চতুর্থ খণ্ড
রন্ধ্রে যুদ্ধ
প্রথম পরিচ্ছেদ : চঞ্চলের বিদায়
প্রভাতে মোগল সৈন্য সাজিল। রূপনগরের গড়ের সিংহদ্বার হইতে, উষ্ণীষকবচশোভিত, গুম্ফশ্মশ্রুসমন্বিত, অস্ত্রসজ্জাভীষণ অশ্বারোহিদল সারি দল। পাঁচ পাঁচ জন অশ্বারোহীর এক এক সারি, সারির পিছু সারি, তার পর আবার সারি, সারি সারি সারি অশ্বারোহীর সারি চলিতেছে; ভ্রমরশ্রেণীসমাকুল ফুল্লকমলতুল্য তাহাদের বদনমণ্ডল সকল শোভিতেছিল। তাহাদের অশ্বশ্রেণী গ্রীবাভঙ্গে সুন্দর, বল্গারোধে অধীর, মন্দগমনে ক্রীড়াশীল; অশ্বশ্রেণী শরীরভরে হেলিতেছে, দুলিতেছে এবং নাচিয়া নাচিয়া চলিবার উপক্রম করিতেছে।
চঞ্চলকুমারী প্রভাতে উঠিয়া স্নান করিয়া রত্নালঙ্কারে ভূষিতা হইলেন। নির্মণল অলঙ্কার পরাইল; চঞ্চল বলিল, “ফুলের মালা পরাও সখি–আমি চিতারোহণে যাইতেছি |” প্রবলবেগে প্রবহমান অশ্রুজল চক্ষুমধ্যে ফেরৎ পাঠাইয়া নির্মমল বলিল, “রত্নালঙ্কার পরাই সখি, তুমি উদয়পুরেশ্বরী হইতে যাইতেছ |” চঞ্চল বলিল, “পরাও! পরাও! নির্ম ল ! কুৎসিত হইয়া কেন মরিব? রাজার মেয়ে আমি; রাজার মেয়ের মত সুন্দর হইয়া মরিব। সৌন্দর্যেখর মত কোন্ রাজ্য? রাজত্ব কি বিনা সৌন্দর্যে; শোভা পায়? পরা |” নির্মিল অলঙ্কার পরাইল; সে কুসুমিততরুবিনিন্দিত কান্তি দেখিয়া কাঁদিল। কিছু বলিল না। চঞ্চল তখন নির্মইলের গলা ধরিয়া কাঁদিল।
চঞ্চল তার পর বলিল, “নির্মল ! আর তোমায় দেখিব না! কেন বিধাতা এমন বিড়ম্বনা করিলেন! দেখ, ক্ষুদ্র কাঁটার গাছ যেখানে জন্মে, সেইখানে থাকে; আমি কেন রূপনগরে থাকিতে পাইলাম না!”
নির্মেল বলিল, “আমায় আবার দেখিবে। তুমি যেখানে থাক, আমার সঙ্গে আবার দেখা হইবে। আমায় না দেখিলে তোমার মরা হইবে না; তোমায় না দেখিলে আমার মরা হইবে না |”
চ। আমি দিল্লীর পথে মরিব।
নি । দিল্লীর পথে তবে আমায় দেখিবে।
চ। সে কি নির্মথল ? কি প্রকারে তুমি যাইবে?
নির্ম ল কিছু বলিল না। চঞ্চলের গলা ধরিয়া কাঁদিল।
চঞ্চলকুমারী বেশভূষা সমাপন করিয়া মহাদেবের মন্দিরে গেলেন। নিত্যব্রত শিবপূজা ভক্তিভাবে করিলেন। পূজান্তে বলিলেন, “দেবদেব মহাদেব! মরিতে চলিলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, বালিকার মরণে তোমার এত তুষ্টি কেন? প্রভু! আমি বাঁচিলে কি তোমার সৃষ্টি চলিত না? যদি এতই মনে ছিল, কেন আমাকে রাজার মেয়ে করিয়া সংসারে পাঠাইয়াছিলে?”
মহাদেবের বন্দনা করিয়া চঞ্চলকুমারী মাতৃচরণ বন্দনা করিতে গেলেন। মাতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল। পিতার চরণে গিয়া প্রণাম করিল। পিতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল! তার পর একে একে সখীজনের কাছে, চঞ্চল বিদায় গ্রহণ করিল। সকলে কাঁদিয়া গণ্ডগোল করিল। চঞ্চল কাহাকে অলঙ্কার, কাহাকে খেলনা, কাহাকে অর্থ দিয়া পুরস্কৃত করিলেন। কাহাকে বলিলেন, “কাঁদিও না–আমি আবার আসিব |” কাহাকে বলিলেন, “কাঁদিও না–দেখিতেছ না, আমি পৃথিবীশ্বরী হইতে যাইতেছি |” কাহাকেও বলিলেন, “কাঁদিও না–কাঁদিলে যদি দু:খ যাইত, তবে আমি কাঁদিয়া রূপনগরের পাহাড় ভাসাইতাম |”
সকলের কাছে বিদায় গ্রহণ করিয়া, চঞ্চলকুমারী দোলারোহণে চলিলেন। এক সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য দোলার অগ্রে স্থাপিত হইয়াছে;এক সহস্র পশ্চাতে । রজতমন্ডিত রত্নখচিত সে শিবিকা,বিচিত্র সুবর্ণ-খচিত বস্ত্রে আবৃত হইয়াছে ; আসাসোঁটা লইয়া চোপদার বাগ্জালে গ্রাম্য দর্শকবর্গকে আনন্দিত করিতেছে। চঞ্চলকুমারী শিবিকায় আরোহণ করিলে, দুর্গমধ্য হইতে শঙ্খ নিনাদিত হইল; কুসুম ও লাজাবলীতে শিবিকা পরিপূর্ণ হইল; সেনাপতি চলিবার আজ্ঞা দিলেন; তখন অকস্মাৎ মুক্তপথ তড়াগের জলের ন্যায় সেই অশ্বারোহিশ্রেণী প্রবাহিত হইল। বল্গা দংশিত করিয়া, নাচিতে নাচিতে অশ্বশ্রেণী চলিল–অশ্বারোহীদিগের অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা বাজিল। অশ্বারোহিগণ প্রভাতবায়ুপ্রফুল্ল হইয়া কেহ কেহ গান করিতেছিল। শিবিকার পশ্চাতেই যে অশ্বারোহিগণ ছিল, তাহার মধ্যে অগ্রবর্তী একজন গায়িতেছিল–
“শরম্ ভরম্ সে পিয়ারী,
সোমরত বংশীধারী,
ঝুরত লোচনসে বারি!
ন সম্ঝে গোপকুমারী,
যেহিন্ বৈঠত মুরারি,
বিহারত রাহ তুমারি ||”
রাজকুমারীর কর্ণে সে গীত প্রবেশ করিল। তিনি ভাবিলেন, “হায়! যদি সওয়ারের গীত সত্য হইত!” রাজকুমারী তখন রাজসিংহকে ভাবিতেছিলেন। তিনি জানিতেন না যে, আঙ্গুল-কাটা মাণিকলাল তাঁহার পশ্চাতে এই গীত গায়িতেছিল। মাণিকলাল, যত্ন করিয়া শিবিকার পশ্চাতে স্থান গ্রহণ করিয়াছিল।