পঞ্চদশ অধ্যায়
কাশীচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর যুবরাজ কৃষ্ণকিশোর ১২৩৯ ত্রিপুরাব্দর ২৯ পৌষ রাজ্যভার গ্রহণ করেন। গবর্ণমেন্ট হইতে খেলাত প্রাপ্ত হইয়া ১২৪০ ত্রিপুরাব্দের (১৬১) বৈশাখ মাসে (১৮৩০ খ্রিঃ ১০ মে) তিনি সিংহাসন আরোহণ করেন। ত্রিপুরায় তদানীন্তন জজ মেজেস্ট্রেট টমসন সাহেব[১] গবর্ণমেন্টের অনুমত্যনুসারে আগরতলায় উপনীত হইয়া মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যকে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিক প্রদত্ত সনন্দ[২] ও খেলাত প্রদান করেন। মহারাজ তৎকালে ৬৩০ আনা মূল্যের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা গবর্ণমেন্টতে “নজর” প্রদান করিয়াছিলেন।[৩] মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর তৎকালে আড়াই বৎসর বয়স্ক স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার ঈশানচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন।
কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য আসামের রাজকন্যা রত্নমালা এবং মণিপুরের রাজা মারজিতের কন্যা চন্দ্রকলা, অখিলেশ্বরী ও (১৬২) বিধুকলাকে ক্রমে ক্রমে বিবাহ করেন। তদ্ভিন্ন মহারাজ কৃষ্ণকিশোরের ত্রিপুরা ও মণিপুরী জাতীয় অনেকগুলি পত্নী ও উপপত্নী ছিল। পরম ভাগ্যবতী রাণী সুদক্ষিণার গর্ভে যুবরাজ ঈশানচন্দ্র, এবং কুমার উপেন্দ্রচন্দ্র ও বীরচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন। অখিলেশ্বরীর গর্ভে কুমার নীলকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করেন। তদ্ব্যতীত চক্রধবজ, মাধবচন্দ্র, যাদবচন্দ্র, সুরেশ কৃষ্ণ ও শিবচন্দ্র নামে তাহার আরও ৫টি পুত্র এবং ১৫টি কন্যা ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল।
অল্পকাল মধ্যেই বৃদ্ধ উজির দুর্গামণির সহিত মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য কলহ করিতে উদ্যত হইলেন। অপব্যয়ী নরপতি সর্বদাই বৃদ্ধ উজিরকে টাকার জন্য উৎপীড়ন করিতেন। পুত্রশোকগ্রস্ত বৃদ্ধ উজির বিবেচনা করিলেন যে, পুরুষানুক্রমের সঞ্চিত সমস্ত অর্থদান করিয়াও এই অপব্যয়ী নরপতিকে সন্তুষ্ট করিতে পারিব না। এইরূপ বিবেচনা করিয়া তিনি তাঁহার সমস্ত ধন সম্পত্তি গোপনে স্বীয় তহসীল কাছারী শিঙ্গারবিল নামক স্থানে প্রেরণ করেন। অবশেষে ১২৪৩ ত্রিপুরাব্দে একদা রজনী যোগে পলায়ন পূর্বক আগরতলা পরিত্যাগ করিয়া সেই শিঙ্গারবিলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের কমিসনর সাহেব পার্বত্য ত্রিপুরা ব্রিটিস রাজ্যের একাংশ বলিয়া তাহা খাসদখল করিবার (১৬৩) জন্য গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করেন। মহারাজ ও তাঁহার কলিকাতাস্থ এজেন্ট বিগনেল সাহেব তাহার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। লর্ড অকলেণ্ড বাহাদুর কমিসনারের রিপোর্ট ও তাহার উত্তর এবং তৎসঙ্গীয় অন্যান্য কাগজ পর্যালোচনা করিয়া পার্বত্য ত্রিপুরা, স্বাধীন রাজ্য অবধারণ পূর্বক কমিসনর সাহেবের প্রার্থনা অগ্রাহ্য করেন।[৪]
মহারাজ কৃষ্ণকিশোর পারস্য ভাষায় ব্যুৎপন্ন ছিলেন; শস্ত্র বিদ্যা ও মল্ল যুদ্ধে সুনিপুণ ছিলেন, তন্ত্র শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল।
মহারাজ কৃষ্ণকিশোর ঘোর ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও বিলাসী নরপতি ছিলেন। তিনি তাঁহার পাচিকা (মণিপুরী ব্রাহ্মণ কন্যা) পূর্ণকলার প্রেমে মুগ্ধ হইয়া বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।
মহারাজ কৃষ্ণকিশোরের জীবনী ব্যাঘ্র শিকার, ব্যাঘ্রের বিবাহ, কোঁড়া শিকার প্রভৃতি ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। ইতিহাস লেখকের উল্লেখ যোগ্য বিশেষ কোন ঘটনা তাহার জীবনে দেখা যায় না। কুকিদিগের অত্যাচার ও জমিদারি (১৬৪) সংক্রান্ত ঘটনাবলী যথাস্থানে বর্ণিত হইবে। শিকারের সুবিধার জন্য বহু অর্থব্যয় করিয়া তিনি আগারতলার নিকটবর্ত্তী এক জলাভুতিতে “নতুন হাবেলী” নামক নগর নির্মাণ পূর্বক সেই স্থানে রাজপাঠ স্থাপন করেন। কৃষ্ণকিশোর তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র উপেচন্দ্রকে বড়ঠাকুরী পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।
অন্তঃপুর পত্নী উপপত্নীতে পূর্ণ করিয়া, চাকলে রোশনাবাদ ঋণজালে বদ্ধ করিয়া ১২৫৯ ত্রিপুরাব্দের ২রা বৈশাখ রজনী যোগে, বজ্রাঘাতে কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য প্ৰাণত্যাগ করেন।
পিতার মৃত্যুর পর যুবরাজ ঈশানচন্দ্র রাজ্যভার গ্রহণ করেন। গবর্ণমেন্ট হইতে খেলাত প্রাপ্ত হইয়া ১২৫৯ ত্রিপুরাব্দের ২০মাঘে (১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি) মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য সিংহাসন আরোহন করেন। মহারাজ ঈশানচন্দ্রের অভিষেক কালে গর্ভমেন্ট ১২৫ টি স্বর্ণ মুদ্রা”নজর” প্রদান করিবার জন্য আদেশ করেন। অনেক তর্ক বিতর্কের পর ১১১টি স্বর্ণমুদ্রা নজর গৃহীত হয়। প্রথমত ত্রিপুরেশ্বরগণ গবর্ণমেন্টের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিবার মানসে নজর স্বরূপ কয়টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রদান করিতেন। মহারাজ কৃষ্ণকিশোরের অভিষেক কালেও ৩৬০ টাকা মূল্যের কয়েকটি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রদত্ত হইয়াছিল। তাহার ১৯ বৎসর অন্তে সেই ৬৩০ টাকা ১১১ থান মোহরে পরিণত (১৬৫) হয়। ইহার ২০ বৎসর অন্তে কিরূপ হইয়াছে তাহা পশ্চাৎ প্রদর্শিত হইবে। অভিষেককালে মহারাজ ঈশানচন্দ্র তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা উপেন্দ্রচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে নিয়োগ করিয়াছিলেন।
রাজাসনে উপবেশন করিয়া মহারাজ ঈশানচন্দ্রকে ১১ লক্ষ টাকার ঋণভার মস্তকে বহন করিতে হইল। তিনি তাঁহার পিতামহী মহারাণী চন্দ্রতারা দেবীর জনৈক দাসীর গর্ভজাত বলরাম “হাজারিকে” দেওয়ানী পদে নিযুক্ত করিয়া তাহার হস্তে রাজ্য ও জমিদারির শাসনভার অর্পণ করেন। তাঁহার যত্নে মহারাজ ঋণদায় হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিবেন এইরূপ বিবেচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু বলরাম ও তাহার ভ্রাতা শ্রীদামের দুর্ব্যবহারে ত্রিপুরাবাসীগণ অল্পকাল মধ্যে বিরক্ত হইয়া উঠিল। সর্বসাধারণের পরামর্শানুসারে পরীক্ষিৎ ও কীৰ্ত্তি নামক দুইজন দুৰ্দ্দান্ত পর্বতবাসি ত্রিপুরা সরদার কতকগুলি ত্রিপুরা ও কুকি সংগ্রহ করিযা ১২৫৯ ত্রিপুরাব্দের ১২ই চৈত্র গভীর রজনীতে বলরামের বাটী আক্রমণ করে। বলরাম পলায়ন পূর্বক প্রাণরক্ষা করেন; শ্রীদাম কীর্তির হস্তে নিহত হন। মহারাজ ঈশানচন্দ্র বলরামের শত্রুগণকে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্র কীর্তির প্রাণবধ করিলেন। কোন অকথ্য কারণে বলরামের প্রতি যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্রের কিঞ্চিৎ (১৬৬) অতিরিক্ত অনুগ্রহ ছিল। সেই অনুগ্রহের বলে বলরাম কোন অন্যায় কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে মহারাজ ঈশানচন্দ্র তাঁহার বাধা জন্মাইতেন। দুষ্ট বলরাম এইজন্য মহারাজ ঈশানচন্দ্রের প্রতি জাতক্রোধ হইয়া, তিনি প্রিয় সুহৃদ রামমাণিক্য বর্মণ, কাপ্তান সর্দ্দার খাঁ ও ছোবান খাঁ প্রভৃতি কয়েকজন সৈনিকের সহিত দলবদ্ধ হইয়া, গোপনে মহারাজ ঈশানচন্দ্রকে হত্যা করিয়া, যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্রকে সিংহাসনে স্থাপন করিতে পরামর্শ করেন। মহারাজ জনৈক বিশ্বস্ত অনুচর মুখে এই সংবাদ অবগত হইয়া, কাৰ্য্য কালে চক্রান্তকারীদিগকে ধৃত করণার্থে স্থির প্রতিজ্ঞ হইলেন। যথা সময় কাপ্তান সরদার খাঁ মহারাজকে হত্যা করিবার জন্য অগ্রসর হইলে মহারাজ তাহাকে ধৃত করিয়া রাজ্য হইতে নির্বাসিত করিলেন। তদনন্তর বলরাম ও রামমাণিক্যকে এই ষড়যন্ত্রদলের নেতা জানিয়া তাহাদিগকেও নির্বাসিত করেন। তৎকালে ব্রজমোহন ঠাকুরের হস্তে রাজ্য ও জমিদারির শাসনভার সমর্পিত হইল।
কিছুকাল ত্রিপুরাবাসীকে জ্বালাতন করিয়া প্রজাপীড়ক ও অপরিমিত মদ্যপায়ী যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্র ১২৬১ ত্রিপুরাব্দের বৈশাখ মাসে পরলোক গমন করেন।
মহারাজ ঈশানচন্দ্রের প্রথম পত্নী রাজলক্ষ্মী দেবীর গর্ভে কোন সন্তান জন্মে নাই। দ্বিতীয় পত্নী মুক্তাবলী দেবীর গর্ভে (১৬৭) ১২৬১ ত্রিপুরাব্দের পৌষমাসে জ্যেষ্ঠ কুমার ব্রজেন্দ্রচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার চতুর্থ পত্নী জাতীশ্বরী দেবীর গর্ভে ১২৬৩ ত্রিপুরাব্দের ১৩ মাঘ দ্বিতীয় কুমার নবদ্বীপচন্দ্র ভূমিষ্ঠ হন। তদনন্তর তৃতীয় পত্নী চন্দ্রেশ্বরী দেবীর গর্ভে এক কন্যা ও জাতীশ্বরী দেবীর গর্ভে তৃতীয় কুমার রোহিনীচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন।
ব্রজমোহন ঠাকুর ঋণ পরিশোধ করিতে না পারিয়া পদ পদে অপমানিত হইতে লাগিলে। এক এক সময় চাকলে রোশনাবাদ গবর্ণমেন্টের রাজস্বের জন্য বিক্রীত হইবার উপক্রম হইতে লাগিল। এই সময় কলিকাতা নিবাসী খ্যাতনামা বাবু (পশ্চাৎ রাজা) দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় আগরতলায় উপস্থিত হইয়া অল্পকাল মধ্যে মহারাজকে অঋণী করিবেন প্রকাশ করিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রার্থনা করিলেন। মহারাজ তাঁহাকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করিতে উদ্যত হইলে অন্যান্য অমাত্যবর্গের পরমার্শে মহারাজের গুরু বিপিনবিহ- ারী গোস্বামী রাজসমক্ষে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে নিযুক্ত করিতে নিষেধ করিলেন। গুরুর প্রতি মহারাজের অচলা ভক্তি ছিল। তিনি কদচ গুরুর আজ্ঞা অবহেলন করিতেন না। এই জন্য দক্ষিণারঞ্জনের নিয়োগপত্র খণ্ড খণ্ড করিয়া করযোড়ে বলিলেন “প্রভো! আমি চাকলে রোশনাবাদ রক্ষার উপায় দেখিতেছি না। (১৬৮) নিরুপায় হইয়া আমার রাজ্য ও জমিদারির ভার আপনার চরণে সমর্পণ করিলাম, আপনি রক্ষা করুন।” ১২৬৫ ত্রিপুরাব্দের ১৬ আষাঢ় বিপিনবিহারী ত্রিপুরার শাসনভার গ্রহণ করেন। শুভক্ষণে তিনি সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।
গুরু বিপিনবিহারী বিশেষ লেখাপড়া জানিতেন না, তথাচ তিনি বুদ্ধিবলে ও সুকৌশলে সুন্দররূপে রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। বিপিনবিহারী জানিতেন, মহারাজ ঈশানচন্দ্র প্রাণান্তেও তাঁহার বাক্য অবহেলা করিবেন না, তথাপি তিনি নৃপতি কিম্বা তাঁহার অধীনস্থ অমাত্য ব্রজমোহন ঠাকুর, গোলকচন্দ্র সিংহ ও গুরুদাস বর্দ্ধনের মত গ্রহণ না করিয়া কোন কার্য্য করিতেন না। বিপিনবিহারীর সুশাসনে রাজ্য ও জমিদারির আয় বৃদ্ধির সূত্রপাত হইল। তিনি আয় বৃদ্ধি ও ব্যয় সঙ্কোচ করিয়া ঋণ পরিশোধ ও ধন সঞ্চয়ের পথ পরিষ্কার করিলেন। বিপিনবিহারীর সমস্ত সৎগুণের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ দোষ ছিল; ১— তিনি সামরিক বিভাগের জন্য ব্যয় অনাবশ্যক বিবেচনা করিতেন; ২– আশু লভ্যজনক না হইলে তিনি কোন কার্য্যেই হস্তক্ষেপ করিতেন না; ৩— তিনি জমি জমা সংক্রান্ত কাৰ্য্য ভালরূপ জানিতেন না, এই জন্য অর্থব্যয় করিয়া যে, সম্পত্তি রক্ষা করিতে হয়, ইহা তিনি বুঝিয়াও বুঝিবেন না; এজন্য (১৬৯) তাঁহার শাসনকালে রাজ্য ও জমিদারির সীমান্ত স্থানে স্থায়ী ক্ষতি হইয়াছে।
কোন কোন ত্রিপুর নৃপতির রাণী ও শালা সম্বন্ধি প্রভৃতি ব্যক্তিগণ রাজ কোষের দুর্নিবাৰ্য্য শত্রু হইয়া থাকেন। রাজকর্মচারিগণ প্রায়ই ইহাদিগের দমন করিতে অক্ষম হন। কিন্তু বিপিনবিহারীর শাসনকালে এই সকল ব্যক্তির কোনরূপ মুখব্যাদানের অধিকার ছিল না।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের “সিপাহি বিদ্রোহ” সময়ে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সৈন্যগণ সাহায্য লাভের আশায় ত্রিপুরাপতির নিকট আসিতেছে এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া ঈশানচন্দ্ৰ তাহাদিগকে ত্রিপুরা হইতে বাহির করিয়া দিতে আদেশ করেন। তাহারা সেই আদেশ শ্রবণে ত্রিপুরা রাজ্য পরিত্যাগ পূর্বক ব্রিটিস রাজ্য দিয়া কাছাড়াভিমুখে প্রস্থান করেন। কয়েকজন বিদ্রোহী সেই আদেশ অবহেলা পূর্বক আগরতলার নিকটবর্ত্তী স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মহারাজ এই সংবাদ অবগত হইয়া তাহাদগিকে ধৃত করিয়া কুমিল্লাস্থ ইংরেজ কর্তৃপক্ষের হস্তে সমর্পণ করেন। তথায় তাহাদের ফাঁসী হইয়াছিল। মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের ১২৬৭ ত্রিপুরাব্দের ২৫শে অগ্রহায়ণে ৩২০ নং চিঠি পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, ত্রিপুরারাজ্যের উত্তর বিভাগে, বিদ্রোহী সৈন্যগণের অনুসন্ধান ও গতিরোধ (১৭০) জন্য ত্রিপুর সৈন্য প্রেরিত হইয়াছিল। তাহাদের কার্য্যকলাপ পর্যবেক্ষণ ও ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণকে উপযুক্ত সময়ে সমস্ত অবস্থা জ্ঞাপন করিবার জন্য মহারাজের পক্ষে গোলকচন্দ্র সিংহ মহাশয় “পলিটিকেল অফিসার” স্বরূপ প্রেরিত হইয়াছিলেন।[৫]
মহারাজ ঈশানচন্দ্র স্বীয় পুত্র ব্রজেন্দ্র ও নবদ্বীপচন্দ্রকে যুবরাজ ও বড়ঠাকুরের পদে নিযুক্ত করিতে মনস্থ করেন। কুমার নীলকৃষ্ণ ও বীরচন্দ্র ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুকম্পায় সেই সেই পদ লাভের অভিলাষী হইলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষগণ এ বিষয়ে মহারাজের ক্ষমতা সম্পূর্ণ স্বাধীন বলিয়া তাঁহাদের আবেদন অগ্রাহ্য করেন। কুকিদিগের অত্যাচার নিবারণ ও অন্যান্য কয়েকটি গুরুতর কার্য্যের পরামর্শ জন্য গবর্ণমেন্টের অনুমত্যানুসারে চট্টগ্রামের কমিশনর বকলেণ্ড সাহেব লেপ্টেনান্ট গ্রেহাম সাহেবকে আগরতলায় প্রেরণ করেন। তিনি মহারাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগষ্ট কমিসন সাহেব নিকট যে সুদীর্ঘ রিপোর্ট করেন (১৭১) তাঁহার স্থূলমর্ম্ম এইরূপ :- “কুকিদিগের অত্যাচার নিবারণ জন্য স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রান্তভগে গবর্ণমেন্ট যেরূপ সৈন্য স্থাপন করিতে ইচ্ছা করেন, মহারাজ তাহাতে সম্মত নহেন। তিনি তাঁহার নিজ সৈন্য উপযুক্ত স্থানে সন্নিবিষ্ট করিতে প্রস্তুত আছেন। নিবিড় অরণ্যে গবর্ণমেন্টের সৈন্যগণ কুকিদিগের সহিত যুদ্ধে কৃতকার্য হইবে না, আগামী শীত ঋতুতে মহারাজ তাঁহার অধীনস্থ বৃহৎ একদল কুকি সেনা দুরন্ত কুকিদিগের বিরুদ্ধে পাঠাইতে প্রস্তুত আছেন, আমার বিশ্বাস মহারাজ সরলভাবে এই প্রস্তাব করিয়াছেন। এবং এই প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা তাঁহার আছে।
“যুবরাজ এবং বড়ঠাকুর নিযুক্তি সম্বন্ধে আমরা আরও ৩/৪ বৎসর তাঁহাকে উৎপীড়ন না করি, ইহা মহারাজ প্রকাশ করিলেন; তাঁহার কথার ভাবে বোধ হইল যে, তিনি ঐ কালের পর বর্তমান দাবিদার ঠাকুর নীলকৃষ্ণ ও বীরচন্দ্রকে পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার স্বীয় পুত্রদ্বয়কে ঐ দুইটি পদে নিযুক্ত করিবেন। উক্ত ঠাকুরদ্বয়কে তিনি ঐ দুই পদের অনুপযুক্ত বিবেচনা করেন। ঠাকুরদ্বয় ঐ দুই পদে নিযুক্ত হইলে গুরু নিশ্চয়ই রাজ্য হইতে তাড়িত হইবেন। স্বীয়পুত্রদ্বয়কে ঐ দুই পদে নিযুক্ত করিয়া গুরুর ক্ষমতা অবিচলিত ভাবে লক্ষা করাই মহারাজরে অভিপ্রায় বলিয়া আমি বিবেচনা করি।” (১৭২)
“গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে পর্বত ত্রিপুরা (টপোগ্রাফিকেল্ সার্ভে) জরিপ করিবার কারণ মহারাজের সম্মতি প্রদান জন্য অনুরোধ করিয়াছিলাম, উক্ত জরিপি কাৰ্য্য, যে প্রণালীতে সম্পাদিত হইবে এবং ইহাদ্বারা যে মহারাজের কোন ক্ষতির কারণ নাই তাহাও বলা হইয়াছিল, এই প্রস্তাবে মহারাজ সম্মতি প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু বোধহয় এক্ষণ মহারাজের সেই মত নাই, এজন্য আমি তাঁহার প্রতি কোনরূপ দোষারূপ করিতে পারি না। নির্বোধ, অজ্ঞ, অবিনীত গুরু গবর্ণমেণ্টের প্রস্তাবিত সরল ও নির্দোষ কাৰ্য্যকেও তাঁহার ক্ষমতার প্রতিকূল বলিয়া বিবেচনা করে।”
তদনন্তর কমিসনর বকলেও সাহেব কুমিল্লায় মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার সম্মতিক্রমে গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করিলেন। গবর্ণমেন্ট বলাণ্ড সাহেবের মত অনুমোদন করেন। কমিসনর বক্লেণ্ড সাহেব গবর্ণমেন্টের মতানুসারে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১২ নবেম্বর একখণ্ড রোবকারী ত্রিপুরাপতির নিকট প্রেরণ করেন। এই রোবকারিখানাকে গবর্ণমেন্টের সহিত ত্রিপুরাপতির সন্ধিপত্র বলা যাইতে পারে। ত্রিপুরার স্বাধীনতার প্রতি গবর্ণমেন্ট হস্তক্ষেপ করিবেন না; মহারাজ স্বেচ্ছানুসারে যুবরাজ নিযুক্ত করিবেন ইত্যাদি বিষয় ঐ রোবকারীতে লিখিত আছে। এই রোবকারীর একখণ্ড ইংরেজি অনুবাদ পশ্চাৎ সন্নিবিষ্ট হইবে। (১৭৩)
এই সময় জিলা ত্রিপুরার জমিদারগণ ১০০ বিঘার ন্যূনপরিমাণ “অসিদ্ধ” নিষ্কর বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য উন্মত্ত হইয়া উঠেন। সরাইলের জমিদারের বিজয়বার্তা শ্রবণে গুরু বিপিন বিহারী গোস্বামী চাকলে রোসনাবাদের অন্তর্গত “সিদ্ধ” “অসিদ্ধ” নিষ্কর বাজেয়াপ্তের জন্য বদ্ধপরিকর হইলেন। তিনি অবস্থানুসারে উন্মত্তবৎ বল প্রয়োগ ও আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। পরম ধার্মিক ঈশানচন্দ্র মাণিক্য গুরুর পদ যুগল ধারণ করিয়া বলিলেন “প্রভো! এই কার্য্য হইতে বিরত হউন। আমার পূর্ব পুরুষগণ অনেক নিষ্কর দান করিয়া গিয়াছেন। সেই সকল নিষ্কর মধ্যে যদি কাহারও সনন্দ কালক্রমে নিবষ্ট হইয়া থাকে; তবে তাহা হরণ করিলে আমাকে ঘোর নরকে পতিত হইতে হইবে।” স্বার্থান্ধ গুরু বলিলেন, “বাবা! তোমার সমস্ত পাপ আমি গ্ৰহণ করিলাম। লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত করিয়া আমি তোমার আয় প্রায় লক্ষ টাকা বৃদ্ধি করিব।” গুরুর এই বাক্য মহারাজের কিছুমাত্র প্রীতিকর বোধ হইল না। প্রথমেই বলক্রমে একজন রাজপুরোহিতের ব্রহ্মোত্তর বাজেয়াপ্ত করিয়া তাহার কর ধার্য্য করিলেন। তাহার বন্দোবস্তী পাট্টাতে মহারাজের মোহর অঙ্কিত করিবার জন্য গুরু সেই পাট্টা লইয়া রাজ সমক্ষে উপস্থিত হইলে, মহারাজ পুনর্বার গুরুকে বলিলেন “প্রভো! এই কার্য্য হইতে বিরত হউন।”
গুরু বলিলেন “বাবা! তাহা হইবে না।” এই কথা বলিয়া গুরু মহারাজের বাক্স খুলিয়া মোহর গ্রহণ করত তাহাতে কালী মাখাইয়া মহারাজের হস্তে প্রদান পূর্বক বলিলেন “আমার আজ্ঞা পালন জন্য তোমাকে এই পাট্টায় মোহর করিতে হইবে।” গুরুভক্তি পরায়ণ নৃপতি গুরুর আজ্ঞা পালন জন্য “শ্রীগুরু আজ্ঞা” মোহর তাহাতে অঙ্কিত করিলেন। কিন্তু ধর্মভয়ে ধম্মভীরু নৃপতির হৃদয় ও হস্ত কম্পিত হইল। ইহার কয়েক মুহূর্ত পরে মহারাজ একখণ্ড চিঠি লিখিতে ইচ্ছা করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন, কিন্তু লেখনী সঞ্চালন করিতে পারিলেন না, তাঁহার দক্ষিণ হস্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এইরূপে ৩৩ বৎসর বয়ক্রমে (১২৭১ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য জীবনান্ত রকর বাতব্যাধী রোগে আক্রান্ত হইলেন। রোগ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। কয়েক মাস অন্তে তিনি চিরজীবনের জন্য শয্যাশায়ী হইলেন।
মহারাজ ঈশানচন্দ্র রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বপরিবারে বাস করিবার জন্য একটি নূতন অট্টালিকা নির্মাণ আরম্ভ করেন। সেই অট্টালিকা প্রস্তুত হইলে ১২৭২ ত্রিপুরাব্দের ১৬ই শ্রাবণ মহারাজ নূতন গৃহে প্রবেশের দিনাবধারণ করিলেন।
একদা মহারাজ ঈশানচন্দ্রের মহিষীগণ এবং তাঁহার বিমাতা মহারাণী রত্নমালা যুবরাজ এবং বড়ঠাকুর নিয়োগ (১৭৫) সম্বন্ধে কি করা হইবে, ইহা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন; তদুত্তরে মহারাজ বলিলেন, “আমার পুত্রদ্বয় শিশু, আমি শারীরিক নিতান্ত অসুস্থ, এরূপ অবস্থায় আমার পুত্রগণকে ঐ দুই পদে নিযুক্ত করিয়া আমার মৃত্যু হইলে, আমার দুরন্ত ভ্রাতৃগণ তাহাদের প্রাণবধ করিবে। যদি কাহাকেও নিযুক্ত না করি তাহা হইলে ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট আমার পুত্রগণকে রক্ষা করিবেন। ঈশ্বর আমাকে রোগ মুক্ত করিলে ২/৩ বৎসর পর ব্রজেন্দ্রকে যৌবরাজ্যে ও নবদ্বীপচন্দ্রকে বড় ঠাকুরের পদে নিযুক্ত করিব।”
নির্দ্দিষ্ট ১৬ই শ্রাবণ পুত্র কলত্র সমভিব্যাহারে মহারাজ ঈশানচন্দ্র নূতন নিকেতনে প্রবেশ করিলেন। তৎপর দিবস পূর্বাহ্নে (প্রায় ১০ ঘটিকার সময়) অসাধারণ গুরুভক্তি পরায়ণ প্রজারঞ্জক মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ৩৪ বৎসর বয়ক্রমে লোকান্তর গমন করেন।
.
টীকা
১. ইনি ভূত পূর্ব লে. গবর্ণর সার রিভার টমসনের পিতা।
২. সনন্দ খানা পারসী ভাষায় লিখিত, তাহার ইংরেজি অনুবাদ পশ্চাৎ প্রকাশিত হইবে। এই সনন্দ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চের লিখিত।
৩. নজরের মুদ্রার তালিকা টমসন সাহেবের ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে তারিখের চিঠি হইতে উদ্ধৃত হইল।
১টী স্বর্ণ মোহর…. ১৯ টাকা
২টী স্বর্ণ মোহর (রাজার নিজ টাকশালে মুদ্রিত) ২৮।।০
১৬টী রৌপ্যমুদ্রা….. ’১৬
৬৩।।০
৪. The Raja has an independent Hill territory, that your propositions for its resumption are totally inadmissible.
Government letter to the Comissioner of Chittagong. Dated the 27th December, 1838.
৫. গবর্ণমেন্ট সন্দেহ দ্বারা পরিচালিত ত্রিপুরেশ্বরকে বিদ্রোহী গণের সাহায্যকারী বলিয়া ত্রিপুরারাজ্য দখল ও ত্রিপুরাধিপতিকে কারারুদ্ধ করিবার জন্য অনুমতি প্রচার করেন। জজ মেটকাফ্ সাহেব গবর্ণমেন্টের অমূলক সন্দেহ ও ভ্রম প্রদর্শন করিয়া ত্রিপুরারাজ্য রক্ষা করেন।