রাজরাজেশ্বর
শ্রীনিবাস সরকার প্রভাতের অফিসে এসে যখন বসতে লাগলেন—তখনই তিনি কম কিছু নন। দৈনিক, মাসিক, সপ্তাহের কাগজের জগতে শ্রীনিবাস সরকার বেশ ভালােই পরিচিত। তসরের পাঞ্জাবি। ধুতির কেঁাচার ফুলের ঢেউ পাম্পশুর নাকে লুটোপুটি। মাথার মাঝে টাক। তার চারপাশে কালাে কেঁকড়া চুলের বাগান।
শ্রীনিবাসের তখন যদি সাঁইত্রিশ তাে আমার যাচ্ছিল তেত্রিশ-চৌত্রিশ। কিন্তু মাঝের এই কয়েক বছরের তফাত তিনি গাম্ভীর্য, ঔদার্য, দাক্ষিণ্য দিয়ে এমনই সুদূর করে তুললেন—যাতে কিনা খুবই কেতাবি কথা ছাড়া শ্রীনিবাসবাবুর সঙ্গে আমি গােড়ায় গােড়ায় কিছুই বলতে পারিনি।
কেননা, তিনি হাসিমুখে কথা না বলে দৈনিক প্রভাতের আড্ডায় শুধু তাকিয়ে থাকতেন। অর্থাৎ হাসিমুখে শুধু তাকিয়ে থাকতেন। সেই তাকানাের ভেতর আমি তাে কোন ছার—বড়াে বড়াে অভিজ্ঞ মানুষ সেই চোখে ডুব দিয়ে কোনাে তল পেত না।
কোনাে কথার পর শ্রীনিবাস ছােট্ট করে বললেন—ওঃ ! তাই নাকি? কিংবা—হয়তাে খুব ছােটো করে বললেন—বুঝেছি। ব্যাস! ওই হয়ে গেল। আর কথা নয়। আসলে কাগজের জগতের ঘাঁতঘোঁত, পাচপয়জার জেনে জেনে তিনি তখন বাড়ির বসন্ত পিসিমা হয়ে উঠেছেন।
শ্রীনিবাস সরকার নড়লে-চড়লে আমি তার গায়ে এই অভিজ্ঞতার কালশিটে দেখতে পাই। অথচ তিনি কোনাে দৈনিক থেকে আসেননি। এসেছেন মাসিক কাগজ থেকে। যে-কাগজ সামান্য থেকে বিরাট হয়েছিল একসময়। আবার তা পড়তির মুখে বসল। তখনই দৈনিক প্রভাত-এ শ্রীনিবাসের আবির্ভাব।
রথের রশি ছেড়ে এলেন কেন?
আর থাকা গেল না। অনন্তদা কাগজ করার সময় আমার হাত ধরে নিয়ে যান। তার কাছেই কাজ শিখি। রথের রশি বড়াে হল। পুজো সংখ্যায় এক এক জেলার অর্ডার আমরা লরি ভরে পাঠিয়েছি। রথের রশি-র বার্ষিক পুরস্কার একসময় প্রেস্টিজের ব্যাপার ছিল। তা অনন্তদা মারা যেতে তার স্ত্রী মানে আমাদের বউদি-অনন্তদার গা ম্যাসেজ করত ত্রিলােচন নন্দী—তাকে এডিটর করে বসালেন রথের রশি-তে। এর পর থাকা যায় বলুন?
একই সঙ্গে শ্রদ্ধা আর দুঃখে আমি শ্রীনিবাস সরকারের দিকে চেয়ে থাকি। সফল কাগজ করিয়ের এমন দুর্দশা। শেষে গা মালিশ করার লােক সম্পাদক হয়ে বসল? এ কেমন বুদ্ধি অনন্ত বউদির।
তারপর তাে আপনি অনাদি অনন্ত-র সম্পাদক হলেন।
হা। কাগজের নাম আমারই রাখা। অনন্তদার বন্ধু রসময়দা অনন্তদা বেঁচে থাকতেই রথের রশি ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যান। এ-ব্যবসা সে-ব্যবসায় ঘুরলেন। অনন্তদাকে লুকিয়ে রসময় ফিল্ম প্রডিউস করলেন—
রিলিজ হয়েছিল?
শুনুন না—রসময়দা গােপনে ফিল্ম তুলছেন শুনে অনন্তদা মুখে কিছু বললেন না। একটা গল্প লিখলেন।
আগে লিখেছেন কখনাে? কোনােদিন না। লিখে আমায় ডেকে বললেন—চিত্রনাট্য করে নিয়ে আয়। আপনি কোনােদিন চিত্রনাট্য করেছেন?
কোনােদিন না। চিত্রনাট্য করলাম। ছবিও হল। বিশ্বজিৎ, সন্ধ্যা রায় তখন উঠছে সবে। ওদের নিয়ে ছবি করলাম। মানে অনন্তদা করালেন। সুর হেমন্তর। ছবি তাে সুপার সুপার হিট। সেই প্রফিট দিয়েই তাে রথের রশি’-র নিজের বাড়ি হল। অফসেট প্রেস হল।
আর গােপনে তােলা রসময়বাবুর ছবি ?
রিলিজ হল। তিনদিনের দিন সব হাউজ থেকে উঠে গেল। সেই থেকে অনন্তদাকে রসময়দা ভীষণ ভয় পেত—আবার শ্রদ্ধাও করত। তা অনন্তদার মৃত্যুর পর রসময়দা আমার বাড়ি এসে হাজির। শ্রীনিবাস কাগজ করব—তুমি তার সম্পাদক। কাগজের নাম ঠিক করাে।
বললাম, আমায় ভাবার সময় দিন দুদিন। দুদিন পরে আপনাকে জানাব। দুদিন পরে গিয়ে বললাম—কাগজের নাম হবে অনাদি অনন্ত। রসময়দা বলল, তথাস্তু। তারপর তাে জানেনই—সেসব এখন হিস্ট্রি। পুজো সংখ্যা দিয়ে শুরু। প্রথম পুজোতেই লাখ ছাড়িয়ে গেল বিক্রি। রি-প্রিন্ট করতে হল আরাে বিশ হাজার। রসময়দা আমায় চুমু খেলেন। কিন্তু কথা রাখলেন না। আমার কাজে নাক গলাতে লাগলেন। আমি ছেড়ে দিলাম।
এখন কী অবস্থা অনাদি অনন্ত-র। দেখছেন তাে। লাট খাচ্ছে। ইররেগুলার। দুমাস পিছিয়ে আছে। রসময়দা আমাকে ডাকতে এসেছিলেন। আমি যাইনি।
আর গেলেন না? আপনারই দাঁড় করানাে কাগজ। আমার কাগজ বলে ভাবাটাই ভুল। কাগজ পাবলিকের।
শ্রীনিবাস খুব ঠান্ডা গলায় এমন বড়াে বড়াে সাকসেস আর বিশাল বিদায়ের কথা একনিশ্বাসে বলে যান।
দৈনিক প্রভাত রথের রশি বা অনাদি অনন্তর চেয়ে অনেক বড়াে কাগজ। কিন্তু দৈনিক কাগজ। তাতে সিনেমা আছে, সাহিত্য আছে, রাশিফল আছে। সবই আছে একটু একটু করে।
অফিস ক্যান্টিনে শ্রীনিবাসবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দৈনিক প্রভাত-এর পাতায় পাতায় টুকরাে টুকরাে লেখা বেরােয় তাঁর। আমরা তারিফ করি। শ্রীনিবাসবাবু ধীর গলায় বলেন, যদি একখানা কাগজ করতে পারতাম— স্বাধীনভাবে।
ডেইলি পেপার? সে তাে অসম্ভব। অন্তত তিন-চার কোটি টাকা দরকার।
ডেইলি নয় রথীনবাবু—ডেইলি নয়। মনােমতাে একখানা মাসিক ম্যাগাজিন। বাঙালির ঘরে ঘরে থাকবে। দুটি ভালাে প্রবন্ধ। রিভিউয়ের জন্যে বারােটি পাতা দেব। বাছাই ছােটোগল্প একটি কি দুটি। একখানা সম্পূর্ণ উপন্যাস।
বারাে পাতা রিভিউ কি সাহিত্যের ওপর।
না। ভালাে বই পেলে রিভিউ হবে। তা ছাড়া নিয়মিত সমালােচনা থাকবে এন্টারটেইনমেন্ট জগতের ওপর। স্ক্রিন কিংবা স্টেজ পার্সোনালিটির ওপর আলাে ফেলা হবে আলাদা লেখায়।
এসব কথা যখন শ্রীনিবাস সরকার বলতেন—তখন দৈনিক প্রভাত-এর থার্ড ফ্লোরে এলাহি আলাের ভেতর আমি এলাহি অপব্যয় দেখতে পেতাম। দেখতে পেতাম—কত বড়াে সব মােটা মাইনের অপদার্থ হে হে করে হেসে জর্দা পান চিবিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। মাসের শেষে মাইনে নিচ্ছে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আর এই অতিকায় নিস্পৃহ খবরের কাগজের অফিসটার ভেতর অবহেলায় অবহেলায় শ্রীনিবাসের মতাে একটা সিংহের বাচ্চা আস্তে আস্তে বিড়ালের বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। সিগারেট সবচেয়ে শস্তা। স্যান্ডেল কঁচা চামড়ার। ধুতি লাল পেড়ে কোরা। পাঞ্জাবির পিঠটা ফাটা। হাত-পায়ের মােটা শিরা দাগড়া হয়ে ফুলে ওঠে হাঁটাচলায়। তবু ওরই ভেতর ওঁর লেখা একটা-দুটো বেরােতে লাগল।
বসার টেবিল-চেয়ার নেই। খাবার জল বারােয়ারি গ্লাসে। ক্যান্টিনের শস্তার চা বারবার খেয়ে তাকে খাদ্য মনে করায় প্রশান্তি। এইসব নিয়েই শ্রীনিবাস সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন।
খবরের কাগজে যশােপ্রার্থী তাে এসেই থাকেন। মন্দভাগ্য হলে মনােকষ্টে ফিরেও যান। এ তাে দেখেই আসছি। কথায় কথায় একদিন শ্রীনিবাস বললেন, স্ক্রিন বা স্টেজ পার্সোনালিটি নিয়ে যদি লােকের কৌতুহল থাকে তা লেখক, ঔপন্যাসিক, কবিকে নিয়েও লােকের কৌতুহল আছে। একজন নভেলিস্টকেও সিনেমার হিরাের মতাে ট্রিট করা দরকার।
লােকটা যখন এইসব আইডিয়ায় টগবগ করে ফুটছে—তখন আমি ওঁর। সঙ্গে শস্তার দিশি খাচ্ছি হয়তাে বারদয়ারিতে—কিংবা বাগবাজার ঘাটের সিডির খাঁজে বসে—গঙ্গাকে সামনে রেখে। মাসান্তে তখন ওর লেখা থেকে দৈনিক প্রভাত-এ বিল যা যেত কুল্লে একশাে টাকার। পুরােনাে দিনের কোনাে অভিনেত্রী মারা যেতে হয়তাে বাইশ লাইন লিখেছিলেন। তার জন্যে এখানে ভাউচার হয়েছে চল্লিশ টাকার। সেই বাইশ লাইনের ভেতর কিন্তু বলা আছে—মধ্য যৌবনে নিভাননী সাতশিরার জমিদারের সান্নিধ্যে এসে বরানগরের বাগানবাড়িতে উঠে আসেন। সেই লাইনটি কিন্তু দৈনিক প্রভাত-এর সাতচল্লিশ লক্ষ পাঠকের মনে গেঁথে গেল।
রথের রশি কিংবা অনাদি অনন্ত-র পাশে দৈনিক প্রভাত কিন্তু অতিকায় ডাইনােসাের। তার উঠতে-বসতে আড়মােড়া ভাঙতে সময় লাগে। তাই লাইনাে থেকে অফসেটে যেতে দৈনিক প্রভাত-এর ভেতর ভূমিকম্প চলছিল। রােটারির ঢালাই প্লেট থেকে একলাফে একেবারে সারা পাতার ছবি তুলে ক্যামেরার মেরামতি অনেকেরই সহ্য হচ্ছিল না।
ঠিক এই সময়ে শ্রীনিবাস সরকারও দৈনিক প্রভাত-এ অনেকের চোখে অসহ্য হয়ে উঠলেন।
যে-কিনা এর ওর টেবিলের কানাতে প্যাড রেখে লিখত—সে এখন বড়াে বড়াে অ্যাসাইনমেন্ট লিখছে। দৈনিক প্রভাত-এর স্পেশাল নাম্বারে সেইসব লেখা ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন করে বেরােতে লাগল। এক-একজন বড়াে পার্সোনালিটিকে নিয়ে। যেমন—
কানাকেষ্ট ও মিসলাইট।
সরযূদেবীর লাহিড়ীমশাই। বড়ুয়ার জীবনে নানান নারীর প্রবেশ ও প্রস্থান। দুর্গাদাসের মানভঞ্জনে চন্দ্রাবতী।। পঙ্কজ মল্লিক, রবীন মজুমদার, সায়গল—কে নয়?
এমনি সব বিষয়। হারানাে চিঠি, যৌবনের ছবি, সাকসেসের চূড়ায় নয়তাে বিষাদের পায়ের নীচে—এমনি সব জিনিস দিয়ে সাজিয়ে তােলা সেসব বিষয় পাঠকের মন কাড়বেই। এই হল গিয়ে শ্রীনিবাসের ওপর সবার মনে জ্বালা ধরে যাওয়ার কারণ।
ঠিক এই সময়ে শ্রীনিবাস বললেন, আবার একখানা উপন্যাস লিখে দিন না।
আমি? কোথায় ছাপাবেন? | হ্যা আপনি। ছাপাবার চিন্তা তাে আমার। ঠিক যেভাবে আপনি কথা বলেন—সেই ভাষায়—সেই ভঙ্গিতে লিখে দিন। আপনার গল্প আমার ভালাে লাগে। অনেককে পড়িয়েছি। তারাও ভালাে বলে—
তবু কী রথীনবাবু? লিখতে বলেছি—লিখে ফেলবেন। আর কোনাে শারদীয় সংখ্যা লেখা চেয়েছে কি?
আমার কাছে কেউ চায় না। এই তাে আমি চাইছি। দিন—লিখে দিন এবারে। কার হাত দিয়ে লেখা বেরােয় আমি জানি। রথের রশি-তে থাকতে তারাশঙ্করবাবুর কাছে লেখা চাওয়া হয়েছে। উনি বললেন, এবার বাদ দাও। লেখা আসছে না। আমি টালায় গিয়ে বসে থেকে লেখা নিয়ে এলাম। পঞ্চপুত্তলী’ সেবার ওঁর কলম দিয়ে বেরােল। অনন্তদা আমাকে পুজো সংখ্যার জন্যে দুশাে দুইতেও পাঠিয়েছেন। বুদ্ধদেব ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আমি গিয়ে বসে থেকেছি। উনি লিখেছেন—তবে কপি নিয়ে অফিসে ফিরেছি। আপনি লিখুন তাে মশাই—
লিখে ফেললাম। লেখাটা ছাপাও হল। সঙ্গে সুন্দর ইলাসট্রেশন। কাগজের নামও চমৎকার। রাজেশ্বরী।
নিন্দুকরা বলল, ওটা শ্রীনিবাসের ব্রেইনচাইল্ড। এইবার বেরােল। আর বেরােবে না। কার ঘাড় ভেঙে বের করেছে দ্যাখাে। উপন্যাস তাে ছাপল আপনার। আপনি টাকা পেয়েছেন?
সত্যিই পেয়েছিলাম। আগাম দিয়েছিলেন শ্রীনিবাস সরকার। নগদ চারশাে টাকা। বললাম, হুঁ। পেয়েছি।
কত ?
টাকার অঙ্কটা ভাঙলাম না। নিন্দুকরা হেসে বলল, ফাইনানসিয়ার যা দিয়েছে—তা শ্রীনিবাস লেখকদের দেননি। কিছু কিছু করে নিজের জন্যে কেটে রেখেছেন। আমি আর যাচাই করে দেখিনি। যদি তা সত্যিই হয়—তাতেই বা কী? রাজেশ্বরী-র মতাে সাজানাে-গােছানাে পুজো সংখ্যা তাে দৈনিক প্রভাতও বের করতে পারেনি। কী অল্প মালমশলা নিয়ে কী কাণ্ড করে ফেলতে পারে লােকটা।
এরপর আরও কানে আসতে লাগল—দেশে শ্রীনিবাসের একটি পরিবার আছে। তা ছাড়া কলকাতায় আছে আরেকটি। দুই চরম মিলিয়ে বিশাল ব্যান্ডপার্টি। এরপরেও নাকি বদখরচে শ্রীনিবাস সরকারকে কবিরাজের গলিতে রাত কাটাতে যেতে হয়। এইসব মাইফেলে তার সাগরেদ বন্ধুও আছে।
কথাগুলাে শুনেছি। যাচাই করিনি কোনােদিন। কেননা, আমি যে মাস্টারমশাই! সামনাসামনি যেটুকু দেখছি—অসম্ভব সাহিত্যমনস্ক মানুষ। কাজে তুখােড়। মুখে কোনাে দম্ভ নেই। মৃদুভাষী। ট্রামে সেকেন্ড ক্লাসে চড়েন। সিগারেট খান সবচেয়ে শস্তার। পায়ে স্যান্ডেল। গায়ের পাঞ্জাবিটি ঘেঁড়া।
ওঃ! বলতে ভুলে গেছি। রাজেশ্বরী-তে ছাপা আমার সে-উপন্যাস প্রভাতের সবাই খুব প্রশংসা করল। আমি মনে মনে বললাম—ভাগ্যিস
শ্রীনিবাসবাবু লিখতে বলেছিলেন। নয়তাে লেখাই হত না।
এখন বুঝি, শ্রীনিবাসের রক্তে সম্পাদনা। লেখা চাওয়ার ভেতরে শ্রীনিবাস সম্পাদকের উৎসাহ, আবেগ ভরে দিতে পারেন—যা কিনা একজন লেখককে লেখক করে তােলে। সে লিখে ফেলে।
রাজেশ্বরী দেখে শ্রীনিবাসকে ডাকলেন দৈনিক প্রভাত-এর কর্তা। ওদের সাপ্তাহিকে খুব খারাপ ছাপা হচ্ছিল। প্রুফ শােধরাতে পারবে?
শ্রীনিবাস বললেন, খুব পারব। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী! চেষ্টা কাকে বলে তা টের পেল প্রেস। শ্রীনিবাস গ্যালি ধরে ধরে পাতায় পাতায় কারেকশন হয়েছে কিনা চেক করে। কোনাে ঝগড়া নেই। হাসিমুখ। প্রুফ শােধরাতে গিয়ে শ্রীনিবাস কপিও দেখতে লাগলেন। মাস ছয়েকের ভেতর দেখা গেল সাপ্তাহিক হেসে উঠেছে। নতুন নতুন বিষয়ে লেখা বেরােচ্ছে। কর্তারা এই প্রথম একজন প্রুফ শােধরানাের লােককে সিধে সম্পাদকের পরের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা দাঁড়াল : সাপ্তাহিকে শ্রীনিবাস বিনে গতি নাই। তাতে বাঙালির অফিসে যা হয়—তাই হল। কমােশন। সবাই হাত গুটিয়ে নিল।
তখন শ্রীনিবাস সরকারেরও কুছ পরােয়া নেই ভাব এসে গেছে। সবাই হাত গুটিয়ে নিয়েও সাপ্তাহিকের হাসি হাসি ভাব আটকাতে পারল না।
এতদিনে আমি শ্রীনিবাসকে কিছু কিছু জেনে ফেলেছি। হ্যা, দেশে ওর বড়াে বউ থাকেন। কলকাতার বাড়িতে ছােটো বউ। দুই তরফ মিলিয়ে আট-দশটি ছেলেমেয়ে। বাঁচোয়া যে বাড়িভাড়াটা খুব কম লাগে। সরকারি ফ্ল্যাট। আর ছেলেরা একটু ডাগর হয়ে উঠতেই এক-একজন এক-একরকম দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ তখনাে বিশেষ কিছু করে না। কিন্তু এক ছেলে রেশন, অন্য ছেলে বাড়িভাড়া, আরেক ছেলে মাসকাবারি মুদির দায়িত্ব নিয়েছে। শ্রীনিবাস সরকার হাসতে হাসতেই বললেন, আমি নিত্যকার কাচা বাজারটা করে দিই। আর ধােপা-নাপিত সামলাই।
আপনি তাে এখন দৈনিক প্রভাত-এ ভালাে মাইনে পান। এই তাে জীবনে প্রথম পাচ্ছি এমন মাইনে—তাও পঞ্চাশ পেরিয়ে দু-হাজারের ওপর মাইনে পাচ্ছেন। ট্রান্সপাের্ট অফিসের। এবার সংসারটা গুছিয়ে তুলুন।
তুলব কী? মাসকাবারি মুদির ধার শােধ হচ্ছে কিস্তিবন্দিতে। বড়াে ভালাে লােক—আমায় কোনােদিন অপমান করেনি। বলেছে—যা দরকার নিয়ে যান। অবস্থা ফিরলে শােধ করবেন। ভালাে কথা—একখানা জমজমাট নাটক লিখে দিন তাে। সবরকম রস তাতে চড়া পর্দায় বাঁধবেন। লােক অভিনয় দেখে হাসবে। কাঁদবে। লুটোপুটি খাবে। একটু অবাস্তব হওয়া চাই। অবাস্তব জিনিসই পাবলিক খায়—
কেন? সাপ্তাহিকে ছাপবেন?
না। আপনি লিখুন না। আপনার হাত দিয়ে হবে। আমি বলছি হবে। আমি জানি আপনি একা একা নানা ব্যাপারে গজরান। একা একা কথা বলেন। আপনি পারবেন।
আমায় লক্ষ করেছেন তাে আপনি।—বলেও আমার মনে পড়ল— শ্রীনিবাসবাবুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর এই দশ-বারাে বছরে আমিও অনেক পাল্টে গেছি। নানারকম গল্প-উপন্যাস লিখেছি। পঞ্চাশের দিকে চলে এসেছি। আগে যাঁদের খুব মহান মস্ত ভেবেছি—তাঁদের আর তেমন বড়াে বা কেউকেটা মনে হচ্ছে না।
নাটকখানা লিখে শ্রীনিবাস সরকারের হাতে দিলাম। পরদিন তিনি বললেন, পড়লাম। আমি এর পালারূপ দেব।
কীরকম?
আপনার এই লেখা সারা দেশের মাঠেঘাটে এক এক নাইটে হাজার হাজার মানুষ দেখবে। যাত্রায় খুব জমবে—
আপনি যাত্রা করছেন নাকি?
করে দেখাই যাক না। আপনি জানেন—মেইনল্যান্ড চায়নার বাইরে সারা পৃথিবীতে প্রায় চার কোটি চিনে ছড়িয়ে আছে? ইন্ডিয়ায় মূল ভূখণ্ডের বাইরে কত ভারতীয় ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে—জানেন?
আমি মাথা নাড়লাম।। প্রায় দুই কোটি। তা ভাবুন অখণ্ড বঙ্গের ওয়ান থার্ড নিয়ে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ। তা এই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সারা ভারতে কত ছড়িয়ে আছে জানেন ?
আবারও আমি মাথা নাড়লাম।
বহির্বঙ্গে বাঙালি বইখানা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। গত দেড়শাে বছর হাজার হাজার বাঙালি সারা ইন্ডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে আসাম—এদিকে বিহার, ওড়িশা, এম পি, ইউ পি—সব জায়গায় বাঙালি পুজোর সময় যাত্রা দেখার জন্যে এগিয়ে যান। ভাগলপুর, পুর্ণিয়া, মজঃফরপুর, ঝাসি, বিলাসপুর, নাগপুর, লখনউ, কানপুর—যেখানে যাবেন—আজও অনেক বাঙালি চাক বেঁধে রয়েছে। আমি ওদের ঘুরে ঘুরে যাত্রা দেখাব।
কিন্তু ব্যাপারটা তাে অনেক টাকার। সাকসেস যেমন আছে—ফেইলিওরও আছে।
কোন জিনিসে নেই বলুন তাে?
তার পরের দিনের খবর—সাপ্তাহিকের অফিসে বেলা তিনটে নাগাদ একটা ফোন আসে। শ্রীনিবাসবাবু আছেন?
সবাই দেখেছে—শ্রীনিবাস ফোন ধরে কী যেন বলেছিলেন। তারপর ফোন নামিয়ে বললেন, পানের দোকান থেকে পান খেয়ে আসি একটা।
সেই যে বেরিয়ে গেলেন শ্রীনিবাস–ফেরেননি। একদিন গেল—দুদিন গেল। এক সপ্তাহ গেল। শ্রীনিবাস উধাও। বাড়িতে লােক পাঠানাে হল। ফিরে এসে বলল, ভােরে বেরিয়ে গেছেন।
মাসখানেক পরে একদিন আকাশবাণীর বিবিধভারতীতে অফিসের কে যেন শুনে এসে বলল, শ্রীনিবাস সরকার তাে যাত্রার দল খুলেছে। কার ঘাড় ভাঙল।
নিন্দুকেরা মনে মনে বলল, যাক! আপদ বিদেয় হল !!
ভাবলাম, মােটা মাইনের চাকুরিটা শেষ বয়সে এসে রাখতে পারলেন না শ্রীনিবাস সরকার।
আশ্চর্যের কথা—অফিস যা কোনােদিন করে না—তাই করল। সিধে শ্রীনিবাসের বাড়ি চিঠি গেল : আগামী এক বছরের ভেতর যেকোনােদিন ইচ্ছে— আপনি এসে কাজে যােগ দিতে পারেন। যােগ দিলে আপনার চাকরিতে কোনাে ছেদ পড়বে না।
আমরা বিবিধভারতীতে প্রায়ই শুনি—
জনরঞ্জনের গণচিত্তজয়ী অমর পালা
দুঃখের পায়রা
পালাকার : রথীন দত্তগুপ্ত
শ্রেষ্ঠাংশে…
প্রধান কর্মাধ্যক্ষ
শ্রীনিবাস সরকার
১৭/৩ রবীন্দ্র সরণী, ফোন…
নায়েকগণ গদিঘরে যােগাযােগ করুন
ভাবি, ম্যাগাজিনের মানুষটা শেষমেশ যাত্রায় চলে গেল! কী কুক্ষণেই যে নাটকখানা লিখতে গেলাম। কে ভেবেছিল—একেবারে যাত্রা করে ফেলবে? দুটি পরিবার—আট-দশটি ছেলেমেয়ে—দুখানা সংসার—সব এবার পথে ভাসবে—পথে ভাসবে।
অফিসে কেউ কেউ আমায় দুষল। কী দরকার ছিল আপনার পালা লেখার ? দিব্যি মানুষটা কাজ করে খাচ্ছিল। এখন যদি ভাসে তাে সবাইকে নিয়ে ভাসবে।
যত বলি—মশাইরা—পালা আমি লিখিনি। লিখেছিলাম—নাটক।
তা কেউ বিশ্বাসই করে না। সবাই বলে—রেডিও বলছে—পালাকার রথীন দত্তগুপ্ত—দুঃখের পায়রা—আজ মেদিনীপুরের কর্নেলগােলায়—কাল নদীয়ায় হাঁসপুকুরিয়ায়—আর আপনি বললেন—আপনি লেখেননি—লিখেছেন নাটক?
হা মশাই—আমি পালা লিখতে জানি না। দিব্যি জানেন। আপনিই সংসারী লােকটাকে ফুসলিয়ে যাত্রায় পাঠিয়েছেন। ভালাে কথা!—বলে চুপ করে যাই।
এরপর বিবিধভারতী থেকেও শ্রীনিবাস সরকার একদিন উধাও হয়ে গেলেন। খবর পেলাম—তিনি সকালে বিলাসপুরে পাড়ি দিয়েছেন। যাবেন অমরকন্টক অব্দি। পাশে সিমেন্ট কারখানা—কাঠগােলা এলাকায় পালা দেখিয়ে দেখিয়ে এগােবেন।
খবর দিয়েছিল ওঁরই বড়ােছেলে অবিনাশ। বছর বাইশ বয়স হবে।
বাবা বিলাসপুরে। ছেলে কলকাতার গদিঘর পাহারা দিচ্ছে। খবর দেওয়া নয় আসলে। খবর নিতে এসেছিল। বলেছিল, বলুন তাে, তিনমাস হতে চলল বাবা কিছু পাঠায় না। না চিঠি। না টাকা।
এরও সাত-আট মাস বাদে গরমের ঘেমাে কলকাতায় ধর্মতলায় দেখা হয়ে গেল শ্রীনিবাস সরকারের সঙ্গে। টাকের বর্ডারের চুলগুলাে পাকা। মাংসের প্রলেপ ঠেলে হাড় জেগেছে। বললেন, আপনার নাটকটার কোনাে দোষ নেই। কিন্তু প্রবাসী বাঙালি তাে, ওরা ঠিক বিরহ বােঝে না। তাই দুঃখের পায়রাকে নিল না।
এখন কী করবেন?
দেখি। তিন-চারটে প্রােপােজাল আছে হাতে। একটা আয়ুর্বেদ নার্সিংহােম খুলতে পারি দেশের বাড়িতে। এক নেপালি কবিরাজকে মিট করলাম ফৈজাবাদে। সে ইন্টারেস্টেড। কিন্তু বাজারে বিরাট লােন হয়ে গেল যাত্রা করতে গিয়ে দৈনিক প্রভাত-এ ফিরে আসুন। বাঁধা চাকরি। মাস গেলে মাইনে পাবেন।
সেজন্যেই তাে যাব না। ফি সপ্তাহে সেই থােড়বড়ি খাড়া। ও আমার ভাল্লাগে না।
ভুলে যাবেন না আপনি একজন ফ্যামিলি ম্যান।
আপনিও তাে রথীনবাবু একজন ফ্যামিলি ম্যান। ফি বছর পাতার পর পাতা। লিখে চলেছেন—অথচ কেউ আপনার লেখা পড়ে না। তবু লেখেন কেন?
মনে মনে বললাম, তাহলে ডােবাে।
ক-মাসের ভেতর শ্রীনিবাস সরকার আবার ভেসে উঠলেন। এবার তিনি পুরােনাে নৌকোয়। কাগজ। অন্য কাগজে চড়া রেটে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশকরা জেরবার। অতএব নিজেদের কাগজ হলে চড়া রেটের হাত থেকে রেহাই—আবার নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপনও হয়ে গেল।
আইডিয়াটা দারুণ। আজকাল লােকেরা আলাদা করে বই কেনে কম। যা কিছু কেনাকাটা লাইব্রেরিগুলাের। তাদের কাছে এ-কাগজ পাঠালেই বইয়ের বিজ্ঞাপন হয়ে যায়। বইয়ের দামও আগুন হয় না তাহলে।
রমরম করে চলতে লাগল প্রকাশকদের কাগজ। রাস্তায় দেখা অবিনাশের সঙ্গে। বলল, আমি বাবাকে অ্যাসিস্ট করছি।
তুমি কোনাে মাইনে পাচ্ছ? বাবা আর আমাকে ধরে একটা কনসােলিডেটেড পে দেয়। খারাপ নয়।
এতদিনে আমিও বুড়াে হয়েছি। জানতে পেরে গেছি—মাত্র দুশাে কপি বিক্রির বঙ্গদর্শন তার মৃত্যুর পরেও সেনচুরি ক্রস করেও তার লেখককে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যের নাম্বার ওয়ান লেখক করে রেখেছে—কিন্তু হাজারে হাজারে বিক্রির সাপ্তাহিক, মাসিকরা তাদের লেখকদের মৃত্যুর পরে দশ বছরের | বেশি আয়ুরও গ্যারান্টি দিতে পারছে না। ঝকঝকে ছাপা হাউস ম্যাগাজিনগুলাে যেন খানিকটা বাটা খানিকটা টাটার কর্মচারীদের জন্যে বাড়ি থেকে ছাপানাে পত্রিকার দশা। ওখানে যারা লেখে তাদের লেখককে গােগ্রাসে গেলে বই হয়—হাজারে হাজারে বিক্রি হয়—তারপর লােকে ভুলে যায়। নতুন জন্মানাে মানুষরা তাে পড়ে না।
শ্রীনিবাস বললেন, এখন রথীনবাবু ছােটো কাপড়ের কল চলে না। ছােটো বইয়ের দোকানও চলবে না। দেখছেন না—আচারের ব্যবসা আর কুটিরশিল্প নেই। তার জন্যে দরকার হচ্ছে খাদি গ্রামােদ্যোগ শিল্প। তঁাত চলে গেছে পাওয়ারলুমে। টিকে থাকার জন্যে বানালে শার্টিং, স্যুটিং। পাঁপড়ের বিজ্ঞাপন বেরােচ্ছে মােটরগাড়ির বিজ্ঞাপনের মতাে ঢাউস করে।
তাহলে আপনার এই কাগজ চলবে কী করে?
আমরা খদ্দেরকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি। সিধে তার কাছে যেতে পারছি বলে চলছে। খদ্দেরকে এই খুঁজে বের করাটাই আসল। একবার পারলে মার্কেটিং ব্যাপারটা জল হয়ে যায়। আর খদ্দের খুঁজে বের না করে আপনি হাজার টাকার নােট ছাপুন না—তাও চলবে না। পাঁচ-ছ হাজার লাইব্রেরি জানতে চায়—কী বই বেরােল—কী বই বেরােল। আমরা সেইসব বইয়ের তালিকা সবচেয়ে আগে দিতে পারি। কেননা আমরা প্রকাশকদের ঘরের কাগজ। ফলে পাঠাগার আমাদের কাগজ নেবেই। আর জানি পুরােনাে লেখায় আগ্রহী বাঙালির অভাব নেই। তারাও নেবে আমাদের কাগজ। এর সঙ্গে জুড়ে দিন এখনকার কিছু লেখা। ব্যাস্! আর কী চাই। যাগগিয়ে! পুজো সংখ্যায় একখানা উপন্যাস লিখুন তাে আমাদের কাগজে।
লিখলাম। ছাপাও হল। কাগজ বিক্রিও হল ভালাে। কিন্তু শ্রীনিবাস সরকার এখানে নেই।
কী ব্যাপার? কথা ঠিক কানে ভেসে এল। যারা বই ছাপেন—ফলে প্রকাশক–তারা এই সাকসেসের টুকরােটুকুও শ্রীনিবাসকে দিতে রাজি নন। তাঁরা সবাই বুদ্ধিমান সম্পাদক হয়ে উঠলেন। যার যার নিজের ঘরের লেখকদের লেখা ছাপাতে শুরু করে দিলেন।
শ্রীনিবাস সরকার বললেন, ভরাডুবি অনিবার্য। আমি তার দায়ভাগী হব কেন?
বুদ্ধিমান সম্পাদকরা শ্রীনিবাসের মাইনে বাড়াতে চাইলেন। শ্রীনিবাস উধাও। তিনি এক ছােটোমােটো কাগজে আবার সামান্য সহকারী হয়ে উদয় হলেন। আবার প্রথম। আবার লেখা।
গরমের কলকাতায় সবচেয়ে শস্তার পানশালায় তাকে একদিন পেলাম। মহার্ঘ দিশি খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজের জিভে নুন ছড়িয়ে নিচ্ছেন। তাতে কিক হয় দ্রুত। বললেন, দিন না কোনাে ব্যাঙ্ক থেকে লাখ দুই বের করে। তাহলে মনের মতাে একখানা কাগজ করি। কত নতুন নতুন লেখক এসেছে। এই বিশ বছরে, আমি তাদের ক্যাটার করব। পাঠক ঠিক নেবে। এক-একজনের লেখা পড়ছি—আর চমকে চমকে উঠছি। অথচ ওদের লেখার জায়গা নেই কোনাে। কে ওদেরটা ছাপবে? ভালাে ভালাে লেখক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মশাই।
বুঝলাম, জহুরির চোখ আমাদের পর্ব পেরিয়ে আরাে অনেক অনেক গভীর শিকড়ের দিকে রওনা দিয়েছে। এর নাম কি বাঙালি? না, এটাই সেই অনুসন্ধানী বাঙালি মন—যে কিনা সবার গােচরে সবকিছু লক্ষ করে নতুন জিনিস গড়ে তােলে, বানায়। সেই নেশায়, সেই স্বপ্নে বুদ হয়ে থাকে। খালি গায়ে মাখে না। পৃথিবী আর তার বিপদের তােয়াক্কা করে না। শ্রীনিবাস ছাড়া আমরা কেউ তাে কিছু বানিয়ে তােলার গভীর স্বপ্নে ভুগছি না।
এরপর প্রায়ই না হলেও শ্রীনিবাস সরকারের সঙ্গে দেখা হতে থাকল। আমি বুড়াে হচ্ছিলাম। ব্যর্থ হচ্ছিলাম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিকড় গেড়ে বসে যাওয়া সব ধ্যানধারণার দাস হয়ে উঠছিলাম। নতুন কিছু কোনাে নতুন কেউ বললেই তার বিরুদ্ধে খঙ্গহস্ত হয়ে উঠছিলাম। কেননা আমার এই ঘষে ঘষে ওঠা জীবনের শান-বারান্দায় পাছে অন্য কোনাে কাক এসে বসে। আমার শান-বারান্দাটুকুতে বসে শুধু যে আমিই সারাদিনমান কা কা করব।
আমার বউ আমার ভাই আমার বাড়ি আমার লেখাপড়া আমার কী এক নিয়ে আমি যে এতদিনে একজন পুরােপুরি আন্মাে বাবু হয়ে উঠেছি। ওই শান বাঁধানাে বারান্দাটুকুই যে আমার সবেধন তাজমহল।
ছােটো একটি লাইট। রেকর্ড প্লেয়ারে কে মল্লিকের মিশ্র খাম্বাজ বাজছে—“আমি স্বপনে তাহাকে কুড়ায়ে পেয়েছি—রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া। উল্টোদিকের চেয়ারে শ্রীনিবাসের মাথায় তখন ডি এল রায় কাজ করছে। ঘরের আলাে লাে ভােল্টেজে ডিম—আমার বউ বলল, খেয়ে নাও তােমরারাত হয়ে গেছে অনেক।
সন্ধে থেকে অনেক কথা হয়ে গেছে আমাদের। ঘরের ভেতর সেই জ্বলন্ত কথাগুলাের ভেতর আমি শ্রীনিবাসের নতুন কাগজ দেখতে পাচ্ছিলাম। খাওয়াদাওয়ার পর বললাম, এখন বাস পাবেন না। শুয়ে থাকুন।
আমার বসার ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বললেন, ছােটো ভায়রাভাই তার ছাদটা দেবে। ভাবছি—একটা শেড় করে নেব।
কী করবেন? একশাে কেজি টাইপ কিনে নিয়ে বসে যাব। প্রেস করবেন ? অনেক ঝামেলা ! অনেক আগেই করা উচিত ছিল। কাগজের শেকড় তাে প্রেস। তাই না? কিন্তু কম্পােজিটারদের মাইনে। তাদের আবার ইউনিয়ন—
আমার ছােটো তিন ছেলেকে শেখাচ্ছি। তারাই নতুন প্রেসে কম্পােজিটার হবে।
বাঃ! চমৎকার আইডিয়া। বাবা—প্রেস মালিক। ছেলেরা কম্পােজিটার। গােড়ায় বত্রিশ পাতার কাগজ বের করব সেখান থেকে। বললাম, আলাে নিভিয়ে দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত হয়ে গেছে।
পরদিন ভােরে উঠে চা দিতে গিয়ে আমার বউ ফিরে এল। শ্রীনিবাসবাবু তাে চলে গেছেন।
তাই নাকি। বলে চা খেলাম। বাজারে গেলাম। ফিরে এসে দেখি গিন্নি চুপ করে বসে।।
বলল, দেখে এসাে ও-ঘরে।
বুঝে বসার ঘরে ঢুকে দেখি—খাটের ওপরের তােশক ওলটানাে। তাতে গােল করে জলের ছাপ।
বেরিয়ে এসে বললাম, কী ব্যাপার ? রাতে কি বাথরুম খুঁজে পাননি?
ওঃ! বাথরুম তাে সামনেই। হয়তাে চাপতে পারেন না।
তােমার বন্ধু তুমি রােদে দিয়ে এস। শুকোলে কাল একজন ধুনুরি ডাকবে। আমি তােশকটা ভাঙাব।
বারােয়ারি ফ্ল্যাটবাড়ি। সিঁড়ি থেকে সেই তােশক মাথায় করে ছাদে উঠলাম। রােদেও দিলাম। কোনাে ঘেন্না বা খারাপ কিছু লাগল না আমার। অনেক স্বপ্ন দেখতে হয়েছে শ্রীনিবাসকে। অনেক গর্তে আছাড় খেতে হয়েছে। হয়তাে প্রােস্টেট গ্ল্যান্ড ঢিলে হয়ে গেছে।
এর পরেও প্রকাশক পাড়ায় প্রকাশকদের দুয়ারে শ্রীনিবাস সরকারকে ঘুরতে দেখেছি। তার নতুন প্রেসের জন্যে পাবলিশারদের থেকে টেক্সট বইয়ের ফর্মা ছাপার অর্ডার নিচ্ছেন। ধর্না দিয়ে।
এই প্রকাশকদের কাগজেরই তিনি একসময় সম্পাদক ছিলেন।
আমায় দেখে হেসে এগিয়ে এলেন। টুকটাক কাজ করছি। প্রেসটা দাঁড়িয়ে গেলেই মনের মতাে কাগজ করব।