2 of 3

রাজপাট – ৯০

৯০ 

শরতে আইলা না সাধু 
কবে আইবা ঘরে। 
তোমারে না দেখিয়া পরান
হাই-হাকুর করে ।।
কুন দ্যাশে গিয়াছ সাধু 
আমারে ফেলিয়া। 
আডু পানিত বসিয়া আমি 
কান্দি রইয়া রইয়া ।।

.

বৃদ্ধ নিজামত আলি নিজের কুটিরখানি ছেড়ে দিয়েছেন তাদের। একলা মানুষ তিনি, রয়ে যাবেন কারও ঘরে। 

বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট ঘরখানি চারজন শুলে ফুরিয়ে যায়। 

বাঁশগাছ আছে এখানে ছড়ানো ছেটানো। প্রাকৃতিক এই উপাদানটুকু না থাকলে এঁদের ঘর বাঁধতে হত খোলা আকাশতলে। ইস্টিশন বা সড়কের ধারে যেমন, তার থেকে তফাত কিছু থাকত না। জলো জায়গা এই, এখানে মাটির দেওয়াল ঢেঁকে কী প্রকারে? 

তার শুতে ইচ্ছে করছিল না। কুটিরের বাইরে মাটির দাওয়ায় ঠেস দিয়ে সে বসেছিল। সিগারেট টানছিল একমনে। ভাবছিল। নয়াঠাকুমার অশৌচ নিয়ে তেকোনা গ্রাম বুঝি-বা নিশ্চুপ এখন। রাত আর কত হবে। দশটার বেশি নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মানুষের মৃত্যু হলে অশৌচ কীসের? জানে না সে। মৃত্যু কি স্বয়ং অশুচি? তা হলে কি এমনই ভাবা হয়, মৃত্যু অশুচি, অশুদ্ধ। আর জীবন শুচি, শুদ্ধ, পবিত্র। নাকি অশৌচের সঙ্গে একাকার করে দেখা হয় মৃত্যুশোক। ওই অশৌচপালন আসলেই শোকেরই বিবিক্ত রূপ। হায়! সমাজ তা হলে বিধিবদ্ধ করেছে বুঝি শোকের পালন। শোক হওয়া বাধ্যতামূলক তবে! মৃত্যুতে শোকাতুর না হলেও তার পালন আবশ্যিক! 

সকল অশৌচ, সকল শ্রাদ্ধাদি তর্পণ সে করেছে। এসবে কি বিশ্বাস আছে তার? সে জানে না। ভাবেনি কখনও। মার্ক্সীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ সে, লোকান্তর-জন্মান্তর নিয়ে, শুচি-অশুচি নিয়ে ভাবিত হয়নি। বিশ্বাস বড় গভীরের বস্তু। তাকে অর্জন করতে হয়। তেমনই অবিশ্বাসও হালকা বস্তু নয়। অর্জন করতে হয় তাকেও। অবিশ্বাসের চেয়ে বরং বিশ্বাস সহজ। কারণ বিশ্বাস যুক্তির পরোয়া করে না। কিন্তু অবিশ্বাসের জন্য চাই ঘোর যুক্তিবোধ। 

অশৌচ কেন, সে জানে না, কিন্তু অশৌচ পালনকালে সে দেখেছিল সকল ক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে অভীপ্সা এক, অনষ্ট অবিনশ্বর আত্মার মুক্তি হোক, মুক্তি হোক। 

মুক্তি কী, সে জানে না। মুক্তির ধারণা নেই তার। যদি হয় সকল দুঃখ ও ক্লেশ হতে, সকল রিপুভোগের তাড়না ও আকর্ষণ হতে দূরে বহুদূরে, সবকিছুরই ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া, তা হলে সেই কামনার মধ্যে থাকে শ্রদ্ধা। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মধ্যেও থাকে শ্রদ্ধা। থাকে দেহবিযুক্ত আত্মার পুণ্যলাভের জন্য প্রার্থনা। শ্রদ্ধা আর শ্রাদ্ধ, বড় কাছাকাছি, বড় পিঠোপিঠি দু’টি শব্দ। একের মধ্যে অপরের বিন্যাস। 

.

সে পিতৃ-মাতৃশ্রাদ্ধকালে শ্রাদ্ধের তাৎপর্য বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল যখন বোধিসত্ত্বের কাছে, বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন—শ্রাদ্ধ কী জান? শ্রদ্ধা অর্পণ। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা। তুমি কি চাও না মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে? শ্রদ্ধা প্রয়োজনক কর্ম হল শ্রাদ্ধ। সংস্কৃতব্যঞ্জনাঢ্যঞ্চ পয়োদধিঘৃতান্বিতম্। শ্রদ্ধয়া দীয়তে যস্মাৎ শ্রাদ্ধং তেন নিগদ্যতে। 

সে কোনও তর্ক করেনি। করার মানসিকতাও তার ছিল না। এমনকী তখন, অশৌচ পালনকালে, অশৌচ কেন, এ প্রশ্নও তার মনে আসেনি। কী এক ঘোরের মধ্যে সে সকলই মেনেছিল। তাকে বুকে করে, আগলিয়ে, সদম্ভ সটান পর্বতের মতো বোধিসত্ত্ব পুত্রের অন্ত্যেষ্টি করেছিলেন, পুত্রবধূর অন্ত্যেষ্টি করেছিলেন। 

আজ এতকাল পরে সে ভাবছে এমন। নয়াঠাকুমার মৃত্যুতে সকল মৃত্যু বিষয়ে ভাবছে। চাঁদ আজ পাণ্ডুর নয়। বরং প্রোজ্জ্বল। সে জীবনেরই ইঙ্গিত বহে আজ। তবুও ভাবছে সে। আকাশে কত সহস্র তারা। মৃত বা জীবিত। এর মধ্যে তার মা-বাবা কোথায়? নয়াঠাকুমা কোথায়? ময়না বৈষ্ণবী কোথায়? 

সে ভাবছে, শ্রাদ্ধে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় বলেই, ওই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবিতের সঙ্গে মৃতের আত্মার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ রচিত হয় বলেই কি ওই দিন পর্যন্ত চিত্তশুদ্ধির জন্য অশৌচ পালন? 

সংযত আহার, সংযত বিহার, সংযত শয্যা, সংযত বাক—–চিত্তকে, বাহিরের আচরণ দ্বারা, সর্বাংশে বন্ধন দেওয়া বিধেয়। 

তা হলে কি তা-ই প্রতিষ্ঠিত হল না? শোকেরও প্রকাশ হতে হবে আনুষ্ঠানিক। হয়তো বাহিরের এইসব আচরণ দ্বারা, অনুষ্ঠান ইত্যাদির দ্বারা, এই তোমার সঙ্গে আজ ওই আত্মার সকল সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হল, এই ঘোষণার দ্বারা, শোকচাপ কিছু লঘু হয়ে যায়। কারণ জীবন যে, তার ধর্ম শোকের বিরোধী, দুঃখের বিরোধী, সে ধায় আনন্দ ও হর্ষের পথে। সমাজ হয়তো-বা অনুষ্ঠান মাধ্যমে, জীবিতের হাত ধরে নিয়ে আসে শোকের গভীর বেধ হতে জীবনের উদার আনন্দক্ষেত্রে। নইলে, জীবিতও বাঁচে কী প্রকারে? কী প্রকারে? শোকের অধিক দুর্বহ আর কী আছে? 

সে স্থির করে, অশৌচ বিষয়ে সে প্রশ্ন রাখবে বোধিসত্ত্বের কাছে। তার কাছে বোধিসত্ত্ব সর্বজ্ঞ। মহাজ্ঞানী। বিশাল। বিপুল 

সে সিগারেটের শেষটুকু ছুড়ে ফেলে। অলস ছড়িয়ে দেয় পা। কাজের পরিকল্পনাগুলি বিষয়ে সে ভাবতে চায়, তবু সেই ভাবনাগুলি ছুটে ছুটে চলে। জ্যোৎস্নার ভিতর, ওই দারিদ্র্য সত্ত্বেও, সে দেখে এক মায়াবী পৃথিবী। যতসব খানাখন্দ, যতসব নির্লজ্জ বঞ্চনার ওপর জ্যোৎস্না ছড়িয়ে এ পৃথিবী বড় মনোরম। সে জানে, পৃথিবী মনোরম, এই দেশ সুন্দর, এই রাজ্য সুন্দরতর। শুধু একে গড়ে নিতে হবে। সারিয়ে নিতে হবে। শত শত বৎসরের পদাবনত মেরুদণ্ড করে দিতে হবে সোজা। সহজ কর্ম নয়। 

তখন দুলুক্ষ্যাপা এসে বসে তার পাশে। সে জিগ্যেস করে—কী বৈরাগীঠাকুর? ঘুম আসছে না?

—না। 

—কেন? 

—তার কথা মনে আসছে বড় আজ। সে যেন পাশে পাশে আছে আমার। কাছে কাছে আছে। তার পানমশলার গন্ধ লাগছে নাকে। 

দুলুক্ষ্যাপা গাঁজার আয়োজন করে। সিদ্ধার্থ বলে—এ নেশায় সর্বনাশ। 

দুলুক্ষ্যাপা চমকে বলে—কী বললে? 

—এ নেশায় সর্বনাশ। এত টানেন কেন তবে? সেদিন নেশার গানখানা নিজেই তো গাইলেন। 

—সেও বলত এই কথা। বলত, এ নেশায় সর্বনাশ। 

—যত জানছি ওঁকে, আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। 

—হ্যাঁ, সে আশ্চর্য ছিল। হ্যাঁ, বাবা? 

—বলুন। 

—তাকে হত্যা করেছিল যারা তাদের ক্ষমা করেছ তুমি? 

—না। কোনওদিন করব না। 

—তারা কি সংখ্যায় দুই, না দুইয়ের অধিক জানতে ইচ্ছে হয়। 

—দু’জনের দ্বারা তিনি পীড়িত হয়েছিলেন তার প্রমাণ মিলেছিল। হত্যা যে ক’জনই করে থাকুক, আমার চোখে ধর্ষক ও হত্যাকারীর তফাত নেই বৈরাগীঠাকুর! 

—বুক জ্বলে যায় ভাবলে গো! বুক জ্বলে যায়! 

—হ্যাঁ। বুক জ্বলে যায়! আমারও! 

—অন্য নারী দ্বারা তাকে ভোলার চেষ্টা করেছি…সে আমার…সে আমার চরম ভুল…. 

তারা চুপ করে যায়। ময়না বৈষ্ণবীর সান্নিধ্য গাঢ়ভাবে দু’জনকে ঘিরে থাকে। একসময় সিদ্ধার্থ বলে—গাইবেন? 

—শুনবে? তবে গাই। 

—আপনার ইচ্ছা আছে তো? ঠাকুর? জোর করব না। 

—তোমার কাছে আমার অনিচ্ছা কিছু নাই। গোপন কিছু রইবে না। 

—থাক তবে। জোর করছি আমি। 

—হায় গো! তুমি যদি বুঝতে! তুমিই আমার জোর। আর গান তো আমার শ্বসন ক্রিয়া গো। শ্বাস কি চাইলেই বন্ধ করে দেওয়া যায়, নাকি তা কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া করে? শোনো তবে। এ অন্য গান। বাউলের গান। কিন্তু সহজিয়া সাধনের গান নয়। এ গান তোমার জন্য। জীবনসাধনের জন্য। 

জোড় আসন করে বসে দুলুক্ষ্যাপা। হালকা শীতের আয়োজনে শরীরে শিরশিরানি উঠে আসে। রাত্রিজাগা পাখিদের ডাক শোনা যায়। দূরে। কত কত দূরে। জ্যোৎস্নার আলোয় দুলুক্ষ্যাপার রূপ স্বর্গীয় হয়ে ওঠে। তাকে দেখায় কোন যুগান্তরের জ্ঞানী সম্ভ পির বা সন্ন্যাসীর মতো। এ ধরায় যেন-বা রূপ ধরে না তার। ওই বড় বড় চুলে ও দাড়িতে, ওই গৌরবর্ণ উন্নত দেহ ও সটান নাসায়, ওই সৌম্য কাস্তির ‘পরে লেগে থাকা চাঁদের আলোয় তাকে দেখে মনে পড়ে আরও এক অসীম স্রষ্টার কথা। তিনি তাপস ভগীরথ। তিনি স্নেহাতুর আলিবর্দি খাঁ। তিনি রবীন্দ্রনাথ। বাউল তখন, আস্তে, নৈঃশব্দ্যের কাছাকাছি থেকে ধরে সেই গান। সিদ্ধার্থর দেহ কণ্টকিত হয়। কখন, কোন তন্ময়তায়, এ পার্থিব জগৎ হতে অপার্থিবে চলে যায় তারা। টেরও পায় না, এসেছে বসির খান। তৌফিক। টেরও পায় না মধ্যগগন হতে চাঁদ চলেছে পশ্চিমে। শুধু শুনে যায় গান। 

আমার      পথে পথে পাথর ছড়ানো।
তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্না-ঝরানো ।।
আমার বাঁশি তোমার হাতে              ফুটোর পরে ফুটো তাতে— 
তাই শুনি সুর এমন মধুর পরান ভরানো ॥ 
তোমার হাওয়া যখন জাগে          আমার পালে বাধা লাগে— 
এমন করে গায়ে পড়ে সাগর-তরানো। 
ছাড়া পেলে একেবারে           রথ কি তোমার চলতে পারে—
তোমার হাতে আমার ঘোড়া লাগাম পরানো।

গান শেষ হল। তবু যেন ফুরোল না। ফুটোর পরে ফুটো ভরা বাঁশির সুর মধুর হয়ে ছড়িয়ে গেল পথে পথে। সিদ্ধার্থর মনে হল, গোমুণ্ডি গ্রামের সকল যাতনা মুছে দিতে এই সুর আবহমানকাল রয়ে যাবে। 

বহুক্ষণ স্তব্ধতার পর, তৌফিক বলল—সিধুদা। 

—বল। 

—তুমি ঠিক কী করবে বলে ভাবছ? 

—কেন? 

—তুমি কি সত্যি শেষ পর্যন্ত কোনও সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলবে? সে কি সম্ভব?

সিদ্ধার্থ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কথা বলল—অনর্গল বলে গেল ব্যাখ্যার মতো। সে প্রশ্নে আস্থা রাখে। এবং তৌফিকের ভাবনা স্বাভাবিক। তার প্রশ্ন স্বাভাবিক। আজ যা বলেছে সে, তার পরে তার প্রশ্ন স্বাভাবিক। মানুষের নৈমিত্তিক ভাবনার আড়ালে আছে আরও এক ভাবনার স্তর। তা সচেতন স্তরের অজ্ঞাত। অগোচর। কিন্তু সেই স্তর সক্রিয়। মানুষকে ভবিষ্যতের পথে, সকল সিদ্ধান্তের পথে সে-ই ঠেলে দেয়। 

তার আজও আস্থা আছে নিজের দলের প্রতি। সেই আস্থা টলে যায়। ভেঙে পড়তে চায়। শীর্ষ নেতৃত্বে কয়েকটি মুখের দিকে চেয়ে, ফিরে আসে। সে ভবিষ্যৎ জানে না। 

.

কমিউনিস্ট দল কখনও অহিংস ছিল না। তারা চিরকাল সশস্ত্র আন্দোলনের কথা ভেবেছে। এখন সেই অস্ত্র অপব্যবহৃত হয়। নির্বাচনের জয়ে লাগে। জনশাসনের জন্য, সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য কর্মীদের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হয়। সে তার বিরুদ্ধে ভাবে। সাধারণের কল্যাণের জন্য বিপ্লব আর বিপ্লবের জন্যই সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির অস্ত্র হাতে নেওয়া। যদি সেই অস্ত্র বিপরীত ভূমিকা নেয়, যদি তা জনবিরোধী কর্মে লাগে তবে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সে মনে করে। সে চায় কমিউনিস্ট দলগুলির পুরনো রূপ, পুরনো পথ। যখন তারা কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে তুলছিল। যখন সত্যিকার সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল দলের। কী করতে হবে, কী করবে, তা বলে দেবে সময়। সে এই মাত্র জানে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যে-দলই থাকুক না কেন, তাকে নস্যাৎ করে কোনও পরিবর্তনের জন্য হাতিয়ার তোলা বৈপ্লবিকতা। গণতন্ত্র বা রাজতন্ত্র, যার দ্বারাই কেন্দ্রীয় শক্তি পরিচালিত হোক, প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে জেগে ওঠা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে প্রশাসনিক ধ্বজাধারীরা কখনও মেনে নেয় না। আদিতে একে বলা হত রাজদ্রোহিতা। পরবর্তীকালে এল বিপ্লব। এল আন্দোলন। এখন, বৈপ্লবিক শক্তি বা আন্দোলনকারী দল নিজেই যখন ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে বসে তখন কী হয়? তারও মধ্যে থাকে অন্যায়, অযোগ্যতা, মূর্খামি, একদেশদর্শিতা। থাকেই। কারণ দল মানেই একটি সাধারণ আদর্শ ঘিরে একত্রিত কিছু মানুষ, এমন হলেও, সেই সকল মানুষ সমদর্শী, সমান আদর্শ ধারক, সমান যোগ্য হতে পারে না। সে-কারণেই দল যত বড় হয়, তত বড় হয়ে দেখা দেয় তার আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির গুণগত মানকে ধরে রাখার সমস্যা। এবং এ সমস্যা থাকার ফলেই একদা বৈপ্লবিক সেই দলের বিরুদ্ধে জেগে উঠতেই পারে নতুন বিপ্লবী অভ্যুত্থান। অসন্তুষ্ট কোনও নতুন গোষ্ঠী। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা তাকে কী বলবে তখন? কীভাবে দেখবে? এই যুগে এমন পরিস্থিতিতে এসেছে একটি নয়া শব্দ, সন্ত্রাসবাদ। অথবা জঙ্গি আন্দোলন। এই আন্দোলন শুভ কি না, সৎ কি না, সে প্রশ্ন পরে। আসল কথা হল, আদর্শ নির্বিশেষে যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত শক্তি কোনও নতুন শক্তির অভ্যুত্থানকে ভাল চোখে দেখে না। 

.

মশা এসে হুল ফুটিয়ে দেয়। পিঁপড়ে কামড়ে ধরে পায়ে। জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে এবম্বিধ দংশনে পীড়িত হতে থাকে তারা। কারও অভ্যাস নেই এমন জীর্ণ কুটিরে বসবাস। মোল্লাগেড়ের বস্তিতে তৌফিক যে-ঘরে থাকে, সে ঘরেও আছে মশারির ব্যবস্থা। এমনকী হাটে-বাটে ঘুরে বেড়ানো মানুষ দুলুক্ষ্যাপা, সেও অস্থির বোধ করে। কখনও শিউলির গন্ধ লাগে ঘ্রাণে। কখনও কটু মল-মূত্র-পচাকাদার গন্ধ ভেসে আসে। অপাপ জোছনায় লেগে যায় ঝুলকালি। 

এতক্ষণ মশা লাগেনি, পিঁপড়ে লাগেনি, দুর্গন্ধ লাগেনি। কী এক ঘোরের মধ্যে জ্যোৎস্নালোকে মায়াময় পৃথিবীতে রূপে রসে কর্মপ্রেরণায় তারা ডুবে ছিল। এখন এই নিদ্রার সময় উপদ্রব বড় হয়ে আছে। বসির খান বলল তখন—আমি কি একটা কথা বলতে পারি সিধুদা? 

—নিশ্চয়ই। 

—আপনি বললেন, কেন্দ্রীয় শক্তি কোনও নতুন বিপ্লবী অভ্যুত্থানকে ক্ষমা করে না। এখন বিপ্লবী দল মানেই তো কেন্দ্রীয় শক্তির বিরোধী দল। 

—ঠিক।

—বিরুদ্ধতাকে ক্ষমা করতে না পারা তবুও মানা যায়। কিন্তু যখন দলভুক্ত কোনও ব্যক্তি আলাদাভাবে অধিকতর শক্তিমান হয়ে ওঠে, বা কোনও গোষ্ঠী, তাদের মধ্যে আনুগত্যের অভাব না থাকলেও কি তারা অনেক সময় মূলশক্তির দ্বারা বিদ্রোহীদের মতো অবদমিত হয়ে যায় না?

এই প্রশ্ন সিদ্ধার্থকে বিস্মিত করে। যদি তৌফিক এ প্রশ্ন করত তা হলে এমন চমকিত হত না সে। এক মুহূর্তে বসির খান আরও বেশি শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠল তার চোখে। সে বলল—হ্যাঁ। পারে। এরকম দৃষ্টান্ত যে-কোনও দলেই পাওয়া যায়। কারণ দলেরই মধ্যে ব্যক্তি হিসেবে বা গোষ্ঠী হিসেবে অতিরিক্ত শক্তিমান কোনও কিছুকে বিদ্রোহের সম্ভাবনা হিসেবে ধরা হয়। ইংরেজিতে বলা যেতে পারে পোটেনশিয়াল রেভোলিউশনারি বা পোটেনশিয়াল রেবেলিয়ন। এখন দলের অনুগত, কিন্তু পরে না-ও থাকতে পারে। অতএব, এই শক্তিকে দমন কর। কিন্তু এ প্রশ্ন তোমার মনে এল কী করে?। 

বসির খান বলল—আপনার কথা শুনতে শুনতে মনে হল রাজশাহির জমিদার রাজা উদয়নারায়ণ রায়ের কথা। জানেন তো তাঁর কথা? 

সিদ্ধার্থ বলে জানি কিছু কিছু। পদ্মার উভয় পাড়ে রাজশাহি চাকলার তিনি ছিলেন অধীশ্বর। এখনকার মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা ও রাজশাহির অধিবাসীরা তাঁকেই রাজস্ব দিত। অর্থাৎ এলাকা হিসেবে জমিদারি কিছু কম নয়। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি এবং পরাজিত হয়েছিলেন। 

—কেন এই বিদ্রোহ বলুন? প্রথমে মুর্শিদকুলিই তাঁকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে! উদয়নারায়ণের খ্যাতি ও প্রতিপত্তিকে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। 

তৌফিক বলে—বলো বসিরভাই। পুরোটা বলো, শুনি। 

বসির খান বলে—আজ উদয়নারায়ণের গল্প নয়। আর একদিন বলব। এই জোছনারাত্রে যুদ্ধবিগ্রহের গল্প কি আসে? বলো? তার চেয়ে গান হোক। তৌফিক বলছে—ঠাকুর, গান হোক আরও। 

দুলুক্ষ্যাপা বলছে—গান নয়। গল্প হোক। বসির ভাই গল্প বলুক। গল্পে গল্পে সময় কাটে ভাল। 

—কী বসির ভাই? বলবে? 

—বলব। আজ এই জ্যোৎস্নার রাতে আমার মনে পড়ছে বেগমদের কথা। সবচেয়ে দুঃখিনী যে-বেগম, তার কথা। 

—সবচেয়ে দুঃখিনী কে? 

—লুৎফুন্নেসা। সিরাজের বেগম। 

সিদ্ধার্থ বলে—লুৎফুন্নেসা সিরাজের বিয়ে করা বেগম ছিল না তো। 

বসির খান নীরব হাসিতে ভরিয়ে তোলে মুখ। বলে—দাদা, ছিল যে তার প্রমাণ মিলে না। ছিল না যে, তারও প্রমাণ নাই। তবে কী, সুখে-দুঃখে, যুদ্ধে-বিপদে, সম্পদে-আপদে সকলখানেই সঙ্গে থাকার ধর্ম পালন করে যে, সে-ই তো সহধর্মিণী। সেই দিক থেকে লুৎফুন্নেসাই সিরাজের বেগম কি নয়? 

—হ্যাঁ। তা ঠিক। বলো তুমি। 

চাঁদ পশ্চিমে চলে আর বসির খান বলে যায় লুৎফুন্নেসার কথা। লুৎফুন্নেসা। সিরাজের বেগম। লুৎফ মানে প্রিয়ত্ব, প্রেম। নেসা মানে স্ত্রী। লুৎফুন্নেসা অর্থে প্রিয়তমা স্ত্রী। 

.

সিয়র মুতাক্ষরিনে বলে, লুৎফুন্নেসা ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের পরিবারে এক জারিয়া। 

জারিয়াকে সাধারণ অর্থে ক্রীতদাসী বলা হয়। কিন্তু জারিয়ারা হীন ক্রীতদাসী নয়। তাদের মর্যাদা ছিল। যে-সংসারে তারা আসত, সেখানে কেউ চাইলে, কোনও জারিয়াকে ভার্যারূপে গ্রহণ করতে পারত। 

সিরাজের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন ওমদা উন্নেসা। মির্জা ইরাজ খাঁ নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা তিনি। ইনি ছাড়াও সিরাজের ভার্যা ছিলেন আরও। কিন্তু তাঁদের গুরুত্ব কিছু ছিল না। ওমদাৎউন্নেসাও সিরাজের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেননি কখনও। 

আলিবর্দি খাঁয়ের পরিবারে শিশু লুৎফা বড় হতে লাগল। ক্রমশ বিকশিত হল তার অসামান্য রূপ। আলিবর্দির বেগম শরফউন্নিসার মহৎ সান্নিধ্যে থেকে রূপশালিনী লুৎফার মধ্যে গড়ে উঠছিল এক ধর্মপরায়ণ গভীর হৃদয়। শরফউন্নিসারই মতো মহৎ এক প্রাণ। সুকোমল স্বভাব ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বশালিনী। কৈশোরপ্রান্তে পৌঁছেই কখন তাঁর হৃদয়ে সিরাজের প্রতি প্রেম মুকুলিত হয়েছিল, তার খোঁজ কেউ জানে না। যৌবনের উদ্দাম তরঙ্গে ভাসমান সিরাজের ছিল না সে মন, যার দ্বারা সেই মুকুলিত প্রেমের সন্ধান পাওয়া যায়। 

মন না থাক, সিরাজের রূপলোভ ছিল। যৌবনের প্রারম্ভে, অত ঐশ্বর্য, অত প্রশ্রয়ে উন্মাদ সিরাজ মৌমাছির মতোই ওই প্রস্ফুটিত অপূর্ব কুসুমকে দেখেছিলেন লোভাতুর চোখে। তাকে-তাকে ছিলেন তিনি। একদিন এক নিঝুম দুপুরে, প্রাসাদের এক প্রান্তে তিনি পেয়ে গেলেন একাকী লুৎফাকে। কামাতুর হাতে তাঁকে আকর্ষণ করে বসলেন তিনি। ‘না, জাঁহাপনা, না’ বলে আর্ত চিৎকার করে ছিটকে সরে গেলেন লুৎফা। সিরাজ হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর মুখের ওপর, আলিবর্দি খাঁর নয়নের মণি, ভবিষ্যতে তামাম বাংলা মুলুকের নবাব তিনি সিরাজদ্দৌলা, তাঁর মুখের ওপর না বলে দিতে পারে এক সামান্যা নারী কোন স্পর্ধায়! তিনি বিস্মিত হলেন, ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন-এত সাহস তোমার? জানো, নবাবকে বলে তোমার মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি আমি। 

লুৎফা ধীরে ধীরে জানু পেতে বসে পড়লেন মাটিতে। সিরাজের পায়ের কাছে। তাঁর মুখ, শান্ত। সেখানে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। এমন নারী সিরাজ দেখেননি আর। তাঁর জ্ঞানে নারী হবে মধুরা, চাইবে বিলোল বিভঙ্গে! কিংবা ভীতা হতে পারে। ভাবী নবাবের কামুক থাবায় ধরা দেবার ভয়ে কত সুন্দরী নারী ঘরের এ কোণ হতে অন্য কোণে ছুটে বেরিয়েছে। ওই বন্ধ ঘরে ভীতা নারীর ওই ছুট, পাখির মতো অস্থির অসহায় ঝাপটানো ডানা—তিনি সুখে উপভোগ করেছেন। যে-নারী কামিনী হয়ে ধরা দেয়, তার স্বাদ একরকম। যে ভয়ে পালিয়ে যেতে চায় আর বিতংসে ধরা পড়ে বিবর্ণ হয়ে যায়, সিরাজের স্পর্শ পাওয়া মাত্র অর্ধমৃতার মতো এলিয়ে পড়ে, তার স্বাদ আলাদা! সিরাজ এই দ্বিবিধ নারী পুঙ্খানুপুঙ্খ চেনেন। চেনেন দৃষ্টিতে লেগে থাকা মৃত্যুভয়, অসহায়তা! কিন্তু এই নির্ভীক শান্ত প্রতিবাদ, এই সমর্পণ না করার নির্বিরোধ সমর্পণ, তাঁর অচেনা। অজানা। সুলভ্য নারীর এ কোন রূপ? নাকি, ধারণায় ভুল ছিল তাঁর? সকল নারীই সুলভ নয়। সকল নারীই সহজ নয়। কেউ কেউ আছে, বড় দূরের, দুর্লভ, অতল! বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগল তাঁর। জবরদস্তি অধিকার করার জন্য তাঁর হাত উঠল না। তবু জেগে রইল নবাবজাদাসুলভ অহমিকা। লুৎফা বললেন—জাঁহাপনা! আমার প্রাণ তো আপনারই হাতে। মৃত্যুদণ্ড দিলে আমি মাথা পেতে নেব। মৃত্যুকে ভয় পাই না আমি। 

সিরাজ বললেন-মৃত্যুকে ভয় পাও না? তাই নাকি? 

—পাই না জাঁহাপনা। যা অমোঘ তাকে ভয় পাব কেন? কোন এক শবে-বরাতে আর সব মুসলমানের মতোই, আমারও ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। যা লেখা আছে নসিবে, হবে। 

—আমাকে ভয় পাও না তুমি? এই নবাবজাদা সিরাজদ্দৌলাকে ভয় পাও না? 

—জাঁহাপনা, সত্যি বলতে কী, পাই না। 

—পাও না? 

—আপনাকে প্রাণ সমর্পণ করেছি আমি। ভয় পেলে কি তা পারতাম! 

সিরাজ লক্ষ করলেন না, কত বড় কথা, কত সহজে বলে ফেললেন লুৎফা! কামুক দাম্ভিক তিনি, বললেন –জানো, তোমাকে এখন, এই মুহূর্তে লুণ্ঠন করতে পারি আমি! কোনও প্রহরী বাধা দিতে আসুক দেখি। 

লুৎফা বললেন—না। আপনাকে কে বাধা দেবে? কিন্তু লুণ্ঠন করে কী পাবেন আপনি? কিছু হাড়-মাংস ছাড়া কী পাবেন? সে তো শত শত আছে আপনার। হৃদয় পাবেন কি তাতে? জাঁহাপনা! পুরুষের যে হৃদয় প্রয়োজন। নারীর হৃদয়! 

—এসো। ধরা দাও। আমি তোমাকে চাই। 

—জাঁহাপনা! এই শরীর-মন সবই আপনাকে দিয়েছি আমি। চিরদিন আপনারই বাঁদি, আপনারই সেবিকা হয়ে থাকব। একটু ভালবাসা নিয়ে আসুন শুধু। আমি যদি জারিয়া না হতাম, বলতাম বেগমের মর্যাদা দিন। সে অধিকার আমার নেই। সে সবই আপনার ইচ্ছা। আমি শুধু এতটুকু ভালবাসা দেখতে চাই আপনার চোখে। সেইটুকু না পেলে, আমাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করুন আপনি, কেটে টুকরো টুকরো করে দিন, তবু নিজেকে আমি সমর্পণ করব না। 

—হৃদয়? তুমি বলছ পুরুষের হৃদয় প্রয়োজন? যে সকল নারীকে আমি ভোগ করি, তারা সকলেই আমাকে হৃদয় দেয়। 

—আপনি কি নিশ্চিত জাঁহাপনা? 

—নিশ্চয়ই! আরে হৃদয় তো শরীরের মধ্যেই আছে, না কি? শরীর দিচ্ছে মানেই হৃদয় দিচ্ছে। 

—আমার বিশ্বাস আলাদা জাঁহাপনা! আমি মনে করি, ওই একটিমাত্র জিনিস, যা মানুষ শরীরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। ওই অসামান্য বস্তুই শরীরে থাকে, কিন্তু থাকেও না। জাঁহাপনা, ইচ্ছে করলেই আমরা হৃদয় নিয়ে ওই ভাগীরথীর জলে ছুড়ে দিতে পারি। আবার তুলেও আনতে পারি নদীর পাতালস্পর্শী তল থেকে! 

—হাঃ! সামান্য দাসী হলে কী হয়! কথা শিখেছ তুমি খুব! বেগমসাহেবার মতোই কঠিন কঠিন কথা বেশ বলো দেখছি! অবশ্য পোষা তোতা যা শোনে তা-ই শেখে! শোনো, তোমাকে বলে রাখছি, যে-সব নারীকে আমি ভোগ করি, তাদের হৃদয় লুকনোর সাহসও নেই। 

—জানি না। আমি শুধু আমার কথা জানি। আমার হৃদয়ের কথা। আমাকে হৃদয় দিন মহান সিরাজ! 

.

পদতলে বসে আছেন সুন্দরী রমণী। কাতর। কিন্তু নিৰ্ভীক। এই মুহূর্তে জোর করে ভোগ করা যায় তাঁকে। কিন্তু তবু যেন যায় না। কী যেন আছে এঁর মধ্যে! কী যেন! সিরাজের উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এল। তিনি লুৎফাকে পায়ে ঠেলে বেরিয়ে এলেন। কত সুন্দরী নারী তাঁকে ঘিরে আছে। অভিলাষ করলেই পাওয়া যায়। এই নারী, এঁকে ছাড়বেন কি তিনি? না। সিরাজের যাঁকে পছন্দ হয়, তাঁকে তিনি পান। 

ক’দিনেই লুৎফা ফিকে হয়ে এল। কারণ ফৈজির অতুলনীয় সৌন্দর্য-তরঙ্গে সিরাজ নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। রূপে পাগল হয়ে আপনার হৃদয়ে তাকে স্থান দিলেন সিরাজ। 

ফৈজি দিল্লির এক নর্তকী। পুরো নাম ফৈজি ফয়জান। তার আলোকসামান্য রূপের খ্যাতি ছড়িয়েছিল দেশময়। তার তুল্য রূপবতী ভারতবর্ষে আর ছিল না। সে ছিল কৃশাঙ্গী। বাইশ সের মাত্র তার ওজন। বহু লক্ষমুদ্রা ব্যয়ে সিরাজ এই রূপসীরত্নকে নিয়ে এলেন আপন অন্তঃপুরে। তার উন্মাদয়িত্রী রূপসুধা পান করে আপনি উন্মাদ হলেন। শয়নে স্বপনে-জাগরণে কেবল ফৈজি। দেহ তার সংলগ্ন হতে চায়, মন তার সান্নিধ্য চায়। রূপের সুধায় রামধনুর রং- সিরাজের আবেগ, কাম, তৃষ্ণা তীব্রতম হল, উছলে উঠল! 

অনেকে বলেন, ফৈজি ছিলেন মোহনলালের ভগিনী। সিরাজের হাতে সুন্দরী ভগিনীকে 

তুলে দিয়ে সিরাজের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন তিনি। যদিও এই বক্তব্যের বিপক্ষেও বহু মত আছে। রমণীমোহন রূপ সিরাজেরও ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর, ফৈজি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হল না। সিরাজের সঙ্গে ছলা-কলা করে প্রেমের চটুল অভিনয় সে করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার গোপন প্রণয়ী ছিল সিরাজের ভগ্নিপতি সৈয়দ মহম্মদ খাঁ। দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ, সুপুরুষ ছিলেন মহম্মদ খাঁ। সৈয়দ বংশের রূপ তাঁর মধ্যে যথার্থই ফুটেছিল। সিরাজকে লুকিয়ে মহম্মদ খাঁর সঙ্গে গুপ্ত সংসর্গে লিপ্ত হল ফৈজি। একদিন সিরাজ তা জানতে পারলেন। প্রেমিকার এই বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয় ভেঙে গেল তাঁর। দারুণ দুঃখে, নবাবজাদা সিরাজ, ভবিষ্যতের নবাব সিরাজ, উদ্দাম, বেপরোয়া দুর্বিনীত সিরাজ আপন ওষ্ঠ কামড়ে ধরলেন। শয্যায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন তিনি। আঃ আঃ আঃ! এ কী কষ্ট! কী কষ্ট! কী ভয়ংকর জ্বালা সমস্ত মাথায়, বুকে, দেহের সমস্ত তটে। সিরাজের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ হতে লাগল তাঁর। বিশ্বাসঘাতিনী! বিশ্বাসঘাতিনী! বহু অর্থব্যয় করে এই নারীকে নিয়ে এসেছেন তিনি। এ তাঁর ভোগ্যা। তাঁর একার। এর ওপর তাঁর একার অধিকার। এ কেন অপরকে হৃদয় দেবে? কেন? কোন সাহসে? 

.

সহসা কেঁপে উঠলেন তিনি! হৃদয়! হৃদয়! তিনি, বহুরমণীভোগী সিরাজ, তিনি আজ হৃদয়ের কাঙাল! ফৈজি শরীরও দিয়েছে বলে তাঁর ক্রোধ হচ্ছে, কিন্তু তা যেন মূল ক্রোধ নয়। তা হলে কি, তা হলে কি, ঠিকই বলেছিলেন সেই নারী, ঠিকই বলেছিলেন? সিরাজকে হৃদয় দেয়নি কেউ? কেউ না? 

দুঃখের আগুনে, হতাশার অনলে প্রজ্বলিত হল ক্রোধের সধূম অগ্নিশিখা। সকল অগ্নি দ্বারা পরিবৃত সিরাজ কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হলেন ফৈজির কাছে। সিরাজের মূর্তি দেখে ফৈজি বুঝল তার দিন শেষ। আর কিছু করার নেই। সে হিংস্র হয়ে উঠল। সিরাজ বললেন— নির্লজ্জ, বেহায়া নারী! আমি দেখছি, যথার্থই বারাঙ্গনা তুমি। 

ফৈজি তার সকল গরল উগরে বলল—জাঁহাপনা, আমার ব্যবসাই তো তাই। কিন্তু আপনার মায়ের কথা ভেবে দেখেছেন কি? আপনার উচিত প্রথমেই এই তিরস্কার আপনার জননীকে করা। 

ফৈজির কথা শুনে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন সিরাজ। জননীর প্রতি এই কটূক্তি অসহ্য। কিন্তু তা আদপেই মিথ্যে নয়। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেস মহম্মদ, অর্থাৎ ঘসেটি বেগমের স্বামীর কর্মচারী হোসেন কুলি খাঁকে ঘিরে ঘসেটিবেগম ও সিরাজজননী আমিনার যে-নির্লজ্জ প্রণয়, যে-নির্লজ্জ টানাটানি, ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের বীভৎস খেলা, তা যে-কোনও বেশ্যারও আলোচনার বিষয়। 

কিন্তু বারাঙ্গনার মুখে বেগমের সমালোচনা! তা-ও খোদ সিরাজের কাছে! এত স্পর্ধা! ক্রোধে সিরাজের শরীর ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। তিনি বললেন—ফৈজিকে জীবন্ত সমাধি দাও। 

তাঁর আদেশ পালিত হল। ফৈজিকে ঘিরে তুলে দেওয়া হল নিশ্ছিদ্র ইটের প্রাচীর। কোনও মহম্মদ খাঁ তাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিল না। কিন্তু সিরাজের ক্রোধ তাতেও প্রশমিত হল না। মায়ের অপমানের শোধ নিতে তিনি ছুটলেন। প্রকাশ্য রাজপথে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলেন হোসেন কুলি খাঁকে। সেই ক্ষতবিক্ষত দেহ পথে পড়ে রইল। সিরাজ রক্ত মেখে, মৃত্যু মেখে, শ্রান্ত রিক্ত অবসন্ন হয়ে গৃহে ফিরলেন। চিত্ত ভরে গেল হাহাকারে। সারা দেহ-মন একটু স্নেহ পাবার জন্য, একটু প্রেম পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠল। হৃদয়! হৃদয়! হৃদয় চাই তাঁর! কী তৃষ্ণা! হৃদয়ের তরে কী তৃষ্ণা! এ কি শুধু পাবার কাঙ্ক্ষা? না না না! এ যে দেবারও আর্তি! তাঁর ক্লান্ত হৃদয় তিনি তাঁর হাতে আজ তুলে দিতে চান যত্নের আশায়! তিনি কাতর আহ্বান করলেন—লুৎফা! 

লুৎফুন্নেসা এলেন। দু’হাতে জড়িয়ে নিলেন সিরাজকে। মুছে দিলেন সকল ব্যর্থতা। প্রেম না পাবার জ্বালা জুড়িয়ে দিলেন ধীরে ধীরে। সিরাজ বুঝলেন, এই হল ভালবাসা, এই হল প্রণয়। বুঝলেন, এই হল সেই নারী যে পুরুষের চিরকাম্য। যে ভালবাসে। আশ্রয় দেয়। সকল রূপ-গুণের হিসেব মুলতুবি রেখে সে দেয় একটিই বস্তু। তা হল হৃদয়। হৃদয়। 

.

সেই হৃদবন্ধন কখনও শিথিল হয়নি। আমৃত্যু লুৎফুন্নেসা সিরাজকে হৃদয়ডোরে বেঁধে রেখেছিলেন। সুখ-দুঃখের সহচরী তিনি, মহৎহৃদয়া। ধৃত ব্রিটিশ শত্রু ওয়াটসনের মুক্তির জন্য ও তিনি সিরাজের পদপ্রান্তে পড়েছিলেন। এমনকী যুদ্ধযাত্রাকালেও সিরাজের সঙ্গিনী ছিলেন লুৎফা। নারীহৃদয়ের সকল কোমলতম অনুভূতি দ্বারা সিরাজকে ঘিরে ছিলেন তিনি। 

বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে পলাশির রণক্ষেত্রে পরাজিত হলেন সিরাজ। করুণ, ক্লান্ত, একাকী সেই পুরুষ তখন নিঃসহায়। পলাশি থেকে পালিয়ে তিনি এলেন মুর্শিদাবাদে। যাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন, সে-ই বিমুখ। পরাজিত নবাবকে কে আশ্রয় দেবে? সিরাজের চতুর্দিকে শুধু বিষাদ। চতুর্দিকে ইংরেজ সৈন্য ও মিরজাফরের সৈন্যদের বিজয়োল্লাস প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অন্ধকার আশ্রয় করে, বাংলার পরাজিত নবাব সিরাজ, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিশ্বাসঘাতকেরা পরামর্শ দিয়েছে, পলায়ন করো, নইলে তোমার রক্ষা নেই। 

কোথায় পালাবেন? কার কাছে যাবেন? সিরাজের কাছে আর যোগ্যতার কোনও বিচার রইল না। যে তাঁর চরণ স্পর্শ করারও উপযুক্ত ছিল না, তারও কাছে গিয়ে কৃপার ভিখারি হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু কেউ নেই তাঁর জন্য। এমনকী মির্জা ইরাজ খাঁ পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দুর্দান্ত-হৃদয় সিরাজ তখন ভগ্নহৃদয়ে দাঁড়ালেন লুৎফুন্নেসার কাছে। বললেন-লুৎফা, আমাকে যেতে হবে। 

লুৎফা প্রস্তুত। বললেন—চলো। 

সিরাজ বিস্মিত। আপ্লুত। রুদ্ধস্বরে বললেন- তুমি যেতে চাও আমার সঙ্গে? লুৎফার দৃঢ় জবাব— চাই নবাবসাহেব। 

—পথ অনিশ্চিত। শত্রু চারিদিকে। আমার ধন নেই। বল নেই। বন্ধু নেই। 

—এখনই আমি আরও বেশি করে থাকব প্রিয়তম। তোমার সঙ্গে থাকব। বেহেস্ত বলো বেহেস্ত। দোজখ বলো দোজখ— তোমার সঙ্গে আমি সৰ্বত্ৰ যাব! 

সিরাজ লুৎফার হাত ধরলেন শক্ত করে। 

গভীর রাত্রে বাংলা বিহার ওড়িশার অধিপতি এই মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করলেন। সঙ্গে দু’জন দাসী। কন্যা উম্মৎ জহুরা। 

সারারাত পথ চলে তাঁরা পৌঁছলেন ভগবানগোলায়। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে তাঁরা রাজমহল অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রত্যেকের ক্লান্তিজর্জর ধূলিধূসর দেহ। সাধারণ বসন তাঁদের দেখে কেউ নবাব পরিবার বলে চিনতে পারল না। সিরাজের মনে আশা, তিনি আবার সৈন্যসঞ্চয় করবেন। যুদ্ধ করবেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। 

তিনদিন তিনরাত্রি অনাহারে কাটালেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত রাজমহলের কাছে পৌঁছলেন। কিছু না খেলে প্রাণ আর বাঁচে না। এক ফকিরের কুটিরে উপস্থিত হলেন তাঁরা। ইতিহাস জানে, সেই ফকিরের নাম দান শাহ। সিরাজের মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী। তারই তৎপরতায় ধরা পড়েছিলেন সিরাজ এবং মিরনের আদেশে মহম্মদি বেগের তরবারি তাঁর দেহ খণ্ড খণ্ড করেছিল। 

সিরাজের মৃতদেহ খোসবাগে সমাধিস্থ করা হল। কিন্তু খুব সহজে কি এই হত্যা হতে পেরেছিল? না। জাফরাগঞ্জের প্রাসাদের অন্ধকূপে বন্দি সিরাজকে অনেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ সিরাজ বেঁচে থাকলে মিরজাফরকে বশে রাখা যেত। কিন্তু একদল কূটশক্তি সিরাজের মৃত্যুই শ্রেয় বলে মত দিল। কারণ সিরাজের উপস্থিতি মানেই রাজবিপ্লবের সমূহ সম্ভাবনা। অতএব সিরাজের মৃত্যুদণ্ডই নির্ধারিত হয়েছিল। 

কিন্তু যাকেই এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করতে বলা হয়, সে-ই শিউরে ওঠে। সিরাজদ্দৌলার প্রভূত কলঙ্ক ছিল। কিন্তু সে কলঙ্কও প্রধান হয়ে উঠল না। সাধারণ লোকের কাছে সিরাজদ্দৌলা রাজা, ফিরিঙ্গির শত্রু, আলিবর্দির স্নেহের পুতুল, সুকুমারকান্তি যুবা তিনি, অশান্ত, যৌবনোন্মত্ত, প্রতাপান্বিত সুবাদার। তাঁর এই ভাগ্যপরিবর্তনে লোকের হৃদয়ে হাহাকার উঠে এল। কে তাঁকে হত্যা করবে? 

এল। এগিয়ে এল একজন। কারণ জগতের সকল কাজের জন্যই কেউ না কেউ নির্ধারিত থাকে। যে এল, সিরাজের হত্যার পরোয়ানা নিয়ে, তার নাম মহম্মদি বেগ। আবাল্য আলিবর্দি এবং সিরাজের অনুকম্পায় পালিত মহম্মদি বেগ। মিরজাফরের চেয়েও বড় জাফর, অধিকতর ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতক সে। সকল কৃতজ্ঞতা ভুলে উন্মুক্ত খরসান হাতে সে এসে দাঁড়াল সিরাজের কারাকক্ষে। এক মুহূর্তের জন্য আশা হয়েছিল সিরাজের, হয়তো, হয়তো বাঁচিয়ে রাখা হবে তাঁকে। কারারুদ্ধ করা হলেও মেরে ফেলা হবে না। কিন্তু মহম্মদি বেগের চোখ তাঁকে সব বলে দিল। মৃত্যুভয়ে ভীত অসহায় সিরাজ আর্তনাদ করে উঠলেন—কে? মহম্মদি বেগ? তুমি? তুমি! তুমিই কি অবশেষে আমাকে বধ করতে এসেছ? কেন? কেন? কেন? এরা কি আমার জন্য বহুবিস্তৃত জন্মভূমির নিভৃত নিকেতনে যৎসামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারল না? 

পরক্ষণেই তাঁর মধ্যে অহংকার ব্যাপ্ত হল। ছিঃ! তিনি না নবাব! 

মহম্মদি বেগ চিৎকার করেছিল—তোমাকে খণ্ড খণ্ড করে কাটব হে পাপিষ্ঠ সিরাজ। তোমার দেহখণ্ড ছড়িয়ে দেব পথে পথে। 

সিরাজ আপন মনে বললেন – না, না! বাঁচতে পারি না আমি! পারি না! আর কোনও অপরাধে না হোক, হোসেন কুলি, তোমাকে যে হত্যা করেছিলাম, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হোক আজ। 

এবার মহম্মদি বেগের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি বললেন—এসো, জল দাও, জল দাও আমায়। একবার অন্তিম দেবতার কাছে এ জীবনের শেষ কর্তব্য সম্পন্ন করে নিই! 

সিরাজ নমাজ শুরু করলেন। মহম্মদি বেগ আর অপেক্ষা করল না। সিরাজের কাঁধে কোপ দিল। রক্তাক্ত সিরাজ ঘরের কোণে ছিটকে পড়লেন। মহম্মদি বেগ উম্মত্তের মতো কোপাতে লাগল তাঁকে। 

সিরাজ চিৎকার করলেন—আর না, আর না, হোসেনকুলি, তোমার আত্মার শান্তি হোক, শান্তি হোক। 

খোসবাগে সমাধিস্থ হলেন সিরাজ। নবাব আলিবর্দি খাঁয়েরও সমাধি ছিল ওখানেই। মিরন ষড়যন্ত্র করে আমিনা ও ঘসেটি বেগমকে জলে ডুবিয়ে মারলেন। লুৎফুন্নেসা কিছুদিন ঢাকায় বন্দি থেকে অবশেষে মুর্শিদাবাদে এলেন। খোসবাগের সমাধিস্থল তত্ত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত করা হল তাঁকে। এর জন্য তাঁর মাসিক বেতন নির্ধারিত হল তিনশত পাঁচ তঙ্কা। 

একাকিনী, বালিকা কন্যা নিয়ে বসবাস তাঁর। রোজ আসতেন তিনি সমাধিস্থলে। সোনা- রূপাখচিত কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকত সিরাজের সমাধি। লুৎফা ওই সমাধিটি ফুল দিয়ে সাজাতেন। প্রতিদিন জ্বেলে দিতেন দীপ। এইভাবে কেটে গেল সাঁইত্রিশ বৎসর। একদিন, ফুল দিয়ে সমাধি সাজাতে সাজাতেই মৃত্যু হল তাঁর। সিরাজের সমাধির পাশে তাঁর স্থান হল চিরকালের জন্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *