রাজপুত ভীষ্ম – কালিদাস রায়
চিতোরের মহারানা লাক্ষসিংহ পাত্রমিত্র লইয়া বসিয়া আছেন-এমন সময় মারবারের রাজা রণমল্লের দূত নারিকেল হাতে উপস্থিত হইল৷ নারকেল আনার অর্থ বিবাহের প্রস্তাব৷
রানা জিজ্ঞাসা করিলেন-‘দূত নারিকেল কার জন্য?’
দূত-‘যুবরাজ চণ্ডের জন্য৷’
রানা-‘বেশ, বেশ! মারবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ, বড়োই আনন্দের কথা৷ দূত, তুমি অপেক্ষা করো৷ যুবরাজ এক্ষুনি আসবে; সে নিজ হাতে নারিকেল গ্রহণ করুক, সেটাই ভালো৷ সে নিতান্ত ছেলেমানুষটি নেই, তার মতামত ছাড়া তো গ্রহণ করা চলে না৷’
রানা বড়ো রসিক লোক ছিলেন৷ তিনি নানা প্রকার রহস্যালাপ করিতে লাগিলেন,-রহস্যচ্ছলে বলিয়া ফেলিলেন, ‘আমারও একদিন ছিল হে-ছিল, যখন আমার জন্যও নারিকেল আসত৷ এখন বুড়ো হয়েছি-দাঁত পড়ে গেছে-নারিকেল আর চিবোতে পারব না বলে কেউ আর নারিকেল পাঠায় না৷’ ঠিক এই সময়ে যুবরাজ চণ্ড সভায় প্রবেশ করিয়া পিতার রহস্যালাপ শুনিলেন৷ রানা বলিলেন, ‘এই যে চণ্ড, মারবারের রাজা নারিকেল পাঠিয়েছেন-গ্রহণ করো৷’
যুবরাজ নিরুত্তর, নারিকেল গ্রহণ করিলেন না৷ রানা ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন- বলিলেন, ‘চণ্ড, তোমার কি মারবারের রাজকন্যাকে বিয়ে করতে আপত্তি আছে? মারবারের সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়া তো গৌরবের কথা, বাবা৷ তা ছাড়া মারবার রাজ্যের অপমান করা তো চলে না৷’
যুবরাজ-‘এ নারিকেল আমি গ্রহণ করতে পারি না, বাবা৷ আপনি একটু আগেই যে কথা বললেন, তাতে আপনার মনে ক্ষণকালের জন্যও একটু ভাবান্তর ঘটেছিল৷ তার ফলেই মারবার-রাজকন্যাকে আর আমার বিয়ে চলে না-ক্ষণকালের জন্যও ওই কন্যা আমার মাতৃস্থানীয়া হয়েছেন৷’
রানা-‘চণ্ড, তুমি অবাক করলে যে! আমি তো এমন কিছুই বলিনি যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে এ বয়সে আমার বিয়ের লোভ আছে৷ তুমি কি একটা রসিকতাও বোঝো না-রসিকতার কথা থেকে কি কোনো কিছু অনুমান করে নিতে হয়? পাগলামি কোরো না-নারিকেল গ্রহণ করো, অন্য আপত্তি কিছু থাকলে বলো৷’
যুবরাজ-‘অন্য আপত্তি আমার কিছুই নেই৷’
রানা-‘তবে সামান্য একটা রসিকতার জন্য তুমি মারবার রাজাকে অপমানিত করবে? এ তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷’
যুবরাজের-‘অপমান কেন করা হবে, বাবা? আপনি এই নারিকেল নিজে গ্রহণ করুন৷’
রানা রাগে অগ্নিশর্মা হইয়া বলিলেন, ‘চণ্ড, এমন অবুঝ হয়ো না৷ আমি এই জীর্ণ বয়সে বিয়ে করব, তুমি ছেলে হয়ে এমন কথা বললে!’
যুবরাজ-‘উপায় কী? আপনার বিয়ের বয়স গিয়েছে একথা আমি মনে করি না৷’
রানা-‘চণ্ড, তুমি জান, রণমল্লের কন্যাদানের কী উদ্দেশ্য? তাঁর উদ্দেশ্য তাঁর দৌহিত্র ভবিষ্যতে মিবারের রানা হয় এবং দু-টি রাজ্য সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের আক্রমণ থেকে চিরদিন আত্মরক্ষা করে৷ তা কী করে সম্ভব হয়?’
যুবরাজ-‘খুব সম্ভব হয়৷ যদি এই রাজকন্যার গর্ভে পুত্রসন্তান হয় তবে সে-ই মিবারের রানা হবে৷ আমি রাজ্যের দাবি করব না৷ একলিঙ্গজির নামে, বাপপারাও-এর নামে, চিতোরের চতুর্ভুজা দেবীর নামে শপথ করছি-আমি তাহলে সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করব, রাজার ভৃত্য হয়ে রাজ্য পালন করব৷’
রানা পুত্রের দৃঢ় সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা লক্ষ করিয়া অবাক হইয়া গেলেন-কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন-‘দূত, নারিকেল আমি নিজেই গ্রহণ করলাম৷ মারবার-রাজকে বোলো তাঁর যদি বুড়ার সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি থাকে, তবে অন্যত্র দিতে পারেন, তাতে আমি অপমান বোধ করব না৷ ব্যাপারটা তো স্বচক্ষেও দেখলে-স্বকর্ণে সব কথা শুনলে-রাজাকে সব কথা বুঝিয়ে বলবে৷ আমি কেবল রাজার সম্মান রক্ষার জন্য নারিকেল গ্রহণ করলাম৷’
দূত মারবারে গিয়া যথাযথ ব্যাপার জানাইল৷ দৌহিত্র মিবারের রানা হইবে, মারবার-রাজ এই লোভ ত্যাগ করিতে পারিলেন না৷ রানা লাক্ষের সঙ্গেই কন্যা যোধার বিবাহ দিতে সম্মত হইলেন৷
শীঘ্রই বিবাহ হইয়া গেল৷ অল্পদিন পরেই যোধার একটি পুত্রও হল৷ পুত্রের নাম মুকুলজি৷ চণ্ড রটাইয়া দিলেন-মুকুলজিই যুবরাজ-ভাবী রানা,-তিনি রাজ্যের সেনাপতি৷ কিছুদিন পরে রানা লাক্ষের মৃত্যু হইল৷ চণ্ড মুকুলজিকে সিংহাসনে বসাইয়া নিজে রাজ্য রক্ষা করিতে লাগিলেন৷ সমস্ত দেশময় ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল-চণ্ড দ্বিতীর ভীষ্ম বলিয়া দেশের সম্মান লাভ করিতে লাগিলেন৷ ইহাতে মহারানি যোধার মনে হিংসার ভাব জাগিয়া উঠিল৷ নানা জনে নানা প্রকারের কুপরামর্শ দিতে লাগিল-যোধার পিতৃকুল হইতেও বিষের বাতাস বহিয়া আসিতে লাগিল৷
যোধা ভাবিলেন-রাজপুত সর্দারগণ ও প্রজাসাধারণ চণ্ডকে দেবতার মতো ভক্তি করে-সমস্ত রাজসম্মান চণ্ডই অধিকার করিয়া লইতেছে৷ প্রজারা নিশ্চয়ই চায় চণ্ড রাজা হউক৷ চণ্ড দেশের লোককে এইভাবে বশীভূত করার জন্য হয়তো চাতুরী-জাল বিস্তার করিতেছে৷ ভিতর ভিতর মুকুলের প্রাণবধের জন্য হয়তো চক্রান্ত চলিতেছে৷ চণ্ড যতদিন রাজ্যে থাকিবে ততদিন মুকুলের জীবন ও সিংহাসন কোনোটাই নিরাপদ নয়৷
নানাপ্রকার সন্দেহে যোধার মন চণ্ডের প্রতি বিষাক্ত হইয়া উঠিল৷-যোধা নানাভাবে চণ্ডের বিরুদ্ধাচরণ করিতে লাগিলেন এবং এমন ভাব দেখাইতে লাগিলেন যেন চণ্ড রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেলে তিনি খুশিই হন৷ চণ্ড বিমাতার মতলব বুঝিতে পারিয়া জনকয়েক বিশ্বাসী অনুচর সঙ্গে লইয়া মান্দুরাজ্যে চলিয়া গেলেন৷ যাইবার সময় যোধাকে বলিয়া গেলেন-
‘মা, আপনি পছন্দ করেন না আমি রাজ্য রক্ষা করি৷ চললাম,-মুকুলের যেন কোনো বিপদ না হয়৷ যদি কোনো বিপদ ঘটে সংবাদ পাঠাবেন, আমি যেমন করে পারি তাকে রক্ষা করব৷’ যোধা কোনো উত্তর দিলেন না৷ স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকরী!
চণ্ডও চলিয়া গেলেন-রণমল্ল পুত্র ও লোকজন লইয়া আসিলেন দৌহিত্রের রাজ্য রক্ষা করিতে৷ মিবার মারবারি লোকে ভরিয়া উঠিল-যোধা নিশ্চিন্ত হইলেন৷
রণমল্লের উদ্দেশ্য নয় রাজ্যরক্ষা-তাঁহার উদ্দেশ্য এই সুযোগে রাজ্যগ্রাস৷ মুকুলকে কোলে করিয়া তিনি নিজেই সিংহাসনে বসিতে লাগিলেন৷ একে একে মিবার রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা মারবারিদের হাতে আসিল৷ এমনকী মুকুলের দাস-দাসীগুলিও মারবার হইতে আমদানি হইল৷
রণমল্লের প্রধান ভয় চণ্ডকে৷ আর-একস্থান হইতেও ভয় ছিল আরও বেশি৷ চণ্ডের ছোটো ভাই রঘুবীর মিবার ত্যাগ করিয়া কৈলবারায় সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করিতেন-তাঁহার অনুগত বাধ্য লোক ছিল অনেক বেশি-মিবারের লোক তাঁহাকে দেবতার মতো মনে করিত৷ তিনি যদি একবার শোনেন-মিবারের রাজকুলের কোনো অমঙ্গল ঘটিতেছে-তাহা হইলে রক্ষা নাই৷ রণমল্ল গুপ্তহন্তার সাহায্যে তাঁহাকে হত্যা করাইলেন৷ এ ঘটনার কথা গোপন থাকিল না-মিবারে যখন এ সংবাদ পৌঁছিল তখন মিবারের লোকের মনে ঘোরতর সন্দেহের উদ্রেক হইল-রানিরও তখন চৈতন্য হইল৷ রানি বুঝিতে পারিলেন মুকুলের জীবন আর নিরাপদ নয়, পিতার উদ্দেশ্য বুঝিতে তাঁহার আর বিলম্ব হইল না৷
তখন রানির মনে পড়িল চণ্ডের কথা, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া রানি চণ্ডের কাছে দূত পাঠাইলেন৷ চণ্ড সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র কতকগুলি লোকজন লইয়া চিতোরের নিকটে পৌঁছিলেন- রানি মুকুলজিকে কয়েকটি বিশ্বস্ত সর্দারের সঙ্গে কৌশলে চিতোরের বাহিরে পাঠাইলেন৷ দুই দল মিলিত হইলে চণ্ড চিতোর আক্রমণ করিলেন৷ মারবারিদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিল, কিন্তু চিতোরের বুকের উপরে মারবারিরা কতক্ষণ যুঝিবে? সহজেই নির্মূল হইয়া গেল৷ যুবরাজ যোধ পলাইল৷ রণমল্লের পলাইবার উপায় ছিল না-রণমল্ল নেশা করিয়া ঘুমে অচেতন ছিলেন৷ একজন মিবারি দাসী পালঙ্কের পায়ার সঙ্গে তাঁহাকে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছিল৷ রণমল্লের গৃহে যখন চণ্ডের লোকজন প্রবেশ করিল-রণমল্ল তখন পালঙ্কসুদ্ধ পিঠের উপরে তুলিয়া ভীষণ যুদ্ধ করিলেন, কিন্তু সত্বর মিবারিদের হাতে প্রাণ হারাইলেন৷
চণ্ড মারবারের রাজধানী অধিকার করিলেন-যোধ পালাইয়া গিয়া নূতন রাজধানী স্থাপন করিলেন-তাহারই নাম যোধপুর৷ মিবারের সঙ্গে মারবারের সন্ধি হইল৷ মুকুলজিকে সিংহাসনে বসাইয়া চণ্ড সমস্ত জীবন ধরিয়া চিতোরের রাজগৌরব রক্ষা করিয়াছিলেন৷