ত্রয়োদশ অধ্যায়
রাজধর মাণিক্যের মৃত্যুর পর রাজ পরিবার মধ্যে এক ভীষণ কলহ উপস্থিত হয়। অমাত্য ও রাজকর্মচারিগণ দুই দলে বিভক্ত হইলেন। উজির দুর্গামণি, বক্সী রামহরি ঘোষ বিশ্বাস, চাকলে রোশনাবাদের দেওয়ান কালীচরণ সিংহ, কুমার রামগঙ্গার পক্ষ অবলম্বন করিলেন। সুবা ধনঞ্জয় ও নাজির রাজমঙ্গল দেওয়ান রামরতন দেব[১] ও রামচন্দ্র সেন প্রভৃতি সেন বংশীয় বিশ্বাসগণ যুবরাজ দুর্গামণির পক্ষ অবলম্বন করিলেন। কুমার রামগঙ্গার পক্ষাবলম্বীগণ প্রকাশ করিলেন যে, রাজপুত্র প্রকৃত রাজ্যাধিকারী। যুবরাজ (১৪১) জনৈক রাজকর্মচারী মাত্র। দৃষ্টান্ত স্থলে তাঁহারা মহারাজ রাম মাণিক্যের শ্যালক যুবরাজ বলিভীম নারায়ণ, এবং মহারাজ রত্ন মাণিক্যের (ভ্রাতা ভিন্ন) অতিরিক্ত যুবরাজ গৌরীচরণ, চম্পক রায় এবং মুকুন্দ মাণিক্যের যুবরাজ কুমার গঙ্গাধর প্রভৃতি কতকগুলি যুবরাজের নাম উল্লেখ করিলেন। তদতিরিক্ত ভূতপূর্ব রেসিডেন্ট লিক সাহেবের ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারির বিস্তারিত রিপোর্ট তাঁহাদের বিশেষ অনুকূল হইয়াছিল। কৃষ্ণমাণিক্যের মৃত্যুর পর বড় ঠাকুর বীরমণির জীবিতাবস্থায় রেসিডেন্ট লিক সাহেব ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তরাধিকারীত্ব সম্বন্ধে গবর্ণমেন্টের অভিপ্রায় অনুসারে প্রথা অনুসন্ধান করিয়া যে রিপোর্ট করেন তাহাতে তিনি মৃত রাজার নৈকট্য উত্তরাধিকারীকে রাজ্যাধিকারী বলিয়া প্রকাশ করেন। তদনুসারে গবর্ণমেন্ট মৃত রাজার পুত্র ও ভ্রাতার অভাবে ভ্রাতুষ্পুত্র রাজধরকে ত্রিপুর সিংহাসনের অধিকারী নির্ণয় করিয়াছিলেন।
যুবরাজ দুর্গামণির সহচরগণ প্রকাশ করিলেন যে, হিন্দুশাস্ত্র ও রাজবংশের প্রথা অনুসারে যুবরাজই রাজ্যাধিকারী।
জেলা ত্রিপুরার তদানীন্তন জজ- ম্যাজেস্ট্রেট ইলিয়ট সাহেব কুমার রামগঙ্গার এবং ত্রিপুরার কলেক্টর যুবরাজ দুর্গামণির পক্ষ অবলম্বন করিলেন। কুমার রামগঙ্গা যথাশাস্ত্র পিতৃ (১৪২) শ্রাদ্ধ সমাপ্তনান্তর সিংহাসনে আরোহণ পূর্বক “মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্য” আখ্যা গ্রহণ করেন। (১২১০ ত্রিপুরাব্দে)
যুবরাজ দুর্গামণি সুবা ধনঞ্জয় ও নাজির রাজমঙ্গল প্রভৃতির সাহায্যে পার্বত্য কুকি সরদারগণের সহিত সম্মিলিত হইয়া রামগঙ্গার প্রতিকূল অস্ত্রধারণ করিলেন। মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্য যে কেবল স্বীয় সৈন্য বলে আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন এমত নহে, জজ সাহেবের রিপোর্ট অনুসারে ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট তাঁহাকে রক্ষা করিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগষ্ট গবর্ণর জেনারেল বাহাদুর দুর্গামণিকে জ্ঞাপন করিলেন যে যুদ্ধ পরিত্যাগ পূর্বক তিনি চাকলে রোশনাবাদে স্বীয় স্বত্ব সংস্থাপন জন্য দেওয়ানী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করুন। দেওয়ানী আদালত দ্বারা জমিদারিতে তাঁহার স্বত্ব স্থির হইলে গবর্ণমেন্ট তাঁহাকে ত্রিপুরার রাজ সিংহাসনে সংস্থাপন করিতে প্রস্তুত আছেন। যুবরাজ দুর্গামণি অনন্যোপায় হইয়া দেওয়ানী আদালতে রামগঙ্গার প্রতিকূলে জমিদারির জন্য এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। ইহা নিতান্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, মহারাজ রামগঙ্গা ও তাহার অমাত্যবর্গ কেবল রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারিত্বের প্রথা লইয়া সেই মোকদ্দমায় বহুবিধ তর্ক ও আপত্তি উপস্থিত করিলেন, কিন্তু ব্রিটীশ আদালতে এবম্পকার মোকদ্দমা চলিতে পারে কি না এই তর্ক (১৪৩) উপস্থিত করিবার জন্য তাঁহাদের মস্তিষ্ক সঞ্চালিত হইল না[২] তৎকালে এই তর্ক উপস্থিত হইলে বোধহয় ত্রিপুরার এইরূপ অধঃপতন হইত না। এই মোকদ্দমায় কল্যাণ মাণিক্যের তৃতীয় পুত্র জগন্নাথ ঠাকুরের বংশধর রামচন্দ্র ঠাকুর তৃতীয় পক্ষ স্বরূপ দাবিদার হইয়াছিলেন।
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই এই মোকদ্দমা ঢাকা প্রবিন্সিয়েল কোর্টের প্রধান বিচারপতি মিষ্টার সারমেন বার্ড ও দ্বিতীয় বিচারপতি মিষ্টার জন মেলবিল দ্বারা নিষ্পত্তি হইয়াছিল। উক্ত আদালত পণ্ডিতগণের ব্যবস্থা অনুসারে এইরূপ নির্ণয় করেন যে, রাজার মৃত্যুর পর যুবরাজই রাজ্যাধিকারী হইয়া থাকেন সুতরাং যুবরাজ দুর্গামণি রাজ্যাধিকারী ও জমিদারির ক্ষমতা প্রাপ্ত মেনেজার নির্ণীত হইবেন। কারণ চাকলে রোশনাবাদ কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরগণের অবিভক্ত সাধারণ সম্পত্তি সুতরাং তাহার উপস্বত্ব তাঁহাদের মধ্যে বিভক্ত হইবে।
উক্ত নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে মহারাজা রামগঙ্গা সদর দেওয়ানী আদালতে আপীল করেন এবং কল্যাণ মাণিক্যের দ্বিতীয় পুত্র মহারাজ ছত্র মাণিক্যের বংশধর ঢাকা নিবাসী রাজা পরশুরাম (১৪৪) রামকৃষ্ণ, রাজা প্রতুরাম ও মৃত রাজা রামচন্দ্রের পত্নী রাণী চন্দ্রকলা চাকলে রোশনাবাদের উপস্বত্বের পাঁচ আনা ছয় গণ্ডা দুই কড়া দুই ক্রান্ত (অর্থাৎ এক তৃতীয় অংশের)[৩] উত্তরাধিকারী বলিয়া দাবিদার হন।
মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্য প্রবিনসিয়েল কোর্টের বিচারে পরাজিত হওয়ার পর নানা প্রকার বিপদে পতিত হইলেন। যুবরাজ দুর্গামণির পক্ষাবলম্বী সুবার উত্তেজনায় পরাক্রমশালী পৈতৃকুকিগণ রামগঙ্গার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। রামগঙ্গা পর্বত পরিত্যাগ পূর্বক জেলা ত্রিপুরার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন।[৪] রামগঙ্গার অনুরোধে গবর্ণমেন্ট পৈতুকুকির বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। গবর্ণমেন্ট সৈন্যগণ কুকিদিগকে নিৰ্য্যাতন করিয়া, নিবিড় অরণ্যে আশ্রয় লইতে বাধ্য করিয়াছিল। (১৪৫)
১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মার্চ (১২১৮ ত্রিপুরাব্দের ১৩ই চৈত্র) সদর দেওয়ানী আদালতের জজ সুবিখ্যাত হেরিংটন ও ফ্লেমিং সাহেব মহারাজ রামগঙ্গার আপিল ডিসমিস করেন; পণ্ডিতগণের ব্যবস্থা অনুসারে সদর দেওয়ানী আদালত যুবরাজ দুর্গামণিকে ত্রিপুরারাজ্যের অধিকারী বলিয়া অবধারণ করেন। প্রবিনসিয়েল কোর্ট চাকলে রোশনাবাদের উপস্বত্ব কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরদিগের মধ্যে বিভক্ত হওয়ার জন্য যে আদেশ করিয়াছিলেন, সদর দেওয়ানী আদালত সেই আদেশ রহিত করিয়া বলেন যে, “রাজবংশীয় ব্যক্তিগণের ভরণ পোষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ জন্য বাধা থাকিয়া রেস্পণ্ডেন্ট যুবরাজ দুর্গামণি জমিদারির অধিকার প্রাপ্ত হইবেন”।
সদর দেওয়ানী আদালতের ডিক্রীর বলে যুবরাজ দুর্গামণি ১২১৯ ত্রিপুরাব্দের বৈশাখ মাসে চাকলে রোশনাবাদ অধিকার করেন। তদনন্তর গবর্ণমেন্ট তাঁহাকে ত্রিপুরার রাজা বলিয়া স্বীকার করিলেন। দুর্গামণি সিংহাসন আরোহণ পূর্বক “মহারাজ দুর্গামণিক্য” আখ্যা গ্রহণ করেন। ঐ সনের আশ্বিন মাসে তাঁহার অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়।
রামগঙ্গার অধিকার কালে তাঁহর প্রিয় সহচর রামহরি ঘোষ বিশ্বাসের সহিত মহারাজ দুর্গামাণিক্যের শ্যালক দেওয়ান রামরতনের নানা প্রকার বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। (১৪৬) দুর্গামাণিক্য রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইলে রামরতন তাহার প্রতিশোধ লইতে যত্নবান হইলেন। একদা দেওয়ান রামরতন রামহরিকে অবমানিত করিতে যাইয়া স্বয়ং বিশেষরূপে লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন। রামরতন রামহরি কর্তৃক লাঞ্ছিত হইয়া স্বীয় ভগিনী মহারাণী সুমিত্রা দেবীকে (ইনি পশ্চাৎ “জগদিশ্বরী” উপাধি প্রাপ্ত হন,) ইহার বিশেষ প্রতিকার করিবার জন্য অশ্রুপূর্ণলোচনে অনুরোধ করেন। মহারাণী সুমিত্রা রামহরির রক্তদ্বারা স্নান না করিলে জল গ্রহণ করিবেন না, বলিয়া স্বীয় স্বামীর সমক্ষে প্রতিজ্ঞা করিলেন। মহারাজ দুর্গামাণিক্য স্বীয় সহধর্মিণীর এবপ্রকার প্রতিজ্ঞায় কিঞ্চিৎ বিচলিত হইলেও হৃদয়ের মহত্ব বিস্তৃত হইলেন না। তিনি মহারাণীকে বলিলেন, “অদ্যই রামহরিকে কারাগারে বন্ধ করা হইবে, আগামীকল্য বিচারান্তে তাঁহার প্রাণদণ্ড হইবে।” তদনন্তর রামহরিকে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়া মহারাজ দুর্গামাণিক্য গোপনে কারাধ্যক্ষকে বলিলেন, “বলরাম বিশ্বাস আমার শিক্ষক ছিলেন, আমি তাহার নিকট সমস্ত বাল্য জীবন বিদ্যাশিক্ষা করিয়াছি। আমার দ্বারা সেই বলরামের পুত্র রামহরির প্রাণদণ্ড হইতে পারিবে না। তুমি নিশীথ সময়ে গোপনে রামহরিকে কারাগার পরিত্যাগের উপায় করিয়া দিবে।”
সিংহাসন চ্যুত মহারাজ রামগঙ্গা মহারাণী সুমিত্রার (১৪৭) প্রতিজ্ঞা ও রামহরি কারারুদ্ধ হওয়ার সংবাদ শ্রবণে কিঞ্চিৎ বিচলিত হইলেন। তিনি রজনীতে যে কোন উপায়ে রামহরিকে কারাগার হইতে উদ্ধার করিবার জন্য মনস্ত করিলেন। যথা সময়ে মহারাজ রামগঙ্গার প্রেরিত লোক কারাধ্যক্ষের সাহায্যে কারাগার প্রবেশ করিয়া রামহ- রিকে বলিলেন, আপনি শীঘ্র কারাগার পরিত্যাগ করিয়া আসুন, আমরা মহারাজ রামগঙ্গার আদেশানুসারে তাহার সুন্দর উপায় করিয়াছি। রামসহরি বলিলেন, আমি চোরের ন্যায় পলায়ন করিতে ইচ্ছা করি না। রামহরির এই বাক্য শ্রবণে কারাধ্যক্ষ তাহাকে আহ্বান করিযা, মহারাজ দুর্গামাণিক্যের অভিপ্রায় গোপনে জ্ঞাপন করিলেন। তদনন্তর রামহরি বিনা বাক্যব্যয়ে কারাগার পরিত্যাগ পূর্বক রামগঙ্গার নিকট গমন করিলে তিনি রামহরিকে দর্শন করিয় যথোচিত প্রীতি লাভ করিলেন। অন্যান্য আলাপের পর রামহরি মহারাজ রামগঙ্গাকে বলিলেন, মহরাজ! এই বিপদ সময়ে আমি কখনই আপনাকে পরিত্যাগ করিব না। কিন্তু আমার ভীষণ শত্রু মহারাণী সুমিত্রা ও তাঁহার ভ্রাতা দেওয়ান রামরতনের হস্ত হইতে আমার পরিবারবর্গকে রক্ষা করা নিতান্ত প্রয়োজন, এজন্য কোন দূরবর্তী স্থানে একটি বাটী নির্মাণ করিবার জন্য অদ্যই আমি কিছুকালের নিমিত্ত মহারাজার নিকট বিদায় গ্রহণ করিতেছি। তদনন্তর রামহরি স্বীয় (১৪৮) ভ্রাতা রামদুলালকে লইয়া শ্রীহট্ট প্রদেশে গমন করেন; তপে বিষগাঁও মধ্যে একটি জমিদারী ক্রয় করিয়া স্বীয় বাসভবন নির্মাণ করিলেন।
যথাকালে মহারাণী সুমিত্রা ও তাহার ভ্রাতা দেওয়ান রামরতন, রামহরির পলায়ন বাৰ্ত্তা শ্রবণে ক্রোধে অধীর হইয়া নুরনগর ও মেহেরকুলস্থিত তাঁহার পৈত্রিক ভূসম্পত্তি নষ্টের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
কিছুকাল রাজধানী আগরতলা, মোগরা ও কুমিল্লায় বাস করিয়া হৃতরাজ্য মহারাজ রামগঙ্গা নানা প্রকার কষ্ট ও অপমান ভোগ করিলেন। এই সময়ে তিনি রামহরির বিষগাঁও জমিদারী ক্রয়ের সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। রামগঙ্গা স্বদেশ পরিত্যাগ করা শ্রেয়ষ্কর বোধে স্বপরিবারে বিষগাঁও গমন করেন। তিনি তাঁহার জন্য একটী জমিদারী ক্রয় করিতে রামহরিকে আদেশ করেন। তখন অসাধারণ প্রভুভক্তি পরায়ণ রামহরি মহারাজ রামগঙ্গাকে সেই বিষগাঁও প্রদান করিয়া বলিলেন, “মহারাজের কৃপাই আমার সমস্ত ধন সম্পত্তি, আমি ইহা মহারাজের জন্যই ক্রয় করিয়াছি, মহারাজ তাহা গ্রহণ করুন। * মহারাজ রামগঙ্গা সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁহার প্রিয় সহচরের দান গ্রহণ করিলেন। তৎপর তিনি বালিশিয়া পরগণার কিয়দংশ ক্রয় করিয়াছিলেন। রামহরি স্বীয় ভ্রাতা রামদুলালের নামে হরিতলা নামক মহালের (১৪৯) জমিদারি স্বত্ব ক্রয় করেন। উজির দুর্গামণি মহারাজ দুর্গামাণিক্যের আশ্রয় গ্রহণ করিতে চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হন তৎপর উপায়ান্তর অভাবে তিনি রামগঙ্গার নিকট গমন করেন। মহারাজ রামগঙ্গার অনুরোধে রামহরি উজির দুর্গামণির নিকটে হরিতলা মহাল বিক্রয় করেন। এই ঘটনার পর রামহরি জোয়ার বানিয়া চুং মধ্যে “তাং মহাম্মদ ছমি” নামক একটি জমিদারি ক্রয় করিয়া তথায় বাস ভবন নির্মাণ করিতে সমদ্যুত হন।[৫]
এইরূপে মহারাজ রামগঙ্গা ও তাঁহার ভ্রাতা কাশীচন্দ্র স্বীয় সহচর ও অনুচরবর্গের সহিত শ্রীহট্টবাসী হইলেন। তথায় তাঁহাদিগকে পুরুষানুক্রমে বাস করিতে হইবে, ইহাই তাঁহারা স্থির করিলেন।
মহারাজ দুর্গামাণিক্য স্বীয় শত্রুগণকে দূরীকৃত করিয়া রাজ্যমধ্যে শান্তি স্থাপন করিলেন। বিপদ সময়ে তিনি যে সকল ব্যক্তির নিকট উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, রাজদণ্ড ধারণ পূর্বক তাঁহাদের যথোচিত প্রত্যুপকার করিয়াছিলেন। ভূকৈলাসের ঘোষাল রাজাগণের পূর্বপুরুষ দেওয়ান গোকুল (১৫০) ঘোষাল মহারাজ দুর্গামাণিক্যের সাহায্য করিয়াছিলেন এজন্য তিনি তাহাকে একখানা গ্রাম নিষ্কর প্রদান করিয়াছিলেন। তদ্ব্যতীত তিনি অন্যান্য অনেক ব্যক্তিকে ও নানা প্রকার নিষ্কর প্রদান করেন।
নুরনগরের নামকরণ কর্ত্তা নুরুল্লা খাঁ তিতাস নদীর তীরে এক বাজার সংস্থাপন করিয়াছিলেন। লোকে তাহাকে “খাঁর হাটখলা” বলিত, মহারাজ দুর্গামাণিক্যের মাতা রাণী মহোদয়া দেবী সেই বাজার ও সৎসন্নিহিত স্থান তালুক প্রাপ্ত হইয়া তাহার নিকট একটি বৃহৎ পুষ্করিণী খনন করিয়াছিলেন। তাঁহাদ্বারা সেই বাজারের উন্নতি হইয়াছিল বলিয়া লোকে অদ্যাপি তাহাকে মহোদয়াগঞ্জ বলিয়া থাকে। মৃত্যুকালে রাণী মহোদয়া দেবী স্বীয় পুত্রবধূ সুমিত্রাকে তাহা দান করিয়া যান।
মহারাজ দুর্গামাণিক্যের মহিষী সুমিত্রার গর্ভে তাঁহার দুইটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। তৎপর তিনি নকুল ঘালিমের কন্যা মধুমতীকে বিবাহ করেন। তাঁহার গর্ভে কোন সন্তান হয় নাই।
মহারাজ দুর্গামাণিক্য বারাণসী নগরে এক মন্দির নির্মাণ করিয়া তাহাতে শিবলিঙ্গ সংস্থাপন করেন। তিনি দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের পৌত্র শম্ভুচন্দ্র ঠাকুরকে ছাত্ৰ দণ্ড প্রভৃতি যৌবরাজ্য- চিহ্নাদি সমর্পণ করেন। কিন্তু শাস্ত্রানুসারে (১৫১) তাঁহার অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয় নাই। মহারাজ দুর্গামাণিক্য তিন বৎসর রাজ্যশাসন করিয়া শম্ভুচন্দ্রের হস্তে রাজ্য ও জমিদারির শাসনভার সমর্পণ পূর্বক বারাণসী যাত্রা করেন। তথায় পহুঁছিবার পূর্বেই পাটনা নগরী সন্নিকর্ষে তাঁহার পরলোক প্রাপ্তি হয়। (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল। ১২২২ ত্রি : অঃ ২৫ চৈত্র।)
.
টীকা
১. যুবরাজ দুর্গামণি, দেওয়ান রামরতনের ভগিনী সুমিত্রার পানিগ্রহণ করেন।
২. এই ঘটনার ৬০ বৎসর পর কলিকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা বেরিষ্টার মৃত মহাত্মা মট্রী ও সাহেবের মস্তিষ্কে প্রথমে ইহা উদিত হইয়াছিল।
৩. কল্যাণ মাণিক্যের তিন পুত্রের বংশই এইক্ষণ বৰ্ত্তমান আছে, এজন্য এক তৃতীয় অংশ দাবি করা হইয়াছিল।
৪. এই সময় তিনি মোগরা গ্রামে তত্রত্য তালুকদারগণ হইতে ভূমি ক্রয় করিয়া একটি দীর্ঘিকা খনন করেন সেই দীর্ঘিকা অদ্যাপি গঙ্গাসাগর নামে পরিচিত হইয়া থাকে। সেই দীর্ঘিকার উত্তর পাড়ে তিনি যে বাসভবন নির্মানারম্ভ করিয়াছিলেন, সেই অসম্পূর্ণ রাজ নিকেতন অদ্যাপি বর্তমান রহিয়াছে। তাহাতে অধুনা চাকলে রোশনাবাদের উত্তর বিভাগের তহসীল কাৰ্য্য নির্বাহ হইতেছে।
৫. ইহার কিয়দংশ অদ্যাপি রামহরির উত্তরাধিকারগণ ভোগ করিতেছেন। বিয়গাঁও ও বালিশিয়া ত্রিপুরার রাজ ষ্টেটভুক্ত হইয়াছে। উজির দুর্গামণির উত্তরাধিকারী ঠাকুর গোপীকৃষ্ণ দেব প্রভৃতি ১২৯৫ ত্রিপুরাব্দে হরিতলা বিক্রয় করিয়াছেন।