সপ্তদশ অধ্যায়
মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক বাহাদুর পুনর্বার গরুর পরিবর্তে অজা দ্বারা হল কর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই দীনবন্ধু পুনর্বার মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হইলেন (১২৮৬ ত্রিপুরাব্দের শেষ ভাগে।)
এই সময় শ্রীশ্রীমতী মহারাণী ভিক্টোরিয়া “দিল্লীর দরবারে” “ভারত সাম্রাজ্ঞী” উপাধি গ্রহণ করেন। তৎকালে ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট অন্যান্য সামন্ত নরপতিবর্গের ন্যায়, ত্রিপুরাপতিকেও একটি পতাকা (বেনার) দান করিয়াছিলেন। ইহার কিছুকাল পরে গবর্ণমেন্ট ত্রিপুরার মহারাজকে (১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে) “মহারাজ” উপাধি দান করেন। যে ত্রিপুর নরপতিগণ নরমান কর্তৃক ইংলণ্ড বিজয়ের পূর্ব হইতে “মহারাজ” উপাধি ধারণ করিয়া আসিতেছেন, মুসলমান সম্রাটগণ যাঁহাদিগকে স্বাধীন নরপতি বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন; ভারতে ব্রিটিস সাম্রাজ্য সংস্থাপণ হইতে, মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পূর্ব পর্য্যন্ত রোবকারী সমূহে ব্রিটিস কর্তৃপক্ষগণ যাহাদিগকে “মহারাজ” কিম্বা “মহারাজ বাহাদুর” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, সেই মহারাজ বংশীয় মহারাজকে গবর্ণমেন্ট “মহারাজ” উপাধি দান করিলেন ইহা নিতান্ত বিস্ময়জনক।
১২৮৭ ত্রিপুরাব্দে যুবরাজ রাধাকিশোর খাস আপীল আদালতের (২০৯) জনৈক বিচারপতি নিযুক্ত হন সুবিখ্যাত মন্ত্রী ব্রজমোহন ঠাকুরের পুত্র বিজ্ঞবর ধনঞ্জয় ঠাকুর উদয়পুর বিভাগের শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত হইলেন। মহারাজ বিজ্ঞবর শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে সহকারী মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করিয়া দীনবন্ধুকে “প্রধানমন্ত্রী” উপাধি প্রদান করিলেন; দীনবন্ধু প্রতিভাশালী ছিলেন না, কিন্তু দীর্ঘকাল মহারাজ বীরচন্দ্র বাহাদুরের দরবারে উপস্থিত থাকিয়া কূটনীতিতে কিয়ৎ পরিমাণ অভ্যস্ত হইয়াছিলেন।[১] সুতরাং তিনি রাজদরবারে আত্ম প্রাধান্য রক্ষা করিবার জন্য একটি দল সৃষ্টি করিলেন। মহারাজের প্রিয়তামা মহিষী ভানুমতী মহাদেবী,[২] ও উক্ত মহিষীর ভ্রাতা ঠাকুর নরধবজ সিংহ এবং কুমারগণের শিক্ষক রাধারমণ ঘোষ বি, এ মন্ত্রী দীনবন্ধুর পৃষ্ঠপোষক হইলেন। এইরূপে দলবদ্ধ হইয়া দীনবন্ধু ক্রমে ক্রমে দীনবন্ধুনগর, তারানগর প্রভৃতি কতকগুলি বৃহৎ আবাদি তালুক ও প্রচুর আয় (২১০) বিশিষ্ট বনকর লাট কামথানা প্রভৃতি মহাল অল্প জমায় ইজারা গ্রহণ করিয়াছিলেন। নরধবজও ঐরূপ অল্প জমায় বনকর খোয়াই প্রভৃতি ইজারা ও কতক তালুক গ্রহণ করিলেন। এই উপায় দ্বারা দীনবন্ধু ও নরধবজ ত্রিপুরা রাজ্যের প্রজাবর্গ মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনবান হইলেন। মহারাণী ভানুমতী বিশালগড় পরগণা ও আগরতলা পরগণার কিয়দংশ অল্প জমায় তালুক গ্রহণ করত রাজ পরিবারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পত্তিশালিনী হইয়াছিলেন। রাধারমণ এবপ্রকার ঘৃণিত পন্থা অবলম্বন করেন নাই। তিনি সামান্য লোভ পরিত্যাগ করিয়া ত্রিপুর রাজদরবারে অসাধারণ আধিপত্য সংস্থাপন পূর্বক মহারাজের প্রাইবেট সেক্রেটারি হইলেন। এইরূপে ঘোষ বংশধর রাধারমণ দ্বারা বর্ত্তমার ষড়যন্ত্রকারী দলের বীজ রোপিত হইল।
এই দলের প্রভাবে মহারাণী রাজেশ্বরীর গর্ভজাত, (যুবরাজ রাধাকিশোরের অনুজ)-মহারাজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্র কুমার দেবেন্দ্র ও নৃপেন্দ্রকে উপেক্ষা করিয়া— চতুর্থ কুমার (ভানমুতীর জ্যেষ্ঠপুত্র) সমরেন্দ্রচন্দ্রকে মহারাজ বীরচন্দ্র “বরঠাকুর” উপাধি প্রদান পূর্বক প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতী দেবীর প্রীতি সাধন করিয়াছিলেন। (১২৮৮ ত্রিপুরাব্দের ২৮ জ্যৈষ্ঠ)।
এই ক্ষমতাশালী দলের কৌশলে বিজ্ঞবর শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (২১১) ত্রিপুরা রাজ্যে কোনরূপ ক্ষমতা প্রচার কিম্বা আধিপত্য সংস্থাপন করিতে পারেন নাই। গবর্ণমেন্টের সঙ্গে চিঠিপত্র লেখা পড়ার কার্য্য লইয়া, তিনি প্রধানত সময় কৰ্ত্তন করিতেন। তদ্ব্যতীত কদাচিৎ কোন সময় বিচার ও বন্দোবস্তের কার্য্য নির্বাহ করিতেন। ১২৮৮ ত্রিপুরাব্দে “পাহাড় আদালত” নামক বিচারালয় এবলিস হইয়া যায়। প্রাচীনকাল হইতে অন্যান্য পার্বত্য রাজ্যের ন্যায় ত্রিপুরারাজ্যে দাস দাসী ক্রয় বিক্রয়ের প্রথা প্রচলন ছিল। যদিচ কোন সময়ে কোন ক্রীতদাসী গৃহিনী পদবী লাভ করত পরম সুখে জীবন যাপন করিয়াছেন সত্য, কিন্তু অধিকাংশস্থলেই তাহাদের জীবন চিরকষ্টময় হইয়াছে। ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট এই জঘন্য প্রথা ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত থাকার সংবাদ অবগত হইয়া তাহা উঠাইয়া দিতে যত্নবান হন। গবর্ণমেন্টের উপদেশে বাধ্য হইয়া মহারাজ বীরচন্দ্র ১২৮৮ ত্রিপুরাব্দের ১৭ আষাঢ় ঘোষণাপত্র প্রচার পূর্বক এই প্রথা রহিত করেন।
১২৮৮ ত্রিপুরাব্দে গবর্ণমেন্ট আগরতলায় পলিটিকেল এজেন্টের পদ এবলিস করেন। তৎপরিবর্তে জেলা ত্রিপুরার মেজেস্ট্রেট “একসওফিসিউ” পলিটিকেল এজেন্ট হইলেন। তাঁহার অধীনে ডেপুটী মেজেস্ট্রেট বাবু উমাকান্ত দাসকে আগরতলার এসিষ্টান্ট পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করা হইয়াছিল।
১২৮৯ ত্রিপুরাব্দে কুমার নবদ্বীপচন্দ্র পুনর্বার এক মোকদ্দমা উপস্থিত করেন। এবার তিনি সেই রোবকারির বলে[৩] চাকলে রোশনাবাদে ভাবী অধিকারিত্ব সংস্থাপন ও ভরণ পোষণের জন্য বৃত্তিঃ পাওয়ার প্রার্থনা করিলেন।
ত্রিপুরার জজ টাওয়ার সাহেব (১৮৮১ খ্রিঃ ২৪ জানুয়ারি) তাঁহার বৃত্তি মাসিক ৬০০ টাকা অবধারণ করেন। বাদী, বিবাদী উভয় পক্ষ হাইকোর্টে আপীল করিলেন। ৭০ বৎসর অন্তে ব্রিটিস বিচারাদালতের নিদ্রাভঙ্গ হইল। এই মোকদ্দমায় তাঁহারা অবধারণ করিলেন যে, ‘ত্রিপুরাধিপতি একজন স্বাধীন নরপতি, তাঁহার বিরুদ্ধে এরূপ মোকদ্দমা বিচার করিবার আমাদের অধিকার নাই।” এই কথাটা শুনিতে বড়ই মধুর। গবর্ণমেন্টের “নজরানা রিজলিউসন” প্রচারের পরেও কলিকাতা হাইকোর্টের মান্যবর বিচারপতিগণ পার্বত্য ত্রিপুরাকে “স্বাধীন ত্রিপুরা” বলিয়া ঘোষণা করিলেন। সম্রাট স্বরূপে ভারত গবর্ণমেন্টের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতের এবপ্রকার বিচার সম্পূর্ণ মূল্যহীন হইলেও হাইকোর্টের এই নিষ্পত্তি যে, কতকগুলি উপায়হীনের হৃদয়ে ছুরিকার ন্যায় চিরকালের তবে বিদ্ধ হইয়াছিল, (২১৩) তাহা কেহই অস্বীকর করিতে পারেন না। দুর্গামণি যুবরাজ বনামে মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্যের নামীয় মোকদ্দমায় ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারকগণ অতি সুন্দর নিষ্পত্তি করিয়াছিলেন।[৫] চাকলে রোশনাবাদ কিম্বা ত্রিপুরা রাজ্য কোন নরপতির স্বার্জিত সম্পত্তি নহে। ইহা কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরদিগের অবিভক্ত সাধারণ সম্পত্তি। বংশের মধ্যে এক ব্যক্তি মেনেজার স্বরূপ ইহার অধিকারী (রাজা) হইয়া থাকেন। অন্যান্য ব্যক্তিগণ জীবিকা নির্বাহ জন্য বৃত্তি প্রাপ্ত হন। কিন্তু জ্ঞাতিবর্গের জীবিকা নির্বাহের বৃত্তির প্রতি ত্রিপুর নৃপতিগণের সর্বদাই ঔদাসিন্য দৃষ্ট হয়। কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরগণ ক্রমে ক্রমে ভিক্ষুক শ্রেণীতে পরিগণিত হইবার উপক্রম হইয়াছে। নরপতিগণ সর্বদাই স্বীয় পরিবারবর্গ ও শালা সম্বন্ধীয় ভরণ পোষণ লইয়াই ব্যস্ত আছেন। কিন্তু চাকলে রোশনাবাদ কিম্বা ত্রিপুরা রাজ্য বিভক্ত হইলে (২১৪) যাঁহারা এক একটা প্রধান অংশ প্রাপ্ত হইতেন, তাঁহারা কেহই উপযুক্তরূপে অন্নবস্ত্র পাইতেছেন না। অর্থাভাবে তাঁহাদের পুত্রগণের বিদ্যাশিক্ষা হইতেছে না, কন্যার বিবাহ দেওয়া অসাধ্য হইয়াছে। প্রাচীন কথা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। ভূতপূর্ব মহারাজ কৃষ্ণকিশোর ও ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের শাসনকালে আমরা এই অন্যায় অত্যাচার আংশিকভাবে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বর্ত্তমান মহারাজের সময়ে এই অত্যাচারের মাত্রা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। এই জন্য সময় সময় লোমহর্ষণ নাটকের অভিনয় হইতে দেখা গিয়াছে। অন্যায় অত্যাচারে উৎপীড়িত রাজবংশীয় কোন কোন ব্যক্তি[৬] দুদন্ত কুকিদিগের সহিত মিলিত হইয়া নররুধিরে পৃথিবী রঞ্জিত করিয়াছেন। প্রজাহিতৈষী গবর্ণমেন্ট রাজবংশজদিগের বীরত্ব প্রকাশের পন্থা রুদ্ধ ও অত্যাচার নিবারণ করিয়া প্রজাবর্গের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। পক্ষান্তরে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া, কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরগণ যে, তাঁহাদের ন্যায় সঙ্গত বৃত্তি সাময়িক নরপতি হইতে আদায় করিয়া লইবেন, সেই পন্থাও হাইকোর্টের উল্লিখিত নিষ্পত্তি পত্র দ্বারা রুদ্ধ হইয়াছে। এক্ষণ (২১৫) তাঁহারা কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিবে? আমরা ভরসা করি, সম্রাট স্বরূপে ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট অবশ্যই ইহার প্রতিকার করিবেন। ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট যদি আত্মসর্তের সময়ে সম্রাটত্ব ঘোষণা করিয়া, উপায় হীনের বেলায় অন্ধত্ব অবলম্বন করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের এই কলঙ্ক চিরকাল ইতিহাস পটে ঘোষিত হইবে।
বাঙ্গালা গবর্ণমেন্টের ভুতপূর্ব প্রধান সেক্রেটারি পিকক সাহেবের যত্নে কুমার নবদ্বীপচন্দ্র, মহারাজ হইতে সামান্য বৃত্তি (মাসিক ৫২৫ টাকা) প্রাপ্ত হইতেছেন। সুতরাং এস্থলে তিনি আমাদের লক্ষ্য নহেন। রাজবংশীয় অন্যান্য ব্যক্তির অবস্থা প্রকৃত পক্ষেই শোচনীয়। গবর্ণমেন্ট যদি তাঁহাদের জীবিকা নির্বাহ ও বিদ্যা শিক্ষার কোনরূপ সুবন্দোবস্ত না করেন, তাহা হইলে ইহাদের দ্বারা দস্যু তস্কর প্রভৃতির শ্রেণী বৃদ্ধি হওয়া বিচিত্র নহে।
কুমার নবদ্বীপচন্দ্রের দ্বিতীয় মোকদ্দমা প্রথম আদালতে নিষ্পত্তি হইলে মহারাজ বীরচন্দ্র বাহাদুর এক অক্ষয়কীৰ্ত্তি সংস্থাপন করিতে মনস্থ করিলেন। তৎ সাহায্যে ষড়যন্ত্রকারিদলের পূর্ণ বিকাশ হইয়া উঠিল।” ১৮৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক রিপোর্টে তদানীন্তন পলিটিকেল এজেন্ট বোল্টন সাহেব ষড়যন্ত্রকারীদলের প্রাধান্য এবং তাহার বিষময় ফলের কথা অতি কঠোর ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন।” কিন্তু (২১৬) বক্ষ্যমান ঘটনা দ্বারা ষড়যন্ত্রকারীদলের ক্ষমতা ও অত্যাচার পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হইল। অর্থনাশের স্রোত শতমুখী গঙ্গার ন্যায় প্রবলাকার ধারণ পূর্বক প্রবাহিত হইতে লাগিল। অসভ্য ত্রিপুরা জাতির জলাচরণ রূপ ভীষণ সমাজ বিপ্লব তরঙ্গ উপস্থিত হইয়া, রাজকোষের অর্থনাশ, পদে পদে রাজ পদের অবমাননা, ৭ নিরীহ লোকের সর্বনাশ এবং ষড়যন্ত্রকারিদল ও তাঁহাদের আত্মীয় কুটুম্বগণের উন্নতি ও স্বার্থসিদ্ধির পন্থা পরিষ্কৃত হইল। ত্রিপুররাজকূল চন্দ্রবংশীয় হউক আর নাই হউক, ত্রিপুরাবাসী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণ অতি আদরের সহিত তাঁহাদিগকে হৃদয়ে ধারণ করিয়াছিলেন। ত্রিপুরাবাসী আর্যগণ স্মরণাতীত কাল হইতে রাজবংশটীকে অতি যত্নের সহিত যথাসম্ভব সমাজ অঙ্কে সংস্থাপন পূর্বক তাঁহাদের গৌরব বৃদ্ধির জন্য যত্নবান ছিলেন। উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণগণ তাঁহাদের পৌরহিত্য গ্রহণ পূর্বক আর্য্য ধর্মানুযায়ী ক্রিয়াকলাপ (২১৭) সর্বদা সম্পাদন করিতেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন স্বার্থপর কুচক্ৰিব্যক্তি পর্বতবাসী সমস্ত ত্রিপুরাজাতিকে ক্ষত্রিয়বংশজ বলিয়া প্রচার ও রাজপরিবারভুক্ত করত, তাহাদের স্পৃষ্ট জল হিন্দু সমাজে চালাইবার জন্য মহারাজকে পরামর্শ প্রদান করিলেন। তাহাদের পরামর্শে মহারাজ এরূপ প্রমত্ত হইয়াছিলেন যে, রাজপরিবারস্থ কোন কোন ব্যক্তি ও দূরদর্শী দুই একজন অমাত্য এই দুরূহ কাৰ্য্য হইতে মহারাজকে বিরত করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া সম্পূর্ণ অকৃতকাৰ্য্য হন। বাবু শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সমাজ বিপ্লবের সূচনা সদর্শনে কলিকাতা গমন করেন। ত্রিপুরাবাসী হিন্দুগণ সকলেই মহারাজের অন্যায় কার্য্যের তীব্র প্রতিবাদ আরম্ভ করিলেন। ষড়যন্ত্রকারিগণ মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি মহারাজকে এইরূপ পরামর্শ প্রদান করেন যে, বিক্রমপুরের প্রধান পণ্ডিতগণকে রাজধানীতে আহ্বান করিয়া, তাঁহাদিগকে পার্বত্য জাতির স্পৃষ্ট জল পান করাইলেই মহারাজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হইবে। মহারাজ এই কুপরামর্শকে সৎপরামর্শ বলিয়া গ্রহণ করিলেন। বিক্রমপুর নিবাসী কতকগুলি অর্থগৃধনু পণ্ডিত ও চাকরিপ্রার্থী “উমেদওযার” রাজধানীতে উপনীত হইয়া ১২৯১ ত্রিপুরাব্দের ২০ মাঘ রজনীতে চতুৰ্দ্দশ দেবতার বাটিতে বসিয়া ত্রিপুরাজাতির সৃষ্ট জল সহ কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন ভোজন করিলেন। শ্রেণীবিভাগ ক্রমে সেই সকল পণ্ডিতগণ (২১৮) ৪/৫/৬ শত টাকা দক্ষিণা প্রাপ্ত হইলেন। জলপায়িদলের নেতৃগণ প্রত্যেক সহস্র মুদ্রা দক্ষিণা গ্রহণ করিলেন। উমেদওয়ারদিগের স্থান করিবার জন্য দুইটী উপায় অবলম্বন করা হইয়াছিল। নূতন পদ সৃষ্টি করিয়া কতকগুলি লোক নিযুক্ত করা হইল।[৮] মহম্মদের শিষ্যগণ যেরূপ ধর্ম প্রচারার্থ এক হস্তে কোরাণ অন্য হস্তে তরবারি লইয়া কিছুকাল জগতে বিচরণ করিয়াছিলেন, জলপায়িদলের নেতৃবর্গ সেইরূপ একহস্তে ত্রিপুরাজাতির সৃষ্টজল এবং (ক্ষমতার অভাবে) অন্য হস্তে অৰ্দ্ধচন্দ্ৰ লইয়া দণ্ডায়মান হইলেন! ত্রিপুরাবাসী যে সকল হিন্দু কাৰ্যে নিযুক্ত ছিলেন, তন্মধ্যে অল্প কয়েকটি লোক চাকরির মায়া পরিত্যাগ করিতে না পারিয়া জলপান করিলেন, অধিকাংশের ভাগ্যেই অর্দ্ধচন্দ্র লাভ হইল। তাঁহাদের স্থল, সেই সকল জলপায়ী উমেদারগণ দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়াছিল।[৯] দেবসেবা ও ব্রাহ্মণদিগের জীবিকা নির্বাহ জন্য মহারাজের পূর্বপুরুষগণ যে সকল “নগদিবৃত্তি” (২১৯) (বার্ষিক কিম্বা মাসিক নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা) প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার অধিকাংশ বন্ধ করিয়া যে মহারাজ নিরস্ত হইয়াছিলেন এমত নহে, তিনি স্বয়ং “ভুবনেশ্বর” নামক এক শিবদেবতার সেবা পূজার ব্যয় নির্বাহ জন্য বার্ষিক যে ৬০ টাকা “নগদি বৃত্তি” প্রদান করিয়াছিলেন, সেই দেবতার সেবাইতগণ ত্রিপুরাজাতির স্পৃষ্ট জল পান করে নাই বলিয়া এই অপরাধে দেবতার বৃত্তি বন্ধ হইল। প্রস্তরময় ভুবনেশ্বর বাক্য উচ্চারণ শক্তি থাকিলে, তিনি অবশ্যই মহারাজ বাহাদুরকে দত্তাপহারী বলিতেন। অত্যাচার উভয় পক্ষেই সমভাবে চলিতেছিল, মহারাজ যাহাদিগকে ক্ষত্রিয় বানাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলেন, তাহাদের শূকর, মোরগ, ছাগী প্রভৃতি আহার বন্ধ করিয়া উপবীত ধারণ করিবার জন্য আদেশ প্রচার করিলেন, সুতরাং তাহাদের আহারের যে নিতান্ত কষ্ট হইয়াছিল তাহা বলা বাহুল্য। অপর পক্ষে যে সকল ত্রিপুরাবাসী চাকরি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের পরিবারবর্গের অন্ন কষ্ট উপস্থিত হইল। নগদবৃত্তি বদ্ধ হওয়ায় কতকগুলি মূক দেবতার আহার বন্ধ ও ব্রাহ্মণ পরিবার নিতান্ত কষ্টে পতিত হইলেন। মহারাজ স্বীয় জমিদারির অন্তর্গত স্থানবাসী হিন্দুদিগের প্রতি বল ও আইনের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করিলেন। ফলত বোধহয় রোমসম্রাট নিরো (২২০) কিম্বা খোরা তৈমুরের[১০] ন্যায় অসাধারণ ক্ষমতা থাকিলে মহারাজ বীরচন্দ্র তৎকালে ত্রিপুরাবাসী লক্ষ লক্ষ হিন্দুর মুণ্ড ছেদন করত আত্ম প্রসাদ লাভ করিতেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ত্রিপুরাবাসী হিন্দুগণ ব্রিটিস সিংহের আশ্রিত এবং আগরতলায় বসিয়া ব্রিটিস পলিটিকেল এজেন্ট ও এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট ব্রিটিস প্রজাকে রক্ষা করিতেছিলেন। মহারাজের ভীষণ অত্যাচারে বাধ্য হইয়া ত্রিপুরাবাসী হিন্দুগণ দলবদ্ধ হইলেন। ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, নওয়াখালী, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টবাসী সর্বসাধারণ হিন্দুগণ ত্রিপুরার হিন্দুসমাজের সহায় হইলেন। তাঁহারা যদিও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুগণের ক্ষতিপূরণ করিতে পারেন নাই, কিন্তু ভীষণ সমাজ যুদ্ধে মহারাজকে বিশেষরূপে পরাজিত করিলেন। বাঙ্গালা দেশে এইরূপ সমাজ বিপ্লব বোধহয় কখনও সংঘটিত হয় নাই। ত্রিপুরাবাসী হিন্দুগণ এই সমাজ বিপ্লব আপনাদের জাতীয়ভাবের জীবন্ত দৃষ্টান্ত প্ৰদৰ্শন করিয়াছিলেন কতকগুলি অর্থপিশাচ ব্যতীত ঢাকা নিবাসী অপর হিন্দুসাধারণ তাঁহাদের প্রধান সহায় ছিলেন। রাজকোষ অর্থ শূন্য করিয়া, ত্রিপুরারাজ্যকে ঋণজালে বদ্ধ করিয়া, ৭ বৎসর অন্তে এই সমাজ বিপ্লব পরবর্ত্তী মন্ত্রী বাবু মোহিনীমোহন বর্দ্ধনের কাৰ্য্য কৌশলে (২২১) নির্বাচিত হইয়াছিল। কিন্তু নুরনগর নিবাসী উচ্চ শ্রেণী হিন্দুগণের প্রতি মহারাজের রোষাগ্নি নির্বাপিত হইল না।
ভীষণ সমাজবিপ্লবানলে উৎসাহরূপ আহুতি প্রদান পূর্বক, – পূর্ণমাত্রায় আত্মস্বার্থ উদ্ধার করিয়া, –রাজ ভাণ্ডার শূন্য করিয়া, আত্মভাণ্ডার পূর্ণ করিয়া ১২৯২ ত্রিপুরাব্দের বর্ষাকালে দীনবন্ধু প্রেতপুরে গমন করিলেন। এই সময়ে মহারাজের প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতী দেবী পরলোক গমন করেন। মহারাজ তাঁহার শোকে কিছুকাল নিতান্ত কাতর ছিলেন। শীতকালে মহারাজ বালিশিরার পাহাড় ফিনি মিউর কোম্পানিকে মকররী বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া প্রায় এক লক্ষ টাকা গ্রহণ করেন।[১১] সেই টাকা দ্বারা মহারাণী ভানুমতীর পারলৌকিক কার্য্য সম্পাদন জন্য মহারাজ বৃন্দাবন ধামে গমণ করেন। ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতৃগণও মহারাজের সহিত গমণ করেন।(২২২)
মহারাজের অনুপস্থিত কালে রাজ্য ও জমিদারির শাসন কার্য্য নির্বাহ জন্য মহারাজ একটী সভা গঠন করিয়াছিলেন। যুবরাজ রাধাকিশোর তাহার সভাপতি ও অন্য চার ব্যক্তি তাহার সভ্য ছিলেন। যুবরাজ প্রায় ৪ মাস বিশেষ দক্ষতার সহিত অবাধে রাজ্য ও জমিদারি শাসন করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন।[১২]
মহারাজ বৃন্দাবন হইতে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এক্ষণ কাহাকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হইবে, তাহাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হইল, ষড়যন্ত্রকারিদল তাঁহাদের ইচ্ছামত মন্ত্রী নিযুক্ত করিতে যত্নবান হইলেন। কিন্তু পলিটিকেল এজেন্ট ও এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট এবং অন্যান্য বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সকলেই বিখ্যাত মন্ত্রী ঠাকুর ব্রজমোহনের পুত্র ঠাকুর ধনঞ্জয়কে মন্ত্রী নিযুক্ত করিবার জন্য মহারাজকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। ধনঞ্জয় উদয়পুর বিভাগের শাসন কার্য্য সুচারুরূপে নির্বাহ করিয়া সর্বসাধারণ সমক্ষে যশস্বী হইয়াছিলেন। তিনি বিদ্বান; বুদ্ধিমান, ও বিশেষ কার্য্যক্ষম বলিয়া যে কেবল প্রজাবর্গের ভক্তি আকর্ষণ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন এমত নহে, ইংরেজ রাজ পুরুষ ও অপর (২২৩) ভদ্র সাধারণেরও শ্রদ্ধা, প্রীতি লাভ করিয়াছিলেন।[১৩] পলিটিকেল এজেন্টের অনুরোধ রক্ষার্থে নামত দীনবন্ধুর ক্ষমতা অর্পণ করিয়া মহারাজ বীরচন্দ্র, ঠাকুর ধনঞ্জয় দেবকে প্রধান মন্ত্রীর(২২৪) পদে নিযুক্ত করিলেন। প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্রকারিদলের চক্রান্তে তিনি কিছুমাত্র ক্ষমতা প্রাপ্ত হন নাই। তাঁহার মন্ত্রণাশক্তি পরিচালন ক্ষমতার প্রতিরোধ জন্য ৭ জন মেম্বর দ্বারা একটি সভা গঠিত হইয়াছিল এবং ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতা প্রাইবেট সেক্রেটারি, মহারাজের সেক্রেটারি হইলেন। সেক্রেটারীর দল পদে পদে মন্ত্রীকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করিতে লাগিলেন। জলাচরণ উপলক্ষ করিয়া পূর্বোল্লিখিত অর্থ পিশাচগণ নানা প্রকার উপায়ে লুট পাট করিতে লাগিল। ঋণজালে রাজ সংসার ডুবু ডুবু হইয়াছিল, তথাপি ঋণ করিয়া অর্থ জোগাইবার জন্য মহারাজ মন্ত্রীকে উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন।
এই সময় মহারাজ বাহাদুর (৫০ বৎসর বয়ক্রমে), স্বীয় প্রিয়তমা মহিষী, মহারাণী ভানুমতীর কনিষ্ঠা ভগিনীর কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। সেই বালিকা “মহারাণী মনোমোহিনী মহাদেবী” আখ্যা দ্বারা পরিচিত হইলেন।
ঠাকুর ধনঞ্জয় তিন বৎসর কাল মহারাজের ও ষড়যন্ত্র কারীদলের উৎপীড়নে নানা প্রকার অপমান ও কষ্ট ভোগ করিলেন। এই সকল বিশৃঙ্খলা দর্শনে গবর্ণমেন্টের রোষ উদ্দীপ্ত সুতরাং গবর্ণমেন্টের বিশেষ পরিচিত কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রিত্বে নিযুক্ত করিয়া কিছু দিনের জন্য মহারাজ বাহাদুর “গা ঢাকা” দিতে মনস্থ করিলেন। ১২৯৬ ত্রিপুরাব্দের আরম্ভে ঢাকা বিভাগের স্কুল আসিষ্টান্ট(২২৫) ইনস্পেক্টার বাবু দীননাথ সেনকে মহারাজ মন্ত্রীত্বে নিযুক্ত করিলেন।[১৪]
প্রকৃতপক্ষে বাবু দীননাথ সেন তিন মাসের অধিক আগরতলায় ছিলেন। এই অল্পকাল মধ্যেই তিনি বনকরের আয় ৬০ টাকা বৃদ্ধি করেন। সংসার ও শাসন বিভাগ স্বতন্ত্র ভাবে গঠন করিয়া তিনি সুশৃঙ্খলতার ভিত্তি সংস্থাপন করিয়াছিলেন। অল্পকাল কার্য্য করিয়াই তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, দীর্ঘকাল এই কার্য্যে নিযুক্ত থাকিলে তাঁহাকে অপমানিত হইতে হইবে এবং গবর্ণমেন্টও তাঁহাকে মাসিক ৮০০ শতের অধিক বেতন রাজ্য সরকার হইতে গ্রহণ করিতে নিষেধ করিলেন; সুতরাং তিনি রাজকীয় কাৰ্য্য উপলক্ষে ঢাকায় গমন করিয়া, প্রায় তিন মাস অন্তে স্বীয় পদত্যাগ পত্র মহারাজ সমীপে প্রেরণ করেন। (২২৬) তদনন্তর মহারাজ পুনর্বার মন্ত্রী অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। “তুমি সকলের নিকাশ গ্রহণ করিবে তোমার নিকাশ গৃহিত হইবে না”। একপ্রকার অঙ্গীকৃত হইয়া মহারাজ কুমিল্লার গবর্ণমেন্ট প্লিডার বাবু মোহিনী বর্দ্ধন বি এলকে মন্ত্রিত্ব নিযুক্ত করেন।
১২৯৬ ত্রিপুরাব্দের ১০ অগ্রহায়ণ বাবু মোহিনীমোহন বৰ্দ্ধন স্বীয় কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় দুই বৎসর কাল কার্য্য করিয়াছিলেন। তাঁহার অধিকাংশ সময় লুট পাটের প্রশস্ত উপায় “বরাতী” প্রথা বন্ধ করবার জন্য অতিবাহিত হয়। তাঁহার কৌশলজনক কার্য্য দ্বারা সমাজ বিপ্লবের ভীষণ ভাব তিরোহিত হইয়াছিল, ইহা পূৰ্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার সময়েই “চিফ জষ্টিসের” পদ সৃষ্টি হইয়া যুবরাজ খাস আপীল আদালতের প্রধান বিচারপতি মনোনীত হন। (১২৯৬ ত্রিপুরাব্দের মাঘ মাসে।) আপীলের সুযোগ্য ও সুধীর বিচারক উজীর-বংশধর ঠাকুর গোপীকৃষ্ণ দেব খাস আপীল আদালতের জজের পদে নিযুক্ত এবং আপীল ও সেসন আদালতের বিচারকার্য্য ভার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী ঠাকুর ধনঞ্জয়ের হস্তে স্থায়ীরূপে ন্যস্ত হইয়াছিল। মোহিনী বাবু প্রজাস্বত্ব বিষয়ক আইন, কর্মচারিবর্গের বিদায় সম্বন্ধীয় আইন, ও নাবালকের সম্পত্তি রক্ষা বিষয়ক বিধান প্রভৃতি কয়েক খণ্ড আইন প্রণয়ন করেন। (২২৭)
তিনি মহারাজের প্রিয়পাত্রদিগের ইজারা মহালের খাজানা উপযুক্ত রূপে বৃদ্ধি ও বাকী আদায় করিতে যাইয়া অকৃতকাৰ্য্য হন। তাঁহার কার্য্যকালে রাজ্যের আয় অল্পবৃদ্ধি হইয়াছিল। যুবরাজ বাহাদুরের যত্ন ও উৎসাহে মোহিনী বাবু পার্বত্য জুমিয়া প্রজা বর্গের উন্নতি বিধান জন্য বাঙ্গালায় প্রচলিত প্রথামত কৃষিকাৰ্য্য শিক্ষার্থে বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি পার্বত্য প্রজাদিগের বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক চির প্রচলিত তৈথং (বা তৈথন) প্রথা রহিতের চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য হন। তিনি ত্রিপুরারাজ্যের পূর্বসীমা প্রসারিত করিবার জন্য গবর্ণমেন্ট সমীপে প্রস্তাব করিয়াছিলেন। এই সময় ষড়যন্ত্রকারিদলের ও তাহার অন্যান্য শত্রুগণের চক্রান্তে তিনি আগরতলা পরিত্যাগ করেন এবং কুমিল্লা হইতে স্বীয় পদত্যাগ পত্র মহারাজ সমীপে প্রেরণ করিয়াছিলেন। (১২৮৮ ত্রিপুরাব্দের অগ্রহায়ণ।)
১২৯৮ সনের ১১ পৌষ মহারাজ বীরচন্দ্র রাজ্য ও জমিদারি শাসন জন্য একটি মন্ত্রী সভা গঠন করেন। সেই সভা রাজস্ব ও ব্যয় এই দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। মহারাজের শ্যালক ঠাকুর নরধবজ সিংহ দুর্য্যোধনের সহচর কর্ণ সদৃশ মহারাজ বীরচন্দ্রের প্রিয় সহচর ও সেক্রেটারিবাবু রাধারমণ ঘোষ, সুযোগ্য দেওয়ান দুর্গাপ্রসাদ গুপ্ত ও অনুগৃহীত দেওয়ান হরিচরণ নন্দী এই মন্ত্রী সভার সভ্য হইলেন। (২২৮) সর্বসাধারণে ইহাকে একটি প্রহসন বিবেচনা করিল। কোন কোন ব্যক্তি উপহাস করিয়া “চারিইয়ারিদল” বলিত। এই সভা রাজকীয় যে অনুমতি পত্র দ্বারা গঠিত হয়, তাহাতে লিখিত ছিল যে, যুবরাজ ও বড় ঠাকুর ইহার কার্য্যকলাপ পরিদর্শন পূর্বক রাজসমক্ষে রিপোর্ট করিবেন। প্রকৃত পক্ষে সেই সভার কার্য্যকলাপ পরিদর্শনের ক্ষমতা যুবরাজ ও বড়ঠাকুরের ছিল কিনা তৎপক্ষে আমাদের সন্দেহ আছে। মাসাধিক কাল অতীত হইতে না হইতে “ইয়ার” চতুষ্টয়ের মধ্যে কলহ উপস্থিত হইল। নরধবজ ভগ্নধবজ হইয়া সভাগৃহ পরিত্যাগ করিলেন।
প্রাচীনকাল হইতে ত্রিপুরা রাজ্যে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট বাবু উমাকান্ত দাস ইহা নিবারণ জন্য যত্নবান হইলেন। চরণ সেনাপতি নামক এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁহার পত্নী নিছন্দবতীর সহমরণ উপলক্ষে উমাকান্ত বাবু সতীদাহ নিবারণ জন্য বিশেষ যত্নবান হন। মোহিনী বাবু উমাকান্ত বাবুর মতানুমোদন করিয়াছিলেন। তদনন্তর “চারইয়ারি” দলে প্রভুত্বকালে ১২৯৯ ত্রিপুরাব্দের ৮ জ্যৈষ্ঠ প্রকাশ্য ঘোষণা পত্র দ্বারা মহারাজ সতীদাহ নিবারণ করেন।[১৫](২২৯)
“চারিইয়ারি” দলের শাসন কালে নানারূপ বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। রাজ্যের আয় পূর্ব বৎসর অপেক্ষা ৩৯৮৪২ টাকা কমিয়া গেল। গবর্ণমেন্ট দেখিলেন যে, ত্রিপুরার মহারাজকে বারংবার সদুপদেশ প্রদান করিয়াও কোন ফল লাভ হইতেছে না। রাজ্যের বিশৃঙ্খলতার ও আবর্জ্জনা দূর করিবার জন্য মহারাজ কিছুই করিতেছেন না, অগত্যা গবর্ণমেন্ট বাধ্য হইয়া ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন কার্য্যের প্রতি হস্তক্ষেপ করিতে সমুদ্যত হইলেন। ১২৯৯ ত্রিপুরাব্দের শরৎকালে পলিটিকেল এজেন্ট গিয়ার সাহেব আগরতলায় উপনীত হন। তৎকালে ত্রিপুরা রাজ্যের শাসনভার ৫ বৎসরের জন্য মহারাজ গবর্ণমেন্টের হস্তে সমর্পণ করিলেন বলিয়া লিখিয়া দেন।[১৬] পশ্চাৎ উপযুক্ত মন্ত্রী নিয়োগ করিয়া সুচারুরূপে রাজ্যশাসন করিবেন বলিয়া গবর্ণমেন্টের হস্তক্ষেপ নিবারণ করেন এবং মহারাজর প্রার্থনা অনুসারে এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্টবাবু উমাকান্ত দাসকে মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিবার জন্য গবর্ণমেন্ট অনুমতি প্রদান করেন। (২৩০) উমাকান্ত বাবুকে ত্রিপুরা রাজকার্য্যে “মোতায়েন” করিয়া গবর্ণমেন্ট এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্টের পদ “এবলিস” করিলেন। কিন্তু গবর্ণমেন্ট ইহা অনুধাবণ করিলেন না যে, কালক্রমে উমাকান্তবাবুর অবস্থা নিতান্তই কষ্টকর হইয়া উঠিবে। একমুণ্ডদ্বারা দুই দেবতার পূজা করা বড়ই কষ্টকর।
১৩০০ ত্রিপুরাব্দের ৪ বৈশাখ (১৬ এপ্রিল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে) রায় উমাকান্ত দাস বাহাদুর মন্ত্রী স্বরূপে ত্রিপুরা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। কুর্ম্মনীতি পরায়ণ মহারাজ বীরচন্দ্র, উমাকান্ত বাবুর নিয়োগ পত্রে তাঁহাকে প্রায় সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করিয়াছিলেন। কেবল মাত্র ৫টি বিষয়ে মহারাজের অনুমতি গ্রহণ করিতে হইবে এইরূপ লিখিত হইয়াছিল।[১৭] (২৩১)
রাজ্য ও জমিদারি শাসন সংক্রান্ত সর্বপ্রকার আবর্জ্জনা দূর করিয়া বাবু উমাকান্ত উন্নতির পন্থা পরিষ্কার করিলেন। তিনি মহারাজের প্রাপ্য বাকী আদায় করিয়া মহাজন ও নানা প্রকার প্রাপকের প্রাপ্য দেনা প্রায় অর্দ্ধাংশ পরিশোধ করিয়াছিলেন। মহারাজের প্রিয় ও সুচতুর কর্মচারীগণ তাঁহাদের বেতন প্রায়ই ফাজিল লইয়া যাইতেন, অপর সাধারণ কর্মিচারিগণের তাঁহাদের বেতন দীর্ঘদিন বাকী পড়িয়া থাকিত, তাঁহারা অনাথ শিশুর ন্যায় কাঁদিয়া বেড়াইতেন। উমাকান্ত বাবু এই সকল বিশৃঙ্খলা দূর করিয়া, কর্মচারিগণের নিয়মিত রূপে মাসিক বেতন প্রদান করিতে লাগিলেন। সৈন্য বিভাগে অবর্ণনীয় বিশৃঙ্খলা চলিতেছিল। উমাকান্ত বাবু সৈন্য বিভাগ হইতে অকর্মণ্য লোকদিগকে অবসর ও স্থানান্তরিত করিয়া অবশিষ্ট সৈন্যগণকে সুশিক্ষিত ও কার্য্যক্ষম করিয়াছিলেন। ১৩০০ ত্রিপুরাব্দের শাসন বিবরণী পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, তৎকালে সামরিক বিভাগে সর্বশুদ্ধ ২৯৪ জন সৈন্য ছিল।[১৮]
উমাকান্ত বাবুর শাসনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী (২৩২) বর্গের চিরস্থায়ী আশঙ্কাযুক্তভাব বিদূরিত হইয়াছিল। বিবিধ সদগুণ মণ্ডিত যুবরাজ রাধাকিশোর বাহাদুর বিচার বিভাগের উন্নতি করত ন্যায় বিচারের পন্থা পরিষ্কার করিয়াছিলেন; কিন্তু রাজদরবার কিম্বা রাজদবার সংসৃষ্ট ব্যক্তিবর্গের মোকদ্দমায় বিচারকগণের বিবেক শক্তি প্রায়ই কুর্মের হস্ত পদের ন্যায় সঙ্কুচিত হইয়া যাইত।[১৯] উমাকান্ত বাবুর শাসনকালে সেই দোষের লেশমাত্র ছিল না।
পূর্ব হইতে আগরতলায় একটি সামান্য রকমের— ইংরেজি-বঙ্গ-বিদ্যালয় ছিল। যুবরাজ বাহাদুরের উৎসাহ ও সাহায্যে উমাকান্ত বাবুর দ্বারা সেই বিদ্যালয়টি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসৃষ্ট এটেন্স স্কুলে পরিণত হইয়াছিল এবং অসভ্য ত্রিপুরা, কুকি, হালামদিগকে বঙ্গভাষায় শিক্ষা দান জন্য নানা প্রকার উপায় অবলম্বন ও যত্ন করা হইয়াছিল।
মহারাজের জমিদারীর শাসন কার্য্য সুচারুরূপে নির্বাহ (২৩৩) জন্য উমাকান্ত বাবু ইহাকে চারিভাগে বিভক্ত করেন। প্রতি বিভাগে এক এক জন সব মেনেজার নিযুক্ত হইয়াছিল।
এই সময় বাঙ্গালার লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর চার্লস ইলিয়ট সাহেবের প্রস্তাব অনুসারে মহারাজ স্বীয় জমিদারি জরিপ ও জমাবন্দি করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টে প্রার্থনা করেন।
উমাকান্ত বাবু প্রায় আড়াই বৎসর মন্ত্রিত্বে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথম একবৎসর কাল তিনি বিশেষ উৎসাহের সহিত অবাধে কার্য্য নির্বাহ করেন; অবশিষ্ট ১॥০ বৎসরকাল মহারাজ ও তাঁহার স্নেহপালিত ষড়যন্ত্রকারিদলের সহিত নিয়ত কলহ করিয়া গিয়াছেন। মহারাজ বীরচন্দ্র যখন যে মন্ত্রী (প্রধান কর্ম্মচারী) নিযুক্ত করিয়াছেন, তখনই তাহাকে মুক্ত হস্তে ক্ষমতা প্রদান পূর্বক উৎসাহিত করিয়াছেন। ষড়যন্ত্রকারিগণও শিশির সমাগমে বীর্য্যহীন বিষধরের ন্যায় তৎকালে জীবস্মৃত অবস্থায় কালাতিপাত করিয়াছেন।[২০] তদনন্ত র যখন মন্ত্রীর ন্যায়সঙ্গত কার্য্যে মহারাজের স্বেচ্ছাচারিতা ও বিলাসোচিত কাৰ্য্য (২৩৪) বাধা প্রাপ্ত হইয়াছে, তখনই তাঁহার প্রতি মহারাজের বিদ্বেষ সঞ্জাত হইয়াছে। তখন ষড়যন্ত্রকারিদল গ্রীষ্ম সমাগমে উত্তেজিত কাল ভুজঙ্গের ন্যায় ফণাবিস্তার পূর্বক মন্ত্রীকে দংশন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।
বাবু উমাকান্তকে পদচ্যুত করিবার জন্য চিরন্তন পদ্ধতি বিশেষভাবে অবলম্বিত হইয়াছিল। এই সময় ষড়যন্ত্রকারিগণের যে ঘৃণিত ও ভীষণ উপায় দ্বারা আপনাদের দলবৃদ্ধি ও উমাকান্ত বাবুকে পদচ্যুত করিতে সক্ষম হইয়াছিল, তাহার গূঢ়তত্ব ইতিহাসে উল্লেখ করিতে আমরা ঘৃণা বোধ করি। মনুষ্য স্বার্থসাধনজন্য যে কতদূর নারকীয় ভাব অবলম্বন করিতে পারে ২/১ জন ষড়যন্ত্রকারী তাহার চরম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন।
উমাকান্ত বাবু যৎকালে রাজ্যের উন্নতি সাধন জন্য প্রাণপণ যত্ন ও পরিশ্রম করিতেছিলেন, মহারাজ সেই সময় তাঁহাকে ত্রিপুরারাজ্য হইতে বহিষ্কৃত করিবার জন্য কিরূপ কূটনীতি অবলম্বন করিয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, বক্ষ্যমান ঘটনা দ্বারা তাহা সামান্যভাবে প্রদর্শিত হইল। ষড়যন্ত্রকারিগণের পরামর্শে মহারাজ গবর্ণমেন্টকে জানাইলেন যে, “জরিপ ও জমাবন্দি” কার্য্যে মহারাজের পক্ষে উপযুক্ত তদ্বির চালাইবার জন্য চাকলে রোশনাবাদের একজন বিশেষ উপযুক্ত “সাহেব” মেনেজার নিযুক্ত করা প্রয়োজন। এই (২৩৫) রূপে কৌশলজাত বিস্তারপূর্বক মহারাজ বীরচন্দ্র সার চার্লস ইলিয়টের বিশেষ পরিচিত (পেনসিয়ান প্রাপ্ত সিবিলিয়ান) মেকমিন সাহেবকের চাকলে রোশনাবাদের মেনেজারের কাজে নিযুক্ত করিলেন।[২১] বাঙ্গালি চাকর উঠাইবার জন্য সাহেব চাকর নিযুক্ত করা হইল। মেকমিনের নিয়োগ পাক্কা হইলে মহারাজ বলিলেন, আর অধিক বেতনে দুইজন কর্মচারী রাখা নিষ্প্রয়োজন, যুবরাজ ও বড় ঠাকুর রাজ্য শাসন সংক্রান্ত কাৰ্য্য নির্বাহ করিবেন সুতরাং মন্ত্রী রাখা হইবে না। এই সকল হেতুবাদ প্রদর্শন পূর্বক মহারাজ বাবু উমাকন্তকে পদচ্যুত করিয়া অন্য ব্যক্তিকে চার্জ বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য অনুমতি করিলেন। উমাকান্ত বাবু সেই আদেশ প্রাপ্তমাত্র বাঙ্গালা গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করিলেন, এবং মহারাজকে জানাইলেন যে, “গবর্ণমেন্টের বিনানুমতিতে আমি কার্য্য পরিত্যাগ করিতে পারি না।” গবর্ণমেণ্ট উমাকান্ত বাবুকে জানাইলেন যে, তিনি পূর্বের ন্যায় স্বীয় কার্য্য নির্বাহ করেন। লেপ্টেনেন্ট গবর্নর কুমিল্লায় উপনীত হইয়া যথা কর্ত্তব্য অবধারণ (২৩৬) করিবেন। উমাকান্ত বাবু গবর্ণমেন্টের হুকুমের বলে “স্বাধীন ত্রিপুরা” শাসন করিতে লাগিলেন। “স্বাধীন ত্রিপুরেশ্বর” মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর বেগতিক দেখিয়া পুনর্বার উমাকান্ত বাবুকে লিখিলেন যে, দ্বিতীয় আদেশ সাপক্ষে আপনাকে মন্ত্রিত্ব কার্য্যে স্থির রাখা গেল।
১৩০২ ত্রিপুরাব্দের শ্রাবণ মাসের শেষভাগে লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর কুমিল্লায় উপস্থিত হন। মহারাজ, যুবরাজ, বড় ঠাকুর ও অন্যান্য কয়েকজন আত্মীয় এবং ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতৃবর্গকে লইয়া তৎপূর্বেই কুমিল্লায় উপনীত হইয়াছিলেন। গবর্ণমেন্টের অজ্ঞাতে উমাকান্ত বাবুকে পদচ্যুত করিয়া মহারাজ যে অন্যায় করিয়াছেন, তজ্জন্য তিনি লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তদনন্তর মহারাজ কর্তৃপক্ষগণ সমীপে বিবিধ প্রকার কাকুতি মিনতি করিলে লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর আদেশ করিলেন যে, উমাকান্ত বাবুকে উঠাইয়া লইবেন, কিন্তু চট্টগ্রামের কমিসনর কুমিল্লায় উপস্থিত হইলে মহারাজ স্বয়ং কিম্বা (তিনি অপারগ হইলে তাঁহার প্রতিনিধি স্বরূপ) যুবরাজ ও বড়ঠাকুর তথায় যাইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। কমিসনর সাহেব যখন যে বিষয় জ্ঞাত হইতে ইচ্ছা করিবেন, মহারাজ তাহাই তাঁহাকে জ্ঞাপন করিবেন। তদ্যতিরিক্ত মহারাজ গবর্ণমেন্ট সমীপে প্রতিবৎসর (রাজ্য শাসন সংক্রান্ত) “বার্ষিক নিকাশ”[২২] প্রদান করিবেন। (২৩৭)
এইরূপ বন্দোবস্ত দ্বারা আমাদের গবর্ণমেন্ট ও ত্রিপুরেশ্বর যে সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা বলা বাহুল্য। ভারতের কোন২ নরপতি কিম্বা পার্বত্য সরদার হইতে একপ্রকার অঙ্গীকার গ্রহণ করিবার জন্য ব্রিটিশ সিংহের চরণে সেই “স্বাধীনতা” স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া উপহার অর্পণ করিতেছেন, ইহা অবশ্যই গবর্ণমেন্টের সুখের বিষয়। আর মহারাজ বীরচন্দ্র অবশ্যই আগরতলার রাজান্তঃপুরে যাইয়া প্রকাশ করিতে পারিলেন, যে তিনি উমাকান্ত বাবুকে বরখাস্ত করিতে সক্ষম হইয়াছেন; ইহা অবশ্যই তাঁহার পক্ষে হর্ষের বিষয় বটে।
মহারাজ বীরচন্দ্র পূর্বোক্তরূপে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইলে, লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর এইরূপ আদেশ করিলেন যে, উমাকান্ত বাবুর কার্য্যকালের দ্বিতীয় বার্ষিক রিপোর্ট প্রস্তুত করিয়া তিনি মন্ত্রীত্বপদ ত্যাগ করিবেন। তদনুসারে তিনি তাঁহার দ্বিতীয় বার্ষিক রিপোর্ট দাখিল করত ১৩০২ ত্রিপুরাব্দের আশ্বিন মাসে অবসর গ্রহণ করেন। গবর্ণমেন্ট তাহার স্থায়ী কাৰ্য্য “ডিপুটী ম্যাজেস্ট্রেটিতে” তাঁহাকে আলিপুরে প্রেরণ করিলেন।[২৩] (২৩৮)
মহারাজ বীরচন্দ্র বাহাদুরের মনপ্রীতির আর একটি কারণ এই হইয়াছিল যে এক্ষণ তিনি পূর্বের ন্যায় “স্বাধীন” নরপতি হইলেন। আগরতলায় পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত হইবার পূর্বে “পাইওনিয়র” পত্রিকায় লিখিত হইয়াছিল যে: – “সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও শাসন হইতে উন্মুক্ততা যদি রাজন্যবর্গকে সুখ প্রদান করে এবং সমকক্ষদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব সংস্থাপনের কারণ হয়, তাহা হইলে পর্বত ত্রিপুরার রাজা নিশ্চয়ই ভারতবর্ষীয় নৃপতিমণ্ডলী মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক সৌভাগ্যশালী ও সর্বপ্রধান। যিনি তিন সহস্র বর্গমাইল রাজ্যের অধিপতি, যাঁহার আদেশই জীবন মরণের একমাত্র ব্যবস্থা, যিনি কাহাকেও কর দেন না, যিনি স্বেচ্ছানুরূপ সংগ্রাম ঘোষণা অথবা করনির্দ্ধারণ করিতে সক্ষম, যিনি ব্রিটিশ কর্মচারীর অনুশাসনের অধীন নহেন, যাঁহারা রাজ্য বিদেশীয়গণের দৃষ্টিগোচর হয় না, কিম্বা যাঁহার কার্য্যকলাপ সংবাদপত্র দ্বারা (২৩৯) সমালোচিত হয় না, একপ্রকার গর্বিত স্বাধীনতার উপর একমাত্র এই নরপতিই দণ্ডায়মান বটেন।[২৪]
সম্রাট স্বরূপে ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট ত্রিপুরার সামন্ত নরপতির যে সকল ক্ষমতা বিলোপ করা উচিত বোধ করিয়াছিলেন, তাহা সাধন পূর্বক আগরতলা হইতে পলিটিকেল এজেন্ট উঠাইয়া লইলেন। ত্রিপুরাজ্যের আভ্যন্তরিক অবস্থা বিশেষরূপে অবগত হইয়া, ত্রিপুরারাজ্যের পূর্বসীমা রেখা সুরক্ষিত করিয়া গবর্ণমেন্ট আগরতলায় পলিটিকেল এজেন্টের পদ এবলিস করিলেন, কিন্তু ত্রিপুরাপতি কিম্বা তাঁহার কর্মচারিবর্গের হস্ত হইতে উৎপীড়িত প্রজাবর্গকে রক্ষা করিবার জন্য জনৈক রাজকর্মচারী আগরতলা সর্বদা উপস্থিত রাখা গবর্ণমেন্টের নিতান্ত কর্তব্য ছিল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে সার রিচার্ড টেম্পল যৎকালে পলিটিকেল এজেন্ট উঠাইয়া আগরতলায় এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট সংস্থাপনের প্রস্তাব করেন, তৎকালে আসামের চিফ-কমিশনার সাহেব ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন।[২৫] গবর্ণমেন্ট দ্বারা পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ সুরক্ষিত (২৪০) হওয়ায় সেই অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে সত্য, প্রজা রক্ষার জন্য একজন এসিস্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট আগরতলা রাখার যে প্রয়োজন ছিল, সেই অবস্থার পরিবর্তন হয় নাই। মহারাজ কুমিল্লায় যাইয়া কমিসনার সাহেব নিকট স্বীয় কার্য্যকলাপের নিকাস দিতে অঙ্গীকার করিয়াছেন সত্য কিন্তু কোন ব্রিটিশ প্রজা তাহা দ্বারা উৎপীড়িত হইলে সেই প্ৰজা “একস অফিসিও” পলিটিকেল এজেন্ট নিকট কুমিল্লা নগরে উপস্থিত হইয়া কি সেই ঘটনা প্রমাণ করিতে সক্ষম হইবে? কখনই নহে। একপ্রকার ও অন্যান্য বহুবিধ কারণে আগরতলায় জনৈক এসিষ্টেন্ট পলিটিকেল এজেন্ট রাখা সম্রাট স্বরূপে ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের প্রধান কৰ্ত্তব্য বলিয়া ইতিহাস লিখক বিবেচনা করেন।
উমাকান্ত বাবু প্রস্থান করিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদল তাঁহাদের ইচ্ছানুসারে রাজ্যশাসনের বন্দোবস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রাজস্ব, বিচার, পুলিশ, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি বিভাগের ভার যুবরাজ বাহাদুরের হস্তে সমর্পণ করিয়া, ব্যয় সামরিক ও পলিটিকেল বিভাগ ইত্যাদি বড়ঠাকুর বাহাদুরের হস্তে রক্ষিত হইল (!!!) রাজা মুকুন্দরাম রায় সমস্ত কার্যের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হইলেন। যুবরাজ বাহাদুরের হস্তে যে সমস্ত বিভাগের কার্য্য অর্পিত হইল, সেই সকল বিভাগে যে সকল কর্মচারী বহুকাল হইতে কাৰ্য্য করিয়া অভিজ্ঞতা লাভ (২৪১) করত বিচক্ষণ মন্ত্রিগণ দ্বারা প্রশংসিত হইয়াছিলেন; এবপ্রকার প্রায় ৩০/৩২ জনকে বিদায় করত তাঁহাদের ষড়যন্ত্রকারিগণের আত্মীয় ও অনুগত ব্যক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ করা হইল। ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতা কোন কার্য্যের দায়িত্ব স্পর্শ করিলেন না। অথচ নিঃশঙ্ক ও নিষ্কন্টক হইয়া স্বীয় আধিপত্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
প্রায় তিন বৎসর হইল উমাকান্ত বাবু কার্য্য পরিত্যাগ করিয়াছেন। এই কাল মধ্যে যে, রাজ্যের কোনরূপ উন্নতি কিম্বা মঙ্গল সাধিত হইয়াছে তাহা দৃষ্ট হয় না! বরং এই কাল মধ্যে ত্রিপুরারাজ্যের প্রজা ও ত্রিপুরাবাসী ব্রিটিস প্রজা যে উৎপীড়িত হইয়াছে, তাহার ভুরি ভুরি প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। মহারাজ তাহার প্রিয়পাত্রবর্গকে অল্প জমায় তালুক ও ইজারা প্রদান করত রাজ্যের আয় খর্ব করিয়াছেন।[২৬] পক্ষান্তরে দরিদ্র প্রজাবৃন্দের রক্ত শোষণ (২৪২) করত রাজস্ব ও শুল্ক বৃদ্ধির চেষ্টা হইতেছে। বিচার বিভাগে বিচারের নাম করিয়া কিরূপ অবিচার হইতেছে, ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বপ্রধান উকীল বাবু নবকুমার সেন এবং মণিপুরী ও অন্যান্য প্রজাবর্গের গবর্ণমেন্ট ও পলিটিকেল এজেন্ট সমীপে দাখিলি আবেদনপত্র তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ইহা নিতান্ত আশ্চর্য্যের বিষয় যে, যুবরাজ বাহাদুরের হস্তে যে সমস্ত বিভাগের কার্যভার অর্পিত হইয়াছে, সেই সকল বিভাগের কার্য্যকলাপের বিরুদ্ধে অধিকাংশ দরখাস্ত উপস্থিত হইয়াছে। যে যুবরাজ বাহাদুর, মহারাজ বাহাদুরের অনুপস্থিতিতে প্রায় ৪ মাস কাল রাজ্যশাসন করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন; যিনি কেবল বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সেই বিভাগের প্রচুর পরিমাণে উন্নতি সাধন করত[২৭] (২৪৩) রাজ্যের অন্যান্য মঙ্গল ও উন্নতিজনক কার্য্যের জন্য সর্বদা যত্ন করিয়াছেন এবং যাঁহার গুণরাশি অল্পকাল মধ্যে জনসাধারণের ভক্তি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। সেই যুবরাজ বাহাদুর এক্ষণ কেন কলঙ্কের ভাগী হইতেছেন, প্রকৃত পক্ষে বোধ হয়, যুবরাজ বাহাদুর স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালন করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম। উপযুক্ত ও ক্ষমতাশালী মন্ত্রীকে পদচ্যুত করিয়া রাজপুত্রগণের হস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করা একটি “প্রহসন” বা “ছায়াবাজী” মাত্র। ইহা দ্বারা ষড়যন্ত্রকারিদলের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ হইয়াছে। যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া অদৃষ্টরূপে হস্তসঞ্চালন করত তাঁহারা অদ্ভুত নাটকের অপূর্ব অভিনয় করিতেছেন। মহারাজ ষড়যন্ত্রকারিদলের ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করত সুখে অধঃপাতে যাইতেছেন, পুত্র তাহাকে কিরূপে নিবারণ করিবে। (২৪৪)
মহারাজ বীরচন্দ্রের বয়ঃক্রম কিঞ্চিদূন যষ্টিবৎসর হইবে। ঈশ্বরী বা মহারাণী উপাধি প্রাপ্তা তাঁহার তিন পত্নী। তন্মধ্যে যুবরাজ বাহাদুরের জননী মহারাণী রাজেশ্বরী মহাদেবী ও বড়ঠাকুরের মাতা মহারাণী ভানুমতি মহাদেবী পরলোক গমন করিয়াছেন। মহারাণী মনোমোহিনী মহাদেবী এক্ষণ জীবিত আছেন। তদ্ব্যতীত উপাধি অপ্রাপ্তা তাঁহার আর যে সকল পত্নী আছেন, আমরা তাহার সংখ্যা লিখিতে অক্ষম। আমাদের জ্ঞাত মতে মহারাজের ৯টি পুত্র ও ১৬টি কন্যা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের আকৃতি নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব, বর্ণ বিশুদ্ধ গৌর, তিনি সর্বাঙ্গ সুন্দর, মুখশ্রী অনেকটা বাঙ্গালির ন্যায়, চক্ষু সুন্দর, নাসিকা উন্নত।
মহারাজ বাঙ্গালা ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন, তিনি একজন সুকবি। তৎপ্রণীত দুইখানা কবিতা পুস্তক আমরা দর্শন করিয়াছি। উভয় গ্রন্থই গীতিকাব্য। তাঁহার গীতির অনেকগুলি “বর্জ্জি” বুলিতে রচিত, সেগুলি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিগণের, অনুকরণে লিখিত; অনুকরণ হইলেও তাহাদের ভাব সরল, মধুর ও মর্মস্পর্শী। তাঁহার সমস্ত গীতি কবিতাই প্রেমের কাকলীপূর্ণ ও মধ্যে মধ্যে দর্শনাত্মক ভাবের ছায়া পাতে সমুজ্জল হইয়াছে। দুঃখের বিষয় এই যে, এই সকল সুন্দর (২৪৫) কবিতা কুসুমের সৌরভ আগরতলার গণ্ডি অতিক্রম করিয়া কদাচিত কাহাকেও আকুলিত করিয়া থাকে। সেগুলি প্রকাশ করিতে মহারাজ নিতান্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু প্রকাশিত হইলে তিনি বঙ্গীয় কবি সমাজে উচ্চ আসন প্রাপ্ত হইতেন সন্দেহ নাই।
মহারাজ উর্দু ও মণিপুরী ভাষায় মাতৃ ভাষার ন্যায় আলাপ করিতে পারেন। ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা সামান্য রূপ অবগত আছেন। তিনি একজন সুনিপুণ চিত্রকর ও ফটোগ্রাফার; সঙ্গীত শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত। তিনি পানাদি দোষ বৰ্জ্জিত, বুদ্ধিমান, কূটনীতি পরায়ণ ও অত্যন্ত বাকপটু। তাঁহার বাক্যন্যাস শক্তি এইরূপ প্রবল যে তৎপ্রতি ভীষণ বিদ্বেষ ভাবাপন্ন কোন ব্যক্তি ক্ষণকাল তাঁহার সহিত আলাপ করিলে, সেই ভাব পরিত্যাগ না করিয়া থাকিতে পারেন না। তিনি স্বীয় কার্য্য কলাপের প্রতিবাদ সহ্য করিতে অক্ষম হইলেও তাঁহার ক্রোধ সংবরণ শক্তি এত অসাধারণ যে, তাহা সহজে কেহ উপলব্ধি করিতে পারেন না। তাহার হৃদয় দৌর্বল্যই বারংবার মন্ত্রী পরিবর্তন ও ষড়যন্ত্রকারিদলের অন্যায় প্রাধান্যের কারণ। মহারাজ বীরচন্দ্রের সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের যথেষ্ট পরিবর্ত্তন ও কোন কোন বিষয়ে উন্নতি সংসাধিত হইয়াছে। যদি মহারাজের যত্নে এই সকল উন্নতি ও পরিবর্ত্তন সাধিত হইত, তাহা (২৪৬) হইলে অদ্য আমরা তাঁহাকে ইদানীন্তন ভারতীয় নরপতি মণ্ডলীর মুকুটমণি বলিয়া ইতিহাসে বর্ণনা করিতাম। প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিস গবর্ণমেন্টের যত্নে ও কোন কোন মন্ত্রী বা প্রধান কর্মচারীর চেষ্টায় এই সকল পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হইয়াছে। অনেক স্থলেই মহারাজের কার্য্যকলাপ তাহার প্রতিরোধক হইয়াছে।[২৮] প্রজার নিঃশঙ্কভাব ও রাজার প্রতি প্রজার ঐকান্তিক বিশ্বাসই রাজ্যের সর্বপ্রকার উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূলীভূত কারণ। কিন্তু ত্রিপুরারাজ্যে তাঁহার সম্পূর্ণ অভাব উপস্থিত হইয়াছে।[২৯]
মহারাজের জ্যেষ্ঠপুত্র, ত্রিপুরার ভাবি নরপতি যুবরাজ রাধাকিশোর দেববর্মণ বাহাদুরের বয়ঃক্রম কিঞ্চিদূন চত্বারিংশ বৎসর। তিনি শান্ত, সুশীল, দয়ালু ও (২৪৭) বিদ্যানুরাগী।[৩০] প্রকৃতি তাঁহাকে গুণরাশিতে মণ্ডিত করিয়াছে। স্বর্গীয় মহারাজ ঈশানচন্দ্রের একমাত্র জীবিত পুত্র কুমার নবদ্বীপচন্দ্রকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া কুমার রাধাকিশোরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবার কালে, মহারাজ স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি যে স্নেহ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, ক্রমেই সেই স্নেহের হ্রাস দেখা যাইতেছে। মহারাজ প্রথমত তাঁহার প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতী দেবীর গর্ভজাত পুত্র কুমার সমরেন্দ্র ও তাঁহার অনুজের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ ঢালিয়া দিয়াছেন। তদনন্তর তাহা দুই শাখায় বিভক্ত হইয়া তৃতীয় মহিষী মনোমোহিনী দেবীর গর্ভজাত পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেও অভিষিক্ত করিয়াছে। যে পুত্রের মুখচন্দ্র দর্শন করিয়া মহারাজ পুনাম নরক হইতে ত্রাণ প্রাপ্ত হইয়াছেন, যে পুত্র তাঁহার পারলৌকিক কার্য্যের একমাত্র অধিকারী, সেই পুত্রের প্রতি মহারাজের অবজ্ঞা নিতান্ত বিস্ময়জনক। কুমার সমরেন্দ্রের বিদেশভ্রমণ জন্য মহারাজ (২৪৮) বারংবার অকাতরে অর্থ ব্যয় করিয়াছেন। কিন্তু যুবরাজের মানসিক উন্নতি সাধন জন্য বিদেশ ভ্রমণার্থে তাঁহাকে প্রেরণ করিবার কারণ যখনই ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ অনুরোধ করিয়াছেন, তখনই মহারাজ স্বীয় দৈন্যদশা প্রকাশ করিতে কিছুমাত্র লজ্জা বোধ করেন নাই।[৩১] আমরা দিব্যচক্ষে দর্শন করিতেছি, যে ইহার অভ্যন্তরে কূটনীতির উপাসক মহারাজ বাহাদুরের একটি কূট অভিসন্ধি লুক্কায়িত রহিয়াছে। ইতিহাস লেখক তাহার যবনিকা উত্তোলন করিতে ইচ্ছা করেন না। কিন্তু (২৪৯) আমরা ত্রিপুরারাজ্যের “বিজয় বসন্তের” অভিনয় দর্শন না করিলেই সুখী হইব।
বীরবংশ প্রসূত যুন পণ্ডিত জেরুম বলিয়াছেন “সত্য বলিবে, যদি সত্যবাক্য প্রকাশ দ্বারা অপ্রীতির কারণ উদ্ভব হয়, হউক, তথাপি সত্য গোপন করিবে না”[৩২] আমরা পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মতানুসরণ করিয়া বর্ত্তমান রাজবংশের ইতিহাস শেষ করিলাম। কিন্তু মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর জীবিত নরপতি বলিয়া তৎসম্বন্ধে কতগুলি বিষয় আপাতত প্রকাশ করিতে ক্ষান্ত রহিলাম। উপযুক্ত সময়ে পুনর্বার লেখনী ধারণ করিব। কিম্বা ভবিষ্যৎ ইতিহাস লেখক তাহা সম্পাদন করিবেন। (২৫০)
.
টীকা
১. এই দীনবন্ধু কিছুকাল গোপনে কুমার নবদ্বীপের পক্ষে ছিলেন। পুনর্বার মহারাজ বীরচন্দ্রের পক্ষ অবলম্বন করত নবদ্বীপের পর মর্মান্তিক শত্রুর ন্যায়, তাহার প্রতিকুলে সাক্ষ্য প্রদান পূর্বক বীরচন্দ্রকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন।
২. মহারাণী ভানুমতি দেবী যে, স্বীয় স্বামীর উপর কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত আধিপত্য স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা বেলবেড়িযার নামক রাজ প্রাসাদেও ঘোষিত হইয়াছিল।
Bengal Administration Report. 1882-83.
৩. ষোড়শ অধ্যায়ের টীকা পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
৪. Maintainance (sic)
৫. Respondent should hold the Zemindary subject to the usual charge for maintionance of members of the family, and other establised dis- bursment.
Extract from the Decision of Sudar Dewan Adowlut, Dated 24th. March 1809. Ramganga Deo Appilient (sic) Vs. Durgamonee Jubraj. Respdt.
৬. ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের রিপোর্টে ঠাকুর নীলকৃষ্ণ, শম্ভুচন্দ্র, রামকানু, ভগবানচন্দ্র, মধুচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্র, প্রভৃতির নাম আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি।
৭. In consequence of a movement for raising the statue of certain per- sons, and amongst other the Maharaja, as Hindus, which was set on foot about the end of the year 1880-81, the Maharaja lost much of respect of his People, and was also put to considerable expense. Bengal Administration Report 1882-83.
৮. এই সময় কৈলাসহরের সুপারিনটেণ্ডেন্ট বিক্রমপুর নিবাসী দুর্গাপ্রসাদ গুপ্ত আগরতলার দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হন।
৯. All officers who did not Join in the movement were removed from the Maharaja’s service and their places filled by those who support it.
Bengal Administration Report 1883-84.
১০. তৈমুর লং। লেং (লেংরা) অর্থ খোড়া।
১১. যেরূপ একবার লিখিয়া দিয়া মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য ফিলনি মিউর কোম্পানি হইতে নজরানার টাকা গ্রহণ করেন, কোন বিবেচক ব্যক্তি এইরূপ একবার লিখিয়া দিবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করিতে পারি না। পত্নী বিয়োগ শোকে মহারাজ নিতান্ত অধীর ছিলেন সত্য, কিন্তু তাহার অমাত্যগণ তৎকালে কি করিতেছিলেন, অসাধারণ নীতিশাস্ত্রবিদ বিষ্ণু শর্ম্মা এবপ্রকার মন্ত্রিবর্গকে রাজার প্রকৃত শত্রু বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
১২. The arrangement worked well.
Bengal Administration Report 1882-83.
১৩. উদয়পুর বিভাগের শাসন কর্তৃত্বে নিযুক্ত থাকা কালে তাঁহার যত্নে “ডাইনবলি” নামক লোমহর্ষণ নরহত্যা কাণ্ড রহিত হয়। ঠাকুর ধনঞ্জয়ের এই কীৰ্ত্তি ইতিহাস লেখক অনন্তকাল ঘোষণা করিবেন। পাঞ্চিহাস রায় নামক জনৈক রিয়াং সরদারের বাড়িতে (গ্রামে) কপিরায় নামক এক ব্যক্তি বাস করিত, সাধারণত তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা চিকিৎসা করিয়া কপিরায় জীবিকা নির্বাহ করিত। প্রাচীন সংস্কার অনুসারে সেই গ্রামের কালাহা রিয়াং প্রভৃতি কতকগুলি লোক গরিব কপিরায়কে ডাইন বলিয়া স্থির করিল। তাহারা কপিরায়ের স্ত্রী খিচিমাকে বলিল, “তোমার স্বামী ডাইন হইয়াছে, অতএব তাহাকে বধ করা উচিত।” খিচিমা বলিল, “সে ডাইন হইয়া থাকিলে তাহাকে বধ করিতে পার।” তদনন্তর ১২৯১ ত্রিপুরাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে একদা দিবা দুই প্রহরের সময় পর্বত মধ্যস্থিত নিবিড় অরণ্যে কালীপূজা উপলক্ষ্যে হতভাগ্য কপিরায়কে বলিদান করা হয়। প্রায় ১০ মাস অন্তে ঠাকুর ধনঞ্জয় এই লোমহর্ষণ ঘটনার সংবাদ অবগত হন। তদনন্তর তিনি বিশেষ দক্ষতার সহিত ইহার তথ্য নির্দ্ধারণ পূর্বক কালাহা রিয়াং প্রভৃতি ৯ জন, —“ডাইন বলি” নামক নরহত্যা অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারার্থে সদরে প্রেরণ করেন, সেসনের বিচারে তাহাদের কারাদণ্ড হইয়াছিল।
১৪. তৎকালে সার রিভার্স টমসন বলিয়াছিলেন :-
If the Maharaja of Hill Tipperah-a State of ancient and distinguished lineage-cannot see his way to an effective reduction of the personal and other expenses at the capital, the Lieutenant Governor antici- pates very little from the exertions of any minister, however ener- getic and earnest in the way of real reform.
Calcutta Gazette. 22nd September 1886.
১৫. The Maharaja has, in accordance with advice given to him, prohib- ited by a duly promulgated order the practice of ‘suttee’ which for- merly was permitted.
Bengal Administration Report 1885-89.
১৬. পশ্চাৎ রাজপক্ষ হইতে এরূপ প্রকাশ করা হইয়াছিল যে, মহারাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পলিটিকেল এজেন্ট এরূপ লেখাইয়া লইয়াছিলেন।
১৭. নিম্নলিখিত ৫টী বিষয়ে মহারাজের মঞ্জুরি গ্রহণ করিতে হইবে। ১-অপরাধীর প্রাণদণ্ড, ২- মকররি জমায় কোন তালুক প্রদান, ৩-২০০ টাকার উর্দ্ধ কোন কর্ম্মচারী নিয়োগ ও অবসর, ৪-৫০ টাকার উর্দ্ধ বৃত্তিপ্রাপ্ত ঠাকুর লোকদিগের বৃত্তিবহার ও বাজেয়াপ্ত, ৪-রাজপরিবার সংক্রান্ত বিষয়। তৃতীয় বিষয়টি বোধহয়, কেবল ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতৃবর্গকে রক্ষা করিবার জন্য লিখিত হইয়াছিল। বাবু দীননাথ সেনের নিয়োগ কালেও এইরূপ ১০০ টাকার উর্দ্ধ বেতনের কর্মচারি বহাল ও বাজেয়াপ্তের অধিকার মহারাজ স্বহস্তে রাখিয়াছিলেন। তদৃষ্টে তদানীন্তন লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর বাহাদুরও নানা প্রকার আশঙ্কা করিয়াছিলেন।
Calcutta Gazette. 22nd September 1886.
১৮. ২৪৫ জন পদাতিক সৈন্য, ৫ জন বিগলবাদক, অবশিষ্ট হুদ্দাদায় (অফিসার)। পুলিশ বিভাগে ২৬৪ জন সৈন্য ও হুদ্দাদায় ছিল। সুতরাং সামরিক ও পুলিশ বিভাগে সর্বশুদ্ধ ৫৫৮ জন লোক দেখা যাইতেছে।
১৯. Justice is said to be fairly administered when the cases are between subjects and subjects; but when the state or any one having influ- ence in the Durbar, is one of the parties the presiding officers of the court are said occasionally to appear to lose nerve.
Bengal Administration Report 1888-89.
২০. উমাকান্তবাবু যৎকালে কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই সময় ষড়যন্ত্রকারিদলের নেতা রাজকার্য্য হইতে কিরূপে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই বৃত্তান্ত উমাকান্তবাবুর প্রথম বার্ষিক রিপোর্টে দ্রষ্টব্য। Administration of the state of Tipperah 1300 T. E. page 9.
২১. Mr. Mc’ Minn has been appointnted to have charge of Zemindaris and to superintendent to the survey of the Maharaja’s behalf. Calcutta Gazette. 4th October, 1893.
২২. Annual Administration Report .
২৩. In the hill Tipperah the Minister Rai Umakanta Das Bahadoor was permitted to retire during the year, he had thoroughly reorganized the finance of the State and relieved it of its embarrassments. His attempts, however to bring the administration of the State into accord with advanced ideas led to complications, and his positions became untenable.
Calcutta Gazette. 4th October, 1893.
২৪. Pioneer, 4th May 1870. (See also Maekenzie’s North-East Frontier of Bengal, page 561)
২৫. Maekenzie’s North-East Frontier of Bengal, page 320.
২৬. মহারাজ কাশীচন্দ্র মাণিক্য স্বীয় মহিষী কুটিলাক্ষী দেবীকে চাকলে রোশনাবাদ মধ্যে একটি তালুক প্রদান করেন। মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মানিক্য তাহা বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য দেওয়ানী আদালতে নালিশ করেন। সেই মোকদ্দমায় সদর দেওয়ানী আদালতের বিচারপতিগণ ১৮৩৭ খ্রিঃ অঃ ৪ মে অবধারণ করিয়াছেন যে, কোন রাজা এই জমিদারির অন্তর্গত কোন ভূমি পরিবারস্থ কোন ব্যক্তিকে তালুক দিতে পারিবেন না। At present it is deemed proper to establish this custom that no Raja has the power to grant talooks out of the lands of the said Zemindary এই সূত্র অবলম্বন পূর্বক মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য স্বীয় বৈমাত্রেয় ভগিনী, ভ্রাতৃজায়া ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের (রাজ্য ও জমিদারিস্থিত) তালুকগুলি বাজেয়াপ্ত করিয়াছেন, আবার সেই মহারাজ বাহাদুরই কল্পতরুর ন্যায় স্বীয় স্ত্রী, পুত্র, শালা সম্বন্ধি প্রভৃতিকে তালুক প্ৰদান করত অসাধারণ দাতৃত্বগুণের পরিচয় প্রদান করিয়াছেন।
২৭. The Jubraj, as presiding officer of the chief Court of Justice, is said to have done much to improve the condition of the subordinate court and of the jails.
Bengal Administration Report 1888-89.
The chief Judge of the khash Appelate court is the Jubraj Bajadoor. Who asusal took an intelligent interest in the general Administration of Justice.
Report on the Administration of the State of Tipperah 1300 T. E.
২৮. This very unsatisfactory state of affairs is due almost entirely to the want of firmness on the part of Maharaja.
Calcutta Gazette. 22nd September 1886.
২৯. Sir River Thompson fears that that, sense of absolute security, which is essential for the growth of a people’s welfare and prosperity, does not exist in Hill Tipprah.
Calcutta Gazette. 22nd September 1886.
৩০. The hope that the excellent example of the Joobraj would induce many of the Thakurs to apply themselves to study has hot been fulfilled.
৩১. It is to be regretted that the education even of the Jubraj, the heir to the Guddi, has been neglected. His younger brother the Barathakur, visited Calcutta at the time of the international exhibition, and is said to have profitted much by what he saw and heard. The Jubaraj has, however, never been allowed an opportunity of leaving Agurtola the Maharaja has frecuently been advised to let his eldest son see something of the world, but as in every thing else pecuniary embarrassments are pleaded as an obstacle to the measure. In view of the liberty conceded to the younger brother, such explanation is scarcely Intelligible.
Bengal Administration Report 1883-84.
৩২. If an offence come out of the truth, better is it that offence come, than the truth be conceated. (Jerome).