সপ্তম পরিচ্ছেদ : স্নেহশালিনী পিসী
রাণাকে বিদায় দিয়া, মাণিকলাল রূপনগরের সেনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ পর্বতরোহণ করিল। পলায়নপরায়ণ মোগলসেনা তৎকর্তৃক তাড়িত হইয়া যে যেখানে পাইল, পলায়ন করিল। তখন মাণিকলাল সৈনিকদিগকে বলিলেন, “শত্রুদল পলায়ন করিয়াছে–আর কোন বৃথা পরিশ্রম করিতেছ? কার্য সিদ্ধ হইয়াছে, রূপনগরে ফিরিয়া যাও |” সৈনিকেরাও দেখিল–তাও বটে, সম্মুখশত্রু আর কেহ নাই। মাণিকলাল যে একটা কারসাজি করিয়াছে, ইহাও তাহারা বুঝিতে পারিল। হঠাৎ যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই দেখিয়া, তাহারা লুঠপাটে প্রবৃত্ত হইল। এবং যথেষ্ট ধনসম্পত্তি অপহরণ করিয়া সন্তুষ্টচিত্তে, হাসিতে হাসিতে, বাদশাহের জয়ধ্বনি তুলিয়া রণজয়গর্বে গৃহাভিমুখে ফিরিল। দণ্ডকাল মধ্যে পার্বত্য পথ জনশূন্য হইল–কেবল হত ও আহত মনুষ্য ও অশ্ব সকল পড়িয়া রহিল। দেখিয়া, উচ্চ পর্বতের উপরে প্রস্তরসঞ্চালনে যে সকল রাজপুত নিযুক্ত ছিল, তাহারা নামিল। এবং কোথাও কাহাকেও না দেখিয়া রাণা অবশিষ্ট সৈন্য সহিত অবশ্য উদয়পুর যাত্রা করিয়াছেন বিবেচনা করিয়া, তাহারাও উহার সন্ধানে সেই পথে চলিল। পথিমধ্যে রাজসিংহের সহিত সাক্ষাৎ হইল। সকলে একত্রে উদয়পুরে চলিলেন।
সকলে জুটিল–কেবল মাণিকলাল নহে। মাণিকলাল, নির্মলকে লইয়া বিব্রত। সকলকে গুছাইয়া পাঠাইয়া দিয়া, নির্মলের কাছে আসিয়া জুটিল। তাহাকে কিছু ভোজন করাইয়া, গ্রাম হইতে বাহক ও দোলা লইয়া আসিল। দোলায় নির্মলকে তুলিয়া, যে পথে রাণা গিয়াছেন, সে পথে না গিয়া ভিন্ন পথে চলিল–বমাল সমেত ধরা পড়ে, এমন ইচ্ছা রাখে না।
মাণিকলাল নির্মলকে লইয়া পিসীর বাড়ী উপস্থিত হইল। পিসীমাকে ডাকিয়া বলিল, “পিসীমা, একটা বউ এনেছি |” বধূ দেখিয়া পিসীমা কিছু বিষণ্ণ হইলেন–মনে করিলেন,-লাভের যে আশা করিয়াছিলাম, বধূ বুঝি ব্যাঘাত করিবে। কি করে, আশরফি নগদ লইয়াছে–একদিন অন্ন না দিয়া বধূকে তাড়াইয়া দিতে পারিবে না। সুতরাং বলিল, “বেশ বউ |”
মাণিকলাল বলিল, “পিসী, বহুর সঙ্গে আমার আজিও বিবাহ হয় নাই |”
পিসীমা বুঝিলেন, তবে এটা উপপত্নী। গো পাইয়া বলিলেন, “তবে আমার বাড়ীতে___”
মাণিকলাল। তার ভাবনা কি? বিয়ে দাও না? আজই বিবাহ হউক।
নির্মল লজ্জায় অধোবদন হইল।
পিসীমা আবার গো পাইলেন; বলিলেন, “সে ত সুখের কথা–তোমার বিবাহ দিব না ত কার বিবাহ দিব? তা বিবাহের ত কিছু খরচ চাই?”
মাণিকলাল বলিল, “তার ভাবনা কি?”
পাঠকের জানা থাকিতে পারে, যুদ্ধ হইলেই লুঠ হয়। মাণিকলাল যুদ্ধক্ষেত্র হইতে আসিবার সময়ে নিহত মোগল সওয়ারদিগের বস্ত্রমধ্যে অনুসন্ধান করিয়া কিছু সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল–ঝনাৎ করিয়া পিসীর কাছে গোটাকত আশরফি ফেলিয়া দিলেন, পিসীমা আনন্দে পরিপ্লুত হইয়া তাহা কুড়াইয়া লইয়া পেটারায় তুলিয়া রাখিয়া বিবাহের উদ্যোগ করিতে বাহির হইলেন। বিবাহের উদ্যোগের মধ্যে ফুল চন্দন ও পুরোহিত সংগ্রহ, সুতরাং আশরফিগুলি পিসীমাকে পেটারা হইতে আর বাহির করিতে হইল না। মাণিকলালের লাভের মধ্যে তিনি যথাশাস্ত্র নির্মলকুমারীর স্বামী হইলেন। বলা বাহুল্য যে, মাণিকলাল রাণার সৈনিকদিগের মধ্যে বিশেষ উচ্চ পদ লাভ করিলেন, এবং নিজগুণে সর্বত্র সম্মান প্রাপ্ত হইলেন।