রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.১১

একাদশ অধ্যায়

১১৭০ ত্রিপুরাব্দের ১ পৌষ যুবরাজ কৃষ্ণমনি “মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য” আখ্যাগ্রহণ পূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তিনি যেরূপ নানা প্রকার যন্ত্রনা ও কষ্ট ভোগ করিয়োছেন, ত্রিপুর বংশীয় অন্য কোন নরপতি তদ্রুপ যন্ত্রণা ও কষ্টভোগ করিয়াছেন কিনা সন্দেহ। বারংবার সমরে পরাজিত হইয়া সাহায্য লাভ কামনায় কখন বা অনাহারে কখন বা ফল মূল ভক্ষণে, কখন বা দগ্ধ মাংস ভক্ষণে অরণ্যে অরণ্যে ভ্রমণ করিয়া কাছাড় ও মণিপুর রাজসভায় গমন করিয়াছেন। কখন বা দুর্দান্ত কুকিদিগের মধ্যে বাস করিয়া তাহাদের ন্যায় কদর্য্য আহারে জীবিকা নির্বাহ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। রাজদণ্ড ধারণ করিয়াও তিনি কষ্ট হইতে এককালে নিষ্কৃতিলাভ করিতে সক্ষম হন নাই। অল্পকাল মধ্যেই চাকলে রোশনাবাদের রাজস্ব পরিশোধ (১২৭) উপলক্ষে ফৌজদার, মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্যের সহিত ভীষণ কলহ উপস্থিত করিলেন। সেই কলহ হইতে ক্রমে সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ফৌজদার নবাব সমক্ষে অতিরিক্ত সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। নবাব তদানীন্তন ইংরেজ গবর্ণর বানসিটার্ট সাহেবকে ফৌজদারের সাহায্যার্থে সৈন্য প্রেরণ করিতে অনুরোধ করেন। বানসিটার্ট সাহেব চট্টগ্রামের সীমারেখা প্রসারিত করিবার উত্তম সুযোগ প্রাপ্ত হইলেন। তিনি চট্টগ্রামের শাসনকর্তা “সরদার[১] বারলেষ্ট সাহেবকে লিখিলেন, “ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে ত্রিপুরা অধিকার করিবে এবং নবাবের কর্মচারিগণকে বলিবে যে, তাহারা এই ঘটনা নবাবকে জানাইতে পারেন। নবাব এ সম্বন্ধে যাহা প্রশ্ন করিবেন তাহার উত্তর আমরা নবাবকে প্রদান করিব।”

তদনুসারে বারলেষ্ট সাহেব ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ২০৬ জন পদাতিক সৈন্য ও দুইটি তোপ সহ লেপ্টানান্ট মথি সাহেবকে চট্টগ্রাম হইতে ত্রিপুরায় প্রেরণ করেন। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য তৎকালে নুরনগর নগরের নিকটবর্ত্তী প্রাচীন কৈলারগড় দুর্গে সপ্ত সহস্র সুশিক্ষিত পদাতিক বহু সংখ্যক কুকি সৈন্য ও কয়টি তোপ লইয়া অবস্থান করিতে ছিলেন। মথি সাহেব নুরনগর নগরে উপস্থিত হইয়া তাহার পশ্চিমদিকস্থ (১২৮) ময়দানে শিবির সন্নিবিষ্ট করিলেন। প্রবাদ অনুসারে রাজকীয় “ফৌজের বক্সীকে”[২] মথি সাহেব প্রলোভনে বাধ্য করিয়াছিলেন। এই বিশ্বাসঘাতভৃত্য দুৰ্জ্জয় ইংরেজের হস্তে প্রাণনাশ অনিবাৰ্য্য বলিয়া ভয় প্রদর্শন পূর্বক রাজকীয় সৈন্যগণকে দুর্গ পরিত্যাগ পূর্বক পর্বতমধ্যে পলায়ন করিবার জন্য পরামর্শ প্রদান করে। সৈন্যগণ ভয়াতুর হইয়া রজনী যোগে দুর্গের পূর্বদিকস্থ গুপ্তদ্বার দিয়া অরণ্য মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য অকস্মাৎ এই দুর্ঘটনায় পড়িয়া মথির হস্তে আত্ম সমর্পণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। এইরূপে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী প্রাপ্তির চারি বৎসর পূর্বে ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র ব্রিটিশ সিংহের কুক্ষিগত হইয়াছিল। লিক সাহেব ত্রিপুরার প্রথম রেসিডেন্টের পদে নিযুক্ত হন।

ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী প্রাপ্তির তিন বৎসর পরে অল্পকালের জন্য মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য চাকরে রোশনাবাদের অধিকার হইতে চ্যূত হইয়াছিলেন। জগৎমাণিক্যের বংশধর (১২৯) বলরাম মাণিক্য চাকলে রোশনাবাদের শাসন ভার প্রাপ্ত হন। কি রূপে তিনি এই অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা পরিষ্কার রূপে লিপিবদ্ধ করা সুকঠিন। তিনি পার্বত্য প্রদেশ অধিকার করিতে পারেন নাই। সুতরাং বাহুবলে যে তিনি রোশনাবাদ অধিকার করিয়াছিলেন এইরূপ অনুমান সঙ্গত নহে। শান্তিময় ব্রিটীশাধিকার কালে এইরূপ পরিবর্তন অবশ্যই বিষ্ময়কর। যাহা হউক অল্পকাল মধ্যেই মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য, “রাজা বলরাম মাণিক্য” কে দূরীকৃত করিয়া পুনর্বার রোশনাবাদ অধিকার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। সম্ভবত ১১৭৬ ত্রিপুরাব্দের শেষভাগে ও ১১৭৭ ত্রিপুরাব্দের প্রথম ভাগে বলরাম মাণিক্য চালে রোশনাবাদ সম্পূর্ণ কিম্বা তাহার কিয়দংশ শাসন করিয়াছিলেন।

রেসিডেন্ট লিক সাহেবের সময় হইতে চাকলে রোশনাবাদ ও পার্বত্য রাজ্যের বিচার কাৰ্য্য স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাহ হইতে আরম্ভ হয়। পার্বত্য প্রদেশের বিচার কার্য্য মহারাজের নিযুক্ত বিচারকগণ দ্বারা নির্বাহ হইত; রোশনাবাদের বিচার কার্য্য রেসিডেন্ট সাহেব এবং মহারাজা বাহাদুর কিম্বা তাহার প্রতিনিধি স্বরূপ চাকলে রোশনাবাদের দেওয়ান উভয়ে একত্র বসিয়ে নির্বাহ করিতেন। তৎকালের কয়েক খণ্ড (১৩০) নিষ্পত্তি পত্রের সহি মোহরাঙ্কিত নকল আমরা দর্শন করিয়াছি। আদর্শ স্বরূপ তাহার একখণ্ড প্ৰতিলিপি যথাস্থানে মুদ্রিত হইবে।

মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য একজন দয়ালু, দাতা ও স্বধর্ম নিরত নরপতি ছিলেন। কুমিল্লা নগরীর পূর্ব পার্শ্বে মহারাজ রত্নমাণিক্য যে, সতররত্ন নামক দেবমন্দিরের ভিত্তি সংস্থাপন করিয়াছিলেন, মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য সেই মন্দিরের নির্মাণ কার্য্য সম্পূর্ণ করিয়া তাহাতে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার দারুমূর্ত্তি সংস্থাপন করেন। কথিত আছে, এই দেবমূৰ্ত্তি সংস্থাপন কালে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য চৌদ্দগ্রাম নিবাসী অনাচরণীয় নীচজাতীয় শিবিকা বাহক বেহারাদিগকে জলাচরণীয় শূদ্র শ্রেণীতে ভূক্ত করিয়াছিলেন। স্বদেশীয় ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণের সাহায্যে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য বিনা অর্থব্যয়ে অক্লেশে যাহা সম্পাদন করিয়াছিলেন, বর্তমান মহারাজ স্বদেশীয়াদিগের সহিত কলহ করিয়া বহু অর্থব্যয়ে তদ্রূপ কার্য্য সম্পাদন করিতে যাইয়া পদে পদে লাঞ্ছিত হইয়াছেন, তদ্বৃত্তান্ত যথাস্থানে বিশেষ রূপে বর্ণিত হইবে। তিনি তুলা পুরুষ প্রভৃতি ক্রিয়া উপলক্ষে বাঙ্গলা দেশের সমস্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। প্রচুর পরিমাণে ভূমি ও অর্থদান দ্বারা নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানবাসী পণ্ডিতগণকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন।

মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য যে কেবল দেবোত্তর ব্রহ্মোত্তর ও (১৩১) মহত্ত্বরাণ প্রভৃতি নিষ্কর ভূমি দান করিয়া নিরস্ত হইয়াছিলেন, এমত নহে। তিনি “ডাকাইত” সমসের গাজির প্রদত্ত সমস্ত নিষ্কর “বহাল” করিয়া মাহত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন।[৩] (১৩২)

মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের শাসন কালে তিনি বিশ্বাস বংশীয়দিগের সহিত কলহ করিয়া মেহেরকুলের অন্তর্গত দুর্গাপুর নিবাসী সিংহ বংশীয় সুরমণি চাকলে রোশনাবাদে দেওয়ানী পদে নিযুক্ত করেন। ইহার উত্তর পুরুষগণ দীর্ঘকাল ঐ কার্য্য নির্বাহ করিয়া সমৃদ্ধিশালী হইয়াছিলেন।[৪] তাঁহারা হিন্দু শাস্ত্রানুমোদিত নানাবিধ ক্রিয়া কলাপের অনুষ্ঠান করিয়া (১৩৩) এক সময় সমগ্র বঙ্গদেশে আপনাদের খ্যাতি প্রচার ও দাতৃত্বের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন।

মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের জীবিতকালে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা যুবরাজ হরিমণি পরলোক গমন করেন। তাঁহার দুইটি শিশুপুত্র ছিল। জৌষ্ঠ তাতের স্নেহভাজন ছিলেন না। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য ও তাঁহার পত্নী মহারাণী জাহ্নবী মহাদেবী কুমার রাজধরকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন। ক্রমেই কণ্ঠমণির প্রতি মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য বিদ্বেষ ভাব প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে কুমার কণ্ঠমনির মাতা তাঁহাকে লইয়া কাছাড় রাজ দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তদনন্তর মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য কুমার রাজধরকে স্বীয় উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কুমার রাজধর সৌভাগ্যবশত রাজ্যাধিকারী নির্ণীত হইলেন বটে, কিন্তু জৌষ্ঠতাত ও জ্যেষ্ঠতাত পত্নীর অতিরিক্ত আদরে তিনি একটি সম্পূর্ণ মূর্খ হইয়া উঠিলেন। স্বীয় নাম স্বাক্ষর (১৩৪) করিতে যাঁহার গলদঘর্ম হইত তাঁহাকে সম্পূর্ণ মুর্খ ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে?[৫]

১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য মানবলীলা সংবরণ করেন।

.

টীকা

১. Chief of Chittagong.

২. মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্যের প্রিয় সহচর রামহরি বিশ্বাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামদুলাল ঘোষ বিশ্বাসের নিকট এইরূপ শ্রুত হওয়া গিয়াছে যে, বিক্রমপুর নিবাসী জনৈক কায়স্থ তৎকালে মহারাজের ফৌজের বক্সী ছিলেন। কৃষ্ণ মাণিক্যের শাসনকালে বিদেশী বিশ্বাসঘাতক ভৃত্যের আমদানী আরম্ভ হয়।

৩. সমসের গাজি নামা পুস্তকে লিখিত আছে
তবে গাজী যে সবারে দিল লাখেরাজ।
পাকড়ি আনিল রাজা লইতে খেরাজ।।
সকলে মিনতিকরে মহারাজা আগে।
মহারাজ দোহাই দিয়া ক্ষমাবার মাগে।।
তপুদ্দক খাই মোরা ফকির খোনার। ১
ভট্ট ব্রাহ্মণ মোরা পেসা নাই আর।।
মহারাজ বলে তোরে কে দিল নিস্কর।
বলে, দিছে হেন রজক সমসর।।
এক পুরিয়া জমিদার দিল আমরারে।
পোস্তা পোস্থি হই তুমি চাহ ভাঙ্গিবারে॥২
এতেক শুনিয়া রাজা হৈল সলজ্জিত।
পাত্রগণ বুঝাইল রাজার বিদিত।।
রায়ত হইয়া কৰ্ত্তা দিয়াছে নিস্কর।
আপনি লইলে কর লজ্জা বহুতরা।।
তবে মহারাজ বহাল করিল সবারে।
খয়রাত নিস্কর মিনা আর দেবোত্তর।।

১। খোনার-খন্দকার। ২। এক পুরুষের জমিদার সমসের গাজি নিস্কর দিয়াছেন, আর আপনি পুরুষানুক্রমের প্রাচীন অধিপতি হইয়া ভাঙ্গিতে চাহেন।

৪. উক্ত সিংহ বংশের বংশাবলী ও দেওয়ান সুরমনির জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান কালীচরণ সিংহের জবানবন্দী পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, সুরমণি পিতা হরিচরণ ও পিতামহ বলরাম ত্রিপুর রাজ সরকারে দেওয়ানী কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা কোন নরপতির সময় কোন বিভাগে দেওয়ানী কার্য্য নির্বাহ করিয়াছিলেন তাহার কোন বিশ্বস্ত প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করিতে পারি নাই। উক্ত দেওয়ান বংশের বংশাবলী এস্থানে সংক্ষিপ্ত ভাবে প্রকাশিত হইল।

এই দেওয়ান বংশে যাহারা দেওয়ানী পদপ্রাপ্ত হন নাই, আমরা তাঁহাদের নাম পরিত্যাগ করিলাম। তন্মধ্যে দেওয়ান সুরমণি সিংহের তৃতীয় ও চতুর্থ পুত্রের বংশ এবং দুর্গাচরণ সিংহের দ্বিতীয় পুত্র কালীচন্দ্রের বংশধরগণ এক্ষণে বর্তমান আছেন। কালীচন্দ্র সিংহের পুত্র পৌত্র ব্যতীত অন্যান্যের অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়।

৫. রেসিডেন্ট জনবুলার সাহেবের ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগষ্টের চিঠিতে লিখিত আছে যে, রাজধর কিছুমাত্র লেখাপড়া জানিতেন না, এবং নিজের নামটিও দস্তখত করিতে পারিতেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *