তৃতীয় অধ্যায়
সম্ভবত ১১২১ শকাব্দে (৫৯৪-৯৫ হিং সালে) অযোধ্যার শাসনকর্তার অধীনস্থ মহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামক জনৈক জায়গীরদার নবদ্বীপ অধিকার করেন। মহারাজ বল্লালসেন দেবের পুত্র মহারাজ লক্ষ্মণসেন দেব তৎকালে ॥২৮॥ বাঙ্গালা দেশ শাসন করিতেছিলেন। বখতিয়ার নবদ্বীপ আক্রমণ করিলে তিনি খিড়কীর দ্বার দিয়া বহির্গত হইয়া বঙ্গের রাজধানী সমতট (রামপাল) নগরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বখতিয়ার নবদ্বীপ লুণ্ঠন পূর্বক লক্ষণাবতী (গৌড়) নগরে গমন করত তথায রাজপাট সংস্থাপন করিয়াছিলেন। বাঙ্গালার মুসলমান শাসনকর্তাগণের স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনের পূর্বে লক্ষ্মণাবতীর শাসনকৰ্ত্তাগণ “মালিক” উপাধি দ্বারা পরিচিত হইতেন।
দিল্লীর পাঠান সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের, তাতার জাতীয় জনৈক সাহসিক কার্য্যক্ষম ও বুদ্ধিমান ক্রীতদাস ছিল। তাঁহার নাম তুগ্রল। লক্ষণাবতীর মালিক তাতার খাঁ ৬৭৬ হিং সালে (১১৯৯ শকাব্দে) পরলোক গমন করিলে সুলতান বলবন সেই ক্রীতদাস তুগ্রলকে তৎপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তুগ্রল লক্ষ্মণাবতীর মালিকের পদ গ্রহণ করিয়া প্রবল বিক্রমে শাসন দণ্ড পরিচালন করিতে লাগিলেন।
কুমার রত্নফা পৈত্রিক রাজ্য হইতে বহিষ্কৃত হইয়া লক্ষ্মণাবতীতে উপনীত হইলেন। মালিক তুগ্রল তাঁহার পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া রাম-প্রীতির সহিত তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন। কুমার রত্নফা কিছুকাল তথায় বাস করিয়াছিলেন। অবশেষে তুগ্রল ত্রিপুর রাজকুমারের সাহায্যার্থ বৃহৎ একদল সেনা প্রদান করেন। রত্নফা সেই সেনাদলের সহিত ত্রিপুরায় (৯) উপনীত হইলে দেশস্থ প্রাচীন সুহৃদবর্গ তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিলেন। ভীষণ সংগ্রামে মহারাজ রাজাফা ও তাহার অনুজগণ হত হইলেন ৬৯২ ত্রিপুরাব্দে (১২০১ শকাব্দে) ভ্রাতৃরুধিরে বিজয়ী পতাকা অনুরঞ্জিত করিয়া মহারাজ রত্নফা ত্রিপুর সিংহাসন আরোহণ করেন। মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ ইহাকেই তুগ্রল কর্তৃক ত্রিপুরা জয় বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।[১] মহারাজ রত্নফা মৃগয়া উপলক্ষে নিবিড় অরণ্যে প্রবেশ করত একটি অত্যুজ্জ্বল “ভেক মণি” প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।[২] তিনি সেই ভেকমণি ও একশত হস্তী তুগ্রলকে (৩০) উপঢৌকন প্রদান করেন। তুগ্রুল তখন দিল্লীশ্বরের অধীনতা শৃঙ্খল ছেদন পূর্বক “সুলতান মোবিস উদ্দিন তুগ্রল” আখ্যা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি মহারাজ রত্নফা কর্তৃক উজ্জ্বলমণি উপহার প্রাপ্ত হইয়া তাহাকে “মাণিক্য” উপাধি প্রদান করিলেন। মহারাজ রত্নফা “মহারাজ রত্ন মাণিক্য” বলিয়া আখ্যাত হইলেন।[৩] প্রাচীন “ফা” উপাধি পরিত্যক্ত হইল। অদ্যাবধি ত্রিপুরেশ্বরগণ ফার পরিবর্ত্তে সেই “মাণিক্য” উপাধি ধারণ করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু কল্যাণ মাণিক্যের রাজ্যাধিকারের পূর্ব পর্য্যন্ত রাজপুত্র রাজ পরিবারস্থ অন্যান্য ব্যক্তিগণ “ফা” উপাধি গ্রহণ করিতেন।
মহারাজ রত্নমাণিক্যের সময়েই মুসলমানদিগের সহিত সংশ্রব আরম্ভ হয়, এজন্য পার্শি ও বাঙ্গালা ভাষার রাজকার্য্য নির্বাহ আবশ্যক হইয়াছিল। রতু মাণিক্য যৎকালে লক্ষ্মণাবতী নগরে অবস্থান করেন তৎকালে তিন জন বাঙ্গালি ভদ্রলোকের সহিত তাঁহার সবিশেষ পরিচয় হইয়াছিল। তাহার দুইজন লিপি ব্যবসায়ী কায়স্থ অন্য ব্যক্তি চিকিৎসা ব্যবসায়ী। কায়স্থদ্বয়ের মধ্যে এক ব্যক্তি দক্ষিণ রাঢ়ী ঘোষ বংশজাত, (৩১) তাঁহার নাম বড় খাণ্ডব ঘোষ।[৪] দ্বিতীয় ব্যক্তি “রাজ” বংশজাত তাঁহার নাম পণ্ডিতরাজ। চিকিৎসা ব্যবসায়ী ধন্বন্তরি গোত্রজ সেন বংশীয়, তাহার নাম জয়নারায়ণ সেন।[৫]
মহারাজ রত্ন মাণিক্য রাজদণ্ড ধারণ করিয়া এই তিন ব্যক্তিকে স্বরাজ্যে আনয়ন করেন। তিনি তাঁহাদিগকে নানা প্রকার প্রলোভন দ্বারা পুরুষানুক্রমে প্রতিপালন করিবেন বলিয়া, জায়গীর, নিষ্কর ও বৃত্তি প্রদান পূর্বক এই অনার্য্য প্লাবিত অরণ্যময় দেশে উপনিবেশ সংস্থাপন করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রথমত আধুনিক সরালি পরগণার অন্তর্গত কালিকচ্ছ গ্রামে উপনিবিষ্ট হন। কিছুকাল ॥ ৩২॥ অন্তে তাঁহারা সেই স্থান পরিত্যাগ পূবর্বক রাজধানী কৈলার গড়ে বাস ভবন নির্ম্মাণ করেন। তদনন্তর ত্রিপুরেশ্বরদিগের রাজধানী পরিবর্তনের সহিত ঘোষ, রাজ ও সেনের বংশধরগণ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বাসস্থান নির্মাণ করিয়া অদ্যাপি ত্রিপুরেশ্বর দিগের অধিকারভুক্ত স্থানে বাস করিতেছেন।
বড় খাণ্ডব ঘোষ ও রাজবংশীয় পণ্ডিতরাজ দ্বারা মহারাজ রত্নমাণিক্য মুসলমানদিগের অনুকরণে শাসন প্রণালী ও “সেরেস্থা” গঠন করিয়াছিলেন। তাঁহারা ত্রিপুরেশ্বরের অত্যন্ত বিশ্বাসী বলিয়া “বিশ্বাস” উপাধি প্রাপ্ত হন। উত্তর কালে জয়নারায়ণ সেনের বংশধরগণ চিকিৎসা ব্যবসায় পরিত্যাগ পূবর্বক রাজকার্য্যে, প্রবেশ করত বিশ্বাস উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তৎকালে তীষ্ণা পরগণার অন্তর্গত বাতিসা নিবাসী “বৈদ্যগণ” ত্রিপুরায় উপনীত হইয়া রাজ চিকিৎসকের পদ গ্রহণ করেন। ফলত আদি রত্নমাণিক্যের শাসনকাল হইতে কৃষ্ণমাণিক্যের অভ্যুদয়ের পূর্বাবধি ঘোষ, রাজ, ও সেন বংশীয় “বিশ্বাসগণ” একচেটিয়াভাবে সুদীর্ঘকাল ত্রিপুরার রাজকার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। উজির, দেওয়ান ও সেনাপতির পদ হইতে সামান্য লেখকের (মোহরের) কার্য্য উল্লেখিত তিন বংশের বংশধরদিগের একচেটিয়া ছিল। কদাচিৎ তাঁহাদের বিশেষ সম্পর্কিত (জামাতা, ভাগিনেয়, দৌহিত্র) রাজকার্য্যে প্রবেশ লাভ করিয়া “বিশ্বাস” উপাধি )৩৩) প্রাপ্ত হইতেন, কিন্তু তাঁহারা “উপবিশ্বাস” আখ্যা দ্বারা সর্বত্র পরিচিত ছিলেন।[৬]
প্রবাদ অনুসারে মহারাজ রত্নমাণিক্যের শাসনকালে এক দল ব্রাহ্মণ ত্রিপুরায় উপনীত হইয়া তত্রত্য প্রাচীন ব্রাহ্মণ দিগকে নির্যাতন পূর্বক রাজকীয় পৌরোহিত্য গ্রহণ করেন।[৭] সেই প্রাচীন ব্রাহ্মণদিগের বংশধরগণ অধুনা পার্বত্য ত্রিপুরাদিগকে যাজন করিয়া কথঞ্চিৎ জীবিকা নির্বাহ করিতেছেন।
উল্লেখিত রাজ পুরোহিতগণ ব্যতীত এই সময়ে আরও কতকগুলি ব্রাহ্মণ ত্রিপুরায় উপনিবিষ্ট হন। তাহারা ঘোষ, রাজ ও সেন বংশীয়দিগের সংশ্রবে এদেশে আগমন করেন। বড় খাণ্ডব ঘোষের যে বংশাবলী তাঁহার উত্তর পুরুষগণ নিকটে রক্ষিত হইয়াছে, তাহাতে লিখিত আছে যে, উক্ত ঘোষ (৩৪) মহাশয়ের সহিত তাঁহার গুরু জগন্নাথ চক্রবর্ত্তী ও পুরোহিত (সাবর্ণ গোত্রজ) তরণি মিশ্র আগমন করিয়াছিলেন।[৮] প্রকৃতপক্ষে রত্নমাণিক্যের শাসনকালে ব্রাহ্মণ কায়স্থ ও বৈদ্যদিগের ত্রিপুরায় উপনিবেশ সংস্থাপন করিবার পন্থা বিশেষ রূপে পরিষ্কৃত হইয়াছিল।
মহারাজ রত্নমাণিক্য প্রবল পরাক্রমের সহিত দীর্ঘকাল রাজত্বের পর দুই পুত্র বর্তমান রাখিয়া মানবলীলাসংবরণ করেন।
রত্নমাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রতাপমাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁহার রাজ্য শাসনকালে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশ (সমতট) মুসলমানদিগের কুক্ষিপ্রবিষ্ট হইয়াছিল। (১৩২৩ খ্রিস্টাব্দ)। মুসলমান শাসনকর্তাগণ সমতট নগরী পরিত্যাগ পূর্বক সুবর্ণগ্রামে রাজপাট সংস্থাপন করেন।
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে মালিক ফকিরদ্দিন “সুলতান সেকেন্দর” আখ্যা গ্রহণ পূর্বক বাঙ্গালায় স্বাধীনতা পতাকা উডডীন করেন। সুবর্ণগ্রামে রাজপাট সংস্থাপন করেন।
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে মালিক ফকিরদ্দিন “সুলতান সেকেন্দর” আখ্যা গ্রহণ পূর্বক বাঙ্গালায় স্বাধীনতা পতাকা উডডীন করেন। সুবর্ণগ্রামে তাঁহার রাজ-সিংহাসন সংস্থাপিত ছিল। সুতরাং তথা হইতে ত্রিপুরা আক্রমণ ও লুণ্ঠন মুসলমানদিগের পক্ষে (৩৫) বিশেষ সুবিধাজনক হইয়াছিল। হস্তি সংগ্রহ মুসলমানদিগের ত্রিপুরা আক্রমণের প্রধান কারণ।[৯]
১২৬৯ শকাব্দে (১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে) বাঙ্গালার পাঠান সুলতান সামস্উদ্দিন আবুল মোজাফর ইলিয়া সাহ ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। তিনি মহারাজ প্রতাপমাণিক্যকে পরাজয় করিয়া অর্থ ও হস্তী সংগ্রহ করিয়াছিলেন। এই সময় চট্টগ্রাম মুসলমানদিগের কুক্ষিগত হয়। ১২৭২ শকাব্দে মুর পরিব্রাজক ইবনবতোতা পীর বদরুদ্দিনের দর্শন জন্য চট্টগ্রামে গমন করেন। তৎকালে সুলতান ফকিরুদ্দিন চট্টগ্রামের করগ্রাহি অধিপতি ছিলেন।
অপুত্রাবস্থায় প্রতাপ মাণিক্য কাল কবলিত হন। তদন্তে তাঁহার কনিষ্ট ভ্রাতা মুকুট মাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন তিনি দীর্ঘকাল রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। ১৩১৭ শকাব্দে (১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিপুরেশ্বর আরাকানপতি রাজা মেংদির নিকট উপঢৌকন প্রদান পূর্বক তাঁহার প্রসন্নতা লাভ করিয়াছিলেন। আরাকানের ইতিহাস “রাজোয়াং” গ্রন্থে ত্রিপুরা ॥ ৩৬॥ “খুরতন” আখ্যায় পরিচিত হইয়াছে[১০] মুকুট মাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র মহামাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি বহু শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ও পরম ধার্ম্মিক ছিলেন। তাঁহার পাঁচটি পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে ধর্ম্ম ও তৎকনিষ্ঠ গগনফার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জ্যেষ্ঠ কুমার ধর্ম্ম পিতার বর্তমানে সন্ন্যাস গ্রহণ পূর্বক তীর্থ পর্য্যটন করিতেছিলেন। অপর রাজকুমারগণ পিতৃ-বিয়োগ সময়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন।
কুমার ধর্মদেব সন্ন্যাসী বেশে বারাণসীনগরে অবস্থানকালে একদা মধ্যাহ্নসময়ে মণিকর্ণিকাতটে নিদ্রিত ছিলেন; তৎকালে এক প্রকাণ্ড কালফণী ফণা বিস্তারপূর্বক তাঁহার মস্তক মার্ত্তগু দেবের প্রখর উত্তাপ হইতে রক্ষা করিতেছিল। কান্যকুব্জ দেশীয় জনৈক ব্রাহ্মণ এই ঘটনা দর্শনে নিতান্ত বিস্মিত হইয়া, তাঁহার নিদ্রাভঙ্গের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কুমার জাগ্রত হইলে বিষধর স্বস্থানে প্রস্থান ॥৩৭॥ করিল। তখন সেই ব্রাহ্মণ তৎসমক্ষে উপনীত হইয়া তাঁহার পরিচয় গ্রহণ করিলেন। তাঁহার পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া সেই ব্রাহ্মণ বলিলেন, কুমার! আপনি স্বদেশে গমন করুন, শীঘ্রই আপনার মস্তকে রাজছত্র ধৃত হইবে। আপনি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলে আমি সপরিবারে আপনার সহিত ত্রিপুরায় গমন করিতে প্রস্তুত আছি। এই সময়ে ত্রিপুরা হইতে কয়েকজন লোক তাঁহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া বারাণসী নগরে উপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা কুমারের সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া তাঁহাকে বলিল, “কুমার! আপনার পিতা বসন্ত রোগে মানবলীলা সংবরণ করিয়াছেন, সৈন্যগণ প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, আপনার জীবিতাবস্থায় অন্যের কথা দূরে থাকুক, আপনার অনুজকেও সিংহাসন আরোহণ করিতে দিবে না।” কুমার ধর্ম্ম এই বাক্য শ্রবণে ত্রিপুরায় গমন করিয়া রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন। কান্যকুব্জ দেশীয় কৌতুক নামক সেই ব্রাহ্মণ সপরিবার তাঁহার সহিত আগমন করিয়া ছিলেন। ১৩২৯ শকাব্দে মহারাজ ধর্মমাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন।
মহারাজ ধর্মমাণিক্য কান্যকুব্জ দেশীয় সেই ব্রাহ্মণকে স্বীয় পৌরোহিত্যে বরণ করিয়াছিলেন। তিনি বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর নামক প্রাচীন পুরোহিত দ্বয়ের নিকট স্বীয় পিতৃপুরুষগণের যে কীৰ্ত্তি কাহিনী শ্রবণ করিয়াছিলেন তাহাই বাঙ্গলা (৩৮) পয়ার ছন্দে লিখিত হইয়া “রাজমালা” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। রাজমালা গ্রন্থে লিখিত আছে যে, তিনি “ধর্মসাগর” নামক সুবৃহৎ দীর্ঘিকা খনন করাইয়া ছিলেন।[১১] এই সরোবরের খনন কার্য্য দুই বৎসরে শেষ হইয়াছিল। সেই দীর্ঘিকা উৎসর্গ কালে ১৩৮০ শকাব্দের বৈশাখ মাসে সোমবার শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে তিনি তাম্রশাসন দ্বারা কৌতুক ও অন্যান্য ৭ জন ব্রাহ্মণকে “২৯ দ্রোণ শস্য পূর্ণ ভূমি” ব্রহ্মোত্তর প্রদান করিয়াছিলেন। সেই সকল সনন্দে মহারাজ ধর্মমাণিক্য লিখিয়াছিলেন— “আমার বংশ বিলুপ্ত হইলে যদি এই রাজ্য অন্য কোন নরপতির করতলস্থ হয়, তাহা হইলে আমি তাঁহার দাসানুদাস হইব, তিনি যেন ব্রহ্মবৃত্তি লোপ না করেন।”[১২] (৩৯)
মহারাজ ধর্মমাণিক্য ধর্ম্মপরায়ণ নরপতি ছিলেন। তাঁহার জীবনের অধিকাংশ সময় সৎকার্য্যে ব্যয়িত হইয়াছিল। তাঁহার দুইটী পুত্র জন্মে, জ্যেষ্ঠ ধন্য, কনিষ্ঠ প্ৰতাপ
মুসলমানদিগের কৃত অত্যাচারের প্রতিশোধ লইবার॥ ৪০ মানসে মহারাজ ধর্মমাণিক্য বঙ্গদেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। তিনি ভীষণ সংগ্রামে সুলতান আবুল মোজাহেদ আহাম্মদ সাহকে জয় করত সুবর্ণগ্রাম লুণ্ঠন পূর্বক স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। মহারাজ ধর্মমাণিক্যের শাসনকালে আরাকানপতি “মেং- সো মোয়ান” ব্রহ্মরাজ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়া ত্রিপুরপতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। ত্রিপুর সৈন্যের বাহুবলে মগরাজ স্বীয় সিংহাসন পুনর্বার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মহারাজ ধর্মমাণিক্য যেরূপ ধর্মপরায়ণ ছিলেন, তদ্রূপ একজন প্রবল পরাক্রমশালী নরপতিও ছিলেন।
ধর্মমাণিক্যের মৃত্যুর পর সেনাপতিগণ ষড়যন্ত্র করিয়া তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্ৰ (দ্বিতীয়) প্রতাপ মাণিক্যকে সিংহাসনে স্থাপন করেন। তিনি অতি অল্পকাল রাজ্যশাসন করিয়া জনৈক দুষ্ট সেনাপতি কর্তৃক গোপনে নিহত হন।
কনিষ্ঠ ভ্রাতার হত্যার পর জ্যেষ্ঠ ধন্যমাণিক্য ১৪১২ শকাব্দে ( ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে) সিংহাসন আরোহণ করেন।
মহারাজ ধন্যমাণিক্য রাজাসনে উপবেশন করিয়া দেখিলেন, সৈনিকগণ যার পর নাই পরাক্রান্ত হইয়াছে। তাহারা যখন যাহাকে ইচ্ছা করে, তখনই তাহাকে সিংহাসন প্রদান করিতে পারে। অতএব ইহাদিগকে আশু দমন করা কর্ত্তব্য। এ বিষয়ে বিশ্বস্ত অমাত্যগণের সহিত পরামর্শ করিলেন। পরামর্শ স্থির হইলে মহারাজ এক দিবস পীড়ার (৪১) ভান করিয়া, সেনাপতিগণকে নিভৃত স্থানে আহ্বান করিলেন। তদনুসারে দশজন সেনাপতি সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তখন হঠাৎ কতিপয় ব্যক্তি আসিয়া অসি দ্বারা তাহাদিগের মস্তকচ্ছেদন করিল। একপ্রকার কুচক্রী সেনাপতিগণের অদৃষ্টে প্রায়ই ঈদৃশ অবস্থা ঘটিয়া থাকে। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক সাম্রাজ্যের জেনিজারি নামক সৈন্যগণের এই দশা ঘটিয়াছিল। ত্রিপুরার সেনাপতিরাও জেনিজারি এবং মিসর দেশীয় মেমলুক্সদিগের ন্যায় প্রায়ই রাজকার্য্যে বলপূর্বক হস্তক্ষেপ করিত।
মহারাজ ধন্যমাণিক্য কুচক্রী সেনাপতিগণকে নিপাত করিয়া বিশ্বস্ত সমরকুশল রায় চয়চাগ নামক ব্যক্তির উপর সমস্ত সৈন্যের ভার অর্পণ করেন। সেই সময় ত্রিপুরার পূর্বদিকে একটী শ্বেত হস্তী দৃষ্টিগোচর হয়। মহারাজ ধর্মমাণিক্য তাহা ধরিবার জন্য আদেশ করেন; কিন্তু থানাসীনগরের কুকি নরপতি ঐ হস্তীটিকে আবদ্ধ করাতে ত্রিপুর সেনাপতি একদল সৈন্য লইয়া কুকিদিগের বিরুদ্ধে যাত্রা করিলেন। সেনাপতি প্রথমত থানাসীননগরের কুকিরাজকে পরাজয় করিয়া শ্বেতহস্তী হস্তগত করেন, তৎপর অন্যান্য (৪২) কুকিগণকে সম্পূর্ণরূপে পদানত করিয়া রাঙ্গামাটীয়া নগরীতে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। সৈন্যাধ্যক্ষ রায় চয়চাগ কর্তৃক কুকিগণ যেরূপ অবস্থায় পরাজিত এবং নিহত হইয়াছিল, আর কখনও কুকিগণ সেই প্রকার অবস্থাপন্ন হয় নাই। তিনি অনেকানেক কুকি স্ত্রীলোক আবদ্ধ করিয়া আনিয়াছিলেন। মহারাজ ধন্যের শাসন সময়েই ত্রিপুরার পূর্ব-প্রান্তস্থিত সমস্ত কুকিজাতি, সেনাপতি রায় চয়চাগের বাহুবলে ত্রিপুরার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে ত্রিপুরার পূর্বসীমা ব্রহ্মদেশের সহিত সংযুক্ত হইয়াছিল।
মহারাজ ধন্যমাণিক্য, বাঙ্গালার সুবিখ্যাত সৈয়দ বংশীয় আলাউদ্দিন ওয়াদ্দিন আবুল মোজাফর হুসন সাহ এবং আরাকানের প্রবল বিক্রম নরপতি মেং রাজার সমসাময়িক। তাঁহারা উভয়েই ত্রিপুরা ধ্বংস করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তুমহারাজ ধন্যমাণিক্য ও তাঁহার সুবিখ্যাত সেনাপতি রায় চয়চাগের বাহুবলে তাঁহারা কৃতকার্য হন নাই।
ধন্যমাণিক্যের রাজ্যাভিষেকের অল্পকাল পরে চট্টগ্রামের আধিপত্য লইয়া এক তুমুল কাণ্ড উপস্থিত হয়, তাহাতে হিন্দু, মুসলমান ও মগ এই জাতিত্রয়ের রুধিরে চট্টলাচল রঞ্জিত হইয়াছিল। ত্রিপুর সেনানী মহাবীর রায় চয়চাগ হনুমান ॥৪৩॥ মূৰ্ত্তি-লাঞ্ছিত- পতাকা লইয়া অগ্রসর হইলেন, আরাকানরাজ বৃষভ ধবজ, -ও হুসনসাহেহর সৈন্যগণ অৰ্দ্ধচন্দ্র শোভিত- পতাকা লইয়া সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। দীর্ঘকাল সংগ্ৰাম চলিয়াছিল। অবশেষে যবন ও মগদিগের ভুজগর্ব খর্ব করিয়া যায় সেনানী বিজয়ী পতাকায় পরিশোভিত হইয়াছিলেন।
“কামরূপ ও কোমতা বিজয়ী” হুসেন সাহ এই অপমান সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি বাঙ্গালার দ্বাদশ বিভাগ হইতে সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং গৌর মল্লিককে তাহার সৈনাপত্যে নিয়োগ করিয়া ত্রিপুরায় প্রেরণ করিলেন। কুমিল্লা নগরীতে গৌর মল্লিকের সহিত চয়চাগের প্রথম সংগ্রাম হয়। সেই যুদ্ধে ত্রিপুর সৈন্যেরা পরাজিত হইয়া পশ্চাতে হটিয়া গেলে, মুসলমানেরা মেহেরকুল দুর্গ অধিকার করিয়া ক্রমশ রাজধানী রাঙ্গামাটীয়ার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ত্রিপুর সৈন্যেরা সোনামাটীয়ার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া গোমতী নদীতে একটী বাঁধ নির্মাণ করে; তাহাতে ৩ দিবস নদীর জলস্রোত বদ্ধ ছিল। তৎপরে যখন মুসলমান সৈন্য জলশূন্য শুষ্ক গোমতী অতিক্রম করিতেছিল, তখন তাহারা ঐ বাঁধ ভাঙ্গিয়া দেওয়ায় মুসলমানদিগের পক্ষে ত্রিপুরা বিজয় অপেক্ষা প্রাণ রক্ষা কঠিন হইয়া উঠে। প্রায় অধিকাংশ মুসলমান জলমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়া (৪৪) ছিল।[১৩] অবশিষ্ট মুসলমান সৈন্য নিতান্ত নিরুপায় হইয়া পরিশেষে চণ্ডীগড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু তাহাতেও তাহারা নিরাপদ হইল না। ত্রিপুরসৈন্যেরা রাত্রিশেষে মুসলমানদিগের মধ্যে প্রবেশ করত অস্ত্রাঘাতে তাহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিল। অতি অল্প সংখ্যক মুসলমান প্রাণ লইয়া পলায়ন করিতে সক্ষম হইয়াছিল। কথিত আছে ত্রিপুর সৈন্য মেহেরকুল দুর্গে পরাজিত হইলে, শত্রুজয় উদ্দেশ্যে মহারাজ ধন্যমাণিক্য একটী কৃষ্ণবর্ণ চণ্ডাল বালককে বলি প্রদান করিয়া ভবানীর পূজা করিয়াছিলেন।
মুসলমানদিগকে জয় করিয়া মহারাজ ধন্যমাণিক্য একটি বৃহৎ সরোবর খনন করাইয়াছিলেন। সেই বাপী অদ্যাপি “ধন্যের দীঘি” আখ্যায় পরিচিত হইয়া থাকে।[১৪] সেই সরোবর তীরে মহারাজ ধন্য মাণিক্য বিজয়স্তম্ভস্বরূপ এক মঠ নির্মাণ করিয়াছিলেন। সেনাপতি চয়চাগ হুসেন সাহের গর্ব খর্ব করিয়া মগদিগের পশ্চাৎ ধাবিত হইয়াছিলেন। তিনি মগদিগকে (৪৫) বারংবার পরাজয় করিয়া আরাকানের কিয়দংশ ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত করেন।[১৫]
এদিকে হুসেন সাহ পুনরায় বৃহৎ এক দল সৈন্যের সহিত হাতিয়ান খাঁকে রাঙ্গামাটীয়া অধিকার করিবার জন্য প্রেরণ করিলেন। সেনাপতি চয়চাগ চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য কতিপয় সৈন্য রাখিয়া অবশিষ্ট সৈন্যের সহিত হাতিয়ান খাঁকে অবরোধ করিতে অগ্রসর হইলেন। কুমিল্লার নিকটে উভয় দল একত্রিত হয়; তাহার পর দিবস প্রত্যুষে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল, সমস্ত দিন সংগ্রামের পর চয়চাগ পরাজিত হইয়া পশ্চাৎ হটিয়া গেলেন। কিন্তু পুনরায় পূর্ব কৌশল অবলম্বন করিয়া গোমতী স্রোতে মুসলমানদিগকে ভাসাইয়া দিয়াছিলেন। হাতিয়ান খাঁ পলায়ন করিয়া শুগড়িযা দুর্গ মধ্যে আসিয়া মস্তকে হস্ত প্রদান করিয়া বসিলেন এবং বলিলেন “যদি ত্রিপুরা জয় করিতে হয়, তবে দ্বিগুণ সৈন্য লইয়া রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে।” কিন্তু তিনি স্বীয় প্রভুর নিকট উপস্থিত হইবামাত্র পদচ্যুত হইলেন।
মহারাজ ধন্য মাণিক্য বন্দিকৃত শত্রুগণকে বলি প্রদান (৪৬) করিয়া মহোৎসবের সহিত চতুৰ্দ্দশ দেবতার পূজা করিলেন। ত্রিপুরাতে বার্ষিক এক সহস্র নরবলির প্রথা আবহমানকাল প্রচলিত ছিল। মহারাজ ধন্যমাণিক্য তাহা রহিত করিয়া কেবল অপরাধী এবং যুদ্ধে বন্দিকৃত শত্রুকে বলি দেওয়ার প্রথা প্রচলন করেন।
এই সময় মহারাজ ধন্যমাণিক্য দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। উক্ত মন্দিরের খোদিত লিপিতে লিখিত আছে যে, ১৪২৩ শকাব্দে উহা নির্মিত হইয়াছিল।[১৬] রাজমালায় লিখিত আছে, দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী চট্টলাচল মধ্যে লুক্কায়িত ছিলেন। তিনি স্বপ্নে মহারাজ ধন্যমাণিক্যের প্রতি আদেশ করেন। তদনুসারে ধন্যমাণিক্য দেবীকে রাঙ্গামাটীয়া নগরে আনয়ন পূর্বক তাঁহার পূজা (৪৭) প্রচার করেন। এই দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী দ্বারা তান্ত্রিক জগতে ত্রিপুরা একটি তীর্থ (পীঠ) স্থান বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। মহারাজ ধন্যমাণিক্য স্বর্ণময়ী ভুবনেশ্বরী দেবী নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তিনি অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করিয়া শিব ও শক্তি মুর্ত্তি সংস্থাপন করেন। তিনি স্বয়ং শৈব ছিলেন।
হুসন সাহ তৃতীয় বার ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। এইবার তিনি কুমিল্লার পথ পরিত্যাগ পূর্বক রাজধানী কৈলারগড় (মুসলমান লেখকদিগের লিখিত জাজিনগর) অভিমুখে ধাবিত হইয়াছিলেন। কৈলারগড় (আধুনিক কসবা) নগরের প্রায় এক মাইল পশ্চিম দক্ষিণ দিকে বিজয় নদীর তীরে তাঁহার সৈন্যগণ শিবির সংস্থাপন করিয়াছিল। এই স্থানের পূর্বদিকে উক্ত নদীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ পার্শ্বে যে প্রকাণ্ড গড় খাত হইয়াছিল, তাহার চিহ্ন অদ্যাপি বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। সেই সেনানিবাস উত্তর দক্ষিণে ৯৫০ হাত দীর্ঘ, আমরা তাহার পরিমাপ করিয়াছি। এই সেনানিবাস রক্ষা করিবার জন্য বিজয় নদীর উভয় তীরে যে উচ্চ মৃন্ময় প্রাচীর নির্মিত হইয়াছিল তাহার চিহ্ন অদ্যাপি বিলুপ্ত হয় নাই।[১৭] (৪৮)
কৈলারগড় সন্নিকর্ষে হুসেন সাহের সহিত মহারাজ ধন্যমাণিক্যের যে সংগ্রাম হইয়াছিল, রাজমালা লেখক তাহার কোন উল্লেখ করেন নাই। বোধ হয় ইহার পরিণাম ত্রিপুরেশ্বরের পক্ষে বিশেষ গৌরবজনক হয় নাই, এজন্যই রাজমালা লেখক তাহা গোপন করিয়াছেন। তৃতীয় যুদ্ধে যে (৪৯) হুসেন সাহ ত্রিপুরার কিয়দংশ অধিকার করিয়াছিলেন এইরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
সুবর্ণ গ্রামের এক মসজিদের দ্বারস্থ প্রস্তর লিপি পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, সুলতান হুসেন সাহের শাসন কালে “ইক্লাম মোজমাবাদের” উজীর এবং ত্রিপুরা ভূমির শাসনকর্তা খঁওয়াম খাঁ (১৪৩৫ শকাব্দ) সেই মসজিদ নির্মাণ করিয়াছিলেন। ইহা দ্বারা বিশেষ ভাবে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, হুসন সাহ ত্রিপুরার কিয়দংশ জয় করিতে সক্ষম হন।[১৮] ইক্লাম মোজমাবাদ অর্থাৎ সুবর্ণগ্রামের উজীরের হস্তে সেই বিজিত অংশের শাসন ভার (৫০) অর্পিত হইয়াছিল। বাঙ্গালার পূর্ব ও উত্তর দিকস্থ রাজ্য সমূহ জয় করিয়া হুসন সাহ “কামরু (কামরূপ) কাতা (কোম্তাপুর) ও জাজনগর (ত্রিপুরা) বিজয়ী” উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু এই সকল বিজিত রাজ্য বা রাজ্যাংশ দীর্ঘকাল মুসলমানদিগের শাসনাধীন ছিল না।
মহারাজ ধন্যমাণিক্য যৎকালে হুসেন সাহের সহিত সমরে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময় আরাকান পতি নির্বিবাদে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। ১৪৩৯ শকাব্দে পর্তুগীজ ভ্রমণকারী জন, ডি, সেলবেরা আরাকান— রাজকর্তৃক আহুত হইয়া চট্টগ্রাম পরিদর্শন পূর্বক মগরাজ্যে গমন করেন। তৎকালে চট্টগ্রাম আরাকান পতির হস্তে ছিল।
মহারাজ ধন্যমাণিক্যের রাজ্ঞী মহাদেবী কমলা রাজধানী কৈলারগড় যে দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন, তাহা অদ্যাপি “কমলাসাগর” নামে পরিচিত হইয়া থাকে। কমলাসাগরের জল অতি উৎকৃষ্ট।
ধন্যমাণিক্য ৩০ বৎসর রাজ্যশাসন করিয়া বসন্ত রোগে মানবলীলা সংবরণ করেন। মহাদেবী কমলা ধবজ এবং দেব নামে দুই পুত্র বর্তমান রাখিয়া স্বামীর সহিত অনুমৃতা হইলেন।
ধন্যমাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ধবজমাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি অল্পকাল রাজ্য শাসন করিয়া পরলোক গমন করিয়াছিলেন। ইন্দ্র নামে তাহার (৫১) এক শিশু পুত্র ছিল। তাঁহাকে দূরীকৃত করিয়া তাঁহার পিতৃব্য দেব মাণিক্য ১৪৪২ শকাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। ১৪৪৪ শকাব্দে তিনি আরাকান পতি গজাবদিকে জয় করিয়া চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু ইহার অল্পকাল পরে হুসন সাহের পুত্র সুলতান নাছিরদ্দিন নছরৎ সাহ, স্বর্গীয় পিতার প্রেতাত্মার পরিতোষ সাধন জন্য চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। তিনি পুর্ণমনোরথ হইয়াছিলেন। হুসন সাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁর বাহুবলে চট্টগ্রাম নছরথ সাহের কুক্ষিগত হইয়াছিল। অনেকেরই এরূপ সংস্কার যে, নছরথ সাহ চট্টগ্রাম বিজয় করিয়া তথায় মহম্মদীয় ধর্ম প্রচার জন্য বিশেষ যত্নবান হইয়াছিলেন। এবং তাঁহার অত্যাচার পূর্ব ও দক্ষিণ বাঙ্গালার নীচ শ্রেণীর লোকে সেই ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল। নছরথ সাহ পরাগল খাঁকে চট্টগ্রামের শাসন কর্তৃত্বে নিয়োগ করিয়াছিলেন।[১৯] (৫২)
নছরথ সাহের সৈন্য কর্তৃক পরাজিত হইয়া দেব মাণিক্য রাজধানী রাঙ্গামাটীয়া নগরে উপনীত হইলেন। তিনি কয়েকজন বিপক্ষ সৈন্যকে বন্দিস্বরূপ লইয়া আইসেন। তাহাদিগকে চতুৰ্দ্দশ দেবতার নিকট বলিদান করা হয়। চতুৰ্দ্দশ দেবতার প্রধান পূজক চন্তাই দেব মাণিক্যকে বলিলেন মহাদেব আদেশ করিয়াছেন “রাজা, তাহার প্রধান যোদ্ধৃগণকে বলিদান করিলে, চতুৰ্দ্দশ দেবতা তৎপ্রতি প্রসন্ন হইবেন। তদনুসারে দেবমাণিক্য স্বীয় প্রধান সেনানী (৫৩) ৮ জনকে বলি দিয়াছিলেন। পরে তিনি জানিতে পারিলেন, চন্তাই ধবজমাণিক্যের পত্নীর সহিত মিলিত হইয়া তাঁহাকে বধ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। তখন তিনি আত্মরক্ষার জন্য সতর্ক হইলেন এবং চন্তাইর বধোপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার সতর্ক হওয়ার সময় অতীত হইয়া গিয়াছিল। চন্তাই দেব মাণিক্যকে ৯৪৫ ত্রিপুরাব্দে গোপনে হত্যা করিলেন। চন্তাই ধবজমাণিক্যের অল্পবয়স্কপুত্র ইন্দ্ৰমাণিক্যকে সিংহাসনে স্থাপন করিয়া প্রচার করিলেন-চতুৰ্দ্দশ দেবতার উপযুক্তরূপে অর্চ্চনা না করায় দেবমাণিক্য তাঁহাদের কর্তৃক নিহত হইয়াছেন।” চন্তাই ইন্দ্ৰমাণিক্যের মাতার সহিত মিলিত হইয়া রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহাদিগের এই ষড়যন্ত্র মূলক রাজ্যশাসন অল্প দিন (৫৪) মাত্র স্থায়ী হইয়াছিল। সৈন্যগণ যখন জানিতে পারিল, চন্তাই রাজ্ঞীর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া দেবমাণিক্যকে হত্যা করিয়াছেন, তখন তাঁহারা প্রধানমন্ত্রীর সহিত পরামর্শ করিয়া প্রথমেই চন্তাইকে এবং তৎপরে মাতার সহিত ইন্দ্রমাণিক্যকে নিহত করিয়া মৃত্তিকায় সমাহিত করিল। ইন্দ্রমাণিক্যের রাজ্য শাসন কাল ৪ মাসের অধিক হইবেক না।[২০]
প্রবল বিক্রম সম্রাট সের সাহের শাসনকালে ত্রিপুরার অন্তর্গত অনেকগুলি পরগণা তাঁহার শাসন দণ্ডের অধীন ছিল। সের সাহ সুবর্ণ গ্রাম হইতে পাঞ্জাব পৰ্য্যন্ত এক প্ৰশস্ত রাজমার্গ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। মেঘনার পূর্বতীর হইতে বলদাখাল ও নুরনগর পরগণার মধ্যদিয়া ত্রিপুরা পর্বতের পাদমূল পর্য্যন্ত যে রাজপথ নির্ম্মিত হইয়াছিল তাহার ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। সর্ব সাধারণে অদ্যাপি সেই রাজমার্গকে “পুরারাজার জাঙ্গাল” বলিয়া থাকে। দেব মাণিক্যের অভিষেক কাল হইতে বিজয় মাণিক্যের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্য্যন্ত ত্রিপুরার অধিকার কিয়ৎ পরিমাণে খর্ব হইয়াছিল।(৫৫)
.
টীকা
১. In the year 678 (1279 A. D) he assembled a very numerous army, and invaded the country of Jasenagur (Tipperah). After having defeated the Raja in a general engagement, he plundered the inhabitants, and brought away with him immense wealth and one hun- dred elephants, Stewart’s History of Bengal, p. 44.
২. ‘সমসরগাজি নামা’ পুস্তকে এই ভেকমনির এক আশ্চর্য্য ইতিহাস লিখিত হইয়াছে। তাহা নিতান্ত অলৌকিক বলিয়া এস্থলে উল্লেখ করা হইল না। প্রবাদ অনুসারে কৈলাসহর উপবিভাগের অন্তর্গত ‘মাণিক্যভাণ্ডার’ নামক স্থানে এই মনি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল।
৩. মহারাজ রামমাণিক্যের পুত্র রত্নমাণিক্য (দ্বিতীয়) হইতে পৃথক রাখিবার জন্য ইহাকে ‘আদি রত্নমাণিক্য’ আখ্যায় পরিচিত করা হইয়া থাকে।
৪. বড় খাণ্ডব ঘোষের নিবাস স্থান রাঢ়দেশান্তর্গত রাঙ্গামাটী। এই রাঙ্গামাটী মুর্শিদাবাদের দ্বাদশ মাইল দক্ষিণে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত। ইহার অন্য নাম ‘কর্ণশোনা’ বা ‘কর্ণসেন পুরী’। প্রবাদ অনুসারে প্রাচীনকালে কর্ণসেন নামক নরপতি এই স্থান রাজধানী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বিজ্ঞবর ফারগুসন সাহেব ইহাকে হিয়োন সাঙের লিখিত ‘কিরণসুবর্ণ’ নগরী নির্ণয় করিয়াছেন। কাপ্তান লেয়ার্ড রাঙ্গামাটীয়ার পুরাতত্ত্বমূলক একটা সুদীর্ঘ প্ৰবন্ধ এসিয়াটিক সুসাইটির জর্ণেলে প্রকাশ করিয়াছেন (J. A. S. Bengal vol. XX II pp. 281. 282) প্রকৃত পক্ষে প্রাচীনকালে রাঙ্গামাটী, একটী সমৃদ্ধিসম্পন্ন নগরী ছিল।
৫. মতান্তরে জয়নারায়ণ সেন, খাণ্ডব ঘোষের অধীনস্থ ‘পাত্র’ অর্থাৎ পেস্কার ছিলেন।
৬. বিশ্বাস ও উপবিশ্বাসে প্রভেদ এই যে, ঘোষ রাজ ও সেন বংশীয়গণ পুরুষানুক্রমে বিশ্বাস উপাধি ধারণ পূবর্বক রাজকীয়বৃত্তি সকল ভোগ করিতেন। উপবিশ্বাসের মৃত্যুর সহিত তাঁহার সমস্ত বৃত্তি ও অধিকার বিলুপ্ত হইত।
৭. তাঁহাদের বংশধরগণ অদ্যাদি তলাবারেক এবং কালীয়াজুরি প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেছেন।
৮. তরণীমিশ্রের বংশধরগণ নিকট তাঁহাদের সুদীর্ঘ বংশাবলী প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।
৯. ভারতের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে হস্তী প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু ত্রিপুরা পবর্বতের হস্তী সর্বোৎকৃষ্ট। আবোল ফাজেল স্বীয় আইন আকবরী গ্রন্থে মোগল সম্রাট আকবরের ‘ফিলখানার’ বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিয়াছেন, ‘The best elephants are those of Tipperah’- Gladwin’s Aynee Akbery vol. I page 94.
১০. আরাকানের ইতিহাস ‘রাজোয়াং গ্রন্থে ত্রিপুরাকে ‘খু-র-তন’ লেখা হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থের অনুবাদক কর্ণেল ফেয়ার খুরতনকে সুবর্ণগ্রাম নির্ণয় করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। বাঙ্গালার পূবর্বপ্রান্তে ‘ত্রিপুরা’ নামে যে একটি প্রাচীন রাজ্য আছে, ইহা ফেয়ার সাহেবের জ্ঞানেই ছিল না।
১১. ধৰ্ম্মসাগর নামে দুইটি দীর্ঘিকা দৃষ্ট হইয়া থাকে। একটী প্রাচীন কৈলারগড় রাজধানীতে, অন্যটি কুমিল্লা নগরী বক্ষে বিষ্ণু বক্ষঃস্থিত কৌস্তভমনির ন্যায় দর্শকমণ্ডলীর নয়নানন্দ বর্দ্ধন করিতেছে। রাজমালা লেখক কেন যে একটি ধর্মসাগরের উল্লেখ করিলেন তাহা বুঝিতে পারি না।
১২. মমবংশ পরিক্ষীণে যঃ কশ্চিদ্ভদ্ভু পতির্ভবেৎ
তস্য দাসস্য দাসোহং ব্রহ্মবৃত্তিঃ ন লোপয়েৎ।
প্রাচীন হিন্দু নরপতিগণের তাম্রশাসন সমূহে ভাবি নরপতিবর্গকে দত্তভূমির প্রতি কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করিতে বিশেষরূপে নিষেধ করা হইয়াছে। প্ৰায় সমস্ত তাম্রশাসনে ধৰ্ম্মানুশাসনোক্ত নিম্নলিখিত শ্লোকগুলি দৃষ্ট হয়।
বহুভির্বসধাদত্তা রাজভি : সগরাদিভিঃ।
যস্য যস্য যদাভূমিস্তস্য তস্য তদাফলম।
স্বদত্তাং পরদত্তাংবা যো হরেৎ বসুন্ধরাম।
সবিষ্ঠায়াং কৃমির্ভূত্বা পিতৃভিঃ সহ পচ্যতে।
তড়াগানাং সহস্রেণ রাজপেয়শতেন চ।
গবাং কোটিপ্রদানেন ভূমিহৰ্ত্তানশুদ্ধ্যতি।
কান্যকুব্জপতি গোবিন্দ চন্দ্রের ১১৬৩ সংবতের একখানি তাম্রশাসনে লিখিত আছে যে, মদ্বংশজ কিম্বা অন্য বংশজাতি ভাবিনরপতিগণ যেন দত্তভূমির একখানি দুর্বা ও গ্রহণ না করেন।
মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্দ্ধন শিলাদিত্যের শাসনকালে বামরথ্য নামক জনৈক ব্রাহ্মণ এক কূট (জাল) সনন্দের বলে আধুনিক অযোধ্যা প্রদেশের অন্তর্গত সোমকুণ্ডিকা নামক গ্রাম ভোগ করিতেছিলেন। মহারাজ হর্ষবর্দ্ধন তৎসংবাদ অবগত হইয়া সেই কূটসনন্দ বিনষ্ট করত সোমকুণ্ডিকা গ্রাম অন্য দুইজন ব্রাহ্মণকে দান করেন। কিন্তু তিনি তাহা ‘খাস দখলে’ আনয়ন করেন নাই।
১৩. স্পেনীয় দিগের লিডন আক্রমণকালে ওলন্দাজেরা এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন।
১৪. এই স্থানটী অধুনা বলদাখাল (বরদাখ্যাত) পরগনার অন্তর্গত। দীঘির চতুৰ্দ্দিকস্থ গ্রাম “ধনাৎ খোলা দীঘির পাড়” আখ্যায় পরিচিত হইয়া থাকে।
১৫. মহাবীর চয়চাগ যে সমুদ্রবক্ষে বিজয়ী পতাকা উডডীন করিয়াছিলেন রাজমালা গ্রন্থে তাহার কোন উল্লেখ নাই। কিন্তু তেতুলিয়ার মোহনায় যে ‘ধন্য মাণিক্যের চর’ নামক একটি দ্বীপ দৃষ্ট হয়, তাহার সহিত কি ধন্য মাণিক্যের বিজয় বৃত্তান্তের কোন সংশ্রব নাই?
১৬. আসীৎ পূর্ববৎ নরেন্দ্রঃ সকল গুণযুতো ধন্যমাণিক্য দেবো যাগে যস্যহ্যরীশঃ ক্ষিতিতল মগমৎ কর্ণতুল্যস্যদানে। শাকে বত্যুক্ষি বেধোমুগ ধরনীযুতে লোকমাত্রেই স্বিকারৈ প্রাদাৎ প্রাসাদরাজং গগণ পরিগতং সেবিতায়ৈ সদেবৈঃ। (মন্দিরগাত্রে সংযোজিত প্রস্তর লিপি)
মহারাজ ধন্যমাণিক্য যে সময় ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির নির্ম্মাণ করিতেছিলেন, সেই সময় তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হুসনসাহ ঢাকার অন্তর্গত বল্লীপুর মধ্যে এক প্রকাণ্ড মসজিদ প্রস্তুত করেন। মসজিদের খোদিত লিপির তারিখ ৯০৭ হিং ২২ জুমদা। উভয়ই ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে নিৰ্ম্মিত।
১৭. কুমিল্লা হইতে যে প্রশস্ত রাজমার্গ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অভিমুখে গিয়াছে, তাহা এই গড়ের প্রায় বক্ষঃস্থল কর্ত্তন করিয়া নিৰ্ম্মিত হইয়াছে। পথিকগণ নয়াগাঁর পূবর্বদিকস্থ বৃহৎ বটবৃক্ষ পশ্চাৎ রাখিয়া কিয়দ্দুর উত্তরদিকে গমন করিলে সেই গড়ের ভগ্নাবশেষ দর্শন করিতে পারিবেন। এই গড়ের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে যে খানা গ্রাম বর্তমান আছে তাহাতে হুসন সাহের ত্রিপুরা বিজয়ের চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া যায়। গড়ের দক্ষিণদিকস্থ গ্রাম জমিদারী সেরেস্তার কাগজপত্রে ‘অদ্যাপি’ হুসনপুর এবং পশ্চিমদিকস্থ গ্রাম ‘সাহাপুর’ আখ্যায় পরিচিত হইয়া থাকে। কিন্তু সাধারণে হুসনপুরকে ‘নয়াগাও’ এবং সাহাপুরের দক্ষিণভাগ অর্থাৎ দক্ষিণ সাহাপুরকে ‘আকছিনা’ বলিয়া থাকে। উভয় গ্রামের প্রধান অধিবাসী মুসলমান। বিশেষত সাহাপুর গ্রামে এক অতি প্রাচীন মুসলমান বংশ অদ্যাপি বাস করিতেছেন। ইহারা সৈয়দবংশীয়, সুলতান হুসন সাহাও সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। সাহাপুর নিবাসী সৈয়দবংশীয় দিগের পূবর্বপুরুষ সুলতানের ‘সিপাসেলার’ আখ্যা প্রাপ্ত সেনাপতি ছিলেন। বোধহয় হুসন সাহের বিজয়ের পর তিনি সীমান্ত প্রদেশ রক্ষার জন্য স্বজাতীয় কোন কর্মচারীকেও এ স্থানে স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি সুবর্ণগ্রামের শাসনকর্তার অধীনে থাকিয়া স্বীয় কাৰ্য্য নির্বাহ করিতেন।
১৮. This masque (sic) was built in the reign of the Sultan of the Age, the heir of the kingdom of Soloman, A lauddunya-Waddin Abil Muzaffar Husain Shah * * * by the great and noble Khan, namely Khawac Khan Governor of the Land of Tipurah and Vazir of the District Muazzamabud,- may God preserve him in both worlds. Dated 2nd Rabi II., 911, (7-6-1513) (J. A. B. (sic) XII. I, 333-34.) ১৪২৭ শকাব্দের একখণ্ড প্রস্তরলিপিতে ত্রিপুরাভূমির উল্লেখ দৃষ্ট হয় না, তাহাতে খালিছ খাঁকে কেবল ‘মোয়মাবাদের উজির’ লেখা হইয়াছে, অতএব বোধ হয় ১৪২৭ শকাব্দের পর হুসন সাহ ত্রিপুরার কিয়দংশ অধিকার করিয়াছিলেন।
১৯. রাজমালা লেখক নছরথ সাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় বৃত্তান্ত গোপন করিয়াছেন, কিন্তু মুসলমান ইতিহাস লেখক তাহার সবিস্তার বর্ণনা করিয়াছেন। ইহার সাক্ষিস্বরূপ নছরথ সাহেব অনুমত্যানুসারে খনিত ‘নছরথসার দীঘি’ নামক বৃহৎ দীর্ঘিকা অদ্যাপি বর্তমান রহিয়াছে। নছরথ সাহেব সেনাপতি ও শাসনকর্তা ‘লস্কর’ পরাগল খাঁর সভাসদ পণ্ডিত কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক ব্রাহ্মণ জৈমিনির ভারত-সংহিতা অবলম্বন পূর্বক পিয়ারাদ ছন্দে মহাভারত রচনা করেন। পরাগল খাঁর উপযুক্ত পুত্র ছুটি খাঁর অভিপ্রায় মতে তাহার সভাসদ্ শ্রীকর নন্দী নামক জনৈক কবি অশ্বমেধ পবর্ব রচনা করিয়াছিলেন। সেই গ্রন্থের প্রারম্ভে নিম্নলিখিত বর্ণনা প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রীকর নন্দীর রচিত অশ্বমেধপবর্ব, যাহা আমাদের হস্তগত হইয়াছে, তাহা ১৫৮৬ শকাব্দের লিখিত একখানা প্রাচীন গ্রন্থ। ছুটিখাঁর গুণানুবাদ করিয়া কবি শ্রীকর নন্দী বলিতেছেন :-
তান এ সেনাপতি লস্কর ছুটিখান।
ত্রিপুরার উপরে করিল সন্নিধান।।
ত্রিপুর নৃপতি যার ভয়ে এড়ে দেশ।
পর্বত গহ্বরে গিয়া করিল প্রবেশ।।
গজ বাজিকর দিয়া করিল সম্মান।
মহাবন মধ্যে তার পুরীর নির্ম্মাণ।।
অদ্যাপি ভয় না দিল মহামতি।
তথাপি আতঙ্কে বৈসে ত্রিপুর নৃপতি।।
সমসাময়িক হইলে ও কবি নন্দী মহাশয় ইতিহাস লেখক নহেন; তিনি যে তাহার আশ্রয়দাতার গুণ কিছু অতিরিক্ত মাত্রায় বর্ণনা করিয়াছিলেন, প্রকৃত ইতিহাস লেখক অবশ্যই এরূপ অনুমান করিতে পারেন। নছরথ সাহ কর্তৃক ত্রিপুর সৈন্য জয় ও চট্টগ্রাম অধিকার, ইহাই ঐতিহাসিক সত্য। ছুটিখার ভয়ে তদানীন্তন ত্রিপুরেশ্বর ‘পর্বত গহ্বরে’ প্রবেশ পূর্বক ‘গজ বাজী কর দিযা খাঁ মহাশয়ের পদ পূজা করিয়াছিলেন। এই সকল বর্ণনা তোষামোদকারী কবির প্রলাপ বাক্য, আমরা ইহা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি না।
২০. মতান্তরে ইন্দ্রমাণিক্য দেবমাণিক্যের পুত্র এবং তিনি বিজয় মাণিক্যের কনিষ্ঠ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা।