধার করে, এজন্য ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন। কিন্তু যুদ্ধের কোলাহলে তিনি কোন উত্তর শুনিতে পাইলেন না। কেবল একবার যেন, দূর হইতে কে বলিল, “স্থির হইয়া থাক–তুলিব |” সেটাও সন্দেহ মাত্র।
যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে, রণক্ষেত্র নি:শব্দ হইলে, কেহ যেন কূপের উপর হইতে বলিল, “বাঁচিয়া আছ?”
মবারক উত্তর করিল, “আছি। তুমি কে?”
সে বলিল, “আমি যে হই, বড় জখম হইয়াছ কি?”
“সামান্য |”
“আমি একটা কাঠে, দুই চারিখানা কাপড় বাঁধিয়া লম্বা দড়ির মত করিয়াছি। পাকাইয়া মজবুত করিয়াছি। তাহা কূয়ার ভিতর ফেলিয়া দিতেছি। দুই হাতে কাঠের দুই দিক ধর–আমি টানিয়া তুলিতেছি |”
মবারক বিস্মিত হইয়া বলিল, “এ যে স্ত্রীলোকের স্বর! কে তুমি?”
স্ত্রীলোক বলিল, “এ গলা কি চেন না?”
ম। চিনিতেছি। দরিয়া এখানে কোথায় হইতে?
দরিয়া বলিল, “তোমারই জন্য। এখন তুলিতেছি–উঠ |”
এই বলিয়া দরিয়া কাপড়ের কাছিতে বাঁধা কাঠখানা কূপের ভিতর ফেলিয়া দিল। তরবারি দিয়া কূপের মুখের জঙ্গল কাটিয়া সাফ করিয়া দিল। মবারক কাঠের দুই দিক ধরিল। দরিয়া তখন টানিয়া তুলিতে লাগিল। জোরে কুলায় না। কান্না আসিতে লাগিল। তখন দরিয়া একটা বৃক্ষের বিনত শাখার উপর বস্ত্ররজ্জু স্থাপন করিয়া, শুইয়া পড়িয়া টানিতে লাগিল। মবারক উঠিল। দরিয়াকে দেখিয়া মবারক বিস্মিত হইল। বলিল, “এ কি? এ বেশ কেন?”
দরিয়া বলিল, “আমি বাদশাহী সওয়ার |”
ম। কেন?
দ। তোমারই জন্য।
ম। কেন?
দ। নহিলে তোমাকে আজ বাঁচাইত কে?
ম। সেই জন্য কি দিল্লী হইতে এখানে আসিয়াছ? সেই জন্য কি সওয়ার সাজিয়াছ? এ যে রক্ত দেখিতেছি! তুমি যে জখম হইয়াছ! কেন এ করিলে?
দ। তোমার জন্য করিয়াছি। না করিলে, তুমি বাঁচিতে কি? শাহজাদী কেমন ভালবাসে?
মবারক ম্লানমুখে, ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল, “শাহজাদীরা ভালবাসে না |”
দরিয়া বলিল, “আমরা দু:খী,-আমরা ভালবাসি। এখন বসো। আমি তোমার জন্য দোলা স্থির করিয়া রাখিয়াছি; লইয়া আসিতেছি। তোমার চোট লাগিয়াছে–ঘোড়ায় চড়া সৎপরামর্শ হইবে না |”
যে সকল দোলা মোগল সেনার সঙ্গে ছিল, যুদ্ধে ভীত হইয়া তাহার বাহকেরা কতকগুলি লইয়া পলায়ন করিয়াছিল। দরিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে মবারককে কূপমগ্ন হইতে দেখিয়া, প্রথমেই দোলার সন্ধানে গিয়াছিল। পলাতক বাহকদিগকে সন্ধান করিয়া, দুইখানা দোলা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। তার পর এখন, সেই দোলা ডাকিয়া আনিল। একখানায় আহত মবারককে তুলিল, একখানায় স্বয়ং উঠিল। তখন মবারককে লইয়া দরিয়া দিল্লীর পথে চলিল। দোলায় উঠিবার সময় মবারক দরিয়ার মুখচুম্বন করিয়া বলিল, “আর কখনও তোমায় ত্যাগ করিব না |”
উপযুক্ত স্থানে উপস্থিত হইয়া, দরিয়া মবারকের শুশ্রূষা করিল। দরিয়ার চিকিৎসাতেই মবারক আরোগ্য লাভ করিল।
দিল্লীতে পৌঁছিলে, মবারক দরিয়ার হাত ধরিয়া আপন গৃহে লইয়া গেল। দিন কত ইহাতে উভয়ে বড় সুখী হইল। তার পর ইহার যে ফল উপস্থিত হইল, তাহা ভয়ানক। দরিয়ার পক্ষে ভয়ানক, মবারকের পক্ষে ভয়ানক, জেব-উন্নিসার পক্ষে ভয়ানক, ঔরঙ্গজেবের পক্ষে ভয়ানক। সে অপূর্ব রহস্য আমি পশ্চাৎ বলিব। এক্ষণে চঞ্চলকুমারীর কথা কিছু বলা আবশ্যক।