2 of 3

রাজপাট – ৯২

৯২ 

আশ্বিন মাসেত ঢাক-ঢুল 
দুগগা পূজার ঘটা। 
ধানের ক্ষ্যাতে হুলাইয়া পড়ে 
সুনা রোদের ছটা।।
সুনা জামাই আইব ঘরে 
ভাইরে কইছে মায়। 
হলুদ মাখিয়া সুনা বন্ন 
মানিয়া লাইছি গায় ।।
সুনার পিতিমা কইবান সাধু 
রাইতে একলা ঘরে। 
আশায় আশায় চাইয়া থাকি 
দেহ কেমন করে ।।
চাহিয়া চাহিয়া দিন গেল 
রাতি পোহাইল। 
সুনার বন্ন কালা করলাম 
সাধু না আসিল ।।

কলাবিবির বন পেরুতেই তাদের চোখ জুড়িয়ে দিল ভরা ফসলের ক্ষেত। পড়ন্ত বেলার নরম রোদ্দুর বিছিয়ে আছে দিগন্ত জোড়া সবুজ ক্ষেতে। এমন শস্য-শ্যামল গ্রাম দেখে বিশ্বাস করা যাবে না এ হল অনাবৃষ্টির বর্ষ। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে হা-হা করছে নগ্ন ক্ষেত। স্তব্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে গেল তারা। ক্ষুধার্ত ছিল সকলেই, ক্লান্ত ছিল। কিন্তু সেসবের কথা তারা ভুলে গেল মুহূর্তে ওই শ্যামল আঘাতে। এই সুফলা ক্ষেতের জন্য তারা একেবারেই তৈরি ছিল না। আকুল উদাসী অনাবাদি রুক্ষতা দিকে দিকে ছড়িয়ে আছে, এই জানবার পর, কোনও আদিম, বিচ্ছিন্ন, ডাকাতিয়া গ্রামে এই সপ্রাণ শস্যের উদ্ভাস তাদের চমকিত করে দিল। বিস্ময়ে পুলকে তারা আবিষ্ট। বিস্ময় নেই কেবল দুলুক্ষ্যাপার। বৈরাগ্যের স্মিত ললিত নিরাসক্তিই যেন-বা তার চোখে-মুখে! সে তো জানতই, এই বিস্ময় পরতে পরতে উঠে আসবে। ধরা দেবে। 

দুলুক্ষ্যাপা ম্লান হাসল তাদের এমতাবস্থায়। বলল—এ গ্রামে জলের অভাব নেই। নদী দু’পাশে বলে, কালান্তর অঞ্চল বলে, জলস্তর খুবই ওপরে। অগভীর নলকূপেই কাজ চলে ভাল। এই অনাবৃষ্টির বৎসরেও এখানে জলের অভাব হয়নি। নলকূপে সেচন দিয়েছে। 

গ্রামের সীমানায় পৌঁছতেই কয়েকজন ঘিরে ফেলল তাদের। একজন বলল—তা ক্ষ্যাপা, এঁদেরই কথা বলেছিলে? এঁরাই আসবেন? 

—হ্যাঁ বাবা। এঁরাই। 

দুলুক্ষ্যাপা সকলের পরিচয় দেয়। সিদ্ধার্থকে সকলেই দেখে সম্ভ্রমের চোখে এবং অভিবাদন জানায়। দুলুক্ষ্যাপা বলে—কই, মুস্তাকিম শেখকে দেখছি না। 

একজন, জুলমত তার নাম, সে বলে – মুস্তাকিমভাই ঘরে আছে। তার ছ্যামরাডার বড় অসুখ। 

দুলুক্ষ্যাপা আক্ষেপ করে—আ হা হা! কচি ছেলে তার। কী অসুখ? 

—সে ধরা যাচ্ছে না। অসুখের মধ্যে এক আশ্চর্য অসুখ লেগেছে এ গ্রামে। গেল মাস হতে শিশুগুলানকে রোগে ধরছে। আর ফট করতেই মরে যাচ্ছে তারা। 

জাহিরুদ্দিন খাঁ নামে একজন ধমকে উঠল জুনামত মিঞাকে চুপ যা দেখি! বাবুরা এসেছেন শ্রান্ত ক্লান্ত না-খাওয়া। আর তুই যত দুঃসংবাদ দিতে লেগেছিস। সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি? একটু আপ্যায়ন কর। জিরোতে দে। তা না। 

আফাজুদ্দিন মণ্ডল বলে—ঠিক কথা জাহিরভাই। চলেন বাবুরা। আগে বিশ্রাম নেন। 

খাওয়া-দাওয়া সারেন। তারপর কথা হবে। 

সকলে মিলে তাদের মুস্তাকিমের বাড়ির দিকেই নিয়ে যেতে থাকল। তাদের দেখামাত্রই ক্ষেত থেকে, এধার থেকে, ওধার থেকে বেরিয়ে আসছে লোকজন। ইতিমধ্যেই জনা পঁচিশের ভিড় জমেছে। সিদ্ধার্থ একবার জিগ্যেস করল—আমরা কোথায় যাচ্ছি? 

জাহিরুদ্দিন বলল—জি, মুস্তাকিম শেখের বাড়ি। 

সিদ্ধার্থ থমকে দাঁড়াল। বলল—তার তো ছেলের অসুখ। তার বাড়িতে অতিথি হওয়া কি ঠিক হবে? 

জাহিরুদ্দিন ম্লান হাসল। বলল—জি বাবু, এ গ্রামে এমন কোনও বাড়ি আপনি পাবেন না যেখানে অসুখ নাই। এখানকার সব মোকামেই রোগ-বালাই। 

আফাজুদ্দিন বলল—তা ছাড়া মুস্তাকিমভাইয়ের এমনই নির্দেশ আছে। 

সিদ্ধার্থ আর কোনও কথা বলল না। সে বুঝতে পারছে, মুস্তাকিম এ গ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। 

সে দেখছিল, মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এ গ্রাম। তেকোনার মতো পূতিগন্ধময় নয়। সে যত গ্রামে গেছে এ পর্যন্ত, তার অধিকাংশই বড় নোংরা। অপরিচ্ছন্ন। গুয়ে-গোবরে মানুষের অস্বাস্থ্যকর ঘেঁষাঘেঁষি বসবাস। এই গ্রামকে, সেই দিক থেকে, অবশ্যই বলা যাবে এক ব্যতিক্রম। শুধু যা তাকে আশ্চর্য করেছিল, অধিকাংশ মানুষেরই গায়ে-মুখে কালো কালো ছিটে ছিটে দাগ। এটাই কি এ গ্রামের অসুখ? সে বুঝতে পারছিল না। যার গাত্রবর্ণ ঘোর কালো, তারও এমনকী, সেই কালোর ওপর ফুটে উঠেছে দাগগুলি। চিন্তিত হয়ে উঠল সে। এ কীসের প্রকাশ? তার মনে হল, সে যেন জানে, শুনেছিল, কিন্তু মনে পড়ছে না কিছুতেই। বিস্মৃতির অন্ধকার হতে উঠে আসা এক তীক্ষ্ণ কালো কাঁটা বিঁধেই রইল তার চিন্তায়। 

.

এবং মুস্তাকিম এসে দাঁড়াল তার আঙিনায়। অভিবাদন-প্রত্যভিবাদনের পালা শেষ করে সিদ্ধার্থ এবং মুস্তাকিম পরস্পরকে দেখল পূর্ণদৃষ্টিতে। 

সৃষ্টিকর্তা সমগ্র মহাকালের কোনও কোনও মুহূর্ত চিহ্নিত করে রাখেন তাকে ঐতিহাসিক করে তোলার জন্য। হতে পারে, এ তেমনই এক মুহূর্ত যখন সিদ্ধার্থ নামের পূর্ণ ছাব্বিশের হৃদয়বান যুবক পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল ঘোর তিরিশের স্বাস্থ্যবান যুবক মুস্তাকিম শেখের দিকে এবং মুস্তাকিম দ্বারা নিজেও নন্দিত হল। 

মুস্তাকিম মাঝারি উচ্চতার। চওড়া তার কাঁধ। ঘোর কালো গাত্রবর্ণে কোনও বাড়তি ছিট-ছিট নেই। গালের ঘন কালো চাপদাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে কিছু-বা গম্ভীর। কিন্তু সিদ্ধার্থকে দেখে ঝকঝকে দাঁতে সে হাসল যখন, অপরূপ সারল্যে ভরে গেল অস্তিত্ব তার। নীলের ওপর কালো চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবিতে শোভিত তার নির্মেদ শক্তিমান দেহ। তাকে সার্বিক দেখামাত্র সিদ্ধার্থর মনে জন্মাল আস্থা একপ্রকার, প্রীতি একপ্রকার। 

এবং মুস্তাকিম সে, সিদ্ধার্থর ভিতরে পেল আলোর উপস্থিতি। এ আলো সততার, দৃঢ়তার, ভালবাসার। একপ্রকার বিরল আস্থা ও প্রীতি, যা প্রথম দর্শন মাত্রই পুরুষের প্রতি পুরুষের জন্মায় না, কারণ বিশ্বাসযোগ্যতার সকল লক্ষণ তারা পরস্পর যাচাই করে নিতে চায়, হৃদয়ানুভূতি গোপন রাখে এই বোধে যে অনভিব্যক্তই পৌরুষেয়, এতদসত্ত্বেও জন্মাল সিদ্ধার্থর প্রতি মুস্তাকিমেরও হৃদয়ে। 

কী এক প্রেরণায়, যেন কতকালের চেনা পরিজন ফিরেছে ঘরে এমন আবেগে, মুস্তাকিম শেখ আলিঙ্গন করল সিদ্ধার্থর সঙ্গে এবং একে একে অপর ক’জনের সঙ্গেও। 

এবং সিদ্ধার্থ নিজেও, অপূর্ব প্রশান্তিতে ভরে, অনায়াসে তুমি সম্বোধন করল মুস্তাকিমকে। বলল—তোমার ছেলে কেমন আছে মুস্তাকিমভাই? 

মুস্তাকিম হাসল। বলল— খোদাতায়ালার আশীর্বাদে ভাল আছে এইবেলা। ভাত খাবে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল উপস্থিত জনতা। মুস্তাকিম তাদের প্রিয়। তাদের প্রধান। তাদের ভাল-মন্দর নির্ভর। একটিই মাত্র ছেলে তার। বিবাহের অন্তত চার বৎসর পরে তার জন্ম। মুস্তাকিম আদর করে তার নাম রেখেছে জোনাকি। রাত্রির নিকষ আঁধারের ক্ষুদ্র দীপ সে। কিন্তু মুস্তাকিমের জীবনের দীপক। প্রাণের চিরাগ। এই অমূল্য প্রদীপের বয়স মাত্র চার। 

জোনাকিই থাকবে তার নাম? শেষ পর্যন্ত? এ প্রশ্ন করলে মুস্তাকিম হেসে বলে—না। সুন্নৎ করার সময় নাম পালটে দেব। 

—কী নাম রাখবে তখন? 

লোকে জানতে চায়। 

সে বলে—নাম রাখব সিরাজ। সিরাজুদ্দৌলা। শেখ সিরাজুদ্দৌলা। 

গ্রামের লোক লেগে গেল কাজ করতে। এদের কেউ দারুণ সাংঘাতিক ডাকাতের মতো দেখতে নয়। স্বাভাবিক, সাধারণ। তবে কয়েকজন খুঁড়িয়ে হাঁটছে লক্ষ করল সিদ্ধার্থ। স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সারতে বিকেল গড়িয়ে গেল তাদের। আর পেটে দু’টি ডাল-ভাত পড়ামাত্র ক্লান্তির ঘুম নেমে এল শরীর জুড়ে। একখানি ছোট ঘরে পাশাপাশি শুয়ে পড়ল তারা। 

ঘুম যখন ভাঙল, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। আকাশে উঠেছে শুক্লা দ্বাদশীর মস্ত চাঁদ। এখনও সে স্বর্ণময়। জ্যোৎস্নার বিস্তার এখনও সে ফোটায়নি ধরাভাগে। ইতস্তত ছড়ানো ঘরগুলির মধ্যে বিরাজ করছে শান্ত নৈঃশব্দ্য। একপাশে জঙ্গল ও একপাশে নদী থাকায় এই গ্রামকে মনে হয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। 

ধুলামাটি হতে আরও কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে পশ্চিমে গেলে ভাগীরথীর দেখা মেলে। সে-ও নয় দূর এমন কিছু। 

অনাবৃষ্টির কারণে জলঙ্গীরও জল কম। তবু দক্ষিণের বাতাস কিছু জলো স্নিগ্ধতা এনে ছড়িয়ে দিচ্ছিল গায়ে। আকাশে ফুটে উঠেছে কয়েকটি নক্ষত্র। সমস্ত তারাদের দৃশ্যমান হওয়ার মতো ঘোর অন্ধকার নামেনি এখনও। মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভেসে আছে ফুলের সুগন্ধ। মুস্তাকিমের ছোট গৃহের আঙিনায় ফুটেছে লাল, সাদা, হলুদ রঙের অসংখ্য সন্ধ্যামালতী। এই হালকা অন্ধকারেও তাদের রং বুঝি-বা চেনা যায়। গাছে গাছে পাখিদের কথা চলছে এখনও। আজকের মতো শেষ কথা কওয়া। সন্ধ্যা আর একটু গাঢ় হলেই, আঁধারের ডানা বিস্তারিত হওয়া মাত্র আপনার পক্ষ গুটিয়ে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে। 

দুলুক্ষ্যাপা কার কার বাড়ি দেখা করতে গিয়েছে। এর আগে সে একবারই এসেছিল এবং গান শুনিয়ে আপন হয়ে গেছে। বসির খান আর তৌফিককে সঙ্গে করে সিদ্ধার্থ এসেছে ক্ষেতের নিকটে। সে দেখছিল, যেন মাটির তলা থেকে উঠে আসছে চাঁদ। তার মনে হচ্ছিল, উদয়ের সময় চন্দ্রের রূপ এমন যে একটানা তাকিয়ে থাকলে পাগল-পাগল লাগে। আবার চোখ সরাতেও ইচ্ছে করে না। ধীরে ধীরে মধ্যগগনের দিকে যেতে থাকা সোনার থালার মতো চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। 

তৌফিক বলল—এ গ্রামেও কি মেয়েদের বিক্রি করে দেয়, সিধুদা? 

সিদ্ধার্থ ধোঁয়া ছেড়ে বলল—জানি না। কেন? 

—ওরকম কিছু শুনতে হবে ভেবে আতঙ্ক হচ্ছে আমার। 

—আতঙ্কিত হলে চলবে কেন? মেয়ে বিক্রির চেয়েও ভয়ংকর কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

—সহ্য করতে পারছি না সিধুদা। ওঃ! কী অসহ্য! কী ভয়ানক অবস্থা এ জেলার!

— শুধু এ জেলার? অন্য জেলার নয়? পশ্চিমবঙ্গের নয়? গোটা ভারতবর্ষের নয়?

—হয়তো। চোখের সামনে দেখতে পাই না বলে সেগুলো জ্বালা ধরায় না। 

—এটা ভুল ভাবনা তৌফিক। জানবি, কোনও জায়গার কোনও সমস্যাই বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়। বিচ্ছিন্ন সমস্যা বলে কিছু হয় না। একটি গ্রামের সমস্যা যখন তুই দেখছিস তখন সেই গ্রামও একটি একক হিসেবে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করছে। 

—আমরা তো প্রথমে জেলা দিয়েই ভাবব। ভাবব না? 

—না। আমরা সবসময় দেশ দিয়ে ভাবব। কিন্তু আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে যতটুকু কাজ করা সম্ভব, আমরা তা-ই করব। আস্তে আস্তে কাজের পরিধি বাড়াব। দেখ, আমরা আগে পাড়ার টুকিটাকি কাজ করতাম। কবে আমরা বহরমপুর শহরটার কাজও করতে শুরু করে দিলাম। এখন শহর ছেড়ে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আমরা আমাদের জেলার মধ্যে আছি মানেই এই নয় যে আমাদের উদ্দেশ্যও জেলাতেই সীমিত থাকবে। আঞ্চলিকতার ভাবনা খুব খারাপ জিনিস। মনকে সংকীর্ণ করে দেয়। বিচ্ছিন্ন করে দেয় দেশাত্মবোধ থেকে। 

বসির খান বলে—দাদা, একটা কথা বলি? 

—বলো। 

—দেশাত্মবোধ কি একটা সাময়িক আবেগ নয়? 

—সাময়িক বলতে? 

জিগ্যেস করে সিদ্ধার্থ। বসির খানের দিকে তাকায়। সেই সুযোগে চাঁদ তরতর করে আকাশ বেয়ে উঠে পড়ে খানিকটা। এবং নিজের লালচে-সোনালি বরণ ছেড়ে রুপোর পোশাক পরে। হাসি ছলকে পড়ছে দেহ থেকে তার। যৌবনের অশীল চঞ্চলতা ঠিকরে উঠছে। এই মুহূর্তে সিদ্ধার্থ নামের এক মহাতরুণের দৃষ্টি সে আকর্ষণ করতে বুঝি চায়! 

চাঁদের এই উদ্ব্যক্তি দেখে নিয়ে বসির খান বলে- সাময়িক এজন্য যে দেশের কোনও বিপন্নতায় এই বোধ জেগে ওঠে না কি? অন্যসময় তা থাকে না। 

সিদ্ধার্থ জবাব দেয়—সবসময়ই তা থাকে বসিরভাই। কিন্তু আমাদের স্বার্থচিন্তার আড়ালে চাপা পড়ে থাকে। আমার তো মনে হয় মানুষ দেশাত্মবোধ নিয়েই জন্মায়। কোন আদিকাল থেকে, যখন মানুষ কথা শেখেনি ভালমতো, আগুনের ব্যবহার শেখেনি, তখন থেকে তারা দুটি বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করেছিল। এক, গোষ্ঠীবদ্ধতা; দুই, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অধিকারে রাখা নির্দিষ্ট অঞ্চল। কালক্রমে দেশের বোধ, এরই উন্নত প্রকাশ। 

বসির খান বলে—তা হলে মানুষ এমন কাজ করে কেন যাতে নিজের দেশের ক্ষতি হয়?

সিদ্ধার্থ বলে-এ-ও মানুষের চরিত্রের আর একটি প্রকার। মানুষ বড় স্বার্থপর বসিরভাই। এবং জটিল। মানুষের কোনও আচরণকেই সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এবং সব মানুষই একই আচরণ করে না। আমি এটুকু বলতে পারি, দেশাত্মবোধ শুধু বিপন্নতার জন্য অপেক্ষা করে না। এই তোমার কথাই ধরো, এই তুমি পার্টি করো না, সমাজ-উন্নয়নের কোনও সংস্থার সঙ্গে তুমি জড়িত নও, তবু তুমি এত কষ্ট করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? দেশের প্রতি কোথাও একটা ভালবাসা আছে বলেই তো? 

বসির খান মাথা ঝাঁকায়। বলে—না। আপনাকে ভালবাসি বলে আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকি। আপনার কাজে লাগার চেষ্টা করি। 

সিদ্ধার্থ হেসে ফেলে এ উত্তরে। অপূর্ব সারল্য খেলে যায় তার মুখে। তাই দেখে চাঁদ কিছু বাড়তি জ্যোৎস্না ঢেলে দেয় সেখানে। সে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ওঠে যেন। তার আপাতসাধারণ চেহারা কোন মন্ত্রে নয়নলোভন হয়ে ওঠে। সে বলে—সে না হয় হল। কিন্তু ধরো, তুমি তো পর্যটকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও। এবার মনে করো, কোনও বিদেশি তোমার সামনে তোমার দেশ সম্পর্কে ঘৃণা প্রকাশ করল, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল তোমার দেশকে, তোমার রাগ হবে না? অপমান বোধ করবে না তুমি? 

—বলে দেখুক একবার! 

—দেখো, শুনেই উত্তেজিত হয়ে উঠছ তুমি। একেই দেশাত্মবোধ বলে বসিরভাই। 

তার কথা শেষ হতে না হতে নারীকণ্ঠের আর্ত কান্না ছড়িয়ে গেল আকাশে। সচকিত হল তারা। কী হল! কীসের এই কান্না! জুলমত নামে লোকটি বলছিল এ গাঁয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে এক অদ্ভুত রোগে। এ কি তেমনই কিছু? 

মুস্তাকিমের বাড়ির দিকে দ্রুত পা চালাল তারা। তৌফিক বলল—এত সমস্যা মানুষের! মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। 

সিদ্ধার্থ দ্রুত পা চালাতে চালাতে বলল—শক্ত হতে হবে তৌফিক। সহ্য করতে হবে। আমরা দেখতে বেরিয়েছি। কেন বেরিয়েছি? জানতে। আমাদের অবস্থা জানতে। এবং লোককে জানাতে, কী তাদের প্রাপ্য, কী করা উচিত। কিন্তু জানানোর আগে আমাকে জানতে হবে। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের যখন কোনও গভীর সংকটের বিষয়ে জানানো হয়, তাঁরা বলেন, ‘এ কথা জানতাম না। এখন জেনেছি। দেখছি কী করা যায়।’ এই চাতুরি লজ্জাজনক। এই মন্তব্য লজ্জাজনক। রূপকথায় পড়েছি, ঐতিহাসিক কাহিনিতেও পড়েছি, আগেকার রাজারা ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের পরিস্থিতি দেখার জন্য। কারণ রাজ্যের অবস্থা সম্যক জানা না থাকলে শাসন সম্ভব নয়। উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কালে রাজা নেই। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ আছেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। প্রতিনিধিত্ব পাবার জন্য তাঁরা হাত পেতে দাঁড়ান জনতার দরবারে। সেই তাঁরাই, সাধারণের দুর্দশা অবহিত থাকবেন না কেন? 

তার কথাগুলি শোনায় উত্তেজিত। তৌফিক চলতে চলতে তার মুখের দিকে তাকায়। শ্রদ্ধায় ভরে যায় তার হৃদয়। তার রাজনৈতিক জীবনে সিধুদা একমাত্র মানুষ যে কখনও ব্যক্তিগত নিয়ে ভাবিত থাকে না। কিংবা থাকলেও তা প্রকাশ করে না কিছুমাত্র। তার সকল জুড়ে আছে মানুষ জনগণ। রাজনীতি। অথচ, তৌফিক সিদ্ধার্থর সমগ্র জানে। জানে, কী গভীর ব্যথা ছড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থর জীবনময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *