রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.৫

পঞ্চম অধ্যায়

গোপীপ্রসাদ নিজ নাম পরিত্যাগ পূর্বক “উদয়মাণিক্য” নাম গ্রহণ করিয়া ৯৯৫ ত্রিপুরাব্দে (১৫৮৫ খ্রিঃ) ত্রিপুরার সিংহাসনে আধিরূঢ় হইলেন। তিনি বহুবিধ জলাশয় খনন এবং প্রাসাদাদি নির্মাণ করেন এবং রাজধানী রাঙ্গামাটীয়ার নাম পরিবর্ত্তন পূর্বক স্বীয় নামানুসারে “উদয়পুর” নামকরণ করিলেন।[১]

তাঁহার ২৪০টী স্ত্রীগণমধ্যে প্রায় অনেকেই রজনী যোগে রাজবাটী হইতে বহির্গত হইয়া পরপুরুষ সহযোগে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করিতেন। সে সময় গৌড়ের একজন মুসলমান রাজপুত্র দেশ পৰ্যটনে বহির্গত হইয়া ত্রিপুরায় উপস্থিত হন। উদয়মাণিক্য তাঁহার যথোচিত অভ্যর্থনা করেন; কিন্তু যখন (৬৪) জানিতে পারিলেন, তাঁহার কয়েকটি স্ত্রী রাত্রি যোগে ঐ যবন রাজপুত্রের নিকট গমন করিয়া তৎসহবাসিনী হইয়াছেন, তখন তিনি তাঁহাকে রাজ্য হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন; এবং ঐ সকল স্ত্রীকে হস্তিপদতলে নিক্ষেপ করত ও কুক্কুর দংশনে বধ করিলেন।

ঐ সময়ে মোগলেরা চট্টগ্রাম অধিকার করিতে অগ্রসর হয়। এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া মহারাজ উদয়মাণিক্য তাহাদিগকে পথিমধ্যে অবরোধ করিবার জন্য বৃহৎ একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। কথিত আছে সেই যুদ্ধ যাত্রা কালে আকাশ হইতে উল্কাপাত এবং শৃগালগণের ঘোরতর অমঙ্গলসূচক শব্দ হইয়াছিল। ত্রিপুর সৈন্যরা রাত্রিযোগে মুসলমান দিগকে আক্রমণ করিল। ঘোরতর সংগ্রামের পর মুসলমানেরা জয়ী হইল। সেই যুদ্ধে ৩৪ হাজার ত্রিপুর সৈন্য এবং ৫ হাজার মুসলমান সৈন্য বিনষ্ট হয়। এই যুদ্ধ ঘটনার পাঁচ বৎসর পরে কোন এক দুষ্টা স্ত্রীলোক বিষপান করাইয়া উদয়মাণিক্যের প্রাণ সংহার করে। তাঁহার রাজ্য শাসন সময়ে দুর্ভিক্ষে বহুসংখ্যক লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে আরাকানপতি মেংফালো পর্তুগীজদিগের সাহায্যে যে চট্টগ্রাম পর্য্যন্ত অধিকার করিয়া নিরস্ত হইয়াছিলেন এমত নহে, তিনি সমগ্র ত্রিপুরা লুণ্ঠন করিয়া মেঘনাদ তীরে স্বীয় বিজয় বৈজয়ন্তী উডডীন করেন। (৬৫)

উদয় মাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র জয়মাণিক্য ১০০৬ ত্রিপুরাব্দে (১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে) সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। তিনি কেবল নামত রাজা ছিলেন; কিন্তু তাঁহার পিতৃব্য রঙ্গনারায়ণই রাজ্য শাসন করিতেন। রঙ্গনারায়ণ দেখিলেন, বিজয়মাণিক্যের ভ্রাতা অমর ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিতেছেন; ঐ সমযে তাঁহার বিনাশ সাধন না করিলে প্রাচীন রাজবংশই পুনরায় সিংহাসনের অধিকারী হইবেন। এই বিবেচনা করিয়া রঙ্গনারায়ণ ভোজনার্থ অমরকে নিমন্ত্রণ করিলেন, অমর রঙ্গের আলয়ে উপস্থিত হইলেন, অমরের এক বন্ধু তথায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি তরবারি দ্বারা একটী পান দ্বিখণ্ড করিয়া সঙ্কেত করিলেন। রাজপুত্র অমর প্রাণনাশ শঙ্কা করিয়া অকষ্মাৎ শারীরিক অসুস্থতার ভানে গাত্রোত্থান করিয়া অশ্বশালায় প্রবেশ পূর্বক দেখিলেন, তথায় তাঁহার অশ্ব নাই; তখন তিনি অন্য একটি অশ্বে আরোহণ করিয়া স্বীয় আলয়ে গমন করিলেন এবং সৈন্য সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইলেন। রঙ্গ যেমন তাঁহার প্রাণবধের চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনিও তদ্রূপ রঙ্গের প্রাণসংহারের নিমিত্ত সৈন্যগণকে নানাবিধ বস্ত্রাদি পুরস্কার প্রদান পূর্বক উৎসাহিত করিলেন। রঙ্গনারায়ণ ভয়ার্ত্ত হইয়া দুর্গ মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন, এবং স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অচিরে সসৈন্যে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইবার জন্য পত্র লিখিলেন। কিন্তু (৬৬) পত্রবাহক পথিমধ্যে অমর কর্তৃক ধৃত হইল। অমররঙ্গের স্বহস্তলিখিত পত্রের ন্যায় একখানি কৃত্রিম পত্র প্রস্তুত করিয়া একজন বিশ্বস্ত অশ্বারোহী দ্বারা রঙ্গনারায়ণের ভ্রাতার নিকট প্রেরণ করিলেন। রঙ্গের ভ্রাতা ঐ পত্র প্রাপ্ত হইয়া আহ্লাদিত চিত্তে যেমন বাহককে আলিঙ্গন করিতে যাইবেন, অমনি পত্রবাহক অশ্বারোহী তরবারির আঘাতে তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া, তাহা রঙ্গনারায়ণের দর্শনার্থ দুর্গ মধ্যে নিক্ষেপ করিল।

রঙ্গনারায়ণ নিজভ্রাতার ছিন্ন মস্তক দর্শন করিয়া অতিশয় দুঃখিত ও চিন্তিত হইলেন এবং বিবেচনা করিলেন যে, তাঁহার ভ্রাতার অধীনস্থ সমস্ত সৈন্যই বিনষ্ট হইয়াছে, নচেৎ কখনই তাঁহার ভ্রাতা নিহত হইবেন না। রঙ্গনারায়ণ এইরূপ ভাবিয়া দুর্গ পরিত্যাগপূর্বক প্রাণ রক্ষাভিপ্রায়ে রাত্রিযোগে গোপনে তথা হইতে পলায়ন করিলেন। তিনি দুই দিবস কাল এক নিভৃতস্থানে লুক্কায়িত রহিলেন। ইতোমধ্যে অমরের একজন সৈনিক পুরুষ তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া হৃষ্টচিত্তে তাঁহার মস্তক ছেদন করিয়া স্বীয় প্রভুকে উপঢৌকন প্রদান করিল। অমর যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া ঐ সৈনিককে “সাহসনারায়ণ” উপাধি প্রদান করিলেন।

জয়মাণিক্য এই সকল ঘটনা শ্রবণ করিয়া অতিশয় দুঃখিত হইয়া অমরকে লিখিলেন, তিনি কি জন্য এরূপ ॥ ৬৭॥ অন্যায় কার্য্য করিতেছেন। অমর স্থির করিলেন, পত্র দ্বারা প্রত্যুত্তর না দিয়া অস্ত্র দ্বারা উত্তর প্রদান করা সঙ্গত। স্বীয় উদ্দেশ্যসাধন জন্য তদভিমুখে সসৈন্যে যাত্রা করিলেন। শত্রু সমাগত হইয়াছে, শুনিয়া জয়মাণিক্য অতিশয় ভীত হইলেন। অনন্তর তিনি রাজনিকেতন পরিত্যাগ পূর্বক পলায়ন করিলেন। কিন্তু অমরের সৈন্যগণ পথিমধ্যে তাঁহাকে ধৃত করিয়া মস্তকচ্ছেদন করিল। জয় মাণিক্য সম্ভবত এক বৎসর মাত্র রাজ শাসন করিয়াছিলেন।

উদয়মাণিক্য এবং জয়মাণিক্যের শাসনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা বিশেষরূপে খর্ব হইয়াছিল।

.

টীকা

১. প্রকৃতপক্ষে উদয়পুর রাঙ্গামাটীয়ার কিয়দংশ মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *