2 of 3

রাজপাট – ৮৪

৮৪ 

আশ্বিনে অম্বিকা পুজা 
ঘটে আলিপন। 
অবশ্য আসিবেন প্রভু 
করিবেন স্থাপন! 
অম্বিকাপূজার দিনে 
সুখী সব নারী। 
কাঁদিয়া গোঙাই আমি 
দিবস শর্বরী ॥ 

সকল হাসি-ঠাট্টা হইচই-এর মধ্যে আপাতত প্রধান ছিল মোহনলালের বিয়ের প্রসঙ্গ। সকলেই আসতে পারবে কিনা বিবাহে, তারই আলোচনা, পরিকল্পনা। হিসেব করলে বাকি মাত্ৰ চার মাস। এরই মধ্যে আরও একবার আসার জন্য কতখানি গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, জানে না কেউ। তবু, এক আসন্ন বিবাহ ঘিরে বহুদিন পর একসঙ্গে হওয়া ভাইবোনগুলি নানা স্বপ্ন বুনে চলেছিল। সেই রঙিন কল্পনার মধ্যে সহসাই এক গভীর, বিষণ্ণ, অনুচ্চারিত প্রসঙ্গের অবতারণা করে বসল নয়াঠাকুমার নাতজামাই শুভ্র। সে বলল— তোমরা সব আধুনিক প্রগতিশীল মানুষ। তোমরা কি জান, এ বাড়িতে প্রতিদিন একজনের ঘোর অবমাননা চলে? 

—কী শুভদা? 

জানতে চায় সকলে। ব্যগ্র ও উৎসুক মুখে। কিছু-বা আশাহতও। এমন আনন্দের প্রসঙ্গে এ কোন হৃদয়বিদারক উক্তি? 

শুভ্র বলে তখন—তোমরা কি জান, তোমাদের ঠাকুমা পুজোর ঘরে ঢোকেন না? শৌভ বলে—জানব না কেন? ছোট থেকে দেখছি। 

—কেন ঢোকেন না, তা জান? 

—হ্যাঁ। জানি। ঠাকুমা কায়স্থকন্যা ছিলেন বলে ওঁর ঢোকা নিষেধ ছিল। 

—তোমাদের কি উচিত নয় এই নিষেধ ভেঙে দেওয়া? তোমাদের সকলের ধমনীতে ওঁরই রক্ত বইছে। অথচ তোমরা এরকম একটা অন্যায়কে মেনে নিচ্ছ? 

—শুভ্রদা, তুমি দেখেছ এ বাড়ির পূজায় মুসলমানেরাও অংশ নেন। বরকত চাচা আবদুস চাচা চিরকাল ঠামাকে, মাকে শাড়ি দিয়ে আসছেন ঈদের সময়। আমাদের বাড়িতে ওসব মানামানি কোনওদিনই নেই। 

কথাগুলো বলেছিল মোহনলাল। দুলু বাউলের সঙ্গে কথা বলে ফিরেছিল সে। সিদ্ধার্থ ফেরার পথে বরকত আলির বাড়ি গিয়েছিল। আপাতত এই মজলিশে সে উপস্থিত ছিল না। থাকলেও, এই পারিবারিক বিষয়ে সে কোনও মন্তব্য নিশ্চয়ই করত না। 

মোহনলালের কথা শুনে শুভ্র বলল—সেই তো বলছি। তোমরা এত উদার, আধুনিক, ঠামা নিজে এত শিক্ষিত এত প্রগতিশীল—তোমাদের বাড়িতে এতদিন ধরে একজনের ওপর অন্যায় হয়ে চলেছে। এটা মানা শক্ত। 

মোহনলাল বলল—প্রথমদিকে নিষেধ ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু পরে সেই নিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল। আমি জানি বাবারা চেষ্টা করেছেন। 

শৌভ বলল—হ্যাঁ। চেষ্টা করেছেন। আমিও জানি। এখন এটা ঠামারই জেদ। তিনি ভেতরে যাবেন না। 

শুভ্র বলে—জেদ নয়। অভিমান। কেউ তো জোর করেনি তাঁকে। হয়তো শুধু বলেছিল। 

—ঠামা কারও জোর শোনার মানুষ? ওঁকে কে জোর করবে? 

—এই তো তোমাদের ভুল ভাই। নারীচরিত্র দেবতাও জানেন না, তো মানুষ। উনি হয়তো ওই জোরের অপেক্ষাতেই আছেন। উনি হয়তো ভাবছেন, কেউ জোর করল না মানে কেউ-ই হয়তো মনে মনে চায় না উনি ঠাকুরঘরে যান। আমাদের উচিত ওঁকে জোর করা। 

মোহনলাল বলল—আমার তা মনে হয় না শুভ্রদা। ঠামাকে আমি জন্ম থেকে দেখছি তো! ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় ওঁর স্বভাবে নেই। তা ছাড়া নিজের সন্তানদের সম্পর্কে ওঁর কোনও ধোঁয়া-ধোঁয়া মনোভাবও নেই। ঠামা তাঁর অভিমান নিয়ে আছেন তো ঠিকই। কিন্তু তার দায় উনি ওঁর সন্তান-সন্ততির ওপর চাপান বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া, ঠামা কেন ঠাকুরঘরে যান না সে কারণ তুচ্ছ হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয় এখন। সে অনেক আগের ব্যাপার। আমাদের কাছে ঠামা ঠামাই। ঠাকুর ছোঁয়া না-ছোঁয়ায় কী যায় আসে! 

শুভ্র বলে—তাঁর যত অভিমানের দায় তাঁরই ওপর চাপিয়ে দিয়েও কিন্তু আমরা অন্যায় করছি। অসম্মান করছি ওঁকে। ছোঁয়া না-ছোঁয়ায় নিশ্চয়ই যায় আসে। তুমি কমিউনিস্ট। তুমি বুঝবে না। 

মধুঋতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এবার বলল— হ্যাঁ। আমি শুভ্রদার সঙ্গে একমত। আমাদের জোর করাই উচিত। যে অন্যায় ঠাম্মার সঙ্গে হয়ে আসছে তা বন্ধ হওয়া উচিত। 

সকলেই স্বীকার করে এমন। একমত হয়। মোহনলালের সামান্য দ্বিধা বা অন্যমত সকলের উদ্ভাসিত আবেগ ও উদ্যমের কাছে হার মানে। সে অধিক সময় নয়াঠাকুমার কাছে থাকে বলেই ঠাকুমার প্রতি অন্যদের অধিকার কিছু কম হয় না, এমন মনোভাবের উপলব্ধিও তাকে সহমত হতে বাধ্য করে। এবং সকলে মিলে পরিকল্পনা রচনা করে। বিসর্জনের পর ঠাকুমাকে প্রণাম করতে এসে নাতিরা তাঁকে কোলে তুলে নেবে। এ বাড়ির শরীরের গড়ন লম্বা, সুগঠিত। তার ওপর শৌভ নিয়মিত চর্চা করে অধিক বলশালী। কোলে তুলে নেবার দায়িত্ব সে-ই নেয়। এবং কথা হয়ে থাকে, সকলে মিলে নয়াঠাকুমাকে বসিয়ে দেবে সিংহাসনের কাছে। স্পর্শ করিয়ে দেবে নিত্যপূজার ঘট। 

এক উত্তেজনা তাদের হৃদয়ে ছড়িয়ে যায়। কোনও এক মহান লক্ষ্যের ঔদার্য উপভোগ করতে করতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায় তারা। মধুঋতা আবদার করে-মোহনদা, নৌকা চড়ব। নৌকা চড়াও আমাদের মোহনদা। 

মোহনলাল বলে—নৌকা কী করে চড়বি! জল নেই নদীতে! 

—ওই তো জল! ওই তো! ওতে নৌকা চলবে না? 

—ধুর! ওতে নৌকা ভাসে নাকি? আটকে যাবে যে কাদায়। 

মোহনলাল বেরিয়েছে। অতএব তাকে অনুসরণ করে কিছু-বা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে সমিরুদ্দিনের দল। পুজোর ক’দিন তাদের সীমান্ত ব্যবসা নেই। কারণ এইসময় পুলিশ বড় তৎপর থাকে। মালসমেত ধরে ফেলে, উপরি রোজগারের উপরেও কিছু বাড়তি উপার্জন করতে ইচ্ছুক থাকে তারা। অতএব এই সময় কিছুদিন, দীপাবলী পর্যন্ত, তাদের কাজের মন্দা। ইদানীং যদিও কিছু অস্ত্র-শস্ত্রের দায়িত্ব পাচ্ছিল তারা, কিছু মাদকের ব্যাগও বইছিল, অতএব মালের গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের উপার্জনও হয়েছে ভাল রকমের। একান্তে টাকাকাড়ি গুনে দেখেছে মাতিন শেখ। পনেরো হাজার টাকা জমে গেছে তার। সে এখন ফিকির খুঁজছে। এইবার ঝপ করে একদিন মোহনলালের কাছ হতে বাইক ক্রয় করার প্রস্তাব সে করে বসবে। মোহনলালের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে আশা রাখছে, বিবাহে মোহনলাল পেয়ে যেতে পারে একখানি ঝকঝকে নতুন বাইক। কিংবা নিজেও সে কিনে নিতে পারে নতুন একখানা। তখন পুরনো বাইকের আর দরকার হবে না কোনও। এই ফাঁকে, মাতিন শেখ সে, কিনে নেবে বাইক। ভাবলেই, আবেগে বুক দুরু দুরু করে তার। কিছু-বা ভয়েও করে। একথা ঠিক, সে বাবা-মায়ের মতামত পরোয়া করে না। তবু, তার আব্বাজানের ক্রুদ্ধ চাহনি, মায়ের বিস্ময়াহত দৃষ্টি, আর সেই দৃষ্টির ভাষা এমন—’ঘরে কত অভাব, আর এত টাকা দিয়ে তুই ওই বস্তুটি কিনলি বাপ! এমনই সব ভাষা, এমনই সব ক্রোধ, অনুযোগের কল্পনা তাকে স্তিমিত করে দেয়। অথবা হতে পারে এমন, মাতিন শেখ সে, বাইক কেনার স্বপ্নকে হুবহু বাস্তব করে তোলার সঙ্গতি লাভ করেও, প্রকৃতই সাহস অর্জন করতে পারছে না। নিজেরই দ্বিধা ও ভীরুতাকে সে মা ও বাবার আপত্তিরূপে দেখছে। তবে একথা ঠিক, এই ভীরুতাকে জয় করবেই সে। বলে ফেলবেই একদিন। কী বলবে? কী? মোহনদা আপনি কি বাইকটা বেচবেন? না। এরকম নয়। বলবে সে, মোহনদা আপনি বলেছিলেন, পনেরো হাজারে দিয়ে দেবেন বাইকটা! না। ঠিক হল না এটাও তা হলে কী বলা যায়? 

মাতিন শেখ ভাবতে ভাবতে তার কাটা হাতখানি দোলায়। তার চোখে পড়ে মধুঋতা। সে মধুঋতার আবদার শুনতে শুনতে তার রং দেখে, দেহের গড়ন দেখে, নিপুণ করে কাটা চুল দেখে, ঠোঁটের টকটকে রঙে আঙুল বোলায় মনে মনে। আর কল্পনা করে, বাইক চালাচ্ছে সে, পেছনে বসে আছে ওই মেয়ে। ওই সেই স্বপ্নের মেয়ে। স্বপ্নের মেয়েরা যে এরকমই হয়। হুবহু এইরকম। সে নিরুচ্চারে বলে—সুন্দরী! নৌকায় নয়! আমি আমার বাইকের পিছনে তোমায় বসিয়ে সারা দুনিয়া ঘুরব। 

সমিরুদ্দিন এসে মোহনলালের কাছে দাঁড়াল তখন। বলল—মোহনদা, উনি নৌকা চাপতে চাইছেন, চাপিয়ে দিন না। 

মোহনলাল বলে—আরে, তুই-ও অবুঝ হয়ে গেলি নাকি সমির? এই জলে নৌকা চলবে?

—লিয়াকত মাঝি আর তার ছেলেকে ডেকে নিয়ে আসব আমরা। 

—তারা এসে কী করবে? 

—ওঁরা নৌকায় বসবেন। লিয়াকত মাঝি আর তার ছেলে আবদুল, গায়ে খুব জোর, কাছি ধরে টেনে নিয়ে যাবে নৌকা। 

—পারবে? 

—পারবে না কেন? অনেকদূর যেতে না পারলেও ওই ধরেন এই গ্রামের সীমানা পর্যন্ত পারবে। দিদিদের কিছু তো নৌকা চড়া হবে। 

—যা ডেকে আন তা হলে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই লিয়াকত মাঝি ও আবদুলকে ধরে নিয়ে এল সমিরুদ্দিনের দল। নৌকা বাঁধা ছিল বাঁশের সাঁকোয়। কোনও কথা না বলে বাপ-ছেলে নেমে গেল হাঁটু-ডোবা কাদা পেরিয়ে পায়ের পাতা-ডোবা জলে। নৌকা টেনে সাঁকো বরাবর করে বলল—ওঠেন। 

গোটা দল চেপে বসল নৌকায়। লিয়াকত মাঝি একলাফে গিয়ে বসল নৌকার গলুইয়ে। হাতে নিল লম্বা বাঁশের লগা। নৌকা এধার-ওধার হয়ে গেলে ঠেকাবে। তার কাঁচাপাকা চুল আর কাঁচাপাকা দাড়ি। সারা দেহে জট পাকিয়ে আছে শিরা-উপশিরা। তাদের ঘরের বাঁশের বেড়া ঝুরো ঝুরো হয়ে গেছে। খড়ো চালে অসংখ্য খোঁদল। ঘর না ছাইলেই নয়। শিকনি ঝরানো একপাল ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়ে তারা দিনে একবার মাত্র আহার করতে পারে নুন-ভাত। কোনও দিন শিশুদের সংগ্রহ করে আনা গেঁড়ি-গুগলি সঙ্গে থাকে অতি উপাদেয় পদ। এক থালা ভাত, এ খরায়, উপার্জন দুঃসাধ্য প্রায়! ওই ডিঙিনৌকা একখানি, সে তাদের প্রাণ! তাদের সর্বস্ব! এ নৌকায় গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবারের উত্তরাধিকারীদের নিয়ে কাদা ঠেলে যাবার প্রাক্ লগ্নে তাদের হৃদয়ে সম্মতি আছে কিনা, আনন্দ আছে কিনা, বোঝার উপায় নেই, কেন না তাদের মুখ, নীরব মুখ, এক প্রকার নির্বিকার ভাব ধরে রাখতে সক্ষম! কেন না সম্মতি-অসম্মতি, আনন্দ-নিরানন্দের ভাব প্রকাশ করার জন্যও মানুষের লাগে কিছু স্বাধীনতা! সেই স্বাধীনতার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার যোগ নেই। বিবিধ বৈষম্যে সেই স্বাধীনতার বুকে বাঁশ চেপে দাঁড়িয়ে থাকে উদ্ধত দুর্বিনীত সফল সমাজ! পীড়নে পীড়নে হৃদপিণ্ড ফাটিয়ে টেনে আনে রক্তজল। তাই নিয়ে তৈরি হয় লিয়াকত মাঝি। সে তৈরি হওয়ার পর আবদুল কাছিতে দিল টান। তার হাত ও পিঠের পেশি ফুলে উঠল। নরম কাদার ওপর দিয়ে, জলের পিচ্ছিলতা কাটিয়ে সরসর করে এগিয়ে চলল নৌকা। অপূর্ব দক্ষতায় লিয়াকত মাঝি লগা নিয়ন্ত্রণ করে নৌকাকে দিকভ্রষ্ট হতে দিচ্ছিল না। 

সকলে হইহই করে উঠছিল। যেন এক মজার খেলায় মেতেছে সবাই। জলবিহীন নদীতে নৌকা চেপে এক জাদুর সৃষ্টি করেছে। এমন জাদুর জাদুকর মোহনলাল। সে নায়ক। সে নেতা এই ব্যবস্থাপনায় সকলে তাকেই দিচ্ছে ধন্য রব। তার মুখে জয়ের হাসি। লোককে দিয়ে যা-খুশি করিয়ে নেবার গৌরবে, প্রভুত্বের অহমিকায় সে টান-টান। তার চোখে পড়ল না, আবদুলের সারা শরীরে স্বেদস্রোত। তার ফুলে ফুলে ওঠা পেশিগুলিতে জন্মাচ্ছে আক্ষেপ। আর শুধু পেশিমাত্র নয়, ফুলে ফুলে উঠেছে তার শিরা-ধমনী। বেশ কিছুটা টেনে চলার পর সে দাঁড়িয়ে পড়ছে। হাঁপাচ্ছে। শ্বাস নিচ্ছে লম্বা করে। মধুঋতা হাততালি দিচ্ছে—কী মজা! ওঃ কী মজা! আরও চল! আরও! 

শৌভ ধমক দিচ্ছে মধুঋতাকে—এই থাম। এবার ফিরতে হবে। ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে না!

মোহনলাল, নিজের ক্ষমতা কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে বলছে—ওতে কিছু হবে না। যাক আরেকটু। আরেকটু চল আবদুল! 

আবদুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—ওদিকে আর যাওয়া যাবে না। কাদা শক্ত হয়ে উঠেছে।

শৌভ বলল—না না! ঘুরিয়ে নাও। অনেক হয়েছে। 

লিয়াকত মাঝি আবার নামল এক লাফে। এই কাদায় নৌকা ঘোরানো সহজ নয়। দু’জনে মিলে কাছি ধরে নৌকা টেনে নিয়ে গেল কর্দমাক্ত কিনারে। এ ধারে, এই পশ্চিমভাগে উঁচু প্রাচীরের মতো পাড়। পূর্বভাগে নদীবক্ষ হতে পাড়ের উচ্চতা বেশি নয়। মাটি ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ পশ্চিমদিকে সরে যাচ্ছে ভৈরব। উঁচু পাড় ভেঙে ভেঙে গ্রামকে টেনে আনছে নীচের স্তরে। মাটির ক্ষয়চিহ্ন লেগে আছে পাড়ের গায়ে। স্তরে স্তরে সাজানো মৃত্তিকার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে পাড়-ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছগুলির শিকড়। মূল। শাখামূল। মাটি আঁকড়ে ধরেছিল তারা কবে, নিরাপদ জীবনের জন্য; হায়, এখন মৃত্তিকা স্বয়ং ঝরে পড়েছে নিরাপত্তাহীনতায়। শিকড় মূল সমস্তই শূন্যতায় হাতড়ে মরছে অবলম্বন। আর সেই মৃত্যুর প্রহর গোনা নিরালম্ব শিকড় দেখে পুলকে বিস্ময়ে শব্দ করে উঠছে শহরের মানুষগুলি। তারা জানে না, উপলব্ধি ও করে না, ভাঙা-পাড়ের ভয়াবহতা। আগামী কোনও বিপর্যয়ের সংকেত এইসব, তারা ধারণা করতেও পারে না। তাদেরও শিকড় যে হয়ে আছে এমনই নিরালম্ব, ভাবে না তা। যদি তারা সকলেই থেকে যেত এই গ্রামে, যদি সকল সম্ভাবিত খরা-বন্যা, ভাঙা-গড়া দৈনন্দিন জীবন হত তাদের, তা হলে ভাঙা পাড়ের বেদনাবিধুরতা তারা উপলব্ধি করতে পারত। অসহায় নদী, ক্ষয় না করে উপায় নেই তার। অসহায় মাটি, ভেঙে পড়ে নির্জীব, অনন্যোপায়। তথাপি, এই জল, এই মাটি—নদী ও ভূস্তরের যতেক কণা, শিলাচূর্ণ, ধাতুপিণ্ড, অধাতু মৌল ও যৌগিক বস্তু যত, এমনকী ধাতুকল্পগুলি, তারা ভালবাসে জীব। ভালবাসে প্রাণ। তারা জীবনের অনন্য সুহৃদ। কিন্তু হায়! এক হাতে সৃষ্টি, অন্য হাতে বিনাশের উপকরণ সমেত প্রকৃতিকে মান্য করা ছাড়া মানুষের উপায় নেই। মাতৃ-দ্বারা প্রহৃত সন্তান ব্যথায় কাঁদে, কিন্তু মায়ের স্নেহের কাছে তার সদা সমর্পণ! 

ভাঙনের এই করুণ মূর্তি এ গ্রামের মানুষের মনে প্রকৃতির বিনাশী রূপের কথা সদা জাগরূক রাখে! এই নাগরিক প্রাণীগুলি তা বোঝে না। তারা চিৎকার করে-দেখ দেখ, কেমন শিকড় বেরিয়েছে! 

—মাটির এমন তলা থেকে শিকড় বেরুতে তুই দেখেছিস দিদি? 

—নারে। দেখিনি। 

—অ্যাই! দেখিসনি কী! এর আগে এখানে এসে নৌকো চড়েছিস, তখন দেখিসনি?

—কী জানি! মনে নেই! 

—কী দারুণ না! ইস ক্যামেরাটা রেখে এলাম। এগুলো যেন ন্যাচারাল আর্ট। 

—এখানে ইংরিজি বলিস না। লোকে গালাগালি ভাববে। 

—হা হা হা! 

—হি হি হি! 

—ইংরিজি শুনে গাছও ভেঙে পড়তে পারে। 

—নৌকাও ডুবে যেতে পারে। 

—এই কাদায় নৌকা ডুববে! হি হি হি! এ তো এক মগ জলে সলিল সমাধির মতো!

লিয়াকত মাঝি আর আবদুল সারা গায়ে কাদা মেখে, ঘাম মেখে, নৌকা একটু এগিয়ে নিচ্ছে, আবার পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যেক এগনো-পেছনোর সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে অল্প অল্প করে।

নৌকায় দোলা লাগছে এমন, যেন নাগরদোলায় চড়ার মজা। আরোহীরা উল্লাসে আতঙ্ক মিশিয়ে চিৎকার করছে। এ ওকে জড়িয়ে ছদ্ম-বিপদের ছদ্ম-ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে বাতাসে। তাদের গায়ের ওপর এসে পড়েছে শারদীয় বৈকালের গাঢ় লাল রোদ। সমিরুদ্দিনের দল নৌকার সমান্তরালে চলেছিল পাড় বরাবর। তারা ওই উল্লাস দেখছে আর উৎসাহিত করছে বিপ্রতীপ উল্লাসে মাঝিদের। হুইপ! টান! লাগিয়েছে! জোরসে! নৌকা কাদা ভেঙে ভেঙে ঘুরছে। ঘুরে চলেছে। লিয়াকত মাঝি আবার লাফিয়ে বসছে নৌকায়। আবদুল কাছি ধরে টান মারছে। চলেছে সাঁকোর দিকে। তার পেশি ফুলে উঠছে। শিরা ধমনী ফুলে উঠছে। অবিরল ধারায় ঘাম ঝরে পড়ছে ভৈরবের জলে ও কাদায়। 

নদীপাড়ের জমিতে কাঁঠালতলার বাঁশের আসনে বসে এ দৃশ্য দেখছিল সিদ্ধার্থ। বরকত আলি ছিলেন তার সঙ্গে। তিনি বললেন—দেখেছ কাণ্ডটা! এটা করা কি ঠিক হল মোহনের? 

—না ঠিক হল না। 

সিদ্ধার্থর স্বর থমথমে। বিষণ্ণ। সে টের পাচ্ছে, মোহনলাল তবে এলাকার প্রভু হতে চলল! এলাকার অধীশ্বর! সে বলছে—এ অন্যায়! এইভাবে লোক দিয়ে নৌকা টানানো! এ অন্যায়! ওরা রাজি হল কেন? 

বরকত আলি বললেন- সমিরুদ্দিনের দলটাকে এখন গোটা গ্রাম ভয় পায়। আগে অপছন্দ করত। এখন ভয় পায়। আস্তে আস্তে আমিও ভয় পেতে শুরু করেছি ওদের সিদ্ধার্থ। 

—চাচা! 

—লিয়াকত মাঝি সোমেশ্বরের কাছে টাকা ধারে। আমার কাছেও ধারে। ভৈরবের মৎস্যজীবীদের বড়ই দুর্দশা। তার ওপর এক বছর হল বৃষ্টি নেই। কী করবে ওরা। সোমেশ্বরের মধ্যে এ জিনিস ছিল না। লোককে টাকা ধার দিচ্ছে বলে প্রভু হয়ে উঠছে, এমন মানসিকতা ছিল না। এই মন মোহনলালের। আমিও ভয় পাই ওকে এখন সিদ্ধার্থ। কারণ আমিও ওদের কাছে টাকা ধারি। সেই জোরেই মোহন সর্বসমক্ষে আমাকে ধমকে দেয়। আমি, নিজের সম্মান বাঁচাবার জন্যই এখন হ্যাঁ হ্যাঁ করি। ওর সব কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করি। আর ক’টা দিন। পরের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই সরে যাব আমি। 

—না চাচা। আপনি থাকবেন। আপনাকে আমাদের দরকার। 

—তুমি কি জানো সিদ্ধার্থ, এই রাজনৈতিক পদ হয়ে উঠছে আমার জীবন-মরণ সমস্যা। 

—কেন চাচা? 

—মোহনলাল সার্বিক অধিকার চায়। করম মণ্ডলের কথা তো শুনেছ? 

—হ্যাঁ। 

—করম মণ্ডল পঙ্গু হয়ে গেল মানে এ অঞ্চলে লিগও পঙ্গু হয়ে গেল। কংগ্রেস এমনিই দুর্বল ছিল। তার ওপর জব্বারকে হাত করে মোহন অর্জুন সেনের কোমর ভেঙে দিয়েছে। লোকে এখন হতেই ওকে মান্য করতে শুরু করেছে। এবার ওর সিংহাসনের কাঁটা কে বল? আমি ছাড়া? আমি থাকলে এই অঞ্চল পুরোপুরি ওর দখলে আসবে না। অতএব আমাকে সরানোর ছক কষবে ও। 

—চাচা! ও কি এত নীচে নামবে? 

—নীচে নামতে বাকি রেখেছে কিছু? তুমি জানো না? 

—জানি। 

—তা হলে? কথা কী জানো, ও যেভাবে চটজলদি নেতা হয়ে উঠছে তার পথটা সরল নয়। গ্রামাঞ্চল বলে আর পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে বলে পারছে। এখানে মাথা হয়ে বসতে গেলে আজও পয়সার জোর কাজে লেগে যায়! ও যখন গ্রামে থাকবে বলে এল, আমি খুশি হয়েছিলাম। অত শিক্ষিত ছেলে, গ্রামে থাকবে, সংগঠনের কাজ করবে, এ তো ভাল কথা। দিন-কাল পাল্টেছে। মানুষকে আজ আর অশিক্ষিত থাকতে দেওয়া চলে না। কিন্তু দুঃখ কী জানো, ও শিক্ষিত ছেলে হয়ে গ্রামে যে বিষ ঢুকিয়েছে, তা কিন্তু আমাদের এতকালের অশিক্ষিত জমানাতে ছিল না। তা হলে আর শিক্ষায় কী লাভ বলো? ওই বদমাশ ছেলেগুলোকে এইরকম প্রশ্রয় দেয়! এই তরুণ বয়স, এখনই ও এইরকম করছে। পরে, পোড়-খাওয়া, ঝানু হলে ওর কি মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকবে? আমরা যখন পার্টি শুরু করেছিলাম তখন বড়দের মান্য করতাম কত! নেতৃত্বের ওপর কথা বলার ভাবনা মনেও আসত না। এমন কোনও কাজ করতাম না যাতে দলের গায়ে কোনও দাগ পড়ে! আজ পঁচিশ-তিরিশ বৎসরে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কত পরিবর্তন হল! কত আর বলব! ও এখন দাপট দেখায়! সেদিনের এক ফোঁটা ছেলে! 

—আপনারও তো লোক আছে। আপনি তাদের সংগঠিত করুন। ওর দাপট ভাঙুন। লড়াই করুন। 

—না সিদ্ধার্থ। লড়াই তুমি করবে। আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। অনেক শক্তি আছে তোমার। একদিন গোটা দলকে নেতৃত্ব দেবে তুমি। কে জানে, হয়তো দেশকেও নেতৃত্ব দেবে। সিদ্ধার্থ আবেগ বোধ করে। নিচু হয়ে বরকত আলির পা ছোঁয় সে। বলে—আশীর্বাদ করুন।

—আশীর্বাদ করি। সবসময় আশীর্বাদ করি। সিদ্ধার্থ, বয়স হয়েছে আমার, রাজনীতি করছি, সেও আজ তিরিশ বৎসরের কম নয়। আগে প্রত্যক্ষভাবে এমন জড়িত ছিলাম না। আসলে গ্রামদেশে রাজনীতি এমন প্রত্যক্ষ ছিল না তো আগে। তবু পার্টির নেতারা আসতেন। থাকতেন। তাঁদের কাছে কত শিখেছি! শুধু কমিউনিস্ট নেতারাই নয়। অন্য পার্টিতেও অনেক মাননীয় নেতা ছিলেন। মত আলাদা ছিল কিন্তু শ্রদ্ধা করতে অসুবিধে হয়নি। গ্রামে থেকেছি। তবু বড় বড় নেতাদের দেখেছি। শিবেশ্বর সাধুখাঁ, ত্রিদিব চৌধুরী, অরুণ সেনের মতো নেতারও বক্তৃতা শুনেছি। দেখেছি কাছ থেকে। নমস্য মানুষ তাঁরা। কারণ কী জানো? রাজনীতি করতে এসে তাঁরা হৃদয় হারাননি। ন্যায়-নীতি হারাননি। যে-নেতা, তার শুধু বুদ্ধি আর সাহস থাকলেই চলে না, তার হৃদয় থাকতে হয়। তার ভালবাসা থাকতে হয় মানুষের প্রতি। তোমার তা আছে। তোমার বুদ্ধি, বিবেচনা, হৃদয়, ব্যক্তিত্ব সকলই আছে। 

—চাচা! আপনারা আছেন বলেই তো আমি কাজে ভরসা পাই। আপনারা না থাকলে আমার কোনও অস্তিত্বই নেই। 

—মানুষকে পাশে পাবে তুমি সিদ্ধার্থ। মানুষেরও যে তোমাকে দরকার। কী জানো, তোমাকে কাছ থেকে দেখার আগে পর্যন্ত আমার লোভ ছিল এম এল এ হওয়ার। কতদিন ভেবেছি বরকত আলি এম এল এ! আহা! কিন্তু এইসব সাধ আর নেই এখন। আল্লাহতালার দেওয়া এ জীবন, এই প্রাণ, এ তো মানুষের প্রয়োজনেই লাগার কথা ছিল। মানুষের কাজে লাগার সুযোগও পেয়েছিলাম। কিন্তু স্বার্থ ভেবেই দিন কেটে গেল। 

—আপনি তো করছেন চাচা। মানুষের জন্য করছেন। করবেন আরও। আপনাকে থাকতে হবে।

—কী জানো সিদ্ধার্থ, মন ভেঙে গেছে। মোহন—এই মোহনকে জন্মাতে দেখেছি। আমার ছেলেদেরই মতো ও একজন। আমার বন্ধুর ছেলে। ওকে কত স্নেহ করেছিলাম। ওর বাড়ির সঙ্গে আমার আত্মীয়ের সম্পর্ক। কতবার কত জায়গায় হিন্দু-মুসলমানের রায়ট লেগেছে। এ গাঁয়ে ওই দু’টি মাত্র হিন্দুর ঘর। তাদের গায়ে আমরা আঁচও লাগতে দিইনি। আমাদের ভরসাতেই দিনের পর দিন মা’কে বউকে ফেলে শহরে গিয়ে ব্যবসা করছে সোমেশ্বর। আমরা তার মর্যাদা দিয়েছি। আলাদা করে ভেবে কিছু করিনি। যেমন ঘরের লোকের জন্য ভাবি, তেমন ওদের জন্যও ভেবেছি। সেনরা আলাদা পার্টি করে। তাদের সঙ্গে জমি নিয়ে কাজিয়া আছে আমার। তবু জানি, তেমন প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ দিয়ে সব দাঁড়াব। কিন্তু মোহনলাল গ্রামে এক নতুন সম্পর্কের আমদানি করছে। এ হল শক্তিমানের সঙ্গে শক্তিহীনের সম্পর্ক। সিদ্ধার্থ, বাম জমানায় এমন হওয়ার কি কথা ছিল? কংগ্রেস আমলের সঙ্গে তা হলে আর তফাৎ রইল কী! ঢাকের শব্দ এগিয়ে আসছিল ক্রমশ। ঘট বিসর্জন দিতে আসছে চাটুজ্যেবাড়ির লোকজন। 

প্রতিমা নিরঞ্জন হচ্ছে না। তবু ঘাটে ভিড় করে আছে মানুষ। দেখছে। বিসর্জনের বাজনায় আছে এক করুণ সুর। সিদ্ধার্থর হৃদয়, বরকত আলির হৃদয়, এমনকী সমবেত মানুষগুলির সকল হৃদয় তা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। অনাবৃষ্টির এ মরসুমে স্বয়ং দেবীই রয়ে গেলেন অনৈরঞ্জনা। হায় গো! হায়! 

শেষ আলোর রেশ বিলিয়ে সূর্য নিঃশব্দে ডুবে গেল। মর্ত্যে আঁধার নামল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *