রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.২

দ্বিতীয় অধ্যায়

বৌদ্ধ বিপ্লব সময়ে ব্রাহ্মণগণ ভারতের দিগ্‌ দিগন্তে আপনাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য যত্নবান হইয়াছিলেন। ভারতের যে সকল ক্ষত্রিয় নরপতি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ পূর্বক ব্রাহ্মণদিগের অসীম আধিপত্যের মূলে কুঠারাঘাত করিতে সমুদ্যত হইয়াছিলেন, ব্রাহ্মণগণ সেই সকল ক্ষত্রিয়বর্গকে ব্রাত্য শ্রেণীতে সন্নিবিষ্ট করিয়া, আপনাদের আশ্রয়দাতা নরপতিবর্গকে চন্দ্র সূর্য্য বংশীয় প্রচার করত তাঁহাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন মানসে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। যে লিচ্ছবি ক্ষত্রিয়গণ সার্দ্ধদ্বিসহস্র বৎসর পূর্বে সর্ব প্রথম সাধারণ তন্ত্র শাসন প্রণালী জগতে প্রচারিত করিয়াছিলেন, সেই ভারতের গৌরব- জগতের গৌরব- সূর্য্যবংশীয় লিচ্ছবি ক্ষত্রিয়গণের প্রতি ব্রাহ্মণদিগের জাতক্রোধের অপূর্বকাহিনী আমরা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছি।[১] যে মল্ল ক্ষত্রিয়গণের বীরত্ব কাহিনী কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ মহাভারতে বর্ণনা করিয়াছেন, –ভগবান শাক্যসিংহের চিতাভষ্ম লইয়া যে মল্ল ক্ষত্রিয়গণ সমস্ত ভারতে সমরানল প্রজ্জ্বলিত করিতে সমুদ্যত হইয়া ছিলেন, ব্রাহ্মণগণ বুদ্ধদেবের প্রিয় শিষ্য বশিষ্ঠ গোত্রজ- বীর॥ ১১॥ কুলাগ্রগণ্য সেই মল্ল ক্ষত্রিয়দিগকে ব্রাত্য শ্রেণীতে সন্নিবিষ্ট করিয়া অপার আনন্দ লাভ করিয়াছেন।[২]

সেনাপতি ভট্টার্ক কণক সেন ও তাঁহার বংশধরগণ প্রায় সার্দ্ধদ্বিশত বৎসর বল্লভী দেশে অধীন ও স্বাধীনতার রাজদণ্ড পরিচালন করিয়াছিলেন। সেই রাজবংশের অনেকগুলি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। সেই সকল অনুশাসন পত্রে তাঁহারা সূর্য্যবংশজ বলিয়া আত্ম পরিচয় প্রদান করেন নাই। রাজপুতনার ভট্টকবিগণ মিবার রাজবংশকে ভট্টার্ক সেনাপতির বংশধর প্রচার করত তাঁহাদিগকে সূর্যবংশ তিলক ভগবান রামচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র লবের বংশে উদ্ভুত বলিয়া দুন্দুভি নিনাদিত করিয়াছেন। রাজস্থানের ভট্টকবিগণ এবপ্রকার অন্যান্য রাজবংশকে ও সূর্য্যবংশের শাখা প্রশাখা বলিয়া প্রচার করিতে ত্রুটী করেন নাই। কিন্তু মূলবংশ সমূহের অসংখ্য প্রস্তর লিপি ও তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়া ভট্টকবিগণের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছে। রাজস্থানে যে রূপ সূর্য্যবংশের বাহুল্য প্রদর্শিত হইয়াছে, বাঙ্গালা ও তৎপার্শ্ববর্ত্তী দেশ সমূহে তদ্রূপ চন্দ্রবংশের ছড়াছড়ি দেখা যাইতেছে। উড়িষ্যার কেশরী বংশীয় নরপতিগণের অনুশাসন পুত্রে তাঁহাদিগকে চন্দ্রবংশজ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। বাঙ্গালার সেন রাজগণ ও সোমবংশ সমুদ্ভুত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। চট্টগ্রামাধিপতি যে দামোদর দেবের নাম পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাম্রশাসনে তিনিও চন্দ্ৰবংশজ বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়াছেন। শ্রীহট্টাধিপতি গোবিন্দ দেব ও ঈশান দেবের তাম্রফলকে তাঁহাদিগকে “নিশাপতি” বংশজ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। ত্রিপুরা ও কাছাড় রাজবংশীয়গণ এক আদিপিতা হইতে উদ্ভুত হইয়াও একটি শাখা যযাতিপুত্র দ্রুহ্যের বংশধর ও অন্যটি ভীম- পুত্র ঘটোৎকচের সন্তান বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। মিতাই অর্থাৎ মণিপুর রাজবংশ সার্দ্ধদ্বিশত বৎসর পূর্বে হিন্দু সমাজে প্রবেশ লাভ করত শ্রীহট্টের অধিকারী ব্রাহ্মণদিগের কৃপায় অৰ্জ্জুনপুত্র বভ্রুবাহনের বংশধর বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা-মগ নরপতিগণ অল্পকাল মধ্যে চট্টগ্রামের ব্রাহ্মণ মহাশয়দিগের কৃপায় চন্দ্রবংশজ বলিয়া আখ্যাত হইয়াছেন। কেবল আসামের প্রাচীন “আহুম” বংশীয়গণ ইন্দ্ৰবংশজ এবং কোচবিহার পতিগণ শিববংশজ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। তদ্ব্যতীত বাঙ্গালা ও তৎপার্শ্ববর্তী দেশীয় নরপতিগণ সকলেই চন্দ্ৰবংশজ বলিয়া আখ্যাত হইয়াছেন।

যে কারণে ব্রাহ্মণগণ রাজস্থানের প্রধান রাজবংশগুলিকে সূর্য্যবংশজ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন, সেই কারণর বশবর্ত্তী (১৩) হইয়াই ব্রাহ্মণ মহাশয়গণ রাজমালা গ্রন্থে ঘোষণা করিয়াছেন যে, :

চন্দ্রবংশাবতংশ মহারাজ যযাতি স্বীয় পুত্র যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু, এবং অনুকে বর্জ্জন করিয়া সর্ব কনিষ্ঠ পুরুষকে সাম্রাজ্যাসন প্রদান করেন। মহাবল দ্রুহ্যু পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া হস্তিনানগর হইতে পূর্বাভিমুখে গমন করিত কিরাত ভূমিতে[৩] উপনীত হন এবং কতিপয় প্রধান কিরাত নরপতিকে জয় করিয়া “কোপল” নদীর তীরে ত্রিবেগ— নাম্নী নগরী নির্মাণ-পূর্বক তথায় রাজপাঠ সংস্থাপন করেন।

দ্রুহ্যের স্থাপিত রাজ্য সীমা রাজমালায় এইরূপ লিখিত হইয়াছে, ইহার পূর্বে মেখলিদেশ, উত্তরে তৈড়ঙ্গ নদী, পশ্চিমে বঙ্গদেশ, দক্ষিণে আচরঙ্গ নামক রাজ্য। ত্রিবেগ রাজ্যের এইরূপ সীমা নির্দ্দেশ দ্বারা রাজমালালেখক আমাদের মতের সত্যতা দৃঢ় হইতে দৃঢ়তররূপে পোষণ করিতেছেন। কাছাড়বাসিগণ দ্বারা “মিতাই” অর্থাৎ মণিপুরিগণ ও তাহাদের বাসভূমি “মেখলি” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। সুতরাং সেই মেখলি দেশের পশ্চিম স্থ ত্রিবেগ রাজ্য আধুনিক কাছাড় ব্যতীত অন্য কোন স্থান হইতে পারে না। (১৪)

সেই দ্রুহ্যের পুত্র ত্রিপুর।[৪] মতান্তর দ্রুহ্যের বংশে দৈত্য নামক নরপতি জন্মগ্রহণ করেন। সেই দৈত্যের ঔরসে ত্রিপুরের জন্ম।[৫] তিনি কিরাত নামের উচ্ছেদ সাধন পূর্বক স্বীয় নামানুসারে রাজ্যের নাম “ত্রিপুরা” এবং স্বজাতীয় ব্যক্তিবর্গকে ত্রিপুরাজাতি বলিয়া প্রচার করেন। আমাদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ত্রিপুর হইতে বংশাবলী গণনা করা সঙ্গত। (৫) তৎপূর্ববর্ত্তী যযাতি, দ্রুহ্যু প্রভৃতি নামগুলি বৌদ্ধদ্রোহি ব্রাহ্মণদিগের কল্পনা প্রসূত। রাজমালা লেখক বলেন, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়কালে এই ত্রিপুর নরপতি সহদেবকর্তৃক বিজিত হইয়াছিলেন।[৬] এইরূপ বর্ণনা যে নিতান্ত কবিকল্পনা প্রসূত তাহা বারংবার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।

ত্রিপুর অতিশয় প্রজাপীড়ক নরপতি ছিলেন। তিনি “দেবদ্রোহী”, “নিত্য- পরদার রত” ও “পররাজ্যাপহারক” বলিয়া রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছেন। প্রজাগণ ত্রিপুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত হইয়া শিবারাধনায় রত হইল। দেবাদিদেব আশুতোষ প্রজাগণের কাতরোক্তিতে সদয় হইয়া ত্রিশূলদ্বারা ত্রিপুরকে নিপাত করিলেন।

মহাদেব কর্তৃক ত্রিপুর হত হইলে বিধবা রাজ্ঞী হীরাবতী সিংহাসন আরোহণ পূর্বক যথানিয়মে রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাজ্যের উত্তরাধিকারী নাই, ভবিষ্যতে কিরূপে ইহার শাসন সংরক্ষণ হইবে, এই চিন্তায় প্রজাগণ অধীর হইল। দৈবানুকম্পা ভিন্ন অন্য উপায় অদর্শনে তাহারা পুনর্বার মহাদেবের উপাসনায় প্রবৃত্ত হইল। দেবাধিদেব আশুতোষ তাহাদের আরাধনায় সন্তুষ্ট হইলেন। ভগবানের (১৬) কৃপায় বিধবা রাজ্ঞী গর্ভবতী হইয়াছিলেন।[৭] তৎকালে তিনি উপযুক্ত পুত্র লাভাকাঙ্ক্ষায় চতুৰ্দ্দশ দেবতার আরাধনা করিয়াছিলেন।[৮] কালক্রমে বিধবা রাজ্ঞী শিবাংশ সম্ভূত-সৰ্ব সুলক্ষণাক্রান্ত, চন্দ্র, শূল ও ধ্বজচিহ্ন বিশিষ্ট এক মনোরম পুত্র প্রসব করেন। এই শিশু যৎকালে ভূমিষ্ঠ হইল, তৎকালে তাঁহার ললাটে একটি নেত্র দৃষ্ট হইয়াছিল, এজন্য তিনি ত্রিলোচন আখ্যা প্রাপ্ত হন। দশম বর্ষ বয়ক্রমে ত্রিলোচন সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁহার মাতা যে চতুৰ্দ্দশ দেবতার আরাধনা করিয়াছিলেন, তিনি সেই চতুৰ্দ্দশ দেবতার মূৰ্ত্তি সংস্থাপন পূর্বক তৎপূজা পদ্ধতি প্রচলিত করেন। ইহারাই ত্রিপুর রাজবংশের আদি- কুলদেবতা। সেই আদিম পুরোহিত “চন্তাই” দ্বারা আদ্যাপি সেই চতুৰ্দ্দশ দেবমুণ্ডের পূজা হইতেছে। (১৭) ইহার সহিত হিন্দু শাস্ত্রোক্ত পূজা বিধির কোনরূপ সংশ্রব নাই।

দ্বাদশবর্ষ বয়োক্রমকালে মহারাজ ত্রিলোচন কাছাড়াধিপতির কন্যাকে বিবাহ করেন। সেই রাজ্ঞীর গর্ভে ত্রিলোচনের দ্বাদশটি পুত্র জন্ম গ্রহণ করে।

ত্রিলোচনের দ্বাদশ পুত্রের নাম দৃকপতি, দক্ষিণ, দক্ষ, দ্রুমায়ূ, দ্রবিণ, দৃষ্টঘ্নো, ভৃগু, দুর্দ্ধর, দ্রুহ, দুষ্মায়ূ, দৈবিরি এবং দম্প। রাজকুমারগণ সকলেই নাতিদীর্ঘ নাসিকা, স্থুল কলেবর, সুন্দরকর্ণ, বিশালবক্ষ, সুচন্দ্রবন, রক্তপঙ্কজলোচন, গজ-গ্রীবা ও শালতরু সদৃশ হস্তপদবিশিষ্ট ছিলেন। মহারাজ ত্রিলোচন ১২০ বৎসর প্রবল পরাক্রমে রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন।

ত্রিলোচনের জ্যেষ্ঠ পুত্র দৃকপতি তাঁহার অপুত্রক মাতামহ কর্তৃক তদীয় উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। কাছাড়পতির মৃত্যুর পর দৃকপতি সেই রাজ্যের রাজদণ্ড ধারণ করিলেন। ত্রিলোচন স্বীয় দ্বিতীয় পুত্র দক্ষিণকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। তদনুসারে দক্ষিণ পিতার মৃত্যুর পর পৈত্রিক আসন অধিকার করেন। দৃকপতি পিতার মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া, দক্ষিণকে পৈত্রিক আসন পরিত্যাগ করিতে লিখিলেন। তদুত্তরে দক্ষিণ স্বীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে লিখিলেন, ॥১৮॥ “মাতামহ আপনাকে পুত্রিকা, পুত্র স্বরূপ গ্রহণ করিয়াছিলেন, সুতরাং পৈত্রিক রাজ্যে আপনার অধিকার নাই; বিশেষত ধর্মপরায়ণ স্বর্গীয় পিতা মহারাজ আমাকে পৈত্রিক রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া গিয়াছেন; সুতরাং আমিই তাহার অধিকারী।” দক্ষিণের পত্র প্রাপ্ত হইয়া দৃকপতি তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ৭ দিবস ঘোরতর সংগ্রামের পর দৃকপতি জয়লাভ করত পৈত্রিক রাজধানী অধিকার করিলেন। মহারাজ দক্ষিণ মধ্যকাছাড়ে উপনীত হইয়া, বড়বক্র নদী তীরে এক অভিনব রাজধানী নির্মাণ করেন। প্রবাদ অনুসারে মহারাজ দক্ষিণ ত্রিবেগ হইতে পলায়ন কালে চতুৰ্দ্দশ দেবতার মুণ্ড লইয়া আসিয়াছিলেন। তদবধি দক্ষিণের সন্তানগণ সেই চতুৰ্দ্দশ দেবমুণ্ডের পূজা করিয়া আসিতেছেন। দৃকপতির বংশধরগণ দীর্ঘকাল সেই ছিন্নশীর্ষ চতুৰ্দ্দশ দেবতার আরাধনা করিয়াছিলেন। ত্রিবেগনগরী পরিত্যাগ পূর্বক, মহারাজ দক্ষিণের বড়বক্র নদী তীরে রাজ পাটসংস্থাপন দ্বারা, ত্রিপুরবংশীয় দিগের দক্ষিণদিকে রাজ্য বিস্তারের সূত্রপাত হইল।

দক্ষিণের মৃত্যুরপর তৎপুত্র তয়দক্ষিণ সিংহাসন আরোহণ করেন। তয়দক্ষিণ হইতে নাগপতি পৰ্য্যন্ত ৪১ জন রাজার শাসনকালের কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা রাজমালায় প্রাপ্ত (১৯) হওয়া যায় না। নাগপতির পুত্র শিক্ষরাজ নরমাংস ভোজন করিয়াছিলেন।[৯]

মহারাজ বিমারের[১০] পুত্র কুমার ধার্ম্মিক ও শিবভক্তিপরায়ণ নরপতি ছিলেন। তিনি মনুনদীতীরস্থিত শ্যাম্বল নগরে গমনপূর্বক শিবলিঙ্গ দর্শন করিয়া ছিলেন।[১১] তিনি (২০) সেই স্থানে বাসস্থান নির্মাণ পূর্বক আজীবন শিবারাধনা করিয়াছিলেন। রাজমালার উক্ত বর্ণনা দ্বারা ত্রিপুরবংশীয় দিগের আর এক পদ দক্ষিণদিকে অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, মহারাজ ত্রিলোচনের পুত্র দক্ষিণ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদ্বারা তাড়িত হইয়া, কোপল নদীর তীরস্থিত ত্রিবেগ নগরী পরিত্যাগ পূর্বক বড়বক্র (বড়াক) নদীর তটে রাজপাট স্থাপন করেন। মহারাজ কুমার সেই রাজধানী পরিত্যাগ পূর্বক মনুনদী তীরস্থিত শ্যাম্বলনগরে উপনীত হইয়াছিলেন।

মহারাজ রাজেশ্বরের দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ মিসলিরাজ কনিষ্ঠ তেজাঙ্গ ফা। পিতার মৃত্যুর পর মিশলিরাজ সিংহাসন আরোহণ করেন। রাজমালা বলেন, মিশলিরাজের প্রকৃত (২১) নাম ক্রোধেশ্বর। ইনি অত্যন্ত ক্রোধপরায়ণ ছিলেন। তিনি পুত্রার্থী হইয়া মহাদেবের আরাধনা করেন। মহাদেব তাঁহার সাক্ষাতে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “তোমার পুত্র হইবে না।” মহাদেবের বাক্য শ্রবণে রাজা ক্রোধে অন্ধ হইয়া ধনুর্বাণ হস্তে মহাদেবকে বধ করিতে উদ্যত হইলেন। মহাদেবের ক্রোধ দৃষ্টিতে রাজা তৎক্ষণাৎ অন্ধ হইলেন। রাজ পুরোহিত চন্তাই রাজার চক্ষু প্রদান জন্য মহাদেবের আরাধনা করিলেন। চন্তাইর আরাধনায় সন্তুষ্ট হইয়া আশুতোষ বলিলেন, “নরবলি দ্বারা আমার পূজা করিলে, রাজা পুনর্বার দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু স্ত্রী সহবাসকালে তাঁহার মৃত্যু হইবে। আমি আর সাক্ষাৎ দর্শন দিব না। এই মন্দিরে আমার পদচিহ্ন মাত্র থাকিবে।” নরবলি দ্বারা মহাদেবের পূজা করিয়া মিশলিরাজ দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কেদা তিনি স্বীয় পত্নী সন্দর্শনে কামোন্মত্ত হইয়া রতিক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হন। মহাদেবের অভিসম্পাতে তিনি তৎক্ষণাৎ কালগ্রাসে পতিত হইলেন। জ্যেষ্ঠের মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ মহারাজ তেজাঙ্গ ফা সিংহাসন আরোহণ করেন।

শুক্ররায়ের পুত্র মহারাজ প্রতীতের শাসনকালে বড়বক্র নদী কাছাড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যসীমা নির্ণীত হয়। ইহা দ্বারা স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, কাছাড় পতিগণ যেরূপ দিমাপুর পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণদিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, ত্রিপুরা (২২) পতিগণও সেইরূপ দক্ষিণদিকে আপনাদের রাজ্য বিস্তারের জন্য যত্নবান হইয়াছিলেন। এই সময় মনু নদীর নিকটবর্তি স্থানে ত্রিপুরার রাজপাট সংস্থাপিত ছিল। তদনন্তর তাহা কৈলাড় গড়ে উঠিয়া আইসে। প্রাচীন মুসলমান ইতিহাসে কৈলাড় গড় “জাজীনগর” আখ্যায় আখ্যাত হইয়াছে। কৈলাড়গড়ের উপকণ্ঠস্থ একখানি পল্লী অদ্যাপি জাজীশার নামে পরিচিত রহিয়াছে।

নওয়াবের পুত্র জুঝারু ফা যুদ্ধকাৰ্যে বিশেষ নিপুণ ছিলেন। তিনি বিশালগড় নামক স্থানে একটি রাজভবন নির্মাণ করেন। তাঁহার শাসনকালে লিখ (বা নিক্ষ) নামক নরপতি রাঙ্গামাটীয়া রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। জুঝারুফা তাঁহাকে জয় করিয়া রাঙ্গামাটীয়া নগরীতে ত্রিপুরার রাজপাট সংস্থাপন করেন।

মহারাজ ছেংথুমফা বিশেষ পরাক্রমশালী নরপতি ছিলেন। তিনি মিহিরকুল[১২] (প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটীকাড়া রাজ্য) জয় করিয়া মেঘনাদ তীর পর্য্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা বিস্তার করিয়াছিলেন।

ত্রিপুরেশ্বরের অধিকার মধ্যে “হিরাবন্ত” নামক জনৈক ধনবান্ (২৩) সামন্ত বাস করিতেন। তিনি বঙ্গেশ্বরের প্রধান কর্মচারী ও বিশেষ পরাক্রমশালী ছিলেন। “হিরাবন্ত ত্রিপুররাজের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তাঁহাকে ধৃত করিবার জন্য মহারাজ ছেংথুমফা বৃহৎ একদল সৈন্য সহ তিনজন সেনাপতি প্রেরণ করিলেন। ত্রিপুর সৈন্যগণ গঙ্গাতীরে উপনীত হইলে, “হিরাবন্ত” ভয়াতুর হইয়া গৌড়েশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করেন। গৌড়াধিপতি মহাক্রুদ্ধ হইয়া বৃহৎ একদল সৈন্য ত্রিপুরেশ্বরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিলেন। গৌড়সৈন্যগণ ত্রিপুররাজ্য সীমায় উপনীত হইলে মহারাজ ছেংথুমফা স্বীয় সৈন্যাপেক্ষা বিপক্ষের সৈন্য অধিক বিবেচনায় ভয়াতুর হইয়া স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্র গমনে অনিচ্ছুক হইলেন। তাঁহার রাজ্ঞী স্বামীকে রণ পরাঙমুখ দর্শনে স্বয়ং সেনাপতিগণকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, ‘সাহসাদ্ভজয়ে লক্ষ্মী” আমি স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া বিপক্ষ বিনাশে কুলগৌরব রক্ষা করিব; তোমরা প্রস্তুত হও।” রাজ্ঞী তৎপর দিবস যুদ্ধে গমন করিবেন বলিয়া সৈন্যগণকে বহু সংখ্যক মহিষ এবং ছাগ দ্বারা ভোজ দানে পরিতুষ্ট করিয়াছিলেন। পর দিবস প্রত্যুষে রণসজ্জা করা হইল, ত্রিপুরেশ্বরী হস্ত্যারোহণ পূর্বক রণক্ষেত্রে গমন করিলেন। মহারাজও বাধ্য হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়াছিলেন। ভীষণ সংগ্রামে রণক্ষেত্রে মহারক্ত স্রোত প্রবাহিত করিয়া, ত্রিপুরেশ্বরী বিজয়ী মালায় বিভূষিতা হইলেন। ভারতীয় মহিলাকুল মধ্যে এরূপ (২৪) দৃষ্টান্ত অতি বিরল। গড়মণ্ডলের অধিশ্বরী দুর্গাবতী এবং ঝানসীর রাজ্ঞী লক্ষীবাই ভীষণ সমরে স্ব স্ব প্রাণ আহুতি প্রদান পূর্বক অক্ষয় কীৰ্ত্তি সংস্থাপন করত বীরেন্দ্র সমাজের বরণীয়া হইয়া রহিয়াছেন; কিন্তু বিজয় লক্ষ্মীর সাহচর্য্য তাঁহাদের অদৃষ্টে ঘটে নাই, বিজয়ী পতাকা তাঁহাদের শীর্ষে উডডীন হয় নাই। ইহা নিতান্তই দুঃখের বিষয় যে, রাজমালা লেখক বীরেন্দ্র সমাজের বরণীয়া এহেন রমণী রত্নের নাম স্বীয় গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন নাই।

যুদ্ধাবসানে মহারাজ ছেংথুমফা রণক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করিয়া হতাহত জীবগণ দর্শনে নিতান্ত বিস্মিত হইয়াছিলেন। এই সংগ্রামে মহারাজ ছেংথুমফার জামাতা বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এজন্য মহারাজ তাঁহাকে সর্বপ্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করেন। তদবধি রাজ জামাতৃগণের সেনাপতি পদে নিযুক্ত হওয়ার প্রথা, ত্রিপুরায় প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছিল।

পাল অথবা সেনরাজগণের বাঙ্গালা শাসনকালে, কিম্বা মুসলমানদিগের লক্ষণাবতী অধিকারের পরে উল্লেখিত যুদ্ধ ঘটনা হইয়াছিল এক্ষণে তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন। ১১৬৫ শকাব্দে (১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে) লক্ষ্মণাবতীর “মালিক” (শাসনকৰ্ত্তা) ইজাজদ্দিন আবুল ফতে ভূগ্রল খাঁ জাজনগর আক্রমণ করিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। কোন কোন (২৫) ইতিহাস লেখক এই জাজনগরকে ত্রিপুরা নির্ণয় করিয়াছেন। এই সিদ্ধান্ত সত্য হইলে তুগ্রল ভূগন খাঁ ছেংথুমফার মহিষী দ্বারা পরাজিত হইয়াছিলেন বলিয়া লেখা যাইতে পারে। মতান্তরে ভূগন খাঁ যে জাজনগর আক্রমণ করেন তাহা উড়িষ্যার জাজদানী যাজপুর লিখিত হইয়াছে। মেজর ষ্টুয়ার্ট উড়িষ্যাপতিকে ভূগনখাঁর পরাজয়কারী বলিয়া লিখিয়াছেন।[১৩] খ্যাতনামা হন্টার সাহেব ষ্টুয়ার্টের মতানুসরণ করিয়াছেন।[১৪] আমাদের বিবেচনায় ষ্টুয়ার্ট ও হন্টার সাহেবের সিদ্ধান্ত সঙ্গত বলিয়া বোধ হইতেছে।[১৫] (২৬)

মহারাজ ছেংথুমফার শাসনকালে কিম্বা তাহার অল্পকাল পরে চট্টলাচলে ত্রিপুরা রাজপতাকা উড্ডীন হইয়াছিল।

মহারাজ ছেংথুমফা পরলোক গমন করিলে, তাঁহার পুত্র আচঙ্গফা সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি মাতৃগুণ লাভ না করিয়া পিতৃগুণ লাভ করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার পত্নী স্বীয় শ্বশুর ন্যায় তেজস্বিনী, বিদ্যাবতী এবং গুণসম্পন্না ছিলেন। তাঁহার উৎসাহে ত্রিপুরাতে শিল্পকার্য্যের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। মহারাজা আচঙ্গফা পরলোক গমন করিলে তাঁহার একমাত্র পুত্র ক্ষিছংফা রাজদণ্ড ধারণ করেন। তদনন্তর তৎপুত্র ডুঙ্গুরফা রাজ্যাধিকারী হইলেন। তিনি অষ্টোত্তরশত দার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, তাঁহার অষ্টাদশ পুত্র জন্মিয়াছিল। তিনি পুত্রগণের বুদ্ধি পরীক্ষা দ্বারা ভবিষ্যৎ রাজ্যাধিকারিত্ব স্থির করণ মানসে যুদ্ধের কুক্কুটসকল নিরাহারে আবদ্ধ রাখিতে ভৃত্যদিগকে অনুমতি করেন; পরে যখন স্বয়ং পুত্রগণের সহিত একত্রে আহার করিতে বসিলেন, তখন একজন অনুচরকে ঐ সকল কুক্কুট আহার স্থলে আনিয়া ছাড়িয়া দিতে গোপনে আদেশ করিলেন। তদনুসারে যখন ৩০টী কুক্কুট ছাড়িয়া দেওয়া হইল, তখন তাহারা সমস্ত দিন নিরাহারের পর ভোজ্যদর্শনে রাজকীয় পাত্রের দিকে ধাবিত হইল; মহারাজ কুক্কুট সকল যাহাতে পাত্ৰ স্পর্শ করিতে না পারে, তদুপায় বিধান জন্য কুমারগণকে আদেশ (২৭) করিলেন; কিন্তু কুমারেরা সমস্ত কুক্কুট একেবারে নিবারণের বিষয় চিন্তা করিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না, তাঁহারা ইতিকর্ত্তব্যতাবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। তৎকালে সর্ব কনিষ্ঠ কুমার রত্নফা সহসা পাত্র হইতে কতকগুলি অন্ন লইয়া কুক্কুটগণের সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন।১৬ নৃপতি তাঁহার আশ্চর্য্য বুদ্ধিমত্তা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দর্শনে তাঁহাকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করিলেন। কিন্তু ইহাতে তাঁহার অবশিষ্ট পুত্রগণ নিতান্ত দুঃখিত ও ঈর্ষাপরবশ হইয়া নানাবিধ ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন, এবং মহারাজ ডুঙ্গুরফা পরলোক গমন করিলে সমস্ত কুমারেরা একত্রিত হইয়া রত্নফাকে বহিষ্কৃত করিয়া সর্বজ্যেষ্ঠকুমার রাজাফাকে সিংহাসনে স্থাপন করিলেন।

টীকা

১. মল্লিখিত “লিচ্ছবি রাজাগণ’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। (ভারতী ১২৯৭ বঙ্গাব্দ)

২. মনুসংহিতা। দশম অধ্যায়, ২২ শ্লোক।

৩. বিষ্ণুপুরাণে লিখিত আছে, ভারতবর্ষের পূবর্বপ্রান্তে কিরাত দিগের বাস।

৪. দ্রুহ্যুরাজ সুতোজাত স্ত্রীপুরাখ্যো মহাবলঃ।
সংস্কৃত রাজমালা

মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্যের কৃত (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দের) বংশাবলীতে দ্রুহ্যের পুত্র ত্রিপুর লিখিত হইয়াছে। চক্রধবজ ঠাকুর বনামে বীরচন্দ্র যুবরাজ, ১৮৬৩ইং ৯নং এবং রাজকুমার নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মন বনামে বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর, ১৮৭৪ ইং ৩৫ নং দেওয়ানী মোকদ্দমায়, বিবাদী মহারাজ বাহাদুর স্ববংশের যে সুদীর্ঘ বংশাবলী উপস্থিত করিয়াছিলেন তাহাতেও ত্রিপুর পেছরে দ্রুহ্যু’ লিখিত রহিয়াছে। কিন্তু জলতরঙ্গের কৃপায় রাজবংশের যে অভিনব বংশাবলী প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে দ্রুহ্যু ও ত্রিপুরের মধ্যে কতগুলি কাল্পনিক নাম সন্নিবেশিত হইয়াছে। একেই আমাদের প্রাচীন ইতিহাস কল্পনা জালে জড়িত, তাহার আবার উপর এরূপ ঘৃণিত কাৰ্য্য নিতান্তই বিস্ময়জনক

৫. যযাতি রাজার পুত্র গ্রুহ্য নাম যার।
তানবংশে দৈত্যরাজা চন্দ্রবংশ সার।
তাহান তনয় রাজা ত্রিপুর নামে ধর্ম্মে।
(সংক্ষিপ্ত রাজমালা)

৬. যুধিষ্টিরস্য যজ্ঞার্থে সহদেবেন নির্জিতঃ।
(সংস্কৃত রাজমালা)

৭. শিবলিঙ্গ নতা ধ্যানাৎ সাবভূম সুগর্ভিনী।
(সংস্কৃত রাজমালা)

৮. শঙ্করঞ্চ শিবানীঞ্চ মুরারিং কমলাং তথা।
ভারতীঞ্চ কুবেরঞ্চ গণেশং বেধসং তথা।
ধরণীং জাহ্নবীং দেবীং পয়োধিং মদনং তথা।
হতাশঞ্চ নগেশঞ্চ দেবতান্তাঃ শুভাবহাঃ
(সংস্কৃত রাজমালা)

মহান্তরে :-

হারোমা হরিমা বাণী কুমারোগণকো বিধিঃ।
ঋদ্ধি গঙ্গা শিখী কামো হিমাদ্রিশ্চ চতুৰ্দ্দশাঃ।

৯. তস্য পুত্র শিক্ষরাজ নরমাংস খায়।
(সংস্কৃত রাজমালা)

নাগপতেঃ সুতাজাত শিক্ষারাজ ইতিরিতঃ। সে একদাবনং যাতোমৃগায়ার্থং মহীপতিঃ। বহুকালং বনে ভ্রান্তা মৃগংন প্রাপ্তবান নৃপঃ। অতি শ্রান্ত স্ততোরাজা নিজ মন্দিরজগৎ। ততঃ ক্ষুধাৰ্ত্তো নৃপতি মাংস পাকার্থ মুক্তবান। মৃগমাংসম নাবা প্রাপ্য বিহ্বল পাচক স্তদা। অষ্টাম্যাং দেবদওস্য নরস্য মাংস মানয়ৎ। তন্মাংসমতি সৎপক্কং ভোজয়া মাস ভূমিপং। শিক্ষরাজস্তুতদ্ভুক্তা সন্তুষ্টঃ প্রাহ পাচকং। ঈদৃশং সুরসং মাংসং কুতস্ত্বংসমুপেতবান্। পাচকস্তু ততঃ প্ৰাহ ভুমিপং সুভায়াতুরঃ। দেবদত্ত নরস্মৈতস্মাংসং ভৌজিতং মায়া। ইতিশ্রুত্বা ততোরাজা কম্পান্বিত কলেবরঃ। হরেত্রাহি হরেত্রাহি বিমূস্যাতি পুনঃ পুনঃ মহাবৈরাগ্য মাস্থায় বনবাস মূপাশ্রিতঃ।
(সংস্কৃত রাজমালা)

১০. রাজমালায় ইহার নাম বিমার, কিন্তু মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের কৃত পূর্বোক্ত বংশাবলীতে এই নরপতির নাম ‘প্রমার’ লিখিত হইয়াছে।
১১. এই শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে রাজমালায় লিখিত আছে যে ‘পুরাকৃত যুগে রাজন মনুনা পূজিতঃ শিবঃ। অত্রৈব বিরলে স্থানে মনুনাম নদী তটে। গুপ্তভাবেন দেবেশঃ কিরাতনগরে বসৎ। একাকিরাতিনী তত্র স্থিতা পরম সুন্দরী। রূপ যৌবন সম্পন্না নিত্যং শিবমপূজয়ৎ। ততঃ প্রত্যক্ষ মেধাসৌ দেবাদেব স্তদালয়ং। গত্বা কিরাতিনাংতাঞ্চ বুভুজে সুচিরং শিবঃ। ইতিশ্রুত্বা জগন্মাতা পাববতী বহুকোপিতা। বেশেদ্যাকৃষ্য সংতাড্য সংজহার কিরাতিনাং। ততোতি লজ্জিতঃ শম্ভুঃ শিব লিঙ্গ মুপাবিশ‍।’ এস্থলে রাজমালা লেখক আমাদিগকে কোচবিহার রাজবংশের আদি মাতা হীরার কাহিনী স্মরণ করিয়া দিতেছেন। (যোগিনীতন্ত্র। ত্রয়োদশ পটল দ্রষ্টব্য)

১২. মিহিরকুল হইতে মেহেরকুল নামের উৎপত্তি।
‘তানপুত্র ছেংথুম রাজা মেহেরকুল জিনে।’
(সংস্কৃত রাজমালা)

১৩. Stewart’s History of Bengal PP. 38. 39

১৪. Hunter’s Orissa Vol. II P. 4

১৫. মল্লিখিত ‘জাজনগর রাজ্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, উৎকলাধিপতি বীরচূড়ামণি নরসিংহদেব, (যিনি উড়িষ্যার ইতিহাসে সাঙ্গুলীয়া নরসিংহ নামে পরিচিত) বারংবার তুগন খাঁকে পরাজিত করিয়া লক্ষণাবতী (গৌড়নগরী) অধিকার ও লুন্ঠন পূর্ব্বক স্বদেশে প্রস্থান করেন। (ভারতী সপ্তম ভাগ, ১২, ১৩ পৃষ্ঠা)। উড়িষ্যাই হউক, আর ত্রিপুরাই হউক, জাজনগর পতিদ্বারা তুগন খাঁ নিঃসন্দেহে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন। কিন্তু জাতীয় পক্ষপাতান্ধ ফেরেস্তা পবিত্র ইতিহাস কলঙ্কিত করিয়া গৌড় বিজেতাকে চেঙ্গিস খাঁ লিখিয়াছেন। হিন্দুর হস্তে মুসলমানের এরূপ লাঞ্ছনা বর্ণনা করিতে মুসলমান লেখক নিতান্ত সঙ্কুচিত হইয়াছিলেন।

১৬. সংস্কৃত রাজমালা লেখক বলেন যে, ভীম একাদশীর পারণের সময়ে ঘটনাক্রমে এইরূপ হইয়াছিল। মহারাজ ডুঙ্গর ফা ইচ্ছা পূবর্বক এরূপ করেন নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *