রাজমহিষীর রহস্য
গ্রামের নাম রাজমহিষী, লোকে বলে রাজমৈশি। কলকাতা থেকে যেতে হলে তারকেশ্বর লাইনে সিঙ্গুর স্টেশনে নামতে হবে, সেখান থেকে বাস। সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক। শ্যাওড়াফুলি থেকেও যাওয়া যায়। সময় একটু বেশি লাগে, কিন্তু ঘন ঘন বাস পাওয়া যায়। তবে, সকাল আটটা বত্রিশের লোকালের সঙ্গে সিঙ্গুর থেকে একটা বাস ছাড়ে, সেটা আবার এক্সপ্রেস। সেই বাসটাই সবচেয়ে সুবিধেজনক।
অতএব ওই আটটা বত্রিশের লোকালেই সমরেশ আর দময়ন্তী দুটো সুটকেস সহযোগে সিঙ্গুর স্টেশনে নামল। শীতকাল, দময়ন্তীর কলেজ ক্রিসমাসের ছুটিতে বন্ধ! অতএব, সমরেশের সঙ্গে জুটে পড়ায় কোনো অসুবিধে ছিল না। থাকার একটা ভালো ব্যবস্থাও করা গেছে। শিবেনের বন্ধু চন্দ্রশেখর সাঁতরা রাজমৈশির লোক। তাদের বাড়ির একটা অংশ খালি ছিল, সেখানেই থাকবে দু-জনে। বিছানাপত্রও নেওয়ার দরকার নেই।
সমরেশ একা গেলে অবশ্য থাকত ইনস্পেকশন বাংলোয়। সেখানে ওর কোম্পানির আরও দু-জন লোক আছে— একজন সার্ভেয়ার, অন্যজন তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। সেখানে দুটো মাত্র ঘর। অতএব, দময়ন্তীকে নিয়ে ওঠা সম্ভব হত না। তা ছাড়া তিনজনেই তো সারাদিন বাইরে বাইরে কাটাবে, তখন দময়ন্তীকে একা একা থাকতে হত। চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে সে-রকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তা ছাড়া, অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে ওঠার। যে কারণে সমরেশের রাজমৈশিতে যাওয়া, সেটা সফল হতে হলে চন্দ্রশেখরবাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলে সুবিধে হওয়ার কথা। রাজমৈশির পাশেই একটা মস্ত জঙ্গল-ঢাকা জলা জায়গা আছে। লোকে সেটাকে বলে মহীপালের দিঘি। লোকে সেখানে দিনের বেলাতেই যেতে ভয় পায়। রাত্রে মাঝে মাঝে আলেয়া দেখা যায়। আগে সবাই বলত শাঁকচুন্নি, এখন আর তা বলে না। তবে মনে হয় বোধ হয় তাই বিশ্বাস করে। এই জনমানবহীন পরিত্যক্ত জায়গায় যেই ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড বিদ্যুৎ বিতরণের একটা কেন্দ্র খুলবেন স্থির করলেন, অমনি রাজমৈশি আর তার আশপাশের তিন-চারটে গ্রামের যাবতীয় লোক মহীপালের দিঘি নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সমরেশের কর্তব্য ছিল এই কাজটি সম্পর্কে একটি প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করা যদিও তার কোম্পানি ভয় পাচ্ছিল যে রাজমৈশি থেকে একটা বেশ বড়ো রকমের বাধা আসতে পারে। এখানেই চন্দ্রশেখরবাবুর সঙ্গে পরিচয়টা কাজে লাগার সম্ভাবনা। চন্দ্রশেখরবাবুর পরিবার ওই অঞ্চলে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সকলেই ওঁদের সমঝে চলে। সেই প্রভাবের পরিচয় পাওয়া গেল আটটা বত্রিশের লোকালে সিঙ্গুর স্টেশনে নামার সঙ্গেসঙ্গেই। আপ প্ল্যাটফর্মের ছোটোখাটো ভিড় ঠেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাবইনস্পেকটরের ইউনিফর্ম পরা একটি অল্পবয়স্ক পুলিশ অফিসার এসে সমরেশের সামনে স্যালুট করে দাঁড়াল। ফর্সা, রোগাপটকা লম্বাটে গড়ন, চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা, সদ্য কলেজ থেকে বেরোনো চেহারা। বললেন, ‘আমাকে কৃত্তিবাসবাবু পাঠিয়েছেন। আমি থানা থেকে আসছি। তা ছাড়া, কলকাতা থেকেও আপনাদের আসার খবর পেয়েছি। আমার নাম সনৎ চৌধুরী।’
সমরেশ বলল, ‘কৃত্তিবাসবাবু কে? আর আপনি আমাদের চিনলেনই-বা কী করে?’
সনৎ বললেন, ‘কলকাতা থেকে আপনাদের আসার টাইম আর চেহারা ডেসক্রিপশন পেয়েছি, আর কৃত্তিবাস সাঁতরার বাড়িতেই তো আপনারা উঠবেন। আপনাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এসেছি।’
সমরেশ বলল, ‘বেশ, বেশ। চলুন, তাহলে যাওয়া যাক।’ তারপর জনান্তিকে দময়ন্তীকে বলল, ‘লক্ষ করলে, হেডকোয়ার্টার্সের আগে কৃত্তিবাসের নাম উল্লেখ করা হল?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে মাথা নাড়াল। বলল, ‘হ্যাঁ। করলুম।’
.
রাজমৈশি গ্রামটা খুব সবুজ, প্রচুর গাছপালা। বাসরাস্তা থেকে গ্রামটা প্রায় দেখাই যায় না। তবে বেশ বড়ো গ্রাম আর যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু। অনেক পাকাবাড়ি, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা দোতলা বা তিনতলা। একটা দর্শনীয় পঞ্চরত্ন শিবমন্দির আছে, গ্রামের লোক সেটার পেছনে বেশ অর্থব্যয় করে থাকেন। তবে চুড়োটাই একমাত্র গাছপালার ওপরে বাসরাস্তা থেকে দেখা যায়। এ ছাড়া আরও দুটো মন্দির আছে। একটা কালী মন্দির, অন্যটা খুব সম্ভব বিষ্ণু মন্দির যার মধ্যে আজ আর কোনো বিগ্রহ নেই। তবে দুটো মন্দিরই বেশ ভালো অবস্থায় আছে। গ্রামে একটা প্রাইমারি আর একটা হাইস্কুল আছে। সকালে মেয়েদের, দুপুরে ছেলেদের ক্লাস হয়। আর, একটা কলেজও আছে— জুবিলি কলেজ। মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের সুবর্ণজয়ন্তী বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া আছে অ্যালবার্ট হসপিটাল। খুব বড়ো কিছু নয়, তবে নেহাত ছোটোও নয়। এই দুটোই একটা ক্রিশ্চান মিশনারি সংস্থা চালিয়ে থাকেন।
কৃত্তিবাস সাঁতরা মশাইয়ের বাড়িটা খুব বড়ো, মাঝখানে একটা বিরাট উঠোন ঘিরে চতুষ্কোণ দোতলা স্ট্রাকচার। পশ্চিমমুখো দোতলা সমান উঁচু দেউড়ি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। উঠোনটা বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে বাঁধানো, তার চারদিক ঘিরে একতলায় আর দোতলায় ঢালাই লোহার রেলিং বসানো বারান্দা। অতীতে নিশ্চয়ই অন্দরমহল, বাইরের মহল প্রভৃতি ছিল। আজ আর সেরকম নেই। এখন একতলা দোতলা মিলিয়ে মোট সাতটা ফ্ল্যাট। প্রত্যেকটা যাকে বলে প্রায় স্বাধীন। বাড়ির কর্তা কৃত্তিবাস থাকেন একতলার পূর্ব দক্ষিণ কোণের দুটো কামরা নিয়ে। অন্যগুলোতে থাকেন তাঁর ছেলে এবং নাতিরা। একটা খালি থাকে মেয়েদের জন্যে। তবে, সবকটা ফ্ল্যাটই এখন খালি, একটি ছাড়া। মালিকরা থাকেন বাইরে, থাকার মধ্যে একমাত্র কৃত্তিবাসের ছোটোছেলে ডা শিবশঙ্কর সাঁতরা। অ্যালবার্ট হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাড়িতেও রুগি দেখেন, তবে পয়সা নেন না। কৃত্তিবাস একসময় রেলের দুঁদে অফিসার ছিলেন, এখন সারাদিন কাটান বাড়ি আর বাগান দেখাশুনো করে। আর সন্ধেবেলা হয় স্থানীয় রাজনীতি। রাজমৈশির লোক কৃত্তিবাসকে তাঁদের প্রধান বলেই গণ্য করে থাকেন। শুধু রাজমৈশি নয়, আশপাশের দু-দশটা গ্রামের লোকেরাও তাঁকে মান্যগণ্য করে।
সনতের জিপ দেউড়ির সামনে এসে যখন দাঁড়াল, তখন প্রায় পৌনে দশটা বাজে। সনৎ গাড়ি থেকে নেমে বললেন, ‘আপনারা একটু বসুন, আমি ভেতরে খবর দিয়ে আসছি।’ বলে ভেতরে চলে গেলেন।
একটু বাদেই একজন সৌম্যদর্শন পক্বকেশ বৃদ্ধ আর একটি স্থূলাঙ্গিনী মহিলা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, তাঁদের পেছনে পেছনে এল দু-জন কাজের লোক। বৃদ্ধ অতিথিদের আপ্যায়ন করে গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলা কোনো কথা বললেন না বটে, কিন্তু তাঁর শান্ত সুন্দর হাসি দেখে দময়ন্তী আর সমরেশ বেশ স্বস্তি বোধ করল।
গৃহকর্তা তাঁর অতিথিদের দেউড়ি দিয়ে ঢুকেই ডান দিকের বারান্দার একটা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তোমাদের জন্যে এইখানেই ব্যবস্থা করেছি। দেখো, কোনো অসুবিধে হবে না তো?’
দময়ন্তী আর সমরেশ ঘরের চারদিক দেখে প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, ‘অসুবিধে? কী যে বলেন! এর চেয়ে বেশি সুবিধে আর কোথায় পাব?’
কথাটা সত্যি। ঘরটা বেশ বড়ো। তার একপাশে দুটো ডানলোপিলো দেওয়া স্প্রিংয়ের খাট, ওপরে নাইলন নেটের মশারি, অন্যপাশে একটা সোফাসেট, বুককেস, তার ওপর একটি রেডিয়ো। জানলা দিয়ে বাইরে রাস্তার ওপর সনতের জিপটা দেখা যাচ্ছিল, তার চারপাশে ঘন সবুজ গাছপালার সমারোহ, তার ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে বাড়ি। ঘরের একপাশে একটা ছোটো দরজা— সেখানে বাথরুম।
কৃত্তিবাস বললেন, ‘পাশের ঘরটাও ঠিক এমনিভাবে সাজানো। এ দুটি আমার মেয়ে আর নাতনিদের জন্যে রাখা আছে। ভালো কথা, তোমাদের তুমি করে বললুম বলে কিছু মনে করলে না তো? তোমরা হলে চন্দ্রশেখরের বন্ধু। সে আমার বড়ো আদরের নাতি। আমার বড়োছেলে শিবরামের একমাত্র সন্তান। অবশ্য তার বাবা-মা কেউই আজ আর বেঁচে নেই। আর থাকবেই-বা কেন? থাকলে এই বৃদ্ধ বয়সে শোকতাপ পাব কোত্থেকে? তা, থাকগে সেসব কথা। এ হল আমার কনিষ্ঠ পুত্রবধূ গায়ত্রী। বউমা, তুমি তাহলে এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলো। আমি একটু ঠাকুর ঘরে গিয়ে বসি।’
বৃদ্ধ বেরিয়ে যেতেই সনৎও যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘আমি তাহলে এবার চলি?’
এইবার কনিষ্ঠ পুত্রবধূর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অনুচ্চ অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, ‘যাবে মানে? কোথায় যাবে? চা আর জলখাবার আসছে। সেগুলো শেষ করবে, তারপর যাওয়ার কথা। এই দু-পাঁচ মিনিটে তোমার চোর-ছ্যাঁচড়রা কেউ বেশিদূর পালাতে পারবে না।’ বলে ভদ্রমহিলা মাথার ঘোমটা ফেলে খাটের ওপর জাঁকিয়ে বসলেন। দময়ন্তীকে বললেন, ‘এসো তো মা, আমার পাশে বোসো। আমি তোমার কথা কিছু কিছু শুনেছি। তা এখানে সেরকম কোনো মতলবে আসনি তো?’
দময়ন্তী হেসে উঠে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, না, একেবারেই না। ওর এখানে কী সব কাজ আছে। আমারও কলেজ ছুটি। তাই স্রেফ ছুটি কাটাতে এসেছি।’
সনৎ ছটফট করছিলেন। বললেন, ‘আপনার এখানে এলেই একগাদা খেতে হবে। সকাল বেলা খেয়ে বেরিয়েছি, কিন্তু বলব কাকে? সবাই পুলিশি জুলুম পুলিশি জুলুম বলে চেঁচায়, পুলিশকে কী পরিমাণ জুলুম সহ্য করতে হয় সে-খবর তো কেউ রাখে না।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘চুপ করো! সকাল বেলা কী খেয়েছ তা কি আর আমি জানি না ভেবেছ? তোমার ওই সেপাই— কী যেন নাম? মানিকচাঁদ— সে হতভাগা কালকের বাসি রুটি আর দুধ ছাড়া দিয়েছে কিছু? না দিতে পারে?’
সমরেশ সহাস্যে বলল, ‘আপনি তো ডেঞ্জারাস মহিলা! পুলিশের হাঁড়ির খবর রাখেন দেখছি।’
ভদ্রমহিলা মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘রাখি বই কী। শুধু পুলিশ কেন? আশপাশের সবকটা গ্রামের সক্কলের হাঁড়ির খবর আমার জানা। তোমার গিন্নি ডিটেকটিভ হতে পারে, আমিও কিছু কম যাইনে।’
‘আপনাকে তাহলে কী বলে ডাকব? মিসেস মেপল?’
‘আমাকে ছোটোকাকি ডাকলেই হবে। চাঁদুও আমাকে ওই বলেই ডাকে।’
.
যারই যত আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট হোক না কেন, দুপুরের আর রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু একসঙ্গে। কৃত্তিবাসের ঘরের পাশেই খাবার ঘর। মাটিতে আসন পেতে খাওয়া, বড়ো বড়ো কাঁসার থালায় পরিবেশন করেন গায়ত্রী স্বয়ং। কৃত্তিবাসের স্ত্রী যদিও জীবিত, তাহলেও নানা অসুখেবিসুখে অথর্ব হয়ে পড়ায় তিনি আর ঘরের বাইরে বের হন না। দুপুরে খাওয়ার সময় এখানেই দেখা হল ডা শিবশঙ্করের সঙ্গে।
ডা শিবশঙ্কর শীর্ণকায়, শ্যামবর্ণ, মাথার চুল কাঁচাপাকা, চোখে মোটা লেন্সের স্টিলফ্রেমের চশমা আর অসম্ভব ছটফটে লোক। বাটিকের কাজ করা লুঙ্গি আর ধূসর রঙের আলোয়ান গায়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লেন। আসনে বসে একনিশ্বাসে বলে গেলেন, ‘এই যে তোমরা এসে গেছ? বাঃ বাঃ, বেশ বেশ। কোনো অসুবিধে হয়নি তো? যদি অসুবিধে হয়ও, গ্রামদেশ তো, হতেই পারে, তাহলেও চিন্তা কোরো না। আমার স্ত্রীকে খবর দেবে, উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। ওগো, শুনছ? তাড়াতাড়ি করো। আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে! তা, হ্যাঁ, কী যেন তোমার নাম? সমরেশ। তুমি তো ইনস্পেকশন বাংলোয় যাবে? আমার গাড়িতে চলো। আমাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে তুমি গাড়িটা নিয়ে চলে যেয়ো। চালাতে জানো তো? শহরের ছেলে, তা আর জানবে না? পাঁচটার সময় আমাকে উঠিয়ে নিয়ে এসো।’
ডাক্তার দম নেওয়ার জন্যে একটু থামতেই সমরেশ বলল, ‘সেটা ঠিক আছে। তবে, জানেন তো, আমার কাজের জায়গা কিন্তু ইনস্পেকশন বাংলো নয়, মহীপালের দিঘি। সেখানে যাওয়ার কী ব্যবস্থা করা যায়?’
‘মহীপালের দিঘি?’ বলে ডা শিবশঙ্কর আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ সমরেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘সেখানে তোমার কী কাজ? তুমি কি ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে কাজ কর নাকি?’
সমরেশ মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, না। ইলেকট্রিসিটি বোর্ড আমাদের কোম্পানির কাস্টমার। আমরা ওখানে কাজের কনট্র্যাক্ট পেয়েছি, এখন সার্ভে চলছে। ইনস্পেকশন বাংলোয় আমাদের দু-জন সার্ভেয়ার আছেন।’
শিবশঙ্কর ভুরু কুঁচকে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু সে-কাজটা বন্ধ হয়ে যায়নি? আমি তো শুনেছিলুম যে কাজটা আর হচ্ছে না।’
সমরেশ সহাস্যে বলল, ‘কেন? বন্ধ হবে কেন? আমরা তো সেরকম কোনো খবর পাইনি।’
শিবশঙ্কর পূর্ববৎ চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কিন্তু নিত্য যে আমায় সেরকমই বললে?’
কৃত্তিবাস এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এখন প্রশ্ন করলেন, ‘নিত্য মানে তোমার সেই অতি পণ্ডিত বন্ধু নিত্যগোপাল? তার কথায় আবার কান দিতে আছে?’
শিবশঙ্কর ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, আপনি ওকে যতটা অপদার্থ মনে করেন, ও কিন্তু ততটা নয়। করেছে তো অনেক কাজ এই গ্রামের জন্যে!’
কৃত্তিবাস ব্যাজার মুখে বললেন, ‘অন্য কেউ সে-কাজের ভার নিলে সেগুলো অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যেত! তবে আর তো কেউ নেয় না, কাজেই বাধ্য হয়ে ওকেই দিতে হয়। তবে আমি দেখেছি, ওর বেশির ভাগ কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
শিবশঙ্কর এরপর একেবারে চুপ করে গেলেন। বোঝা গেল, কৃত্তিবাসের কথাটা তাঁর পছন্দ হল না বটে, কিন্তু কোনোরকম প্রতিবাদ না করাই তিনি শ্রেয় বিবেচনা করলেন।
.
সমরেশ কথাটা পুনরায় চালু করল শিবশঙ্করের গাড়িতে উঠে। বলল, ‘ডাক্তার সাঁতরা, আমাদের কাজটা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে আপনি কী বলছিলেন?’
শিবশঙ্কর সন্তর্পণে রাস্তার খানাখন্দ বাঁচিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, ‘নিত্যগোপাল দাস নামে এই গ্রামে একজন আছে, যার কাজই হচ্ছে পরোপকার করে বেড়ানো। পরোপকার সে করবেই, তাকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। তার ভয়ে অনেকে বিপদে পড়লেও মুখ ফুটে সেকথা বলার সাহস পায় না। আপাতত তার মাথায় ঢুকেছে যে মহীপালের দিঘির বনজঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে বাড়িঘর বানালেই এ অঞ্চলে ইকোলজিকাল ব্যালান্স বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, আর তার ফলে এ অঞ্চলে সব ভয়ংকর ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে থাকবে। সেই কারণে, সর্বসাধারণের উপকারার্থে সে সর্বত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছে যাতে এই কাজ বন্ধ করা হয়। সরকারি বেসরকারি কোনো দপ্তরই তার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তবে সে আমায় এই দু-দিন আগেই বললে যে তার এই পরিশ্রম এতদিনে সার্থক হয়েছে। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সে স্বয়ং পাকা খবর নিয়ে এসেছে যে এই প্রোজেক্ট বন্ধ করা হবে।’
সমরেশ হাসতে হাসতে বলল, ‘ওঃ, এই ব্যাপার?’
শিবশঙ্কর মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, হেসো না। নিত্য পাগলাটে ঠিকই, কিন্তু উলটোপালটা কথা ও মোটেই বলে না। একরোখা লোক, মাথায় যেটা ঢুকবে সেটা সে করবেই, কিন্তু তাই বলে, বাবা যেরকম বললেন যে তার কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা মোটেই ঠিক নয়। বাবা তাকে অতি-পণ্ডিত বলে ঠাট্টা করলেন, কিন্তু সত্যি সত্যিই সে যথেষ্ট লেখাপড়া জানা লোক। পরোপকার ছাড়া তার অন্য নেশা বই পড়া। দিনরাত বইয়ের ভেতরেই ডুবে থাকে। তার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।’
সমরেশ বলল, ‘ঠিক আছে। কথাটা মনে রাখা যাবে।’
কথায় কথায় শিবশঙ্কর বাসরাস্তায় এসে পড়লেন। বললেন, ‘এই রাস্তায় আরও মাইল চারেক গেলে মহীপালের দিঘি শুরু। একেবারে রাস্তার ওপরে নয়, কিছুটা ভেতরে ঢুকতে হবে। আর এই হল আমার হাসপাতাল। আমি এখন এখানে নেমে যাব। তুমি গাড়িটা নিয়ে এই বাসরাস্তা ধরে মাইলখানেক গেলেই ডান হাতে ইনস্পেকশন বাংলোটা দেখতে পাবে। একটা বোর্ড আছে নজর রেখো।’ বলে সামনে একটা বাগানওলা চুনকাম করা একতলা লম্বাটে বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করালেন। তারপর বললেন, ‘আমাদের হাসপাতালটা ছোটো বটে, কিন্তু সবরকম ব্যবস্থাই প্রায় আছে। একেবারে লেটেস্ট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি হয়তো নেই, কিন্তু যা আছে…’
সমরেশ সহাস্যে জিজ্ঞেস করল, ‘সেগুলো চলে তো?’
শিবশঙ্কর মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘চলে। আশ্চর্য, নয়?’
.
ইনস্পেকশন বাংলো খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হল না। একসার ঝুপসি দেওদার গাছের আড়ালে টালির ছাদের বাড়ি, সামনে চওড়া টানা বারান্দা। বিশাল বিশাল খড়খড়ি-পাল্লার সবুজ রঙের দরজার সামনে দুটো বেতের চেয়ারে সমরেশের দুই সার্ভেয়ার বাসুদেব পাল আর তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট অজয় সরকার ব্যাজার মুখে বসে ছিলেন। সমরেশের গাড়ি ঢুকতে দেখে দু-জনে উঠে দাঁড়ালেন।
বাসুদেবের বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, রোদে-পোড়া তামাটে গায়ের রং, মাথায় বেশ বড়োসড়ো টাক, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর সাদা বুশশার্ট। অজয়ের বয়েস অনেক কম। বাইশ তেইশ হবে। লম্বাটে গড়ন। তবে চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা থাকায় বয়সের তুলনায় বেশি গম্ভীর বলে মনে হয়। তার পরনে খাকি ফুলপ্যান্ট আর রংচঙে হ্যান্ডলুম শার্ট।
প্রাথমিক কুশল সংবাদ বিনিময়ের পর সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘পালবাবু, আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে? কতদূর এগোল?’
বাসুদেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ারের হাতলের বুনুনির ডিজাইনটা দেখলেন, তারপর নখ দিয়ে সেটা খুঁটতে খুঁটতে মুখ না তুলেই বললেন, ‘কাজকর্ম চলছে স্যার, কিন্তু—’
‘কিন্তু কী?’
‘গোলমাল আছে, স্যার।’
‘গোলমাল কীরকম?’
বাসুদেব মাথা চুলকে বললেন, ‘গোলমাল, স্যার, দু-রকমের। প্রথমত জায়গাটা ভালো নয়।’
‘কীরকম? সাপখোপ না বাঘ-ভাল্লুক?’
বাসুদেব ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, ‘স্যার, গত তিরিশ বছর সার্ভেয়ারের কাজ করছি। মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে, হেন জায়গা নেই যেখানে কাজ করিনি। বাঘ-ভাল্লুক বা সাপখোপে আমি ডরাইনে, এই অজয়ের মতো ছেলেছোকরার কথা অবশ্য আলাদা। ব্যাপার তা নয়। এই জায়গাটা ভালো নয় বলতে আমি হয়তো ঠিক এক্সপ্লেন করতে পারব না, কেমন যেন, স্যার। এমন একটা বিচ্ছিরি স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া, এই শীতকালেও, যে মনে হয় যেন হাড়ের মধ্যে পর্যন্ত শ্যাওলা জমে যাচ্ছে। আর, বাতাসে কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ। মিষ্টি মিষ্টি, অথচ গা গুলোয়। ঘরে ফিরে এসে আর খেতে ইচ্ছে করে না। আর একটা অদ্ভুত জিনিস, স্যার। এখানে দেখছেন তো, এই ভরদুপুর বেলাতেও কত পাখি-টাখি ডাকছে? ওখানে কিন্তু স্যার কোনো আওয়াজ নেই। আমি লক্ষ করে দেখেছি, কোনো পাখি নেই ওই জঙ্গলে।’ বলে দম নেওয়ার জন্যে থামলেন।
অজয় গম্ভীর মুখে বাসুদেবের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলল, ‘এই নৈঃশব্দ্য আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে, স্যার। বিকেলের দিকে মনে হয়, এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাই, নয়তো এখানেই গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়ব। সে-ঘুম আর ভাঙবে না কোনোদিন।’
সমরেশ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘অজয়, তুমি কি কবিতা লেখো?’
‘হ্যাঁ স্যার, লিখি। আপনি কী করে জানলেন?’
‘এই, এমনিই। তা, পালবাবু, দ্বিতীয় গোলমালটা কী? আপনি তো দু-রকম গোলমালের কথা বলছিলেন, নয়?’
‘হ্যাঁ, স্যার। দ্বিতীয় গোলমালটা হচ্ছে, আমাদের এই থিওডোলাইট, চেন আর স্টাফ বইবার জন্যে কোনো লোক পাচ্ছি না। পাচ্ছি না মানে, লোক টিকছে না। যাকেই ধরে আনছি, সে-ই দু-দিন বাদে কেটে পড়ছে। আমরা প্রথমদিকে ভেবেছিলুম, জায়গাটার ভয়ে। গতকাল জানতে পেরেছি, ব্যাপারটা তা নয়।’
‘ব্যাপারটা কী?’
‘কেউ ওদের ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তাড়াচ্ছে, স্যার।’
‘বলেন কী? কী করে জানলেন?’
‘দেখুন, প্রথম আমরা যে ছেলেটিকে নিয়েছিলুম, সে এই রাজমৈশি গাঁয়েরই ছেলে। তার সন্ধান দিয়েছিল এই ডাকবাংলোর চৌকিদার রাজারাম। ছেলেটা ভালো ছিল, কিন্তু দশ দিন বাদেই পালিয়ে গেল। তখন এই রাজারামই, ওপাশের আর একটা গ্রাম, নিমগাছিয়া থেকে আর একটা ছেলে ধরে নিয়ে এল। সে চার-পাঁচ দিন বাদেই কেটে পড়ল। তখন, আমরা সিঙ্গুর থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে এলুম। সে তিন দিন ছিল, গতকাল পালিয়েছে। যাবার আগে বলে গেছে, তাকে নাকি কে বলেছে যে সে যদি আমাদের সঙ্গে কাজ করে তবে তাকে মেরে মহীপালের দিঘিতে ভাসিয়ে দেবে। যে বলেছে তার ডেসক্রিপশন দেবার জন্যে ছেলেটাকে অনেক রিকোয়েস্ট করলুম, কিন্তু সে কোনো খবরই দিলে না। বললে, তাকে মারধর দিলেও আর কিছু সে বলবে না।’
‘বটে! এ তো ভালো নয়।’
‘নয়ই তো, স্যার। আমাদের তো ধারণা ওই জলা জায়গার ভেতর কিছু অসামাজিক কাজকর্ম চলছে। আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।’
সমরেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, তাই দিতে হবে। কিন্তু কাজকর্ম চলবে কীভাবে?’
বাসুদেব মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে বললেন, ‘কী জানেন, স্যার? আমার তো বয়েস হয়ে গেছে। থিওডোলাইট বা ডাম্পি লেভেল আর চেন বয়ে বয়ে কাজ করার ক্ষমতা আর নেই। আর এই অজয়টা ছেলেমানুষ। দু-চারদিন ও যে এইসব ক্যারি করেনি তা নয়, তবে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে।’
সমরেশ ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, ‘আরে, না, না। কী আশ্চর্য! আমি কি আপনাদের এসব বয়ে বয়ে সার্ভে করতে বলেছি নাকি? আমি আজই কলকাতায় টেলিফোন করে লোক আনাবার বন্দোবস্ত করছি। হেড অফিস থেকে আমাদের যে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে যে আনস্কিল্ড লেবার স্থানীয় লোকেদের থেকে নিতে হবে, এক্ষেত্রে তো সেটা আনা যাচ্ছে না দেখছি। আচ্ছা, আপনাদের ওপর কোনোরকম হামলা বা ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়নি তো?’
বাসুদেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘না স্যার, সেরকম কিছু হয়নি।’
‘আপনারা যখন কাজ করেন, তখন লোকজন দেখতে পান?’
‘না, স্যার। জনমনিষ্যি নেই।’
অজয় গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি তো আপনাকে বলেছি স্যার, যে ওখানে এমন নিঃশব্দ নির্জনতা যে আমরা নিজেদের নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাই। একটু কান পাতলে হয়তো হৃদয়ের ধুকধুক শব্দও…’
সমরেশ বাধা দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। তাহলে চলুন, সাইট থেকে ঘুরে আসা যাক।’
.
সমরেশ বলল, ‘সল্ট লেক সিটি এখন যেখানে হয়েছে, সে-জায়গাটা আগে কেমন ছিল দেখেছ তুমি? এই মহীপালের দিঘি ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। যতদূর দৃষ্টি যায়, জল, শুধু জল। কিন্তু একটা অখণ্ড জলাশয় নয়। অসংখ্য ছোটো বড়ো পুকুর বা বিলের সমষ্টি। কোনোটাই খুব গভীর নয়। সেটা বোঝা যায় কারণ প্রায় সর্বত্রই এই বিলগুলোর ভেতর থেকে গাছ বা বড়ো বড়ো ঘাস জলের ওপর মাথা তুলে আছে। আর সল্ট লেকের সঙ্গে তফাত এই যে এই বিলগুলোর মাঝখানে যে ডাঙাজমি আছে সেখানে প্রায় সর্বত্রই দুর্ভেদ্য জঙ্গল। রাস্তার ধার থেকে এই জঙ্গলের শুরু, সমস্ত জলাভূমিটাই ঘিরে আছে। অন্যপাশে কতদূর গেছে বলতে পারব না। আর এই জঙ্গলটা সত্যিই কেমন ভূতুড়ে। জনবসতি তো নেইই, তেমন কোনো পশুপাখিও ওখানে থাকে বলে মনে হয় না। তার অবশ্য একটা সম্পূর্ণ নৈসর্গিক কারণ আছে। এই বিলগুলোর জলে অনবরত ভুড়ভুড়ি উঠছে, সেটা অবশ্যই মার্শ গ্যাস। তার ফলে জায়গাটা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, মানুষের পক্ষে তো বটেই, জন্তুজানোয়ারের পক্ষেও। আর এই গ্যাসের থেকেই যে আলেয়ার সৃষ্টি হয়, তাতে সন্দেহ নেই।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কোনোরকম জন্তুজানোয়ার নেই বুঝলে কী করে?’
‘না, মানে, সেরকমই মনে হয়। তবে সাপখোপ, পোকামাকড় থাকতে পারে। কিছু ছোটোখাটো জন্তু থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু বড়ো জানোয়ার নেই। শেয়াল বা বুনো শুয়োর থাকলে তাদের চলার পথ কিছু নজরে পড়ত। আমি যতটা ঘুরেছি, কোথাও সেরকম দেখিনি। গাছেও বাঁদর বা হনুমান চোখে পড়েনি।’
শিবশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, ‘এহেন একটা জায়গায় কী সার্ভে করছ হে তোমরা? এখানে যদি কোনোদিন কোনো প্লান্ট বসেও, লোকজন থাকতে পারবে?’
সমরেশ হাসল। বলল, ‘প্লান্ট বসলে তার আশপাশের জায়গাটা ডেভেলপ না করে কি আর বসবে? যেমন সল্ট লেক সিটিতে হয়েছে, সেরকম একটা কিছু হবে নিশ্চয়ই। অতটা ব্যাপক হারে না হলেও খানিকটা তো হবেই। তা ছাড়া যে জায়গাটায় আমাদের সার্ভে চলছে, সেটা একটা উঁচু জায়গা। ঢিবি মতন। তার ওপরে ঝোপঝাড় আছে কিন্তু জঙ্গল নেই। অজয় যেরকম বলেছিল সেরকম মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ এখানেও পাওয়া যায়, কিন্তু স্যাঁৎসেঁতে ভাবটা কম। ওপরে দাঁড়ালে একটা দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি বলে মনে হয়। বাসুদেব পাল বলছিলেন প্রথম দিন ওখানে গিয়ে অজয় নাকি পনেরোটা কবিতা লিখে ফেলেছিল। এখন আর অবশ্য লেখে না।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘আমার মনে হয় ওখানকার ওই ডিপ্রেসিং আবহাওয়ার জন্যেই তোমাদের নেওয়া ছেলেগুলো পালাচ্ছে। ওরা তো তোমার ওই দুই সার্ভেয়ারের মতো স্থায়ী কর্মচারী নয়, ওদের বয়ে গেছে অমন অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় সারাদিন কাজ করতে। অকারণে পালালে কেমন কেমন দেখায়, তাই ওই ভয়-টয় দেখানোর গল্প ফেঁদেছে।’
গায়ত্রী মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না, তা কী করে হবে। একটা ছেলে এখানকার, একজন নিমগাছিয়ার, একজন এসেছিল সিঙ্গুর থেকে— তিনজনেই একই কথা বলছে? তা কখনো হয়? আমার বাপু মনে হচ্ছে, ওখানে কোনো গোলমাল আছে। তুমি কি বল, দময়ন্তী?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘মনে হলেই তো হল না। কী গোলমাল সেটা অনুমান করতে হবে। যেখানে জনপ্রাণী নেই বা থাকতে পারে না, সেখানে কী ধরনের গোলমাল থাকতে পারে? আর সেই গোলমাল পাকাবেই-বা কে? স্মাগলিং? কী স্মাগলিং? মাল আসবেই-বা কোত্থেকে, যাবেই-বা কোথায়? গোপন অস্ত্রশস্ত্রের কারখানা? অসম্ভব। মেয়েছেলের ব্যাবসা? ব্যাবসাই-বা করবে কে, খরিদ্দারই-বা হবে কে? অমন স্যাঁৎসেঁতে জায়গায় কার দায় পড়েছে ফুর্তি করতে যেতে? আর যাই হোক না কেন, গোলমাল থাকলেই গাড়ি বা ট্রাক-ফ্রাকের একটা ব্যাপার থাকে। আমি কতদিন গভীর রাত্রে ও রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে এসেছি, কোনোদিন তেমন কিছু নজরে পড়েনি।’
গায়ত্রী বললেন, ‘চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালাও, নজরে তোমার কোনোদিনও কিছু পড়ে কি? না, না, তোমার কথা আমি মানতে পারছি না। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে ওখানে। তাই না দময়ন্তী?’
দময়ন্তী বলল, ‘জোর করে তো কিছু বলা চলে না। তবে কী জানেন ডাক্তার সাঁতরা, আপনি যা বললেন, তা ছাড়াও আরও অনেক ক্রিমিনাল কার্যকলাপের পক্ষে ওই জায়গাটা প্রশস্ত হতে পারে। যেমন ধরুন, চোরাই মাল লুকিয়ে রাখার জন্যে ওটা একটা খুব ভালো জায়গা। একদিন গিয়ে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রাখলেন, পুলিশ খোঁজাখুঁজি বন্ধ করার পর একদিন গিয়ে নিয়ে এলেন। হয়তো দশ মিনিট বিশ মিনিট সময় আপনাকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাটাতে হল। লাভটা যদি ভালো হয়, তাহলে তো সেটা সহ্য করা কোনো ব্যাপারই নয়।’
গায়ত্রী উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। তোমার ওই ডাক্তার সাঁতরার নজরে ভালো মন্দ কিছুই পড়ে না। কেবল রোগ আর রুগি নিয়েই আছেন। অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়া মানুষের যে আর কোনো কর্তব্য থাকতে পারে তা বিশ্বাসই করতে পারেন না। আমি বাপু সনৎকে খবর দিচ্ছি। তুমি ওর সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলো।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘কথাবার্তা বলবে? কেন? ওখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা নিয়ে দময়ন্তীর মাথা খাটানোর দরকারটা কোথায়?’
গায়ত্রী কিঞ্চিৎ উষ্মার সঙ্গে বললেন, ‘দরকার কোথায় তুমি কী করে বুঝবে? ওখানে সমরেশ কাজ করছে না? যদি ওর একটা কিছু হয়ে বসে? না, না, আমি কাল সকালেই সনৎকে ডেকে পাঠাচ্ছি। এখন সবাই ওঠো তো। হাত-মুখ ধুয়ে নাও। রাত্রের খাওয়াটা শেষ করে আমায় উদ্ধার করো।’
.
সনৎ গম্ভীর মুখে সমস্ত কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন সমরেশবাবু, আপনার সার্ভেয়ারটা যা বলেছেন, তার সব কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওখানে যে একটা ক্রিমিনাল ব্যাপার ঘটছে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে পুলিশ অবশ্যই অ্যাকশন নেবে। আপনি তাহলে আমার সঙ্গে থানায় চলুন, একটা এফআইআর প্রথমেই করে ফেলা যাক। তারপরে, যা করবার তা করা যাবে।’
গায়ত্রী বললেন, ‘সে তো হল অফিশিয়াল কর্তব্য। এবার বলো দেখি, ওখানে কী ক্রিমিনাল ব্যাপার ঘটতে পারে? এদিক-ওদিক মিলিয়ে কোন না পাঁচ-ছ-টা গ্রাম হবে। তাদের কোনো বিপদ-আপদ ঘটবে না তো?’
সনৎ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘দেখুন, তদন্ত না করে তো এ ব্যাপারে একেবারে সঠিক কিছু বলতে পারব না। তবে ঘটনাটা অদ্ভুত সন্দেহ নেই। কারণ, এ অঞ্চলে বড়ো ধরনের অপরাধ সাধারণত বড়ো একটা ঘটে না। বুদ্ধিমান, তীক্ষ্নধী দুষ্টু লোক এ অঞ্চলে প্রায় নেই বললেই চলে। তা বলে কি ক্রাইম নেই? আছে। চুরিচামারি আছে, ক্বচিৎ কখনো ডাকাতি হয়, জমির দখল নিয়ে মাথা ফাটাফাটি রক্তারক্তি হয়, দু-একটা খুনও যে হয় না তা নয়। কিন্তু বেশ সাজিয়ে-গুজিয়ে একটা গভীর অপরাধ দিনের পর দিন চালিয়ে যাবার মতো লোক এ অঞ্চলে তেমন কেউ আছে বলে জানি না। যদিও মহীপালের দিঘি একটা অত্যন্ত নির্জন জায়গা, বদমাশ লোকেরা যেরকম পছন্দ করে আর কি, তবু ও অঞ্চলে সন্দেহজনক কোনো ঘটনার রিপোর্ট আমার কাছে নেই। অনেক রাত্রেও বড়োরাস্তার দিকে মাঝে মাঝে লোকজন চলাচল করে। তারা ভয়ে ভয়ে যায়, কিন্তু সে-ভয় ভূতের, মানুষের নয়। অথচ সমরেশবাবুর কথায় মনে হচ্ছে, ওঁদের সার্ভেয়ারদের ওখানে যাবার থেকে কেউ নিরস্ত করবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, ওখানে কিছু একটা ঘটছে যা কেউ অন্য লোকের অগোচরে রাখতে বদ্ধপরিকর।’
দময়ন্তী বলল, ‘মহীপালের দিঘিতে যাতে স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের কাজটা না হয় তা কিন্তু অনেকেই এখানে চান। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল বলে শুনেছি।’
গায়ত্রী বললেন, ‘ঠিক কথা, কিন্তু তাঁদের কেউই পাজি লোক, একথা মেনে নিতে কষ্ট আছে। প্রথমত, ধরো অভিমন্যু হাজরা। ইতিহাসের অধ্যাপক, জুবিলি কলেজে আছেন অনেক বছর। তাঁর বিশ্বাস, ওই মহীপালের দিঘির জলের নীচে আর উঁচু-নীচু ঢিবিগুলোর মধ্যে দুর্দান্ত ইতিহাস লুকিয়ে আছে যা ওখানে বাড়িঘরের ভিত-টিত খুঁড়তে গেলে চিরকালের জন্যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, দীনেশ বিশ্বাস, থাকেন ওদিকের গ্রাম নিমগাছিয়ায়। তাঁর ধারণা মহীপালের দিঘি দেবস্থান। আলেয়ার আলো যা দেখা যায় তা আসলে দেবতাদের জ্যোতি। ওখানে মানুষের খোঁড়াখুঁড়ি করা একদম উচিত নয়, করলে সকলের মহা অকল্যাণ হবে।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘কী করেন দীনেশ বিশ্বাস?’
‘সিঙ্গুরে একটা সরকারি দপ্তরে চাকরি করেন। তৃতীয়ত, নিত্যগোপাল দাস। তাঁর ধারণা মহীপালের দিঘি ডিস্টার্ব করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ফলে, বৃষ্টিবাদলা বন্ধ হয়ে খেতখামার জ্বলে যাবে।’
দময়ন্তী আবার প্রশ্ন করল, ‘ইনি কী করেন?’
‘জমিজমা আছে, চাষবাস করেন। পয়সাওলা লোক। পড়াশুনোও প্রচুর। আর চতুর্থত, শরৎ চক্রবর্তী। তাঁর আবার ধারণা যে ওখানে অফিস-কাছারি হলে প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। বাইরের লোকজন আসবে, শহুরে মানুষরা আসবে। আমাদের এদিকের সমাজ তার ফলে ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। শরৎবাবু ইস্কুল মাস্টার। তবে এখানে নয়, সিঙ্গুরের কোনো ইস্কুলে পড়াতে যান রোজ। আর একটা কথা, এঁদের প্রত্যেকের পেছনেই চার-পাঁচজন করে চ্যালা আছে। তাঁরা কথা বেশি বলেন না, কেবল মাথা নাড়েন।’
সমরেশ বলল, ‘অর্থাৎ আপত্তির পেছনে আছে হয় ইতিহাস, নয়তো সংস্কার, নয়তো প্রকৃতি, তা না হলে সমাজ। চমৎকার! কিন্তু তার চেয়েও চমৎকার যে আপনি এত ডিটেলস জানলেন কোত্থেকে এবং কীভাবে?’
সনৎ হাত নেড়ে বললেন, ‘খুব সহজে। কৃত্তিবাসবাবুর ঘরে মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা যে আলোচনা সভা বসে, পাশের রান্নাঘর থেকে সবই ওঁর কানে যায়। ফলে, এদিককার চার-পাঁচখানা গ্রামের যাবতীয় রাজনীতি ওঁর নখদর্পণে।’
গায়ত্রী বললেন, ‘কেবল শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে কেন, আমার ঘরেও সভা বসে। তবে সেটা গিন্নিদের। ফলে, কেবল বাইরের রাজনীতি নয়, ভেতরের খবরও আমার কাছে সবই পাবে পুলিশ সাহেব।’
সনৎ সহাস্যে বললেন, ‘বেশ তো। তাহলে জঙ্গলের ভেতরে কী হচ্ছে সেটা বলে দিলেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়।’
গায়ত্রী মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘আমি ঘরের খবর রাখি, জঙ্গলের নয়। সে-খবর রাখার দায়িত্ব তোমার। আর এই যে দময়ন্তী রয়েছে। সে তোমাকে সাহায্য করতে পারে।’
সনৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওঁর সম্পর্কে আমি জানি। তবে, এই যে ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, তার জন্যে আমার মতো ক্ষুদ্রবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই যথেষ্ট। ওঁর মগজ ঘামানোর পক্ষে উপযুক্ত উত্তেজনাপূর্ণ কোনো রহস্য এর মধ্যে আছে বলে তো আমার মনে হয় না।’
দময়ন্তী কিছু বলবার জন্যে মুখ খুলতেই সনৎ বাধা দিয়ে বললেন, ‘না, না, আপনি যেন ভাববেন না যে আপনি পুলিশকে ক্রাইম ডিটেকশনে সাহায্যই করে থাকেন, তা আমার জানা নেই। বা, আপনি আমাদের কোনো কাজে ইন্টারফিয়ার করেন না, তাও আমি জানি। আসলে, কথাটা আমি সত্যি ভেবেই বলছি, অভিমান বা ঈর্ষাবশত নয়।’
দময়ন্তী আবার কিছু বলতে গিয়েই মৃদু হেসে চুপ করে গেল। কিন্তু ধমকে উঠলেন গায়ত্রী। বললেন, ‘তুমি থামো তো! দময়ন্তী যদি ইন্টারফিয়ার না-ই করে, তবে ওর পরামর্শ নিলে তোমার ক্ষতিটা কী? আমরা একটু দেখি যে ও কাজ করে কীভাবে।’
এবার দময়ন্তী মুখ খুলল। বলল, ‘ছোটোকাকি, কথাটা উনি ঠিকই বলেছেন। আমার এ ব্যাপারে সাহায্য করার কোনো দরকারই হবে না। দেখুন না, দু-একদিনের মধ্যেই উনি সব ঠিক করে দেবেন।’
সনৎ বললেন, ‘ঠিক আছে। তাহলে, সমরেশবাবু চলুন আমরা একবার থানায় যাই। এফআইআর করার পর আপনি একটু থেকে যাবেন। আমি ইতিমধ্যে যে ছেলেটি প্রথমে আপনাদের কাজে জয়েন করেছিল তাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসব। তাকে জেরা করে দেখা যাক কিছু বের করা যায় কি না।’
.
সমরেশ থানা থেকে ফিরল দুপুর নাগাদ। ততক্ষণে শিবশঙ্করও ফিরে এসেছেন। দময়ন্তী আর গায়ত্রীর সঙ্গে উনিও নীচে সমরেশের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।
সমরেশ একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা যত সহজ বলে মনে হয়েছিল ততটা বোধ হয় নয়।’
তিনজনে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
‘ব্যাপারটা বলি। যে ছেলেটি আমাদের কাছে প্রথম এসেছিল, সে ডাকবাংলোর চৌকিদার রাজারামেরই বোনপো। নাম ভবেন মান্না। বয়েস চোদ্দো কি পনেরো হবে। ভবেনের মা বিধবা, রাজারামের কাছেই থাকে। অত্যন্ত গরিব, আমরা তাকে যে টাকা দিচ্ছিলুম, সেটা তার কাছে আশাতীত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আমাদের কাজ করতে রাজি নয়।’
‘কেন?’
‘সেটাই তো সে কোনোমতেই বলতে চাইছে না। সনৎবাবু অনেক জিজ্ঞেস করলেন, কাকুতি-মিনতি করলেন, ধমক লাগালেন, কিছুতেই কিছু হল না। ভবেনের খালি এক কথা, ওখানে কাজ করব না। তাতে যদি না খেতে পেয়ে ভিক্ষে করতে হয়, তবুও না। যতই তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কেন সে কাজ করবে না, ততই সে ওই একই কথা বলে। রাজারামকেও ডেকে আনা হয়েছিল। সে-ও কোনো কথা বলে না। সব প্রশ্নেরই তার এক জবাব, আমি কিছু জানিনে, স্যার।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি দেখে মনে হল যে দু-জনেই কোনো কারণে সন্ত্রস্ত?’
‘না, ঠিক তা মনে হল না। ভবেন অবশ্যই একটু ভয়ে ভয়ে কথা বলছিল, সেটা পুলিশের সামনে কমবয়সি ছেলের পক্ষে অবাক হবার মতো কিছু নয়। কিন্তু, রাজারামকে মোটেই ভীত বলে মনে হল না। বরং মাঝে মাঝে সে রাগ রাগ করে ভাগনের দিকে কটমটিয়ে তাকাচ্ছিল।’
‘তুমি ঠিক দেখেছ?’
‘একদম ঠিক।’
‘রাজারামকে একবার ডেকে আনতে পারো?’
গায়ত্রী পরম উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘ও ডেকে আনতে যাবে কেন? আমি লোক পাঠাচ্ছি। এক্ষুনি ডেকে আনবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, না, এক্ষুনি ডেকে আনার দরকার নেই! এখন হয়তো খেতে-টেতে বসবে। বিকেল বেলা ডেকে আনলেই হবে।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘তাহলে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে আমিই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব’খন। এখন চলো, আমরা খাওয়াটা সেরে ফেলি। তারপর আমি আর সমরেশ একসঙ্গে বেরোব।’
গায়ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকে আবার কোথায় নিয়ে যাবে?’
‘হাসপাতালে। না, না, ভরতি করার জন্যে নয়, টেলিফোন করার জন্যে। ও কলকাতায় ওদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের টেলিফোন অপারেটার গৌরাঙ্গবাবুকে লাগিয়ে দেব। জানোই তো, ভদ্রলোকের অপরিসীম ধৈর্য।’
.
রাজারাম কৃশকায়, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, পক্বকেশ, বয়েস ষাট ছুঁই ছুঁই। পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, খাকি হাফশার্ট আর বিষম মোটা খাকি রঙের হাতকাটা সোয়েটার। দু-পায়ে পট্টি বাঁধা, কিন্তু জুতো নেই। হাতে পায়ে প্রচণ্ড খড়ি। চোখ দুটি কিঞ্চিৎ রক্তবর্ণ, সেটা ভালোই, নইলে ওর গায়ের রঙের ওপর একেবারে সাদা হলে বোধ হয় অন্য লোকের তাকাতে ভয় হত। তবে দাঁতগুলো একেবারে সাদা— তাকাতে অসুবিধে হয়।
রাজারাম গাড়ি থেকে চিন্তিত মুখে নামল, কিন্তু উপস্থিত সকলের মধ্যে বোধ হয় পুলিশ জাতীয় কাউকে না দেখে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হল। সে ঘরে ঢোকামাত্র দময়ন্তী তার সঙ্গে প্রবল বেগে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল আর একটু বাদেই দেখা গেল রাজারাম মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে বেশ স্বচ্ছন্দেই সেই আলাপে অংশগ্রহণ করেছে।
এই আলাপ থেকে জানা গেল, রাজারাম স্থানীয় লোক নয়, এসেছে মেদিনীপুর থেকে। এই ডাকবাংলোয় আছে গত তিরিশ বছর। তার কোনো ছেলেপিলে নেই, স্ত্রীও মারা গেছে প্রায় বিশ বছর হল। ভবেনের মা গিরি তার বোন। বিধবা হয়েছিল বছর পনেরো আগে, ভবেন তখন কয়েক মাসের। শ্বশুরবাড়িতে লাথি-ঝ্যাঁটা খাচ্ছিল দেখে রাজারাম তাদের নিজের কাছে নিয়ে আসে। একা থাকতে অসুবিধেও হচ্ছিল, গিরি আসায় অনেক ঝঞ্ঝাট কমে গেল। ভবেনকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছে, কিন্তু গিরির এমনই কপাল, ছেলেটা মানুষ হল না। ওকে পুলিশে ধরবে না তো কে ধরবে? হতভাগা শেষে কিনা চোর হয়ে দাঁড়াল! এরপর তো মানুষ খুন করবে! ওকে পুলিশের হাতেই শেষ পর্যন্ত মরতে হবে, এ বিষয়ে রাজারামের কোনো সন্দেহ নেই।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সে যে কী চুরি করেছে, সেটা কিছুতেই রাজারামের কাছ থেকে বের করা গেল না। সেটা জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘কী জানি কী চুরি করেছে।’ অথচ, চুরি যে করেছে সে-বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। এবং তার জন্যে তার বিবেক দংশনেরও শেষ নেই। তার নিজের মানুষ করা ছেলে তো!
এ ছাড়া, আর একটা ব্যাপারেও রাজারামের কথা অসংলগ্ন। ভবেনের চুরি করার সঙ্গে মহীপালের দিঘিতে কাজ না করার কী সম্পর্ক? সে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করলে তো চুরি করার অভ্যেসটা কেটেও যেতে পারত? কিন্তু এ ব্যাপারে রাজারাম ঠিক সরলভাবে উত্তর দিল না। কখনো বলে, সে ভালো ছেলে নয় বলে তাকে বারণ করে দিয়েছে সে। কখনো বলে, তার মা-র ইচ্ছে নয়। কখনো বলে, ভগবান চান যে সে ওখানে কাজ করে দুটো পয়সা ঘরে আনুক। মোট কথা, কোনোটাই ঠিক যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নয়।
রাজারাম চলে গেলে সমরেশ ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘অদ্ভুত লোক! সৎ না অসৎ তাই বুঝতে পারলুম না। ভাইপোকে আড়াল করতে চাইছে অথচ সে চুরি করেছে সেটা থাবা চাপড়িয়ে বলে বেড়াচ্ছে। আড়ালই যদি করবে তো সেকথাটা চেপে গেলেই হয়। পুলিশ তো আর ছেলেটাকে চুরির দায়ে ধরেনি। গায়ে পড়ে সেটা বলবারই-বা দরকার কী?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘বোকা, বোকা! তার যে ঘটে বুদ্ধির অভাব, এ তো সবাই জানে।’
গায়ত্রী কিন্তু কথাটা মানতে পারলেন না। বললেন, ‘তুমি আর রাজারামকে কতটা চেনো? আমি চিনি ঢের বেশি। ও মোটেই বোকা নয় আর অসৎও নয়।’
‘অসৎ নয় কী করে বুঝলে?’
‘প্রায় পাঁচ বছর ও আমাকে দুধ দিত। কোনোদিন জল মেশায়নি। এমন লোক সৎ হবে না তো কী হবে তুমি?’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘তাতে কিন্তু প্রমাণ হয় যে লোকটা রীতিমতো বোকা!’
গায়ত্রী কিন্তু হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আজকের যে যুগধর্ম তাতে অবশ্য সবাই ওকে বোকাই বলবে। কিন্তু মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে বিচারটা অন্যরকম হবে। ধরো, আজকে যে কথাগুলো ও বলেনি, সেগুলো এখানে যদি বলে দিই, তাহলে—’
‘কী বলেনি রাজারাম?’
‘গিরি ওর আপন বোন নয়, বৈমাত্র বোন। আর এই বিমাতার অত্যাচারেই একদিন ওকে গৃহত্যাগী হতে হয়েছিল। এখন ওকে তোমরা অবশ্যই বোকা বলবে। কিন্তু কোথাও একদিন ওর প্রকৃত মূল্য কেউ বুঝতে পারবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
শিবশঙ্কর হাত নেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। বোঝা গেল ওই রাজারাম একটি শাপভ্রষ্ট দেবতা, কিন্তু তাতে করে সমরেশের কাজের কী সুরাহাটা হল? লোক কেন পালাচ্ছে? কে ভয় দেখাচ্ছে বা আদৌ দেখাচ্ছে কি? নাকি ওখানকার আবহাওয়ায় লোকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ছে? ব্যাপারটা কী দময়ন্তী কিছু বুঝলে?’
দময়ন্তী একটু চুপ করে থেকে ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘নাঃ, কিচ্ছু বুঝিনি।’
গায়ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তাহলে কী করবে?’
‘আমি আপনাকে গোটাকয়েক প্রশ্ন করব।’
‘আমাকে?’ গায়ত্রী চোখ কপালে তুললেন, ‘প্রথমেই আমাকে জেরা? ওমা, কোথায় যাব গো?’
শিবশঙ্কর তর্জনী তুলে বললেন, ‘কোত্থাও যাবে না, এখানেই থাকবে। হ্যাঁ, দময়ন্তী, তোমার জেরা শুরু করো তো। এতদিন আমিই কেবল পড়ে পড়ে মার খেয়েছি। এইবার—’
দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘না, না, জেরা করব কেন? আমি কেবল কয়েকটা কথা জানতে চাই। ছোটোকাকি যখন সকলের হাঁড়ির খবর রাখেন, তখন ওঁকেই প্রশ্নগুলো করা শ্রেয়, তাই নয়?’
শিবশঙ্কর ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, চালিয়ে যাও।’
.
দময়ন্তী বলল, ‘আচ্ছা ছোটোকাকি, আপনার কত বছর বিয়ে হয়েছে?’
‘সাতাশ বছর।’ সাবধানে হিসেব করে বললেন গায়ত্রী।
‘আচ্ছা, এই সাতাশ বছরে এই গ্রামে বা তার আশপাশের গ্রামে এমন কোনো ঘটনার কথা শুনেছেন যা আপনার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে?’
‘অস্বাভাবিক?’
‘হ্যাঁ। মানে আমি কেবল ক্রাইমের কথাই বলছি না, যেকোনো ঘটনা যা সাধারণত স্বাভাবিকভাবে ঘটে না।’
‘হুঁ, বুঝেছি। দাঁড়াও, ভেবে ভেবে বলি। এই ধরনের ঘটনার মধ্যে আছে অনেকগুলো চুরির কেস। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কেসটা হয়েছিল বিষ্ণু মন্দিরের বিগ্রহ চুরি। কলকাতা থেকে একদল লোক লরি করে এসে দিনদুপুরে বিগ্রহটা উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল। তখন ঠাকুরমশাই বিশ্রাম করছিলেন, আশপাশে লোকজনও কেউ ছিল না। আর মন্দিরের দরজা তো খোলাই ছিল।’
‘সেটা কত বছর আগেকার ঘটনা?’
‘তা প্রায় বছর কুড়ি হবে।’
‘তারপর এরকম ঘটনা আর ঘটেনি? শিবমন্দির বা কালী মন্দিরে এ ধরনের—’
‘না, এরকম ঘটনা আর ঘটেনি।’
‘আপনি বললেন চোরেরা কলকাতা থেকে এসেছিল। কী করে জানলেন?’
‘পুলিশ তাই বলেছিল। লরিটার নম্বর ছিল কলকাতার আর গিয়েছিলও সেইদিকে।’
‘অর্থাৎ মহীপালের দিঘির দিকে যায়নি, উলটোদিকে গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’
‘বেশ, তারপর বলুন।’
শিবশঙ্কর এখানে বাধা দিলেন। বললেন, ‘কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে মহীপালের দিঘির একটা সম্পর্ক আছে। ওই বিষ্ণু মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার বাবার ঠাকুমা কৃষ্ণভামিনী দাসী প্রায় দেড়শো বছর আগে। বিগ্রহটা ছিল অষ্টধাতুর আর তাঁকে সেটি দিয়েছিলেন একজন সন্ন্যাসী। এই সন্ন্যাসীটি মহীপালের দিঘিতে থানা গেড়েছিলেন এবং মূর্তিটি সম্ভবত সেখানেই তিনি পেয়েছিলেন।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘সন্ন্যাসীর শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল, জানেন? ওখানেই পার্মানেন্টলি থেকে গিয়েছিলেন?’
‘না। শুনেছি, হঠাৎ একদিন আমার প্রপিতামহী এবং অন্যান্য শিষ্যশিষ্যাদের বিষাদসাগরে ভাসিয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে না সেসব ফেলে রেখে?’
শিবশঙ্কর সহাস্যে বললেন, ‘না, না, সেসব নিয়েই। মানে, কেউ তাঁকে হাপিস করে দেয়নি, তিনি স্বেচ্ছায়ই কেটে পড়েছিলেন। আর সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওইখানে কেউ বেশিদিন সুস্থ অবস্থায় থাকতে পারে? যতই সন্ন্যাসী হও আর যোগবল থাকুক, মার্শ গ্যাস-এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন কর্ম।’
দময়ন্তী আবার গায়ত্রীর দিকে ফিরল। বলল, ‘তারপর বলুন।’
গায়ত্রী বললেন, ‘এই মূর্তি চুরির ব্যাপারটা ছাড়া বাকি সবকটা ঘটনাই ছোটোখাটো কেস। কিছু সিঁদেল চুরি, বেশির ভাগই ছিঁচকে চুরি। এরকম লেগেই আছে, থাকবেও। এরপর ধরো ডাকাতি।’
সমরেশ বলল, ‘লরি করে এসে মন্দির থেকে মূর্তি উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কি ডাকাতি নয়?’
‘না। আমরা এখানে ডাকাতি বলতে বুঝি একদল লোকের অস্ত্রশস্ত্র হাতে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে সর্বস্ব নিয়ে যাওয়া। তার মধ্যে কোনোরকম গোপনীয়তা তো থাকেই না, বরং দু-দশটা গ্রামের লোকও টের পায়। আগে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটত, আজকাল আর বড়ো একটা ঘটে না। সেটা অবশ্যই ভালো, কারণ এইসব ডাকাতিগুলো প্রায় সর্বদাই খুব ট্র্যাজিক হয়ে থাকে। যার বাড়িতে ডাকাত পড়ে তার যে কেবল সর্বস্ব যায় তাই নয়, তার কোনো কোনো প্রিয়জনেরও প্রাণহানি ঘটে। আর এই প্রিয়জনেরা সাধারণত অল্পবয়সি হয়ে থাকে, কারণ তারাই তো এগিয়ে যায় বাধা দিতে।
‘আমার বিয়ের পর এই ধরনের ঘটনা আমি প্রথম শুনি আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশেক আগে। নিমগাছিয়ার পেছনে বুড়োশিবতলা বলে একটা গ্রামে। যাঁর বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, তিনি তাঁর দুই ছেলে সহ নিহত হয়েছিলেন। বেঁচে ছিলেন তাঁর স্ত্রী আর এক বছর দশেকের নাতি। তাঁরা বাড়ির পেছনের জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন।’
শিবশঙ্কর পুনরায় বাধা দিলেন। বললেন, ‘তোমার এখানে বলা উচিত যে ওই জঙ্গলটা মহীপালের দিঘির জঙ্গলেরই এক্সটেনশন। আর তুমি বোধ হয় জানো না সেই নাতিটিই অধ্যাপক অভিমন্যু হাজরা।’
দময়ন্তী বলল, ‘বলেন কী? তাহলে তো অধ্যাপক হাজরার সঙ্গে একটু পরিচিত হতে হয়। ওই এলাকাটা সম্পর্কে ওঁর কাছ থেকে নিশ্চয়ই অনেক খবরাখবর পাওয়া যাবে?’
শিবশঙ্কর মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তা যাবে। অভিমন্যু ওই জঙ্গলটার অনেকটাই ঘুরে দেখেছে। এখনও ঘোরে। ওর ধারণা, ওখানে কোনো লুপ্ত সভ্যতার অস্তিত্ব ও খুঁজে বের করবে মাটির তলা থেকে। আর হ্যাঁ, তুমিও তো ইতিহাসের অধ্যাপিকা। তোমাদের আলাপটা বেশ জমবে ভালো।’
দময়ন্তী বলল, ‘দেখা যাক। হ্যাঁ ছোটোকাকি, তারপর বলুন।’
গায়ত্রী বললেন, ‘এরপর থেকে আর আজ পর্যন্ত আরও গোটা দশেক এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সবকটাই মর্মান্তিক। প্রত্যেক বাড়িতেই দু-একজন করে নিহত হয়। আর এই গ্রামের বিশ্বম্ভর দাসের বাড়িতে ডাকাতি করে ডাকাতরা লুঠের মালের সঙ্গে দাসবাবুর সতেরো বছরের বিধবা বোনটাকেও চুরি করে নিয়ে যায়।’
‘মেয়েটির কোনো হদিশ পাওয়া গিয়েছিল?’
‘নাঃ, তা কি আর যায়?’
‘সেটা কতদিন আগের ঘটনা?’
‘তা প্রায় কুড়ি বছর হবে।’
‘এই ডাকাতির কোনো কিনারাই হয়নি?’
‘একেবারেই হয়নি তা নয়। শুনেছি ওই দলের সর্দার গগন মণ্ডল ধরা পড়েছিল। কিন্তু লুঠের মালের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। লোকটার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।’
সমরেশ বলল, ‘তার মানে লোকটা কয়েক বছর আগে ছাড়া পেয়েছে। অবশ্য যদি সে বেঁচে থাকে।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘গগন যখন ধরা পড়ে তখন তার বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়েস। সে জেলে মরেছে, এরকম সম্ভাবনা কম। তার স্বাস্থ্য খুবই ভালো ছিল। আমি তাকে দু-একবার আমাদের হাসপাতালে দেখেছি। চেহারা দেখলে ভয় করত— একেবারে ডাকাত মার্কা।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘সে এই অঞ্চলেরই লোক ছিল?’
‘হ্যাঁ। তার বিধবা মা থাকত নিমগাছিয়ায়। তবে, তার দলটা ছিল তারকেশ্বর অঞ্চলের।’
‘মহীপালের দিঘিতে তাদের কোনো গোপন আস্তানা…’
‘না, সেরকম কিছু ছিল না বলেই মনে হয়। এরা একদিকে যতই ডাকাবুকো হোক, অন্যদিকে খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এরা ভূতের ভয়ে মহীপালের দিঘিটা এড়িয়েই চলত।’
‘গগন মণ্ডল যদি জেল থেকে বেরিয়ে থাকে, তাহলে সে এখন কোথায় আছে বা কী করছে, জানেন?’
‘না, জানি না। তবে সনৎকে বললে সে ঠিক খবর বের করতে পারবে। দীনেশ বিশ্বাসকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। গগন জেলে যাবার পর তার মা দীর্ঘদিন দীনেশের বাড়িতে কাজ করেছিল। খুব অর্থকষ্টে পড়েছিল কিনা।’
‘গগনের মা এখন কী করেন?’
‘এখন সে আর নেই। বছর তিনেক হল মারা গেছে। পাগলা কুকুর কামড়েছিল। ইঞ্জেকশন নেয়নি। জলাতঙ্ক হয়েছিল। কিছু করা যায়নি।’
‘বিশ্বম্ভর দাস কী করতেন?’
‘একরকম জোতদার বলতে পারো।’
‘গগন মণ্ডলের আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?’
‘সেটা অবশ্য আমার সঠিক জানা নেই। তবে থাকাটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখব?’
দময়ন্তী একটু চিন্তা করে বলল, ‘দেখতে পারেন, তবে খুব গোপনে। একেবারে যেন জানাজানি না হয়।’
শিবশঙ্কর চিন্তিত হলেন। বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে।’
দময়ন্তী পুনরায় গায়ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাকাতি তো হল। তারপর বলুন।’
গায়ত্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, এরপর আসছে খুনের ব্যাপারটা। আমি গোটা চার-পাঁচেকের কথা জানি। ও বোধ হয় আরও বেশি জানবে। প্রথমত ধরো, প্রফেসার হাজরার ঠাকুরদা আর তাঁর দুই ছেলে। দ্বিতীয়ত, এ গ্রামের রমেশ সামন্তর স্ত্রী। রমেশ তাঁর স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। শেষে একদিন রামদা দিয়ে…। মেয়েটির কোনো দোষ ছিল না, সে ভালো মেয়ে ছিল। রমেশের সন্দেহটা ছিল একটা মানসিক অসুখ। তৃতীয়ত, বুড়োশিবতলার ধনঞ্জয় মাঝির স্ত্রী কাটারি দিয়ে নিজের শাশুড়িকে খুন করেছিল। সে নাকি অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি। আর আমার শ্বশুরমশাইয়ের খাস চাকর নীলমণিকে কেউ তাঁর বাড়িতে সিঁদ কেটে ঢুকে খুন করে যায় আজ থেকে বছর দশেক আগে। সে-খুনের কোনো কিনারা হয়নি।’
‘রমেশ সামন্ত আর পার্বতীর কী হয়েছিল?’
‘রমেশের যাবজ্জীবন আর পার্বতীর বোধ হয় আট বছর জেল হয়েছিল।’
‘রমেশ এখন কোথায়?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘বোধ হয় কোন লুনাটিক অ্যাসাইলামে। সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। জেলেই।’
‘আর পার্বতী?’
‘তার কথা জানি না। ধনঞ্জয় আবার বিয়ে করেছে।’
‘ব্যস? আর কিছু?’
‘নাঃ, আর তো কিছু মনে পড়ছে না।’
দময়ন্তী অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইল। তারপর গায়ত্রীকে বলল, ‘আমি যদি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই, তাহলে তার ব্যবস্থা কি করা সম্ভব হবে? মানে, এখানকার সমাজে আবার কোনো গোলমাল হবে না তো?’
গায়ত্রী সহাস্যে বললেন, ‘সেটা নির্ভর করেছ তুমি কার সঙ্গে কথা বলতে চাও, তার ওপর।’
দময়ন্তী বলল, ‘আমি দেখা করতে চাই প্রফেসার অভিমন্যু হাজরা, দীনেশ বিশ্বাস, নিত্যগোপাল দাস, শরৎ চক্রবর্তী, বিশ্বম্ভর দাস এবং ধনঞ্জয় মাঝির সঙ্গে।’
‘অভিমন্যু হাজরা বা শরৎ মাস্টারের সঙ্গে কথা বলায় কোনো অসুবিধে নেই। তবে দু-জনের প্রকৃতি দু-রকমের। একজন ভদ্র সভ্য, অন্যজন ঠোঁটকাটা, রূঢ়ভাষী। নিত্যগোপালবাবু ওঁর বন্ধু, প্রায়ই আসেন। আর কথা বলতে উনি খুব ভালোই বাসেন, কার সঙ্গে বলছেন সে-ব্যাপারে কোনো বাছবিচার করেন না। বিশ্বম্ভর দাসের সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব, কারণ তাঁর এখন আশির ওপর বয়েস আর বদ্ধ কালা। ধনঞ্জয় মাঝি আর দীনেশ বিশ্বাসের বেলা ব্যাপারটা একটু স্বতন্ত্র।’ বলেই গায়ত্রী মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
‘কেন? স্বতন্ত্র কেন?’
‘কারণ, এঁদের দু-জনেরই দ্বিতীয় পক্ষ আর দু-জনেই তাঁদের স্ত্রীদের কথায় ওঠেন বসেন। কলকাতা থেকে আসা কোনো মহিলার সঙ্গে আলাপ করতে এঁরা রাজি হবেন বলে তো মনে হয় না।’ বলতে বলতে গায়ত্রীর হাসিটা আরও বিস্তৃত হল।
‘আর একটু খুলে বলুন।’
‘দীনেশ বিশ্বাসের ব্যাপারটা ট্র্যাজি-কমেডি বলতে পার, দুঃখেরও বটে আবার মজারও বটে। দীনেশবাবু অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। বাড়িতে পুজোআচ্চা, সাধুসন্ন্যাসী পালাপার্বণ লেগেই আছে। ওঁর বাড়ির ভেতরেই একটা মন্দির আছে। এইসব ধর্মকর্মের ফলে ওঁর প্রথম বিয়েটা গণ্ডগোল হয়ে যায়। ওঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী মায়ারানি এতই এতে মত্ত হয়ে পড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী সন্ন্যাস নেবেন এরকম কথাবার্তাও শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মায়ারানিই সন্ন্যাসিনী হয়ে গৃহত্যাগ করল, দীনেশ বিশ্বাস রয়ে গেলেন। দুষ্টু লোকেরা বলে এক সুপুরুষ সন্ন্যাসীর সঙ্গে নাকি মায়ারানির একটু ইয়ে হয়েছিল, দীনেশ ব্যাপারটা আঁচ করে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ান। তবে মায়ারানিকে বাধা দেননি, দিলে নাকি তাঁর প্রাণসংশয় হতে পারত। কিন্তু দীনেশ সেকথা বলেন না। তাঁর মতে মায়ারানির ভেতরে সত্যিই একটা অতীন্দ্রিয় ভাবের উদয় হয়েছিল। সে নাকি মাঝে মাঝে বিভূতিও দেখাতে শুরু করেছিল। তবে দীনেশ যতই ধর্মকর্ম করুন না কেন, তাঁর মধ্যে কিন্তু বৈরাগ্য আসেনি, তিনি মায়ারানির প্রভাবেই সন্ন্যাস নিতে যাচ্ছিলেন। শেষ মুহূর্তে মায়ারানি সেটা উপলব্ধি করে তাঁকে সন্ন্যাস নেওয়া থেকে বিরত করে এবং একাই এক যোগী মহাপুরুষের সঙ্গে হিমালয়ের দিকে চলে যায়।’
‘আপনি কার কথা বিশ্বাস করেন— দীনেশবাবুর না দুষ্টু লোকের?’
‘বলা কঠিন, জানো? মায়ারানিকে আমি দেখেছি। খুব সাধারণ গ্রামের মেয়ে, অত্যন্ত শান্ত আর চাপা প্রকৃতির ছিল। সে সবসময় বিষণ্ণ হয়ে থাকত, খুব কম কথা বলত। এই ধরনের মেয়েরা সাধারণত একগুঁয়ে প্রকৃতির হয়। কাজেই মায়ারানির পক্ষে ভৈরবী হয়ে গৃহত্যাগ করা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিন্তু তাকে দেখে কখনোই ঠিক গোপনে দুষ্কর্ম করা টাইপ বলে মনে হয়নি। তবে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম!’
‘তারপর কী হল?’
‘মায়ারানি গৃহত্যাগ করার বছরখানেক বাদে দীনেশ বিশ্বাস আবার বিয়ে করেন তাঁর প্রতিবেশী নারায়ণ মণ্ডলের একমাত্র মেয়ে টগরকে। দুষ্টু লোকেরা বলে দীনেশের নাকি অনেকদিনই টগরের দিকে নজর ছিল। মায়ারানি সরে যেতেই টগরকে…’
শিবশঙ্কর বাধা দিয়ে বললেন, ‘দুষ্টু লোকের আর দোষ কী। টগর তো দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। আর ওর হাসিটা— যেন নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি।’ বলেই দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন।
গায়ত্রী চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘অমন শেয়ালের মতো দাঁত বের করে আর হাসতে হবে না। নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি না আমার গুষ্টির পিণ্ডি। পেতনির হাসি বুঝেছ দময়ন্তী, একেবারে পেতনির হাসি। এপাড়ায় হাসলে ওপাড়ায় ঘাটের মড়া চমকে উঠে বসে।’
‘আপনি সে-হাসি শুনেছেন?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।
‘শুনিনি আবার? নারায়ণ মণ্ডল তো আগে আমাদের এই পাড়াতেই থাকতেন। পরে নিমগাছিয়ায় চলে যান। শ্বশুরের সম্পত্তি পেয়েছিলেন। টগরের তখন ষোলো-সতেরো বছর বয়েস হবে। ওর বিয়ে তো হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। তা সে-ও কোনো না ন-দশ বছর আগেকার কথা, কিন্তু এখনও সেই হাসি আমার কানে বাজে।’
শিবশঙ্কর মুখে পর্বতপ্রমাণ গাম্ভীর্য এনে বললেন, ‘আমারও বাজে।’
‘তা আর বাজবে না? টগরের হাসি শুনলেই তো তোমার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি বেড়ে যেত, সে কি আর আমি জানি না? অমন পড়শির মুখে আগুন।’
সমরেশ বলল, ‘এতে চটবার কী আছে? সেই গান শোনেননি? পড়োশনের হরষনে, শিহর লাগে মনে মনে…’
‘তা লাগুক, কিন্তু ও তো আর তখন বিরহী নয় যে অমনি ওর মন সুদূরপানে পাখা মেলবে! আমি পাশে আছি কোন কম্মে, শুনি? আসলে, তোমরা পুরুষমানুষরা মোটেই ভালো লোক নও, বুঝেছ? তা, থাকগে সেকথা। টগর মেয়েটি বিয়ের আগে একটু পুরুষঘেঁষা ছিল, কিন্তু বিয়ের পর সোয়ামিটিকে চোখের আড়াল করে না। রাস্তায়, ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, অফিসে বা নেমন্তন্ন বাড়িতে, কোথাও কোনো মেয়ের সঙ্গে চোখ তুলে কথা কইবার অনুমতি নেই দীনেশবাবুর। যদি তার অন্যথা হয় আর সেটা যদি টগরের কানে যায় বা চোখে পড়ে, তো ব্যস! তারপর সাতদিন দীনেশ বিশ্বাসের অফিস কামাই।’ বলে গায়ত্রী হেসে গড়িয়ে পড়লেন।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘আহা, অফিসে যাবে কী করে? সেই সাতদিন তো সে হাসপাতালে। আমি ফিট সার্টিফিকেট না দিলে অফিসে জয়েন কি করতে পারে? আর আমি বাপু গুরুতররূপে আহত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে কোনোরকম সার্টিফিকেট দিই না।’ বলে নকল গাম্ভীর্য ছেড়ে সকলের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলেন।
কিছুক্ষণ বাদে দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘মায়ারানিকে আপনি ক-বার দেখেছেন?’
গায়ত্রী একটু চিন্তা করে বললেন, ‘বোধ হয় তিন-চারবার।’
‘তার পোশাক-আশাক কি ভৈরবী ধরনের ছিল? মানে গেরুয়া বা রুদ্রাক্ষ?’
‘না, না। সাধারণ গৃহস্থের বাড়ির বউয়ের যেরকম হওয়া উচিত, সেরকমই ছিল। তবে শেষ কয়েক বছর দেখিনি। সে তখন বাড়ি থেকে বেরোত না, সাধনভজন করত।’
‘টগরকে আপনি বিয়ের পর দেখেছেন?’
‘দেখেছি। দু-তিনবার।’
‘তার বেশভূষা কীরকম?’
‘টগরও ওইরকমই। মানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
‘সাধুসন্ন্যাসীরা এখনও আসেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। দু-তিনজন সবসময়েই আছেন থানা গেড়ে।’
‘ভালো কথা। এবার তাহলে ধনঞ্জয় মাঝির কথা বলুন।’
গায়ত্রী গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ধনঞ্জয়ের ব্যাপারটা একটু রহস্যময়। ধনঞ্জয় স্থানীয় লোক নয়, রাজারামের মতো সেও এসেছিল বাইরে থেকে। শুনেছি, এখানে প্রথমে এসেছিল জুবিলি কলেজের বেয়ারা হিসেবে। সে অবশ্য বহু বছর আগেকার কথা। তারপর সে নানারকম ব্যাবসা শুরু করে, অনেক পয়সা রোজগার করে। অনেক জমিজমা কিনে বুড়োশিবতলায় বাড়ি করে। চাকরি অবশ্য তার আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু লোকটা কারুর সঙ্গে বড়ো একটা মেলামেশা করত না।’
‘কীসের ব্যাবসা করেন ধনঞ্জয়?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘সেটা আমরা কেউই সঠিক জানি না। শুনেছি চন্দননগর-সিঙ্গুর রুটের কয়েকটা বাস ওর। তা ছাড়া ধান চালের ব্যাবসা তো আছেই। জুবিলি কলেজ আর আমাদের হাসপাতালের স্টেশনার সাপ্লাইয়ের কাজও মাঝে মাঝে করে। কিন্তু এগুলিই সব নয়। এর বাইরেও কিছু আছে। কিন্তু সেটা আমাদের অজানা।’
‘আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয় না?’
‘হয়, তবে তা অত্যন্ত কম। মানে, লোকটা ঠিক কাজের কথাটুকু ছাড়া অন্য কোনো কথা বলতে চায় না। আড্ডা মারে না, গ্রামের পলিটিকসের ভেতরেও থাকে না। আর ওর গাঁয়ের লোক ওকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না, কারণ প্রথমত ওর অনেক টাকা আর দ্বিতীয়ত ওর সম্বন্ধে নানারকম ভীতিজনক গুজব চালু আছে।’
‘ভীতিজনক কীরকম?’
‘কেউ বলে লোকটা নাকি পিশাচসিদ্ধ, অনেকেই নাকি দেখেছে যে কালো কালো ভূতেরা উড়তে উড়তে ওর বাড়িতে ঢোকে, তারাই নাকি ওকে টাকাপয়সা দেয়। কেউ বলে, লোকটা নিজেই পিশাচ, তাকে নাকি মাটিতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে তালগাছের মগডাল থেকে মোহরের ঘড়া নামাতে দেখা গেছে।’
‘লোকটা কি চিরকালই এরকম ছিল? মানে এখানে যখন প্রথম আসে তখন থেকেই?
‘দেখ, ধনঞ্জয় যখন এখানে আসে তখন আমি তাকে চিনতুম না। দেখিনি কখনো। ওর নাম প্রথম শুনি বছর পনেরো আগে যখন ওর স্ত্রী খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ল। স্ত্রী জেল হওয়ার পর থেকে ওকে চিনি, মানে মুখ চিনি আর কি! হাসপাতালে মাঝে মাঝে এসেছে, কিন্তু আমার কাছে নয়, অন্য ডাক্তারের কাছে।’
‘দ্বিতীয় পক্ষ কতদিন হয়েছে।’
‘অনেকদিন। সঠিক সময়টা বলতে পারব না। নেমন্তন্ন খাইনি তো।’
‘কেন?’
‘খাওয়ায়নি, তাই। শুনেছি কলকাতায় বিয়ে হয়েছিল।’
‘দ্বিতীয় পক্ষকে দেখেছেন?’
‘নাঃ! শুনেছি তিনি নাকি ভয়ানক পর্দানশিন। তবে সেই পর্দার আড়ালে থেকেই নাকি তিনি ধনঞ্জয়ের সব কাজের কলকাঠি নাড়েন।’
দময়ন্তী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, ‘অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং। একটু দেখা করতে পারলে ভালো হত। দেখুন না চেষ্টা করে।’
শিবশঙ্কর অভয়মুদ্রায় হাত তুলে বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই। ডাক্তার শিবশঙ্কর সাঁতরা চেষ্টা করলে অসম্ভব সম্ভব হতে পারে। কী বল গো?’
গায়ত্রী মুখ বেঁকিয়ে যেন কথাটা শুনতেই পাননি এরকম ভাব দেখিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। প্রশ্নটার কোনো উত্তরই দিলেন না।
.
শিবশঙ্করের কথা শেষ হতে-না-হতেই বাইরে একটা হাঁক শোনা গেল। গায়ত্রী উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘নিত্যগোপালবাবু! ওঁকে এখানেই ডাকো।’
শিবশঙ্কর ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন যাঁকে সঙ্গে করে তিনি অবশ্যই নিত্যগোপাল। রোগা, লম্বা, শ্যামবর্ণ, মাথার চুল খুব ছোটো ছোটো করে ছাঁটা, কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা গোঁফ, পরনে একটু খাটো করে পরা ধুতি আর সাদা খদ্দরের শার্ট তার ওপর নস্যি রঙের র্যাপার। একহাতে একটা মোটা লাঠি, অন্য হাতে একটা বড়োসড়ো টর্চ।
শিবশঙ্কর ঘরে ঢুকেই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তড়বড় করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁরে নেত্য, আমরা যে শুনেছিলুম মহীপালের দিঘিতে প্রোজেক্ট-ট্রোজেক্ট বন্ধ, তা কি ঠিক নয়? এই সমরেশ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ওখানে তাহলে করছে কী?’
নিত্যগোপাল গ্রামভারী হেসে বললেন, ‘এখন যা কিছুই করুন না কেন, আর বেশিদিন করতে হবে না। আমার কাছে পাকা খবর আছে যে রাইটার্স থেকে এই প্রোজেক্ট বন্ধ করার অর্ডার বেরোল বলে। হয়তো এতদিনে বেরিয়েও গেছে। এখানে এসে পৌঁছোতে যা দেরি।’
সমরেশ বলল, ‘দেখুন, এই প্রোজেক্ট বন্ধ হলে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এটা বন্ধ করার জন্যে আপনারা উঠে-পড়ে লেগেছেন কেন?’
নিত্যগোপাল করুণার দৃষ্টিতে সমরেশের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘কাল সকালে এই জানলাটা দিয়ে একবার বাইরে তাকাবেন। দেখবেন, চারদিক কী সুন্দর, গাছগুলো সবুজ, পথের দু-পাশে রঙিন ফুল, শুনবেন পাখির গান, মৌমাছির গুনগুন।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় মৌমাছি? তোর কি মাথা খারাপ?’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘আহা, ঠিক এক্ষুনি হয়তো নেই। কিন্তু কিছুদিন পরেই আসবে। সেটা বুঝেছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই বিশাল মহীপালের দিঘির কয়েক বিঘে জমি নিয়ে একটা ছোটো কমপ্লেক্স যদি তৈরি হয়, তাহলেই কি এসব নষ্ট হয়ে যাবে?’
নিত্যগোপাল আবার গ্রামভারী হাসলেন। বললেন, ‘সেই উটের গল্প জানেন না? তাকে তাঁবুর মধ্যে শুধু নাকটা ঢোকাতে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দেখা গেল পুরো তাঁবুটাই তার দখলে আর তাঁবুওলারা বাইরে। সেইরকম, এই এক বিঘেটাও তো শুধু উটের নাকটা, এটা যদি এক্ষুনি বন্ধ করা না যায়, তাহলে দেখা যাবে যে একদিন সমস্ত মহীপালের দিঘিটাই নানারকম কমপ্লেক্সের কবলে চলে গেছে। তখন কী হবে চিন্তা করতে পারেন?’
‘কী হবে?’ সমরেশ আর শিবশঙ্কর একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন।
‘বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে, গাছপালা মরে যাবে, চাষবাস উঠে যাবে, এই সমস্ত এলাকাটা একটা মরুভূমিতে পরিণত হবে। প্রকৃতিকে একদিকে আঘাত করলে সে অন্য দিক দিয়ে প্রত্যাঘাত করে, প্রতিশোধ নেয়— এটা আপনাদের না জানার কথা নয়।’
সমরেশ মাথা চুলকে বলল, ‘না, তা অবশ্য নয়। তবে কিনা আজকাল তো ইকোলজি নিয়ে সকলেই অল্প-বিস্তর জানেন শোনেন এবং চিন্তাভাবনা করেন। সে-অবস্থায় ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নষ্ট না করেও তো কমপ্লেক্সটা ডিজাইন করা যায়। এবং শুনেছি, সেরকমই করা হয়েছে।’
‘ওসব বাজে কথা। এখানকার লোক যারা নয়, তাদের কী দায় ঠেকেছে এসব ব্যাপারে চিন্তা করবার? থিয়োরি তো অনেকেরই অনেকরকম জানা আছে, তার ক-টা কাজে লাগে? আসল কথা, ওসব ভাঁওতায় আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, আমরা পারি না। আর বিশ্বাস করতেই-বা আপনার অসুবিধে কোথায়? সমস্যাটা তো আপনার নয়, আমাদের।’
দময়ন্তী কোনোরকম ভূমিকা না করে প্রশ্ন করল, ‘ওখানে যে জরিপের কাজ হচ্ছে, তার লোকজনদের কেউ ভয় দেখাচ্ছে, যাতে তারা সেখানে কাজ না করে। মনে হচ্ছে, কাউকে কাউকে প্রাণনাশেরও ভয় দেখানো হয়েছে। তা, সেগুলো কি আপনাদের সমস্যার সমাধানের উপায় বলেই করা হয়েছে?’
নিত্যগোপাল খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেটা আমি শুনেছি। প্রাণনাশের কথা অবশ্য শুনিনি। সেজন্যে কি আপনি আমাকে সন্দেহ করেন? কেবল এটুকু আপনি জেনে রাখতে পারেন, নিত্যগোপাল দাস বেআইনি কোনো কাজ কখনো করেনি, করবেও না। আর, আড়ালে কাউকে শাসানো আমার স্বভাব নয়। আমি যাকে যা বলি, চিৎকার করে বলি। আর আপনার মতো একজন মেয়েমানুষের সন্দেহকে আমি থোড়াই কেয়ার করি।’
দময়ন্তী নির্বিকার মুখে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, সন্দেহ আমি কাউকেই করি না। আপনি করেন কি? আপনি তো সবাইকেই চেনেন।’
নিত্যগোপাল ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, ‘না, আমি কাউকেই সন্দেহ করি না। শুধু আমি নয়, এখানে আরও অনেকেই আছেন যাঁরা চান না যে মহীপালের দিঘিতে মানুষের হাত পড়ে। তাঁরা সকলেই ভদ্রলোক, কোনোরকম নোংরা কাজ তাঁরা আগেও করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন বলে মনে করি না। আমি দুঃখিত যে আপনার গোয়েন্দাগিরিতে আমি কোনোরকম সাহায্য করতে পারলুম না।’ বলে দুমদাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। শিবশঙ্কর দৌড়োলেন তাঁর পেছন পেছন।
.
শিবশঙ্কর ফিরে এসে বললেন, ‘নেত্যর কথায় কিছু মনে কোরো না। ভয়ানক চটে গেছে। কিন্তু সবাই তোমার পরিচয় জেনে গেছে দেখছি। সনৎটা ছেলেমানুষ, পেটে যদি কোনো কথা রাখতে পারে!’
দময়ন্তী বলল, ‘তাতে আর কী হয়েছে। হয়তো এতে ভালোই হবে।’
‘ভালো কী হবে জানি না। তবে নেত্য খুব একটা কেউকেটা লোক। তাকে চটানো কতটা ভালো হল, সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে।’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘আমি কিন্তু চটাতেই চেয়েছিলুম। এতে আপনাদের গ্রামে যে একটা নড়াচড়া পড়বে, সন্দেহ নেই। তার ফলে যিনি নাটের গুরু, এতদিন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন, হয়তো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন।’
‘তা বটে। আচ্ছা, নেত্য আজকে হঠাৎ এসে উপস্থিত হল কেন বলে তোমার মনে হয়? তোমাকে বাজিয়ে দেখতে?’
‘হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।’
সনৎ চৌধুরী এলেন পরদিন সকাল বেলা। গায়ত্রী পরিবেশিত লুচি আর আলুর চচ্চড়ি আন্ডার প্রোটেস্ট খেতে খেতে বললেন, ‘গগন মণ্ডল, মানে ডাকাত গগন মণ্ডল? সে বোধ হয় আর বেঁচে নেই। মানিকচাঁদের মুখে শুনেছি গগনের মা তার ছেলে ফিরে এল না বলে খুব কান্নাকাটি করত। বছর তিনেক আগে সে যখন মারা যায়, তখনও তার ছেলেকে আসতে দেখা যায়নি। বেঁচে থাকলে সে নিশ্চয়ই আসত। শুনেছি, সে ভয়ানক দুর্দান্ত ডাকাত ছিল বটে, কিন্তু প্রচণ্ড মাতৃভক্ত ছিল।’
‘আপনার মানিকচাঁদ গগন সম্পর্কে কী বলে?’ জিজ্ঞেস করল দময়ন্তী।
‘ও তো বলে যে গগনকে তার দলের লোকেরাই মেরে ফেলেছে। বছর দশেক আগে তারকেশ্বরে নাকি ওকে দেখা গিয়েছিল, তারপর থেকেই মিলিয়ে গেছে লোকটা। গগন জেলে যাওয়ার পর ওর দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। পরে, ওর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছানা বাগদি আবার নতুন করে সবাইকে একত্র করে। এই ছানা যে কেবল ভয়ংকর ডাকাত ছিল তাই নয়, কথায় কথায় খুন করে বসত। কাজেই, গগন ফিরে এসে সর্দারি ফেরত চাইলে, ছানা তাকে খুন করে বসবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
‘এই ছানা এখন কোথায়?’
‘বেশ কয়েক বছর আগে তার ফাঁসি হয়ে গেছে। তার দলটারও আর অস্তিত্ব নেই।’
গায়ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা দময়ন্তী, এই গগন মণ্ডল সম্পর্কে তোমার এত কৌতূহল কেন বলো তো? মহীপালের দিঘির সঙ্গে তার কিন্তু কখনোই কোনো যোগাযোগ ছিল না। তার দলটা অপারেট করত তারকেশ্বর থেকে, এ অঞ্চল থেকে নয়।’
সনৎ বললেন, ‘উনি বোধ হয় ভাবছেন যে যেহেতু তার বাড়ি নিমগাছিয়ায়, অতএব জেল থেকে বেরিয়ে সে হয়তো ওই মহীপালের দিঘিতেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। সেটা অসম্ভব নয়। সত্যিই যদি বছর দশেক আগে তাকে তারকেশ্বরে দেখা গিয়ে থাকে, তাহলে খুব সম্ভবত সে জেল ভেঙেই পালিয়ে এসেছিল। তার মতো দুর্দান্ত ডাকাতকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে, এ তো আমার বিশ্বাস হয় না।’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, না, গগন মণ্ডল সম্পর্কে আমি খুব একটা কৌতূহলী নই। আমার বেশি কৌতূহল বিশ্বম্ভর দাসের বিধবা মেয়েটির সম্পর্কে, যাকে গগনের দল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। গগন বেঁচে থাকলে তার খোঁজ দিতে পারত।’
সনৎ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দময়ন্তীর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘সেই মেয়ের খবর আমি জানি। গগন জেলে যাওয়ার পর সে ছানার সঙ্গে থাকত। ছানা তাকে বাসের পারমিট করে দিয়েছিল, রেশন দোকান করে দিয়েছিল আর একটা ছোটো বাড়িও করে দিয়েছিল। গত বছর তার দোকানে পুলিশ রেড হয়, বেশ কিছু চোরাই মাল ধরা পড়ে। তাকে অ্যারেস্ট করা হয়। তখন আমার ওপর আদেশ হয় বিশ্বম্ভরের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু বিশ্বম্ভর তার মেয়ের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষী দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল সে তাঁর মেয়ে নয়। তাঁর মেয়ে জীবিত নয়, মৃত। তা, বিশ্বম্ভরের মেয়ে বলে পরিচয় দিচ্ছে যে স্ত্রীলোকটি সে এখনও পুলিশের হেফাজতেই আছে। আপনি যদি চান তো তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’
দময়ন্তী পুনরায় মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, তার দরকার হবে না। আমার যা জানবার ছিল, তা জানা হয়ে গেছে।’ বলে চুপ করে অন্যমনস্কভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
গায়ত্রী আর সনৎ দু-জনেই, ইতস্তত করছিলেন বোধ হয় ‘কী জানা হয়ে গেছে’ সেই প্রশ্নটা করবার জন্যে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই করে উঠতে পারলেন না। সনৎ নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তাহলে আমি চলি? যদি আর কিছু জানবার থাকে তো…’
দময়ন্তী চটকা ভেঙে প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ, ভালো কথা, শুনেছি নিত্যগোপালবাবু সকলের উপকার করে বেড়ান, কিন্তু তাঁর উপকার কেউ করেন বা করেছেন বলে শুনেছেন কখনো?’
সনৎ মৃদু হেসে বলল, ‘শুনেছি নিত্যগোপালবাবু মাঝে মাঝে গোপনে পাশের গ্রামের ধনঞ্জয় মাঝি বলে একজন পয়সাওলা ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে থাকেন। উদ্দেশ্য, টাকা ধার করা। কথাটা কতদূর সত্যি, জানি না।’
.
সনৎ চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে বাড়ির বাইরে একটা সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজ পাওয়া গেল; তারপরেই হুংকার, ‘ডাক্তারকাকি আছেন নাকি?’
গায়ত্রী উল্লসিত হয়ে সাড়া দিলেন, ‘কে রে? মনু নাকি? আয় বাবা, ভেতরে আয়। এই ঘরে…’ বলে ঘরের বাকি দু-জনকে জানালেন, ‘অভিমন্যু। এসে গেছে।’
অভিমন্যু হাজরার বয়েস বছর পঁয়ত্রিশ হবে। গোলগাল গড়ন, মাথার সামনে টাক পড়তে শুরু করেছে আর সেই ক্ষতিপূরণের জন্যেই বোধ হয় একটা পুরুষ্টু গোঁফ রাখা হয়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি আর গাঢ় বাদামি রঙের আলোয়ান। বেঁটেখাটো মানুষটি, কিন্তু চটপটে চলাফেরা।
ঘরে ঢুকেই কোনোরকম ভণিতা না করে দময়ন্তীকে বললেন, ‘আমার নাম অভিমন্যু হাজরা। আপনি তো আমাদের এ অঞ্চলে হলুস্থুল ফেলে দিয়েছেন!’
দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘সে কী? কেন?’
‘কেন, মানে? নেত্যবাবুকে খেপিয়ে দিয়েছেন। আপনি নাকি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে উনি মহীপালের দিঘিতে ভয়ংকর সব কাণ্ডকারখানা করছেন। নেত্যবাবু তো ফায়ার। এখন দেখুন, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।’
দময়ন্তী প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, আমি কিন্তু সেরকম…’
অভিমন্যু বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনি হয়তো সেরকম কিছু বলেননি। কিন্তু নেত্যবাবু ফায়ার— এ বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ নেই। সেকথা যাক, ওঁকে সামলাবেন ডাক্তারকাকা আর এই মহিলা। এঁকে জানেন তো? এঁর অসাধ্য কোনো কাজ নেই। আমি এলুম ব্যাপারখানা কী জানতে। মহীপালের দিঘিতে অ্যান্টিসোশ্যাল কাজকর্ম! কী হয়েছে বলুন তো?’ বলে একটা চেয়ারে জুত করে বসে বললেন, ‘কাকি, ব্যাপারটা কী? আতিথেয়তা জিনিসটা কি জগৎ থেকে উঠে গেল? সকাল বেলা এলুম। কিছু না খেয়েও তো এসে থাকতে পারি। সে-সম্পর্কে কোনোরকম খোঁজখবর নেবার কি দরকার নেই?’
গায়ত্রী বললেন, ‘কোনো দরকার নেই। তুই আসার আগে অন্তত পাঁচ গেলাস চা, একবাটি মুড়ি আর নারকোল, অন্তত গোটা ছয়েক রুটি আর আলু-ফুলকপির তরকারি খেয়েছিস, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’
অভিমন্যু হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘ভুল, ভুল। একেবারে ভুল। মুড়ি-নারকোল নয়, মুড়ি আর গুড় এবং আলু ফুলকপির তরকারি নয়, ডিমের অমলেট।’
গায়ত্রী বললেন, ‘তোমার গিন্নি এটুকু না খাইয়ে তোমাকে বাইরে যে বেরোতে দেবেন না, সেটা আমি খুব ভালো করে জনি। যাকগে, তুই বোস। এদের কাছ থেকে ব্যাপারটা শোন। আমি তোর জন্যে লুচি করে আনি।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সমরেশের কাছে বৃত্তান্ত শুনি অভিমন্যু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘এ কী কাণ্ড! এ তো ভালো কথা নয়। মহীপালের দিঘির সমস্তটা না হলেও বেশ অনেকটার সঙ্গেই আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে। বহুদিন ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছি, এখনও বেড়াই। কখনো কিছু চোখে পড়েনি যাতে মনে হতে পারে যে ওখানে অসামাজিক ঘটনা কিছু ঘটেছে।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো বুড়োশিবতলায় থাকেন, তাই না? শুনেছি, বুড়োশিবতলার পিছনেই মহীপালের দিঘির জঙ্গল।’
অভিমন্যু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আগে ছিল। এখন আর নেই। আগে রাস্তার দু-ধারেই জঙ্গল ছিল। পরে বুড়োশিবতলা আর নিমগাছিয়ায় লোক বেড়েছে, গ্রামের সীমানা বেড়েছে, কাজেই জঙ্গল কাটা পড়েছে। কিন্তু রাস্তার অন্যধারে, যেদিকে জলা, সেদিকে কখনোই কোনো বসতি ছিল না। কাজেই সেদিকটার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
সমরেশ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তার মানে জঙ্গল সাফ হয়েছে। অথচ ফুল তো ফুটছে, মৌমাছি গুনগুন করছে…’
অভিমন্যু আবার অট্টহাসি হেসে উঠলেন। বললেন, ‘ও ব্বাবা! নেত্যবাবুর ওপরে আপনিও তো ফায়ার! ওঁর ওই প্রাকৃতিক ভারসাম্যটা একটা পাগলামো, ওটা নিয়ে উত্তেজিত হবার কিছু নেই। তবে উনি যা করতে চাইছেন, মানে আপনাদের প্রোজেক্টটা বন্ধ করতে চাইছেন, সেটা কিন্তু আমি সমর্থন করি যদিও সম্পূর্ণ অন্য কারণে।’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘সেই কারণটা আমরা জানি। আপনার ধারণা ওখানে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ লুকোনো আছে। কিন্তু, বলুন তো মশাই, ওই বিচ্ছিরি জলা জায়গায় কোনো সভ্যতা কখনো গড়ে উঠতে পারে? এমন গর্দভ কোনো রাজা থাকতে পারে যে ওইরকম একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘরবাড়ি বানাতে যাবে?’
‘আপনারা তো ঠিক তাই করতে যাচ্ছেন।’ সহাস্যে বললেন অভিমন্যু।
‘করতে যাচ্ছি কি সাধে? জায়গার অভাব, তাই। আর ওই জায়গাটা কেন্দ্র করলে আশপাশের অনেকগুলো গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করাটা সুবিধেজনক হবে। তা ছাড়া, আমাদের সাইটটা জলা জায়গাটার এক প্রান্তে, তার আশপাশের জমিটা সাফসুতরোও করা হবে। আর সেটা তো শহর হবে না, হবে গোটা দুয়েক বাড়ি, লোক থাকবে জনা দশেক, তাদের অনেকে আবার হয়তো চন্দননগর, শ্যাওড়াফুলি বা সিঙ্গুর থেকে যাতায়াত করবে। কিন্তু, আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সে সময়ে তো জায়গার কোনো অভাব ছিল না। বেছে বেছে এই জলার মধ্যে কে শহর বসাতে যাবে বলুন দেখি?’
‘হয়তো আপনাদেরই মতো কোনো রাজা ওখানে কোনো কিছু সরবরাহের কেন্দ্র খুলেছিলেন। তার কোনো চিহ্ন পেলেও ঐতিহাসিকরা খুশিই হবেন। তবে কী জানেন, ওই জলা জায়গাটা চিরকাল ওইরকম ছিল না। আপনি যদি ম্যাপে ওই জলার বিস্তারটা ভালো করে দেখেন, তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ হবেন যে ওটা অতি প্রাচীনকালে মজে যাওয়া কোনো বিশাল নদীর খাত। আপনি শুনেছেন কি না জানি না যে এ অঞ্চলের লোক বিশ্বাস করে যে সিঙ্গুর আসলে সিংহপুরের অপভ্রংশ, ওটাই ছিল বিজয়সিংহের রাজধানী।’
‘কোন বিজয়সিংহ? যিনি হেলায় লঙ্কা জয় করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, সেই বিজয়সিংহ। তিনি এখান থেকেই সিংহলের পথে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন। তা যদি ঠিক হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এখানে কোনো এক সময়ে একটা মস্ত বড়ো নদীর অস্তিত্ব ছিল যা দিয়ে বড়ো বড়ো সমুদ্রগামী জাহাজ যাতায়াত করত। সিঙ্গুরের কাছে কানা বলে একটা সরুমতন নদী আছে— লোকে বলে সেটাই অতীতের কর্ণ নদী যা দিয়ে বিজয়সিংহ তাঁর জাহাজে রওনা হয়েছিলেন। আগে খুব বড়ো ছিল, এখন মজে গিয়ে সরু হয়ে গিয়েছে। তা যে হতে পারে না, তা নয়। কিন্তু কানা যে কোনোকালে খুব বিরাট একটা নদী ছিল তার কোনো প্রাকৃতিক প্রমাণ আমি এখনও পাইনি। যদিও কানার দুই তীরে বেশ কিছু প্রাচীন মূর্তি-টুর্তি পাওয়া গেছে। অথচ, মহীপালের দিঘি যে কোনো অতিকায় প্রাচীন নদীর ধ্বংসাবশেষ, সে-বিষয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য, এমনও হতে পারে যে, কর্ণ নদী তার অরিজিন্যাল খাত থেকে সরে গিয়ে আজ কচুরিপানায় ভরতি কানা নদীতে পরিণত হয়েছে। তার ফেলে যাওয়া খাতটাই হয়েছে আজকের মহীপালের দিঘি।’
দময়ন্তী বলল, ‘বিজয়সিংহ ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে আপনি মনে করেন?’
অভিমন্যু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, করি। আমি জানি অনেক ঐতিহাসিক আছেন, যাঁরা লেজেন্ড, ট্র্যাডিশন বা উপকথাগুলোকে ইতিহাসের উপাদান মনে করেন না। তাঁরা বলেন, ওসব কবির কল্পনা, গালগল্প। শ্লীম্যান সাহেব এশিয়া মাইনরে ট্রয় শহর মাটির তলা থেকে খুঁড়ে বের করবার আগে পর্যন্ত এইরকম ঐতিহাসিকরা বলতেন যে ইলিয়াড কবির কল্পনা, রূপক ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর বেরোল অ্যাগামেমননের রাজধানী। ফিরিস্তি মিলিয়ে দেখা গেল, ইলিয়াড ইতিহাস, গালগল্প নয়। সেইরকম, আমি মনে করি, রামায়ণ বা মহাভারতও ইতিহাস। বহু প্রাচীন বলে হয়তো কোথাও কোথাও বিকৃত হয়েছে বা বিবর্ণ হয়েছে, কিন্তু মূল কাহিনিটি বিশুদ্ধ সত্য ঘটনা। বিজয়সিংহের লেজেন্ডটিও সেইরকম। ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেই সেটা উড়িয়ে দিতে হবে, তা আমি মনে করি না। আজ পাওয়া যায়নি, হয়তো কাল পাওয়া যাবে। হয়তো দেখা যাবে রাজাটার নাম বিজয়সিংহ ছিল না, ছিল বিজয়কেতু। সে একটা নেভাল এক্সপিডিশনে বেরিয়ে জয় করেছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, সিংহল নয়। কিন্তু মূল কাহিনিটি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।’
‘লেজেন্ড বা লোককথা কিম্বা উপকথা সর্বাংশে উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী আমিও নই। তবে, শুধুমাত্র এগুলোর ওপরেই নির্ভর করে ইতিহাসের সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয় বলে মনে করি। অনেক সময়েই তো দেখা গেছে যে এক দেশের প্রচলিত উপকথা অন্য দেশে চলে গিয়ে সেদেশের ইতিহাসের জলহাওয়ায় বড়ো হয়ে চেহারা পালটে ফেলেছে। সেখানে তারা কিন্তু সেদেশের উপাদান নয়, তাদের ঐতিহাসিকতাটা অন্যত্র।’
‘খুব সত্যি কথা। যেমন পঞ্চতন্ত্রের অনেক গল্প আজ গ্রিস থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়ার বহু জায়গায় স্থানীয় উপকথা বলেই প্রচলিত, রামায়ণের গল্প মধ্য এশিয়ায় এখনও চলে, ইন্দোনেশিয়ার মহাভারত তাদের কৃষ্টির মূল উৎসগুলোর অন্যতম। কাজেই এটা খুব খাঁটি কথা যে এক জায়গার প্রচলিত উপকথা যে সেখানকার কোনো অতি প্রাচীন ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, এটা সবসময়েই মেনে নেওয়া যায় না। তার জন্যে অন্য প্রমাণের দরকার হয়। আমাদের এই অঞ্চলে যে অতি প্রাচীনকালে একটি উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, তার কিন্তু অন্য প্রমাণও আছে। তাদের বেশির ভাগই অবশ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়, নিতান্তই পরোক্ষ।’
‘প্রথমে কয়েকটা প্রত্যক্ষ প্রমাণের কথাই বলুন।’
‘কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার বাড়িতে গেলে আপনাকে দেখাতে পারি। আমি এ অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সামান্য কয়েকটি পুরাবস্তু যা খুঁজে পেয়েছি সেগুলি সযত্নে সাজিয়ে রেখেছি। মিউজিয়ামে দিইনি, কারণ সেগুলি সেখানে রাখবার মতো জিনিস নয়। কিন্তু আমার কাছে তাদের মূল্য অনেক। ওই মহীপালের দিঘির কাদার মধ্যে পেয়েছি কিছু ফসিল হয়ে যাওয়া কাঠের টুকরো যার মধ্যে করাত চালানোর দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। পেয়েছি কিছু পাথরের অস্ত্রশস্ত্র, মূর্তির অংশবিশেষ। এখান থেকে একটু দূরে একটা বিষ্ণু মন্দির আছে যেটা এখন পরিত্যক্ত, কারণ তার মূর্তিটা চুরি হয়ে গেছে। সেই মূর্তিটা পাওয়া গিয়েছিল ওই জলা জায়গাতেই। মূর্তিটা যখন চুরি যায়, তখন আমি ইস্কুলে পড়ি, বোধ হয় ক্লাস টেন-এ। কাজেই সেই মূর্তিটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। একটা অপূর্ব জিনিস ছিল। আমেরিকার কোন মাল্টিমিলিয়নেয়ারের ঘরের শোভাবর্ধন করছেন আজ, কে জানে।’
‘মূর্তিটা কোন সময়ের বলে আপনার ধারণা?’
‘গুপ্তযুগের তো বটেই। মনে হয়, মধ্য গুপ্তযুগই হবে। আচ্ছা, এর পরের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আপনি পাবেন কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সেই সিংহলি পুথিটার কথা আপনি নিশ্চয়ই জানেন যেখানে বিজয়সিংহের লঙ্কাজয়ের কথা বলা আছে? সেটার কপি ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে দেখে নিতে পারেন। অনেকে বিজয়সিংহকে গুজরাটের লোক বলেন। আমার তা মনে হয় না। কারণ তা যদি হত, তাহলে এ অঞ্চলে প্রচলিত লোকগাথা আর সিংহলি পুথির গল্প মোটামুটি একরকম হত না।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘এই বিজয়সিংহ কোন সময়ের লোক? খ্রিষ্ট্র জন্মের আগের নাকি?’
‘নিশ্চয়ই। সম্ভবত অশোকেরও আগে।’
‘সেই অতদিন আগে বাঙালি যুদ্ধবিগ্রহ করত নাকি? আমি তো জানতুম শশাঙ্ক না কী যেন নাম রাজাটার যে হর্ষবর্ধনকে মেরেছিল, তার আমল থেকেই বাঙালি একটু লড়াই-টড়াই…’
অভিমন্যু উত্তেজিত হয়ে সমরেশকে বাধা দিলেন। বললেন, ‘হর্ষবর্ধনকে নয়, শশাঙ্ক মেরেছিলেন তার দাদা রাজ্যবর্ধনকে। কিন্তু বাঙালি তার আগে লড়াই করেনি, এরকম কথা কে বলল আপনাকে? বেদে যে আর্যদের মহাশত্রু পনিদের কথা বলা আছে, তারা যে নৌবাণিজ্যে সমৃদ্ধ বাঙালি, একথা অনেক ঐতিহাসিকই বিশ্বাস করেন। এই বাংলার গঙ্গারিডি বা গঙ্গাহৃদি রাজ্যের নৌসেনারা ভূমধ্যসাগরে গিয়ে গ্রিক নৌবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে, সেকথা গ্রিক বা রোমান ঐতিহাসিকরাই লিখে রেখে গেছেন। দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহ যে বঙ্গরাজকে সমুদ্রশায়ী করেছিলেন, তিনিই খুব সম্ভব অঙ্গ বা আঙ্গাম এবং শ্যামদেশ অধিকার করেছিলেন। আর এরকম হবে না-ই বা কেন? লোহা আবিষ্কৃত হবার আগে সারা পৃথিবীর সভ্যতাকে কন্ট্রোল করত তামা। সেই তামা বাঙালি এক্সট্র্যাক্ট করত সিংহভূমি বা সিংভূমের তামার খনি থেকে। এখনও করে। ঘাটশিলায় গেলেই দেখতে পাবেন। আর সেই তামা দেশ-বিদেশে চালান দিত মেদিনীপুরের যে বন্দর থেকে, তার নামই ছিল তাম্রলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তি। আজ তা তমলুকে পরিণত হয়েছে। কাজেই অতি প্রাচীনকালে বাংলা দেশে যে এটা একটা ভালো রকমের সভ্যতা গড়ে উঠবে এবং সেই সভ্যতা এবং বাণিজ্য হামলামুক্ত রাখতে যে বাঙালিকে অস্ত্রধারণ করতে হবে, সেটা তো অস্বাভাবিক নয়।’
সমরেশ মাথা চুলকে বলল, ‘না, তা অবশ্য নয়। তবু প্রশ্ন থাকে, মহীপালের দিঘিতেই কেন?’
‘তার কারণ, প্রাচীন সভ্যতাগুলো প্রায়শই গড়ে উঠেছে নদীর ধারে ধারে। মহীপালের দিঘি যখন নদী ছিল, তখন তার ধারে যে কোনো অতি প্রাচীন জনপদ গড়ে উঠবে, সেটা ভেবে নেওয়ায় কোনো দোষ নেই। বিশেষত সিংভূম থেকে তাম্রলিপ্তের পথ যখন এ অঞ্চল থেকে খুব একটা দূরে নয়। প্রকৃতির খেয়ালে মহীপালের দিঘি জলা আর জঙ্গলে পরিণত হওয়ায় হয়তো সেই জনপদ মাটির নীচে অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। অন্যত্র মানুষের গাঁইতি তো কিছুই টিকতে দেয়নি। তা ছাড়া, অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে এ অঞ্চলের গ্রামগুলোর নাম লক্ষ করুন। সিঙ্গুর বা সিংহপুর, রাজমৈশি বা রাজমহিষী, কীর্তিনগর, আনন্দনগর এমন আরও কত। আমার তো একটা গোপন বিশ্বাস আছে— সেটা বড়ো একটা বলিনে কারুর কাছে— এ অঞ্চলেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই রহস্যময়ী গঙ্গারিডি। দিন গুনছে মুক্তির আশায়। হয়তো আমিই একদিন সেই মুক্তি এনে দেব।’
‘শ্লীম্যানের মতো?’
‘ঠাট্টা করছেন? করুন। হয়তো একদিন দেখবেন এই ঠাট্টাটাই সত্য হয়ে উঠবে!’
অভিমন্যু চলে যাওয়ার পর গায়ত্রী প্রশ্ন করলেন, ‘ছেলেটিকে কেমন লাগল তোমাদের?’
দময়ন্তী চুপ করে রইল। সমরেশ বলল, ‘ভালোই। তবে বড্ড কথা বলেন। আমার আবার বেশি কথা বলনেওয়ালা লোকেদের কেমন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। সেই যে ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।’
সমরেশের মন্তব্যে গায়ত্রী খুশি হলেন বলে মনে হল না। দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মনু কি মিথ্যে কথা বলে গেল? ও বেশি কথা বলে, বেশি খায়, বেশি হইচই করে, কিন্তু মানুষটা খারাপ নয়। জেনেশুনে মিথ্যে বলবে তা আমার মনে হয় না। তুমি কি বল?’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘মিথ্যে বলছেন কি না জানি না। কিন্তু ইতিহাসের সময়গুলো নিয়ে কোথায় যেন গোলমাল করেছেন। সেটা ইচ্ছে করে করেছেন না ওঁর ব্যাপারটা গুলিয়ে গেছে, সেটা বলা কঠিন। উনি একথা ভীষণভাবে বিশ্বাস করেন যে ওখানে মাটির তলায় কোনো প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন লুকিয়ে আছে, অথচ আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত খোঁড়াখুঁড়ির কোনোরকম ব্যবস্থা করে ওঠেননি। বা করে থাকলেও সেকথা আমাদের বলেননি। তার কারণ কী?’
গায়ত্রী সস্নেহ হাসি হেসে বললেন, ‘কারণ আবার কী? মনুটা আলসের ঢিবি। খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে, কোনো ব্যাপারে গা ঘামাবার ইচ্ছে আছে ওর? আর হবে না-ই বা কেন? ঠাকুমার আদরে মানুষ। ছোটোবেলায় ওর বাবা মারা গিয়েছিলেন তো। আর ওর বউটাও হয়েছে তেমনি। ওকে যে কী যত্নআত্তি করে, কী বলব তোমায়! ভারি ভালো মেয়ে আমাদের পূর্ণিমা। ফলে মনুটা কেমন যেন থ্যাসথেসে হয়ে যাচ্ছে।’
‘ওঁর ছেলেপুলে আছে?’
‘আছে। দুটো ছেলে। কৃষ্ণ আর বলরাম। বড়োটার বয়েস বোধ হয় দশ, ছোটোটার সাত। দুটোই ডাকাত।’
.
বিকেল বেলা বাসুদেব পাল আর অজয় সরকার এসে হাজির। দু-জনেরই মুখ ভয়ানক গম্ভীর।
বাসুদেব কোনোরকম ভণিতা না করে বললেন, ‘ব্যাপার ক্রমশ গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, স্যার।’
সমরেশ তাড়াতাড়ি দু-জনকে ঘরের মধ্যে এনে বসাল। বলল, ‘আগে শান্ত হয়ে বসুন তো। তারপর বলুন কী হয়েছে।’
ইতিমধ্যে গলার আওয়াজ পেয়ে গায়ত্রীও ঘরে এসে ঢুকেছেন।
বাসুদেব হাত বাড়িয়ে একটা ভাঁজ করা রুলটানা কাগজ সমরেশের হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখুন, স্যার। জোরে জোরে পড়বেন না যেন, মনে মনে পড়ুন।’
সমরেশ সেইমতো নিঃশব্দে কাগজটা পড়ে দময়ন্তীর হাতে দিল। দময়ন্তী যতক্ষণ কাগজটা পড়ল, ততক্ষণ বাসুদেব আর অজয় অধোবদনে বসে রইলেন। দময়ন্তী কাগজটা পড়া শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় সমরেশের হাতে ফেরত দিল।
গায়ত্রী এতক্ষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সমরেশকে বললেন, ‘কী লেখা আছে? আমি একটু পড়ব?’
সমরেশ মৃদু হেসে বলল, ‘কী আর পড়বেন? আমার আর দময়ন্তীর গুষ্টির পিণ্ডি চটকেছে আর এঁদের দু-জনকে পত্রপাঠ কেটে পড়তে বলেছে। আমাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছে। নইলে আমাদের চারজনকেই জবাই করা হবে।’
গায়ত্রী আবার বললেন, ‘দাও না, একটু পড়ি।’
সমরেশ মাথা নেড়ে বলল, ‘পড়বেন না ছোটোকাকি। অশ্লীল, কদর্য গালিগালাজ ছাড়া আর কিছু নেই। আমরা এরকম জিনিস দেখে অভ্যস্ত। আপনি তো তা নন। কাজেই, এটা না দেখাই আপনার শ্রেয়।’ বলে বাসুদেবের দিকে ফিরে বলল, ‘এটা কবে পেলেন? কোথায়?’
বাসুদেব নতমস্তকে বললেন, ‘আজ সকালে। ডাকবাংলোর লেটার বক্সে।’
‘এতক্ষণ কী করছিলেন? আসেননি কেন?’
‘আজ্ঞে, অজয় প্রথমে বলেছিল ওটা ছিঁড়ে ফেলে দিতে। পরে ভেবে দেখলুম, সেটা ঠিক হবে না। তখন গেলুম থানায়। দারোগাবাবু প্রথমে ছিলেন না। পরে এলেন। ওটা পড়ে বললেন যে…’
‘কী বললেন?’
‘ওই, আপনি যা বললেন, স্যার। এরকম জিনিস পেয়ে আপনাদের অভ্যেস আছে। কাজেই আমাদের বললেন আমরা যেন তক্ষুনি আপনাদের কাছে যাই। এইসব করতে একটু দেরি হয়ে গেল।’
গায়ত্রী দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তুমি কী করবে? আমি তো বলি তোমরা বাপু আজই কলকাতায় ফিরে যাও। সরকারি কাজ সরকারই সামলাবে।’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘কেউ সামলাবে না ছোটোকাকি। আজ যদি আমরা ভয় পেয়ে চলে যাই, তাহলে বহুদিনের জন্যে সমস্ত ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যাবে। আর যে লোকটা এই চিঠি লিখেছে, সে মহানন্দে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে।’
এই কথার মধ্যেই শিবশঙ্কর হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন। এসেই সব শুনে আর সমরেশের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়ে স্তম্ভিত বিস্ময়ে ধুপ করে খাটের ওপরে বসে পড়লেন। বললেন, ‘ব্যাপারটা তো খুব ঘোরালো হয়ে উঠছে দেখছি। এ তো একটা দুটো লোকের কাজ নয়, এর পেছনে একটা বড়ো গ্যাং কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। মানে, বেশ একটা অর্গানাইজড দল। কিন্তু তারা সেখানে করছে কী? স্থানীয় লোক বলেই মনে হচ্ছে, অথচ…’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘স্থানীয় লোক মনে হচ্ছে কেন?’
‘দেখো, বাইরের লোক যদি হত, তাহলে তাদের মহীপালের দিঘিতে ঢোকা বা বেরোনোর খবর কানাঘুসোয় ঠিক আমাদের কানে আসত। এই যে অভিমন্যু মাঝে মাঝেই হন্যের মতো ওই জঙ্গলের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়, সে-রিপোর্ট আমরা ঠিকই পাই। এরকম আরও দু-চারজন যায়— কেউ কাঠ কাটতে, কেউ পাতা কুড়োতে। কিন্তু, বাইরের একদল লোক ওখানে যাচ্ছে আসছে, এরকম কথা কখনো শুনিনি।’
দময়ন্তী নীচু গলায় প্রশ্ন করল, ‘প্রফেসার হাজরা প্রায়ই ওখানে যান, না?’
‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই যায়। আর তখন ওর পোশাক যদি দেখো! মোটা খাকি ড্রিলের প্যান্ট, পায়ে গামবুট, কাঁধে কোদাল গাঁইতি।’
দময়ন্তী স্থির হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আর কোনো কথা বলল না।
.
পরদিন রোববার। সকালের জলখাবার শেষ হতে হতে একটু বেলাই হয়ে গেল। খাওয়ার ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে শিবশঙ্কর বললেন, ‘দময়ন্তী, আজ কি একবার শরৎ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে নাকি? গতকাল খবর পাঠিয়েছিলুম হাসপাতালের এক ছোকরাকে দিয়ে। বলে পাঠিয়েছেন যে আজ সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন।’
দময়ন্তী ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব। কখন যাবেন?’
‘এখুনি চলো। বেশি দূরে নয়, কাছেই। হাঁটাপথ। তবে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি। ভয়ানক কটু কথা বলেন ভদ্রলোক। মানুষকে অপমান করতে বা অসম্মান করতে সিদ্ধহস্ত। তোমাকেও ছেড়ে কথা না কইতে পারেন।’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘ওতে আমার কিছু যায় আসে না ডাক্তার সাঁতরা। তবে, এরকম করেন কেন?’
‘অহংকার— অহংকার! পড়াশুনোর, জ্ঞানের অহংকার। বিদ্যা দদাতি বিনয়ং কথাটা যে কত বড়ো মিথ্যে সেটা ওঁকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। তাহলে চলো, আমরা বেরিয়ে পড়ি।’
.
শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, স্থূল, থলথলে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় প্রকাণ্ড টাক। বয়েস পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নর ভেতর। সবুজের ওপর লাল চেক-কাটা কম্বল জড়িয়ে দাওয়ার ওপর মোড়া পেতে বসে কাঁসার বাটিতে করে চা খাচ্ছিলেন। ডা সাঁতরা তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে, ‘চক্রবর্তীমশাই আছেন নাকি?’ বলে হাঁক দিয়ে উঠোনের দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল।
শরৎচন্দ্র তাড়াতাড়ি ‘এই যে আছি’ বলে উঠে দাঁড়াতে গেলেন। অমনি ওঁর হাতের বাটিটা ঠং করে মাটিতে পড়ে গেল। খানিকটা চা চলকে পড়ে গেল মেঝেয়। ঠিক তক্ষুনি দুমদাম করে অনেকগুলো জানলা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে একটা বাচ্চা ভ্যাঁ করে তারস্বরে কেঁদে উঠল। বাড়ির পেছনের বাগানে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল।
চক্রবর্তী মশায়ের বাড়িটা বেশ ছড়ানো। সদর দরজার পর উঠোন। তার তিনদিক ঘিরে বাড়ি। পাকা ছাদ, ইটের দেওয়াল, যদিও জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা উঠে গেছে। দোতলায় পেছন দিকে ঘর থাকতে পারে, সামনে থেকে দেখা যায় না। জানলাগুলো দরজার সমান উঁচু, আগাগোড়া খড়খড়ি-পাল্লা দেওয়া। সেই খড়খড়িগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা ফাঁক করা, তাদের আড়ালে উদবিগ্ন চোখের আভাস।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘কী চক্রবর্তীমশাই, এটা কত নম্বর কাপ চা?’
বাকি সকলে একটা তর্জনগর্জন জাতীয় কিছু আশঙ্কা করছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, শরৎচন্দ্র অতি বিনীত হাসি হেসে বললেন, ‘হেঁ হেঁ, না, মানে ছুটি কিনা…’
শিবশঙ্কর হাত নেড়ে বললেন, ‘সেকথা থাক। আসুন, এঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই।’
পরিচয়পর্ব শেষ হলে শিবশঙ্কর বললেন, ‘চক্রবর্তীমশাই, মহীপালের দিঘিতে যে একটা সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বসতে যাচ্ছে, তাতে নাকি আপনার এবং আরও কয়েকজনের আপত্তি আছে। এঁরা সেই আপত্তিগুলো সম্পর্কে কিছু জানতে চান।’
সকলকে আবার ভয়ানক আশ্চর্য করে দিয়ে চক্রবর্তীমশাই বললেন, ‘আপত্তি? না, না, সে কী কথা? আপত্তি থাকবে কেন? সরকারি কাজ, সে তো আমাদের ভালোর জন্যেই। আমি আপত্তি করব কেন? আর আমি আপত্তি করবারই-বা কে?’
শিবশঙ্কর মাথা চুলকে বললেন, ‘আপনার আপত্তি নেই? সে কী? নেত্য যে বলল আপনি, ধীরেশবাবু, পঞ্চাননবাবু, সবাই এতে আপত্তি জানিয়েছেন, প্রতিবাদ প্রতিরোধ ইত্যাদির কথা ভাবছেন?’
প্রবল বেগে মাথা নেড়ে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘বাজে কথা, একদম বাজে কথা। হ্যাঁ, আমরা বলেছিলুম যে এখানে সরকারি অফিস হলে যতরাজ্যের উড়ে-মেড়ো সব এসে বসবে, জায়গাটা নোংরা হবে। তাই বলে প্রতিবাদ প্রতিরোধ? আমি কি পাগল? আসলে, আপনার ওই বন্ধুটি, নিত্যগোপালবাবু, আজকাল নেশার পরিমাণটা বড্ড বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন। ওঁর সব কথায় সেইজন্যে আপনার কান না দেওয়াই উচিত।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘নিত্যগোপালবাবু নেশা করেন নাকি?’
‘করেন মানে? পাঁড় নেশাখোর লোক মশাই। নেশার ঝোঁকে কখন যে কী করে বসেন, তার ঠিক নেই!’
‘সে কী? আমরা যে শুনলুম উনি অত্যন্ত পরোপকারী লোক? সকলের ভালোর জন্যে জীবন উৎসর্গ করে বসে আছেন?’
‘ছাই করেছেন! পরের ব্যাপারে নাক গলানো ওঁর স্বভাব। সকলকে বিরক্ত করে আনন্দ পান। জিজ্ঞেস করুন না ডাক্তারবাবুকে। ওঁর তো খুব বন্ধু। উনি জানেন না যে নেত্যবাবু নেশা করেন কি না? আগে নিজেই ইঞ্জেকশন নিতে, এখন শুনি সাদা সাদা গুঁড়োমতন কী খান।’
‘কথাটা সত্যি নাকি ডাক্তার সাঁতরা?’ দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল।
শিবশঙ্কর বিপন্ন মুখে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘কথাটা সত্যি। আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি। ওর স্ত্রীর সঙ্গে এইজন্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে। বার বার কলকাতায় যায় আর ছাইপাঁশ কিনে নিয়ে আসে। বেশি কিছু বললে বলে ইন্টেলেকচুয়ালদের নাকি একটু নেশাভাং করতেই হয়।’
শরৎচন্দ্র রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘ইন্টেলেকচুয়াল না হাতি! নেত্যবাবু যদি ইন্টেলেকচুয়াল হন তো আরশোলাও পাখি। বাড়িতে একগাদা বই থাকলেই কেউ পণ্ডিত হয় না, বুঝলেন ডাক্তারবাবু? সেগুলো পড়তে হয় আর তাদের মানে বুঝতে হয়। সে-ব্যাপারে নেত্যবাবুর ক্ষ্যামতা আমার জানা আছে— হ্যাঁ!’
দময়ন্তী বললে, ‘নেশাভাং করতে গেলে তো অনেক পয়সার দরকার। উনি কি খুব বড়োলোক?’
‘এককালে ওঁদের অনেক পয়সাকড়ি ছিল। জমিজমা ছিল, অন্যান্য কিছু ব্যাবসাও ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। নেত্যবাবু বলেন উনি নাকি পড়াশুনো নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে এসব দিকে মন দিতে পারেন না। বাজে কথা। পয়সা নিজেই ওড়ান। আজকাল তো শুনি ওই বদমাশ লোকটার কাছ থেকে টাকা ধার নিচ্ছেন।’
‘কে বদমাশ লোক?’
‘ওই যে ধনঞ্জয় মাঝি। বাইরে কোত্থেকে এসে জুড়ে বসেছে। মহা গোলমেলে লোক। টাকার নাকি কুমির, অথচ গাঁয়ের কোনো ব্যাপারে থাকে না, কোনোরকম জনহিতৈষী কাজে নেই। এ অঞ্চলের জন্যে তার কোনো মমতাই নেই। থাকবে কোত্থেকে? বাইরের লোক তো। আমি তো সেইজন্যেই বলি, আমাদের এ অঞ্চলের পবিত্রতা বজায় রাখতে গেলে উটকো লোকের আমদানি বন্ধ করতেই হবে।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘অভিমন্যু কিন্তু আপনার এই থিয়োরি মানে না। ও বলছিল…’
শরৎ বাধা দিয়ে বললেন, ‘ওর কথা আর বলবেন না ডাক্তারবাবু। ওই আর একটা লোক। ওকে তো চোখের সামনে বড়ো হতে দেখলুম। এখন নাকি প্রফেসার হয়েছেন। হায় ভগবান! বড়োলোকের ভুঁদো ছেলেটাও যদি আজ ছাত্র পড়ায়, তাহলে তাদের যে ভবিষ্যতে কী আছে, তিনিই জানেন। ওর কথা আপনি শুনবেন না ডাক্তারবাবু। আমি জানি, ওটা একেবারে অপদার্থ। কিস্রু জানে না, কিস্রু বোঝে না, অথচ ভাব দেখায় যেন মহাপণ্ডিত। সে নাকি মহীপালের দিঘির কাদার ভেতরে প্রাচীন সভ্যতা খুঁজে বের করবে। হেসে আর বাঁচিনে। আরে, আমরা এ অঞ্চলে বহু পুরুষ ধরে বাস করছি, বুঝলেন? আমার ঠাকুরদার মুখে শুনেছি, তাঁর ছেলেবেলাতেও ওই জায়গা আজকের মতোই জনমনিষ্যিহীন ছিল। ওখানে থাকবে সভ্যতা! আসলে, কোদাল কাঁধে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। নির্ঘাত কোনো বদ মতলব আছে, হ্যাঁ!’
.
শরৎচন্দ্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আচ্ছা সমরেশ, তোমাদের প্ল্যানটা কী বলো তো? ঠিক কী করতে চাইছ তোমরা?’
সমরেশ হাঁটা শুরু করে বলল, ‘দেখো, মহীপালের দিঘির ঢিবিটার কথা তোমাকে আগেই বলেছি। ঢিবিটার পাশে একটা ছোটো জলা আছে যেটা মূল বিলটা থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে জলাটা বাকি বিলটার মতোই অগভীর, আগাছা আর ছোটো ছোটো গাছে ঢাকা। আমরা চাইছি, এই ঢিবিটা চৌরস করে তার ওপরে ট্রান্সমিশন সেন্টারটা বসাব আর জলাটা ভরাট করে তার ওপরে স্টাফ কোয়ার্টার বানাব। তাতে সবচেয়ে কম গাছপালা কাটতে হবে। নেত্যবাবুকে সেকথাটা বোঝানোর কোনো সুযোগই তো পেলুম না।’
‘নেত্যবাবুকে বোঝানো পরে করলেও চলবে। এখন বলো, জলাটা ভরাট করতে গেলে কি আগে সেটাকে ড্রাই করে নিতে হবে?’
‘নিশ্চয়ই। তা না হলে তার ভেতরের গাছপালাগুলো কাটবে কী করে? আর, তা না কাটলে, সে-জায়গাটা বাড়ি বানাবার উপযুক্তই-বা হবে কী করে?’
‘তোমাদের এই প্ল্যানের কথা কি সবাই জানে?’
‘জানে। এখানকার জুবিলি কলেজে এ নিয়ে সরকারি অফিসার আর স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলোর সদস্যদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন আগে বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গিয়েছে।’
শিবশঙ্কর এখানে বাধা দিলেন। বললেন, ‘দেখো দময়ন্তী, আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। শরৎবাবুর ব্যবহারটা দেখলে? মনে হল যেন সিটিয়ে আছেন। তার অর্থ এও হতে পারে যে উনিও ভয় দেখানো চিঠি পেয়েছেন। তার মানে উনি বেশ বিপজ্জনক কোনো ব্যাপারের গন্ধ পেয়েছেন। এর পরেও কি তোমরা এর মধ্যে থাকবে?’
দময়ন্তী হাসল। বলল, ‘ভয় পেয়ে পালিয়ে যাব? না, ডাক্তার সাঁতরা। সেটা সম্ভব নয়। তবে আমাদের জন্যে আপনাদের কিন্তু বিপদ-আপদ হতে পারে। বিশেষত আপনার। আপনি গভীর রাত্রে রুগি দেখতে যান, একা গাড়ি চালিয়ে ফেরেন। এ অবস্থায় আমার মনে হয়, আমাদের আপনার বাড়িতে না থাকাই ভালো। আমি বলি কী, আমরা আজই ডাকবাংলোয় উঠে যাই। সমরেশ, তুমি বাসুদেববাবু আর অজয়বাবুকে আজ বিকেলেই কলকাতায় ফিরে যেতে বলো। যত শীঘ্র সম্ভব ওঁরা যেন অন্তত জন পনেরো লোক নিয়ে ফিরে আসেন এবং ক্যাম্পে থাকার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আসেন। আর সনৎবাবুকেও খবর পাঠাও, আজ রাত থেকে যেন ডাকবাংলোর ওপর একটু নজর রাখতে শুরু করেন।’
শিবশঙ্কর আর কোনো কথা বললেন না। নীরবে হাঁটতে থাকলেন।
.
বাড়িতে ঢুকেই শিবশঙ্কর হুংকার ছাড়লেন, ‘ওগো, শুনছ?’
গায়ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কী ব্যাপার? চেঁচাচ্ছ কেন?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘চেঁচাব না? দময়ন্তী কী বলেছে জানো? ওদের জন্যে আমাদের বিপদ হতে পারে, এইজন্যে ওঁরা এখান থেকে উঠে গিয়ে ডাকবাংলোয় থাকবেন। এটা সাঁতরা বংশকে অপমান করা নয়? ওঁদের একবার বলে দাও তো, উনসত্তর সত্তর সালে আমাদের ওপর কতবার আক্রমণ করা হয়েছে? কৃত্তিবাস এবং তাঁর ছেলেরা কতবার অ্যাসাসিনেটেড হতে হতে বেঁচে গেছে? তখন কি আমরা আমাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছি? একদিনের জন্যেও আমাদের রোজকার কাজের অন্যথা হয়েছে?’
সমরেশ মাথা চুলকে বলল, ‘এসব ইতিহাস আপনার আগে আমাদের বলা উচিত ছিল। আমরা কী করে জানব যে আপনারা বিপদে…’
গায়ত্রী বাধা দিয়ে বললেন, ‘চুপ করো! ডাকবাংলোয় যাবে! সোজা ভেতরে এসো। শরৎ মাস্টারের বাড়ি কী কী হল সব গোড়া থেকে বলো।’
.
শিবশঙ্কর বললেন, ‘তুমি চারজনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে। অভিমন্যু, নেত্যগোপাল, শরৎ মাস্টার আর দীনেশ বিশ্বাস। এদের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে তো মোলাকাত হয়ে গেল। কী বুঝলে বলো দেখি।’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘উঁহু, আপনার হিসেব ঠিক হল না। আমি দেখা করতে চেয়েছিলুম পাঁচজনের সঙ্গে। ধনঞ্জয় মাঝিকে আপনি ভুলে যাচ্ছেন। আর আমার দেখা হয়েছে চারজনের সঙ্গে, চৌকিদার রাজারামকে বাদ দিলে চলবে না।’
শিবশঙ্কর সহাস্যে বললেন, ‘আচ্ছা বেশ, তাই না হয় হল। কিন্তু, কী বোঝা গেল তা তো বললে না।’
‘দেখুন, বোঝা কিছুই যায়নি। মহীপালের দিঘিতে সমরেশের কোম্পানির কাজ করায় কোনো লোক বা একাধিক লোকের আপত্তি আছে, শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছে। বোঝা না যাওয়ার আইটেম কিন্তু অনেক। এক, আপত্তির কারণ কী? দুই, আপত্তি কি কেবল সমরেশের কোম্পানির জন্যে নাকি যেকোনো লোকের জন্যে? তিন, লোকজন জোগাড় করে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট করাটাই যেখানে স্বাভাবিক, সেখানে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ব্যাপারটা অকারণে কমপ্লিকেটেড করে ফেলা কেন?’
সমরেশ ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘তুমি তো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে করে দিলে! তুমি বলতে চাও, আমাদের কোম্পানির রাইভ্যালের এর পেছনে থাকার সম্ভাবনা আছে?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘দময়ন্তী ঠিক ধরেছে। এ গাঁয়ের কোনো লোক যদি হত, তাহলে সে গণ-আন্দোলন ফন-আন্দোলন জাতীয় কোনো রাস্তা নিত। এখানে তো তা হচ্ছে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিকই। কিন্তু গণ-আন্দোলনের প্রশ্নই ওঠে না যদি ওখানে কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি গোপন করার চেষ্টা থাকে।’
‘তাহলে, অভিমন্যু ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে? তবে তো বলতে হয় যে হয় সে ওই ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত, নয়তো ক্রিমিনালগুলো তার ইয়ারদোস্ত। সেটা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। আমরা মনুকে খুব ভালো করে চিনি। এসব ব্যাপারে ওর থাকা অসম্ভব। কাজেই ওই রাইভ্যাল কোম্পানি ব্যাপারটাই বেশ যুক্তিপূর্ণ সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছে। কী মনে হয় তোমার, আমি কি খুব ভুল কথা বললুম?’
দময়ন্তী প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, একেবারেই নয়। আমি তো গোড়াতেই বলেছি, এটা একটা ব্যাপার যেটা তলিয়ে দেখা দরকার।’
সমরেশ বলল, ‘বেশ প্যাঁচেই ফেললে! তাহলে তো আজই একবার কলকাতায় ফোন করতে হয়। রোববার বলে কথা, কাকে যে বাড়িতে পাই!’
.
ডা শিবশঙ্কর আর সমরেশ হাসপাতাল থেকে ফিরল সন্ধে নাগাদ। সমরেশকে বেশ উৎফুল্ল বলেই মনে হল। গায়ত্রী সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে সমরেশ বলল, ‘স্বয়ং মেজোসাহেবকে বাড়িতে পেয়ে গেছি। উনি তো মহা উত্তেজিত। কালই নাকি উনি জনা পঞ্চাশ লোক, সিকিউরিটি গার্ড আর একটা জিপ আমাদের জন্যে পাঠাচ্ছেন।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘এত লোক কেন? তোমাদের প্রোজেক্ট তো এক্ষুনি শুরু হচ্ছে না। তোমরা তো এখন শুধু রিপোর্ট বানাচ্ছ। তার জন্যে এত লোক?’
সমরেশ বলল, ‘দেখুন, আমরা এখন রিপোর্ট বানাচ্ছি বটে, কিন্তু এই রিপোর্টটা ভাসা ভাসা হলে চলবে না। আমাদের খুব গভীরে যেতে হবে। আমাদের অরিজিন্যাল প্ল্যান ছিল যে আগে সার্ভে হবে, তারপর হবে সয়েল টেস্ট, জলের কেমিক্যাল টেস্ট ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপারটা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে সবই একসঙ্গে করতে হবে, আর বিশেষ কোনো গোলমাল বেধে যাবার আগেই কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘এত লোক থাকবে কোথায়?’
‘যারা আসছে তারা দরকার হলে তাঁবু খাটিয়েও থাকতে পারে। তবে একটা বাড়ি বা ঘর পেলে সুবিধে হয়। কিন্তু হাতে তো সময় মাত্র একদিন। কাল সন্ধের মধ্যে বাড়ি এখানে কোথায় পাব?’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘পাবে।’
‘পাব? কোথায়?’
‘নিমগাছিয়ায়। ওখানে আমাদের একটা গোডাউন আছে। যুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। এখন আর বড়ো একটা ব্যবহার হয় না। দু-জন লোক লাগালে আধ বেলায় ওটা পরিষ্কার করে দেওয়া যাবে। যদি বল তো, কাল সকালেই লোক লাগিয়ে দিই?’
‘এ তো অত্যন্ত ভালো প্রস্তাব। আমরা তাহলে কাল দুপুরে গিয়ে একবার জায়গাটা দেখে আসতে পারি।’
‘তা পারো। আর, দময়ন্তী যদি যায়, তাহলে সে ধনঞ্জয় মাঝি আর অভিমন্যুর সঙ্গে বুড়োশিবতলায় আর দীনেশের সঙ্গে নিমগাছিয়ায় দেখা করেও আসতে পারবে। সময় পেলে তোমার কাজের জায়গাটাও দেখিয়ে দিয়ে আসতে পার।’
সমরেশ দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি, যাবে নাকি?’
দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘তাহলে ধনঞ্জয় আর দীনেশকে খবর পাঠাই?’
দময়ন্তী বলল, ‘না। আপত্তি করলে তো যাওয়াই যাবে না। বরং হঠাৎ গিয়ে পড়ব। যদি দেখা না করে বা তাড়িয়ে দেয় তো চলে আসব।’
.
শিবশঙ্কর পরদিন হাসপাতাল থেকে দুপুর বেলা ফেরার একটু আগেই জিপটা পৌঁছে গেল। ড্রাইভারের নাম মুখতার আমেদ। আগে আর্মিতে ছিল, বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছে। প্রকাণ্ড লম্বা-চওড়া চেহারা, টুকটুকে ফর্সা রং, মুখে হাসি লেগেই আছে। হাওড়া জেলায় বাড়ি। সমরেশকে দেখে জিপ থেকে নেমে এসে একটা বড়োরকমের স্যালুট ঠুকে বলল, ‘আপনাদের নাকি কারা ভয় দেখাচ্ছে, স্যার? তাদের একটু দেখিয়ে দিতে পারেন? এক মিনিটে ঠান্ডা করে দিই।’
সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘মুখতার, প্লিজ মাথা গরম কোরো না। আমি ঠিক জানতুম অফিস থেকে তোমাকেই পাঠাবে। তুমি বাপু একটু শান্ত হয়েই থাকো। আমাদের সামনে কাউকে বেচাল দেখলেই তাড়া করে যেয়ো না, আমি বললে যেয়ো।’
মুখতার বত্রিশ পাটি দন্ত বিকাশ করে বলল, ‘সে আপনি ভাববেন না, স্যার। আপনি শুধু যাকে দেখিয়ে দেবেন, তাকেই শুধু ধরে ধড় একদিকে আর মুন্ডু আর একদিকে করে দেব।’
সমরেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, তাই হবে। তুমি বাপু এখুনি লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিয়ো না।’
সমরেশ কথা বলতে বলতেই তার দুই সার্ভেয়ার সাইকেল রিকশা চড়ে এসে উপস্থিত। মুখতারকে দেখে দু-জনে অসম্ভবরকম পুলকিত হয়ে পড়লেন। বাসুদেব দু-হাত তুলে বললেন, ‘মুখতার এসে গেছিস? মনে মনে তোকেই চাইছিলুম রে! ব্যস, আর ভয় নেই। জানো অজয়, এই মুখতার একাই একশো। ও সঙ্গে থাকলে আমি ডরাইনে।’
অজয় সহাস্যে বললেন, ‘আমি জানি বাসুদেবদা। মুখতার, তুমি আসায় আমাদের হৃদয়ে নতুন করে জীবনের ছোঁয়া…’
সমরেশ তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলল, ‘মুখতার, তোমার খাওয়া-দাওয়া কিছু হয়েছে?’
বাসুদেব বললেন, ‘ওর খাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করব, স্যার। আমরা এখন ওকে নিয়ে ডাকবাংলোয় চলে যাই। ওর থাকারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে বেলা দেড়টা নাগাদ আমরা সাইটে চলে যাব।’
‘না, পালবাবু, আপনারা এখানে আসবেন। আমার আরও কয়েকজন যাবে। একসঙ্গে বেরোব।’
.
শিবশঙ্কর হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলেন একবেলার জন্যে। সমরেশদের সঙ্গী হতে ওঁর কোনো অসুবিধে ছিল না। সমরেশ আর দময়ন্তীকে নিয়ে ওঁর গাড়ি আর সরকার, পাল আর তিনজন মজুরকে নিয়ে মুখতারের জিপ যখন সাঁতরা-বাড়ি থেকে বেরোল, তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে।
রাজমৈশি গ্রাম থেকে বেরিয়ে বাসরাস্তা দিয়ে গাড়ি যত এগোতে লাগল, বাঁ-দিকটা ততই ক্রমশ যেন জনবিরল হয়ে আসতে লাগল। ডান দিকে খেত, লোকজনের চলাফেরা সবই আছে, কিন্তু বাঁ-দিকটায় ঝোপঝাড় আর জঙ্গল। মিনিট দশেক চলার পরে জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে এল। নিশ্ছিদ্র নয়, মাঝে মাঝে ফাঁকা আছে বটে, কিন্তু সে-জায়গাগুলোও অনুচ্চ ঝোপে ঢাকা।
সমরেশ বলল, ‘জলা জায়গাটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না। সেটা একটু ভেতরে। মনে হয়, প্রকৃতি যেন এই জঙ্গলের পর্দা টেনে সে-জায়গাটা মনুষ্যদৃষ্টির আড়ালে রাখতে চাইছে।’
দময়ন্তী স্থির দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বলল, ‘এই জঙ্গলে ঢোকার তো কোনো পথ দেখছি না। তোমরা যাচ্ছ কী করে?’
‘পথ এদিকটায় নেই ঠিকই। আর একটু এগিয়ে গেলে একটা নাম-কা-ওয়াস্তে পথ আছে। আমরা সেখান দিয়ে ঢুকে ঢিবির ওপর চড়ি।’
‘আমি একবার যাব।’
‘যেতে পার, তবে শাড়ি পরে যেতে অসুবিধে হবে। কাঁটাঝোপ আছে।’
‘তা থাক। আচ্ছা, ঢিবিটার পরেই কি জলা?’
‘ঢিবিটার গায়ে একটা ছোটোমতন আছে, তবে মূল জলা জায়গাটা আর একটু ভেতরে।’
এই কথার মধ্যে শিবশঙ্কর গাড়ি ডান দিকে ঘোরালেন। বাসরাস্তা থেকে নেমে একটা অপেক্ষাকৃত সরু পিচের রাস্তা ধরলেন। রাস্তার দু-ধারে খেত, একটু দূরে একটা ছায়াসুনিবিড় গ্রাম দেখা যাচ্ছে।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘ওই হল নিমগাছিয়া।’
নিমগাছিয়া বেশ বড়ো গ্রাম। তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তাটা চলে গেছে। দু-পাশে বাড়ি। বেশ কয়েকটা দোকানপাট আছে। একটা মনোহারী দোকান আছে যার শোকেসে নানারকমের লোভনীয় জিনিস সাজানো আছে। একাধিক মিষ্টির দোকান। পাকাবাড়ির সংখ্যাও কম নয়। দুটো বাঁধানো ঘাটওয়ালা পুকুরও নজরে পড়ে।
শিবশঙ্করবাবুদের গুদোমঘর গ্রামের শেষ প্রান্তে। লম্বাটে দোচালা ঘর, ইটের দেওয়াল, টিনের ছাদ, প্লিন্থ মাটি থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচু, রাস্তার দিকে ঘরের সামনে টানা বারান্দা, ঘরে ঢোকার দুটো চওড়া দরজা আর ছাদের ঠিক নীচে একসার স্কাইলাইট জাতীয় জানলা।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘কী হে সমরেশ, এতে হবে?’
‘নিশ্চয়ই হবে।’ বলল সমরেশ, ‘এ তো আশাতীত ব্যাপার।’
‘একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিতে হবে। প্রায় এক বছর হল এটা ব্যবহার হয়নি। তবে যজ্ঞেশ্বর আর তার দুই চ্যালা কয়েক ঘণ্টায় সাফসুতরো করে দেবে।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের জিপ থেকে যজ্ঞেশ্বর আর তার দুই চ্যালাকে দেখালেন। তাদের হাতে গুদোমের চাবি দিয়ে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসলেন। বললেন, ‘ওরা পরিষ্কার করুক। ততক্ষণে চলো আমরা বুড়োশিবতলা থেকে ঘুরে আসি।’
সমরেশ বলল, ‘ঠিক আছে। আমি তাহলে জিপটাকে এখানে এখন থাকতে বলি। ওদের তো ওখানে গিয়ে কোনো দরকার নেই।’
.
নিমগাছিয়া থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা আবার খেতের মধ্যে পড়ল। মাইল দেড়েক গিয়ে সেটা ঢুকল আর একটা গ্রামের মধ্যে। এ গ্রামটা ছোটো। গুটিকয় মাত্র পাকাবাড়ি। দোকান বলতে একটা মুদির দোকান। সেখানে অবশ্য পাওয়া যায় না হেন বস্তু নেই, এমনকী জামাকাপড় পর্যন্ত।
শিবশঙ্কর বললেন, ‘এটাই হল বুড়োশিবতলা গ্রাম। আর ওই যে পাকাবাড়িটা দেখছ, ওটাই মনুদের বাড়ি।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ধনঞ্জয় মাঝির বাড়ি কোথায়? আপনি না বলেছিলেন তিনি মস্ত বড়োলোক, মস্ত তাঁর বাড়ি?’
শিবশঙ্কর গ্রামের অন্য প্রান্তের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইদিকে ধনঞ্জয়ের বাড়ি। এখান থেকে দেখা যায় না। যখন তার সামান্য অবস্থা ছিল তখন এই গ্রামের সীমানায় একটা পোড়ো জমি কিনে সেখানে একটা ছোট্ট ঘর তুলেছিল। আজ সেখানেই তার বসতবাড়ি, যদিও জমি অনেক বেড়েছে। এবার বলো, আগে কোথায় যাবে, ধনঞ্জয়ের বাড়ি না মনুদের বাড়ি?’
দময়ন্তী বলল, ‘চলুন, আগে ধনঞ্জয়ের বাড়িতেই যাওয়া যাক। আমাদের অভ্যর্থনা করার ইচ্ছে যদি না থাকে তো আমাদের আসার খবর পাওয়ার আগেই ওঁর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া দরকার।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘সেই ভালো।’ বলে গাড়ির গতি একটু বাড়ালেন।
.
ধনঞ্জয় মাঝির বাড়ি বুড়োশিবতলা গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে। এর পরেই দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বাড়িটা দোতলা, ক্যাটকেটে হলুদ রঙের দেওয়াল, সবুজ রঙের জানলা। প্রত্যেক জানলার ওপর বহুবর্ণরঞ্জিত উড়ন্ত পরিদের মূর্তি। প্রায় আট ফুট উঁচু চওড়া মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার চেহারাটা কেবল গেটের ফাঁক দিয়েই দেখা যায়।
দময়ন্তী আপন মনেই যেন বলল, ‘ভারি আশ্চর্য!’
‘কী আশ্চর্য?’ জিজ্ঞেস করল সমরেশ।
‘এমন রংচঙে যাঁর বাড়ি, তিনি নিজেকে এমন আড়াল করে রাখেন কেন?’
‘নিশ্চয়ই কোনো অসদুদ্দেশ্য আছে।’
‘তা থাকতে পারে।’
শিবশঙ্কর গাড়িটা গেটের ভেতর ঢোকালেন। লম্বা লাঠি হাতে ন্যাড়া মাথা দারোয়ান কোনো বাধা দিল না। বোঝা গেল, ডাক্তারবাবুর গাড়ি সে চেনে, বাধা না দেওয়ার আদেশই তার ওপর আছে।
গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, পাশের বাগান থেকে একজন ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোক ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় তৈলনিষিক্ত কাঁচাপাকা চুল, আঁটসাট দোহারা চেহারা, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা গেঞ্জি।
ভদ্রলোক গাড়ির দরজার কাছে এসে বললেন, ‘ব্যাপার কী ডাক্তারবাবু? আমি তো আপনাকে ডাকিনি। কোনো প্রয়োজন আছে কি?’ ভদ্রলোকের গলাটা গম্ভীর এবং হয়তো কিছুটা বিষণ্ণ।
শিবশঙ্কর গাড়ি থেকে নামলেন। বললেন, ‘ধনঞ্জয়বাবু, আপনি আমাকে ডাকেননি ঠিকই। আমি খানিকটা নিজের দরকারেই এসেছি। আপনি শুনেছেন বোধ হয় সম্প্রতি মহীপালের দিঘি নিয়ে কিছু গোলমাল বেধেছে। এঁরা এসেছেন সে-বিষয়ে আপনার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে।’ বলে গাড়ির অন্য দু-জনের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের পরিচয়টা করিয়ে দিলেন।
পরিচয়পর্ব শেষ হলে ধনঞ্জয় বললেন, ‘আমার সঙ্গে কী কথাবার্তা থাকতে পারে? আমার সঙ্গে মহীপালের দিঘির কোনোই সম্পর্ক নেই।’
দময়ন্তী এগিয়ে এসে বলল, ‘ধনঞ্জয়বাবু, আমরা কিন্তু আপনাকে কোনোরকম সন্দেহ করে এখানে আসিনি। এসেছি আপনার সাহায্যের আশায়।’
ধনঞ্জয়ের মুখের কোনো পরিবর্তন ঘটল না। বললেন, ‘কীরকম সাহায্য?’
‘আপনি যদি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেন তো খুব উপকার হয়। প্রশ্নগুলো হয়তো একটু ব্যক্তিগত হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি উত্তর না দিলে আমরা কিছু মনে করব না।’
‘কী প্রশ্ন, বলুন?’
‘আপনি কলকাতায় না থেকে এখানে থাকেন কেন?’
প্রশ্ন শুনে ধনঞ্জয় একটু যেন অবাক হয়ে গেলেন। একটু চিন্তা করে বললেন, ‘কলকাতায় থাকার চেষ্টা করে দেখেছি, ভালো লাগেনি। আমি গেঁয়ো লোক, গাঁয়েই আমার স্থান। তা ছাড়া আমার জমিজমা, ব্যাবসাপাতিও এইখানেই।’
‘আপনার ছেলেমেয়ে ক-টি? কী করে তারা?’
‘আমার চার ছেলেমেয়ে। বড়োছেলের বয়স আঠারো বছর, সে খড়গপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। মেজোছেলে ষোলো, সে কলকাতায় হোস্টেলে থেকে স্কুলে পড়ে। সেজোমেয়ে সাত আর ছোটোছেলে পাঁচ আমার কাছেই থাকে। নিমগাছিয়া হাইস্কুলে ঢুকিয়ে দেবার ইচ্ছে আছে আগামী বছর।’
দময়ন্তী আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একটু অপেক্ষা করে ধনঞ্জয়ই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করবেন?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘না, আর কিছু জিজ্ঞেস করবার নেই। চলুন ডাক্তার সাঁতরা, আমরা ফিরে যাই।’ বলে একবার ওপরের দিকে তাকাল। তক্ষুনি দোতলার একটা জানলা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল আর বোধ হয় এক লহমার জন্যে দেখা গেল একজোড়া ব্যাকুল উদবিগ্ন চোখ।
.
এরপর অভিমন্যু হাজরার বাড়ি। সারারাস্তা দময়ন্তী কোনো কথা বলেনি। শিবশঙ্করও কোনো প্রশ্ন করেননি, কারণ এতদিনে উনি বুঝে গেছেন যে এসময় কোনোরকম প্রশ্ন করা পণ্ডশ্রম হবে।
অভিমন্যুর বাড়িটা দোতলা। প্রচুর বড়ো বড়ো গাছের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। কেবল তেতলার চিলেকোঠার ঘরটি পরিষ্কার দেখা যায় গাছপালার ওপর দিয়ে। সমস্ত বাস্তুজমিটা নীচু ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ভেতরে সিমেন্টের বাঁধানো ঘাটওলা একটা পুকুরও আছে। বাড়িটা বেশ পুরোনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে গেছে, কিন্তু এখনও খুব শক্তপোক্তই আছে।
বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর একটা সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। রিকশাওলা সওয়ারির সিটে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে একটা রংচঙে সিনেমা পত্রিকা পড়ছিল বা ছবি দেখছিল। শিবশঙ্কর তার পেছনে গাড়ি পার্ক করলেন। রিকশাওলা তাঁকে দেখে দন্ত বিকাশ করে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবার আগেই বলল, ‘নমস্কার ডাক্তাবাবু। ভেতরে যান, বাবুরা সবাই বাড়িতেই আছেন। গিন্নিমাও এয়েছেন।’
শিবশঙ্কর ভ্রূকুটি করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গিন্নিমা কে?’
বলামাত্র বাড়ির ভেতর থেকে নারীকণ্ঠে একটা উচ্চহাসির শব্দ ভেসে এল। অদ্ভুত হাসি— উঁচু পর্দায় বাঁধা সেতারের তীক্ষ্ন ঝংকারের মতো, কিন্তু সুরের মতো নরম বা প্রশান্ত নয়। এ হাসি শুনলে পুরুষের মনে স্বর্গীয় আনন্দের বিপরীত ভাবোদয় হয়।
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘টগর, দীনেশ বিশ্বাসের স্ত্রী?’
শিবশঙ্কর হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে।’
.
টগরের বয়েস ত্রিশের কাছাকাছি হবে। চেহারায় চটক আছে, অল্প বয়েসে যে আরও বেশি ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। গায়ের রং বেশ ফর্সা, ছিপছিপে গড়ন, টিকোলো নাকে হিরের নাকছাবি, পাতলা চাপা ঠোঁট, বড়ো বড়ো চঞ্চল চোখ। সিঁথিতে দগদগে লাল সিঁদুর।
তার পাশে অভিমন্যুর স্ত্রী পূর্ণিমা একেবারে আলাদা। শ্যামলা রং, মোটাসোটা, হাসিখুশি। কিছুমাত্র ভণিতা না করে অবলীলাক্রমে দময়ন্তীকে প্রশ্ন করে বসল, ‘হ্যাঁ ভাই, তুমি নাকি গোয়েন্দা? তোমাকে ছোরাছুরি চালাতে হয়?’
দময়ন্তী সহাস্যে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, তা হয় না।’
‘তবে ডাকাত ধর কী করে? ডাকাতরা তো ছোরা, পিস্তল কত কী চালায়! ওদের কি আর মুখের কথায় ধরা যায়?’
‘না, তা যায় না। তবে কী জানো, ডাকাত আমি ধরিনে। ডাকাত ধরে পুলিশ। আমি শুধু ডাকাতদের চিনিয়ে দিই।’
পূর্ণিমার বোধ হয় আরও কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল। কিন্তু ওকে বাধা দিয়ে টগর প্রশ্ন করল, ‘ডাকাত কি দেখলেই চেনা যায়?’
দময়ন্তী বলল, ‘তা যদি যেত, তাহলে কি আমাদের ডাক পড়ত?’
পূর্ণিমা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, ‘তা যা বলেছ ভাই। ডাকাত চেনা খুব শক্ত। আমার বাপের বাড়িতে একটা চাকর ছিল, তার নাম ছিল জগবন্ধু। রোগা, ক্যালা, হদ্দ বোকা, কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারত না। অথচ ছেলেবেলায় সে নাকি ডাকাত ছিল।’ বলে হি হি করে হাসতে লাগল। তারপর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তা তুমি নাকি দিঘির জঙ্গলে ডাকাত ধরবে বলে এসেছ? ওখানে কিন্তু ডাকাত নেই। যা আছে সে আরও খারাপ। ও অবশ্য বিশ্বাস করে না, কিন্তু সব্বাই বলে ওখানে আছে বেহ্মদত্যি আর শাঁকচুন্নি। কয়েকজন নাকি দেখেছে তাদের। ইয়া শিড়িঙ্গে লম্বা, কালো কুচকুচ করছে, চোখ দুটো ভাঁটার মতো। তাদের ধরবার চেষ্টাও কোরো না। করলেই মরবে।’
দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘যদি রাম রাম করতে করতে যাই?’
পূর্ণিমা হাত নেড়ে বলল, ‘তাহলে অবশ্য মরবে না, কিন্তু তাদের ধরতেও পারবে না। ভগবানের নাম করলে ওরা কেবল ক্ষতি করতে পারে না। ও অবশ্য এসব কথা মানে না। এই তো দেখো না, মাঠঘাট ঘুরে যত রাজ্যের পুরোনো ভাঙা জিনিসপত্র জোগাড় করে জমা করছে। তার মধ্যে ভারি সুন্দর একটা পাথরের গোপাল আছে। বললুম ওটা আমায় দাও, ঠাকুর ঘরে রাখি, দিলে না। বললে, ওটা নাকি সংগ্রহশালা না গুষ্টির পিণ্ডি, সেখানে থাকবে। তুমি তো ভাই সেই সংগ্রহশালা দেখতে এসেছ, তখন গোপাল মূর্তিটা দেখো। প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, দেখব বই কী।’ তারপর টগরের দিকে ফিরে বলল, ‘শুনেছি আপনাদের বাড়িতেও একটা খুব সুন্দর মন্দির আছে। ভাবছি, সেটাও আজ দেখতে যাব।’
শুনে টগর একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল যেন। বলল, ‘আজই আমার বাড়িতে যাবেন? কিন্তু ব্যবস্থা তো কিছু করা হয়নি! একটু আগে খবর পেলে…’
দময়ন্তী বাধা দিয়ে বলল, ‘খবর দেবার কী আছে? যাব, মন্দির দেখব, পুজো দেব, চলে আসব। এর মধ্যে ব্যবস্থা করার তো কিছু নেই।’
টগর প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, তা বললে কী করে হবে? আপনি অতিথি, প্রথমবার আমাদের বাড়িতে আসছেন, আর একটু ব্যবস্থা করব না? আপনাকে ধুলো পায়ে বিদায় দেব নাকি? আমরা গাঁয়ে থাকি, সামান্যই আমাদের আয়োজন। সেটুকুও যদি না করতে পারি, তাহলে…’
দময়ন্তী ভয়ানক লজ্জিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। পূর্ণিমা তার আগেই বলল, ‘তুমি ওকে চেনো না ভাই। ওদের মতো এরকম অতিথিবৎসল পরিবার এ তল্লাটে আর দ্বিতীয়টি নেই। তুমি যদি ওদের বাড়িতে গিয়ে শুকনো মুখে বেরিয়ে আসো, তাহলে দীনেশদা আর এ— দু-জনেই আত্মহত্যা করবে। তুই এক কাজ কর টগরদি, এক্ষুনি বাড়ি চলে যা। তোর ছেলেটা তো কেষ্ট আর বলরামের সঙ্গে বল পিটছে। ওকে আমি পরে পাঠিয়ে দেব। তুই এক্ষুনি যা।’
এমন সময় বাইরে অভিমন্যুর হাঁক শোনা গেল, ‘কই গো, তোমাদের মিষ্টিমুখ শেষ হল? এবার ওঁকে একটু ছেড়ে দাও, আমার সংগ্রহশালাটা একটু দেখাই।’
.
অভিমন্যুর বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়িয়ে গেল। শীতের সন্ধে, অন্ধকার নামলও তাড়াতাড়ি। শিবশঙ্করের গাড়ি যখন নিমগাছিয়ায় ঢুকল, তখন সব বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে।
শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দময়ন্তী, দীনেশবাবুর বাড়ি যাবে নাকি আজ?’
দময়ন্তী বলল, ‘যেতে তো হবেই। টগরকে কথা দিয়েছি। সে বোধ হয় কী সব ব্যবস্থাও করেছে।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘বেশ, তাই চলো। যাবার পথে তাহলে যজ্ঞেশ্বরকেও একটা হাঁক দিয়ে যাই। সে মুখতারের জিপে আমাদের পেছনে পেছনে আসুক।’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের সঙ্গে আসার কী দরকার? ওরা তো সোজা ফিরে গেলেই পারে।’
‘নাঃ, একসঙ্গে যাওয়াই ভালো।’ শিবশঙ্করের গলাটা গম্ভীর শোনাল, ‘এখন অন্ধকারে দময়ন্তীকে নিয়ে ফেরা— যত লোক সঙ্গে থাকে ততই মঙ্গল।’
শিবশঙ্করের কথা শুনে দময়ন্তী মৃদু হাসল, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করল না।
.
দীনেশ বিশ্বাসের বয়েস পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হবে। বেঁটেখাটো রোগাটে গড়ন, কিন্তু এককালে যে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তাতে সন্দেহ থাকে না। এখন মাথার চুলে আর গোঁফে পাক ধরেছে, চোখের পাশে বলিরেখার চিহ্নও বিদ্যমান, কিন্তু তাতে লেডি কিলার লেডি কিলার ভাবটা বেড়েছে বই কমেনি।
বিশ্বাস মশাই বাড়ির সদর দরজায় অতিথিদের আশাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর পরনে ফিনফিনে ধুতি, গায়ে আগাগোড়া সুতোর কাজ করা দামি কাশ্মীরি শাল, পায়ে বিদ্যেসাগরি চটি। জোড়হাতে সবিনয়ে অতিথিদের স্বাগত জানালেন। জিপটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল— সে-সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করলেন। তবে তার আরোহীরা কারা এবং তারা ভেতরে আসতে অনিচ্ছুক জেনে সে-বিষয়ে আর কোনোরকম বাক্যব্যয় করলেন না।
বিশ্বাস মশাইয়ের বাড়িটা বেশ বড়ো। সদর দরজার পর প্রকাণ্ড উঠোন, বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে বাঁধানো। তার উত্তর দিকে দোতলা বসতবাড়ি যার একতলা ঘিরে চওড়া বারান্দা। উঠোনের পশ্চিম দিকে একটা মাঝারি আকারের একরত্ন মন্দির। পুবদিকে বাগান, অন্ধকারে তার বিস্তারটা বোঝা যায় না। আর দক্ষিণে একসার একচালা। সেগুলো বোধ হয় গোয়াল ঘর, চাকরদের ঘর, গুদাম ঘর ইত্যাদি হবে। কিন্তু সবচেয়ে যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা একটা বড়ো গাছের নীচে বাঁধানো বেদির ওপর একটা তান্ত্রিক সাধনার আসন। আসনটা একটা বাঘছাল। তার সামনে পাঁচটা খুলি, একপাশে একটা ত্রিশূল সিমেন্টের মেঝেয় গাঁথা।
দময়ন্তী ওদিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে দেখে দীনেশ বললেন, ‘কী দেখছেন? ওটা কিন্তু আর ব্যবহার হয় না।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যবহার হয় না? তবে বাঘছাল অমনিই পড়ে আছে? নষ্ট হয়ে যাবে না? জল-টল লাগলে…’
দীনেশ বাধা দিয়ে বললেন, ‘নষ্ট হবে কেন? বাঘ কি ছাতা মাথায় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় যে তার চামড়ায় জল লাগলে সেটা নষ্ট হয়ে যাবে?’ বলে ফিক করে হাসলেন। বললেন, ‘এখন ব্যবহার হয় না বটে, কিন্তু জায়গাটা খুব পবিত্র। আমার গুরুদেব ওখানে বসেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।’
‘আপনার গুরুদেব এখন কোথায়?’
‘তিনি দেহরক্ষা করেছেন আজ বহুদিন হল।’
‘শুনেছি আপনার বাড়িতে সবসময়েই বহু সাধুসন্ন্যাসীর আনাগোনা। তাঁদের কাউকে দেখছি না তো?’
‘আগে আসতেন। আজকাল আর তেমন কেউ আসেন না। প্রকৃত সাধুর দেখা পাওয়াই তো বার। বেশির ভাগই ঠগ নয়তো জোচ্চোর।’
‘এখন তাহলে কেউ নেই? আমার আবার সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ করার খুব ঝোঁক!’
দীনেশ সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘অদ্ভুত! আপনি একদিকে পুরো শহুরে, একদিকে গোয়েন্দা আবার অন্যদিকে সাধুসন্ন্যাসীতে ইন্টারেস্টেড? ভারি আশ্চর্য! তবে হ্যাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে সকলেরই কৌতূহল থাকতে পারে। ওটা তো প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অবশ্য, এখানে আপনি একজন সন্ন্যাসীরই দেখা পেতে পারতেন। তিনি আমার গুরুভাই— জীবাত্মানন্দ গিরি। বহুদিন এখানে আছেন। ওই মন্দিরের সেবায়েত বলতে পারেন। কিন্তু আজ তো তিনি নেই, সিঙ্গুরে চলে গেছেন। কাল ফিরবেন।’
‘ইনি কতদিন আছেন আপনার এখানে?’
‘বছর দশেক হবে।’
‘আপনি সাধনভজন করেন আবার চাকরিও করেন? কোথায় চাকরি করেন?’
‘সিঙ্গুরে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ দপ্তরে। রিটায়ার করবার সময় হয়ে এল। তারপর শুধুই সাধনভজন। দেহমন পরিষ্কার করে ওপারে পাড়ি জমাতে হবে তো!’
‘তা বটে। চলুন, এবার আপনাদের মন্দিরটা দেখে আসি।’
‘চলুন।’
.
সমরেশ সহর্ষে বলল, ‘আরে কী কাণ্ড! এত খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন কেন? এত কি কখনো খাওয়া যায়?’ বলে থালাটা আরও কাছে টেনে নিল।
দীনেশ বললেন, ‘সামান্য আয়োজন। আপনাদের এরপর একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াব। আমার স্ত্রীর হাতের রান্না খেলে আর ভুলতে পারবেন না।’
দময়ন্তী আলোচনাটা আর বেশিদূর এগোতে দিল না। বলল, ‘আচ্ছা, মহীপালের দিঘিতে যে সরকারি কাজকর্ম হতে যাচ্ছে, তাতে নাকি আপনার আপত্তি আছে। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?’
দীনেশ একটু চিন্তা করে বললেন, ‘আপত্তি আছে ঠিকই। বেশ ভালো রকমের আপত্তি আছে। তবে, আমার কথা আর শোনে কে? আপনি যখন বললেন যে সাধুসন্ন্যাসীতে আপনার ভক্তিশ্রদ্ধা আছে, ধর্মকর্মেও আছে, তখন আপনাকে বলা যায়। আপনি হয়তো আমার কথা শুনে হাসবেন না। আমার ধারণা, মহীপালের দিঘি একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। আমি অন্তত দু-জন সাধুকে জানি যাঁরা ওখানে সাধনা করেছেন, সিদ্ধিলাভ করেছেন এবং আমার এই ধারণাকে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। আপনি হয়তো শুনেছেন যে মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে ওই দিঘির ভেতরে একটা অত্যুজ্জ্বল আলো দেখা যায়। লোকে বলে ওটা আলেয়া। শুনে আমি হাসি। আলেয়ার আলো কখনো অত উজ্জ্বল হয়? আমি জানি ওটা স্বর্গীয় আলো।’
‘কী করে জানলেন? আপনি কি ওই আলো স্বচক্ষে দেখেছেন?’
দীনেশ একটা করুণ হাসি হাসলেন। বললেন, ‘আমি পাপী-তাপী লোক। ওই আলো দেখবার সৌভাগ্য আমার হবে? ওই আলো দেখেছেন যাঁরা সাধক। তাঁদের অনেকেই এই বাড়ি পবিত্র করে রেখে গেছেন। তাঁদের মুখেই আমি শুনেছি যে ওই আলো দিঘির জলে সৃষ্ট হয় না, নেমে আসে আকাশ থেকে। একজন তো রথের আকৃতিবিশিষ্ট কিছু একটা ওই আলোর মধ্যে দেখেছেন। আর ওই আলোর কাছাকাছি গেলে নাকি একটা অপূর্ব সুগন্ধ পাওয়া যায়।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘আমি তো মশাই ওই আলো বেশ কয়েকবার দেখেছি। খুব উজ্জ্বল বলে তো মনে হয়নি। কেমন একটা ভূতুড়ে— আবার এদিক-ওদিক চলে বেড়ায়।’
দীনেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি পুণ্যাত্মাদের মুখে যা শুনেছি তাই বললুম। হয়তো আপনি যা দেখেছেন তা অনেক দূরের আলো। তবে, আমার গুরুদেব আমাকে বলেছিলেন যে ওই জায়গাটা অত্যন্ত পবিত্র, দেবতাদের লীলাক্ষেত্র। ও জায়গাটা খোঁড়াখুঁড়ি করতে গেলে দেবতাদের অভিশাপ কীভাবে কার ওপরে আসবে, কে বলতে পারে?’
সমরেশ একটা সন্দেশ মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে খুব আশার সঙ্গে বলল, ‘অভিশাপ যদি বর্তায় তবে সেটা নির্ঘাত আমাদের জেনারেল ম্যানেজার শালা মহালিঙ্গমের ওপর বর্তাবে। আমরা তো কেবল হুকুম তামিল করছি। যত দোষ সব ওই শালা মহালিঙ্গমের।’
শিবশঙ্কর মৃদু হেসে বললেন, ‘অত আশা কোরো না। ন্যুবেমবার্গ বিচারের সময় নাতসি মহাপ্রভুরাও ওই একই কথা বলে পার পেয়ে যাবে ভেবেছিল। পায়নি।’
.
গায়ত্রী সব শুনে বললেন, ‘হ্যাঁরে দময়ন্তী, তোর তো চারজনের সঙ্গেই মোলাকাত হল, কী বুঝলি?’
দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘সব কিছু বুঝতে পেরেছি তা বলতে পারছি না। অনেক জায়গায় খটকা লাগছে।’
শিবশঙ্কর বললেন, ‘কয়েকটা বলো না। আমরাও তো একটা হেল্প করতে পারি, নাকি? অবিশ্যি যদি তোমার আপত্তি থাকে…’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, আপত্তি থাকবে কেন? তাহলে, যা যা মনে আসছে, বলছি।’
প্রথমত, রাজারাম তার ভাগনেকে চোর বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করছে, অথচ তাকে না দিচ্ছে পুলিশে, না ফেরত দিচ্ছে চোরাই মাল। লোকটাকে কিন্তু সবাই সৎ বলেই জানে। তার এরকম ব্যবহার করার কারণ কী হতে পারে? দ্বিতীয়ত, শরৎ মাস্টার ঠোঁটকাটা রূঢ়ভাষী লোক, দুনিয়ার লোককে খারাপ বলতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নন, কিন্তু আমাদের দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। কেন? তৃতীয়ত, নিত্যগোপালবাবু আমাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাগে দিশেহারা হয়ে এমন ব্যবহার করলেন যে তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষের কাছে তা আশা করা যায় না। কেন?
এগুলো ছাড়া আরও কয়েকটা ব্যাপার অস্বাভাবিক ঠেকে। যেমন, দীনেশের ধারণা দিঘির জঙ্গল দেবতার স্থান। ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি করলে সেটা ভয়ানক অভিসম্পাত নিয়ে আসবে সকলের ওপর। অথচ, অভিমন্যু হাজরা, যিনি প্রায়ই কোদাল গাঁইতি কাঁধে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান, তাঁকে বাধা তো দেনই না, বরং তাঁর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলেন। ধনঞ্জয় মাঝির বাড়িটা অসম্ভব রংচঙে, পরি-টরিওয়ালা। এরকম বাড়ি তারাই করে যারা নিজেদের জাহির করতে চায়। অথচ ধনঞ্জয় কারুর সঙ্গে মেশেন না, কেউ বাড়িতে আসে সেটা পছন্দ করেন না। দীনেশের বাড়িতে গাছের তলায় বেদিতে বাঘছাল পাতা, অথচ সেটা নাকি বহুদিন ব্যবহার হয় না। জায়গাটা কিন্তু ঝকঝক করছে। হয়তো কেউ পরিষ্কার করে রোজ, কিন্তু বাঘছালটা সরায় না। কেন? অভিমন্যু দিঘির জঙ্গলে এমন এক লুপ্ত সভ্যতার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন যার সম্পর্কে তাঁর কোনো সঠিক ধারণাই নেই।’
দময়ন্তী চুপ করার পর শিবশঙ্কর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুঃখিত দময়ন্তী, তোমার একটা প্রশ্নেরও জবাব বা ব্যাখ্যা দিতে পারছি না। তবে একটা কথা বুঝতে পারছি যে কেবল সমরেশের কোম্পানির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির প্রতিই যে তোমার সন্দেহ, তা নয়। আমাদের অনেকের প্রতিও তোমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
দময়ন্তী গম্ভীর মুখে ওপরে নীচে মাথা নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।’
গায়ত্রী বললেন, ‘এখন তাহলে তুই কী করবি?’
‘একবার মহীপালের দিঘিটা দেখতে যাব।’
.
জিপটা রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে দু-জন সার্ভেয়ার, মুখতার, সমরেশ আর দময়ন্তী ঝোপঝাড়ের মধ্যে প্রায়-অদৃশ্য একটা শুঁড়িপথ ধরল। রাস্তার অন্যদিকে কয়েকজন কৌতূহলী দর্শক দাঁড়িয়ে ছিল। তারা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল, কেউ এগিয়ে আসার চেষ্টা করল না।
শাড়ি পরে থাকার জন্যে দময়ন্তীর চলতে অসুবিধে হচ্ছিল আর সেই কারণে পুরো দলটাই খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল। মিনিট পাঁচেক চলার পরই ওরা ঢুকে পড়ল ঘন জঙ্গলের ভেতর। চারদিকে বড়ো বড়ো গাছের সমারোহ, বেলা দশটার সময়ও যেন সন্ধ্যের অন্ধকার। পেছনের রাস্তাটা আর দেখা যায় না। আর, অদ্ভুত ব্যাপার, রাস্তায় বাস বা লরি চলার কোনো শব্দও পাওয়া যায় না। সমস্ত জায়গাটা একটা থমথমে, ভীতিজনক নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে রয়েছে। আরও কিছুটা যাওয়ার পর জঙ্গলটা যেন একটু পাতলা হয়ে এল। আলো বাড়তে লাগল। সেইসঙ্গে নাকে এল একটা মিষ্টি মিষ্টি কিন্তু অস্বস্তিজনক গন্ধ। প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর দলটা জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে উপস্থিত হল।
জায়গাটা অদ্ভুত। সামনে একটা বড়ো জলাশয়, এক বিঘের চেয়ে একটু কম হবে। অপরিচ্ছন্ন শ্যাওলা ভরা জল অগভীর, মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ মাথা উঁচিয়ে আছে। চারদিকে জঙ্গল হওয়ার ফলে হাওয়া চলাচল প্রায় নেই। কাজেই জলে কোনো ঢেউ ওঠার লক্ষণ নেই। কেবল জায়গায় জায়গায় মাঝে মাঝে তলা থেকে বুদবুদ উঠে ওপরে এসে ফেটে যাচ্ছে। এটুকুই যা চাঞ্চল্য। এ ছাড়া সব কিছু স্থির, শব্দহীন, স্যাঁৎসেঁতে অসাড়। জলাশয়ের একপাশে একটা উঁচু ঢিবি, কাঁটাঝোপে ঢাকা। তার মাথায় চারটে শালখুঁটি পুঁতে একটা ক্যানভাসের কাপড় টাঙানো। সেই শামিয়ানার নীচে একটা টেবিল আর গোটাতিনেক চেয়ার শোভা পাচ্ছে।
দময়ন্তী অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সেই জলাশয়ের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘মাছ আছে নাকি?’
সমরেশ মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, মার্শ গ্যাসের ভুড়ভুড়ি উঠছে, মাছ নেই। এই যে গন্ধটা পাচ্ছ ওটা ওই গ্যাসেরই!’
‘এরকম ডোবা আর ক-টা আছে? অবশ্য এটাকে যদি ডোবা বলা যায়।’
‘অসংখ্য। রাস্তা থেকে এটাই সবচেয়ে কাছে। এরপর শুধুই জঙ্গল আর জলা, জলা আর জঙ্গল। কয়েক মাইল গেছে। কয়েকটা তো বিশাল। বিল বলা চলে।’
‘আমরা যে পথটা দিয়ে এলুম, এরকম পথ আরও আছে?’
‘আছে কয়েকটা। এর পরেরটা আরও আধ মাইলটাক দূরে।’
‘নিমগাছিয়ার মোড় আর রাজমৈশির ভেতরে কোনো রাস্তা নেই?’
‘না।’
‘ঠিক আছে। চলো, ফিরে যাই!’
‘আর কিছু দেখবে?’
‘না, দরকার নেই। কেবল একটা কথা। এই জলাটা তো তোমাদের ভরাট করার কথা, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তবে এখুনি নয়। সেটা হবে কাজের একেবারে শেষ দিকে।’
‘একটা কাজ করতে পারো? পাম্প করে এই জলার সব জল তুলে দিতে পারো?’
সমরেশ জবাব না দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বাসুদেবের দিকে তাকাল। বাসুদেব বললেন, ‘পারা যাবে। আপনি স্যার হেড অফিসে ফোন করে বলুন গোটা তিনেক বড়ো ডিজেল পাম্প যেন পাঠিয়ে দেয়। আমাদের হলদিয়া সাইটে যেরকম আছে, সেইরকম। দু-দিনে ওই ডোবা ডিওয়াটার করে দেওয়া যাবে।’
সমরেশ বলল, ‘ঠিক আছে। আমি তাহলে আজই ফোন করে দিচ্ছি। চলো হে মুখতার, তুমি ওঁকে সাঁতরাবাড়িতে আর আমাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘না। মুখতার এখানেই থাকবে। চারদিকে নজর রাখবে। আমরা দু-জন ফিরে যাব। নিমগাছিয়ার মোড় থেকে বাস ধরে নেব।’
.
সন্ধে ছ-টা নাগাদ ডা শিবশঙ্কর সাঁতরার গাড়ি ফিরে এল। পেছনে পেছনে মুখতারের জিপ। মুখতারকে নামতে দেখে গায়ত্রী হাউমাউ করে উঠলেন, ‘এ কী, কী হয়েছে তোমার? এসব কী করে হল?’
গায়ত্রীর আর্তনাদ শুনে দময়ন্তী দৌড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল। দেখা গেল মুখতারের জামা কয়েক জায়গায় ছেঁড়া, সারা মুখে হাতে আর গলায় গুচ্ছের স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো।
মুখতার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শালা, পালিয়ে গেল! ধরতে পারলাম না!’
দময়ন্তী রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, ‘কে পালিয়ে গেল? কী হয়েছিল?’
‘আমি তো, মেমসাহেব, ওই ঢিবিটার নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আর এই বাবুরা ওপরে কাজ করছিলেন। এমন সময় ঢিবির পেছন থেকে একটা সড়সড় শব্দ কানে এল। ওখানে এমনিতে কোনো শব্দ নেই। কাজেই ভাবলাম দেখি শব্দটা কোত্থেকে আসছে। শব্দটা সরকারবাবুরও কানে গিয়েছিল। আমি ওঁকে ইশারা করে বললাম, কাজ চালিয়ে যান, আমি দেখছি। আমি ঢিবিটার পেছন দিকে চুপি চুপি গিয়ে দেখি একটা মোটা মতন লোক মুখে লাল কাপড় বেঁধে আস্তে আস্তে ঢিবি বেয়ে ওপরে উঠছে। লোকটার হাতে একটা লোহার ডান্ডা।’
সমরেশ এখানে বাধা দিয়ে বলল, ‘ডান্ডা ঠিক নয়, সড়কি বলতে পারো।’
‘হ্যাঁ, তা হতে পারে। লোকটা পেছন ফিরে হঠাৎ আমাকে দেখেই ডান্ডাটা আমার দিকে ছুড়ে মারল। আমি লাফিয়ে একপাশে সরে যেতে যেটুকু সময় লাগল তার মধ্যেই সে শালা দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। আমি ওকে খুব তাড়া করলাম বটে, কিন্তু মনে হল লোকটা জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মাঝখান থেকে পা পিছলে ঝোপের মধ্যে পড়ে গিয়ে আমার এরকম অবস্থা হয়ে গেল! পা যদি না পিছলে যেত তাহলে হয়তো লোকটাকে ধরতে পারতাম।’
দময়ন্তী বলল, ‘সে-ব্যাপারে সন্দেহ আছে, মুখতার। সে জঙ্গলটা খুব ভালো চেনে। তুমি তাকে সেখানে ধরতে পারতে কি না সেকথা জোর করে বলা যায় না। তবে দুটো জিনিস বোঝা যাচ্ছে। এক, লোকটা ওখানে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি আশা করেনি। দুই, যা বললুম, লোকটা ওই জঙ্গলের সঙ্গে খুবই পরিচিত। আচ্ছা মুখতার, লোকটা কী পরেছিল বলো তো?’
‘লাল রঙের হাফপ্যান্ট আর কালো কম্বল। মুখে লাল কাপড় বাঁধা ছিল। আর বিশেষ কিছু দেখিনি— অল্প সময় তো!’
‘তুমি বললে লোকটা মোটা। কী করে বুঝলে?’
‘পা দুটো দেখেছিলাম, মোটা মোটা। আর পালাবার সময় দেখেছিলাম ভারী শরীর।’
‘লোকটা পালিয়ে যাবার পর তুমি কী করলে?’
‘আমি এই দুই বাবুকে উঠিয়ে নিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে গেলাম। সেখানে সাহেবও ছিলেন। আর ডাক্তারবাবু আমাকে এইসব লাগিয়ে দিলেন।’
দময়ন্তী সমরেশের দিকে ফিরে বলল, ‘ফোন পেলে?’
সমরেশ বলল, ‘পেয়েছি। তিনটে পাম্প কাল বিকেলে পৌঁছোচ্ছে! লোকজন আজ রাত্রে এসে যাবে। কাল সকাল থেকে ফুল সুইঙে কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে।’
.
বাইরে তখন সন্ধ্যের অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। শিবশঙ্করের গাড়ি দেউড়ি পার হয়ে ভেতরে এসে ঢুকল। বারান্দায় বসে গায়ত্রী আর দময়ন্তী চা খাচ্ছিল। শিবশঙ্কর গাড়ি থেকে নেমে বারান্দায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সমরেশ ফেরেনি এখনও? খুব কাজ করছে দেখছি। গত দু-দিন তো নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছে না। আজ একটু তাড়াতাড়ি এলে ভালো করত। ওকে বলতেই ভুলে গেলুম।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? তাড়াতাড়ি কীসের?’
‘আজ বাবার ঘরে মিটিং আছে। আশপাশের গ্রামের মাতব্বররাও আসছেন। ওর কোম্পানির কাজ নিয়েই কথাবার্তা হবে। মিটিং ডেকেছে নেত্য। সেখানে ও থাকলে ভালো হত।’
‘তাই বলুন। বিকেল থেকেই অনেকে আসছেন দেখছি। নিত্যগোপালবাবু এসেছেন। দীনেশবাবু, শরৎবাবুও এসে গেছেন। আরও চার-পাঁচজন এসেছেন। তবে মিটিং এখনও শুরু হয়নি। চা খাওয়া চলছে। হয়তো আরও কয়েকজনের জন্যে সবাই অপেক্ষা করছেন।’
এই কথার মধ্যেই কৃত্তিবাস বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। বোধ হয় গাড়ির আওয়াজ পেয়ে থাকবেন। বললেন, ‘কে, শিবু এলি? আমার ঘরে আয়। আমরা মিটিং শুরু করে দিচ্ছি। আর বউমা, সমরেশ এলে ওকেও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ো।’
শিবশঙ্কর আর বাক্যব্যয় না করে কৃত্তিবাসের পেছন পেছন চলে গেলেন।
শিবশঙ্করের প্রস্থানের মিনিট দশেক বাদেই দুটো জিপ ঝড়ের বেগে বাড়ির ভেতর ঢুকল। প্রথমটা পুলিশের, সেটা থেকে নামলেন সনৎ। দ্বিতীয়টা থেকে সমরেশ। মুখ দেখে মনে হল দু-জনেই অত্যন্ত উত্তেজিত।
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কী, লাশ পেয়েছ মনে হচ্ছে?’
সনৎ রুদ্ধশ্বাসে বললেন, ‘হ্যাঁ, কঙ্কাল! ফিমেল। এখনও মাথায় লম্বা চুল লেগে আছে।’
‘কী করে পাওয়া গেল?’
সমরেশ বলল, ‘আজ দুপুরের দিকে ওই জলার জলের লেভেল অনেকটা নেমে যায়। আমাদের একজন কুলি পাম্পের সাকশন পাইপটা আরও নীচে নামানোর জন্যে কাদার মধ্যে নামে। সেখানে একটা সাপোর্ট বসাবার জন্যে কোদাল দিয়ে গর্ত কাটতে গিয়ে চিৎকার করে দৌড়ে উঠে আসে। আমরা গিয়ে দেখি সেই গর্তের ভেতর একটা কাদামাখা কঙ্কালের হাত। তক্ষুনি থানায় খবর পাঠাই আর সবাই মিলে সাবধানে কাদা সরিয়ে কঙ্কালটা এক্সপোজ করি। ওটার গায়ে তখনও জায়গায় জায়গায় অল্প অল্প মাংস লেগেছিল।’
দময়ন্তী বলল, ‘জলা জায়গায় যেখানে অনবরত মার্শ গ্যাস উঠছে, বেশি রোদ আসে না, স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া, সেখানে এটা অস্বাভাবিক নয়। ইংল্যান্ডের এরকম একটা জায়গায় প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো মৃতদেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।’
সমরেশ আর সনৎ প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু এ কে? কার কঙ্কাল?’
দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এখনও বোঝনি? ঠিক আছে মিটিং-এ চলো। সেখানেই বলব। আর সনৎবাবু, এ খবরটা কি খুব চাউর হয়ে গেছে?’
সনৎ মাথা নেড়ে বললেন, ‘খুব সম্ভব না। সমরেশবাবুর লোকেরা জানেন। আশপাশের গাঁয়ের লোকেরা জানে বলে মনে হয় না।’
‘তাহলে, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। একটা রেড করা দরকার। এক্ষুনি।’
সনৎ বললেন, ‘কী করতে হবে, বলুন।’
.
দময়ন্তী বলল, ‘আপনাদের এই মিটিং-এ অনাহূত হলেও আমাকে আসতে হল। মহীপালের দিঘিতে যে কাজকর্ম হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। এবার সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।’
নিত্যগোপাল বিদ্রূপপূর্ণ গলায় বললেন, ‘পরিষ্কার হয়ে গেছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে, নিত্যগোপালবাবু।’ বলে দময়ন্তী কৃত্তিবাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার অনুমতি পেলে আমি বলতে পারি।’
কৃত্তিবাস মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ মা, বলো। আমরা সবাই শুনব।’
‘আমরা জানি, মহীপালের দিঘিতে সরকারি প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে চাররকম অভিযোগ ছিল। প্রথম, সামাজিক। শরৎবাবুর ধারণা প্রোজেক্ট হলেই বাইরের লোক আসবে এবং এই অঞ্চলের ট্র্যাডিশনাল জীবনযাত্রা প্রণালীতে ফাটল ধরবে। দ্বিতীয়, ঐতিহাসিক। অভিমন্যুবাবুর বিশ্বাস ওখানে মাটির নীচে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাবস্তু লুকিয়ে আছে। সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়, প্রাকৃতিক। নিত্যগোপালবাবুর বিশ্বাস ওখানে জঙ্গল সাফ করলে ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। চতুর্থ, পারত্রিক। দীনেশবাবুর বিশ্বাস ওটা দেবতার স্থান। ওখানে গোলমাল করলে দেবতারা ভয়ানক রেগে যাবেন।
‘এ পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের যুক্তি তর্ক ইত্যাদি উঠতে পারে। এবং ওঠা উচিত। তবে প্রথম তিনটে যুক্তির সঙ্গে তর্ক চলে, হয়তো একটা আপোশও করা চলে। যেমন, শরৎবাবুকে বলা যেতে পারে যে ওই প্রোজেক্টের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ চাকরি কেবল স্থানীয় লোকদেরই দেওয়া হবে, বা অভিমন্যুবাবুকে বলা যেতে পারে যে খোঁড়াখুঁড়ি যা হবে সব আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভের তত্ত্বাবধানে যাতে হয় তার বন্দোবস্ত করা হবে। নিত্যগোপালবাবুকে একথা বলা যায় যে বুড়োশিবতলা বা নিমগাছিয়ার দিকের যে জঙ্গল তা যখন সাফ হয়েছিল তখন তিনি যখন কোনো আপত্তি করেননি এবং তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্যেরও কোনো ঘাটতি পড়েনি, তখন এই বেলায় কোনো অসুবিধে হবে না এটা ধরে নেওয়ায় কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। তবে, চার নম্বর যুক্তির সঙ্গে কোনো তর্ক চলে না। আমরা সামান্য মানুষ, দেবতারা কীসে খুশি হন আর কীসে হন না, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা তো আমাদের নেই।
‘ঘটনাটা যদি যুক্তি তর্ক বা বাদ-প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে একরকম হত। কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়াল অন্যরকম। দেখা গেল, এক বা একাধিক ব্যক্তি কাজটা বন্ধ করার জন্যে কেবল যে উঠে-পড়ে লেগেছেন তাই নয়, অসামাজিক বা বেআইনি রাস্তা নিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। প্রাণের ভয় দেখানো শুধু নয়, কিছুদিন আগে প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছে।
‘এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ওখানে এমন একটা কিছু আছে যা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখার জন্যে কেউ কেউ অত্যন্ত ব্যগ্র। এবং এ বিষয়েও সন্দেহ থাকে না যে সেটা একটা ভয়ংকর ক্রিমিনাল কোনো ব্যাপার। যাঁরা যুক্তিতর্ক দেখাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে একজন ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছেন। অথবা সকলেই সত্যি কথা বলছেন, সম্পূর্ণ বাইরের কেউ এর মধ্যে জড়িত।
‘বাইরের কেউ হতে পারে না, কারণ ওখানে বাইরের লোকের আনাগোনা থাকলে শিবশঙ্করবাবুর কানে আসত। সেরকম কিছু আসেনি। অতএব এ অঞ্চলেরই কেউ ওখানে কোনো কুকর্ম করেছেন বা করছেন যেটা এখন ঢাকা দেবার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা কিন্তু পুরোনো। তা যদি না হত তাহলে ওই ঢিবির দিকে যাওয়ার রাস্তাটা অনেক পরিষ্কার থাকত। তা যখন নয়, তখন কোনো সন্দেহ থাকে না যে কোনো পুরোনো পাপ চাপা দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য কার হতে পারে?
‘প্রথমেই আমরা শরৎবাবুকে বাদ দিলুম। কারণ, তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখলুম যে তিনি কূটভাষী, রুক্ষ স্বভাবের মানুষ, কিন্তু ভীতু প্রকৃতির। তাঁর স্বভাবের জন্যে তিনি যে খুব একটা জনপ্রিয়, তাও মনে হয় না। অতএব তাঁর যে কোনো শাগরেদ থাকতে পারে যে তাঁর হয়ে নোংরা কাজ করবে, সেটা কখনোই মনে হয় না। অথচ এ কাজের ধরনটা এমনই যে একেবারে একজন লোকেরই হাতের কাজ তা হতে পারে না।
‘এরপর অভিমন্যুবাবু। ইনি জঙ্গলের মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঘুরে বেড়ান। হয়তো কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিতে জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন। সেটা কী হতে পারে? আগেই বলেছি, এখানে যেটা চাপা দেবার চেষ্টা চলেছে, সেটা কোনো পুরোনো পাপ। অভিমন্যুবাবুর বয়েস অল্প, আরও অল্প বয়সে তিনি কী এমন খারাপ কাজ করে থাকতে পারেন? ইনি একজন জনপ্রিয় অধ্যাপক, বিশ্বাস করেন যে এখানে এককালে সুপ্রাচীন সভ্যতা একটা ছিল। সেটা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে দিঘির জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করে অতি চমৎকার একটা মিউজিয়াম বানিয়েছেন নিজের বাড়িতে, সুখী সংসারী মানুষ— এমন লোক কোনো ভয়ংকর কাজ করেছেন আর সেটা চাপা দেবার জন্যে মানুষ খুন করবার চেষ্টা করছেন, এটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। অথচ যে লোকটা খুন করবার জন্যে ঢিবিতে গিয়েছিল তার শারীরিক বর্ণনা কিছুটা ওঁর সঙ্গে মেলে। অতএব, এঁকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া গেল না।
‘অতঃপর আসছেন নিত্যগোপালবাবু। এঁর সম্পর্কে জানা গেল যে ইনি পণ্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু নেশাভাং করেন। সম্প্রতি ড্রাগের নেশাও ধরেছেন। এমন লোক যতই বড়োলোক হোক না কেন, আস্তে আস্তে নীচের দিকে নেমে যায়। তার জমিজমায় টান পড়ে। দেখা যাচ্ছে, উনি কিন্তু খুব একটা খারাপ অবস্থায় পড়েননি, অথচ নেশা চালিয়েই যাচ্ছেন। প্রথম যখন ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তখন উনি আমার সঙ্গে ক্ষিপ্তের মতো অভদ্র ব্যবহার করেছিলেন। ড্রাগ অ্যাডিক্টদের লক্ষণ। আমরা জানি এরকম মানুষের ক্রিমিনাল ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর একটা ঘটনা লক্ষণীয়। তা হচ্ছে, জুবিলি কলেজে সরকারি অফিসারদের সঙ্গে আপনাদের আলোচনার পর থেকেই ইনি পাগলের মতো কাজটা বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটা কি নিজের ইচ্ছেয় না অন্যের আদেশে? ওঁর যে মতবাদ সেটা যে ফাঁকা তার প্রমাণ, জঙ্গল যখন আগে সাফ হয়েছে তখন তিনি কিন্তু তার কোনো প্রতিবাদ করেননি। অতএব, হয় তিনি নিজেই দিঘির কোনো কুকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, নয়তো অন্য কেউ তাঁকে পরিচালিত করছে। যদি দ্বিতীয় তথ্যটা সঠিক হয়, তাহলে কে সেই পরিচালক হতে পারে? নিঃসন্দেহে যে তাঁকে নেশার বস্তু সাপ্লাই করছে। দু-জন এই কাজ করতে পারে। প্রথম, দীনেশবাবুর বাড়ির কোনো সন্ন্যাসী। দ্বিতীয়, রহস্যময় ধনঞ্জয় মাঝি।’
কৃত্তিবাস প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি বলতে চাও, নেত্য একটা ড্রাগের ব্যাবসা চালায়?’
‘না, তা আমি কখনোই বলতে চাই না। আমি তো আগেই বলেছি, ওখানে কিছু চলছে, তা হতে পারে না। কিছু একটা ঘটেছে সেটাই চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
‘আমি তাহলে এবার ধনঞ্জয়বাবুর কথা বলি। ইনি কারুর সঙ্গে মেশেন না, গ্রামের কোনো ব্যাপারে থাকেন না। অথচ, গ্রামেই থাকেন। প্রচুর খরচ করে রংচং করে বাড়ি করেছেন যেরকম বাড়ি লোক ডেকে দেখানোর জন্যেই বানানো হয়। অর্থাৎ, ওঁর অন্তরালে বাস সম্ভবত স্বেচ্ছায় নয়। তাহলে এভাবে আছেন কেন? দুটো কারণ হতে পারে। এক, উনি কোনো ক্রিমিনাল কাজ অতীতে করেছেন যার জন্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অথবা, অন্য কোনো কারণে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
‘এবার তাহলে দেখতে হয় যে, যে অন্যায় কাজটা চাপা দেওয়া হচ্ছে, সেটা কী। সেটা খুন। ওখানে কোনো নারীহত্যার সাক্ষ্যপ্রমাণ চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
‘নারীহত্যা? তুমি কী করে বুঝলে?’ কৃত্তিবাস প্রশ্ন করলেন।
‘রাজারামের সঙ্গে কথা বললে এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয়। রাজারাম এখানে নেই, কিন্তু তার ব্যাপার-স্যাপার আপনারা জানেন। সে লোকটা অত্যন্ত সৎ, পৃথিবীতে তার আত্মীয় বলতে আছে তার বিধবা বোন আর ভাগনে। এই বোনের বৈধব্যের কষ্ট দেখতে না পেরে সে তাকে নিজের সংসারে নিয়ে আসে এবং দারিদ্র্যের মধ্যেও তাকে আর তার ছেলেকে সে প্রতিপালন করে। অতএব, ধরা যেতে পারে যে এই বোনের কোনো কথা বা উপরোধ ঠেলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন, এই রাজারামের ভাগনে কিছুদিন দিঘির জঙ্গলে সার্ভেয়ারদের সঙ্গে কাজ করেছিল। তারপর, ছেড়ে পালিয়ে আসে। সেই সময় থেকে রাজারাম তাকে চোর বলে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমরা জানি সার্ভেয়ারদের কিছুই চুরি যায়নি। অথচ, রাজারাম তাকে পুলিশেও দিচ্ছে না। কেন? পুলিশে দিতে গেলে চোরাই মাল বের করে দিতে হয়। সেটা সে দিতে পারছে না। এই অন্যায় কাজটা সে একমাত্র তার বোনের উপরোধেই করতে পারে। তাহলে সন্দেহ থাকে না যে চোরাই মালটি এক বা একাধিক গয়না। রাজারামের ভাগনে দিঘির জঙ্গলে ওই গয়নাগুলো কুড়িয়ে পেয়ে মাকে দেয়। রাজারাম জানতে পেরে তাকে প্রচণ্ড বকাবকি বা মারধর দেয়। তখন তার বোন বলে যে যদি কেউ এই গয়না দাবি করে, তাহলে তাকে দিয়ে দেওয়া যাবে। তা না হলে এটা ভগবানের দান বলে মেনে নিতে হবে। মেয়েদের গয়নার প্রতি যে আসক্তি রাজারাম সেটা বিলক্ষণ জানে। অতএব, এই প্রস্তাব সে স্বীকার করে নেয় বটে, কিন্তু তার মন এগুলো ভগবানের দান, একথা অন্তরের সঙ্গে মেনে নিতে পারে না। সেইজন্যেই সে ভাগনেকে চোর সাব্যস্ত করে বসে আছে।’
কৃত্তিবাস মৃদু হেসে বললেন, ‘গয়নার প্রতি কার কীরকম আসক্তি, তুমি ছাড়া সেটা কে আর বেশি ভালো বুঝবে?’
দময়ন্তীও হাসল। বলল, ‘সেকথা ঠিক। আর সেইজন্যেই আমার বিশ্বাস, আমার এই অনুমান একটুও মিথ্যে নয়। অতএব, দিঘির জঙ্গলে কোনো পুরোনো দুষ্কর্ম চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, আর ওখানে পাওয়া গেছে কিছু বেওয়ারিশ গয়না যে সম্পর্কে পুলিশে কেউ কখনো রিপোর্ট করেনি। এই দুই ঘটনার যোগফল কিন্তু একথাই প্রমাণ করে যে ওখানে কোনো নারীহত্যা হয়েছিল এবং মৃতদেহ ওখানেই কোথাও আছে। মৃতদেহের গা থেকে যে কিছু গয়না খুলে পড়ে গেছে, হত্যাকারী তাড়াহুড়োর মধ্যে সেটা আর লক্ষ করেনি।
‘এবার তাহলে ধনঞ্জয়বাবুকে এই অনুমানের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক। ধনঞ্জয়বাবু কাকে খুন করে থাকতে পারেন? তাঁর স্ত্রীর আজ থেকে বছর পনেরো আগে খুনের দায়ে আট বছর জেল হয়েছিল। তখন তাঁর দুই ছেলে, একজনের বয়েস তিন, অন্যজনের এক। এরপর ধনঞ্জয় দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। কখন কেউ জানে না, কেউ নেমন্তন্নও খায়নি। কিন্তু সময়টা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। আজ তাঁর ছোটো দুই ছেলেমেয়ের বয়েস সাত আর পাঁচ। মেজো আর সেজোর মধ্যে তফাত ন-বছরের।’
কৃত্তিবাস আঙুল তুলে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাও ধনঞ্জয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী আসলে তার প্রথমা স্ত্রীই?’
‘হ্যাঁ, পার্বতী। অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্যে তার জেল হয়েছিল। ধনঞ্জয়বাবু তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন এবং তার অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন। তিনি চাননি যে অনিচ্ছাকৃত কোনো অপরাধের জন্যে তার জীবনটা সর্বনাশে তলিয়ে যায়। সাত বছর তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি অনেক অর্থোপার্জন করেছেন, জমিজমা ইত্যাদি করেছেন। কিন্তু সাত বছর বাদে আবার সংসার পাততে গিয়েও পারলেন না। কেন? আমাদের সমাজে জেলখাটা বউ নিয়ে সংসার পাতা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়। অথচ তিনি তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত নন। অতএব, তিনি প্রচার করে দিলেন যে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন এবং তাঁর স্ত্রী ভয়ানক পর্দানশিন। সেইসঙ্গে তিনিও স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিলেন। যাঁর স্বভাব নিজেকে প্রকাশ করা, তিনি নিজেকে নিজের ভেতরে গুটিয়ে নিলেন। কেন?’
কৃত্তিবাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
‘এ বিষয়ে আমি আমার অনুমান প্রকাশ করে বলতে পারি। কিন্তু তা বললে ধনঞ্জয়বাবুর কাছ থেকে তাঁর মতামত প্রয়োজন হবে। এবং সে-মতামত নির্ভীক সত্য হওয়া দরকার। সেটা হতে পারে যদি আজ এই সভা ঘোষণা করে যে ধনঞ্জয়বাবু তাঁর কৃতকর্মের জন্যে একঘরে হবেন না এবং সসম্মানে সমাজে থাকতে পারবেন।’
কৃত্তিবাস একটু চিন্তা করে বললেন, ‘এটা একটা অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত, দময়ন্তী। চট করে নেওয়া যাবে না। তবে এই সভার পক্ষ থেকে এটুকু বলতে পারি যে তোমার অনুমান নির্ভয়ে জানাও। যদি তা ভুলও হয়, তবুও তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অ্যাকশন নেবে না।’
‘বেশ, আমার ধারণা ধনঞ্জয়বাবুকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। ধনঞ্জয়বাবু স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে ফিরে তথাকথিত পরোপকারী লোকটির কাছে সব কথা বলেন। পরোপকারী লোকটি তখন ড্রাগের নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি এই সুযোগের সদব্যবহার করলেন। গোপন কথাটি গোপন রাখার মূল্য হিসেবে তিনি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। সেই টাকায় ড্রাগ কেনা হচ্ছে, তাঁর জমিজমায় টান পড়ছে না। পরোপকারী ব্যক্তিটি যে ধনঞ্জয়ের কাছ থেকে টাকা নেন সেটা কিন্তু এ গ্রামের সবাই জানে। তবে তাদের ধারণা, সেটা ধার।’
নিত্যগোপাল উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বাধা দিলেন কৃত্তিবাস। বললেন, ‘চুপ করে বোসো, নেত্য। দময়ন্তী যা বলেছে, সে-ব্যাপারে আমরা সবাই খোঁজ নেব। এবং কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে যে অপরাধী তাকে এই গ্রামের বাইরে বের করে দেব। এখন বলো তো দময়ন্তী, এই ড্রাগটি এখানে সাপ্লাই করে কে? ধনঞ্জয়? সে ব্যাবসাসূত্রে প্রায়ই কলকাতায় যায় বটে।’
‘আমার তা মনে হয় না। এ ধরনের গুরুতর দুষ্কর্ম করার লোক উনি নন। আমার বিশ্বাস এই ড্রাগ সাপ্লাই করে দীনেশবাবুর বাড়ির কোনো সন্ন্যাসী। খুব সম্ভবত, তাঁর গুরুভাই জীবাত্মানন্দ গিরি।’
দীনেশ লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। আপনি একথা প্রমাণ করতে পারেন?’
‘প্রমাণ অবশ্যই হবে দীনেশবাবু, কোনো চিন্তা করবেন না। এই মুহূর্তে পুলিশ আপনার বাড়ি ঘেরাও করেছে, আর ওয়ারেন্টও এক্ষুনি এসে যাবে। সার্চ করলে ওখানে কী বেরোবে, আপনি জানেন? আপনি যদি ভেবে থাকেন বাঘছাল পাতা পঞ্চমুণ্ডি আসন দেখে পুলিশ আর সেদিকে এগোবে না, তাহলে খুব ভুল করেছেন। ওটাই যাতে আগে দেখা হয়, পুলিশকে সেইরকম নির্দেশ দেওয়া আছে।’
দময়ন্তীর কথা শুনে দীনেশ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। দময়ন্তী বলে চলল, ‘নিত্যগোপালবাবু যে কাজটা আটকানোর চেষ্টা করছিলেন, সেটা দীনেশবাবুর তথাকথিত গুরুভাইটির নির্দেশে। গুরুভাইটি অ্যারেস্টেড হলে সেকথা চেপে রাখবে না, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে আমার বিশ্বাস, দিঘির জঙ্গলে কী লুকোনো আছে, নিত্যগোপাল তা জানেন না। তিনি আদেশ পালন করছেন মাত্র।’
কৃত্তিবাস প্রশ্ন করলেন, ‘কী লুকোনো আছে?’
‘দীনেশবাবুর প্রথমা স্ত্রী মায়ারানির মৃতদেহ। দীনেশবাবু আর তাঁর গুরুভাই— দু-জনে মিলে মায়ারানিকে খুন করে ওখানে ফেলে রেখে আসেন।’
দীনেশবাবু এখন কিন্তু আর লাফালেন না। বসে বসেই কিছু বলবার জন্যে মুখ খুললেন। কিন্তু কৃত্তিবাস বাধা দিলেন। বললেন, ‘এটা একটা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ, দময়ন্তী। প্রমাণ করতে পারবে?’
দময়ন্তী মৃদু হাসল। বলল, ‘আমার কিছুই প্রমাণ করতে হবে না। দীনেশবাবুর গুরুভাই জীবাত্মানন্দ গিরি গ্রেপ্তার হলে নিজেই সব কথা স্বীকার করবে। সে একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামি, দশ বছর আগে জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছিল। সে জানে, সব কথা স্বীকার করলে তবে হয়তো সে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে পারবে। খুনের মামলা তো তামাদি হয় না। আর স্বীকারোক্তি টগরও করবে। যে অপরাধের ভয় দেখিয়ে সে দুশ্চরিত্র লম্পট দীনেশবাবুকে তার মুঠোর মধ্যে পেয়েছিল, সেই অপরাধের ভয়ংকর গুরুত্ব সে বিলক্ষণ জানে। তবে হ্যাঁ, সে যদি স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে চায়, তবে সেটা হবে স্বতন্ত্র কথা।’
‘কে এই জীবাত্মানন্দ গিরি?’
‘গগন মণ্ডল। ডাকাত গগন মণ্ডল। দশ বছর আগে জেল ভেঙে বেরিয়ে তার দলের নতুন সর্দার ছানা বাগদির কাছে তাড়া খেয়ে সে নিমগাছিয়ায় তার মা-র কাছে ফিরে আসে। তার মা তখন দীনেশবাবুর বাড়িতে চাকরি করে। দীনেশবাবুর বাড়িতে তখন অনেক সন্ন্যাসীর আনাগোনা। তাদের মধ্যে তিনি গগনকে আশ্রয় দেন। তবে, একটা শর্ত ছিল। দীনেশের মনে তখন একটি ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছিল। সেই ষড়যন্ত্রে গগনকে সাহায্যও করতে হবে। আর, সেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে, মায়ারানিকে সরানো। গগনের কাছে সেটা সামান্য ব্যাপার। সে সানন্দে সম্মতি দিল এবং আশ্রয় পেল।’
‘মায়ারানির অপরাধ?’
‘মায়ারানির অপরাধ যে সে ছিল একটি অতি সাধারণ গ্রামের মেয়ে। নবকার্তিক মার্কা চেহারার দুশ্চরিত্র দীনেশ তাকে সরিয়ে তার জায়গায় আনতে চাইছিলেন টগরকে। টগরের চেহারায় চটক ছিল, চমক ছিল, তার হাসি শুনলে আজও পুরুষমানুষের বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। টগরও অবশ্যই তার প্রতিবেশী, দীনেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। কাজেই, সন্দেহ নেই যে দীনেশকে ঘন ঘন তার প্রতিবেশিনীর হাসি শুনতে হত। গ্রামের লোকও সেটা লক্ষ করেছিল। কাজেই দুষ্টু লোকেরা যে গুজব ছড়িয়েছিল, সেটা নেহাত ভিত্তিহীন ছিল না। এ ছাড়া, টগরের আরও একটা অ্যাসেট ছিল— তার বাপের সম্পত্তি। সিঙ্গুরের সরকারি অফিসের ক্লার্ক দীনেশ বিশ্বাসের ধর্মকর্ম আর দানধ্যানের পক্ষে সেটাও কম জরুরি ছিল না। অতএব গগন আর দীনেশ মিলে মায়ারানিকে গভীর রাত্রে হয়তো কোনো ধর্মীয় অভিচারের লোভ দেখিয়ে, জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে খুন করে এবং একটি ডোবার মধ্যে মৃতদেহ ফেলে দিয়ে আসে।’
‘ডোবার মধ্যে ফেলে আসে সেটা বুঝছ কী করে?’
‘তা না করে মাটিতে যদি পুঁতে রাখা হত, তাহলে অভিমন্যুর কোদাল কাঁধে ওই জঙ্গলের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো সহ্য করা হত না। আর ডোবা শুকিয়ে সেখানে বাড়ি তৈরি করা হবে জানতে পেরে এই কাজে বাধা দেবার জন্যে এত উঠে-পড়ে লাগাও হত না।’
‘রাজারামের ভাগনে যদি গয়না পেয়ে থাকে, সেটা অভিমন্যু পেল না কেন? সে তো অনেকদিন থেকেই ওখানে ঘুরছে।’
‘ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে সেটা নিমগাছিয়া থেকে বেরিয়ে বড়োরাস্তার সবচেয়ে কাছে। সবচেয়ে সহজে পৌঁছোনো যায়। ও জায়গাটা অভিমন্যুবাবুর হত্যাকাণ্ডের আগেই ঘোরা হয়ে গেছে। কাজেই গয়না ওঁর নজরে পড়েনি।’
‘যে ছেলেগুলো ওখানে কাজ করতে গিয়েছিল, দীনেশ তাদের তাড়াল কী করে?’
‘অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামের গরিব ছেলেকে তার ক্ষুধার অন্নের সামনে থেকে গায়ের জোর না দেখিয়ে তাড়ানোর একমাত্র উপায় ভূতের ভয় দেখানো বা দেবতার অভিশাপের কথা বলা। এটা তথাকথিত জীবাত্মানন্দ গিরি ছাড়া ভালোভাবে আর কে করতে পারে? এবং এই ভয় দেখিয়ে যাদের তাড়ানো যায়নি তাদের প্রাণে মারতে গিয়েছিল ডাকাত গগন মণ্ডল। অশ্লীল গালিগালাজে ভরা ভয় দেখানো চিঠি এ গ্রামে লিখতে পারে ওই ডাকাত গগন মণ্ডলই। তার মালকোচা মারা লাল ধুতি মুখতার লাল হাফপ্যান্ট বলে ভুল করেছিল। আমি ডাকাত দেখেই চিনতে পারি সন্দেহ করে টগর তাকে সরিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে বোধ হয় পারবে না।’
‘তাহলে তো আমাদের ডোবাটায় জাল ফেলার প্রয়োজন।’
‘না, তার আর প্রয়োজন নেই কৃত্তিবাসবাবু। ওই জলার ভেতর থেকে একটি মৃতদেহ আজই পাওয়া গেছে। সেটি যে মায়ারানির সেটা পরীক্ষায় প্রমাণিত হবে।’
হঠাৎ দীনেশ উঠে দাঁড়ালেন। উদ্ভ্রান্তের দৃষ্টি। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘পরীক্ষার আর দরকার নেই। আমি সব স্বীকার করব। এই পাপের ভার আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি সর্বসমক্ষে স্বীকার করছি আমি খুনি। মায়া কোনো দোষ করেনি। আমি তাকে নিজের হাতে…’
বলতে বলতে দীনেশ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
.
সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বসে সমরেশ চা খাচ্ছিল। হঠাৎ উঠে ভেতরে এল। বলল, ‘শুনছ? অভিমন্যুবাবু আসছেন। দেখে মনে হচ্ছে, ভয়ানক উত্তেজিত।’
অভিমন্যু সত্যিই অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলেন। ধপাস করে একটা সোফায় বসে পড়ে বললেন, ‘ইস! কলকাতায় মানুষে থাকে? ঠিকানা খুঁজতে প্রাণান্ত। কই মশাই, আপনার গিন্নিকে ডাকুন। কথা আছে।’
দময়ন্তী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। বলল, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে? আপনারা সবাই ভালো আছেন তো?’
অভিমন্যু হাত নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা সবাই ভালো আছি। কিন্তু, এদিকে কী কাণ্ড ঘটেছে, জানেন?’
‘না তো! কী ঘটেছে?’
‘ওই যে কঙ্কালটা— ওটা মোটেই মায়ারানির নয়। এমনকী এ যুগের কোনো মেয়েরই নয়। ওটা প্রায় দেড় হাজার বছর আগেকার কোনো সুন্দরীর।’
‘বলেন কী?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কার্বন ডেটিং করে তাই বেরিয়েছে বটে। পুলিশের রিপোর্ট আমি দেখে এসেছি। মহা হইচই পড়ে গেছে। কালই কাগজে বেরুবে। মহা মহা পণ্ডিতেরা লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিয়েছেন। এখন আর আমাকে কেউ ঠাট্টা করুক দেখি! কবে থেকে বলে আসছি যে ওখানে একটা অতি প্রাচীন মনুষ্যবসতি ছিল— কেউ পাত্তাই দেয়নি।’
সমরেশ মাথা চুলকে বললে, ‘তা তো হল। আপনার থিয়োরি তো নির্ভুল প্রমাণিত হল। কিন্তু যারা স্বীকারোক্তি করে বসে আছে, তাদের কী হবে?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বললে, ‘কী আর হবে? তাদের স্বীকারোক্তির ওপর তারা যা শাস্তি পায়, তাই পাবে। আর মায়ারানির মৃতদেহ আজ না হয় দু-দিন বাদে বেরুবে।’
অভিমন্যু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কী অদ্ভুত কপাল এই মায়ারানির। এক প্রতিবেশিনী তাকে ঠেলে দিল মৃত্যুর মুখে, অন্য প্রতিবেশিনী হত্যাকারীদের মুখোশ খুলে তার প্রতিশোধ নিল। আশ্চর্য, তাই না?’