সপ্তম অধ্যায়
মহারাজ যশোধর মাণিক্যের অভিপ্রায় অনুসারে কল্যাণ বা “কল্যাণ মাণিক্য” আখ্যা ধারণ পূর্বক ত্রিপুরার রাজদণ্ড ধারণ করেন। (১০৩৫ ত্রিপুরাব্দে) আমরা বহু অনুসন্ধান করিয়াও তাঁহার পিতার নাম অবগত হইতে পারিলাম না। রাজমালা গ্রন্থে তাঁহাকে মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গগনফার বংশধর লেখা হইয়াছে। প্রাচীন বংশাবলিসমূহে তাঁহাকে যশোধর মাণিক্যের “জ্ঞাতি ভ্রাতা” বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। (৭৭)
কল্যাণ মাণিক্যের জন্ম সম্বন্ধে আমরা যে একটি প্রবাদ অবগত আছি, তাহাও বিস্ময়জনক। কথিত আছে, তাঁহার পিতা একদা কতিপয় সৈন্য সমভিব্যাহারে মৃগয়া জন্য বনে গমন করেন। অশ্বারোহণে মৃগয়া করিতে করিতে স্বীয় অনুচরবর্গকে পরিত্যাগ করিয়া তিনি পলায়িত মৃগের পশ্চাদ্ধাবিত হইলেন। কিন্তু মধ্যাহ্নকালীন প্রখর সূর্যকিরণে তাঁহার পিপাসা প্রবল হইল। তিনি ইতস্তত জলান্বেষণ করিতে করিতে এক বাছাল[১] প্রজার গৃহে উপস্থিত হইয়া জলপান পূৰ্বক শান্ত হইলেন বটে কিন্তু সেই পরিবারের একটি বিধবা যুবতীকে দর্শন করিয়া কাম-বিমোহিত হইলেন। যুবতিও রাজ-বংশীয় যুবক কর্তৃক প্রার্থিত হইয়া আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিয়া সহর্ষচিত্তে তাঁহাকে আত্ম সমর্পণ করিলেন। সেই সহযোগে ত্রিপুর কুলরত্ন মহাত্মা কল্যাণ মাণিক্য জন্মগ্রহণ করেন। বাছালেরা আজিও এই প্রবাদটির উল্লেখ করিয়া আপনাদের গৌরব করিয়া থাকে।
ইদানীন্তন ভূপতিগণ মধ্যে কল্যাণমাণিক্য একজন পারাক্রান্ত ও বলশালী নরপতি ছিলেন। কিন্তু অমর মাণিক্যের পুত্রগণ আরাকান যুদ্ধে একটি মুকুটের জন্য বিরোধ করিয়া যে ক্ষতি করিয়া গিয়াছেন, তাহা তিনি সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করিতে (৭৮) পারেন নাই। ভবিষ্যতে কেহ পারিবে বলিয়াও আমরা আশা করিতে পারি না। তাঁহার রাজ্যাভিষেকের পূর্বেই ত্রিপুরার দক্ষিণ সীমা খবীকৃত হয়। পশ্চিম দিগে মুসলমানগণ অনেকগুলি পরগণা অধিকার করিয়া তাহা স্থায়ীরূপে মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত করিয়াছিলেন।
মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান, এবং বাহুবল সম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তিনি ত্রিপুরার ছিন্ন ভিন্ন সৈন্য সমূহ একত্রিত করিয়া সুশিক্ষিত করিয়াছিলেন। মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য মোগলগণকে দূরীকৃত করিয়া পুনর্বার খববীকৃত ত্রিপুরার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু সমগ্র ত্রিপুরারাজ্য তিনি অধিকার করিতে পারেন নাই। তাঁহার শাসনকালে সৌরমঙ্গল[২] উপকূলের ওলন্দাজ গবর্ণর বান ডিন ব্রোকে লিখিয়াছেন :- “ত্রিপুরা এবং উদয়পুর রাজ্য স্বাধীন, কিন্তু কোন সময় মোগল সম্রাট, কখন বা আরাকান রাজ ইহা অধিকার করিয়াছেন।[৩] (৭৯) বান ডিন ব্রোকের কৃত মানচিত্রে পর্বত ও অরণ্যময় ত্রিপুরা রাজ্য স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ রূপে চিত্রিত রহিয়াছে।[৪] কিন্তু উক্ত মানচিত্র দ্বারা তদানীন্তন ত্রিপুরারাজ্যের সীমা রেখা বিশুদ্ধ রূপে নির্দ্দেশ করা নিতান্ত দুরূহ। ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বিশুদ্ধভাবে “ভুলুয়া” চিত্রিত রহিয়াছে। আরাকান ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে “কোডাবাস্কাম” নামে আর একটি রাজ্য চিত্রিত হইয়াছে। ইহাকে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্ণয় করিতে পারি। ত্রিপুরার পশ্চিম দিকে ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরে “অসুই” এবং “উদিসি” নামে দুইটি ক্ষুদ্র রাজ্য চিত্রিত রহিয়াছে। উক্ত “অসুই” এবং “উদিসির” প্রকৃত নাম নির্ণয় করা অধুনা সুকঠিন। আমাদের বিবেচনায় এই দুইটি স্থান আধুনিক ময়মনসিংহের পূর্বাংশ ও ঢাকা জেলার উত্তর পূর্বাংশ অনুমিত হয়।
মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য “হরগৌরী” নাম স্বীয় নামের সহিত সংযুক্ত করিয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। তিনি নূতন পদ্ধতি অবলম্বন পূর্বক রাজকুমারদিগকে “ঠাকুর” আখ্যা প্রদান করেন। অদ্যাপি ত্রিপুর-রাজ পরিবারস্থ ব্যক্তিগণ সেই আখ্যায় আখ্যাত হইয়া থাকেন। মহারাজ কল্যাণ মাণিক্যের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তাঁহার এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন, তাহার নাম গোবিন্দদেব (৮০) ঠাকুর। তাঁহার অভিষেকের পর তিনি যে রমণীর পাণি গ্রহণ করেন, তাহার গর্ভে এক পুত্র ভূমিষ্ঠ হন, তাহার নাম “নক্ষত্ররায়” বা “নক্ষত্র ঠাকুর”। তাঁহার তৃতীয় পুত্রের নাম জগন্নাথ ঠাকুর এবং চতুর্থ পুত্র রাজবল্লভ ঠাকুর। মহারাজ কল্যাণমাণিক্য তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র গোবিন্দদেব ঠাকুরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন।
কল্যাণমাণিক্যের শাসনকালে বাঙ্গালার শাসনকর্তা সুলতান সুজা ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু কল্যাণ মাণিক্যের বাহুবলে মোগলগণ পরাজিত ও ত্রিপুরা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
মহারাজ কল্যাণমাণিক্য সমস্ত ত্রিপুরা রাজ্য ভ্রমণ করিয়া ব্রাহ্মণ এবং দুঃখী প্রজাগণকে বাসনানুরূপ ভূমি ও অর্থদান করিয়াছিলেন। তিনি তাম্রশাসন দ্বারা অনেক নিষ্কর ভূমি প্রদান করিয়াছিলেন। তৎপ্রদত্ত কয়েকখণ্ড তাম্রশাসন আমাদের হস্তগত হইয়াছে। পরিশিষ্টে তাম্রশাসনের প্রতিলিপি প্রদত্ত হইল।
মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য “কল্যাণসাগর” নামক বৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। তদনন্তর তিনি কৈলারগড় দুর্গমধ্যে কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তর নির্ম্মিত সিংহবাহিনী, মহিষাসুরমর্দ্দিনী দশভূজা ভগবতী মূৰ্ত্তি সংস্থাপন করেন। ঐ প্রতিমার নিম্নভাগে একটি শিবলিঙ্গ খোদিত থাকায় কালী মূৰ্ত্তি বলিয়া ॥৮১॥ আখ্যাত হয়।[৫] এই দেবীর সুদৃঢ় ইষ্টক মন্দির দুর্গমধ্যস্থিত উচ্চভূমিতে অবস্থিত। মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য এই মন্দিরের নির্ম্মাণ কার্য্য শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই। কারণ মন্দিরের দক্ষিণদিকস্থ খোদিত লিপিতে আমরা “সং ১০৯৭” প্রাপ্ত হইয়াছি। মহারাজ কল্যাণমাণিক্য ১০৬৯ ত্রিপুরাব্দে মানবলীলা সম্বরণ করেন। তৎপরবর্ত্তী ৩০ বৎসরে মন্দিরের নির্ম্মাণ কার্য্য সমাধা হইয়াছিল। এই মন্দিরের গঠন প্রণালী উল্লেখযোগ্য বটে। ইহার চতুষ্কোণ প্রাচীরের পরিসর চতুদিকেই ৪ হস্ত এবং মধ্যস্থান ৪ হস্ত, সুতরাং উভয়ই, দৈর্ঘ ও পরিসর দ্বাদশহস্ত পরিমিত।
এই মন্দির নির্ম্মাতা যে যুদ্ধ বিদ্যা বিশারদ ছিলেন, মন্দিরের দ্বারদেশে দণ্ডায়মান হইলেই তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে। দুর্গের পশ্চাৎভাগে অনন্ত বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী বিরাজিত রহিয়াছে। তাহার সম্মুখভাগে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্র। দূরবীক্ষণ কিম্বা চক্ষু দ্বারা যতদূর দৃষ্টি সঞ্চালিত হয় তত্তাবৎ সমতলক্ষেত্র করতলস্থ রেখার ন্যায় দৃষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু সমতল ক্ষেত্র হইতে এই মন্দির কিম্বা দুর্গ কিছুমাত্র লক্ষ্য হয় না। আমরা ইতিপূর্বে হুসন সাহেরকৃত বিজয়নদীর (৮২) তীরস্থিত যে সেনানিবাস ও গড়ের উল্লেখ করিয়াছি এই মন্দিরের দ্বারে দণ্ডায়মান হইলে অদ্যাপি তাহা বিশেষরূপে দৃষ্ট হইয়া থাকে। এই মন্দিরের গাথুনি এরূপ সুদৃঢ় যে দূরস্থিত কামানের গোলাতে তাহা সহজে বিনষ্ট হইবার নহে। মন্দিরের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণদিকে তিনখানি খোদিত প্রস্তর লিপি সংযুক্ত হইয়াছিল। উত্তর পার্শ্বের শিলালিপিতে যে কয়েকটি অক্ষর প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে তাহা পরিশিষ্টে প্রদত্ত হইবে। পূর্বপার্শ্বের লিপিখণ্ড সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। দক্ষিণ পার্শ্বের শিলালিপির অন্তভাগে কেবল “স ১০৯৭” অক্ষর দৃষ্ট হইয়া থাকে, অবশিষ্ট সমস্তই বিনষ্ট হইয়াছে। উক্ত দেবতার সেবা পূজা নির্বাহ জন্য পঞ্চদ্রোণ ভূমি দেবোত্তর প্রদান পূর্বক কল্যাণমাণিক্য “শাণ্ডিল্য” গোত্রজ বিশ্বনাথ শৰ্ম্মা নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বিশ্বনাথের বংশধরগণ অদ্যাপি সেই দেবোত্তর ভূমি ভোগ করিয়া দেবীর সেবা পূজা নির্বাহ করিতেছেন।[৬]
জেলা ত্রিপুরার মধ্যে ৪ খানা গ্রাম মহারাজ কল্যাণমাণিক্যের নামানুসারে “কল্যাণপুর” আখ্যায় পরিচিত। (৮৩)
সুলতান সুজার বাঙ্গালা শাসনকালে (১৫৮০ শকাব্দে) সুবে বাঙ্গালার যে সংশোধিত রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত হইয়াছিল তাহাতে সরকার উদয়পুর সংযুক্ত রহিয়াছে। ইহাতে বোধ হয় চরমাবস্থায় কল্যাণমাণিক্য কিয়ৎ পরিমাণে মোগলদিগের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন।
মহারাজ কল্যাণমাণিক্যের মৃত্যুর পর তদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ গোবিন্দদেব ঠাকুর ১০৬৯ ত্রিপুরাব্দে ‘মাণিক্য’ উপাধি ধারণ করেন। তিনিও কিয়ৎপরিমাণে মোগল সম্রাটের অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। গোবিন্দ মাণিক্যের সিংহাসন আরোহণে তৎকনিষ্ঠ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নক্ষত্র রায় নিতান্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। গোবিন্দ মাণিক্যের বংশধরগণ নিকট যে রাজমালা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে লিখিত আছে যে, “সুলতান সুজার সাহায্যে উপযুক্ত বল সংগ্রহ করিয়া কুমার নক্ষত্র রায় গোবিন্দ মাণিক্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন।” গোবিন্দ মাণিক্য ভ্রাতার অভিলাষ শ্রবণে বিবেচনা করিলেন, রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলে হয় ভ্রাতৃশোণিতে পৃথিবী রঞ্জিত করিতে হইবে, নতুবা সমরানলে স্বীয় প্রাণ আহুতি প্রদান করিতে হইবে। অতএব বিনাযুদ্ধে ‘রাজ্য’ পরিত্যাগ পূর্বক প্রথমত রিয়াংদিগের বাসস্থানে এবং তদনন্তর চট্টগ্রামের পর্বতমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। নক্ষত্র রায় সুজার অধীনতা স্বীকার করত ছত্রমাণিক্য নাম ধারণ পূর্বক (৮৪) সিংহাসন আরোহণ করেন।” কিন্তু নক্ষত্র রায়ের বংশধরগণ নিকট যে রাজমালা রক্ষিত হইয়াছে তাহাতে লিখিত আছে যে, “নক্ষত্র রায় ভীষণ যুদ্ধে গোবিন্দ মাণিক্যকে জয় করিয়া ত্রিপুর সিংহাসন অধিকার করেন।” এস্থলে কোন রাজমালার বর্ণনা সত্য, তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন হইলেও ভারতের তদানীন্তন ইতিহাস পর্যালোচনা করিয়া নক্ষত্ররায়ের বংশধরগণের নিকটে রক্ষিত রাজমালার উক্তি সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে আমরা বাধ্য হইয়াছি[৭]। ইহা নিতান্তই দুঃখের বিষয় যে, গোবিন্দ মাণিক্যের বংশধরগণ যে নক্ষত্র ও জগন্নাথের বংশধরগণকে সিংহাসন হইতে দূরে নিক্ষেপ করিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছেন, এমত নহে, তাঁহাদের উত্তর পুরুষগণ মধ্যে যাঁহারা অস্ত্রবলে কিম্বা কৌশলে সিংহাসন অধিকার করিয়াছেন, গোবিন্দ মাণিক্যের বংশধরগণ সেই সকল মহাপুরুষের চরিত্র নিতান্ত বিকৃতভাবে ইতিহাসপটে চিত্রিত করিয়াছেন।
কুমার নক্ষত্র “ছত্রমাণিক্য” নামগ্রহণ পূর্বক স্বাধীনভাবে ত্রিপুররাজ দণ্ডধারণ করেন; ১০৭০ ত্রিপুরাব্দে (৮৫) তিনি সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁহার একটি রৌপ্য মুদ্রার প্রতিকৃতি প্রকাশ করা হইয়াছে। সেই মুদ্রার প্রথম পৃষ্ঠায়- “শ্রীশ্রীহরগৌরী পদে মহারাজ শ্ৰীশ্ৰীযুত ছত্রমাণিক্য দেব” এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটি সিংহ ও তাহার নিম্ন ভাগে “শকাব্দ ১০৮২” ক্ষোদিত রহিয়াছে। তাঁহার শাসনকালে ফরাসী দেশীয় দুইজন বিখ্যাত ভ্রমণকারী ভারতের অন্তর্গত বিবিধস্থান পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন। একজন চিকিৎসা ব্যবসায়ী, তাঁহার নাম বর্ণিয়ার। দ্বিতীয় ব্যক্তি ফরাসীদেশীয় সম্ভ্রান্ত (ব্যরণ) বংশীয় বণিক, তাঁহার নাম জনব্যাপটিষ্টা টেবার্ণিয়ার। আমরা টেবার্ণিয়ারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত গ্রন্থে ত্রিপুরেশ্বর “মহারাজ ছত্রমাণিক্যের” নাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বর্ণনা প্রাপ্ত হইয়াছি। টেবার্ণিয়ার বলেন যে, মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমা আসাম, ত্রিপুরা আরাকান নামক তিনটি স্বতন্ত্র রাজ্যের সহিত সংযুক্ত। টেবার্ণিয়ার স্থানান্তরে লিখিয়াছেন যে, ত্রিপুরা রাজ্য হইতে স্বর্ণ ও তসর বাণিজ্যার্থ বিদেশে প্রেরিত হইয়া থাকে। কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্য সমুৎ- পন্ন স্বর্ণ সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নহে।
মহারাজ ছত্রমাণিক্য যৎকালে স্বীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতিকূলে অস্ত্রধারণ করেন, সেই সময় আর এক ভীষণ ভ্রাতৃবিরোধের দ্বারা সমগ্র ভারতভূমি নরশোণিতে রঞ্জিত হইতেছিল। (৮৬) মোগল সম্রাট সাহজাহানের দুর্বিনীত পুত্রগণ পিতার বর্তমানেই পৈত্রিক ময়ূরাসন অধিকার করিবার জন্য সমগ্র ভারতব্যাপী সমরানল প্রজ্জ্বলিত করিয়াছিলেন। মুসলমান ইতিহাস লেখক ও ফরাসী ভ্রমণকারীগণ উল্লিখিত যুদ্ধ বৃত্তান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করিয়াছেন। এস্থলে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।
সাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান সূজা বাঙ্গালার শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একজন দয়ালু, প্রজা প্রিয় শাসনকর্তা বলিয়া সর্বত্র খ্যাতি লাভ করেন।[৯] তাঁহার মহিষী পরিভানুর অসাধারণ বুদ্ধি গৌরব ও অত্যুজ্জ্বল রূপরাশির খ্যাতি ইতিহাস পটে চিত্রিত রহিয়াছে। রাজ্ঞী পরিভানুর গুণ-গীতি দীর্ঘকাল বঙ্গের সর্বত্র পরিকীর্ত্তিত হইত। কিন্তু এক্ষণ সেই সকল গ্রাম্যগীতি বিস্মৃতিসাগরে বিলীন হইয়া গিয়াছে।
আঔরংজেব ও মুরাদবক্সের সম্মিলিত সৈন্যের বাহু বলে সোমনগরের (ফতেয়াবাদ) যুদ্ধে যেরূপ ধূর্ত্ত আঔরংজেব বাবার সমস্ত আশা নির্মূল করিয়াছিলেন; তদ্রূপ আলাহাবাদের ৩০ মাইল দূরবর্ত্তী কিরগাঁর যুদ্ধে শঠচূড়ামণি আঔরংজেব, তাঁহার পাপিষ্ঠ সেনাপতি মিরজুস্লার বুদ্ধিবলে, সুলতান সুজার রাজ মুকুট লাভাশা চিরকালের তরে বিনাশ (৮৭) করিতে সক্ষম হন। কিরগাঁর যুদ্ধে পরাজিত হইয়া সুজা মুঙ্গেরের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আঔরংজেবের সৈন্যগণ তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছিল। তাঁহাদের উৎপীড়নে বাধ্য হইয়া তিনি মুঙ্গের হইতে রাজমহলে এবং তথা হইতে বঙ্গের প্রাচীন রাজধানী তাঁড়া নগরে;[১০] তদনন্তর তাঁড়া হইতে ঢাকা নগরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। আঔরংজেবের সেনাপতি মিরজুস্লা ঢাকা আক্রমণ করিতে প্রস্তুত হইলেন, এই সংবাদ শ্রবণে সুলতান সুজা সার্দ্ধৈক সহস্র অশ্বারোহী সৈন্যের সহিত ত্রিপুরা পর্বতের মধ্য দিয়া আরাকানে গমন করেন। কিন্তু বর্ণিয়ার বলেন যে, সুজা অর্ণবপোতারোহণে ঢাকা হইতে আরাকানে গমন করিয়াছিলেন।[১১] মুসলমান ইতিহাস লেখকদিগের মতে, সুলতান সুজা ব্রহ্মপুত্র নদী পার হইয়া রাঙ্গামাটীয়ার (ত্রিপুরার) পার্বত্য প্রদেশের মধ্য দিয়া আরাকানে গমন করিয়াছিলেন।[১২] আমাদের বিবেচনায় এস্থলে বর্ণিয়ারের বর্ণনা অপেক্ষা মুসলমানদিগের লিখিত বৃত্তান্ত সমধিক প্রত্যয়োগযোগী সুজা ত্রিপুরা পর্বতে প্রবেশ করিয়াছেন, এই সংবাদ শ্রবণ (৮৮) করিয়া সম্রাট আঔরংজেব ত্রিপুরেশ্বর সমক্ষে বন্ধুভাবে একখণ্ড পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। সেই পত্রে মোগল সম্রাট ত্রিপুরার স্বাধীনতা স্বীকার পূর্বক লিখিয়াছিলেন যে, ত্রিপুরেশ্বর বন্ধুর ন্যায় আমার শত্রুকে স্বীয় শত্রু বলিয়া জ্ঞান করিবেন এবং তিনি অনুগ্রহ পূর্বক আমার শত্রু সুজাকে ধৃত করিয়া স্বীয় সৈন্য দ্বারা মূঙ্গেরের দুর্গে প্রেরণ করিলে নিতান্ত উপকৃত হইব। কিন্তু এই পত্র ত্রিপুরায় পঁহুছিবার পূর্বেই সুলতান সুজা আরাকানে উপনীত হইয়াছিলেন।
সিংহাসন চ্যুত ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য চট্টগ্রামের পূর্বদিকস্থ পার্বত্য প্রদেশে বাস করিতেছিলেন।[১৩] সুজা ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী রাঙ্গামাটী হইতে পর্বত (৮৯) শ্রেণী অতিক্রম করত গোবিন্দ মাণিক্যের বাসভবনে উপনীত হন।[১৪] গোবিন্দ মাণিক্য সুজাকে অতি আদরের সহিত গ্রহণ করেন, এবং তিনি তাঁহাকে যথোচিত সাহায্য করিতে ত্রুটী করেন নাই। বিদায়কালে সুজা কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ স্বীয় ব্যবহাৰ্য্য বহুমূল্য “নিমচা” তরবারি ও একটি হীরকাঙ্গুরীয় গোবিন্দ মাণিক্যকে উপহার প্রদান করিয়াছিলেন।
দুর্ভাগ্য সুজা আরাকানপতি “সন্দ সু ধর্মের” আবাসে উপনীত হইলে রাজা সুজা- পুত্রীররূপে বিমোহিত হইলেন। তিনি জনৈক অনুচর দ্বারা সুজার নিকট বিবাহের প্রস্তাব উপস্থিত করিয়াছিলেন। কিন্তু সুজা নিতান্ত ঘৃণার সহিত এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। সুজার জীবিতাবস্থায় তাঁহার বাসনা পূর্ণ হওয়া দুষ্কর জানিয়া রাজা সন্দ সু ধর্ম প্রচার করিলেন যে, সুজা কৌশলক্রমে আরাকানের সিংহাসন অধিকার করিতে আসিয়াছেন, আশু তাঁহার প্রাণ বধ করা কর্তব্য। বিনাযুদ্ধে রক্তপাত বৌদ্ধদিগের ধর্ম বিরুদ্ধ, সুতরাং সুজাকে নৌকায় বন্ধন করিয়া জলমগ্ন করা হইয়াছিল। তাঁহার পত্নী পরিভানু ও কন্যাদ্বয় আত্মহত্যা দ্বারা পামরের অত্যাচার হইতে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু সুজার তৃতীয় (৯০) কন্যা মগরাজ অন্তঃপুরে স্থান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। বর্ণিয়ারের লেখা পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, সুজা মৃত্যুকালে ও স্বীয় বংশ গৌরব রক্ষা করিয়া বীরের ন্যায় শত্রু হস্তে আত্মসমর্পণ করেন। যে পর্য্যন্ত তাহার অসি ধারণ ক্ষমতা তিরোহিত না হইয়াছিল, সে পর্য্যন্ত মগেরা তাহার নখাগ্রও স্পর্শ করিতে পারে নাই। কিন্তু রাজমালা গ্রন্থে লিখিত আছে যে,সুজা আরাকানরাজের কন্যা বিবাহ করিয়া তথায় সুখে বাস করিয়াছিলেন, অবশেষে তাঁহার দুর্বুদ্ধি উপস্থিত হইলে তিনি স্বীয় শ্বশুরকে গোপনে বিনষ্ট করিয়া রাজ সিংহাসন অধিকার করিবার অভিপ্রায়ে এক ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। আরাকান রাজ ইহার প্রত্যক্ষ প্ৰমাণ প্রাপ্ত হইয়া সুজাকে বধ করেন।
রাজমালা গ্রন্থে লিখিত আছে যে, মহারাজ ছত্রমাণিক্য “ছত্রসাগর” নামক বৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করিয়াছিলেন। এখন সেই দীর্ঘিকার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। কিন্তু ত্রিপুরা পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাঁহার নাম অনুসারে “ছত্রচূড়া” (ছাতাচূড়া) নামে পরিচিত হইতেছে। তদ্ব্যতীত কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী “ছত্রেরখীল” ও চান্দিনা থানার অন্তর্গত “ছত্রেরকোট”, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সাবডিবিসনের অন্তর্গত ছত্রপুর প্রভৃতি গ্রাম সমূহের নামকরণ যে তাঁহার নামানুসারে হইয়াছিল এইরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। কারণ বিখ্যাত (৯১) ত্রিপুর নৃপতি, রাজ্ঞী কিম্বা রাজপুত্রদিগের নামানুসারে বিবিধ স্থানের নামকরণ হইয়াছিল। ইহার ভুরি ভুরি প্রমাণ উপস্থিত করা যাইতে পারে।
গোবিন্দ মাণিক্যের জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ রামদেব ঠাকুর ছত্র মাণিক্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিলেন। কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী আমতলী গ্রামে উভয় পক্ষের সৈন্য পরস্পরের প্রতিকূলে দণ্ডায়মান হইয়াছিল। তুমুল সংগ্রামে যুবরাজ রামদেব ঠাকুর পরাজিত হন।
সম্ভবত ৬ বৎসর রাজ্য শাসন করিয়া ছত্রমাণিক্য পরলোক গমন করেন। গোবিন্দ মাণিক্য পুনর্বার ত্রিপুর সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। ছত্র মাণিক্যের পুত্র কুমার উৎসব রায় কাদবা, আমিরাবাদ প্রভৃতি পরগণা বৃত্তি স্বরূপ প্রাপ্ত হন।
গোবিন্দ মাণিক্যের যত্নে মেহেরকুল বিশেষরূপে আবাদ হইয়াছিল। ইতিপূর্বে গোমতীর জলপ্লাবনে তত্তীরস্থ শস্য ক্ষেত্র সর্বদা বিনষ্ট হইত। তিনি “গাং আইল” নামক বাঁধ প্রস্তুত করিয়া শস্যক্ষেত্র রক্ষার উপায় উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। “গোবিন্দপুর নামে ত্রিপুরা জেলার মধ্যে অনেকগুলি গ্রাম দৃষ্ট হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য যে ইহার অধিকাংশই মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের সময় সংস্থাপিত হয়। মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য তাম্র শাসন দ্বারা ব্রাহ্মণদিগকে বিস্তর নিষ্কর ভূমি (৯২) দান করিয়াছিলেন। আমরা তাহার অনেকগুলি তাম্র শাসন দর্শন করিয়াছি। তাম্র শাসনগুলি বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত দুই খণ্ড তাম্র শাসনের পাঠ পরিশিষ্টে সংযুক্ত হইবে।[১৫]
চন্দ্রনাথের শিবমন্দির গোবিন্দ মাণিক্যের একটী প্রধান কীর্তি। তাঁহার অনুমত্যানুসারে উজির বিশ্বাস নারায়ণ ঘোষ বিশ্বাস তাহা নির্মাণ করেন। ভূমিকম্প দ্বারা সেই মন্দির বিচূর্ণ হইয়া পর্বত গহ্বরে সমাহিত হইয়াছে।
কসবা থানার অধীন জাজীয়াড়া গ্রামে তাহার মহিষী গুণবতী দেবী যে দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন, তাহা অদ্যাপি “গুণসাগর” নামে পরিচিত হইয়া থাকে। জগন্নাথ দীঘি থানার অধীন বাতিসা গ্রামে মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য একটি বৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। তিনি আরও অনেক সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ করিতে পারেন নাই। সম্ভবত ১০৭৯ ত্রিপুরাব্দে গোবিন্দ মাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করেন।
রাজমালা লেখক বলেন, মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য সুজার নিমচা তরবারি বিক্রয় করিয়া সেই অর্থ সৎকার্য্যে ব্যয় করিয়াছিলেন। গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লা নগরীতে “সুজা মসজিদ” নামক একটি ইষ্টক নির্মিত বৃহৎ মসজিদ অদ্যাপি (৯৩) দৃষ্ট হইয়া থাকে। এই মসজিদ সম্বন্ধে দুই প্রকার প্রবাদ শ্রুত হওয়া যায় :- ১) সুজা ত্রিপুরা জয় করিয়া বিজয় বৃত্তান্ত চিরস্মরণীয় করিবার জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করিয়াছিলেন। (২) মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য সুজার নাম চিরস্মরণীয় করিবার জন্য নিমচা তরবারি ও হীরকাঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে বহু অর্থ ব্যয় করিয়া এই মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। দ্বিতীয় প্রবাদ অপেক্ষা প্রথমোক্ত প্রবাদ সত্য বলিয়া আমাদের বিশ্বাস হইতেছে। এই মন্দিরের দ্বারদেশে একখণ্ড প্রস্তর ফলক সংযুক্ত ছিল। জনৈক প্রাচীন মুসলমান নিকট আমরা এরূপ শ্রুত হইয়াছি যে, অৰ্দ্ধ শতাব্দী কিম্বা ততোধিক কাল পূর্বে ত্রিপুর রাজ সরকারী জনৈক দেওয়ান “ওয়াক্ফ” সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য গোপনে সেই প্ৰস্তর ফলকখানা উৎপাটন করিয়া গোমতীজলে বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন। কুমিল্লার অন্তর্গত “সুজানগর” নামক পল্লী সেই মসজিদের “ওয়াক্ফ” সম্পত্তি বলিয়া শ্রুত হওয়া যায়।
গোবিন্দ মাণিক্য যৎকালে ছত্রমাণিক্য দ্বারা পরাজিত হইয়া পলায়ন করেন, তৎকালে তাঁহার মহিষীকে লইয়া উজির বিশ্বাস নারায়ণ বগাসাইর পরগণার অন্তর্গত শ্রীপুর গ্রামবাসী “কুণ্ড” দিগের বাসভবনে লুক্কায়িত ছিলেন। গোবিন্দ মাণিক্য পুনর্বার রাজদণ্ড ধারণ করিয়া কুণ্ডদিগকে (৯৪) “চৌধুরী” উপাধি প্রদান পূর্বক সেই পদের বৃত্তিস্বরূপ “নানকার” প্রদান করিয়াছিলেন।
কল্যাণ মাণিক্যের পুত্রগণ মধ্যে গোবিন্দ মাণিক্য ও ছত্রমাণিক্য রাজদণ্ড ধারণ করিয়াছিলেন। তাঁহার তৃতীয় পুত্র জগন্নাথ ঠাকুর একটি বৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করাইয়া চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। যাঁহারা কুমিল্লা হইতে স্থলপথে চট্টগ্রামে গমন করিয়াছেন, তাঁহারা অবশ্যই সেই রাজপুত্রের অমর কীৰ্ত্তি “জগন্নাথ দীঘি” দর্শন করিয়াছেন। ইহার দৈর্ঘ্য কিঞ্চিদূন একমাইল। কল্যাণ মাণিক্যের চতুর্থ পুত্রের নাম রাজবল্লভ ঠাকুর।
গোবিন্দ মাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ রামদেব ঠাকুর ১০৮০ ত্রিপুরাব্দে “মাণিক্য” উপাধি ধারণ করেন। তিনি মাইজখাড় গ্রামে একটি বৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। তাহা অদ্যাপি “রামসাগর” নামে পরিচিত হইয়া থাকে। মহারাজ রাম মাণিক্য একজন শ্যালকভক্ত নরপতি ছিলেন, এজন্য তিনি প্রথমত স্বীয় শ্যালক বলিভীম নারায়ণকে যৌবরাজ্যে নিয়োগ করেন। তৎপর ক্রমে স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র রত্নদেব ঠাকুরকে যৌবরাজ্যে এবং “বড়ঠাকুর” নামে একটি নূতন পদ সৃষ্টি করিয়া দ্বিতীয় পুত্র দুর্জয়দেব ঠাকুরকে ঐ পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। মহারাজ রাম মাণিক্য নিতান্ত নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী (৯৫) নরপতি ছিলেন। প্রথমত স্বীয় শ্যালককে যৌবরাজ্যে নিয়োগ করা, দ্বিতীয়ত “বড়ঠাকুর” পদ সৃষ্টি করিয়া রাজ পরিবার মধ্যে অনন্ত কলহের বীজ বপন করা নিতান্তই নির্বোধ ও অপরিণামদর্শিতায় কাৰ্য্য হইয়াছিল। শ্যালককে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করা জগতের ইতিহাসে একটি নূতন দৃষ্টান্ত বটে।
রাজ পরিবার মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি মহারাজ রাম মাণিক্যকে সিংহাসন চ্যুত করিবার জন্য বাঙ্গালার মোগল শাসন কর্তার সহিত মিলিত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারা কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। যুবরাজ রত্নদেব এবং বড়ঠাকুর দুর্জয় দেব ব্যতীত ঘনশ্যাম ও চন্দ্রমণি নামক আর দুই পুত্র বর্তমান রাখিয়া রাম মাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করেন।
জিলা ত্রিপুরা ও ত্রিপুরা রাজ্য মধ্যে রামপুর নামে ৩৮ খানা ও রামনগর নামক ১৭ খানা গ্রাম বৰ্ত্তমান আছে। ইহার অধিকাংশ গ্রামের নামকরণ যে মহারাজা রাম মাণিক্যের নাম অনুসারে হইয়াছিল, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
পিতার মৃত্যুর পর মহারাজ রত্ন মাণিক্য (দ্বিতীয়) ১০৯২ ত্রিপুরাব্দে (১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে) সিংহাসন আরোহণ করেন। তৎকালে তাঁহার বয়ঃক্রম পাঁচ বৎসর মাত্র ছিল। (৯৬) সেই সুযোগে তাঁহার পিতৃব্য নরেন্দ্র মাণিক্য তাঁহাকে সিংহাসন চ্যুত করিয়া রাজ দণ্ডধারণ করেন। কিন্তু অল্পকাল রাজ্য শাসন করিয়া তিনি কাল কবলিত হন। তদনন্তর ১০৯৪ ত্রিপুরাব্দে রত্ন মাণিক্য পুনর্বার সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁহার চারিজন যুবরাজ ছিল। তিনি স্বীয় মাতুল বলিভীম নারায়ণকে যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া স্বীয় অনুজ দুৰ্জ্জয় দেবকে এবং তদনন্তর রাজ বংশজ গৌরীচরণ ও চম্পক রায়কে যুবরাজের পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তৎকালে তিনি স্বীয় দ্বিতীয় অনুজ চন্দ্রমণিকে বড় ঠাকুরী পদে নিযুক্ত করেন। মহারাজ রত্ন মাণিক্য এবং তাঁহার ভ্রাতা যুবরাজ দুর্জয় দেব ও বড় ঠাকুর চন্দ্রমণি অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকায় বয়োপ্রাপ্ত যুবরাজ বলিভীম নারায়ণ, গৌরীচরণ ও চম্পক রায় রাজ্য শাসন করিতেন। তাঁহারা ত্রিপুরা রাজ্য তিন অংশে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেকে এক এক প্রদেশের শাসন ভার গ্রহণ করেন। নুরনগর পরগণা ও তৎসন্নিহিত স্থানের শাসন ভার যুবরাজ চম্পক রায়ের হস্তে সমর্পিত হইয়া ছিল। চম্পক রায়ের মোহরাঙ্কিত সনন্দ নুরনগরের তালুক রায় বর্গের নিকট সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়।[১৬]
মহারাজ রত্ন মাণিক্য বয়োপ্রাপ্ত হইয়া নুরনগরের “জমিদার ও তালুকদার” প্রভৃতির প্রতি ১১০৫ ত্রিপুরাব্দের ১১ই বৈশাখে। (৯৭) এক খণ্ড ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। তাহার এক খণ্ড নিতান্ত জীর্ণ অবস্থায় আমাদের হস্তগত হইয়াছে। ইহার প্রতিলিপি পশ্চাৎ প্রকাশিত হইবে। এই ঘোষণাপত্রের শীর্ষদেশে ভগবান নারায়ণের মূর্ত্তি এবং সেই মূর্ত্তির দুই পার্শ্বে দুইটি রমণী মূর্ত্তি চিত্রিত রহিয়াছে। সনন্দ সমূহের শীর্ষভাগে কোন দেব মূৰ্ত্তি উৎকীর্ণ কিম্বা চিত্রিত করার প্রথা ভারতে প্রাচীন কাল হইতে প্রচলিত ছিল। কোন কোন প্রাচীন তাম্র শাসনের শীর্ষভাগে ভাগবতী মূর্ত্তি কিম্বা গরুড় বাহন নারায়ণ মূর্ত্তি অথবা অন্য কোন দেবমূৰ্ত্তি চিত্রিত থাকার প্রমাণ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি।[১৭] (৯৮)
মহারাজ রত্নমাণিক্য[১৮] স্বাধীনভাবে শাসনদণ্ড পরিচালন করিয়াছিলেন। মেজর ষ্টুয়ার্ট স্বপ্রণীত বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখিয়াছেন যে, “যদিচ ইতিপূর্বে মুসলমানদিগের বাহুবলে ত্রিপুরা লুণ্ঠিত ও বিজিত হইয়াছিল, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাঁহার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় নাই। ত্রিপুরেশ্বর স্বাধীন ছত্র ধারণপূর্বক স্বনামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচার করিতেছিলেন। ১৭০৭-৮ খ্রিস্টাব্দে (১১১৮ ত্রিপুরাব্দে) ত্রিপুরেশ্বর নবাব মুরসিদকুলী খাঁর প্রবল বিক্রম কাহিনী শ্রবণে তাঁহাকে গজ ও গজদন্ত প্রভৃতি উপঢৌকন প্রদান করেন। তদ্বিনিষয়ে নবাব ত্রিপুরেশ্বরকে “খেলাত” প্রদান করিয়াছিলেন। প্রতি বৎসর ত্রিপুরাপতি নবাবকে যেরূপ উপঢৌকন প্রেরণ করিতেন নবাবও তদ্রূপ তাঁহাকে “খেলাত” প্রদান করিতেন।[১৯]
মহারাজ রত্নমাণিক্য কুমিল্লা নগরীর পূর্বদিকে “সতর উত্তম” নামক এক প্রকাণ্ড ও অতি উচ্চ দেব মন্দিরের ভিত্তি সংস্থাপন করেন। তিনি ১২৫টি বিবাহ করেন, কিন্তু তাহার কোন পুত্র সন্তান জন্মে নাই। ১১২২ ত্রিপুরাব্দে কুমার ঘনশ্যাম রত্নমাণিক্যকে বধ করিয়া ত্রিপুর সিংহাসন অধিকার করেন। রাজ্যাভিষেক কালে ঘনশ্যাম “মহেন্দ্ৰ মাণিক্য” আখ্যা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিঞ্চিদূন দুই বৎসর (৯৯) মাত্র রাজ্য শাসন করিয়া মহেন্দ্র মাণিক্য কাল কবলিত হন।[২০]
ত্রিপুরা রাজ্য ও জেলা ত্রিপুরার মধ্যে ১২ খানা গ্রাম রতননগর ও রতনপুর নামে পরিচিত। এই সকল গ্রামের নামকরণের সহিত অবশ্যই মহারাজ রতু মাণিক্যের কোনরূপ সংশ্রব আছে।
.
টীকা
১. পূর্বতন কিরাত বা বর্তমান ত্রিপুর জাতির মধ্যে বাছাল নামে একটি সম্প্রদায় আছে।
২. সৌর মণ্ডল হইতে ছৌর মণ্ডল। বাঙ্গালি ভূগোল বেত্ত্বগণ ইংরেজি C অক্ষরকে ‘ক’স্থির সেই সৌর মণ্ডলকে ‘করমণ্ডল করিয়া ফেলিয়াছেন।
৩. The Countries of Oedapur and Tipers are sometimes independent; Sometimes under the Great Mogul and sometimes even under the king of Arakar. (van den Broucke)
৪. T Rky van Tipera.
৫. তদণ্ডে দুর্গমধ্যে চ স্থাপয়ামাস কালিকাং। (সংস্কৃত রাজমালা)
৬. বিশ্বনাথ শর্ম্মার ষষ্ঠ উত্তর পুরুষ শ্রীযুক্ত মহেন্দ্ৰচন্দ্ৰ চক্রবর্তী তাঁহাদের বংশাবলী আমাদিগকে প্রদান করিয়াছেন। এক্ষন বিশ্বনাথের ষষ্ঠ ও সপ্তম উত্তর পুরুষ জীবিত আছেন।
৭. যে সময়ে সুলতান সুজার আত্মরক্ষা করিবার ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবে তিরোহিত হইয়াছিল, সেই সময় তিনি কিরূপে অন্য ব্যক্তিকে সাহায্য করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন? সুতরাং নক্ষত্র রায় যে স্বীয় বাহুবলে সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন, ইহাই সত্য।
৮. Tavernier’s Travels in India, p. 156.
৯. Dow’s History of Hindostan vol. III p 354
১০. এই তাঁড়াকে ইংরেজ লেখকগণ Tanda এবং বাঙ্গালি লেখকগণ তণ্ডা করিয়া ফেলিয়াছেন।
১১. Beriner’s Travels in the Mogoul Empire vol. I p. 12
১২. Dow’s History of Hindostan vol. III p. 38
১৩. গোবিন্দ মাণিক্যের বাস ভবনের চিহ্ন অদ্যাপি বিলুপ্ত হয় নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূতপূব ডিপুটী কমিশনার বেউন সাহেব লিখিয়াছেন :
Far in the jungles on the banks of the Myance, an affluence of the kassalong River, are found tanks, fruit-trees, and the remains of the masonry building-evidence that at some bygone period, the land here was cultivated and inhabited by men of the plains. Tradition attributes this ruins to a former Raja of Hill Tipperach who, it is said, was driven from that part of the Country.
Lewin’s Hill Tracts of Chittagong, page 6
১৪. মতান্তরে আরাকানের রাজসভায় গোবিন্দ মাণিক্যের সহিত সুজার সাক্ষাৎ হইয়াছিল।
১৫. উক্ত তাম্রশাসন সম্বন্ধে আমাদের মন্তব্য সেই স্থলে প্রকাশ করা হইবে।
১৬. এরূপ অনেক জাল সনন্দ আমরা সংগ্রহ করিয়াছি।
১৭. গুপ্তবংশীয় সম্রাট মহারাজাধিরাজ কুমার গুপ্তের মুদ্রার শীর্ষদেশে কেবল গরুড় মূর্তি খোদিত রহিয়াছে। (J. A. S. B vol. LV III Part I palate VI) মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্দ্ধন শিলাদিত্যের মুদ্রার শীর্ষদেশে মহাদেবের প্রিয়বাহন ‘বৃষভ’ মূৰ্ত্তি উৎকীর্ণ দৃষ্ট হয়। (C. I. I. Vol. III P 231 ) নেপালের শৈব নরপতিগণের খোদিত লিপি সমূহের শীর্ষে ‘বৃষভ’ মূর্তি খোদিত রহিয়াছে। (Inscriptions’ From Nepalions. 7, 12) কোন কোন খোদিত লিপিতে ভগবান নারায়ণের আদি অবতার মৎস্য মূৰ্ত্তি উৎকীর্ণ দৃষ্ট হয়। (Inscriptions’ From Nepal nos. 9) গৌড়েশ্বর লক্ষণ সেন দেবের তাম্রশাসনের শিরোভাগে ভগবতী মূর্ত্তি খোদিত রহিয়াছে। এবপ্রকার ভুরি ভুরি প্রমাণ সংগ্রহ করা যাইতে পারে।
১৮. ত্রিপুরা রাজ্য সংলগ্ন হোমনাবাদের জমিদার মির্জা সুলতান খান কৃত পুরাতন এক উইলের বিবরণ হইতে জানা যায় যে, তাহার পূর্বপুরুষ শাহাজাদা জাহান্দার মোগল সম্রাট প্রথম শাহ আলমের প্রতিনিধি হিসাবে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করিয়াছিলেন (উইলের অনুদিত বিবরনের জন্য Webster, J, E, Eastern Bengal District Gazetteers PP, 14-15 দ্রষ্টব্য)। ‘ত্রিপুরা বুরঞ্চী’ তে উল্লিখিত যে, আসামের প্রতাপশালী রাজা স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার জন্য রত্নমাণিক্যের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করিয়া এক কূটনৈতিক মিশন প্রেরণ করিয়াছিলেন (Buiyam S, K, ed Tripura Buranji PP XI-XII Introduction)
১৯. Stewart’s History of Bengal page 233.
২০. মহেন্দ্র মাণিক্যের গুনানুবাদ মূলক ৫টি প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোক আমাদের হস্তগত হইয়াছে। ইহা তাঁহার সমসাময়িক কোন কবির রচনা। পরিশিষ্টে সানুবাদ সেই সকল শ্লোক মুদ্রিত হইবে। কবি, মহামান্য মহেন্দ্র মাণিক্যকে দানে কল্পতরু, সৌন্দর্যে কন্দর্প, পাণ্ডিত্যে সুরগুরু বৃহস্পতি, – মহাদেব কীর্তিতে নারায়ণ এবং কুবের সদৃশ ধনবান বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।