2 of 3

রাজপাট – ৭৭

৭৭ 

গম্ভীর নিপট মূর্তি সমুদ্রের পারে
এখনো দাঁড়ায়ে আছে। 
সূর্যের আলোয় সব উদ্ভাসিত পাখি 
আসে তার কাছে। 
জানো না কী চমৎকার! 
বলিল মৃতের হাড়, বিদূষক, তরবার, 
আর যে বলদ তার ফলার খেয়েছে ঘানিগাছে। 

.

রান্না শেষ করে জানালার কাছে বসেছিল মৌসুমি। কী-ই বা এমন রান্না তাদের দু’জনের! তার মধ্যে হারাধন কোনও দিনই দুপুরে খেতে আসে না। বাইরে খেয়ে নেয়। কে জানে, হয়তো মায়ের বাড়িতেও যায় সে। মৌসুমি অনুমান করে। এ পর্যন্ত তার সঙ্গে যত না সময়, তার চেয়ে অধিক হারাধন কাটিয়েছে ওখানেই। তার একা লাগে। দুঃখ হয়। নববিবাহিতা সে। স্বামীসঙ্গের ইচ্ছা তার মধ্যে প্রবল। সম্পর্ক স্থাপন করতেও সে গভীর আগ্রহী। কিন্তু হারাধন, কী এক আবর্তের মধ্যে সারাক্ষণ ডুবে থাকে! মৌসুমি তাকে ছুঁতেও পারে না। আজ অবধি হারাধনের সঙ্গে তার কোনও স্বপ্ন-সংলাপ হয়নি। শুধু সাদামাটা চাহিদার কথা আর শরীর। আজ পঞ্চান্ন গ্রাম কালো জিরে আনতে হবে। বিস্কুট ফুরিয়েছে। হাতে টাকা নেই, পঞ্চাশটা টাকা রেখে গেলে ভাল হয়। ওপরের মেসোমশাই একবার দেখা করতে বলেছেন।—এইসব হল তার তরফের। হারাধনের কথা আরও কম। গামছাটা দাও। আলোটা জ্বালো তো। চা করো এক কাপ। চিনি নেই, সেটা আগে মনে করতে পারোনি? বিছানাটা করো তো।—এই সব। এই সর্বস্ব। তারা আজ পর্যন্ত কোনওদিন পরস্পরের চোখে চোখ রেখে উধাও উদাসী হয়ে যায়নি। কিন্তু যোনি ও লিঙ্গসন্ধি ঘটিয়েছে নিত্য। 

মনের সম্পর্ক তৈরি না হলেও শরীরের সম্পর্ক তৈরি হয়, সে জেনেছে। যদিও, তার মায়ের অসফল দাম্পত্য দর্শন সত্ত্বেও, সে মনের সম্পর্কের ওপর আস্থা রেখেছিল। ভেবেছিল, শরীরের পথ ধরেই তারা হয়ে উঠবে মনের প্রেমিক। হয়নি তা। হল না। হবে কি কোনও দিন? সে জানে না। 

স্বাধীন সংসার তার। শ্বশুর-শাশুড়ির শাসন নেই, দেবর ননদের আবদার, ঈর্ষা, ঝামেলা নেই। তবু তার আনন্দ নেই। বরং তার মনে হয়, পরিবারের সকলে একত্র থাকলে এত একা লাগত না তার। সুখে-দুঃখে কেটে যেত দিন। শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করত সে। ননদের সঙ্গে খুনসুটি করত। দেবরদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে গড়ে নিতে পারত আপন জগৎ। সারাক্ষণ হারাধনের জন্য হাহাকার জমত না বুকে 

মায়ের একা সন্তান সে। তার মধ্যে কাঙ্ক্ষা ছিল এক ভরা সংসারের। এই কাঙ্ক্ষা মিটতে পারত। তার আয়োজন ছিল। হল না। সে দেখছে ক্রমশ, যেন এই তার নিয়তি। তার চারপাশে সাজিয়ে রাখা থাকে ভরা জীবনের উপকরণ। কিন্তু সে অল্পের জন্য তার নাগাল পায় না। 

তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তাকে ঘনিষ্ঠ হতে দেয় না হারাধন নিজেই। তার অবাক লাগে, কেন এমন? বরং এটাই তো স্বাভাবিক ছিল, হারাধন আগ্রহী হয়ে উঠবে, মৌসুমিকে পরিবারের একজন করে তুলতে! 

সে টের পায়, এক ধরনের সংকোচ আছে হারাধনের মধ্যে। তার পেতনির চরের বাড়ি নিয়ে, নারানমুদি পিতা নিয়ে, ফ্যাকাশে মা আলতা আর বেকার ভাইগুলি নিয়ে। কোনও অর্থ পায় না সে এই সংকোচের। দারিদ্র কোনও অপরাধ নয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তারাও তো দরিদ্রই। সে আর তার মা! মায়ের সামান্য রোজগার ভরসা করে বেশ কষ্টেই তারা কাটিয়েছে দিন। 

অন্য দিকটাও ভেবে দেখেছে সে, হতে পারে, তার পিতৃ-পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যাবার ভয়েও হারাধন উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু তারও কোনও মানে খুঁজে পায় না সে। সে কি নিজের মুখে বলে বেড়াবে পিতৃকলঙ্কের কথা? 

মাঝে মাঝে এই একা জীবন দুর্বিষহ লাগে তার। যদি প্রেম গড়ে উঠত তার ও হারাধনের, সে সারাদিন, হারাধনের ভাবনায় বিভোর কাটাতে পারত। কিন্তু হয়েছে তার উলটো অবস্থাই। হারাধনের বিষয়ে ভাববার মধুরতা কিছু মাত্র নেই। কেবল ওই শরীরী বিষয়। তার বিবমিষা হয়। গা গুলিয়ে ওঠে ভাবতে ওই দৃশ্য। একের পর এক রাত্রি জুড়ে ঘটে যাওয়া একঘেয়ে প্রক্রিয়া। তার হাঁটুদুটি নির্মম ছড়িয়ে ফেলে উঠে আসছে হারাধন। তীব্র উপস্থ দ্বারা বধ করছে 

তাকে রাতের পর রাত। রাতের পর রাত। 

এবং এ এক অদ্ভুত সংস্কার হারাধনের। রাত্রি ছাড়া শরীরে আগ্রহী সে নয়। দিবালোকে নয়। সন্ধ্যাভাগে নয়। অথচ বিবাহিত বন্ধুদের কাছ হতে জেনেছিল মৌসুমি, নতুন বিয়ের পর মিলনকালের কোনও নির্দিষ্ট নির্ধারিত সময় থাকে না কারও। বিশেষত, যেখানে স্বামী-স্ত্রী একান্তে বসবাস করে। 

কখনও, কোনও দিন পাখিরা শিস দিলে সে হৃদয়ে বোধ করে আকুলতা, এমনকী ভ্রমরের গুঞ্জনেও আপনার মর্মকথা খুঁজে পায়। প্রণয়িনী হতে সাধ জাগে তার। একান্ত ঘন গুঞ্জরণ-সাধ জাগে। প্রেম-রচনার অভীপ্সায়, এক ছুটির দুপুরে সে বাড়িয়ে দিয়েছিল ওষ্ঠ। চেপে ধরেছিল ইচ্ছুক স্তন হারাধনের বুকে। হারাধন তাকে সরিয়ে দিয়েছিল ঠেলে। বলেছিল— ছিঃ! এই দিনের বেলায়! 

সে, একদিনই, স্বভাববিরুদ্ধভাবে ফুঁড়ে বলেছিল-তাতে কী! কেউ তো নেই তুমি আর আমি ছাড়া! 

—কেউ এসে পড়তে পারে। 

—এলে তখন সামলে নেব। 

—ছিঃ! এই অসময়ে! কী নির্লজ্জ তুমি! বেড়াল-কুকুর নাকি! 

নিজের এই লজ্জাহীন প্রকাশে মুহ্যমান ছিল সে বেশ কয়েকদিন। ইচ্ছে করেছিল তার, সে জানতে চায় কারও কাছে, এ কি অন্যায়? এ কি ছিছিক্কারের বিষয়? দিবাভাগে যৌনসঙ্গম করলেই কি বিড়াল-কুকুর গোত্রীয় হয়ে যায় মানুষ! আর হয় যদি, তাতে ক্ষতি কী! মানুষ ও প্রাণী, ওরাও প্রাণী। প্রত্যেকেই আলাদা। প্রত্যেকেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। 

মানুষ কি নেয় না পশুর বিভঙ্গ? নেয় না কি? যখন অতি বিনাশী হয়ে ওঠে হারাধন, অতি তীব্র কামাতুর, আর উলটে দিয়ে তাকে সবলে, টেনে-হিঁচড়ে আনে খাটের প্রান্তে আর তাকে পেছন ফিরিয়ে তুলে ধরে এমন ভাবে, যেন সে ঘাসে মুখ দেওয়া গাভী এক কিংবা গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলা কুক্কুরী, এমতাবস্থায় সে হারাধন দ্বারা বিদ্ধ হয় এবং প্রতিটি আঘাতে তার স্তন দুলে ওঠে, হারাধনের শক্ত হাত সেই দোলনের বিরুদ্ধে সকাম—তখন সেই ভঙ্গিকে, আগাগোড়া ভঙ্গিকে, তার যে প্রাকৃতই মনে হয়। পশুধর্মের অবিকল অনুকরণ মনে হয়। সে তা অস্বীকার বা আপত্তি তো করে না। তা হলে? 

একের পর এক প্রশ্ন জন্মায়, মিশে যায় মাটির সঙ্গে। একের পর এক কাঙ্ক্ষা জন্মায়, মিশে যায় ধূলির সঙ্গে। 

সে কখনও-বা করেছে কল্পনা। উদ্বেল ঔজ্জ্বল্যে সে মেলে দিয়েছে দেহ এক পুরুষের কাছে। সে-পুরুষ সবলকাম। সে পুরুষ মোহময়। প্রেমী। কে সে? কে কে? মুখ দেখা যায় না তার। নাম জানা যায় না। সে, সকল আকুল নারীর কল্পনায় ধরা দেয় শুধু। 

এবং সে ক্লান্তই হয়েছে। দিনের পর দিন কল্পনা করতে করতে ক্লান্তই হয়েছে। যৌনতার আকাঙ্ক্ষা মরে এসেছে তার যেভাবে নদীর সোঁতা শুকিয়ে খাক হয়ে যায়। মরে এসেছে, চরম মুহূর্তে সেই মাতৃআহ্বান শুনতে শুনতে। 

মা মা মা। হারাধন ডাকে—মা মা মা! তুমি আমার মা? আমার মা? 

প্রথম রাত্রে একথা শুনে সে পাথর হয়ে গিয়েছিল। ঘৃণা করেছিল এই ডাককে। তীব্র তীব্র তীব্র ঘৃণা। অশিক্ষিত সে নয়। সে জানে, মাতৃপ্রেম সমস্ত পুরুষের মধ্যে সুপ্ত থেকে যায়। কিন্তু শিক্ষা ও সুচেতনা দ্বারা সেই প্রেমকে মানুষ গড়ে তোলে পূজা। কাম পরিহার করে মাতৃসম্পর্ক হয়ে ওঠে জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কিন্তু এ কী! এ কী! 

ওই সময় সে তার চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। সকল ইন্দ্রিয়ের জানলা-দরোজা বন্ধ করে দিতে চায়। এবং চাইতে চাইতে ক্লান্ত সে। ক্লান্ত। অবসন্ন। এখন আর কিছুই চায় না। 

প্রথমে সে ভেবেছিল এ এক বিকৃতি। তারপর ধীরে, অতি ধীরে তার মধ্যে জুটেছে এক কুটিল সন্দেহ। এই সন্দেহ কালো বিষ হয়ে আক্রমণ করেছে তাকে। তার শান্তি গিয়েছে। সুখ গিয়েছে। আনন্দ গিয়েছে। তার স্বপ্ন নেই আর। আর কোনও আকাঙ্ক্ষাও নেই। এমনকী এমনকী সে, নারীসত্তার স্বাভাবিক ঈপ্সার তাড়নায়, মা হওয়ার যে বাসনা, তাকেও হত্যা করেছে কোনদিন। 

মা হতে চায় না সে। চায় না। কাকে জন্ম দেবে সে? কার সন্তানকে? 

এ কথা, এইসব কথা, সে কাকে বলবে? জন্মদুঃখী কপালপোড়া তার মা। সে-ও এক। কাকে সে জানাতে পারে, এই দীন, অতি দীন, জীবনের কথা! 

মেনে নিচ্ছে সে, সকলই মেনে নিচ্ছে। আর মেনে নিতে নিতে ক্ষয় লেগে যাচ্ছে তার প্রাণে। ইদানীং তার মরে যাবার ইচ্ছা হয়। হারাধন থাকলেও সে একা; হারাধন কাজে চলে গেলেও। সারা দিবস একা। এমনকী, রাত্তিরে, হারাধনের শরীরের কাছে ছেড়ে দেওয়া তার শরীর- সে-ও একাই। একা একা একা চলতে চলতে সে কখন, অনবধানে, এসে দাঁড়িয়েছে, এক অতল খাদানের প্রান্তে, যেখানে ঝাঁপ দিলে শূন্যতা, শূন্যতাই কেবল। 

সে একাকিত্বের কথা বললে হারাধন বলে—মা-র কাছে চলে যাও। মা-র সঙ্গে গল্প করো। সে যায় না। একা থাকে। তবুও যায় না। প্রথম প্রথম সন্ধ্যায় সে সেজে-গুজে অপেক্ষা করত হারাধনের জন্য। ছ’টা পেরিয়ে যেত, সাতটা, আটটা—ফিরত না হারাধন। এখনও সেইরকম। তফাত, সে আর সাজে না, অপেক্ষাও করে না। সারাদিন থাকে আটপৌরে, আধময়লা শাড়িখানি পরে। চুল বাঁধে না। সিদুর দেয় না কপালে। কাপড় কাচতে গিয়ে শাঁখা ভেঙেছিল, আর পরেনি। মাঝে মাঝে একটা কশিদাকর্ম নিয়ে বসে। নিজের হাতে সুতোর কারুকাজ করে একটি শয্যাঢাকনি সে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। তা বিশেষ এগোয়নি। কার্বন-কাগজে তোলা নকশার ছাপ মুছে-মুছে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে কাপড়ের জলুস। সে বসে আর জল পড়ে তার চোখ দিয়ে। হল না। বুনে তোলা হল না শয্যার কারুকার্য। হয়তো অনেক কিছুই এই পৃথিবীতে আসে না পূর্ণতার তরে। যেমন জীবন তার। 

এখনও, এই জানালার কাছে বসে তার চোখে জল ভরে এল। ঘর মোছা বাকি তার। স্নান করা বাকি। এইসব সেরে খেতে হবে। একা একা খেতে হবে। কতদিন মায়ের বাড়ি হতে খেয়ে ফেরে হারাধন। এসে বলে— খাব না। 

সে একা একা খায়। বাড়তি খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে। এইভাবে দিনের পর দিন, সে জানে না, কোথায় এর শেষ। এই মফস্সল শহরে, বিচিত্র নয় জীবন, বরং একঘেয়ে সকলেরই। তবু তারই মধ্যে আনন্দ রচে নেয়, বৈচিত্র খুঁজে নেয় মানুষ। ক্বচিৎ তারাও সিনেমায় গিয়েছে, গিয়েছে নাটক দেখতে, বহরমপুর নাটকের শহর, নানাবিধ উচ্চমানের নাটক তারা দেখতে গিয়েছে, মৌসুমি গিয়েছেন সঙ্গে। ‘আমাকে তো কেউ কোথাও নিয়ে যায় না’, বলেছেন তিনি, বলেছেন—হারাধন আমার পাগল ছেলে। আমাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। 

শুনে গম্ভীর থাকতে চেয়েছে সে। হাসেনি। মৌসুমি আড়ালে অনুযোগ করেছেন –-তোদের সঙ্গে যাব না। মৌ বড় দুর্ব্যবহার করে আমার সঙ্গে। 

হারাধন শাসিয়েছে তাকে তখন—শোনো, মা-র সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমি কিন্তু বরদাস্ত করব না। 

সে বলেছে—আমি তো খারাপ ব্যবহার করিনি। 

—মা-র সামনে যা গম্ভীর তেতো মুখ করে রাখো, তাতে যে কেউ তোমার মনোভাব বুঝতে পারে। 

—আশ্চর্য! আমার হাসতে ইচ্ছে না করলেও হাসতে হবে নাকি? 

—সেটা তো ভদ্রতাবোধের মধ্যে পড়ে, কেউ এলে প্রসন্নতা দেখান। 

—আমার প্রসন্নতা দেখাবার কী আছে! উনি তো আমার জন্য আসেন না। আসেন তোমার জন্য। তোমার প্রসন্নতাই ওঁর পক্ষে যথেষ্ট হওয়া উচিত। 

—দেখ, মা-ই আমার সব। সব কিছু। মাকে দুঃখ দিলে আমাকে তুমি কোনও দিন পাবে না। এটা আমার শেষ কথা। 

—তোমাকে আমি সত্যিই কি পাই? 

—আমাকে পাবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কষ্ট করতে হবে। আমি যা বলব, যেমন বলব, শুনতে হবে। মায়ের করুণায় তুমি আমাকে পেয়েছ। মা বলেছিলেন বলেই আমি বিয়ে করেছিলাম। কী দিইনি তোমাকে আমি? সংসার স্বাচ্ছন্দ্য কী নয়? কোন ঝামেলাটা সহ্য করতে হয় তোমাকে? যা পাচ্ছ তা-ও তোমার কাছে যথেষ্ট নয়। নিজের ভাগ্যকে তোমার ঈর্ষা করা উচিত। 

কঠিন ব্যঙ্গের হাসি সে হেসেছিল। বলেছিল—এতক্ষণে একটা খাঁটি কথা বললে। 

—হ্যাঁ। বললামই তো। 

বলেছিল হারাধন।

—তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে বিয়ে না করলে বিয়ে হত তোমার? নেহাত মায়ের নামে তোমার নাম, তাই তোমায় ফেলতে পারিনি। 

সে আর কথা বাড়ায়নি। ঘৃণার পাত্র অনর্গল হয়ে গেলে সে বড় সংকোচ বোধ করে। সে চায় না তিক্ত মলিন কথার দ্বারা মানুষকে বিদ্ধ করতে। হয়তো বিদ্ধ হওয়া এড়াতে চায় বলেই এমন সে। তবু এড়াতে পারল কই! হারাধন, প্রতি পদে আকারে-ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দেয় তাকে। সে নির্মল নয়, পিতৃপরিচয়ে শুদ্ধ নয়। মাঝে মাঝে তার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে ওঠে। কী দোষ তার! সে তো কোনও অন্যায় করেনি, তার মা তো কোনও অন্যায় করেননি। তবু, একজন তাদের ছেড়ে চলে গেছে, এই লজ্জায় আজীবন মুখ লুকিয়ে বাঁচতে হয় কেন? ছেড়ে সে গেল, তার তো কোনও শাস্তি হল না! এ কেমন নিয়ম! এ কোন সমাজ! বরং, সে আর তার মা, দু’জনে, সকল সংকট পেরিয়ে এই যে শুদ্ধভাবে কাটাল জীবন, এই যে কারও হাতে-তোলা হয়ে রইল না, তার জন্যই কি সমাজের চোখে তাদের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠা উচিত ছিল না? 

এই সকল প্রশ্নই তার মধ্যে জাগে আর মিলিয়ে যায় ধুলোয়। এবং সে ক্রমশই প্রত্যাখ্যান করে চলে সিনেমা, নাটক ইত্যাদি দেখার প্রস্তাব। 

আজ মৌসুমি আসবেন বাড়িতে। তারা পূজার জন্য কেনাকাটা করবে কিছু। মৌসুমি সঙ্গে থাকবেন। গতকালই বলেছিল হারাধন—মা বলছিল, বিয়ের প্রথম বছর, সবার জন্য কেনাকাটা করা উচিত। 

সে বলেছিল—কবে বললেন? সেদিন যে বাড়ি গেলে, তখন? 

—ওঃ! ওই মা না। 

—ও। 

—কাল চলো, বাজার করে আসি। 

—চলো। 

—তুমি তৈরি থেকো। সন্ধ্যাবেলা মা চলে আসবে। 

—ও। 

—খুব সুবিধে হবে মা থাকলে। মা-র পছন্দ খুব সুন্দর। 

সে মনে মনে বলেছিল—আমার পছন্দ কেমন, তা তো বুঝতেই চাইলে না তুমি। আমাকেও বোঝবার সুযোগ দিলে না। 

মুখে কিছু বলেনি সে। কেনাকাটায় উৎসাহও বোধ করেনি আর। বলেছিল—তুমিই ওঁর সঙ্গে যাও না। 

—না। তুমিও যাবে। আর ওঁর সঙ্গে মানে কী! মা বলতে পারো না? 

এ কথারও জবাব দেয়নি সে। মা যাঁকে ডাকবার তাঁকে ডেকেছে সে। কোনও দ্বিধা হয়নি। আলতার শিরাময় ফ্যাকাশে হাত, হাজা লাগা পাতলা শ্রীচরণ এবং ক্লান্তিমাখা মুখকে বড় কাছের লেগেছে তার। বড় আপন। সেই স্থানে সে মৌসুমিকে বসাতে পারেনি। তার কাছে সমনামের কোনও মাহাত্ম্য নেই। এ শহরে বা ধুলিয়ানে খুঁজলে মৌসুমি নামের অন্তত পাঁচশো মেয়ে পাওয়া যাবে। বরং তার মনে হয়েছে, সে নিয়মরক্ষার কাঁঠালিকলা মাত্র। মৌসুমি ও হারাধনের বেপরোয়া ঘোরাফেরা নিন্দনীয় হতে পারে বলে তাকে ঢালের মতো সঙ্গে রাখা। 

বিষ বিষ বিষ! সন্দেহের কুটিল বিষে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। মায়েরই মতো পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার জীবন! হায়! কেন হল এমন! কেন! কখনও সে কাঁদে অবিশ্রাম। কখনও শুকিয়ে মরুসদৃশ হয়ে থাকে। 

হারাধনের কথাগুলিকেই নাড়াচাড়া করে সে মনে মনে। মৌসুমির কথাতেই বিয়ে করেছিল হারাধন। মৌসুমি কেন বিয়ে করতে বলেছিলেন হারাধনকে? বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যায়নি তার! এমনকী সদ্য চাকরি পেয়ে তার পরিস্থিতিও ছিল না বিয়ের অনুকূল। তা হলে কি তাকেই আড়াল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এই বিয়ে! সে কি তা হলে পুতুলের মতো ব্যবহৃত হয়ে গেল না? কুৎসিতভাবে ব্যবহৃত হয়ে গেল না? 

অঝোর কান্নায় গলে যেতে থাকছিল সে। দরজাঘন্টি বাজল তখন। সে, চোখ মুছে, দরজা খুলে দেখল ওপরের নমিতা মাসিমা দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁদেরই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে তারা। এই মহিলার সঙ্গে তাদের সহজ সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছে। 

নমিতা মাসিমা আর তাঁর স্বামী থাকেন ওপরে। এমনই এই বাড়ির গড়ন যে ওপরে-নীচে একেবারে পৃথকভাবে থাকা যায়। নীচের তলায় ভাড়াটের কাছেও ওঁরা আসেন বাইরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সদর দরজায়। 

নমিতার হাতে একটি ঢাকা দেওয়া বাটি। মৌসুমি বলল—আসুন মাসিমা। 

—বসব না। সব কাজ সারা হয়নি। নবু ফোন করেছিল দিল্লি থেকে। কথা বলতে বলতে সময় গেল। তোমার মেসোমশাইকে তো জান। খালি চায়ের ফরমাশ। ফ্লাস্কে যে একবারে চা করে রাখব, তা ওঁর রুচবে নাকি? একটু ছানার ডালনা করেছিলাম। ভাবলাম তোমাকে একটু দিয়ে যাই। 

মৌসুমি বাটি হাতে নিয়ে হাসি টানল মুখে। বলল—একটু বসুন মাসিমা। 

নমিতা বসলেন। তাকালেন মৌসুমির দিকে। বসবার সংকল্প নিয়ে তিনি আসেননি ঠিকই। কিন্তু অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে যায় অনেক খবর। সেগুলি সুখবর নয় মোটে। নমিতা, এক সাধারণ গৃহিণী, সাধারণ গৃহবধূ, তাঁর মন বেদনায় ভরে যায়। এই কয়েক মাসেই, মৌসুমি মেয়েটাকে অধিক স্নেহ করেছেন নমিতা। তিনি বললেন—খেয়ো।

—খাবই তো। 

—মুখ ভার কেন তোমার? 

—কে বলেছে ভার? না তো! 

—আমার চোখে তো ছানি পড়েনি এখনও বাছা। দেখতে পাই। হারাধনের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়েছ? 

—না না। 

—তা বিশ্বাস করি। ঝগড়া বাঁধাবার মেয়ে নও তুমি! তা কাঁদছিলে কেন? মন খোলো দেখি। খুলে বলো। হালকা লাগবে। 

মৌসুমি নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল প্রাণপণ। পারল না। আজ সে বড়ই কাতর হয়ে আছে। মৌসুমি আসবেন, মৌসুমির সঙ্গে তাকে বেরুতে হবে, এই ভেবে কাতর হয়ে আছে। তার চোখে জল ভরে এল। দাঁতে ঠোঁট কামড়াল সে। নমিতা বললেন–হারাধন কটু কথা বলেছে কিছু? 

সে মাথা নাড়ল। না। 

নমিতা বললেন—তবে? একা ঘরে বসে কাঁদছিলে, এ তো ভাল কথা নয়। কী হয়েছে? 

—কিছু ভাল লাগে না মাসিমা। 

—কেন? ভাল লাগে না কেন? নতুন বিয়ে হয়েছে, কোথায় সারাক্ষণ ছুটে বেড়াবে, হাসবে, আনন্দ করবে, তা নয়! ভাল লাগছে না! এ কী কথা! কাঁদবার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে। তোমার মেসোমশাই পর্যন্ত বলেন, মেয়েটা কী রকম বিষণ্ণ হয়ে থাকে কেন! ওইরকম আলাভোলা মানুষ, তাঁরও চোখ এড়ায়নি। কী হয়েছে মৌসুমি? বড় কোনও সমস্যা থাকলে বাড়িতে জানাও। 

—না, মানে… 

সে চুপ করে যায়। আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে। নমিতা বলেন—এই বয়সের মেয়েদের কত শখ-আহ্লাদ থাকে! তোমার কোনওটায় গরজ নেই। ছেলেমেয়ে তো আমিও মানুষ করেছি। হ্যাঁগো, হারাধনের কোনও দোষ নেই তো? মদ-টদ তো খায় না। 

—না না। 

—তা হলে? 

—মাসিমা! কী জ্বালায় জ্বলছি আমি, আপনাকে বলতে পারব না! পারব না! আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে মাসিমা! বাঁচতে ইচ্ছে করে না। 

সে কান্নায় নুয়ে পড়ে। নমিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। যে-কান্না মায়ের বুকে ঝরিয়ে দিতে চেয়েছিল সে, পারছিল না, তা-ই এই মাতৃসমা মানুষটির বুকে উজাড় করে দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সংযত করছিল সে নিজেকে। যতটুকু বলে ফেলেছে, তার জন্যই সংকোচে গুটিয়ে যাচ্ছিল তার মন। 

নমিতা তাকে কাঁদতে দিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন—যা বলতে মুখে আটকাচ্ছে, তা বোলো না। যা বোঝার বুঝলাম আমি। কোনওভাবে কপাল পুড়েছে তোমার। মেয়েমানুষের কপালে আগুন লাগবে কখন, কে বলতে পারে! ওঠো। ওঠো এখন। যাও। স্নান করো। কাজ সব শেষ? 

—না। 

সে কোনওক্রমে বলে। 

—ঘর মোছা বাকি। 

—সেরে ফেলো যাও। তারপর স্নান করে ঘুম দাও দেখি। সন্ধ্যায় চলে এসো আমার কাছে। চষির পায়েস করব আজ। তুমি আমায় চষিগুলি বুনে দেবে। 

চোখ মুছল সে। নাক টানল। ঘাড়ের ওপর এলিয়ে পড়া ভাঙা-খোঁপা বেঁধে নিল আবার। তারপর বলল—সন্ধ্যায় থাকব না মাসিমা! 

—কোথায় যাবে? 

—ওই, মাসিমা আসবেন, ওঁকে নিয়ে আমরা একটু কেনাকাটা করতে বেরুব। 

–মাসিমা মানে ওই স্যারের বউ? 

—হ্যাঁ! 

একটা কথা বলি বাছা, কিছু মনে কোরো না। সিনেমা যাও, থিয়েটারে যাও, বাজারে যাও, সর্বত্র ওই মাগি সঙ্গে সঙ্গে থাকে কেন? এ আবার কী! তা-ও তো নিজের কেউ নয়। পাতানো মা। এ তো ভাল কথা নয়। 

সে চুপ করে থাকে। থাকতেই হয় তাকে। কারণ সে নিজেও মনে করে এ ভাল নয়। ভাল নয়।

নমিতা বলেন-তুমি আর কী বলবে? দেখতে দেখতে চোখ পচে গেল। ভগবানের দুনিয়ায় অনাসৃষ্টি তো কম নেই! আমাকে যদি তুমি নোংরা বলো তো তা-ই সই। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে যাই, শ্যাওড়া গাছের পেতনি ঘাড়ে চাপার জন্য তৈরি থাকে। ওঝার দাওয়াই দিয়ে তাকে তাড়াতে হয়। শক্ত হও। শক্ত হও। নিজেরটা নিজে বুঝে না নিলে কেউ তোমার হাতে তুলে দেবে না। 

—মাসিমা! 

—দেখো বাছা, ছেলে-মেয়ের নতুন বিয়ের পর শাশুড়ি সবসময় নবদম্পতির সঙ্গে ট্যাং-ট্যাং করে ঘুরছে, এ মোটেই শোভন নয়। আগেকার কালে একরকম ছিল। এ কালে একরকম। যখনকার যা দস্তুর। ছেলেমেয়েকে মেলামিশি করতে না দিলে তাদের ভাব জমবে কেন! তা ওই মাসিমাটি সারাক্ষণ লগ ধরে ধরে চলেছেন, এ কি ভাল? 

তাঁর কথার মধ্যেই বেজে উঠল দরজাঘণ্টি। মৌসুমি দরজা খুলল। খুলে অবাক হয়ে গেল! মৌসুমি দাঁড়িয়ে আছেন। এমন অপ্রত্যাশিত এই আগমন, সে হকচকিয়ে গেল। মৌসুমি বললেন—কী? বাইরে থেকেই চলে যাব, নাকি আসব ভেতরে? 

এবার কথা বলে উঠল সেনা না। আসুন আসুন। 

—চলেই এলাম। বাড়িতে তো কিছু করার নেই। সন্ধ্যায় হারাধন আসবে এই অপেক্ষায় সারা দুপুর কেটে যায়। আজ তো ও এখানেই আসবে। 

পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নমিতা। মৌসুমি মায়ের আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে বললেন—সেই! হারাধন তো ছেলেই আপনার, তাই না? চলি রে মৌসুমি। 

—আচ্ছা মাসিমা। 

সে দরজা পর্যন্ত যায় মাসিমার সঙ্গে সঙ্গে। নমিতা চাপা গলায় বলেন—কী নির্লজ্জ! শক্ত হও মৌসুমি! নইলে কপালের বাকি যা আছে সব পুড়বে। এ আপদ ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো। তোমার জিনিস বুঝে নাও, আবারও বললাম। 

সে ফিরে এল ঘরে। মৌসুমি কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছেন। যখনই আসেন, এমনটা করাই তাঁর স্বভাব। কোথায় এতটুকু ময়লা আছে, কোথায় অগোছাল, কোন বস্তুটি আনাড়ি রাখার ফলে ঘটে গেছে রুচিহীনতার প্রকাশ, এমনই সব নির্দেশ করতে থাকেন। সে জানে। জেনে গেছে। তাকে দেখে মৌসুমি বললেন—খুব বিপদে ফেলে দিলাম তোকে এই দুপুরে এসে! 

—না না! বিপদ কীসের! 

সে বলল, অবশ্যই মুখে হাসি টেনে। 

—আমার রান্না করা আছে। 

—আমি খেয়ে এসেছি। 

—তাতে কী! আমার সঙ্গে খাবেন আবার। রোজ তো একাই খাই। 

—তা একাই তো খেতে হবে তোমাকে। আমার হারাধন কি কাজকর্ম ফেলে তোমাকে বসে সঙ্গ দেবে? 

—আমি কি তাই বললাম? 

—ঘুরিয়ে বললে। একা খাও বলে অভিযোগ। অমন ভাল ছেলে আমার হারাধন, তাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছ, এ তোমার ভাগ্য। 

সে কোনও জবাব দিল না। ঘর মোছার ন্যাতা-বালতি এনে বলল—আপনি বসুন। আমি ঘরটা মুছে নিই। 

—এখনও ঘর মোছোনি? এই বেলা অবধি ফেলে রেখেছ! আমার সোনাটার সংসারে তুমি অলক্ষ্মী না ডেকে ছাড়বে না দেখছি। 

সে বলতে চেয়েছিল—সংসারটা কি আমারও নয়? কিন্তু বলতে পারল না। যতদিন যাচ্ছে, তত মৌসুমি তার সঙ্গে আরও বেশি খিটখিটে ব্যবহার করছেন। তার মন উত্তপ্ত হচ্ছে। তবু ভদ্রতার আবরণে থাকে অপার সহনক্ষমতা। সে সয়ে যাচ্ছে। সয়ে যাচ্ছে। জানে না পারবে কত দিন। নিঃশব্দে ঘর মুছে চলল সে। মৌসুমি বললেন—ওপরের ভদ্রমহিলার সঙ্গে অত আড্ডা মারো কেন? 

সে তাকাল। বলল—কেন? 

বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্ক কখনও ভাল হয় না। কাগজে, টিভিতে দেখো না? —ওঁরা মানুষ ভাল। 

—আমার কিন্তু ভদ্রমহিলাকে বেশ চালাক বলেই মনে হয়। আর কী ট্যাঁক-ট্যাঁক কথা। অসহ্য! 

—চালাক হওয়া কি দোষের? একটা মানুষ বোকা মানেই ভাল, চালাক মানেই খারাপ, তা তো নয়। 

—শুধু চালাক নয়, বেশ ধড়িবাজ! 

—মাসিমার সম্পর্কে এরকম কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না। 

কী! কী বললে তুমি? এত বড় কথা! 

—বড় কথা কিছুই বলিনি আমি। শুধু অপছন্দের কথা জানিয়েছি। সেটাও জানাতে পারব না? মাসিমাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁর সম্পর্কে এরকম কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না। 

—তুমি জানো, হারাধন কখনও আমার মুখের ওপর কথা বলেনি! 

বালতির জল পালটাতে উঠে গেল সে। তার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হচ্ছিল। আরও আরও অনেক বেশি করে উত্তপ্ত হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, বুঝি আর ভদ্রতার আবরণ সে রাখতে পারবে না। ময়লা জল সে ঢেলে ফেলল নর্দমার মুখে। গলগল করে চলে যাচ্ছে জল। আর ওই ময়লার সঙ্গে সে বইয়ে দিতে চাইছে তার যাবতীয় মানসিক আবর্জনা। ক্রুদ্ধ হতে চাইছে না সে। চাইছে না। চাইছে না কোনও বাদ-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে। কারণ, সে জানে, এর ফলাফল হিসেবে আগুন জ্বলে যাবে তার ও হারাধনের মধ্যে। সে কি ভয় পায় হারাধনকে? না। সে অশান্তিতে ভীত। নিরন্তর তর্ক, নিরন্তর বিবাদের মধ্যে থাকতে থাকতে কেমন আতঙ্কিত সে! 

পরিষ্কার জল আর ন্যাতা নিয়ে ফিরে এল সে। মুছছে। বাইরে হেঁকে যাচ্ছে ফিরিওয়ালা। সে শুনল। লাগে-এ-এ বাঁশে-এ-এ-র ঝু-উ-ড়ি, চা-ল-নি-ই, কু-লো-ও, চুব-ড়ি-ই-ই-ই! লাগে এ-এ-এ! 

সে ন্যাতা ফেলে উঠল। একখানা কুলো কেনা দরকার। চাল ঝেড়ে নিতে না পারলে ভাতে থেকে যায় কাঁকড়, বালি, ধানের তুষ। জানালার কাছে দাঁড়াল সে। ডাকল—এই! এই ঝুড়িওয়ালা! 

মাথায়, কাঁধে, হাতে পসরা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। দরজা খুলে বাইরে এল সে। মৌসুমি বিছানায় এলিয়ে ছিলেন। হাতে একটি বই। বইটি সে-ই এনেছিল ওপরের নমিতা মাসিমার কাছ থেকে। বইটির বিষয় ধ্যান, যোগ ও প্রাণায়াম। পাতায় পাতায় খুঁজছে সে, আতিপাতি করে খুঁজছে। কোথায় আছে, কীসের মধ্যে আছে, তার ক্ষোভ প্রশমনের উপায়। কোন পদ্ধতির মধ্যে আছে আনন্দ আহরণের শক্তি। তাদের একজন শিক্ষক বলতেন—তোমার চিত্তেই আছে আনন্দের অফুরন্ত ভাণ্ডার। কোনও ঘটনা তাকে বিনষ্ট করতে পারে না। কোনও আঘাত তার নির্বাপণ করতে পারে না। শুধু চিনতে হয় সেই পথ, যাতে সেই অপার ভাণ্ডার থেকে আনন্দ রাখতে পার বোধে। তাকে অনুভব করতে পার। 

সচ্চিদানন্দ ছিলেন ওই শিক্ষক। তাঁর কাছে দাঁড়ালে সে অপার পিতৃস্নেহ অনুভব করত। তাঁর কথা সে মান্য করেছে কিন্তু অনুসরণ করতে পারল কই! এখনও সে পথ খুঁজছে। চিত্তের মধ্যে থেকে তুলে আনতে চাইছে আনন্দের অনুভূতি। নইলে সে বাঁচে কী প্রকারে! কী প্রকারে! 

ফিরিওয়ালার কাছ থেকে একটি কুলো কিনল সে। দামাদামি করে কিনল দু’খানি ছোট ছোট চুবড়ি। একটায় আদা লঙ্কা রাখবে। একটায় পেঁয়াজ। টাকা নিয়ে চলে গেল ফিরিওয়ালা। সে কুলো আর চুবড়ি দুটো নিয়ে ঘরে আসতেই মৌসুমি বললেন—দেখি দেখি! কুলো কিনলে? 

—হ্যাঁ। দরকার ছিল। 

জবাব দিল সে। মৌসুমি বললেন—কুলো কেনার নিয়ম জানো? 

—না তো! 

—কিছুই জানো না। কী শিখে সংসার করতে এলে? আমার হারাধন কচি ছেলে। তার সংসার তো তুমিই গড়ে তুলবে! দেখি। দাও তো। 

তার ইচ্ছে করছিল বলে যে সে বয়সে হারাধনের চেয়ে ছোট। তা হলে আরও বেশি কচি হওয়া, অনভিজ্ঞও হওয়ার দাবি কি তারই থেকে যায় না? বলল না সে। সহনের চেয়ে কঠিন ও শীল আর কী হতে পারে! সে জানে, এক ধরনের মহিলার কাছে মেয়েরা বড় হয়েই জন্মায়। সংসারের যাবতীয় দায় ও কর্তব্য তাদের মাতৃগর্ভেই লব্ধ হয়ে যায়। বিরস মুখে কুলোসমেত চুবড়িগুলোও বাড়িয়ে দিল সে। মৌসুমি চুবড়িগুলো মেঝেয় রেখে কুলোর ছড়ানো দিকে আঙুল দিয়ে দিয়ে গুনতে শুরু করলেন। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা। 

সে অবাক হয়ে দেখছিল। এ কী করছেন মৌসুমি! তাঁর গোনা এসে থামল সীতায়। আর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন—ছারেখারে দেবে তুমি! সংসার ছারেখারে দেবে! জান না, কুলোর বুনট সীতায় শেষ হলে তা কিনতে নেই। ছি ছি ছি ছি! এটুকুও শেখাননি তোমার মা? 

দুই কান থেকে আগুন বেরুচ্ছে সে বুঝতে পারছিল। তবু বিস্ময় কাটছিল না তার। সে ভাবছিল, এই মহিলা কোন যুগের? তাঁর বয়স কত? সন্তান নেই বলেই সম্ভবত তাঁকে দেখায় আটত্রিশ! মধ্যচল্লিশের এই মহিলা, একজন অধ্যাপকের শিক্ষিত স্ত্রী, কথা বলছেন এমন যেন তারা আছে কোন মধ্যযুগে। সে কুলো ফেরত নিয়ে তিক্ত হেসে বলল—আমার মা আমাকে সঠিক শিক্ষাই দিয়েছেন। তিনি কুসংস্কারগ্রস্ত ছিলেন না। 

—তার মানে? তার মানে আমি কুসংস্কারগ্রস্ত? আমি? আমি? আমি? 

সপাট চড় পড়ল মৌসুমির গালে। হকচকিয়ে গেল সে। তার মুখের কাছে ফুঁসছে দুটি ক্রুদ্ধ চোখ। ফুলে ওঠা নাক। ওষ্ঠাধরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। সম্বরণ হারাল সে। ভদ্রতা হারাল। হারাধনের তর্জনের ভীতির কথা তার মনে রইল না। গালের জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে। মনে। সত্তায়। অস্তিত্বে। সকল শক্তি দিয়ে সে-ও তুলল এক যুযুধান চড়। সপাটে মারল মৌসুমি-মায়ের গালে। টাল খেয়ে বিছানায় বসে পড়লেন মৌসুমি গালে হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। অসহায় দেখাল তাঁকে। ভেঙে-পড়া দেখাল। বুকের ওপর মুখ ঝুঁকিয়ে রোদনবিকৃত গলায় তিনি বললেন—এত বড় অপমান…এত বড় অপমান…ওঃ ওঃ ওঃ! হারাধন, হারাধন… 

সরব হল সে। বলল—অপমানের শুরুটা আপনিই করেছেন। আমি তা ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু আপনি বয়সে বড়। বড়র কাছে ক্ষমা চাওয়ার শিক্ষা মা আমাকে দিয়েছেন। আমি ক্ষমা চাইছি। 

কুলো নিয়ে, চুবড়ি নিয়ে রান্নাঘরে গেল সে। তারপর স্নানঘরে গেল। ঘাড়ে মাথায় জল দিল ভাল করে। কাজটা ভাল করল কি? জানে না সে। জানে না। সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। এর বাইরে আর কী সে করতে পারত! এর জন্য হয়তো হারাধন তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ফেলুক। একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। আর পারছে না সে। পারছে না। যা হবার হবে। সে একদিন যাবে বর্ণালীর বাড়ি। সব বলে আসবে নিখিলেশ ও বর্ণালীকে। 

ঘরে এল সে। দেখল ঘর ফাঁকা। দরজা খোলা রেখে চলে গেছেন মৌসুমি। তার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল ভয়। একটু আগের মানসিক দৃঢ়তা আর নিজের মধ্যে খুঁজে পেল না সে। হাত-পা হিম হয়ে এল তার। হারাধনের ক্রুদ্ধ মুখ ফিরতে লাগল তার পাশে-পাশে। কী বলবেন মৌসুমি হারাধনকে? সবকিছুই সঠিক বলবেন কি? বলবেন কি, তিনি বড় নির্মম বিদ্ধ করছিলেন মৌসুমিকে 

দারুণ কান্না পেল তার। মেঝেয় বসে পড়ে বিছানায় মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। অসহায় লাগল তার নিজেকে! কী করে সে কারওকে বোঝাবে, কতখানি বিরক্ত তাকে করেছিলেন মৌসুমি! কতখানি আঘাত অপমান করেছিলেন! 

একবার ভাবল সে, চলে যায়। চলে যায় মৌসুমির বাড়ি। পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আসে। পায়ে মাথা রেখে অনুরোধ করে, যাতে তিনি কিছু না বলেন হারাধনকে। এত কি নিষ্ঠুর হবেন তিনি! শুনবেন না! 

পরবর্তী মুহূর্তেই ঘেন্না হয় তার। ঘেন্না হয় নিজের ওপর। ঘেন্না হয় তার ও হারাধনের দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর। কে মৌসুমি? কে? কেন তাঁর পায়ের তলা থেকে সে দাঁতে কামড়ে তুলে আনবে তাদের দাম্পত্য! এতখানি হীন সে কেন করবে নিজেকে! নিজের ব্যক্তিগত, একান্ত আপন সম্পর্ককে! তার চেয়ে এই ভাল। এই সংঘর্ষ ভাল। ভাঙে যদি ভাঙুক তাদের সংসার। যা গড়েই উঠল না ভাল করে, তা তো ভাঙতেই পারে যে-কোনও দিন। 

আবার কান্না পায় তার। অশ্রুর দাগ পড়ে বিছানার চাদরে। তারই পাশাপাশি কোথাও রয়েছে তাদের মিলনের দাগ। দু’জনের যৌথরসের ছোপ ধরা চাদর ঢাকা আছে আলগা শয্যাবরণীতে। 

মায়ের কথা মনে হয় তার। ভয় করে ফের। উদ্বেগ হয়। এত অশান্তির কথা ঢেকে-চেপে রেখেছিল সে। মাকে কষ্ট পেতে দেয়নি। আর কি পারবে সে? সকলই প্রকাশিত হয়ে যাবে না কি এবার? সে বিবশে বলতে লাগল—মা মা মাগো! আমি তোমাকে শান্তি দিতে পারলাম না মা। আমার বেঁচে থেকে কী লাভ! কী লাভ! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *