রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.১২

দ্বাদশ অধ্যায়

মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁহার রাজ্ঞী জাহ্নবী মহাদেবী রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন। তৎকালে রেসিডেন্ট লিক সাহেব চট্টগ্রামে ও কুমার রাজধর কুমিল্লায় অবস্থান করিতেছিলেন।

লিক সাহেব ত্রিপুরাপতির মৃত্যু সংবাদ শ্রবণে তদানীন্তন গবর্ণর জেনারেল ওয়ারেণ হেষ্টিংস সাহেবকে লিখিলেন যে, অনপত্যাবস্থায় ত্রিপুরাপতির মৃত্যু হইয়াছে; কেবল রাজধর ঠাকুর নামে তাহার এক ভ্রাতুষ্পুত্র জীবিত আছেন। তাহাকে রাজ্যাধিকারী করা মৃত রাজা এবং তাঁহার রাজ্ঞীর অভিপ্রায়।[১] এই পত্র প্রেরণ করিয়া লিক সাহেব আগরতলায় গমন করেন। (১৩৫)

মহারাণী জাহ্নবী (অন্য নাম রাণী চাম্পা) প্রায় তিন বৎসরকাল রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। কুমিল্লা নগরীতে তিনি যে দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন তাহা অদ্যাপি “রাণীর দীঘি” আখ্যায় পরিচিত হইয়া থাকে। তাহার জল অতি উৎকৃষ্ট।

রেসিডেন্ট লিক সাহেব আগরতলায় উপস্থিত হইলে রাজ্ঞী যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিয়াছিলেন। তিনি লিক সাহেবকে এরূপ অভিপ্রায় জানাইলেন যে, “রাজধরকে সিংহাসনে স্থাপন করিয়াই তিনি সাংসারিক সমস্ত বিষয় হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন।” রাজ্ঞী লিক সাহেবের পরামর্শানুসারে রাজধরকে সিংহাসনে স্থাপন করিবার জন্য গবর্ণর জেনারেল নিকট আবেদন করিয়াছিলেন।

বীরমণি বড়ঠাকুর[২] রাজ্ঞীর বাসনা জানিতে পারিয়া স্বয়ং সিংহাসন অধিকার করিবার জন্য অভিলাষী হন। রেসিডেন্ট লিক সাহেবের রিপোর্ট দ্বারা বড়ঠাকুরের দাবি অমূলক স্থির হইল। সমসের গাজির প্রতিষ্ঠিত রাজা লক্ষণ মাণিক্য বল পূর্বক রাজমুকুট ধারণ করিবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। মহারাণী জাহ্নবী কৌশল ক্রমে তাহাকে বাধ্য করিয়া তাহার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত করিলেন যে, রাজধর সিংহাসনে আরোহণ করিলে তিনি লক্ষ্মণ (১৩৬) মাণিক্যের পুত্র কুমার দুর্গামণিকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন।

রাজ দণ্ডধারণ করিবার পূর্বেই কুমার রাজধর বিষম বিপদে পতিত হইলেন। চাকলে রোসনাবাদের শাসন কার্য্য সুচারু রূপে হইতেছে না বলিয়া কৃষ্ণমাণিক্যের মৃত্যুর অল্পকাল পূর্বেই গবর্ণমেন্ট তাহা খাস করিয়া লইয়াছিলেন। রেসিডেন্ট লিক সাহেবের হস্তে তাহার শাসন ভার সমর্পিত হয়। ১১৯২ ত্রিপুরাব্দে (১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে) চাকলে রোসনাবাদ গবর্ণমেন্টের খাস শাসনে আইসে। গবর্ণমেন্টের প্রাপ্য রাজধর পরিশোধ করিয়া শাসন সংক্রান্তব্যয় ও রাজপরিবারের ভরণপোষণ জন্য নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ বৃত্তি প্রদান করা রেসিডেন্টের কর্ত্তব্য কার্য ছিল। কৃষ্ণমাণিক্যের মৃত্যুর অল্পকাল পরেই রাজধর আর একটি অচিন্তনীয় বিপদে পতিত হইলেন। মুসলমান রাজত্বের অবসান ও ইংরেজ রাজত্বের অভ্যুদয় কালে বাঙ্গালা দেশে কিরূপ ডাকাইতের প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল তাহা ইতিহাস পাঠকগণ বিশেষরূপে অবগত আছেন। এবপ্রকার একদল ডাকাইতের আশ্রয়দাতা বলিয়া কুমার রাজধর গবর্ণমেন্টের দ্বারা অবরুদ্ধ হইয়া কিছুকাল চট্টগ্রামের কারাগারে বাস করিয়াছিরেন। (১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে)[৩] অবশেষে তিনি নির্দোষী বলিয়া কারাগার হইতে (১৩৭) মুক্তিলাভ করেন। যদিও গবর্ণমেন্ট ১০ বৎসরের জন্য চাকলে রোশনাবাদের শাসন ভার রেসিডেন্টের হস্তে সমর্পন করিয়াছিলেন, যদিও কিছুকালের জন্য কুমার রাজধর গবর্ণমেণ্টের কারাগারে অবরুদ্ধ হইয়াছিলেন তথাপি গবর্ণমেন্ট স্বাধীন পার্বত্য ত্রিপুরার শাসনকার্য্যের প্রতি কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নাই।

১১৯৫ ত্রিপুরাব্দে কুমার রাজধর গবর্ণমেণ্ট হইতে খেলাত প্রাপ্ত হইয়া ত্রিপুরা রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন।[৪] তৎকালে তিনি লক্ষ্মণ মাণিক্যের পুত্র দুর্গামণিকে যৌবরাজ্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। মহারাজ রাজধরমাণিক্য মণিপুরপতি জয়সিংহের কন্যাকে বিবাহ করেন। মণিপুরের রাজ বংশের সহিত ত্রিপুর রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ। বিলাসের আধার মূর্ত্তি মণিপুরী রমণীগণের ত্রিপুর রাজপুর ইহাই প্ৰথম প্ৰবেশ মণিপুর রাজকুমারীর গর্ভে রাজধরের কোন সন্তান হয় নাই। অন্যান্য পত্নীর গর্ভে তাঁহার ৪টী (১৩৮) পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। দুইটী শৈশবস্থায় মানবলীলা সংবরণ করেন। কুমারদ্বয় রামগঙ্গা ও কাশীচন্দ্র দীর্ঘজীবী হইয়াছিলেন।

মহারাজ রাজধর মাণিক্যের শাসনকালে সুবা আছুমণি দেব প্রধান সেনাপতি এবং রামহরি ঘোষ বিশ্বাস “ফৌজের বক্সী” ছিলেন।[৫] ইহারা উভয়েই বাহুবলশালী বীরপুরুষ বলিয়া খ্যাতিলাভ করেন। দুর্দান্ত কুকিদিগকে বিশেষরূপে দমন করিয়া বৃদ্ধ সুবা আছুমণি ও যুবক বক্সী রামহরি রাজ দরবারে বিশেষ রূপে সম্মানিত হইয়াছিলেন।

মহারাজ রাজধর মাণিক্য ১১৯৫ ত্রিপুরাব্দে রাজদণ্ড ধারণ করিয়াছিলেন, কিন্তু ১২০২ ত্রিপুরাব্দের পূর্বে চাকলা রোশনাবাদের শাসনভার তাঁহার হস্তে সমর্পিত হয় নাই। তৎকালে তিনি স্বয়ং রোশনাবাদের উপস্বত্ব হইতে বার্ষিক দ্বাদশ সহস্র টাকা বৃত্তি স্বরূপ প্রাপ্ত হইতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে যখন গবর্ণমেণ্ট মহারাজ রাজধর মাণিক্যের হস্তে রোশনাবাদের শাসনভার পুনঃ প্রদান জন্য প্রস্তাব করিয়া ছিলেন, তৎকালে রেসিডেন্ট জন বুলার সাহেব ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। বুলার সাহেব ১৭৮৮ (১৩৯) খ্রিস্টাব্দের ১২ আগষ্টের চিঠি দ্বারা বলেন যে, রাজধরের হস্তে রোশনাবাদের শাসনভার সমর্পণ করিলে যে কেবল ষ্টেটের ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবে এমত নহে রাজপরিবারবর্গ, যাঁহারা ষ্টেটের উপস্বত্ব হইতে জীবিকা নির্বাহের জন্য বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তাঁহারা নিতান্ত কষ্টে পতিত হইবেন। বুলার সাহেবের প্রতিবাদ দ্বারা গবর্ণমেণ্টের প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত হইতে কিছুকাল গৌণ হইয়াছিল। অবশেষে যখন লর্ড কর্ণওয়ালিস বাঙ্গালার জমিদারবর্গের সহিত স্থায়ী বন্দোবস্ত করিতে কৃত সঙ্কল্প হইলেন তখন (১২০২ ত্রিপুরাব্দে) রাজধর মাণিক্যের সহিত রোশনাবাদের চিরস্থায়ী বা (দশশালা) বন্দোবস্ত করিয়া তাঁহাকে রোশনাবাদের শাসনভার প্রত্যার্পণ করেন। এই সময় ত্রিপুরায় রেসিডেন্টের পদ এবালিস হইয়া যায়। তৎপরিবর্তে “রোশনাবাদ ত্রিপুরা” জেলার সৃষ্টি হইয়া, জনৈক ইংরেজ রাজপুরুষ তাহার কালেক্টর নিযুক্ত হন।

রাজধর মাণিক্য স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার রামগঙ্গাকে বড় ঠাকুরের পদে নিযুক্ত করেন। বাৰ্দ্ধক্যাবস্থায় (১২১০ ত্রিপুরাব্দে) তিনি যুবরাজকে অতিক্রম করিয়া স্বীয় পুত্র রামগঙ্গার হস্তে রাজত্ব ও জমিদারির শাসনভার সমর্পন করেন। এই অন্যায় কার্য্যের দ্বারা তিনি যে কেবল রাজপরিবারের মধ্যে আত্মকলহের বীজ বপন করিয়াছিলেন (১৪০) এমত নহে, এই কলহ হইতেই রাজকীয় প্রকৃত সম্মানের মস্তকে কুঠারাঘাতের সূত্রপাত হইয়াছিল।

রাজধর শ্রীহট্ট প্রদেশবাসী জনৈক কায়স্থ ভদ্রলোকের কন্যা চন্দ্রতারার সহিত স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র রামগঙ্গার বিবাহ দেন। তিনি অষ্ট ধাতু দ্বারা “বৃন্দাবন চন্দ্র” নামক দেবমূৰ্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। চরমাবস্থায় রাজধর মাণিক্য বৈরাগ্য ভাব অবলম্বন করিয়া সর্বদা দেবোপাসনায় নিযুক্ত থাকিতেন। ১২১৪ ত্রিপুরাব্দে (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে) রাজধর মাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করেন।

.

টীকা

১. Mr. Leeke’s letter to the Honorable Warren Hastings Governor General Dated 15th July 1783.

২. মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য, হরমনিকে যৌবরাজ্য এবং বীরমণিকে বড়ঠাকুর পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

৩. The Zemindari was taken into khas or direct management by the Resident. The Raja was in 1783 sent Prisoner to Chittagong on a charge of harbouring dacoits. Mackenzies North-East Frontier of Bengal Page 273

৪. Government letter to Mr. Leeke
Resident to Tipperah 9th May 1785.

৫. ইনি অদ্যাপি হরিবক্সী’ বলিয়া পরিচিত হইয়া থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *