৬৫
এই মাস গেল কন্যা
না পূরিল আশ।
লহরী যৌবন ধরি
নামিল শ্রাবণ মাস ॥
শ্রাবণ মাসেতে কন্যা
কিষাণে রোয় ওয়া।
হাড়ি কোণে ধরিছে মেঘ
গগনে বর্ষে দেওয়া ॥
বর্ষেক রে বর্ষেক রে দেওয়া
বর্ষেক পঞ্চধারে।
আমার ঘরে নাই সাধু
ফিরিয়া আসুক ঘরে ॥
.
প্রথমে মেঘারানির কুলো নামানো হবে। তারপর ভাঁজুই পুজো। ভাঁজুই পুজোর পালা চুকলে অন্ধকারে মেয়েদের নিজস্ব অনুষ্ঠান। মেঘারানি ইন্দ্রকে লোভ দেখিয়ে ভুঁয়ে নামাবে তখন। আর মেয়েরা ইন্দ্রকে লোভ দেখাতে পারে সহজেই, কেন-না ইন্দ্র চরিত্রহীন। কোনও যুগে কোনওকালে তাঁর চরিত্রের ঠিক ছিল না। এখনও নেই। যতদিন তিনি নারীদেহলোভী থাকবেন, ততদিন মেঘারানিরা তাঁকে প্রলুব্ধ করে আপন আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ করবে। এর মধ্যে দোষের কিছু থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এই প্রলোভন-প্রয়াস যদি দেব ও মানবীর মধ্যে বন্ধন রচনা করে, তাহলে দোষের কিছু থাকে না। অতএব সৎ শুদ্ধ নারীকুলের সঙ্গেও ইন্দ্রের সম্পর্ককে সমাজ স্বীকৃতি দেয়।
কাল গ্রামের এয়ো-স্ত্রীরা জড়ো হয়ে সতীর থানে শিব-পার্বতীর গড় পূজা করেছে। করেছে ইন্দ্রের পূজা। আজ সব ব্রতপালনের দিন। আগে ইন্দ্রপূজার পর আটদিন ধরে ভাঁজুই ব্রত হত। এখন লোকের সময় কমে গেছে। ব্রতবিধানও হয়ে এসেছে সংক্ষেপ। দরকারমতো কিছু কিছু পরিবর্তনও ঘটিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এমন অনাবৃষ্টির সম্ভাবনায় হিন্দু কুলবধূরা কেউ আর গৃহে বসে নেই। সকলেই সতীর থানে এসেছেন। আসেননি কেবল সুকুমার পোদ্দারের স্ত্রী সুমিত্রা এবং সহদেব দাসের স্ত্রী আশা। দু’জনেই ভেবেছেন, গেলে যদি তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! এই দুই মহিলার মধ্যে সুমধুর সম্পর্ক হতে পারত, পরিবর্তে চিরকালের আড়ি রটে গেছে।
সকল পূজার আগে প্রথমেই হয়েছে শিব ও পার্বতীর গড়পূজা। এ পূজায় আয়োজন অত্যল্প। কামনা আকাশ পরিমাণ। ফসলের কামনায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকে গ্রামবাংলার মন। আর ফসলের মধ্যে প্রধান ফসল ধান। ধানের ধন ছাড়া যে বাংলার প্রাণ বাঁচে না।
শিব আর পার্বতী হলেন ধানের দেবতা। তাই তাঁদের পূজা সর্বাগ্রে। তাঁদেরই মধ্যে থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ধান। এ নিয়ে যে-লোককাহিনী, কৃষিজীবী মানুষেরা তা বিশ্বাস করেন। এই বিশ্বাসের যুক্তিগ্রাহ্যতা প্রশ্নাতীত। বহু বিশ্বাস লোকজীবনের অঙ্গে অলংকারস্বরূপ হয়ে বেঁচে থাকে। তার কোনও বিচার হয় না। ধান সৃষ্টির আদি কাহিনী এমনই অলংকারস্বরূপ।
.
সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র উদাসী ভোলা মহেশ্বরকে নিয়ে গৌরীর সংসার। দারুণ দারিদ্র্যে দিন আর চলে না। দু’বেলা দু’ মুঠো আহার জোটে না এমন অবস্থা। শিবের কোনও দিকে নজর নেই। কেবল দুটি ভিক্ষা জুটিয়ে আনেন আর গাঁজা-ভাঙ খেয়ে মৌজ করেন। গৌরীর আর সইল না। তিনি একদিন শিবকে বললেন—এমন সঙের মতো পড়ে না থেকে কিছু কাজ করলেও তো পারো।
সদা প্রসন্ন শিব ঈষৎ হেসে বললেন—কাজ তো করছি। এই যে তোমার জন্য ভিক্ষে জুটিয়ে আনছি দু’বেলা, সে বুঝি কাজ নয়?
গৌরী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন—ছি ছি! ভিক্ষেকে বলো তুমি কাজ! মরণ হয় না কেন আমার! কী কুক্ষণে তোমার গলায় বৈঁচি ফলের মালা দিয়েছিলাম। তার চেয়ে যে আমার মরণ ভাল ছিল!
তাঁর চোখ দিয়ে দু’ ফোঁটা জল গড়াল। গণেশ-কার্তিক ধূলিতে গড়াগড়ি দিয়ে মারপিট খেলছে। লক্ষ্মী-সরস্বতী বুঝি পাড়া বেড়াতে গেছে। রোজকার মতো আজও ঘরে সম্পদ বাড়ন্ত। রাজনন্দিনী গৌরী আরও কাঁহাতক সহ্য করেন। মহেশ্বর বড্ড আলোভোলা।
গৌরীর দুঃখু শিব সইতে পারেন না। তাঁর চোখের জল মুছিয়ে শিব মধুর হেসে বললেন— রাগ করো কেন গৌরী। মরণের কথা মুখেও এনো না। তোমার জন্য হেন কাজ নেই যে আমি পারি না। বলো তুমি, কী করতে হবে বলো।
গৌরী শিবের আপাদমস্তক দেখে বললেন—গেঁজেলের কথায় বিশ্বাস কী! ওই এক ষাঁড়ে চেপে ভিক্ষে করছ, আর গাঁজা-ভাঙ খাচ্ছ। ঘরে হাঁড়ির হাল। আমার আর সহ্য হয় না।
শিব বললেন—প্রেয়সী। প্রসন্ন হও। কী করতে হবে বলো।
গৌরী বললেন—চাষবাস করো না কেন?
—চাষ? বেশ।
শিব বেরিয়ে পড়লেন। সোজা গেলেন ইন্দ্রের কাছে।
বললেন—আমাকে কিছু চাষজমি পাট্টা দেবে ভাই?
ইন্দ্ৰ বললেন—নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু চষবে কে?
—আমি।
ইন্দ্র বিস্মিত হলেন। তবে শিবের কথায় অবিশ্বাস করলেন না। পাগল দেবতা! কে জানে কী খেয়াল হয়েছে! তিনি বেশ অনেকখানি সুফলা জমি শিবের নামে লিখে দিলেন।
এবারে শিব গেলেন কুবেরের কাছে। বললেন— ভাই কুবের, ইন্দ্র আমাকে দিয়েছে চাষজমির পাট্টা। তুমি কি আমাকে কিছু বীজ দেবে?
কুবের বললেন—নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু চষবে কে?
—আমি।
কুবেরও বিস্মিত হলেন ইন্দ্রের মতো। তবে কিনা শিবের অসাধ্য কিছু নেই। হতে পারে তাঁরই মাধ্যমে কুবেরের বিষয়-আশয় দ্বিগুণ হয়ে উঠল! জগৎ পেল নতুন নতুন সব অমৃত ভোগ শস্য! তিনি বেছে বেছে সুস্বাস্থ্য শস্যবীজ দিলেন শিবকে।
ভীম ছিল শিবের ভৃত্য। শিব তাকে গিয়ে বললেন—বৎস ভীম। ইন্দ্র আমাকে দিয়েছে জমির পাট্টা। কুবের দিয়েছে বীজ।
ভীম বলল—ভগবন! কী করবেন আপনি এ দিয়ে?
—চাষ করব। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?
—নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু ভগবন! জানতে ইচ্ছে করে, কেন আপনি হঠাৎ আবাদ করতে চাইলেন!
শিব বললেন—পার্বতী আর ভিক্ষান্নে সুখী নন। তিনি চান আমি চাষাবাদে মন দিই। তা যাই। চাষাবাদ করি গে।
ভীমকে সঙ্গে নিয়ে শিব ধরায় নেমে এলেন। শুরু করে দিলেন চাষ-বাস!
পাগল ঠাকুর। যা নিয়ে মাতেন, তাতেই চিত্ত সমর্পণ করেন। ভীমের সহায়তায় কর্ষণ হল, বীজবপন হল, কচি চারাগাছের নয়নমোহন সবুজাভা দেখে নিজের আর দৃষ্টি ফেরে না। চাষের কাজে এমন মেতে উঠলেন শিব যে গৌরীর কথাই ভুলে গেলেন।
গৌরী আর কী করেন! দিন যায়, মাস যায়, শিব আর ফেরার নামটি করেন না। স্বামীবিরহে গৌরী কাতর। ভাবছেন, কেন তাঁকে চাষ করতে বললাম? সবার দ্বারা কি সব হয়? দিব্যি ঘুরতেন, ফিরতেন, গাঁজা খেয়ে গান গাইতেন, ত্রিভুবন মোহিত হয়ে থাকত সুরে। আমিও দিব্যি আঁচলের কাছে তাঁকে রাখতে পারতাম! ভিক্ষান্নে কী বা খারাপ ছিলাম! এই তো আমার গণেশ। ত্রিজগতে কেউ বলবে, বাছার আমার রোগা দেহ? ভিক্ষান্নেই এমন নধরকান্তি! আর বাছা কার্তিক— তার দিকে তাকালে তো চোখই ফেরানো যায় না! মেয়ে দুটিও কচি চালকুমড়ো ডগার মতো ফনফনিয়ে উঠছে। শুধু শুধু কেন বুড়োটাকে কাছছাড়া করলাম!
শেষে আর সহ্য করতে না পেরে মর্ত্যে উঙানি মশা পাঠালেন। বলে দিলেন—
উঙানি মশা, উঙানি মশা
ধরায় উড়ে যাও।
হুলের জ্বালায় জ্বলুক বুড়ো
ফুলিয়া উঠুক গাও ॥
গৌরী বিনা কেমন চলে
দেখব তখন বুড়োর।
ঘরের পথ না ধরলে
জ্বালব মুখে নুড়ো।
মশা গিয়ে শিবের দেহ দংশন করতে লাগল। গৌরীকে তাঁর মনেও পড়ল না, শিব সারা গায়ে ভস্মের ওপর বেশ করে তেল মেখে নিলেন। মশা আর তাঁকে কামড়াতে পারল না।
গৌরী এবার ডাঁশ ও মাছি পাঠালেন। বললেন—
ডাঁশ ডাঁশ ডাঁশ
মাছি মাছি মাছি
বুড়ো গেছেন চাষ করতে
বড় কষ্টে আছি।
কামড়ে দিস তাঁকে
দেহের জ্বালা জুড়াতে সে
আমায় যদি ডাকে।
ডাঁশ ও মাছি শিবকে কামড়াতে লাগল। শিব ভস্মের ওপর এবার ঘি লেপন করলেন। ডাঁশ ও মাছি পালাল। ঘিয়ের গন্ধে তারা টিকতে পারে না। এ হল খাঁটি গাওয়া ঘি। চাষ-বাসের সঙ্গে সঙ্গে ভীম খুব কুশলতায় গোপালন করছে। তার গোশালা দুগ্ধবতী গাভীতে ভরা। তাদের দুধ থেকে প্রস্তুত ঘি— প্রভু আর অনুচর নিত্য খাচ্ছেন। রমণীহীন সংসারে কোনও কিছুর অভাব নেই। কিন্তু ডাঁশের কামড়ে শিবের সর্বাঙ্গে ঘা হয়ে গেল। শিব তখন সারা গায়ে রসুন তেল মেখে মেখে সেরে উঠলেন। তবু গৌরীকে তাঁর মনে পড়ল না।
গৌরী এবার পাঠালেন মশক। ধোঁয়া দিয়ে মশক তাড়ালেন শিব
গৌরী পাঠালেন জোঁক। শিব চুন ও লবণ দিয়ে জোঁক মেরে ফেললেন।
কিছুতেই কিছু হয় না দেখে বাগদি মেয়ের ছদ্মবেশে গৌরী নিজেই এলেন শিবের কুটিরে। ভীম বাগদি মেয়েকে কিছুতেই থাকতে দেবে না। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে তুমুল কলহ হল। কিন্তু বাগদি মেয়ে ছাড়বার পাত্রী নয়। সে সোজা গিয়ে শিবের সামনে দাঁড়াল। বাগদি মেয়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে শিব মোহিত হলেন। ভীমকে বললেন—আহা! থাকতে চাইছে থাকুক না। অবলা মেয়েমানুষ!
ফাঁক পেয়ে শিব বাগদি মেয়েকে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে বসলেন। বললেন— চলো। দু’জনে ঘর বাঁধি।
বাগদি মেয়ে রাজি নয়। সে বলে—মরণ! ঘর বাঁধতে বয়ে গেছে আমার। আমি মাছ ধরব।
শিব তখন তাড়াতাড়ি মাঠে জল সিঞ্চন করতে লাগলেন। বাগদি মেয়ে জলে নেমে মাছ ধরতে লাগল। ভিজে বসনে তার যৌবন হয়ে উঠল মনোহর। শিবের আর সয় না। তিনি বললেন—ওগো, আমাকে আলিঙ্গন দাও।
গৌরী বাগদি মেয়ের মুখ দিয়ে বললেন—এই দিলাম বলে। গায়ে কাদা লেগেছে। ধুয়ে নিই।
কাদা ধোবার ছল করে গৌরী কৈলাসে চলে গেলেন। শিব অপেক্ষা করে আছেন। কখন বাগদি মেয়ে গা ধুয়ে আসে। কিন্তু অনুপল, পল, দণ্ড চলে যায়, বাগদি মেয়ে আর আসে না। শিব বুঝলেন, বাগদি মেয়ে তাঁকে ঠকিয়েছে। খুব দুঃখু পেলেন। ছল-চাতুরি তাঁর সয় না। ভোলা মহেশের সবই সোজাসাপটা। আনন্দে গীত, শান্তিতে গঞ্জিকা, ক্রোধে তান্ডব। কিন্তু দুঃখে কী করেন! কামপীড়িত শিবের কী যেন মনে পড়ি-পড়ি করেও পড়ছে না। অতৃপ্তিতে তাঁর হৃদি—মন ছেয়ে গেল।
এদিকে শিবের ক্ষেত জুড়ে শস্য জন্মেছে। এমন ফলন কেউ কখনও দেখেনি। তাই দেখে গৌরী কৈলাস হতে বললেন—আই ঔ! কী ক্ষেতি ঔ!
তাঁর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে দুটি অগ্নিপিণ্ড বেরিয়ে এল। এই আগুন শিবের শস্যে আগুন লাগিয়ে দিল। শিব পিনাক ধারণ করে আগুন নেভালেন। অগ্নিপিণ্ড দুটি বলল—আমাদের বাঁচান। আমরা শিবানীর মুখনিঃসৃত। আপনার সন্তান। শিবানীর নিষ্ঠীবন থেকে আমাদের জন্ম।
শিব তখন একটি আগুনের পিণ্ডকে শস্যরসে রূপান্তরিত করে দগ্ধ শস্যের মধ্যে পুরে দিলেন। অন্যটিকেও একইভাবে রসে পরিণত করে অদগ্ধ শস্যে পুরে দিলেন। জগতে এক নতুন শস্যের জন্ম হল —তার নাম ধান।
শিব বললেন, অদগ্ধ ধান হল শালিধান, আমনধান। আর দগ্ধ ধান হল আউশ ধান। এই দু’রকম শস্যই পৃথিবীতে ফলবে।
এ ধরিত্রী শস্য পেল। সঙ্গে শিবানীপ্রেরিত মশা, মাছি, ডাঁশ, জোঁক প্রভৃতিও পেল যন্ত্রণাসমেত। শস্যক্ষেত্রের জন্য মারামারি, যুদ্ধ, বিবাদ এবং রক্তপাতও পেল। কিন্তু ধানের এমন মহিমা—এই দুঃখ-কষ্টের কথা কারও মনেই থাকল না।
ইতিমধ্যে গৌরীর কথা শিবের মনে পড়ে গেছে। তিনি গৌরীকে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে সকল শস্য ফেলে কৈলাসে ফিরে গেলেন।
সেই থেকে হর-গৌরী হলেন ধানের জনক-জননী।
.
সেই হর-গৌরীর গড় পূজা হয়েছে কাল। ইন্দ্রের পূজা হয়েছে। এখন মেঘারানির কুলা নামাতে নামাতে চলেছে এয়োতিরা। কারও হাতে কুলা, কারও হাতে জলঘট। গৃহস্থের আঙিনায় এসে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে তারা আর কুলোর বাতাস দিয়ে বলছে—
বেঙা ছেড়ির বিয়া সোনার লাডুম দিয়া
বেঙি লো মেঘ নামাইয়া দে
মোড়লের বউয়ের দাঁত খোঁটা মেঘ পড়ে ফোঁটা ফোঁটা
ছিটা পানি দে বেঙি লো
মেঘ নামাইয়া দে
কালামেঘা ধলামেঘা তোমরা দুটি ভাই
এক ফোঁটা জল ঢালিয়া দাও
সাইলের ভাত খাই
ঘরে ভিজ্যা যাই
চাচামিঞা কান্দন করে ক্ষেতের আইলে বইয়া
বেঙি লো মেঘ নামাইয়া দে
ক্ষেত খলা বিরাণ হইল
জল না পাইয়া
বেঙি লো মেঘ নামাইয়া দে
পাঁচঘর ঘুরে এয়োতিরা গেল গঙ্গার পাড়ে। সকলের আগে শিখারানি। সতীর থানে সতী সে। তার ভর হয়। ঘট মাথায় দিয়ে সে আগে আগে চলল। জলে নেমে কোমর ডুবিয়ে স্নান করল প্রত্যেকে। তারপর ভেজা কাপড়ে ফিরে চলল। যে যার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে চাল, ডাল, নারকোল, তেল। ভাঁজুই মায়ের সিধা। সিধা সাজিয়ে মাথায় ঘট নিয়ে বসল শিখারানি। তাকে ঘিরে বসল অন্যরা। ভরা ঘটে ফুল চাপিয়ে দেওয়া হল।
শিখারানি চোখ বন্ধ করে বসে আছে ঘট নিয়ে। ভাঁজুই মা আসবেন কখন, আর ঘটের থেকে একটি ফুল অন্তত ফেলবেন। এই অপেক্ষার মধ্যে গানের সুরে সুরে শুরু হল আরাধনা। গ্রামের যাঁরা প্রবীণা, তাঁদেরই এ গান মুখস্থ।
বেউল বাঁশে বাঁকখান
তেউর লতার শিকে
কেষ্টর কাঁধে ভর দিয়ে
চলিল রাধিকে
ও লাজের মাথা খাও ॥
ভাঁজুই লো সুন্দরী
মাটির লো সরা
আমার ভাঁজুইকে দেব
কোড়া পিঠের জোড়া
পঞ্চফুলের মালা দেব
আম থোকা থোকা
ভাঁজুই মা কি আইলনি গো
তেঁতুল ধরে বেঁকা
ও লাজের মাথা খাও ॥
আলুঙ্গার বিলেরে ভাই
বগাবগি চড়ে
শচী মাতার দুঃখ দেখে
মন ছটফট করে
ও লাজের মাথা খাও ॥
ঘট হতে ফুল পড়ল এবার। সকলে উলু দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে নমস্কার করল। এবার লাজের মাথা খাওয়ার পালা। সকল আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকল পুরুষ বিস্মৃত। শুখা, ফসলহীন আবাদি জমিতে এসে দাঁড়াল এয়োতিরা। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখে সকলে গোল হয়ে দাঁড়াল। সবচেয়ে যুবতী তিন নারী অনাবৃত হয়ে দাঁড়াল খোলা আকাশের তলায়, মানবীর ঘেরাটোপে। একজন শুয়ে পড়ল মাটিতে। চিৎ হয়ে। অন্য দু’জন ভাঁজুই মায়ের ঘটের জল ছিটিয়ে দিতে থাকল তার দেহে। এমনি করে একে একে তিনজনেই ভিজিয়ে ফেলল সর্বাঙ্গ।
আকাশ হতে কামাতুর ইন্দ্র দেখলেন এই দৃশ্য। ছিটেফোঁটা মেঘ হয়ে তিনি জমে উঠলেন আকাশে। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বেন ধরণীতে। রমণ করবেন যুবতীদের।