রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.৪

চতুর্থ অধ্যায়

মহারাজ দেবমাণিক্যের দুই পুত্র ছিল; জ্যেষ্ঠ বিজয় কনিষ্ঠ অমর। ইন্দ্রমাণিক্যের নিধনের পর ত্রিপুর কুলতিলক বিজয় মাণিক্য ৯৪৫ ত্রিপুরাব্দে (১৪৫৭ শকাব্দে) সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি দৈত্যনারায়ণের কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। সেই সূত্রে পাপিষ্ঠ দৈত্য নারায়ণকে স্বয়ং রাজ্য শাসনভার গ্রহণ করেন। বিজয় মাণিক্য দেখিলেন, তাঁহার শ্বশুরই প্রকৃত রাজা, তিনি স্বয়ং সাক্ষি গোপাল মাত্র। মহারাজ বিজয় মাণিক্য দৈত্য নারায়ণকে নিধন করা কৰ্ত্তব্য বিবেচনায় জনৈক আত্মীয় দ্বারা রাত্রিযোগে তাঁহাকে অপরিমিত মদ্য পান করাইলেন। তদনন্তর তিনি স্বয়ং অজ্ঞানবস্থাপন্ন দৈত্য নারায়ণকে হত্যা করিয়া ত্রিপুরার একজন প্রধান পরাক্রান্ত অধিপতি বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। রাণী পিতার নিধন বার্তা শ্রবণে স্বামীর প্রতি নিতান্ত ঘৃণা প্রদর্শন পূর্বক নানা প্রকার দুর্বাক্য দ্বারা তাঁহার মর্ম্ম পীড়া প্রদান করিয়াছিলেন। এজন্য মহারাজ বিজয় মাণিক্য তাঁহার প্রথমা পত্নীকে অরণ্য মধ্যে নির্বাসন পূর্বক দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন।

মহারাজ বিজয় মাণিক্য স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ পূর্বক রাজ্যের আভ্যন্তরিক সংস্কার ও উন্নতির প্রতি যত্নবান হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রযত্নে ত্রিপুরার সৈন্যবল বৃদ্ধি হইয়াছিল। তিনি লক্ষ লক্ষ পদাতিক ও এক সহস্র হস্তী রণক্ষেত্রে প্রেরণ করিতে সক্ষম ছিলেন। তিনি কতকগুলি পাঠান দ্বারা একদল (৫৬) অশ্বারোহী সৈন্য গঠন করেন। তদ্ব্যতীত তাঁহার অনেকগুলি রণতরী ও ছিল।

সের সাহের মৃত্যুর পর ত্রিপুর কুল তিলক বিজয় মাণিক্য যে ত্রিপুরার হৃত অংশের পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন এমত নহে, তিনি ত্রিপুরার উত্তর ও দক্ষিণস্থ স্থান সমূহ ও পূর্ববঙ্গ লুণ্ঠন করিয়া মুসলমানদিগের কৃত অত্যাচারের প্রতিশোধ লইয়াছিলেন।

তিনি প্রথমত চট্টগ্রামের উদ্ধার সাধনজন্য স্বীয় বাহুবলের প্রয়োগ করিয়াছিলেন। মগ ও মুসলমানদিগকে জয় করিয়া বিজয় মাণিক্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এই যুদ্ধ যাত্রা কালে এক সহস্র পাঠান অশ্বারোহী কোন কারণে বিদ্রোহী হইয়া রাজার প্রাণ নাশ পূর্বক রাজধানী অধিকারের চেষ্টা করে। মহাবীর বিজয় মাণিক্য স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া তাহাদিগকে পরাজিত ও কত্কগুলিকে জীবিতাবস্থায বদ্ধ করিয়া চতুৰ্দ্দশ দেবতার নিকট বলিপ্রদান করিয়াছিলেন।

কররাণী বংশীয় উড়িষ্যা বিজয়ী সুলতান সুলেমান চট্টগ্রাম অধিকার জন্য মহম্মদ খাঁ নামক জনৈক সেনাপতির অধীনে তিন সহস্র অশ্বারোহী এবং দশ সহস্র পদাতিক প্রেরণ করেন। চট্টগ্রামে ত্রিপুর সৈন্যের সহিত মুসলমানদিগের ক্রমান্বয়ে ৮ মাস যুদ্ধ চলিয়াছিল। প্রথম যুদ্ধে ত্রিপুরার প্রধান সেনাপতি নিহত হন; কিন্তু পশ্চাৎ মুসলমানেরাই (৫৭) পরাজিত হয়। ত্রিপুর সৈন্যগণ বিপক্ষ সেনাপতি মহম্মদ খাঁকে লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া রাজধানী রাঙ্গামাটীয়া নগরে আনয়ন করে। মহারাজ বিজয় মাণিক্য তাঁহাকে চতুৰ্দ্দশ দেবতার নিকট বলিদান করেন। কিছুকাল পরে বিজয় বঙ্গদেশ আক্রমণে নিতান্ত অভিলাষী হইলেন। তিনি ২৬ সহস্র উৎকৃষ্ট পদাতিক এবং ৫ সহস্র অশ্বারোহী ও কতিপয় গোলন্দাজ সৈন্যের সহিত ৫ পাঁচ সহস্র নৌকায় আরোহণ করিয়া যাত্রা করিয়া প্রথমে সোনার গাঁর মুসলমানদিগকে পরাজিত করিলেন। এবং তথা হইতে লঙ্গা নদী অতিক্রম করিয়া গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত অগ্রসর হইলেন। তিনি সেই সকল নদীতীরবর্ত্তী গ্রাম লুণ্ঠন করিয়া প্রচুর অর্থ এবং কতিপয় সুন্দরী যুবতী রমণী সংগ্রহ পূর্বক ব্রহ্মপুত্র নদে উপস্থিত হইয়া ধন এবং স্ত্রীলোকদিগকে রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন।

পূর্ববঙ্গে বিজয়ী পতাকা উডডীন করত মহারাজ বিজয় মাণিক্য ব্রহ্মপুত্রে স্নান করিয়া জনৈক ব্রাহ্মণকে পঞ্চদ্রোণ ভূমি দান করিয়াছিলেন, তদনুসারে সেই স্থান অদ্যাবধি “পাঁচদোনা” নামে পরিচিত রহিয়াছে।[১]

তদন্তর মহারাজ বিজয় মাণিক্য শ্রীহট্ট প্রদেশ আক্রমণ (৫৮) ও লুণ্ঠন করিলেন। জয়ন্তীয়াপতি নানা প্রকার উপঢৌকন প্রদান পূর্বক ত্রিপুরেশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করেন। জয়ন্তীয়া রাজের বিনয় ও ভক্তিতে বাধ্য হইয়া মহারাজ বিজয় মাণিক্য প্রসাদ স্বরূপ তাঁহাকে একটী হস্তী প্রদান করেন। মহারাজ বিজয় মাণিক্য কৈলারগড় রাজধানীতে পদার্পণ করিয়া শ্রুত হইলেন, যে জয়ন্তীয়াপতি প্রচার করিয়াছেন, “বিজয় মাণিক্য ভয়াতুর হইয়া আমাকে একটী হস্তী উপঢৌকন প্রদান করিয়াছেন।” তিনি এই বাক্য শ্রবণ মাত্র জয়ন্তীয়াপতিকে ধৃত করিয়া আনিবার জন্য বৃহৎ একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। জয়ন্তীয়া-রাজ ত্রিপুর- সৈন্যের আগমণ বার্তা শ্রবণে ভয়ে কাতর হইয়া স্বীয় রাজধানী পরিত্যাগ পূর্বক কাছাড়ে পলায়ন করিলেন এবং কাছাড়পতি দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ত্রিপুরেশ্বর নিকট পত্র পাঠাইলেন। মহারাজ বিজয় মাণিক্য জয়ন্তীয়াপতিকে ক্ষমা করিয়া ত্রিপুর সৈন্যের প্রত্যাবর্তনের আদেশ প্রেরণ করিয়াছিলেন।

মহারাজ বিজয় মাণিক্য বিজয় নদীর বিবিধ বাঁক কর্ত্তন করিয়া দেন, এজন্য সেই স্রোতস্বতী অদ্যাপি “বিজয় নদী” আখ্যায় অভিহিত হইয়া থাকে। তদনন্তর মহারাজ বিজয় মাণিক্য নানাবিধ সৎকাৰ্য সম্পাদন করিয়াছিলেন। তিনি বিবরণ জন্য এক দিবস কল্পতরু হইয়াছিলেন। তিনি “তুলা (৫৯) পুরুষ,” জলাশয় খনন, মঠ নিৰ্ম্মাণ, দেবতা স্থাপন, দেবোত্তর, ব্রহ্মত্তর প্রভৃতি নানা প্রকার ভূমিদান করিতে ত্রুটী করেন নাই।

মহারাজ বিজয় মাণিক্যের দুই পুত্র জন্মে। কনিষ্ঠ পুত্র কুমার অনন্ত, প্রধান সেনাপতি গোপী প্রসাদের কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন। গোপী প্রসাদ চক্রান্ত করিয়া জ্যেষ্ঠ কুমারকে জগন্নাথ দর্শনের ছলে উড়িষ্যায় প্রেরণ করেন। এই সময় ৯৯৩ ত্রিপুরাব্দে বিজয় মাণিক্য বসন্ত রোগে মানবলীলা সংবরণ করেন, তাহার কতিপয় সংখ্যক রাজ্ঞী তৎসহ অনুমৃতা হইলেন।

মহারাজ বিজয় মাণিক্য যে একজন বলবীর্য্যশালী নরপতি ছিলেন তাহাতে সন্দেহ হইতে পারে না। মোগল সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল স্বীয় “আইন আকবরী” গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে “ভাটী প্রদেশের”[২] সংলগ্ন একটি স্বাধীন রাজ্য আছে। সেই রাজ্যের নাম তিপ্রা (ত্রিপুরা) আর তাহার অধিপতির নাম বিজয় মাণিক্য। যিনি (৬০) রাজা হন, তিনিই তাঁহার নামের অন্তে “মাণিক্য” উপাধি সংযুক্ত করেন। সেই রাজ্যের আমির ওমরাগণ “নারায়ণ উপাধি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। এই রাজার দুই লক্ষ পদাতিক ও এক সহস্ৰ হস্তী আছে, কিন্তু অশ্ব অতি বিরল।”[৩]

আইন আকবরী গ্রন্থে মোগল সাম্রাজ্যের রাজস্বের যে হিসাব সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, সাধারণে তাহা রাজা তুডল মল্লের কৃত “ওয়াসীল তোমর জমা” বলিয়া জ্ঞাত আছেন; কিন্তু আমাদের বিবেচনায় সাধারণের ঐরূপ জ্ঞান নিতান্ত ভ্রমাত্মক; কারণ মোগল সম্রাট আকবর কিম্বা জাহাঙ্গীর যে সকল স্থান কস্মিন কালে অধিকার করিতে পারেন নাই, তাহাও উক্ত ওয়াসীল তোমর জমায় ভূক্ত রহিয়াছে। রাজা তুডলমল্ল সুবেবাঙ্গালার অন্তর্গত বলিয়া সরকার চট্টগ্রাম ও তদন্তর্গত মহাল সমূহের এক সুদীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু আবুল ফজল আইন আকবরী গ্রন্থের স্থানান্তরে লিখিয়াছেন যে, “চট্টগ্রাম বন্দর মগরাজার অধিকার ভুক্ত।” রাজা তুডলমল্ল যে বৎসর ওয়াশীল তোমর জমা প্রস্তুত করেন, সেই বৎসর সুবিখ্যাত ইংরেজ ভ্রমণকারী রল্ফ ফিছ বাঙ্গালায় উপস্থিত ছিলেন। মহারাজ বিজয় মাণিক্য যে বৎসর মানব-লীলা সম্বরণ করেন, সেই বৎসর রল্ফ ফিছ চট্টগ্রামে গমন করেন। তিনি লিখিয়াছেন, (৬১) “সাত গাঁও হইতে আমি ত্রিপুরেশ্বর অবিরত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ত্রিপুরাপতির দুর্বলতায় চট্টগ্রাম বা পোর্টগেণ্ডো বারংবার রাক্ষিয়াং রাজার হস্তগত হয়।”[৪]

আধুনিক ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত যে সকল মহাল বা পরগণা রাজা তুডল মল্লের ওয়াসীল তোমর জমা ভুক্ত হইয়াছে তাহার তালিকা পশ্চাৎ প্রদত্ত হইবে। এই সমস্ত মহাল বা পরগণা এবং শ্রীহট্ট জেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশ মহারাজ বিজয় মাণিক্যের রাজচ্ছত্রের অধীন ছিল। তন্মধ্যে তুলুয়া, সিংহেরগাঁও প্রভৃতি কতকগুলি পরগণা সামন্ত নরপতিগণের এবং তদ্ভিন্ন পরগণাগুলি সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহার শাসনাধীন ছিল। আবুল ফজল ও রল্ফ ফিছের বর্ণনা দ্বারা ইহা বিশেষ রূপ নির্ণীত হইতেছে যে, সমগ্র ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উত্তরাংশ (৬২) এবং শ্রীহট্ট জেলার পূর্ব দক্ষিণাংশ মহারাজ বিজয় মাণিক্যের রাজচ্ছত্রের অধীন ছিল। চট্টগ্রামের দক্ষিণভাগ লইয়া মগদিগের সহিত ত্রিপুরেশ্বরের কলহ চলিতেছিল। আমাদিগের বিবেচনায় রাজা তুডল মল্লের ওয়াশীল তোমর জমা সম্পূর্ণ প্রত্যয়যোগে নহে।[৫] বিজয় মাণিক্যের শাসনকালে ত্রিপুরা রাজ্য সীমা বিশেষভাবে বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল। ফলত তাঁহাকেই বঙ্গ ও ব্রহ্মরাজ্যের মধ্যস্থিত সমগ্র সুহ্মদেশের একমাত্র অধিপতি বলা যাইতে পারে। সংক্ষিপ্ত রাজমালা লেখক বিজয় মাণিক্যের নামের সহিত “সম্রাট” শব্দ সংযুক্ত করিয়াছেন।

বিজয় মাণিক্য পরলোক গমন করিলে তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র অনন্ত মাণিক্য স্বীয় শ্বশুরের সাহায্যে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দেড় বৎসর মাত্র রাজত্ব করিয়া শ্বশুরের কুমন্ত্রণায় স্বীয় পাচিকা কর্তৃক গোপনে নিহত হন। তাঁহার পত্নী অনুমৃতা হইতে প্রস্তুত হইলে, গোপীপ্রসাদ তাহাতে বাধা দেন। তৎপরে বিধবা রাজ্ঞী বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি অর্থাৎ স্বীয় পিতার নিকট পতির সিংহাসনে স্বয়ং আরোহণ করিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু গোপীপ্রসাদ তাহাতে অসম্মত হইলেন। তিনি স্বয়ং (৬৩) রাজ্যেশ্বর হইয়া চণ্ডীগড় নামক স্থান জায়গীর প্রদান পূর্বক কন্যাকে চণ্ডীগড়ের রাণী বলিয়া প্রচার করিলেন।[৬]

.

টীকা

১. সেই পাঁচ দোনা অধুনা ঢাকা জেলার অন্তর্গত।

২. হুগলী নদীর তীর হইতে মেঘনাদের তীর পর্য্যন্ত নিম্নভূমিকে মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ ‘ভাটী’ নামে পরিচিত করিয়াছেন। আধুনিক জেলা চব্বিশ পরগনা, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ ও ঢাকা জেলার কিয়দংশ ভাটী প্রদেশের অন্তর্গত হইয়াছে।

৩. মূল আইন আকবরী অনুবাদিত ও উদ্ধৃত।

৪. From Satagam I travelled by the country of the King of Tippara, with whome? the Moges have almost continual warres? The Mogen which be of the kingdome? of Recon and Rame, be stronger than the king of Tippara. So that Chatigan. Or Porto Grando, is often times under the king of Recon. (Ralplh Fitch.)

৫. বুকমান সাহেবও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন।
J.A.S.B. XLII pp. 214. 234.

৬. আমাদের বিবেচনায় কুমিল্লার পশ্চিমদিগে অবস্থিত লালময়ী পবর্বত প্রাচীন চণ্ডীগড় হইতে পারে, কারণ এই পবর্বতের কিয়দংশ অদ্যাপি চণ্ডীমুড়া নামে আখ্যাত হইয়া থাকে। প্রবাদ এই ভগবতী চণ্ডীদেবী এইস্থানে মহিষাসুরের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *