রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

রাজমালা ২.১০

দশম অধ্যায়

মির হবিবের সাহায্যে তৎকালে জৎ মাণিক্য চাকলে রোশনাবাদের আধিপত্য লাভ করেন, সেই সময় দক্ষিণশিক (১১৯) নিবাসী ইমন সদা বা সদা গাজি নামক জনৈক মুসলমান প্রজা হল কর্ষণ কালে ভূগর্ভে কতগুলি মহামূল্য বস্তু প্রাপ্ত হইয়া, রাজা জগৎ মাণিক্যকে উপঢৌকন প্রদান করেন। নরপতি সেই সকল উপঢৌকন প্রাপ্ত হইয়া, সদাগাজিকে পরগণে দক্ষিণশিকের জমিদারি স্বত্ব প্রদান করেন। তৎপূর্বে উক্ত পরগণার বার্ষিক রাজস্ব দ্বাদশ সহস্র মুদ্ৰা নিৰ্দ্দিষ্ট ছিল, জগৎ মাণিক্য দুই সহস্ৰ মুদ্ৰা বাদ দিয়া দশ সহস্র মুদ্রা বার্ষিক রাজস্ব ধার্য করেন। ইমন সদা বা সদাগাজি কবলিত হইলে তাঁহার নাবালক পুত্র নাছির মাহাম্মদ দশ আনা ও খণ্ডল নিবাসী রতন চৌধুরী ছয় আনা জমিদারি প্রাপ্ত হন। নাছির মাহাম্মদ বয়োপ্রাপ্ত হইলে কালক্রমে তাহার কয়েকটি পুত্র জন্মে। সেই জমিদারপুত্রগণের সহিত সমসের গাজি নামক এক দরিদ্র বালক এক পাঠশালায় বিদ্যা অধ্যয়ন করিত। এক সামান্য রমণীর গর্ভে ও জনৈক ফকিরের ঔরসে তাহার জন্ম হয়। সমসেরের জীবন চরিত লেখক তাঁহাকে “পিরের নন্দন” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। অল্পকালেই সমসের বিদ্যা বলে ও বাহু বলে জমিদার পুত্রগণ হইতে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্ণীত হইলেন। সমসের বয়োপ্রাপ্ত হইলে জমিদার নাছির মাহাম্মদ তাহাকে এক কুত ঘাটের তহশীলদারি কার্য্যে নিযুক্ত করেন। তৎকালে সমসরের দূরসম্পর্কিত ছাদুগাজী নামক ভ্রাতা তাহার সহচর হইয়াছিল। ছাদু যদিচ সমসরের ন্যায় বুদ্ধিমান ছিল না, কিন্তু (১২০) সে ভীমের ন্যায় অলৌকিক বলবান ছিল। এই সময় গদাহুসন খন্দকার নামক জনৈক সাধুপুরুষের সহিত সমসেরের সাক্ষাৎ হয়। সেই সাধু পুরুষ তাহাকে একখানি তরবারি ও একটি অশ্ব প্রদান করিয়া বলেন “তুমি চাকলে রোশনাবাদের অধিপতি হইবে, এজন্য তোমাকে এই তরবারি ও অশ্ব প্রদান করিলাম। রসাঙ্গের (আরাকানের) মগরাজ এই তরবারি ছৈয়দ সুলতানকে উপঢৌকন প্রদান করেন। আমি তাঁহার উত্তর পুরুষ বলিয়া এই বহুমূল্য তরবারি দীর্ঘকাল যাবৎ আমার নিকট আছে। অদ্য তোমাকে ইহা প্রদান করিলাম, ইহার দৈব শক্তি বলে তুমি সর্বযুদ্ধে জয়ী হইবে, নাছির মাহাম্মদ জমিদার হত হইবেন। ত্রিপুরেশ্বরের সহিত তোমাকে বারংবার যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে। কিন্তু পরিণামে তোমার জয় অনিবার্য”।

সেই সাধু পুরুষের বাক্যে উৎসাহিত হইয়া সমসের গাজি প্রথমেই জমিদার নাছির মাহাম্মদের কন্যার পাণি গ্রহণাভিলাষী হইলেন। জমিদার সমসেরের অন্যায় অভিলাষ শ্রবণে, তাহাকে বধ করিবার জন্য সৈন্য প্রেরণ করিলেন। জমিদার সৈন্যের আগমণ বাৰ্ত্তা শ্রবণে সমসের ও ছাদু পলায়ন করিলেন। তাঁহারা কিছুকাল বেদরাবাদ পরগণায় লুক্কায়িত থাকিয়া কতকগুলি দুষ্টলোক সংগ্রহ করেন। সেই সকল দুষ্ট লোকের সাহায্যে ছাদু, জমিদার নাছির (১২১) মাহাম্মদ ও তাঁহার পুত্রগণের বিনাশ সাধন করেন। তদনন্তর সমসের বলক্রমে নাছির মাহাম্মদের কন্যাকে বিবাহ করিয়া দক্ষিণশিক অধিকার করেন। ত্রিপুরেশ্বর এই সংবাদ শ্রবণে তাহার বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলে সমসের বলে ও কৌশলে মহারাজার উজিরকে বাধ্য করিয়া কয়েক সহস্র মুদ্রা “নজর” প্রদান পূর্বক দক্ষিণশিকের জমিদারীর সনন্দ গ্রহণ করিলেন। ইহার তিন বৎসর পর সমসের গাজি মেহেরকুল পরগণা ইজারা লইয়াছিলেন। বিজয় মাণিক্যের মৃত্যুর পর সমসের গাজি রাজকর বন্ধ করিয়া স্বয়ং চাকলে রোশনাবাদের অধিপতি বলিয়া ঘোষণা করিলেন। যুবরাজ কৃষ্ণমণি বারংবার যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। কিন্তু একবারও সমসেরকে পরাজয় করিতে পারিলেন না। সমসের ছয় সহস্র উৎকৃষ্ট বলবান সৈন্য প্রস্তুত করিয়া তাঁহার রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। যুবরাজ কৃষ্ণমণি উদয়পুর পরিত্যাগ পূর্বক আধুনিক রাজধানী আগরতলায় বাস ভবন নির্ম্মাণ করেন।

এই সময় বাঙ্গালা দেশে ভীষণ রাষ্ট্র বিপ্লব চলিতেছিল। নবাব আলিবর্দি খাঁর মৃত্যু, তাঁহার প্রিয়তম দৌহিত্র অপরিণত মস্তিষ্ক যুবক সিরাজদ্দৌলার অভিষেক, তদনন্তর গৰ্দ্দভ প্রকৃতি, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের অভ্যুদয় ও হতভাগ্য নবাব সিরাজের অধঃপতন প্রভৃতি ঘটনাবলী দ্বারা যখন বঙ্গের (১২২) অদৃষ্ট মুহুর্মুহুঃ কম্পিত হইতেছিল, কতকগুলি অপরিণাদর্শী স্বদেশদ্রোহী হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসঘাতকতায় যখন বঙ্গলক্ষ্মী বঙ্গদেশ পরিত্যাগের জন্য চঞ্চলা হইয়াছিলেন তৎকালে সমসের গাজি ত্রিপুরায় বসিয়া সিংহনাদ করিতেছিলেন। সমসের যে কেবল চাকলে রোশনাবাদ অধিকার করিয়া নিরস্ত হইয়াছিলেন, এমত নহে, তাঁহার অর্থের অভাব উপস্থিত হইলেই ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত পরগণা সমূহের দুর্বল জমিদারদিগের গৃহে দস্যুবেশে প্রবেশ পূর্বক অর্থ সংগ্রহ করিতেন। সমসেরগাজির প্রিয় ভক্ত, তাঁহার জীবন চরিত লেখক সেখ মনোহর ও ইহা অস্বীকার করিতে পারেন নাই।[১]

পর্বতবাসী মানবগণ হইতে কর আদায় জন্য সমসের উজির রামধন বিশ্বাসকে[২] পর্বত মধ্যে প্রেরণ করিলেন। পর্বতবাসী অসভ্যগণ গর্বের সহিত বলিয়াছিল “আমাদের (১২৩) রাজবংশ ব্যতীত আমরা অন্য কাহাকেও কর প্রদান করিব না, তুমি বাঙ্গালি তোমার কথা আমরা গ্রাহ্য করি না।[৩]

তৎকালে সমসের গাজি এক আশ্চর্য্য কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন; “উদয় মাণিক্যের” ভ্রাতুষ্পুত্র বনমালী ঠাকুরকে “লক্ষ্মণ মানিক্য” আখ্যা প্রদান পূর্বক এক অভিনব সিংহাসন প্রস্তুত পূর্বক তাহাতে স্থাপন করিলেন। মির কাশিমের অধঃপতনের পর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী যেরূপ মুরশিদাবাদে একজন সাক্ষী গোপাল নবাব রাখিয়াছিলেন সমসের গাজীও তদ্রুপ লক্ষ্মণ মাণিক্যের নামোল্লেখে কতকগুলি পার্বত্য জাতি হইতে কর সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন বটে কিন্তু তখনও ত্রিপুরা, বিয়াং, কুকি প্রভৃতি অধিকাংশ পার্বত্য প্রজা যুবরাজ কৃষ্ণমণির পক্ষেই ছিল। যুবরাজ কৃষ্ণমনি বল সংগ্রহের অভিলাষে দীর্ঘকাল কাছাড় ও মণিপুর রাজ্যে ভ্রমণ করেন, কিন্তু আশানুরূপ সৈন্য সংগ্রহ করিতে সক্ষম হন নাই।

সমতল ক্ষেত্রের প্রত্যেক পরগণায় সমসের গাজি এক এক জন শাসনকর্তা নিয়োগ করিয়াছিলেন। (১২৪) তাহাদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান সংখ্যাই অধিক ছিল। আবদুল রজক তাঁহার সৈন্য বিভাগের দেওয়ান ছিলেন। মেহেরকুলের উত্তরদিকস্থ কোন পরগণা সমসের গাজীর অধিকারভুক্ত ছিল কিনা তাহা আমরা জ্ঞাত নহি। কিন্তু তাঁহার জীবনচরিত লেখক বলেন, যে বিশালঘর অষ্টজঙ্গল পরগণার শাসনভার ছানাউল্লার হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল। নুরনগর ও গঙ্গামণ্ডলের শাসন কর্তৃত্বে আবদুল নামক এক ব্যক্তি নিযুক্ত হইয়াছিলেন। আমরা জীবন চরিত লেখকের সমস্ত বাক্য সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে অক্ষম। তাঁহার শাসনকর্তৃগণ মধ্যে জগৎপুরের গঙ্গাগোবিন্দ ও চৌদ্দগ্রামের হরিচন্দ্র এই দুইজন হিন্দুর নাম প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। অন্যের সকলেই সমসেরের স্বজাতীয় ও সম্পকীয় ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু রাজস্ব বিভাগের কার্য্য তাঁহাদের দ্বারা সুচারুরূপে নির্বাহ হইত না। এজন্য হিন্দু শাসনকর্তার প্রয়োজন হইয়াছিল। ধর্মপুর নিবাসী গঙ্গাগোবিন্দ প্রধান দেওয়ান ও খণ্ডলনিবাসী হরিহর নায়েব দেওয়ানের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন।

ইহারা রাজস্ব বিভাগের কার্য্য নির্বাহ করিতেন।

সমসের গাজি তাঁহার অধিকার মধ্যে দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের আশ্চর্য্য নিয়ম প্রচলিত করিয়াছিলেন। ৮২ সিক্কা ওজনে সের ধার্য্য হইয়াছিল। সেই সেরের পরিমাণে কোন্ (১২৫) দ্রব্য কত মূল্যে বিক্রী হইবে তাহার একটি তালিকা প্রত্যেক বাজারে লটকাইয়া দিয়াছিলেন।ধ কেহ ইহার অন্যথা করিতে পারিত না।

সমসেরগাজি প্রকৃত পক্ষে দাতা ছিলেন। তিনি অনেক হিন্দু মুসলমানকে চাকলা রোশনাবাদের মধ্যে অনেক নিষ্কর ভূমি দান করিয়া গিয়াছেন।

সমসেরের সৌভাগ্য তপন পশ্চিমাকাশে বিলম্বিত হইল। অশেষ গুণালঙ্কৃত আলিজা মিরকাশেম বাঙ্গালার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন। যুবরাজ কৃষ্ণমণি নবাব সমক্ষে উপস্থিত (১২৬) হইয়া সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিলেন। ক্রমে সমসেরের দস্যুবৃত্তির সংবাদ নবাবের কর্ণগোচর হইল। তিনি যুবরাজ কৃষ্ণমণিকে “ত্রিপুরাপতি” বলিয়া স্বীকার করিলেন। নবাবের প্রেরিত সৈন্যগণ ত্রিপুরায় উপনীত হইয়া সমসেরকে বন্দি করিয়া লইয়া গেল। পশ্চাৎ নবাবের অনুমতি ক্রমে তোপের মুখে বন্ধন করিয়া সমসের গাজির প্রাণ দণ্ড করা হইয়াছিল।

.

টীকা

১. সেখ মনোহর বলেন, যে, তিনি কেবল একজন কৃপণ জমিদারের গৃহ হইতে এক লক্ষ টাকা ডাকাতি করিয়া আনিয়াছিলেন। কারণ উক্ত জমিদার “দান খয়রাত করিত না” এজন্যই তাহার গৃহে ডাকাতি করা হইয়াছিল।

২. ইনি পরাশর গোত্রজ দত্তবংশীয় কায়স্থ। ঘোষ বিশ্বাস বংশের দৌহিত্র বলিয়া উপবিশ্বাস শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হন। উজির রামধন শোলনল গ্রামবাসী ছিলেন। তাঁহার বাস ভবনের চিহ্ন অদ্যাপি সেই গ্রামে বিদ্যামান রহিয়াছে।

৩. ধন্য ত্রিপুরাজাতি! এ জন্যই রেভারেন্ড লং সাহেব লিখিয়াছেন The people of Tripura like the Shik were a military race.

৪. আমরা তাহার মূল্যের তালিকা এস্থানে প্রদান করিতেছি। চাউল ১সের এক পয়সা, লঙ্কা মরিচ ১ সের এক পয়সা, গুড় ১ সের দুই পয়সা, রসুন পিয়াজ ১ সের দুই পয়সা, কার্পাস ১ সের ৫পয়সা, কলাই ১ সের এক পয়সা, মশুরি ১ সের দুই পয়সা, মটর ১সের দুই পয়সা, মুগ ১ সের চারি পয়সা, অরহড় ১ সের চারি পয়সা, তৈল ১সের ৩ আনা ঘৃত ১ সের ৫ আনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *