2 of 3

রাজপাট – ৯৪

৯৪ 

শতাব্দীর সন্ধিপথে আজ মানুষের 
আধো-আলো আধো-আশা অপরূপ অধঃপতনের
অন্ধকারে অবহিত অন্তর্যামীদের মতন ভোরের সূর্য;
দূরতর সমুদ্রের হাওয়া এসে ছুঁয়ে কিছু ভালো ব’লে যেতে চায়;
নগরীর বিদগ্ধ লোকেরা কথা ভেবে ব’লে 
প্রেরণা জাগাতে চায়; 
সহজ ত্যাগীরা কাজ করে, 
রক্তে দেশ অন্ধকার হয়ে পড়ে; 
কথা ভাষা স্বপ্ন সাধ সংকল্পের ব্যবহারে 
মানুষেরা মানুষের প্রিয়তর না হয়ে শুধু দূরতর হয়; 

.

এমনই ফাল্গুনরাত্রি এই, বসন্ত এমনই তীব্র, যখন পথে পথে ফাগের বদলে, গুঁড়ো গুঁড়ো আবিরের পরিবর্তে পড়ে আছে তাজা রক্তের রং। সে-রক্তের আঁশটে অসহ গন্ধ তাড়া করে ফিরছে এই নগরবাসীকে। আর সিদ্ধার্থ স্তম্ভিত বসে আছে একা। একা। আজ এ নগরের লোক, ঘুমোবে না। 

ঘরে ফিরে, সিদ্ধার্থ এমনই বসে আছে ঠায় কতক্ষণ, যেন কত কত নম্বর যুগ, জানে না সে।

গত চারমাসে তার আর বিশ্রাম ছিল না। ছিল না নিজের পরিকল্পনার তরে রাখা একটু সময়। নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সে সকলই দিয়েছিল। তার বোধ, বুদ্ধি, শ্রম ও সময়। বিচারও করেনি, যিনি প্রতিনিধি তাদের, তাঁর প্রতি তার হৃদয়ের সমর্থন আছে কি না। সে তো জানতই, দাঁড়াবেন মিহির রক্ষিত। সে সর্বাংশে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এ কী? এ কী! 

পরাজয়ে প্রতিহিংসা হতে পারে এত? এত ক্রোধ, দুরন্ত অপ্রতিরোধ্য? 

অপলক সে চেয়ে থাকে গভীর শূন্যতায়। হে শূন্যতা! সে-ই তাকে দিক কোনও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা! হে শূন্যতা! সে-ই তাকে দিক পথ! 

সে চেয়ে থাকে। এবং, কঠিন কঠিন কঠিনতম সংকল্প নেয়। দলত্যাগ করবে! দলত্যাগ! তার প্রিয়, আকৈশোর জড়িয়ে থাকা দল সে ছেড়ে যাবে। 

এরপর? 

জানে না সে! 

এই দলেই সে শিখেছিল, জনগণই আমাদের শক্তি। সে শিখেছিল। বিশ্বাস করেছিল। এই বিশ্বাস তাকে দেখিয়ে দেবে পথ। এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্যই সে থেকে যাবে নিশ্চিত। মানুষের জন্য এক মানুষ হয়ে থাকা, তার জন্য রাজনীতি কি খুবই প্রয়োজন? 

হায়! সে অসহায় বোধ করে। জীবনের কোনও কিছুই, কোনও দিকই আর রাজনীতি-বহির্গত নয়। গণতান্ত্রিক এ দেশে সকল গণসিদ্ধান্তই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক। এ এক এমন পৃথিবী, যখন সমাজ ও রাজনীতি, কে কার প্রতিবিম্ব আর পৃথক করা যায় না। সমাজ রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং রাজনীতিও, অবশ্যই, সমাজের দ্বারা। এমন কি কোনও কাল ছিল, যখন সমাজ রাজনীতি দ্বারা কোনও ভাবে প্রভাবিত হত না? না। ছিল না। রাজনীতি ও সমাজের সহগমন সম্ভবত, মানুষের সামাজিক সভ্যতার এক আদিতম শর্ত। 

সে কি তবে রাজনীতিকেই ঘৃণা করে বসল? জানে না সে। জানে না। রাজনীতি মানে কী কী হতে পারে? ক্ষমতা দখলে রাখবার কূটকৌশল। জনশাসনের রীতিপদ্ধতি। অথবা রাজনীতি মানে, হতে পারে, মানবকল্যাণ। 

কল্যাণ কে করতে পারে? 

ঈশ্বর। 

যার হাতে অশেষ ক্ষমতা। 

মানুষ ঈশ্বর হতে পারে না? 

সে হাতের আঙুলগুলি পাকে পাকে জড়িয়ে নেয়। দৃঢ়বদ্ধ করে ঠোঁট। ভাবে। মানুষের কাছে দেবত্ব প্রার্থনা করা অন্যায়। তাতে মানবিকতাকে খাটো করা হয়। 

কিন্তু মানুষকে মানুষ হতে হবে না কি? সেইখানে এত বাধা কেন? কেন? 

সে অস্থির হয়ে ওঠে। অশান্ত উন্মত্ত হয়ে ওঠে। সে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে। তার মাথার অসীম শূন্যতায় আঘাত করে কথা। কথার পর কথার পর কথা। আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ। জাগো! জাগো! জাগো! ভোরের সূর্যের মতো জাগো। যোগী ঋষির মতো জাগো। জাগো মহাবল মহাচেতনাধর। 

পাগলেরই মতো সে একবার স্থির হয়। একবার ছটফট করে। তাকে তাড়িত করে! পীড়িত করে! তাকে অসহায় অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দেয়। আবার তাকে প্রাণিত করে বুঝি! তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয়। জাগো! জাগো! আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগোরে সকল দেশ। 

সে উঠে বসে। সিগারেট ধরায়। ঘন ঘন দিতে থাকে টান। এবং পূর্বাপর তার বিস্বাদ লাগে তামাকের প্রিয় স্বাদের মুহূর্ত। সিগারেট সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শুয়ে পড়ে। প্রশ্ন তোলে— তা হলে? 

তা হলে একটাই। 

দল সে ছেড়ে দেবে। 

আরও বেশি ক্লেদাক্ত হওয়ার আগে ছেড়ে যাবে। 

তার নাকে রক্তের গন্ধ এসে লাগে। মস্তিষ্কে ঝিম ধরে যায়। দক্ষিণ পবনের ভাষা দুর্বোধ্য ঠেকে কোষকলাসমূহের নিকট। মৃত্যুর বিষয়ে তার কোনও দুর্বলতা নেই। বহুতর মৃত্যুকে সে দেখেছে। সয়েছে তীক্ষ্ণ বেদনায়। যতেক মৃত্যুর যন্ত্রণা তাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছে বারংবার, তেমন সুলভ নয় সকল জীবনে। তবু মৃত্যুর বিধান সে দেয়। দিয়েছে। কিন্তু এ কী? এ কী! 

আদি থেকে উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল এবার। সি পি আই এম-এর মিহির রক্ষিত, আর এস পি-র নিখিলেশ চৌধুরীর পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের আসাদুর রহমান। দু’জন হিন্দু প্রার্থীর পাশাপাশি একজন মুসলমান প্রার্থী। 

মুর্শিদাবাদ মুসলমান-প্রধান জেলা বলে এমন হওয়ার মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য ছিল না। কোথাও এর বিপরীত চিত্রও দেখা যেতে পারে এমনকী। এর মধ্যে কোথাও কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস চোরাভাবে মুসলমান জনগণের সমর্থন টানার চেষ্টা করছিল। মোল্লাগেড়ের বস্তি বা মসজিদবাড়ি এলাকায় কংগ্রেস প্রচারকরা ঘুরছিল এমন যেন চেনা লোকের ঘরে দু’দণ্ড বসার জন্য যাওয়া। নির্বাচনী প্রচারের মতো উচ্চকিত নয়, যেন-বা কথোপকথনের ঢঙে কুশলের আলাপচারিতায় তারা বোঝাতে চেয়েছিল, একজন মুসলমানই একমাত্র ভাববেন মুসলমানের উন্নয়নের কথা! 

সারা ভারতের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যেরও পরিপ্রেক্ষিতে এই বাচন ছিল অসত্য। অন্যায়। এবং সকল অনৃতভাষণের চেয়ে বৃহৎ অপরাধ, এই প্রচার সম্পূর্ণ সংবিধান-বিরোধী। 

.

বিভেদনীতি দ্বারা কিছু সুবিধা লাভ করার প্রচেষ্টা পৃথিবীতে রয়ে গেছে চিরকাল। ধর্মবোধের শর্তে বিদ্বেষ রোপণ করে দেওয়া, এ-ও নতুন নয়। এ সময় কিছুই করার থাকে না, একমাত্র জনগণের শুভবুদ্ধির ওপর, সুচেতনার ওপর আস্থা তৈরি করা ছাড়া। 

এ জেলা এক চিরবিস্ময়। কারণ নবাবি শাসনের আমলে যেমন হিন্দুদের উচ্চপদাধিকারী হওয়ার কোনও বাধা ছিল না, তেমনি মুর্শিদাবাদকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ব্রিটিশ চক্রান্তও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দু ও মুসলমানের ঐকান্তিক ইচ্ছায়। কোনও বিশেষ ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রধান করতে চেয়েছিল যে স্বার্থপরতা শঠতার শক্তি, শেষ পর্যন্ত শুভবোধের কাছে তা পরাস্ত হয়েছিল। 

উনিশশো সাতচল্লিশ সালের পহেলা জুন বহরমপুরের একটি সভায় মহারাজ শ্রীশচন্দ্র নন্দী একটি ভাষণে বলেছিলেন—বর্তমান তথাকথিত গণতন্ত্রের ভিত্তিই হল সংখ্যা অর্থাৎ জনসংখ্যা। কাজেই কথা উঠেছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়েই জাতীয় বঙ্গের প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের দাবি জানানোর পূর্বে একটি কথা বলতে চাই। শুধু সংখ্যাই কি সব? শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিদ্যা, বুদ্ধি, ঐশ্বর্য, বিত্ত এসব কিছুই নয়? যেখানে সরকারি তহবিলের অধিকাংশই আসে আমাদের ধনভাণ্ডার হতে, যেখানে দেশের শিক্ষামন্দিরের প্রায় প্রত্যেকটি আমাদের অর্থসাহায্যে প্রতিষ্ঠিত, বাংলার সংস্কৃতি এখনও যেখানে আমাদেরই প্রতিভার গৌরবময় দানে প্রধানত পরিপুষ্ট, সেখানে আমাদের এ সকল দানের কি কোনও স্বতন্ত্র মূল্যই নির্দিষ্ট হবে না? সেখানেও কি আমরা শুধুই সংখ্যালঘিষ্ঠতার অপরাধে সর্বপ্রকার অবিচার অত্যাচার মাথা পেতে সহ্য করব? তবুও আজ আমরা কোনও অন্যায় বা অযৌক্তিক দাবি জানাতে চাই না। আমরা শুধু চাই বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগ, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলা এবং উত্তরবঙ্গের মালদহ দিনাজপুরের কতক অঞ্চল নিয়ে জাতীয় বঙ্গের প্রতিষ্ঠা হোক 

সেই সময় এক জটিল পরিস্থিতি ছিল বাংলার রাজনৈতিক জগতে। মুসলিম লিগ ছিল দেশবিভাগের পক্ষে কিন্তু প্রদেশ ভাগের বিপক্ষে। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা ছিল দেশভাগের বিপক্ষে কিন্তু প্রদেশভাগের পক্ষে। কংগ্রেস প্রথমে ছিল দেশবিভাগের বিপক্ষে। কিন্তু পরে মুসলিম লিগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও চাইল দেশবিভাগ হোক। কিন্তু বাংলা ও পঞ্জাবের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাখা হোক। 

এই সময় সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবও উঠেছিল। এই প্রস্তাবের হোতা ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু এবং আবুল হাশিম। পরে কিরণশঙ্কর রায় এবং সুরাবর্দিও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন। আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি ঘোষণা করেছিল বঙ্গভঙ্গ চাই না। সুরাবর্দি সাহেবের বৃহত্তর বঙ্গও চাই না। কারণ তা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান না করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে স্থায়ী করবে। 

এমতাবস্থায় অস্থায়ী বিভাজনে মুর্শিদাবাদকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হল। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা উভয়েই মুর্শিদাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাখার দাবি তুলল। এই যৌথ উদ্যোগের পাশাপাশি যিনি মুর্শিদাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দারুণভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ওয়াসিফ আলি মির্জা। খান বাহাদুর মহব্বত জঙ্গ, আমির-উল-উমরা, রইস-উদ্দৌলা, সুজা-উল-মুলক, নবাব বাহাদুর অব মুর্শিদাবাদ। 

লোকে বলে, মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তিনি সারা রাত্রি ঘুমোননি। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটি নিরন্তর নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন—কে আমার জন্মভূমি, কে আমার দেশ? 

তাঁর হৃদয়ে একই জবাব উঠেছিল—ভারত ভারত, তোমার ভারতবর্ষ। 

.

শেষ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ভারতবর্ষেই ফিরে এসেছিল। সাময়িক তিক্ততা এবং অবিশ্বাসের পর্ব বিস্মৃত হয়ে এ জেলার মানুষ হিন্দু-মুসলমান ধর্ম নির্বিশেষে পাশাপাশি গলাগলি বসবাস করে আসছে। ছোটখাটো কয়েকটি ঘটনা ছাড়া কোনও ব্যাপক হানাহানির ইতিহাস এ জেলায় নেই। এই সৌহার্দ্য এ জেলার সম্পদ। এ জেলার ঐতিহ্য। 

আসাদুর রহমান এই ঐতিহ্য ভাঙতে চেয়েছিলেন। এবং মিহির রক্ষিত চেয়েছিলেন কৌশলের জয়লাভ। চুরির জয়। ছলনার জয় 

কবে থেকে এই কৌশলের সূত্রপাত? কংগ্রেসের আমল থেকেই কি নয়? জোর খাটাবার এ প্রক্রিয়া, গণতন্ত্রের গলা টিপে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পঙ্গু করে দেবার যতেক কারুকর্ম বর্ষ বর্ষ ধরে মানুষ কি শেখেনি কংগ্রেসের কাছেই! 

মিহির রক্ষিত যা করতে চেয়েছিলেন, তা অন্যায় ছিল, কিন্তু নতুন ছিল না। জোচ্চুরির এই সকল পদ্ধতিই আদিম। 

নিজস্ব প্রভাবসম্পন্ন নির্বাচনকেন্দ্রগুলিতে পোষা গুন্ডাদের ছড়িয়ে দেওয়া হবে। নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীগুলি প্রাণসংশয়ে হয়ে থাকবেন নির্বাক। নিশ্চুপ। একই লোক বিভিন্ন নামে বারবার এসে দাঁড়াবে লাইনে। অন্যান্য দলের পোলিং এজেন্টরাও এমনকী প্রশ্ন তুলতে সাহস পাবে না। 

আর তুললেই বা কী! প্রশ্নের সমাধান করার জন্য শুরু হবে তর্ক-বিতর্ক, ততক্ষণ নির্বাচন স্থগিত থাকবে, এদিকে নিশ্চিত ভোটগুলি পড়ে যাবে সকাল-সকাল। সাধারণ ব্যক্তিবর্গ, গৃহবধু বা বয়স্ক মানুষ, যাঁরা নানা কাজ সামলে দেরিতে আসবেন ভোট দিতে, তাঁদের নামে নামে ভোট পড়ে যাবে আগেই কিংবা ভোটার নয় এমন লোক দাঁড় করিয়ে লাইন দীর্ঘ করে, তর্কাতর্কি করে বুথ জ্যাম করে ফেলতে পারলেই অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যায়। কেউ বিরক্ত হয়ে ফিরে যান, কেউ হতাশ হয়ে। 

ইতিমধ্যে, নিজেদের নিশ্চিত ভোটগুলি পড়ে গেছে জানলে কিছু-বা হাতাহাতি গণ্ডগোল ঘটিয়ে দেওয়া যায়। সঙ্গে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বোমা ফাটিয়ে দেওয়া যায় যদি, সঙ্গে সঙ্গে এসে যাবে পুলিশ। বুথ জ্যাম করার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হবে তখন। আর এ তো চিরকালের নিয়ম, পুলিশ শাসকদলের সুবিধার দিকে নজর রাখে আগাগোড়া। 

এই হল নিয়ম। এই হল প্রক্রিয়া। নিজের এলাকায় এই প্রক্রিয়ার নিপুণ পরিকল্পনা করেছিলেন মিহির রক্ষিত। কিন্তু পরমেশ্বর সাধুখাঁ এবার বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। সন্দেহজনক কেন্দ্রগুলিতে তিনি ঘুরতে লাগলেন সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রীদের সঙ্গে করে। টেলিভিশনের ক্যামেরাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে লাগল। 

প্রাথমিক কাজ তিনি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। এলাকার কংগ্রেসি কর্মীরা লাইনে দাঁড়ান বহিরাগত এবং ভুয়ো ভোটারদের চিহ্নিত করে সাংবাদিকদের সামনে প্রশ্ন তুলেছিল। 

গোলমাল উঠল তখন। নিজস্ব ভাবমূর্তির স্বার্থে পুলিশ সচকিত হল। ভোটে প্রক্রিয়া কতখানি অনাবিল, তা প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাজনৈতিক দলগুলি। এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে আর এস পি-র নিখিলেশ চৌধুরী, খুব সামান্য ব্যবধানে হলেও, কংগ্রেসের আসাদুর রহমানকে হারিয়ে জয়লাভ করলেন। পেশিশক্তির বিপুল আয়োজন থাকা সত্ত্বেও, প্রথম স্থান দূরের কথা, দ্বিতীয় স্থানও পেল না সি পি আই এম, এই বহরমপুর কেন্দ্রে। 

একের পর এক কেন্দ্রে হানা দিয়ে, সমস্ত জোচ্চুরি বানচাল করে, জননায়ক হয়ে উঠলেন পরমেশ্বর সাধুখাঁ। 

শ্রদ্ধেয় মানুষ তিনি। প্রবীণ কংগ্রেস কর্মী। সর্বজনমান্য। কিন্তু এই ভূমিকায় কেউ তাঁকে দেখবেন, বহরমপুরের মানুষ তা কল্পনাও করেননি। বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষটি, প্রকৃত গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোট হোক, এমনটাই চেয়েছিলেন। না হলে, তাঁর উদ্যোগ না থাকলে, সুদূর কলকাতা হতে ক্যামেরা আসত না শহর বহরমপুরের বিধানসভা নির্বাচন-কেন্দ্রে। 

কংগ্রেস হেরে যাওয়ায় তাঁর দুঃখ ছিল না। কিন্তু ভোট যথাযথভাবে হতে পেরেছে, এতেই তাঁর সন্তোষ ঘটেছিল। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন—প্রত্যেকটি দলই চাইলে জনহিতকর হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রায় একই হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়ন। কর্মসংস্থান। শিক্ষার অগ্রগমন। স্থানীয় সমস্যাগুলির আশু সমাধান ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিজ্ঞপ্তি যেমনই হোক না কেন, প্রতিশ্রুতি যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনের ভার, এই গণতান্ত্রিক দেশে, স্বচ্ছভাবে জনগণের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। 

দল নির্বিশেষে প্রত্যেকেই তাঁর এই উদ্যোগ এবং বিবৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সবটুকু শেষ হয়ে গেল না। প্রতিহিংসার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল কোথাও। ভোটের সময় পুলিশের অকর্মণ্যতার এবং কংগ্রেসি সন্ত্রাসের জিগির তুলে একটি প্রতিবাদ মিছিল বার করল সি পি আই এম। মিহির রক্ষিত এ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসুদার এতে সমর্থন ছিল না। এবং সিদ্ধার্থ নিজেও রাসুদাকেই অনুসরণ করেছিল। সে বা তৌফিক, কেউ-ই ওই মিছিলে যোগ দেয়নি। রাসুদা, তাঁর স্বভাব এবং কৌশলবিরোধীভাবেও খুব প্রকাশ্য রেখেছিলেন এই অসমর্থন। 

কেন? 

সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে এখন, রাসুদা কি অনুমান করেছিলেন এমন কিছু ঘটতে পারে? যদি অনুমান করেইছিলেন, তা হলে প্রতিরোধ করলেন না কেন? 

সে জবাব পায় না। চেয়ে থাকে শূন্যে, শূন্যেই কেবল। আর ভাবে। ভেবে চলে নিরন্তর। আপামর মুর্শিদাবাদবাসীর মতোই সাধুখাঁ পরিবারের প্রতি তারও আছে গভীর শ্রদ্ধা। 

আজই, আজই সন্ধ্যায়, পুরোভাগে মিহির রক্ষিতকে নিয়ে বেরিয়েছিল সেই মিছিল। সারা শহর ঘুরে মিছিল চলেছিল সাধুখাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে। পরমেশ্বর সাধুখাঁ বাড়িতে ছিলেন তখন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন। আর দুটি ছেলে। ছিলেন দেবেশ্বর সাধুখাঁরও পরিবার এবং সম্ভতিবর্গ। কেবল দেবেশ্বর নিজেই ছিলেন না। 

মিছিল চলেছে সাধুখাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে। চলেছে। স্লোগান দিতে দিতে। স্লোগান দিতে দিতে। মিহির রক্ষিতকে সঙ্গে নিয়ে পেরিয়ে গেল অগ্রভাগ। মধ্যভাগ পেরিয়ে গেল। শেষভাগও পেরিয়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল হঠাৎ। কয়েকজন, হতে পারে দশ, হতে পারে বারো বা পনেরো, দারুণ রোষে, অতর্কিতে ঢুকে পড়ল সাধুখাঁদের বাড়ি। পাঁচজন ঘিরে ধরল পরমেশ্বর সাধুখাঁকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই থেঁতলে দিল মুখ। গলার নলি কেটে দিল ক্ষুর দিয়ে। পেটে বুকে জানুতে দিল কোপের পর কোপ। স্ত্রী ছুটে আসছিলেন। এক হাত দূর থেকে গুলি করল একজন। এবং পালাল। কেউ কিছু বোঝার আগেই। লোক ছুটে আসার আগেই। শহরের রাস্তায় রক্তমাখা পদচ্ছাপ ফেলে ফেলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *