৭
কার্তিক-আঘুন দুই মাস আইল
শীত দিল দেখা।
অভাগিনী নারী আমি
ক্যামনে একা থাকি রে।
ফাঁকি দিয়া বন্ধু আমার
কোথায় লুকাইল রে ॥
মরালীগ্রাম যেখানে শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে তেকোনা, সেখানে, তেকোনার সীমানায় এক আখড়া। আখড়ার উঠোনে বসে ছিল দুলুক্ষ্যাপা।
কবে তৈরি হয়েছিল এই আখড়া, বলা যাবে না। এই দু’ গাঁয়ের যাঁরা প্রাচীন মানুষ, তাঁরাই এ আখড়া দেখে আসছেন জন্মাবধি। এবং এই প্রাচীন মানুষের প্রাচীনতর বাপ-পিতামহরাও দেখেছেন এই আখড়া। কালে কালে মাটির চালার আখড়া হয়েছে টিনের চালা দেওয়া পাকা বাড়ি, এই মাত্র পরিবর্তন। তবে তার মাটির মেঝে এখনও মাটির আছে। দেওয়ালে ইটের বাঁধুনি পড়েছে কিন্তু মেঝেতে কোনও আবরণ নেই।
এই জেলা মুর্শিদাবাদে বাউল-বৈষ্ণবের আগমন নিশ্চিতই ঐতিহাসিক ঘটনা। বস্তুত, যে বৈষ্ণব, সে-ও হতে পারে বাউল, যে বৈষ্ণব নয়, শাক্ত, যে হিন্দুও নয়, মুসলমান- সে-ও হতে পারে বাউল। কারণ বাউল কোনও ধর্ম নয়, জীবনচর্যা মাত্র। যে-কোনও ধর্মের মানুষ নিজের ধর্ম বজায় রেখে বাউলচর্যায় রত হতে পারে। সুতরাং মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য বা হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য বাউলে বিরল নয়। বরং স্বাভাবিক। অনেক মুসলমান বাউলচর্যাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। অনেক হিন্দুও করে না। তাদের কাছে বাউলচর্যা যারা করে, তারা পরিত্যজ্য। মুর্শিদাবাদে বাউলের আখড়া কম নেই এবং বাউলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিরোধও এখানে ঘটেছে প্রচুর।
মুর্শিদাবাদের নাম যখন ছিল শুধু মখসুদাবাদ, সে-ইতিহাস সৃষ্টিরও আগে থেকে এখানে এসেছিলেন বাউল ও বৈষ্ণবেরা। মুর্শিদকুলি খাঁ আসার পর এ অঞ্চল হয়ে উঠল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার কেন্দ্রভূমি। কেন্দ্র হয়ে ওঠার আগেই বৈষ্ণব এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত। আর সাধারণ জনজীবন আঁকড়ে বাউলের উৎপত্তি ঘটেছে সকল জাত-পাতের প্রতিবাদ হিসেবে, সকল ধর্ম-বিধর্মের বিরুদ্ধাচার হিসেবে, সাধারণ লোকাচারের প্রতি এক মানবিক টানের কারণে। বৈদিক ঐতিহ্যের সমসময় থেকে নেমে এসেছে এই ধারা। আর বঙ্গে বাউল রয়েছে চর্যাপদের সমকাল থেকে। সুতরাং দুলুক্ষ্যাপার এই আখড়া কোন আদিকাল থেকে রয়েছে বাগড়ির এই তেকোনা গ্রামে— সে-কথা কে বলবে! দুলুক্ষ্যাপা স্বয়ং এ নিয়ে ভাবিত নয়। গাঁয়ের কোনও মানুষই ভাবিত নয়, এইসব ইতিহাস বিষয়ে।
এ-আখড়ায় দুলুক্ষ্যাপার সঙ্গী আরও দু’জন। তারা থাকে সঙ্গিনী সহবাসে। দুলুক্ষ্যাপার সঙ্গিনী নেই। শুনতে আজব লাগে বটে। কিন্তু নেই। সঙ্গিনী বিনা বাউলের সাধনা কি ভ্রষ্ট নয়? সে-কথা দুলু বাউলকে কেউ জিগ্যেস করেনি। জানার প্রয়োজন আছে কারই বা! গ্রামের মানুষ সবই সংসারী, গৃহস্থ। বাউলের সঙ্গে তাদের যোগ সামান্যই। কিছু-বা গান শোনায়, কিছু ভিক্ষাদানে। অতএব, গ্রামের কোনও পুরুষ বয়সকালেও আইবুড়ো থেকে গেলে যে ঔৎসুক্য মানুষের, সঙ্গিনীবিনা বাউল সম্পর্কে তার কণামাত্র নেই। আর আশেপাশের সকল মানুষকেই দুলুক্ষ্যাপা তার মধুর ব্যবহার আর সংগীত দ্বারা তুষ্ট রেখেছে। তার অস্তিত্ব সকলের কাছে এমনই সংগীতমণ্ডিতভাবে স্বাভাবিক। এখানকার পাঁচগাঁয়ে তাকে চেনে না এমন লোক কম। বিশেষত হরিহরপাড়া, নওদা ও ডোমকল থানা অঞ্চলে সে সদা ভ্রাম্যমাণ। এ ছাড়া মাঝে মাঝে সে চলে যায় শহরের বহরমপুরে এবং সেখান হতে রেলে চেপে পাড়ি দেয় দূরান্তরে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য বিনা। রেলের হকাররা বুঝি-বা তার চেনা। নিয়মিত ভ্রমণ করে এমন কিছু যাত্রীও চেনা। আর চেনাচিনি ওই তিন গ্রাম ভরা।
বস্তুত এই তিন থানাঞ্চলের সীমানাতেই রয়েছে তেকোনা গ্রাম। যেহেতু তিনটি থানাকে সে সংযুক্ত করে সেহেতু তার নাম হয়ে উঠেছে তেকোনা এমনই মনে করা যায়। তবে এই আখড়ার যেমন কোনও প্রমাণযোগ্য ইতিহাস লিখিত নেই, তেমনি তেকোনা গ্রামেরও নেই কোনও অক্ষরসমৃদ্ধ ইতিহাস। যদিও এ গ্রাম প্রাচীন এবং এই প্রাচীনতা এক মৌখিক উদ্ধার। আর তারই সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে আছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস।
অধুনা বহরমপুরের নিকটেই ছিল কর্ণসুবর্ণ নগরী। শুধু ওই এক প্রাচীন নগরীই নয়, হয়তো একদা মুর্শিদাবাদ কজঙ্গল নামে এক নগরীর অন্তর্ভুক্ত ছিল যেখানে স্বয়ং বুদ্ধদেব এসেছিলেন। এবং লক্ষ্যণীয়, হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে আজও আছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। আছে তাঁদের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ।
বুদ্ধদেব পৃথিবীতে এসেছিলেন আনুমানিক পাঁচশত তেষট্টি খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সেই সময় বা তৎপূর্ব থেকে সপ্তম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কজঙ্গল নগরীর অস্তিত্ব ছিল। তবে গোটা মুর্শিদাবাদ কজঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা বলা যাবে না। ফরাক্কার নিকটবর্তী ছিল এই নগরী। এবং এরই পাশাপাশি ছিল পৌণ্ড্রকক্ষ জনপদ। ইতিহাস আরও খানিকটা পেরিয়ে মৌর্য, গুপ্ত ও পালযুগের সাক্ষ্য নিয়ে এরই কাছাকাছি তৈরি হয়েছিল প্রাচীকোট নগর। ইতিহাসে লেখা আছে এইসব নগরীর নাম। কারণ রাজা ও ভূস্বামীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইতিহাস। আর সাধারণ গ্রাম, সাধারণ জনজীবন ধূলিকণারই মতো বিছিয়ে থাকে ইতিহাস জুড়ে।
যথায় নদী, তথায় নগর। হতে পারে এমনই মনোভাব নিয়ে এইসব নগরী গড়ে উঠেছিল। কারণ জল ছাড়া চলে না মানুষের। আর প্রাচীন বাণিজ্যব্যবস্থায় প্রধান পরিবহনই ছিল জলপথে।
তবে শুধু কজঙ্গল নয়। যে-কাল জুড়ে বৌদ্ধধর্মের আধিপত্য ছিল, সে-কালে পৌণ্ড্রকক্ষ ও কর্ণসুবর্ণেও যে বৌদ্ধধর্মের সুপ্রচার ঘটেছিল, তার প্রমাণ রেখেছে ইতিহাস। পাল আমল পর্যন্ত। অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীতেও এই অঞ্চলে অক্ষুণ্ণ ছিল বৌদ্ধধর্ম। এই আমলে মুর্শিদাবাদের মহীপালে শতাব্দীব্যাপী পালরাজাদের রাজধানীর মর্যাদা ছিল।
কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের নিদর্শন রয়েছে অনেক। তবে এরই মধ্যে বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে বড় নিদর্শন রয়েছে পাঁচথুপি গ্রামে। পঞ্চস্তূপ থেকে পাঁচথুপি। পাঁচথুপির পাশেই আছে বারকোনার দেউল। এটি একটি বিশাল বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ। এই স্তূপটিও পাল আমলের। পাঁচথুপির দক্ষিণে একটি গ্রামের নাম সিংহারিগড্ডা। তাতে আছে একটি প্রাচীন বুদ্ধের মূর্তি।
কিন্তু এ সবই হল রাঢ় অঞ্চলের কথা। তেকোনা গ্রামের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। তেকোনার ইতিহাস পেতে গেলে বাগড়ি পৌঁছতে হবে। তবে রাঢ়ের ইতিহাস বিনাও বাগড়ির গতি নেই কারণ রাঢ়ের তুলনায় বাগড়ি এক নবীন ভূমি। এই ভূমিতে নেই কে? কোন অঞ্চলের মানুষ? এপারের বঙ্গভূমির সন্তানেরা আছে যেমন, সেরকমই ওপারের সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর, ফরিদপুর। তাই এখানে প্রবচনে পাওয়া যেতে পারে সিলেটি শব্দ লোকপূজায় বরিশাইল্যা দেবী। মুর্শিদাবাদের বরের পাতে পড়ে কুমিল্যার মাইয়ার রান্না শুঁটকি মাছ।
এ তো গেল অধুনার প্যাচাল। কিন্তু তৎপূর্বে? সাতশত আটশত বৎসর পূর্বে? বাগড়িতেও
সাতশত-আটশত ঘটেছিল বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার— তার প্রমাণ প্রত্যক্ষভাবে কোনও ধ্বংসস্তূপে নেই, আছে আকারে-ইঙ্গিতে। এ অঞ্চলে দারুময় বাণেশ্বরের পুজো হয়ে আসছে বহুযুগ হতে। এই বাণেশ্বর যতখানি শিব, তার চেয়ে অনেক বেশি করে বুদ্ধ হয়ে ওঠেন সহজেই।
তবে কিনা, বাগড়ি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পৃথক। প্রাচীন বৌদ্ধধর্মকে সে আর নিজ অঙ্গে বহন করে না। এখন এখানে মুসলমানের আধিক্য। হিন্দুর সংখ্যা কম নয়। এবং হিন্দুর মধ্যে বৈষ্ণব ও বহু। সব মিলেমিশে যা আছে তাতে উঁচু-নিচু জাতপাতের ভেদাভেদ কম। সে বরং আছে রাঢ়ে। একসময় রাঢ় ও বাগড়ি একই কেন্দ্রের শাসনাধীন ছিল, তবু এদের চরিত্রে মিল হয়নি। রাঢ়ে হিন্দুর আধিক্য। মুসলমানের অনেকেই আপন বংশমর্যাদা সম্পর্কে অতি সতর্ক। রাঢ়ে জাত-পাত উচ্চবৰ্ণ-নীচবর্ণের দ্বন্দ্ব সমধিক। মাত্র একটি নদী ভাগীরথী যেন তার দুই পারকে দুটি সৎবোনের মতো ভিন্ন রীতিতে গড়েছে।
তেকোনা গ্রাম যেহেতু বাগড়িতে সেহেতু তেকোনার আছে সকলকে আপন করে নেবার স্বভাব। ভৈরব নদের পাড়ে তার গড়ে ওঠা ও মমতাময় জীবনে তার সাক্ষ্য। আর তেকোনার বৈবাহিক চতুষ্কোনা— তার চরিত্র এমনই। শুধু তফাতের মধ্যে তফাত, এ গ্রাম ভাগীরথীর তীরে। এইসব গ্রামসহ বাগড়ি অঞ্চল একটি পৃথক মণ্ডল হয়ে গড়ে উঠেছিল সেন আমলে। তখন এ অঞ্চলের নাম ছিল ব্যাঘ্রতটি। জলজঙ্গলপূর্ণ কিন্তু উর্বর ভূমি। এই ব্যাঘ্রতটিই কথন-নৈপুণ্যে হয়ে ওঠে বাগড়ি। আর নবাবি আমলে বাগড়ি চলে আসে মুর্শিদা পরগণায়।
সেনরাজ্যের প্রভাব ছিল মুর্শিদাবাদে। লোকে বলে উদ্ধব সেন নামে সেনবংশের এক জ্ঞাতি রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তেকোনা গ্রামের পত্তন করেন। সেই উদ্ধব সেনের সঙ্গে এসেছিলেন পুরোহিত লোকেশ্বর চট্টোপাধ্যায়। উদ্ধব সেনের গৃহদেবতার পূজার জন্য আনা হয়েছিল তাঁকে। সেই থেকে আজও তেকোনা গ্রামে সেন ও চাটুজ্যেদের পাশাপাশি বাস। তবে আজ কে প্রভু কে প্রজা বোঝার উপায় নেই। সেনদের অবস্থা পড়েছে বহু যুগ আগে। রাজসম্মান হারিয়ে আজ তাঁরা সাধারণ চাষিমাত্র। হাল-বলদ ধরতে হয় নিজের হাতে। প্রাচীন সমৃদ্ধি ও আভিজাত্যের সামান্য রেশ আজও কেবল লেগে আছে তাঁদের দেহসৌষ্ঠবে। দীর্ঘদেহী, সবল সেন বংশীয়রা রোদে পুড়ে জলে ভিজে তামাটে হলেও তাঁদের দৈহিক সৌন্দর্য নজর কাড়ে। যদিও তাঁদের পরিবারে অতি সাধারণ নারীরাই এখন বধূ হয়ে আসেন, ফলে অচিরেই নিকটবর্তী ভবিষ্য প্রজন্মে শরীর হতে এই আভিজাত্য খসে পড়তে পারে।
সেনদের তুলনায় চাটুজ্যেরা আজ অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা ও সমৃদ্ধিতে তাঁদেরই দেখায় অনেক বেশি আধুনিক, আভিজাত্যপূর্ণ এবং প্রভুত্বপরায়ণ। এ গ্রামে তাঁদেরই বাড়ির দুর্গাপূজা গ্রামের এক বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। ঐতিহাসিক কারণেও চাটুজ্যেরা আর সেনদের সমীহ করেন না। সেনরাও তাঁদের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির প্রাগিতিহাস আঁকড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন না। হয়তো তাঁদের এমন হতে সাহায্য করেছে, সেনবংশের সুবৃহৎ অট্টালিকাসমূহের ধ্বংসপ্রাপ্তি। কারণ হৃতগৌরব বংশগুলি অদ্যাবধি তাদের আভিজাত্য ধরে রাখে প্রাচীন ইট ও চওড়া স্তম্ভের মধ্যে। অট্টালিকার বিশালতার মধ্যে। সে-অট্টালিকার হাড়ে-পাঁজরে বট-অশ্বত্থের শিকড় চাড়িয়ে গেলেও আভিজাত্যের অহংকার অন্ধকার ঘুলঘুলিতে, ফাটলে, খিলানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে বছরের পর বছর। অট্টালিকাবাসী বর্তমানের মানুষকে করে দেয় অতীতের জীব। ‘আমরা ছিলাম’ এই বোধ বয়ে বেড়াতে গিয়ে তারা হয়ে যায় ন্যুব্জ এবং অর্থহীন। তাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ঘুণপোকায় আক্রান্ত হয়।
উদ্ধব সেনের বংশ তাদের প্রাসাদোপম গৃহ সমেত সমস্ত গৌরব কবেই ভাসিয়ে দিয়েছিল ভৈরবের জলে। তবু আজও সেন বংশের সমৃদ্ধির গল্প লোকমুখে ফেরে। বস্তুত, এ গ্রামের মানুষের কাছে এই গল্প এক প্রিয় বিষয়। এই গল্প এখন কেবল সেনবংশেরই নয়, তাঁদের মন্দিরের চূড়ায় যে সোনার কলসখানি বসানো ছিল, তার গল্প আজ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সারা তেকোনা গ্রামের সম্পদ।
তবে এ গ্রামে হিন্দু মাত্র দু’ঘর। ওই সেন আর চাটুজ্যেরাই। বাকি সব মুসলমান। এই মুসলমান পরিবারগুলির মধ্যে কোনও কোনও ঘর সংগোপনে বাউলচর্চা করে থাকে। সংগোপনে কারণ খাঁটি মুসলমান বাউলচর্যা সমর্থন করে না। লোক জানাজানি হলে বাউলচর্চাকারী সংসারী সামাজিক লোকের কপালে আছে বিস্তর দুঃখ। কিন্তু দুলু বাউলের সে-সমস্যা নেই। গান গেয়ে বেড়ানো দুলুক্ষ্যাপা ও অন্যান্যরা ঘোষিত বাউল। তাদের বসত আলাদা। সমাজ অন্য। এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তারা তেমন সামাজিক নয়।
.
সমাজকে দেখা যেতে পারে দু’ভাবে। একটু দূর থেকে দেখলে সমাজের এক সামগ্রিকতা থাকে। তার মধ্যে নানা ধর্ম-বর্ণ-জাতি মিলেমিশে যায়। কিন্তু এই বৃহৎ সমাজ তৈরি হয় অসংখ্য খণ্ডে-বিখণ্ডে। এই খণ্ডগুলিতে পরস্পরের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। বহু বৈপরীত্য সমেত খণ্ডগুলিকে আলাদা করে দেখাই নিকটতর দৃষ্টি বা দ্বিতীয় দর্শন। সেখানে এক সমাজের অন্তর্গত হয়ে পাশাপাশি বাস করে নানা পৃথক সমাজ। সেখানে হতে পারে এমনকী একটিমাত্র ঘরই একটি সমাজ।
তেকোনা গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে গেছে ভূগোল কেন-না ওই তিন থানা- হরিহরপাড়া, নওদা, ডোমকলের সংলগ্ন, তাই তেকোনা এমত বোঝা যায়। কিন্তু তেকোনার বৈবাহিক চতুষ্কোনার নাম এমত হওয়ার কোনও ইতিহাস তার ভৌগোলিক অবস্থানে নিৰ্দেশিত নেই। এমনকী সে তেকোনার বৈবাহিক হল কোন সূত্রে— তাও জানা যায় না। হয়তো নামের এই মিল তাদের সম্পর্কযুক্ত করেছে। নইলে আকারে-প্রকারে এদের অমিল বিস্তর।
বহরমপুর থানায় গ্রাম চতুষ্কোনা। ভাগীরথীর বুকে পেতনির চর যেখানে পড়েছে তারই সমান্তরালে ভাগীরথীর শরীর-সংলগ্ন। বড় সুফলা এ গ্রাম। আর একে ঘিরে আছে বিষ্টুপুর বিল, বোয়ালিয়া, চালতিয়া এবং চাঁদের বিল। গ্রাম ছাড়িয়ে পূর্বে, উত্তরে ও দক্ষিণে এগোলেই এই বিলগুলির দেখা পাওয়া যাবে। আর এই গ্রাম থেকে খানিক দক্ষিণ-পূর্বে এগোলে রামানা ও অঙ্গারমারি বিলের পাশ ঘেঁষে সোজা গেলেই ভৈরব নদ। এই ভৈরব পদ্মা হতে উৎপন্ন হয়ে রানিনগরে দু’ভাগ হয়ে নাম নিয়েছে ছোট ভৈরব ও বড় ভৈরব। অনেক পথ নিজের মতো প্রবাহিত হয়ে অবশেষে জলঙ্গীতে মিলেছে প্রায় একসঙ্গেই। এই ছোট ভৈরবের পাড়েই তেকোনা। অর্থাৎ তেকোনার সঙ্গে চতুষ্কোনার যে দূরত্ব, তা আসলে ভৈরবের সঙ্গে শ্রীময়ী ভাগীরথীর দূরত্ব। আর সে-দূরত্ব এমন কিছু নয়। ভাগীরথীর পাড় থেকে সোজা দক্ষিণ-পূর্বে ভৈরবের দিকে রওয়ানা দিলে গাঁয়ের উঁচুনিচু পথ পেরিয়ে, মোটরে চেপে, মোটামুটি তিরিশ মিনিটে সেখানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।
এ-আর এমন কী পথ! ভাগীরথী যদি মনে করে, সে তার স্বামী ভৈরবের সঙ্গে মিলিত হবে, তবে তাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। পূর্বে ভৈরব ছিল ভাগীরথীর অববাহিকার নিকটতর—তার সাক্ষ্য দেয় বিলগুলি। এরা ভাগীরথীরই পরিত্যক্ত অববাহিকা। লোকে বলে নদী তার পুরনো পথ ভোলে না কখনও। এক অববাহিকা ছেড়ে সে চলে যায় দূরতর খাতে এবং আবার ফিরে আসে একদিন। পুরনো খাতে নিজেকে বইয়ে দেয়। কারণ, হয়তো সত্তর বছর পর কিংবা একশো দুশো বছর পর, তার মনে পড়ে যায় পুরনো পথের কথা। সে আবেগ-প্রদীপ্ত হয়। ছুটে যেতে থাকে পুরনো খাতের কাছে। যেন পুরনো প্রেমিকের জন্য মন উথালি-পাথালি তার। সে ছুটে যায় আর ভাঙে। আবেগপ্রদীপ্ত হয় আর বিনাশ করে। নাশ করে। তার মনে থাকে না মধ্যবর্তী জনপদের কথা। ফসলের কথা। তারই প্রদত্ত উর্বর জীবনযাত্রার মহিমার কথা। মনে থাকে না তার, আবেগ তাকে উন্মাদ করেছে, উন্মাদনা করেছে আগ্রাসী।
বহরমপুর, হরিহরপাড়া, বেলডাঙা, নওদার মানুষ এসব জানে। জেনেশুনেও নদীর পাড় বরাবর, কিংবা পুরনো অববাহিকার রেখা ধরে বংশপরম্পরায় গড়ে তোলা বসবাস আগলে রাখতে চায়। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে, গঞ্জ জুড়ে, শহর-নগর জুড়ে এক দীর্ঘ— দীর্ঘকালের বেপরোয়া বসবাস।
মৃত্যু অনিবার্য। ধ্বংসও। কিন্তু ধ্বংস ও মৃত্যুর তেমন শক্তি নেই যে জীবনের বিকাশ রুদ্ধ করে।
.
দুলুক্ষ্যাপা এসব নিয়ে ভাবিত নয়। সে কেবল তার নিরুপদ্রব বাউলজীবন যাপন করে। গান গায়। ভিক্ষা করে। ঘুরে বেড়ায়। তার রূপ ও কণ্ঠ দ্বারা সে জয় করেছে বহু নারীর মন। রমণীমোহন সে। তার সম্পর্কে গুজব—সে এক উচ্চবংশীয় হিন্দু, উচ্চশিক্ষিতও। এমনকী সে ছিল এক অর্থবান পুরুষ। কোনও অজ্ঞাত কারণ তাকে ঘরছাড়া করেছিল। কোনও অমোঘ নিয়তি তাকে বাউলজীবন যাপন করায়। এবং এই কথাগুলি সে স্বমুখে ঘোষণা করেনি। কিন্তু একেকজনকে ঘিরে গল্প তৈরি হয় এ-জগতে। আর মধ্যচল্লিশেও সে এক আশ্চর্য আলোচ্য যুবা, যাকে নিয়ে কেবল রমণীর হৃদয়ে গুঞ্জরণ।
উঠোনের প্রান্তে বসে সে দোতারায় শব্দ তুলছিল। দুলুক্ষ্যাপা ঘরে থাকার চেয়ে অধিক পছন্দ করে খোলা আকাশের তল। আকাশকে সে কল্পনা করে নারী, বাতাসকেও সে কল্পনা করে নারী। এই ভূ-পৃষ্ঠ-— সে-ও তার চোখে নারী। সে সারাক্ষণ থাকে নারীতে সমর্পিত প্রাণ এক কল্পনার জগতে। আর গায়। তার ভাবন-ক্রিয়া এক অসীম বিস্তারে বিছিয়ে থাকে সারাক্ষণ। সৃষ্টিরহস্যের সন্ধান করতে করতে তার রাত্রি ভোর হয়। লোকচরিত্র অনুধাবন করতে করতে তার সন্ধ্যা নামে। আর এ সমস্তেই বিশ্বজগতের আর কারও কল্যাণবিধান হয় না, কেবল হয় নিজের তুষ্টি। ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গে এখানে তার রয়ে যায় পার্থক্য। কারণ বৈষ্ণবী সে, কারও কষ্ট দেখলে, দুঃখ দেখলে, আপন মরমে কাতরায়। বলে—আহা গো! কী কষ্ট বলো!
দুলুক্ষ্যাপা উদাসী হতে চায়। ভাবে, এই দুঃখ-কষ্ট নিয়েই তো জীবন! এর বাইরে আর কে কবে যেতে পেরেছে। দুঃখ থেকে চোখ তুলে নির্মোহ হতে পারাই তার শিক্ষা। তার সিদ্ধির পথসন্ধান। আর ময়না বৈষ্ণবী সে, সে নিজেও এক নারী, তবু, দুলুবাউলেরই মতো এ ধরিত্রীকে সে নারীরূপে দেখে। আপাত এই মিলের মধ্যে অমিল সম্ভাবনা বিস্তর। সে ধরিত্রীকে নারী দেখে শুধু এ কারণে নয় যে, ধরিত্রী জীবের জন্মপ্রদায়িণী। সে, প্রকৃতপক্ষে দেখতে পায়, এ ধরণীর বুকে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বেদনা। প্রস্তরীভূত বেদনা সব, পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া বেদনা সব রাখা। এমন থাকতে পারে, এমন হতে পারে কেবল নারীর। সকল নারীর বুকে, তোরঙ্গে তুলে রাখা ভাঁজ করা কাপড়ের মতো দুঃখ সে জানে।
দুলুক্ষ্যাপা তাই ময়না বৈষ্ণবীকে বুঝতে চেয়েও বোঝে না। ধরতে চেয়েও দেখে অধরাই সে বরাবর। হৃদয়ে এই নারীকে আসীন দেখতে পায় সে, তবু মেলে না তারা।
এ-জগতে কিছু মানুষ থাকে যারা কৃতী হয়ে উঠতে পছন্দ করে না, যেন এক অবলোকনই তাদের কাজ, এই জীবনকে কোনওক্রমে ধারণ করাই তাদের লক্ষ্য। তারা আপিস যায় না, ব্যবসা করে না, ফসল ফলায় না, বিভিন্ন কলায় পারঙ্গম হয়ে খুলে বসে না শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। তারা শুধু থাকে। শুধু বাঁচে। বাঁচার রকমটাকে নিজের মতো করে নেয়।
দুলুক্ষ্যাপা এই দলের। তার বাঁচার রকমে আছে নারী। আর গান। আর বাউলপনা। সে ভালবাসে লালনের গান। বাউলের গান তার সাধন-সংগীত। লালনের হাজার গানের মধ্যে দুলুক্ষ্যাপা জানে কেবল গোটা পঞ্চাশ। সে আফসোস করে। লালনের কালে জন্মালে, আরও দশহাজার শিষ্যের মতো সে-ও শুনতে পেত লালনের মুখনিঃসৃত বাণী। সে হল না যখন, তাঁকে বোঝার উপায় মাত্র তার গান। গানই তাঁর বাণী। যা বলার, গানের মধ্যেই তিনি বলে গেছেন। তবু মুখের বাণী শোনায় আনন্দ অমেয়।
দুলুক্ষ্যাপা জানে যে লালন দীর্ঘজীবী সংসারী ছিলেন। তাঁর সঙ্গিনী ছিল। জমি-জমা বস্তু ও সম্পদ ছিল। কিন্তু সংসার ও সম্পদ তাকে টানে না। নিজের জন্য যা তার প্রয়োজন—তা কেবল ওই সঙ্গিনী। সঙ্গিনী বিনা সহজিয়া সাধকের চলে না যখন—সে নিজেকে বোঝায় নিরন্তর আসবে সে, আসবে কোনও দিন। আরও যারা বসবাস করে তার সঙ্গে, তার গুরুভাই—মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন তাকে করে বসে যে সঙ্গিনীবিহনে সে কীভাবে তার সাধনা ঘটায়। সে তখন বড়ই রহস্য করে বলে—তাঁকে খুঁজে মরছি কতকাল! এমন নারী পেলাম কোথায়, যাঁকে মন দিতে পারি!’
বিশ্বাস হয় না। কারও বিশ্বাস হয় না। এমন রূপবান সুকণ্ঠ বাউলের নারী জোটে না? সে ভুল ভাঙায়—’জুটবে না কেন? কিন্তু মনের মতো নারী হওয়া চাই যে।
আহা! ময়না বৈষ্ণবীর প্রতি তার মুগ্ধতা নয়নে উছলিয়ে ওঠে যে, তা টের পেয়ে যায় ঘনিষ্ঠজন। তারা চায়, ব্যক্ত হোক, ব্যক্ত হোক। কিন্তু হয় না, থেকে যায় অব্যক্ত।
দুলুক্ষ্যাপা যেমন সুদর্শন, তেমনই তার প্রিয় লালনও ছিলেন সুদর্শন। সুদীর্ঘ, উন্নত ললাট, উজ্জ্বল চক্ষু, গৌরাঙ্গ। সারা মুখে বসন্তের দাগ। তাঁর মাথায় ছিল বাবরি চুল, গালে লম্বা দাড়ি। এবং লালনের এক চোখে দৃষ্টি ছিল না। কিন্তু অন্য চোখের দৃষ্টি ছিল গভীর ও অন্তর্ভেদী।
দুলুক্ষ্যাপা লালনকে কল্পনা করার চেষ্টা করে। তখন নিজের কাছে নিজের ছবিই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। যেন লালন স্বয়ং পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছেন তারই অবয়বে। এমত ভাবনার মধ্যে গোপন আছে আত্মমোহ, যা তাকে লজ্জায় ফেলে নিজেরই মনে। সে তখন গান ধরে লজ্জার হাত থেকে রেহাই পেতে। এই গানে লালনের গান ছাড়াও মিশে আছে অন্য গান। কিছু কীর্তন। কিছু ভাটিয়ালি। এবং রবিঠাকুরের গান। রবিবাউলের গান বলতেও তার আপত্তি থাকে না। দুলুবাউল রবিবাউলের গান গায় বিশেষ বিশেষ সময়। ভেবে-চিত্তে ধরে না। মনের ফেরে সে-গান আপনি ফুটে ওঠে। আর এইসব গানের সম্পদে কিছু তার নিজেরই রচনা। এইসব রচনায় পৃথক কোনও মাহাত্ম্য নেই। সেগুলি লালনের গানেরই ছায়া মাত্ৰ।
এই সকালে সে ধরেছিল-
শুদ্ধ প্রেমের প্রেমী
মানুষ যেজন হয়
মুখে কথা ক’ক বা না ক’ক
নয়ন দেখলে চেনা যায়।
—যায় নাকি গো? চেনা যায়?
কথাগুলি বলতে বলতে ঘর থেকে জাহিরা বেরিয়ে এল। তার হাতে চা-ভৰ্তি অ্যালুমিনিয়ামের মগ। পরনে আধময়লা সুতির শাড়ি। চুলগুলি টেনে বড় খোঁপা করেছে। ন্যাতানো জীর্ণ শাড়ির আড়াল থেকে ফুটে উঠছে ধকধকে শরীর। হাতের চায়ের মগ সে নামিয়ে রাখল দুলুক্ষ্যাপার পায়ের কাছে। দুলু বাউল রাগত মুখে বলল— গানের সময় বাধা দাও কেন! জাহিরা চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। বলল— প্রাণের নাগর! গানের সময় তো সারাদিনই। এখন না হয় দুটি কথা কইলেই আমার সঙ্গে।
দুলু বাউল তার দোতারা বাজিয়ে চলল। বাজাতে বাজাতেই বলল—গণিমিঞার শরীর কেমন!
জাহিরা ঠোঁট ওল্টাল—শরীর আর কেমন! জ্বর ছাড়েনি। সারা রাত ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমোল। তা তুমি কি শুধু গনিমিঞার শরীরের খোঁজই করবে? আর কারও নয়?
—আর কারও খোঁজে আমার দরকার কী! কারও তো কোনও আধি-ব্যাধি নেই।
জাহিরা দেহ মুচড়োয়। আর ঠোঁটে স্ফুরণ ঘটিয়ে বলে—কী কথা বল রসিক! ব্যাধি কি কেবল ও-ই? আর কোনও ব্যাধি নাই? আমার যে কোন গুপ্তরোগে শরীর জ্বলে-পুড়ে যায়, তার খবর রাখো?
দুলুক্ষ্যাপা হাসে। বলে—এই সকালে জ্বালাপোড়ার খবর দাও কেন! মনে আনন্দ রাখো। সাঁইয়ের নাম করো। জাহিরাবানু, তোমার দেহের জ্বালাপোড়ার খবর আমাকে দিয়ে কী হবে! আমি না কোবরেজ, না হেকিম।
দুলুক্ষ্যাপা চায়ে চুমুক দিতে থাকল। জাহিরা তার দিকে গনগনে চোখে তাকিয়ে বলল—তুমি হেকিম কোবরেজ হতে পারতে! কিন্তু হয়ে গেলে আরও গূঢ় ব্যাধিগ্রস্ত।
দ্রুত পা ফেলে সে চলে গেল ভিতরের দিকে। দুলুক্ষ্যাপা নির্বিকার দেখল এই গমন। এ আখড়ায় জাহিরা আছে বছর পাঁচেক হল। গণিমিঞার সঙ্গিনী সে। ভগ্নস্বাস্থ্য গণিমিঞা বিছানায় পড়ে আছে দীর্ঘকাল ধরে। ভিক্ষাজীবী এইসব বাউলের সম্বল শুধু শিকড়-বাকড় আর চাঁদসির চিকিৎসা। যদিও এ আখড়ার আছে কিছু জমিজমা। সে সামান্যই। কিন্তু জসিম বাউল ছাড়া ওই জমি চাষের আগ্রহ কারও নেই।
শিকড়-বাকড়ের চিকিৎসা তো সর্বজনেই করে। কিন্তু বাউলের জন্য এ ছাড়া আছে বাউলের গোপন ঔষধ। চার চন্দ্র গ্রহণ। মল, মূত্র, রজঃ ও শুক্র। এইগুলি নিয়মিত গ্রহণ করলে রোগ নিরাময় হয়, শরীর সুস্থ থাকে। মূত্রপান দীক্ষাপ্রাপ্ত বাউলের অবশ্য-কর্তব্য। নারী ও পুরুষ দিন ও রাত্রির প্রথম মূত্র বাদ দিয়ে ধরে রাখবে অন্তত দু’বারের মূত্র। পান করবে। স্বমূত্র পানও যেমন প্রচলিত, তেমনি সাধনসঙ্গী ও সঙ্গিনী পরস্পরের মূত্র মিশ্রিত করে পান করবে, এমনও হতে পারে। এ ছাড়া আছে মাটি। মল অর্থে মাটি। মাটির কাজ সকলে করতে পারে না। তার জন্য চাই কঠোর সাধনা। কিন্তু রজঃ ও শুক্রগ্রহণ সাধনপ্রণালীতে অবশ্য গ্রহণীয়। পুরুষ স্ত্রী-শরীর থেকে মুখ দ্বারা রজঃ শোষণ করে তার কিছুটা স্ত্রী-মুখে দেবে, বাকিটা নিজে গ্রহণ করবে। আপন শুক্র বাউল পান করে স্বমুখেই। স্ত্রীও শোষণ করে পুরুষের শুক্র। কখনও শুক্র ও রজঃ মিশ্রিতভাবে যোনি থেকে শোষণ করে নেয় পুরুষ এবং মিশ্রণভাগ স্ত্রীর মুখে দিয়ে নিজে পান করে। এর মাধ্যমে শরীর থাকে নীরোগ। শুক্র হয় ঘন।
বাউলের মতে পিতামাতার অনাচার ভাবী সন্তানের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করে। পৈতৃক রোগ বংশধারায় বাহিত হয়। তা ছাড়া দেহের মূলবস্তু যারা বেশি ক্ষয় করে তারা রোগাক্রান্ত হয়। মূলবস্তু অর্থে পুরুষের শুক্র। স্ত্রীর রতি।
এ তো গেল জ্ঞানের কথা। তত্ত্বের ও তথ্যের কথা। কিন্তু এ কার্য বড় জটিল গো। বড় কঠিন এ সাধন। মুখে কইতে টুক। কিন্তু কাজে করতে যাও— সর্বস্ব ধরে দিতে হবে। ওষুধ-বিষুধ করাই কি সহজ? দুইদিনের বৈরাগী ভাত কইতে অন্ন কয়, কিন্তু বাউলের ওষুধ করা ওস্তাদের কর্ম।
শুদ্ধ আহার করে, অর্থাৎ মাংস পেঁয়াজ রসুন ইত্যাদি বর্জন করে শরীর যে মাটি দেয় তাকে শুকিয়ে বটিকা তৈরি করে বাউল। এই বটিকা ঔষধের কাজ করে। গুরু আপন মাটি দ্বারা প্রস্তুত বটিকা শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে বিতরণ করেন। এ ছাড়াও তিনদিনের রজঃ, নরনারীর মূল বস্তু, স্তনদুগ্ধ, রস অর্থাৎ মুত্র ও মাটি মিশ্রিত করে এলাচ, লবঙ্গ, মধু ও তেজপাতা দিয়ে তৈরি হয় অতি গুরুত্বপূর্ণ রসায়ন। এবং সবার চেয়ে বড় ঔষধ, মহৌষধ লাল চতুর্মুখ। তিনদিনের রজঃ করোয়ায় রেখে, চতুর্থ দিনের দেহমিলনান্তে, রজঃ ও শুক্রবীজের মিশ্রণ এবং রস ও মাটি একত্রে মন্থন করে রজঃকালেই তা পান করতে হয়। এই লাল চতুর্মুখ সর্বরোগহর। একে মুখবন্ধ পাত্রে নিয়ে মাটির তলায় পুঁতে দিতে হবে এমন জায়গায় যেখানে জল পড়ে না। নারী ও পুরুষ সারা বছর যে জলহীন স্থানে প্রস্রাব করে, চল্লিশ দিন পর, তথাকার মাটি ওই পাত্রের বস্তুতে মিশিয়ে তৈরি হয় সর্বরোগহর বটিকা। কিন্তু তার জোরে কখনও নিরাময় আসে, কখনও আসে না। গণিমিঞা নিরাময় লাভ করেনি। ধরে নেওয়া সহজ— পবিত্র স্থানের মৃত্তিকা তেমন পবিত্র ছিল
না। শুধু জড়বস্তুর উপাদান হলেই তো চলে না। এই বটিকার অন্যতম উপাদান প্রস্তাবিত শুদ্ধতা। এর তারতম্যে বটিকার শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।
জাহিরা গভীর মানবিক ধর্মবোধে গণিমিঞার সেবা করে চলেছে রাতদিন। দুলুক্ষ্যাপা জাহিরার অবস্থা বোঝে। আপাদমস্তক সুস্থ এবং সুস্বাস্থ্যবতী নারী সে। সারাক্ষণ রোগীসঙ্গ তাকে তৃপ্ত করে না। তা ছাড়া, আখড়ায় এসে পড়ার প্রথম থেকেই জাহিরা দুলু বাউলের কাছে ঘেঁষতে চেয়েছে। দুলু বাউল তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার। এখন দীর্ঘকাল শরীর অভুক্ত থাকায় এ-নারী উন্মাদিনী হয়েছে। এক-একবার দুলুক্ষ্যাপার মনে হয়, জাহিরা যা চায় তা দেওয়া কঠিন নয়। কিন্তু ফিরে ভাবলেই মন গুটিয়ে আসে। কিছুতেই জাহিরার শরীরে সে মনস্থাপন করতে পারে না। জাহিরার সঙ্গে মিলিত হতে গেলে জাহিরাকে গণিমিঞার অনুমোদন সংগ্রহ করতে হবে। বাউলসমাজে এমনই নিয়ম। কিন্তু দুলুক্ষ্যাপা মনে মনে এই নিয়মকে সমর্থন করে না। নারী স্বেচ্ছায়, স্বাধীনচিত্তে মিলিত হবে, নইলে সুখ কী! সে ইশারা করা মাত্র জাহিরা তার কোলে লুটিয়ে পড়তে পারে গণিমিঞার অনুমতি ছাড়াই—কিন্তু আখড়ার ভিতরেই সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে চায় না। প্রতিষ্ঠান, তা যত ছোট, যত গুরুত্বহীন হোক, তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে নিয়মের অনুবর্তিতা প্রয়োজন, এমনই সে বিশ্বাস করে। তা ছাড়া তার ও জাহিরার মধ্যবর্তী বাঁধ একবার টুটে গেলে তুচ্ছ খড়কুটোর মতোই তারা ভেসে যাবে। সেই ভাসান গণিমিঞার প্রত্যাশিত বা আকাঙ্ক্ষিত নয়। সে জানতে পারলে অসুখী হবে। দুখী হবে। দুলুবাউল তার প্রীতিভাজনকে দুখী করতে চায় না। সে এমন নারীর সঙ্গে জড়াতে চায় না যাকে মনে ধরে না। অতএব সে যাবতীয় নিয়মকে আশ্রয় করতে চায়। না হলে, নর ও নারী পরস্পর মিলিত হবে স্থির করে ফেললে, কোনও নিয়মই আর গ্রাহ্য করে না—এ বিধি চিরকালের।
আজ, এই সকালে পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ। দুলুক্ষ্যাপা আকাশের নির্মলতায় খুঁজে বেড়ায় প্রাণের সঙ্গিনী, প্রাণপ্রিয়া। নীলের সাগরে ভেসে থাকা সাদা মেঘের ভারা—তারা বুঝি দুলুক্ষ্যাপার নয়ন হতে আকাশি নারীর নাভি আড়াল করে, দুলুক্ষ্যাপা বিভোর হতে চায়। সকাল হতে সেবন করেনি একবারও। নিজের ঘন চুলে আঙুল চালিয়ে নিতে নিতে ময়না বৈষ্ণবীকে তার মনে পড়ে। বৈষ্ণবী গঞ্জিকা সেবন পছন্দ করে না। সে বলে—এ নেশায় সর্বনাশ!
দুলুক্ষ্যাপা হাসে এ জবান শুনলে। তখন, সর্বকে নাশ করার পন্থা তার কাছে শতগুণে উপভোগ্য হয়।
জাহিরা নিজের চায়ের পাত্র হাতে নিয়ে আবার এসে দাঁড়ায় উঠোনে। দুলুক্ষ্যাপা দোতারায় শব্দ করে যায়। পুনরায় গান ধরার আগে সে জাহিরার নারীদেহকে জরিপ করে। কী সুন্দর
এই বস্তু। এই দেহ। আকাশ, বাতাস, ভূমি-সমস্তই এই দেহের মহিমায় তৈরি। এদের মধ্যে কোথাও আছে দুলুক্ষ্যাপার প্রিয় এক নারী। সে কে?
তার চোখে আবার ময়না বৈষ্ণবীর অবয়ব ধরা দিয়ে যায়। দুলুক্ষ্যাপা চোখ বন্ধ করে বৈষ্ণবীকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ময়না বৈষ্ণবী বড় নির্মমতায় ধরা দিয়েই অধরা হয়ে মিলিয়ে যায়। দুলুক্ষ্যাপার বুকের তলায় টুপটুপ করে কষ্ট ঝরে পড়ে। এই নারী দুলুক্ষ্যাপার সঙ্গিনী হতে পারত। কিন্তু তার কপালে নেই। ময়না বৈষ্ণবী বড় কঠিন বলয়ে নিজেকে ঘিরে রাখে। তা ছাড়া ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গে তার বিশ্বাসের তফাত। চর্যার তফাত। ধর্মে না মিললে আর সঙ্গিনী কী! সে আবার গান ধরে—
শুদ্ধ প্রেমের প্রেমী
মানুষ যেজন হয়
মুখে কথা ক’ক বা না ক’ক
নয়ন দেখলে চেনা যায়।
মণিহারা ফণি যেমন
প্রেমরসিকের দুটি নয়ন
কী দেখে কী করে সে জন
কে তাহার অন্ত পায়!
রূপে নয়ন ঝরে খাঁটি
ভুলে যায় সে নাম মন্ত্রটি
চিত্রগুপ্ত তার পাপ পুণ্য
কী রূপে লেখে খাতায়!
গুরুজি কয় বারে বারে
শোনরে লালন বলি তোরে
তুই মদনরসে বেড়াস ঘুরে
সে প্রেম মনে কই দাঁড়ায়
হাঁটুতে মুখ রেখে, উঠোনেই বসে পড়ে গান শুনছিল জাহিরা। মেঝেই তাদের আসন। সে এই নিয়ে কিছুমাত্র বিচলিত নয়। অপলক সে দেখছিল দুলুক্ষ্যাপাকে। দুলুক্ষ্যাপা বলল—শুনেছ তো সখী, মদনরসে ঘুরে বেড়ালে প্রেম মনে দাঁড়ায় না।
জাহিরা চোখ সরাল না। বলল— মদনরস ছাড়া আর আছে কী বলো তো ক্ষ্যাপা? যদ্দিন যৌবন আছে তদ্দিন। তারপর তো মরা মাছের মতো পচা ফোলা পেট নিয়ে ভেসে ভেসে বেড়াব।
দুলুক্ষ্যাপা জাহিরার থেকে চোখ ফেরাল নিজেই। যে-নারী সমর্পিতা হয়ে বসে আছে, তার আকর্ষণ কাটানো সহজ নয়। বহু শক্তি ক্ষয় হয় ওই কর্মে। সে দোতারায় আঙুল বোলায় আর দূরের দিকে চোখ রাখে। এই আখড়ার সামনে দিয়ে চলে গেছে কাঁচামাটির রাস্তা। পুবমুখে যেতে যেতে উত্তরে বাঁক নিয়েছে। তারপর চলেছে ভৈরবের পাড় বরাবর সোজা তেকোনা গ্রামে। এখান থেকেই গ্রামের শুরু। এপারে তেকোনা, ওপারে বহেরা। যদিও পাড়ের অনেকখানি চলে গেছে ভৈরবের গর্ভে। কিন্তু পয়োস্তি গড়ে উঠছে ধীরে। সে-সবই ওই বহেরার দিকে। এতকাল ভৈরব কেবল ভাঙছিল। এখন গ্রাস করছে তেকোনা গ্রাম। বরং বহেরাকে সে রেখেছে অটুট। তেকোনাকে ভাঙতে ভাঙতে নদী সরে আসছে পশ্চিমে। আর পুবে উঠছে পয়োস্তি। অল্পে অল্পে। গেল শরতে কিছু কাশ ওই পয়োস্তিতে ফুটেছিল। তার মানে চর আবাদযোগ্য হবে শীঘ্রই। বিলিবণ্টন হবে।
বহেরাকে সতর্ক চোখে নিরিখ করলে একে গ্রাম বলতে মন চায় না। এর গড়ন চরের মতো। এর একপাশ দিয়ে চলে গেছে ছোট ভৈরব, অন্যপাশে লাউডাঙা গ্রাম পেরোলেই বড় ভৈরব। অর্থাৎ পুবে-পশ্চিমে ভৈরবের দুই শাখা নিয়ে শান্ত হয়ে আছে বহেরা।
.
আখড়া ছাড়ালে দাফালিদের বাস। আর দাফালিদের পাড়া ঘেঁষে আছে বেদেরা। নিজস্ব জমিজমা কিছু নেই এদের। সামান্য খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট মেটে ঘরে বাস। অবশ্য তেকোনা গ্রামে কোঠাবাড়ি বিশেষ নেই। সামান্য সংগতিসম্পন্ন ভূস্বামী যারা, নিজের জমিতেই মাটি কেটে ছাঁচে ফেলে তৈরি করে নেয় ইট আর সেগুলি স্তূপাকৃতি করে বাইরে গোবরমাটির প্রলেপ দেয়। স্তূপের নীচেয় রাখা উনুনের মতো গর্তে দেয় আগুন। পুড়িয়ে পুড়িয়ে তৈরি করে নেয় শক্ত ইট আর গোবর মাটি ও চুন মেখে ইটের পরে ইট সাজিয়ে তুলে নেয় ঘর। এইসব ঘর তোলার জন্য প্রয়োজন হয় না কোনও স্থপতি, কোনও বাস্তুকার। মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি যে-পর্যন্ত নিয়ে যাবার পর অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে, তার ঠিক আগের প্রান্তে পৌঁছে এইসব কর্ম সমাধা করা যায়।
তবে একেবারে নিজের জমি না থাকলে এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োগ সম্ভব হয় না। আর নিজের জমি তেকোনা গ্রামের সকল পরিবারের নেই। থাকার মধ্যে এক-দেড় কাঠার মধ্যে এক-একটি কাঁচাবাড়ি। ফাঁক-ফোকরে আম-কাঁঠালের গাছ। চালে ঝুলে থাকে পুঁই বা কুমড়োর লতা। সম্বৎসর এই সমস্ত বৃক্ষ-লতাদি খাদ্যের প্রভূত যোগান দিয়ে থাকে। ভূস্বামী যারা, তারা ভূমিহীনদের দিয়ে চাষ করিয়ে নেয় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। কখনও শুধুই বিনিময়। পরিশ্রমের পরিবর্তে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে দু’ বস্তা ধানের চুক্তি। তবে ভূস্বামী অধিকাংশই হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। নিজেরাও তারা হাল ধরে, রোদে পোড়ে, শ্রম দেয়। ব্যতিক্রম দু’-একজন, চাটুজ্যেদের মতো ধনী ভূস্বামী তারা, জমিজমা ছাড়াও তাদের আছে অন্য কারবার, অন্য ব্যবসা। সরাসরি মাঠে কাজ করার সময় নেই তাদের। তারা সুবিধেমতো ব্যবস্থা করে। জন খাটায় কিংবা আধাআধি ব্যবস্থায় যায়। কে কোন ব্যবস্থা নেবে সেটা নির্ভর করে তার প্রতিপত্তির ওপর। কারণ ভূমিসংস্কার আইন দ্বারা এখন জমির মালিক ও বর্গাদারদের প্রাপ্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকী দৈনিক মজুরির ন্যূনতম সীমাও নির্দিষ্ট। কিন্তু সর্বত্র আইন মেলে চললে রায়তদের চলে কী করে! যতক্ষণ সাধারণ কৃষকের সঙ্গে ভূস্বামীর আয়ের পার্থক্য ততক্ষণ প্রতিপত্তিও বৃদ্ধি করা সম্ভব। সবাই সমানে-সমানে চললে, না কেউ ছোট, না কেউ বড়। মানুষের পক্ষে এ হেন অবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রভুত্বকামিতা তাকে সদাই কিছু সুলুকসন্ধানী করে তোলে। ফলে শুভার্থে যে আইন, তাকে লঙ্ঘন করা প্রায় অপরিহার্য হয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য উদ্ভূত। সরকারও তাই, সরকারবিরোধীও তাই। তা হলে ভূমিসংস্কার আইন না মানলে গণতন্ত্রের চরিত্র অনুযায়ী তার প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ। হয়-ও। মাঝে-মধ্যে গণমাধ্যমগুলি তুলকালাম করে। কিন্তু তেমনভাবে হয় না যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তার কারণ ভূত আছে সর্ষের মধ্যে। আবার ভূতের মধ্যেও সর্ষেদানার ছয়লাপ।
জেলা মুর্শিদাবাদে আজও বর্গাদারের তালিকা দীর্ঘ। ভূমিহীনের তালিকা দীর্ঘতর। অপারেশন বর্গার মধ্যে দিয়ে বাম সরকার ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমি বন্টন করেছে। কিন্তু ভূমিহীনের সংখ্যা লোপ পায়নি। অনেকেই সামান্য জমি পাবার পরেও ঋণের দায়ে সে-জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যেহেতু অধিকাংশ ভারতীয় কৃষকের জীবন আজও প্রকৃতিনির্ভর, যেহেতু কৃষির যন্ত্রপাতি আজও আদিম এবং ভর্তুকি দেওয়া সার ও বিনামূল্যের বীজ পাওয়া সত্ত্বেও, কৃষিকর থেকে ছাড়া পাওয়া সত্ত্বেও, উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ ও গুণমান সম্পূর্ণ অনিশ্চিত প্রকৃতিরই সঙ্গে সঙ্গে, সেহেতু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের অনিশ্চয়তা কমেনি কিছুমাত্র—কাগজে-কলমে অপারেশন বর্গার সাফল্য ঘটে থাকলেও। ভূমিহীনের মধ্যে জমিবণ্টন করে পঞ্চায়েতের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া পর্যন্ত এক চমৎকার ব্যবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার গত এক দশকের অধিক সময়ের মধ্যে খ্যাতি ও আস্থা অর্জন করেছে। বস্তুত, ভূমিহীন কৃষক সরকারি তৎপরতায় ভূম্যধিকারী হল এবং পঞ্চায়েত মাধ্যমে কৃষকরাই জনকল্যাণের বিধিব্যবস্থা করতে পারল, এর চেয়ে চমকপ্রদ এবং গণতান্ত্রিক আর কী হতে পারে!
কিন্তু মুশকিল আসানের পরবর্তী যে-মুশকিল, তার কথা লেখা হয়নি সরকারি কাগজে। ভূম্যধিকারী হওয়ার পর পুনর্বার ভূমিহীন হলে কী হবে—তার বিধান বলা নেই। আন্দাজ করা যায় এবং আশা করতেও বাধা নেই যে ভূমিহীনের তালিকায় পুনরুল্লিখিত সেই কৃষক আবার পেয়ে যাবে কোনও ভূস্বামীর উদ্বৃত্ত জমির থেকে বণ্টিত কিছু পরিমাণ এবং একই কারণে সে হয়ে উঠতে পারে আবার ভূমিহীন। অর্থাৎ অপারেশন বর্গা সত্ত্বেও এ-এক বিষচক্র যা থেকে ক্ষুদ্র কৃষকের মুক্তি নেই। বস্তুত, জমিই হোক আর সম্পত্তি, সে থাকলেই হয় না, সেগুলি রাখতে পারার সঙ্গতি থাকা চাই। মূল্যবান অধিকারের জন্যও মূল্য দিতে হয় কম না।
শুধু রাজনৈতিক সমস্যাই বা কেন? ভৌগোলিক সমস্যা আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চক্র আছে। সব উদ্বৃত্ত জমি অধিগ্রহণ এবং বণ্টন হয়ে যাবার পরেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমি অকুলান হবে। তখন কৃষক জমি না পেলে শ্রমিক হতে চাইবে। বণিক হতে চাইবে বা কারিগর। তখন কারখানা বাড়াতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের বাজার বাড়াতে হবে। পণ্যের ভোক্তা এবং ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ওই পরিস্থিতি এক গেছে রাজ্যময়।
দুলুক্ষ্যাপা ভূম্যধিকারীদের ফসলভরতি মাঠের দিকে তাকায়। হৈমন্তী সকালে এই দুনিয়া বড় মায়াময়। এমন ভুবনে ঈশ্বরের কাছে আয়ুবৃদ্ধি কামনা করে মন। এবং মন ধায় ওই কাঁচামাটির পথে, যে-পথ আলতো শিশিরে ভেজা আর পথের দু’পাশে চৈতালি ফসলের ডাঁটো শরীর হালকা হাওয়ায় দোলে। লোকে সাইকেলে চেপে কাঁচা পথ দিয়ে মরালীর হাটে যায়। কিংবা যায় আরও দূর হরিহরপাড়ায়। কখনও ধুলো উড়িয়ে যায় গোরুর গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি। দুলুক্ষ্যাপা সকলই নয়নভরে দেখে আর আস্বাদন করে বেঁচে থাকা। হঠাৎই, দূরের দিকে চোখ রাখা সে চঞ্চল হয়ে উঠল তখন। তার দৃষ্টিপথে ময়না বৈষ্ণবী হেঁটে আসছে। ছোট ছোট পায়ে। উদাসী ও আনমনে।
দোতারায় শব্দ করে উঠে দাঁড়াল দুলুক্ষ্যাপা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জাহিরাও দেখতে পেল ময়না বৈষ্ণবীকে। এই নারীকে দেখা মাত্র দুলুক্ষ্যাপা চঞ্চল হয়ে ওঠে যে, তা জাহিরার দৃষ্টি এড়ায় না। এবং এই ভাল-লাগার বিষয়ে সে ঈর্ষা বোধ করে না এতটুকু। ময়না বৈষ্ণবীকে দুলুক্ষ্যাপার ভাল লাগবে, এ যেন কোন যুগ থেকে নির্দিষ্ট হয়ে আছে। যদি তারা জুটি বাঁধত, জাহিরা খুশি হত। কারণ ময়না বৈষ্ণবীকে তারও লাগে প্রিয় একজন
দুলুক্ষ্যাপা উঠোন ছেড়ে পথের দিকে এগোল। জাহিরাও গেল সঙ্গে সঙ্গে। বলল—অ দিদি। এই সকালে যাও কোথায়?
ময়না বৈষ্ণবী তার খঞ্জনিতে শব্দ তুলে বলল—জয় রাধে।
—জয় গুরু। একযোগে উচ্চারণ করল দুলুক্ষ্যাপা ও জাহিরা। এবং জাহিরা একই প্রশ্ন করল আবার—যাও কোথায়?
—এই যেদিকে মন টানে। ভাবলাম অনেকদিন আসিনি, একটু খবর করে যাই।
—তা এসো না একবারটি ভিতরে। চা খেয়ে যাও।
দুলুক্ষ্যাপা নির্বাক দেখছিল ময়না বৈষ্ণবীকে। ময়না বৈষ্ণবী মধুর হাস্য স্থাপন করে প্রশ্ন রাখল ওই অবলোকনে কী ক্ষ্যাপা? যাব ভিতরে?
জাহিরা বলল—আমি বললে আসা হয় না?
—হয়! তবে ক্ষ্যাপা বললে আরও বেশি করে আসা হয়। ঠিক কি না?
দুলুক্ষ্যাপা হাতজোড় করল—আখড়া ধন্য হবে গো বোষ্টুমি। এসো এসো।
—গান শোনাতে হবে কিন্তু। কতদিন শুনিনি তোমার গান, ক্ষ্যাপা?
জাহিরা বলল—গান তো গাইছিল এতক্ষণ। হয়তো তুমি আসবে বলেই। তুমি আসবে, গান শুনতে চাইবে, আর রসিক শোনাবে না, তা কি হয়?
—সে গান আমি শুনেছি। যেখানেই থাকি না কেন, ক্ষ্যাপা গাইলেই আমি শুনতে পাই। তবে কিনা শ্রীমুখ দেখতে দেখতে গান শোনা, তার স্বাদ আলাদা।
হৈমন্তী সকাল এই কথার রসে ভিজে কিছু হাস্য উপহার দেয় তিনজনকেই। জাহিরা একটি আসন এনে পেতে দেয় ময়না বৈষ্ণবীর জন্য। শত শত মলিন কাপড় জুড়ে তৈরি করা বিচিত্র বর্ণময় সে-আসন। ময়না বৈষ্ণবী সহাস্যে তাতে উপবেশন করে। দীনের কুটিরে অতিথি হয়েছে দীন-দরিদ্রের অঙ্গনে দরিদ্র। কিন্তু এই দীনতা ও দারিদ্র্যই তাদের অলংকার। এমন দীন বেঁচে থাকার মধ্যেই তারা ধরে রেখেছে প্রেমের হৃদয়। কারণ দারিদ্র্যের মালিন্য তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেনি। সম্পদের লোভ নেই, এমনই এইসব মানুষ।
ময়না বৈষ্ণবীর আগমনের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এল জসিম বাউল ও পারুলবালা। আখড়ার উঠোন জমে উঠল। এবং বিরল নয় এ দৃশ্য। এই বাউলেরা গান ভালবাসে। সকলেই ওস্তাদ গাইয়ে নয়। সকলেরই সুরেলা সুকণ্ঠ নয়। কিন্তু ওই ভালবাসাটি সম্বল। গান তাদের জীবনধারণে সম্পৃক্ত। গানের ভিতর দিয়েই তাদের ভুবনখানি দেখা।
এতজনের মধ্যে দুলুক্ষ্যাপা স্বয়ং দিনমণির মতো উজ্জ্বল। যেন এই দারিদ্র্যের বাতাবরণে সে ধরেছে বাউলের ছদ্মবেশ। ময়না বৈষ্ণবী এই রূপ দেখল কিন্তু তার দৃষ্টি ঠিকরে পড়ল না। পড়েনি কোনও দিন। সে-ও এক সুরের পিপাসু, দুলু বাউলের দিকে তাকিয়ে বলল—ধরো বাউল। শুনি।
—ধরি। তবে বোষ্টুমি, শোনাব এক কীর্তনগান। তোমাকেই শোনাব বলে কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি।
—বলো কী রসিক? তুমি কীর্তনও জানো?
—বাউলের গলায় কীর্তন আর কে শুনবে বলো? আমি কিন্তু জানি হরেক গান। বাউল, কীর্তন, তরজা, বোলান, আলকাপ, শব্দগান ভাদু, টুসু, ভাটিয়ালি।
—হুঁ। তুমি দেখছি সবেতেই ওস্তাদ।
হাসি ছাড়িয়ে পড়ল উঠোনময়। পুবদিকে পিঠ করে বসেছে দুলু বাউল। সূর্যের আলো তেরছাভাবে পড়েছে তার মুখে। ঘন কালো দাড়ির মধ্যে একটি-দুটি রুপোলি রেখা চিকচিক করছে। সে দোতারা পাশে সরিয়ে রাখল। ময়নার দিকে সরাসরি চেয়ে মৃদু হেসে ধরল—
মাইয়া কৃষ্ণভজনের মূল
মাইয়ার প্রেমপাথারে সাঁতার দিয়ে
অনায়াসে মিলবে কূল।
মাইয়া যার পানে চায় আড়নয়নে
তার কি রাখে জাতিকুল
তুমি সহজ মাইয়ার সঙ্গে করো
শ্রীরাধারমণের কুল
গান শুনে জাহিরা ও পারুলবালার মুখে হাসি ঘনিয়ে ওঠে। চোখের তারায় তারায় ঝলমল করে রহস্যের দ্যুতি। শুধু ময়না বৈষ্ণবীর মুখ যেমন ছিল তেমন। হাসিমাখা, কিন্তু আহ্বানহীন। সে বলল—ক্ষ্যাপা! বড় সুন্দর গাইলে। তবে তোমার এ গানের সুর কীর্তনের হলেও আখর কিন্তু বাউলের।
দুলুক্ষ্যাপা হাসল। বলল—ধরেছ ঠিক। এ গান কীর্তনে-বাউলে মেশা। শ্রীহট্টের সহজিয়া বৈষ্ণব কবি রাধামোহনের রচনা। বহুযুগ আগেকার গান।
.
বস্তুত গোটা মোগলযুগ জুড়ে উনিশ শতক পর্যন্ত যত কীর্তন পদাবলী রচিত হয়েছে, তেমন আর কখনও হয়নি। এইসময় ছিল গুরুবাদী সম্প্রদায়ের অনুকুল। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সকলেই এই বৈষ্ণব গুরুকুল সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মহাপ্রভু গোপীদাসের অভ্যুত্থানও ওই সময়। ভগবানগোলা অঞ্চলের হাড়িপোড়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল কৈবর্ত পরিবারে। শৈশব হতেই তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল ভগবৎ-লক্ষণ। পশুপাখির ভাষা বুঝতেন তিনি। হাতে খাবার নিয়ে আঙিনায় এসে দাঁড়াতেন আর হাজার পাখি উড়ে এসে তাঁর কোলে বসত। কৃষ্ণমেঘ দেখলে তিনি কেঁদে উঠতেন হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলে। কালো মাটি দেখলে বলতেন—ও যে কৃষ্ণ শুয়ে আছে।
নাওয়া-খাওয়ার ঠিক ছিল না। কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। নদীর পাড়ে কাদামাটির তাল করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করতেন। একদিন ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেলেন— দীক্ষা নে। দীক্ষা না নিলে চিত্ত শুদ্ধ হয় না। মন শান্ত হয় না। শান্তিপুরে আছেন জগন্নাথ গোস্বামী। তিনি তোকে দীক্ষা দেবেন।
অতদুর যাবেন, পয়সা কোথায়? ঈশ্বরের নাম নিয়ে পদব্রজে চললেন গোপীদাস। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। কেশ অবিন্যস্ত। মুখে দাড়ি। দেখলে মনে হয় চিত্তভ্রংশী উন্মাদ। সারারাত্রি পথ চলে ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। একটি বৃক্ষতলে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লেন কখন। ঘুম যখন ভাঙল, দেখলেন একটি পরিচ্ছন্ন কুটিরের দাওয়ায় তিনি শায়িত। চোখ চেয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কিছুই চিনতে পারলেন না। কীভাবে এলেন এখানে, কে তাঁকে পৌঁছে দিল, ভেবে দিশেহারা হলেন। সে এক ভীত, চকিত, অর্ধোন্মাদ অবস্থা তাঁর। আকুল কৃষ্ণপ্রেমের সঙ্গে মিশেছে স্বপ্নাদেশ পালনের জন্য দীক্ষা নেবার ব্যাকুলতা। কূলে কূলে মিলে যে ভাবোন্মত্ততা—তার দ্বারা যেন আপনাতে আপনি ভীত তিনি। পাছে তস্কর ভেবে কেউ হেনস্থা করে, এই ভয়ে দাওয়া থেকে নামতে যাবেন— দরজা খুলে গেল। এক সৌম্য শান্ত পরিচ্ছন্ন মানুষ দুয়ার আলো করে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে বিহ্বল দৃষ্টি। মুখে আনন্দের বিভা। তিনি স্নেহভরা মন্ত্র স্বরে বললেন—গোপীদাস!
গোপীদাসের সারা শরীর পুলকে কণ্টকিত হল। এ যেন স্বপ্নে শোনা কণ্ঠস্বর! অপূর্ব ভক্তিতে এবং অপার বিস্ময়ে তিনি আভূমি প্রণত হলেন। এ তিনি কোথায় এলেন! কীভাবে এলেন!
—এসো বাবা। বুকে এসো। আমি জানতাম তুমি আসবে। জানতাম দুয়ার খুলে দেখতে পাব তোমাকে।
তিনি গোপীদাসকে আলিঙ্গন করলেন। ইনি জগন্নাথ গোস্বামী। গোপীদাসকে দীক্ষা দিতে ঈশ্বরাদিষ্ট। তিনি বলেছিলেন—তুমি সামান্য নও। মহাপ্রভুর অংশ তুমি। ঈশ্বরভাগী। স্বয়ং গঙ্গাদেবী তোমাকে কোলে করে এখানে পৌঁছে দিয়েছেন।
দীক্ষা পেলেন গোপীদাস। গুরুর সঙ্গে থেকে শুদ্ধমার্গে সাধনচর্চা করলেন। একদিন গুরু বললেন—তুমি যোগ্য হয়েই জন্মগ্রহণ করেছ। যাও, দীক্ষা দাও মানুষকে। দিশাহীন মানুষকে দিনির্দেশ করো।
মহাপ্রভু গোপীদাস ফিরে চললেন গ্রামে। গঙ্গাবক্ষে নৌকা করে ফিরছেন। নৌকায় আপাদমস্তক আবৃত এক সধবা রমণী। একাকিনী যুবতী স্ত্রীলোক ভ্রমণ করছেন দেখে তাঁর বিস্ময় জাগল। মাঝিকে জিগ্যেস করলেন—ইনি কে মাঝি?
মাঝি বলল—ইনি মহাপ্রভু গোপীদাসের স্ত্রী। চলেছেন সেই হাড়িপোড়া গ্রামে।
গোপীদাস চমকে উঠলেন। বলে কী! তিনি বলতে যাচ্ছিলেন—আমিই হাড়িপোড়ার গোপীদাস। আমার তো কোনও স্ত্রী নাই।
কিন্তু বলা হল না। তার আগে এক দিব্যভাবে তিনি দেখলেন স্বয়ং ভগবতী তাঁর কামিনী। ভুবনে সাধন করার জন্য এসেছেন ভগবান ও ভগবতী। সাধারণ কৃষাণির মতো রূপ ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি ছিলেন বিভাময়ী। পঞ্চাশ বছর তাঁরা একসঙ্গে ইহলীলা করেছেন। মঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিয়েছেন ইহধর্ম পালন ও সংযমের দীক্ষা।
.
দুলু বাউল নজর করল, ময়না বৈষ্ণবী যেন অন্যমনস্ক। সে বলল—তা বোষ্টুমি, এবার তোমার গান শুনি।
গানে ক্লান্তি নেই। গানেই ময়না বৈষ্ণবী পেয়ে থাকে যাবতীয় উপশম ও শাস্তি। সে এতটুকু ওজর-আপত্তি না করে সুর ধরে-
স্বেচ্ছাময় প্রভু ধরে মানুষের দেহ
কেবল ভকত হেতু অনুগ্রহ সেহ ॥
ভজত তাদৃশী ক্রীড়া মানুষ যেমন।
যা শুনিয়া সর্বলোক ভজিবে চরণ ॥
এই যে কহিল ক্রীড়া এই অনুগ্রহ।
ইহা ছাড়ি কেমনে তার মায়া হয় গ্রহ ॥
‘সাধু সাধু’ রব করে সকলে। ময়না বৈষ্ণবী উঠে দাঁড়ায় এবার। বলে—চলি গো। ঘুরে আসি।
জাহিরা বলে—এত তাড়া কী গো বোষ্টুমিদিদি? আর একটু বসো। চা খাও।
—আর একদিন খাব। আজ মনটা ভাল নেই যে বড়।
—কেন গো? ভাল নেই কেন? সর্বত্যাগী মানুষ তুমি। তোমার আবার দুঃখ
—সর্বত্যাগী বললেই কি আর হওয়া যায়! আরও সব বাহুল্য এসে ঘিরে ধরে। দুঃখ মানুষের ছায়ার মতো। অন্ধকারে মিশিয়ে থাকে কেবল। আলো পেলেই ফুটে বেরোয়।
কথা বলতে বলতে সে আসনে বসে এবং কথা বলে যায়—আমার বলে কিছু নেই, এই ভাবনায় তুমি আপন সংসার ত্যাগ করতে পারো, কিন্তু জগৎ সংসার তোমাকে ছাড়বে কেন! আমৃত্যু তুমি তার সকল দুঃখ-শোকে জড়িয়ে থাকবে। তার নানান ভুল-ত্রুটি, মর্যাদা-অমর্যাদা তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে না?
দুলুক্ষ্যাপা বলল—কী হল গো বোষ্টুমি! মন যে বড্ড ভার দেখছি। বলো বলো। প্রাণ খোলসা করে বলো। বললে ভার কাটবে।
ময়না বৈষ্ণবী বসল গুছিয়ে। সে তো বলতেই চায়। বলবে বলেই বেরিয়েছে। তবে কিনা, বললেই তো হবে না। ক্ষেত্র বোঝা চাই। শুনতে যে আগ্রহী, তাকে সহজে বলা চলে। আগ্রহী যে নয়, কিন্তু শোনালে যে কাজে আসবে, তেমন-তেমন মানুষ হলে তাকে আগ্রহী করে তোলার কলা-কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। সে জানে, দুলুবাউল বড় আত্মঘেরা মানুষ। অথচ মানুষটা গভীরে ভাবে। গভীরে জানে। তার মন চাইল দুলুক্ষ্যাপাকে বৃত্তান্ত শুনিয়ে রাখতে। কে জানে কখন কার হিতৈষণা জাগে! সে জাহিরার দিকে ফিরে বলল—তা হলে একটু চা করেই আনো বোন। খেয়ে কথা কই।
জাহিরা আর পারুলবালা উঠে গেল চা করতে। আখড়ার পেছনের দিকে ছোট মেটে পাকঘর। কয়লার উনুনের ব্যবস্থা আছে। আবার কাঠকুটো জ্বেলে ঘুঁটে বা গুলের সাহায্যেও রান্না হয়। খাওয়ার কোনও তরিবত নেই এখানে। সামান্য ভাতে ভাত সেদ্ধ। কখনও সামান্য ডাল। তবে গুরু এলে, গুরুমা ও আরও সব গুরুভাই সমেত মিলন হলে এই ছোট্ট হেঁসেলে কিছু ভাল-মন্দ রান্না হয়।
পারুলবালা বা জাহিরা—কেউই সে-অর্থে গৃহকর্ত্রী নয়। এরা সাধনসঙ্গিনী। তবু সংসারে নারীর জন্য আলাদা করে দেওয়া যে-কাজ তা তারা করে। হয়তো যে-সংসারে ছিল সেখানে এ কাজগুলিই করত বলে তারা এমনই কর্মের পরায়ণ ও তন্নিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর বাউলপুরুষেরা একই সমাজধর্মে হেঁসেলে ঢোকে না সহজে। দুটো ফুটিয়ে খাওয়া—এ আর এমন কী ব্যাপার! তবে নারী মজুত থাকতে সে-কাজ তারা করে কী প্রকারে!
সকলের জন্যই চা নিয়ে এল জাহিরা ও পারুলবালা। তখন ভিতর থেকে গণিমিঞার গলা পাওয়া গেল—জাহিরা, ও জাহিরা। জাহিরা রে।
জাহিরা ভিতরে গেল। গণিমিঞা প্রস্রাব করতে চায়। সাধনসঙ্গিনী থেকে সেবিকা হয়ে ওঠা এই নারী, সারাদিন এমনই সব কাজ করে চলেছে। গণিমিঞার মল, মূত্র, গয়ের ধুয়ে ধুয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে সারাদিন। জাহিরার মন লাগে না এ কাজে। তবু সে অনুযোগ-অভিযোগ শাপ-শাপান্ত করে না। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। সে আর কী করে! কিন্তু সুস্থ মানুষের কথাও ভাবা দরকার। একটু বাইরে যাবার জন্য, শহরে-গ্রামে ঘুরে বেড়াবার জন্য তার প্রাণ হাঁকপাক করে। শরীর শরীরের কামড় খেতে চায়। সে তো গণিমিঞার বিয়ে করা বউ নয়। তবু কী এক আশ্চর্য নির্বন্ধ, কী এক কঠোর কর্তব্যবোধে সে গণিমিঞাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারে না। শুধু যদি তার একটি সুন্দর সমান্তরাল জীবন থাকত, যদি একজন পুরুষ পেত সে, সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারত। একজন পুরুষ, দুলুক্ষ্যাপার মতো একজন, যে দিনের শেষে অন্তত একবার জাহিরা বলে আদরের ডাক দিত, সন্ধান করত কবে সে ঋতুমতী হবে, আর ঋতু হলে বড় আহ্লাদে, বড় প্রাণে, তারা সঙ্গম করত। হয় না, গণিমিঞা বিছানায় পড়ে যাবার পর আর হয় না জাহিরার জীবনে। এই অসুস্থতার ভিতরেও কী এক কামনায় গণিমিঞা অবশ আঙুলে তার শরীরের তটভূমি হাঁটকে বেড়ায়। অশক্ত ঠান্ডা আঙুলের চালনায় তার গা গুলিয়ে ওঠে। অসুস্থ অনুভবে দাঁতে দাঁত চেপে সে গিলে ফেলে উগরে ওঠা ঘৃণা। পরম আকাঙ্খিত ভাতের থালায় চুল পড়লে যেমন লাগে, ঠিক তেমনি। সে টের পায়, বহুবিধ যাতনায় ভেঙে ভেঙে পড়ছে পাড়, খসে খসে পড়ছে। ভাঙা ভাঙা হয়ে স্বয়ং সে কেবল গণিমিঞার মল-মূত্র-কফ-থুতু পরিষ্কার করতে করতে সাঁইয়ের কাছে নানাবিধ প্রার্থনা জানায়।
জাহিরা ধূমায়িত চায়ের পাত্র রেখে একটি খালি টিনের কৌটো নিল। গণিমিঞার লুঙ্গি তুলে শুকনো ন্যাতানো পুরুষাঙ্গ দু’ আঙুলে ধরে প্রবেশ করিয়ে দিল কৌটোয়। গণিবাউল প্রস্রাবের চেষ্টা করছে, হচ্ছে না। তার তলপেট কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুর্গন্ধে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ। জাহিরার চোখে জল এসে যাচ্ছে। এই পুরুষাঙ্গ, এই জীর্ণ শরীরের যৌব প্রয়োগ তাকে কতবার বিমোহিত করেছে, ভয়ার্ত করেছে কতবার। আজ এই সবই অকাজের। অক্ষমতার। শুধুমাত্র মলমূত্র নির্গমন ও নিষ্কাশনের কর্মেই এগুলি ব্যবহৃত হয়। জাহিরার মনে হয়, মানুষ যতদিন সুস্থ সক্ষম, ততদিনই সে মানুষ। নইলে সে ক্লীব হয়ে যায়। সে ক্লীব গণিমিঞার ল্যাতলেতে পুরুষাঙ্গ ধরে নাড়ে। মগে জল নিয়ে সিঞ্চন করে শিশ্নের পুরোভাগে। প্রথমে দু-এক ফোঁটা, তারপর অল্প-অল্প মূত্র নিঃসৃত হতে থাকে। গণিমিঞা যন্ত্রণায় গোঙায়। তার যৌনকেশে লেগে থাকা চিটচিটে ময়লা হতে বেরিয়ে আসে দুর্গন্ধ। জাহিরার ঘ্রাণে আঘাত করে। নিত্যদিনের অভ্যাস সত্ত্বেও গা গুলিয়ে ওঠে তার। গণিমিঞা প্রায় আধকৌটো মূত্র ত্যাগ করে জল খেতে চায়। জাহিরা মূত্রের কৌটো মেঝেয় নামিয়ে রেখে আঁচলে হাত মোছে। গণিমিঞার পাশেই রাখা ছোট কুঁজো থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে গণিমিঞার গলায় ঢেলে দেয়। কিছু জল গণিমিঞার ঠোঁটের ফাঁক গলে গাল বেয়ে গলার খোঁজে নেমে আসে। জাহিরা কৌটো নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে আসে এবং দুয়ার পেরিয়ে ভৈরবের পাড়ে চলে যায়। এদিকে ভৈরবের পাড় উঁচু। সে ঢাল বরাবর সাবধানে নামে। এবং নদীতে মূত্র ফেলে দিয়ে কৌটো ধুয়ে ফিরে আসে।
ময়না বৈষ্ণবী জাহিরার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল। জাহিরা ফিরে এলে সে দেখল জাহিরার মুখ বড় শুকনো। কষ্ট পেল সে। আহা! বড় দুঃখী মেয়েটা। সে কারণ কিছু অনুমান করল এবং শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে নিজের হঠাৎ-মৃত্যুর প্রার্থনা রাখল। এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে যেন না থাকে সে। এমন নির্ভরশীল যেন না হতে হয়।
জাহিরা তাড়া দিল এবার। ময়না বৈষ্ণবীর কাছে বসে বলল—এবারে বলো দিদি। আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছ। কী করি বলো! মানুষটা একেবারে এলিয়ে পড়েছে।
ময়না বৈষ্ণবী জাহিরার কাঁধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিল। বলল— আরে আমাদের কার কপালে কী আছে কে বলতে পারে। দেহ থাকলেই ভোগান্তি। তা কী নিয়ে বুকে শেল লেগেছে বলি শোনো। যে-মঠে আছি সেখানে আর মন টেঁকে না। সব অপবিত্র মনে হয়। যা সব ঘটছে!
.
কমলি বৃত্তান্তের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করল ময়না বৈষ্ণবী। সেইসঙ্গে জানাতে ভুলল না, তার সন্দেহ হয় একরকম। ভয়ংকর সন্দেহ। শংকর নামের এই লোকটা মেয়েদের নিয়ে ঠিক কোথায় যায়! এত কোন মঠ আছে কলকাতায় যেখানে বছরে চারজন-পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে যায় সেবাধর্মের কারণে!
সকলে গালে হাত রেখে শুনছিল। দুলুক্ষ্যাপা বলল— তোমার সন্দেহ অমূলক নয় বোস্টুমি। সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে এ এক কাহন চলছে। গরিব মেয়েগুলিকে বিয়ে করে নিয়ে যায়, কাজ দেবার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তারপর বিক্রি করে দেয়। দুঃখের কথা, বলরাম বাবাজির মতো লোক এর মধ্যে আছে। দুঃখের কথা, ঘোষপাড়ার মতো পুরনো মঠ এই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মহাপ্রভু গোপীদাসের মঠে এমন অনাচার—ভাবা যায় না! আমার মনে হয়, কলকাতার বড় মঠে নিয়ে যাবে, এই বিশ্বাস অর্জন করতেই শংকর মেয়েদের ঘোষপাড়ায় এনে রাখে। ইতিমধ্যে সে খদ্দের ঠিক করে আসে।
ময়না বৈষ্ণবী ব্যাকুলভাবে বলে–এর কোনও প্রতিকার নেই? পুলিশকে জানালে হয় না? –হয়তো হারানো মেয়েদের পরিবারগুলি পুলিশকে কিছু জানায় না। আবার এমনও হতে পারে, গোটা ব্যাপারটাই পুলিশ জানে। কিন্তু টাকা খেয়ে চুপ করে থাকে।
ময়না বৈষ্ণবীর মুখের আলো নিভে যায়। একথা সে সহজে মেনে নিতে পারে না যে পুলিশ এই ঘৃণ্য কর্মের সহায়ক। মানুষ তা হলে বিপদে পড়লে কোথায় যাবে! কী করবে! তার পাগল-পাগল লাগে। সে চায় চিৎকার করে সব মানুষকে সাবধান করে দিতে, জানিয়ে দিতে সব। এই সংকল্প নিয়েই সে আজ বেরিয়েছে। সে একা। সামান্য মেয়েমানুষ। তার আর কতটুকু ক্ষমতা! সে শুধু বলতে পারে। ঘরে ঘরে জনে জনে বলতে পারে। আর প্রতীক্ষা করতে পারে— কোন শ্রীরূপ ধরে আবির্ভূত হবেন দেবতা। অসুর বিনাশ করে সুর স্থাপন করবেন।
দুলুক্ষ্যাপা ময়না বৈষ্ণবীর এই কষ্ট উপলব্ধি করে। সে জানে, ময়না বৈষ্ণবীর অভ্যন্তরে আছে এক গভীর অনুভূতিশীল মন। এই মনকে সে সর্বান্তঃকরণে কদর দেয়। সে বৈষ্ণবীর দিকে গভীর চোখে তাকায়। তার মাথা দেখে। কপাল, শরীর দেখে। পা দেখে। পায়ে দু’ রঙের ফিতে পরানো হাওয়াই চটিও তার দৃষ্টি এড়ায় না। ময়না বৈষ্ণবী সর্বার্থেই ত্যাগিনী। অনাড়ম্বর। দুলুক্ষ্যাপা বলে—বেশি ভেবো না বোষ্টুমি। আমাদের না আছে মান, না যশ, না ক্ষমতা। আমরা আর ভেবে কী করব!
সে তার দোতারা তুলে নেয়। বলে—আর একখানা গান গাই। মনটা বড় ভার হয়ে গেল গো।
সে ধরে-
আমি জন্মদুঃখী কপাল পোড়া
গুরু, আমি একজনা
আমার বদ্হাল তুমি দেখলে না।
শিশুকালে মইরা গেছে মা
গর্ভ থুইয়ে পিতা মলো
তারে দেখলাম না।
কে করবে সেই লালন-পালন
কে করবে সান্ত্বনা!
জন্মদুঃখী কপাল পোড়া আমি
গিয়েছিলাম ভবের বাজারে
ছয় চোরা চুরি করে
গুরু, বাঁধে আমারে।
তাই সিরাজ সাঁই খালাস পাইল
লালনের দিল জেলখানা।
জন্মদুঃখী কপাল পোড়া
গুরু, আমি একজনা।
গান শেষ হলে ময়না বৈষ্ণবী উঠে দাঁড়াল। বেলা বাড়ছে। এবার সে যাবে তেকোনা গ্রামের ভিতর। ঘুরবে সারাদিন। বিকেলে আবার এই পথে তার ফেরা।