2 of 3

রাজপাট – ৬২

৬২ 

শাওন মাস বিষম মাস 
বিয়া নাইসে অয়। 
এই মাসে বিয়া অইলে 
সর্বনাশ ঘটয়।।
শাওনে অইছিল বিয়া 
বিপুলা সুন্দরী। 
কালরাইতকুর মাঝে বেটি 
অই গেছিল রাঁড়ি।। 
এর লাগি শাওন মাসে 
বিয়া অইতে মানা। 
এই মানা করিয়া গেইছেন 
ময়মুরব্বিদানা।।

.

আষাঢ় গেল। শ্রাবণ এসেছে। কিন্তু মেঘ নেই। বৃষ্টি নেই। খর দাহে শুকিয়ে গিয়েছে ধরা। ধু-ধু ফসলের খেত। মরা নির্জীব ধানগাছে বিবর্ণতা। কোথাও মাটির বুক ফেটে ফেটে চাকা চাকা হয়ে আছে। চোখ পড়লে শিউরে উঠছে মানুষ। জ্বলজ্বলে আকাশে ক্রূর সূর্য দেখে গলা-বুক শুকিয়ে যাচ্ছে কৃষকের। এমন খরার বর্ষ! ভাদই ধান না উঠলে লোকে খাবে কী! 

পাম্পসেট আছে যাদের, নদীর ধারে যাদের বসত, তারা কিছু আবাদ করেছে। কিন্তু রোদে তাদেরও আবাদ ঝলসে যাচ্ছে। নদীর জলতল নেমে গেছে নীচে। ফরাক্কার কাছে গঙ্গার বুকে চরা জেগে উঠেছে। যে-জলভরনি খাল দ্বারা ভাগীরথীকে রাখা হচ্ছে সমৃদ্ধ, তারও বুকে আটকে যাচ্ছে সাধারণ ডিঙি নৌকো। জল নেই, জল নেই—চারিদিকে এক হাহাকার। 

জলতল নেমে যাওয়ায় চতুষ্কোনার পাড়ে লেগেছে দ্রুত ভাঙন। নদী জেলেপাড়ার গায়ের কাছে এসে গেছে। স্পর্শ করেছে বলাই মণ্ডলের স্বপ্না, বিমলা, দিবা, নিশি, সন্দীপ প্রভৃতি সহকার বৃক্ষকে। গোড়ার মাটি সরে গেছে। শিকড়ের বিস্তার স্পষ্ট দেখা যায়। তবু, কী এক মমতায়, তারা দাঁড়িয়ে আছে সোজা। চলে যাবে কোনওদিন। যে-কোনও দিন। 

সুকুমার পোদ্দারের আমবাগানও নিস্তার পায়নি। নদী ছোবল বসিয়েছে গ্রাম জুড়ে। সকলের চিন্তিত মুখ। করা দরকার কিছু। ইতিমধ্যে সুকুমার পোদ্দার বহুবার গিয়েছেন বহরমপুরের সেচ দপ্তরে। দ্রুত প্রতিকার চেয়ে গ্রামে মিছিল বেরিয়েছে বেশ কয়েকদিন। সরকারি বিশেষজ্ঞ ভাঙনের প্রকৃতি দেখে গিয়েছেন একবার। আজ আসবেন আবার। বদরুদ্দিন গ্রামে আছে আজ। শোনা যাচ্ছে লোক নিয়ে আসবেন মিহির রক্ষিত স্বয়ং। সরকারি বিশেষজ্ঞদের ঘেরাও করে আজ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য চাপ দেওয়া হবে যাতে দ্রুত কাজ শুরু করা যায়। 

আর এস পি বিধায়ক নিখিলেশ চৌধুরী ব্যস্ত মানুষ। এমন গ্রাম-গঞ্জের সমস্যায় ছুটে আসা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। কিন্তু আজকের ঘেরাও পরিকল্পনায় তাঁর পূর্ণ সমর্থন আছে। 

প্রতিটি রাজনৈতিক দল একই হিসেবে কাজ করে। শুধু শাসকদল এবং বিরোধীদলগুলি বিষয় ভাগ করে নেয়। প্রতিটি দলই উন্নয়ন ঘটায় সেই অঞ্চলের, যেখানে তারা জয়লাভ করে। সাধারণ মানুষ এই হিসেব জানে। মেনেও নিয়েছে নির্দ্বিধায়। যে-ভাবে খেলার মাঠে দলভাগ মেনে নেয় মানুষ, এক-এক দলের পক্ষ নিয়ে উন্মত্ত চিৎকার করে, এমনকী ঘটায় রক্তপাত, তেমনই এই রাজনৈতিক রং মাখামাখি। 

তুমি আমার দলের লোক 
তুমি আমার দলের লোক 
তাই তোমার ভাল হোক 
তাই তোমার ভাল হোক 

এই শ্লোক ভারতবর্ষের হৃদয়তন্ত্রীতে। তার থেকে বেরুবে কে? কেমন করে?

এই ঘেরাও নিয়ে চতুষ্কোনা গ্রামে আজ চাপা উত্তেজনা। এমনকী বলাই মণ্ডল, যিনি সকল হতে মুখ ফিরিয়ে আত্মস্থ থাকেন, উত্তেজনা স্পর্শ করেছে তাঁকেও। সেই উত্তেজনা নিয়েই তিনি শস্যের মাঠে ব্যাপৃত আছেন। এখন জমির পরিমাণ অর্ধেক। তাঁর পুরনো কিষাণরাও নেই সবাই। ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। উপায় নেই। ষোলো বিঘা জমি ছিল। এখন হয়েছে আট। নিজে খাটলে আট বিঘা চাষ করতে বেশি লোক লাগে না। 

নিজের ফসলি জমির ভাগ শেষ পর্যন্ত সুকুমার পোদ্দারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে কানাই মণ্ডল। কী দাম সে পেয়েছে জানেন না বলাই। তাঁর শহরের বসবাস সম্পর্কেও কোনও আগ্রহ না থাকায়, কানাই মণ্ডলের দোকান দেখতেও তিনি যাননি। দোকান খোলার দিন মা আর বোনকে নিয়ে গিয়েছিল তীর্থ। তিনি শুনেছেন, ছোট দোকান। তবে পোশাকে ভরা। তীর্থ বলেছিল—বেশিটাই বাইরের জিনিস বাবা। চোরাপথে আসে সব।

তিনি ধমকেছিলেন—তুই জানলি কী করে? 

সে দমেনি। বলেছিল—জানি বাবা। অশোককাকা আছে না কাকার সঙ্গে। অশোককাকা তো ওইসব করে। 

বলাই মণ্ডল দেখছিলেন, বড় হয়ে গেছে তীর্থ। কালো কচি শল্পের মতো রোমরাজি মুখে। বাড়ছে। এখনও একবারও ক্ষৌরি দেওয়া হয়নি। বড় প্রশান্ত দেখায় এখন তীর্থকে। প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেছে সে। দারুণ কিছু নম্বর নয়। তবু প্রথম বিভাগ! বলাই মণ্ডল বড় খুশিতে, বড় আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন। 

ইদানীং তীর্থকে নিয়ে লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা। তীর্থ পড়েছে। বুঝেছে কি? বলেনি কিছুই। বলাই মণ্ডলের মনে হয়েছে, তীর্থর মধ্যে দিয়ে তিনি নতুন করে বেঁচে উঠছেন। ফিরে পাচ্ছেন তারুণ্য। তিনি জানেন, এই নিয়ম বিশ্বের। চিরজীবী হতে চায় মানুষ। সন্ততির মধ্যে নিজেকে দেখে তৃপ্তি লাভ করে। অসাধারণ যাঁরা মানুষ হিসেবে, তাঁরা পৃথিবীতে কীর্তি রেখে যান। বেঁচে থাকেন তারই মধ্যে। যাঁরা সাধারণ, সন্তানের মাধ্যমে রক্ষিত বংশগতিই তাঁদের সম্বল। 

মেয়েও বড় হচ্ছে। কিন্তু মেয়েকে দেখে তাঁর এই বোধ জাগে না। হয়তো মেয়ের মা-র মধ্যে জেগে ওঠে। হয়তো তিনিও মেয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন তাঁর প্রস্ফুটিত কৈশোর। বলাই মণ্ডল ভাবেন, মানুষ কি তা হলে আপন সত্তাকেও চিহ্নিত করে যৌনচিহ্ন সমেত? যৌনপরিচয় বাদ দিয়ে কি তবে আত্মনির্ণয় সম্ভব হয় না! হতে পারে তাঁর মেয়ে তাঁরই স্বভাব পেল। সেই মিল স্বীকৃতি পায়। কিন্তু মেয়ের মধ্যে দিয়ে পিতা তার ফেলে আসা দিনগুলিকে নতুন করে ফিরে পায় না। 

আমবাগান বিক্রি করতে পারেনি এখনও কানাই। ক্রেতা পাচ্ছে না নিশ্চয়ই। ভাঙন-লাগা বাগান কে কিনবে? কিনলেও দাম দেবে সামান্যই। এ বছর বৈশাখে আমের কুঁড়ি ঝেঁপে এসেছিল গাছগুলিতে। কালবৈশাখীতে কিছু ঝরেছিল। কিন্তু তার পরেও ফলন হয়েছিল প্রচুর। থোকা থোকা সবুজ আমের গুচ্ছ দেখে মন ভরে গিয়েছিল বলাই মণ্ডলের। ফলের বাগান যারা বাৎসরিক ইজারা নেয়, তাদের কাছ থেকে, আধখানা বাগানের জন্যও ভাল দাম পেয়েছিলেন তিনি। তীর্থ বলেছিল-বাবা, দেখো, গাছগুলো যেন চলে যাবে বলে ফলে ভরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। 

চমকে উঠেছিলেন বলাই মণ্ডল। তিনি এভাবে তো ভাবেননি! সত্যিই। গাছগুলি তলিয়ে যাবে যে-কোনও দিন। জীবনের জয় ঘোষণা করার জন্যই তারা উৎপাদন করেছে ফলাকার বীজ। রেখে যাবে। রেখে যাবে সন্তান-সন্ততি বংশধারা এই পৃথিবীতে! 

ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখে জল আসে। কী সুন্দর এই ভুবন। কী তার অপার মায়া। একদিন চলে যেতে হবে। তার থেকে পরিত্রাণ নেই। এই অমোঘ সত্য জেনেও তবু ছেড়ে যেতে চায় না প্ৰাণ। 

তিনি নিজের ক্ষেতের দিকে তাকান। কিছু-বা গাছ, তারা সজীব। পাম্প দিয়ে সেচন করেছেন তিনি। সুকুমার পোদ্দারের জমিতেও রয়েছে ফসলের শ্যামল সম্ভার। যারা নালি কেটে ভাগীরথী থেকে জল তুলে সেচ দেয়, তাদেরও হয়েছে কিছু ফসলের ইঙ্গিত। কিন্তু জলতল ক্রমশ চলে যাচ্ছে নীচের দিকে। পাম্পের তোলা জল কাদাঘন। এ সময় শস্যের মাঠে বড় নজরদারি প্রয়োজন। নইলে ভুলুক দিয়ে জল চুরি করে নিতে পারে সংলগ্ন জমির কৃষাণ। আলের তলায় গর্ত করে গোল নলের মতো বাঁশ বসিয়ে দেবে। ওপর থেকে দেখে বোঝা যাবে না কিছুই। কিন্তু নিজের জমির সব জল চলে যাবে পরের জমিতে। 

বলাই মণ্ডল দোষ দেন না কারওকে। কী করবে সব! সেচন প্রক্রিয়া আজও রয়ে গেছে পুরনো পন্থার মতো। জমি চষা, সে-ও বলদই ভরসা। সুকুমার পোদ্দার একটি ট্রাক্টর কিনবেন শিগগিরই, শোনা যাচ্ছে। ট্রাক্টর পেলে মুনিষের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। তখন যাবে কোথা সব? এতগুলি লোককে বেকার করে দেওয়া, এ কি সুকুমার পোদ্দারের বিরুদ্ধে যাবে না? প্রশ্নটা এসেছিল মাথায়। জনসমর্থনের মূলধনেই যাঁর কারবার, তিনি কী করে সমর্থন হারানোর কাজ করেন? অতগুলি মুনিষ, যতদিন পোদ্দারের ওপর নির্ভরশীল, ততদিন তাঁরই হাত তোলা। অতগুলি ভোট বিষয়ে নিশ্চিন্ত তিনি। তা হলে? 

কথাটা বলেছিলেন তীর্থকে। তীর্থ বলেছিল—না। লোক বেকার হবে না। 

—কেন? 

—ঠিকেদারি করবে অনুদা। রাস্তা বানানোর কাজ। ওখানে লোক নিয়ে নেবে। 

—চাষি-মানুষগুলোকে কুলি-মজুর করে দেবে? যারা জমি চষে, তারা কি রাস্তা বানানোর কাজ পারবে? 

—পেটের দায়ে মানুষ সব পারে বাবা। 

–কীসের রাস্তা হবে? 

—চতুষ্কোনা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত যে-রাস্তা, তাকে উঁচু করা হবে আরও। –উঁচুই তো আছে। 

—আরও উঁচু। যাতে বন্যার সময় লোক রাস্তায় আশ্রয় নিতে পারে। এ কাজের জন্য প্রচুর টাকা পেয়েছে পঞ্চায়েত। ভোট আসছে না? তবে পরিকল্পনাটা ভাল। 

—কী পরিকল্পনা? 

—রাস্তার ধারের কিছু খাস জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তা উঁচু করা হবে। মাটি কাটলে যে- গর্ত হবে তাতে জল ধরে এ ধারের জমিগুলি, মানে ভাগীরথীর জল যারা পায় না, তাদের জমিতে সেচ দেওয়া হবে। 

তীর্থ খবর রাখে। এই বয়সই হল খবর রাখার। তিনিও রাখতেন। ধীরে ধীরে সকল ছেড়ে হয়েছেন সকলভোলা। 

কিন্তু ভুলতে চাইলেই কি আর ভুলতে পারা যায়? জীবনের নানা চাহিদা অন্তর হতে দৃষ্টি টেনে বাইরে ফেলতে বাধ্য করে। এই যে পথ উঁচু করা হবে, তা কেন? বন্যা হলে চতুষ্কোনা ও পেতনির চরের মানুষ ওই সড়কেই অস্থায়ী আস্তানা করেছে চিরকাল। যা আছে তার চেয়েও বেশি উঁচু করে বাড়তি ফল কিছু পাওয়া যাবে না। আসলে টাকার খরচ তো দেখাতে হবে। উন্নয়ন তহবিলের টাকা শূন্য কর্মে তো ফিরে যেতে পারে না। উন্নয়ন পরিকল্পনা, কাজ, প্রণয়ন—এ নইলে যে রাজপদ টলে যায়। পুকুর না করে, পথ না করে কৃষকসাধারণের জন্য আরও কয়েকটি পাম্প কেনা যেত। পাম্পে সেচন অনেক বেশি সহজ। কিন্তু এগুলো করা চলে না। চোখে দেখার মতো কাজ নয় এসব। বড় কাজ বড় করে দেখা যায়। তা ছাড়া টাকা যদি আসে সড়ক উন্নয়নের জন্য, তা হলে সেখাতেই তা ব্যয় করতে হয়। এবং সড়ক নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণের মতো বড় কাজে ঠিকেদারের হস্ত ধারণ করেন লক্ষ্মীদেবী স্বয়ং। 

বলাই মণ্ডল আর ভাবতে চান না। বহির্জগৎ পঙ্কে পরিপূর্ণ। স্বার্থচিন্তায় ভরপুর। সে দিকে মন দিলে মনে বড় কালি পড়ে। ময়না বৈষ্ণবীকে তাঁর মনে পড়ে। হঠাৎ উপস্থিত হয়ে সে দুটি সুন্দর কথা বলে যেত। মনে কালি পড়ার কথা বলেছিল সে-ই। বলেছিল—মনে জালি দেন ঠাকুর। মিহি জালি দিয়ে ঘিরে দেন মন। বাহিরের কালি যেন জালিতে ধরা পড়ে। মনে যেন না লাগে কিছু। আপনি বড় সাদা মানুষ। 

বলাই মণ্ডল অন্যমনস্ক হয়ে যান। ময়না বৈষ্ণবীর কথা মনে পড়লে কষ্টে বুক ভরে যায়। সে তো কেউ-ই ছিল না। তবু যেন গাঁয়ের মাটিতে সে ছিল এক নিজের মানুষ। ঘরের দাওয়ায় এসে বসলে ঘর অলংকৃত হয়ে উঠত। বলাই মণ্ডলের কবিমন তৃপ্ত হত তাকে দেখলে। 

তিনি ময়না বৈষ্ণবীর স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে দূরের দিকে তাকান। এই খরায় যেখানে চাষ হয়নি, জ্বলে গেছে শিশু ধানের চারা, সেইদিকে তাকিয়ে অন্য এক টনটনে বেদনায় আচ্ছন্ন করে তোলেন মন। মাত্র ক’দিন আগেকার দুর্ঘটনাটি মনে পড়ে যায়। এতগুলি শিশুর মৃত্যু—এ যেন স্বাভাবিক নয়। হায় হায়! সেই শিশুপোড়া গন্ধ কল্পনামাধ্যমেই চেতনাকে আচ্ছন্ন করে যে! আধুনিক শহরে এমন হয় কী প্রকারে! শিশু ধানের চারাগুলি হতেও অবিকল নির্গত হয় পোড়া দেহের গন্ধ। বলাই মণ্ডল বিড়বিড় করে বলেন—জল চাই, জল। বেঁচে থাকার জন্য জল চাই। জলের অপর নাম জীবন। জীবনীয়। 

.

সেই আদিকালের সেচনপদ্ধতি আজও রয়ে গেছে মাঠে-মাঠে। শত শত বৎসর আগেকার কৃষকের মস্তিষ্কপ্রসূত বিচিত্র উপায়। কুয়োর মতো গভীর গর্ত হতে জল তুলে সেচন করা হয় ঢেঁকলির মাধ্যমে। একটি বাঁশকে লম্বালম্বি চিরে ফেলে তার মাঝখানের গাঁটগুলি ছুরি দিয়ে চেঁছে ফেলা হল। একপ্রান্তে বেঁধে দেওয়া হল একটি পাথর বা মাটির তাল। ঢেঁকলির একপ্রান্ত থাকবে কুয়োর মতো গর্তের জলতল অবধি নেমে যাবার দৈর্ঘ্যে। ভার ছেড়ে দিলেই সে জলতলে পৌঁছবে। ভার ধরে টানলেই তার বুকের খাল বেয়ে জল পড়বে ছুঁয়ে। বিন্যাসে ঢেঁকির সঙ্গে মিল আছে বলেই এর নাম ঢেঁকলি। একজন লোকই সারা দিনমান ঢেঁকলি দিয়ে সেচন করে যেতে পারে। নালি কেটে টেনে আনা জল এ-জমি থেকে ও-জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। 

জল উৎসের তল যদি খুব গভীরে চলে না যায়, তখন ব্যবহৃত হয় দোনা। একে কেউ বলে ডোঙা। কেউ বলে দুনি। দোনার সেচন পদ্ধতিও অনেকটাই ঢেঁকলির মতো। এখানে প্রধানত ব্যবহৃত হয় তালের ডোঙা। তালগাছের কাণ্ডকে ফাঁপা করে নিয়ে চওড়া দিকটা রাখা হয় জলের ওপর। সরু মুখে একটি বাঁশ বেঁধে, ঢেঁকলির মতোই একটি ভার বাঁশের প্রান্তে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জল তোলার পদ্ধতি ঢেঁকলির মতোই। 

ঢেঁকলি ও দোনা ছাড়া আর একটি সেচের যন্ত্র হল সিউনি। শর, বাঁশের ছিলা বা খাগড়া দিয়ে বড়-সড় কুলোর মতো করে তৈরি হয় সিউনি। সেচুনি থেকে এর নাম হয়েছে সিউনি। সিউনির চারকোণে চারটি দড়ি বাঁধা হয়। দুজন জলের নালার দু’পাশে দাঁড়ায়। সিউনির দু’ প্রান্তের দড়ি ধরে নালার জলে ঠেলা মেরে জমিতে ফেলে। 

কিন্তু এ সবই রাঢ়ের প্রক্রিয়া। বাগড়িতে সেচের প্রধান ভরসা নদী ও বিলের থেকে জল নেওয়া। কিছু-বা পুকুরে জমা থাকে বর্ষার জল। বাগড়ি এলাকায় জলস্তর অনেক ওপরের দিকে হওয়ায় এখানে ধনী কৃষকেরা প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে থেকে ব্যবহার করে আসছে অগভীর নলকূপ। সম্পন্ন কৃষক ছাড়া নিজের খরচে নলকূপ বসাবার সামর্থ নেই ক্ষুদ্র বা মধ্যম অবস্থার কৃষকের। এখন পাম্পসেট এসে যাওয়ায় তারও সুবিধা পাচ্ছে সম্পন্ন কৃষকরাই। যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি সেখানে তেল খরচ করে সেচন ঘটান একমাত্র সম্পন্ন কৃষকের পক্ষেই সম্ভব। এমনকী বিদ্যুৎ যেখানে পৌঁছেছে সেখানে তেলের খরচ নেই। কিন্তু বিদ্যুতের খরচ বহনেরও সামর্থ নেই যাদের, গৃহেও এমনকী নেয়নি যারা আলো, পাম্প তারা কেনে কী প্রকারে? চালায় কী প্রকারে? 

নব-আবিষ্কৃত যে-কোনও সুবিধাই প্রাথমিকভাবে ভোগ করে সম্পন্ন নাগরিক। যখন এই ব্যবস্থাকে পুরনো করে দিয়ে নতুন কোনও ব্যবস্থা আসে তখনও তার ব্যতিক্রম হয় না। সারা বিশ্বেরই এ নিয়ম। 

ভাগীরথী ও গঙ্গার মধ্যবর্তী ভূমিতে গড়ে ওঠা বাগড়িতে কুয়ো নেই। কিন্তু রাঢ় অঞ্চলে পুকুর, কুয়ো, দীঘি আর কাঁদর রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। ডোবা আছে যত্র-তত্র। ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের রাঢ় অঞ্চল ছোটনাগপুর মালভূমির সম্প্রসারিত অংশ। এই অংশে মাটির নীচে রয়েছে পাথরের স্তর। ফলে ভূস্থিত জলতল ভূত্বকের অনেক নীচে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নলকূপ বসান এখানে ব্যয়সাধ্য। পাথরের বুক ফাটিয়ে চলে যাবে নল, তার দাম মৃত্তিকাও আদায় করে নেবে কড়াক্রান্তিতে। ফলে পুকুর, ডোবা, কাঁদর, বাঁওর, কুয়ো ছাড়া রাঢ়ের উপায় নেই। 

.

তবে এখানে আছে ময়ূরাক্ষী সেচ প্রকল্পের সুবিধা। যদিও রাঢ়ের যতখানি কৃষিজমি সেচ প্রকল্পের সুবিধা পায় তাতে সকল কৃষকের সমস্যা ঘোচে না। কারণ মোট কৃষিজমির তুলনায় সেচপ্রকল্পের অন্তর্গত আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ অত্যল্প। অতএব বৃষ্টি ছাড়া রাঢ়ের উপায় নেই। এই অনাবৃষ্টিতে রাঢ়ের আবাদহীন জমির ফাটা ভূত্বক অনুমান করে শিউরে উঠলেন বলাই মণ্ডল। 

তখনই দেখতে পেলেন তীর্থকে। এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। সরকারি নদী বিশেষজ্ঞকে ঘেরাও করা হবে বলে তীর্থ আজ স্কুলে যায়নি। আমগাছগুলি বিপন্ন হয়ে উঠেছে বলে তীর্থ ব্যথিত হয়ে আছে। বলাই মণ্ডলের কাছ থেকে নাম শিখে নিয়ে সে-ও ডাকে সন্দীপ, কল্যাণী, দিবা, নিশি, স্বপ্না, বিমলা। কাছাকাছি এসে তীর্থ ডাকল—বাবা। বাবা। 

বলাই মণ্ডল উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটু অবধি ধুতি পরা। খোলা গায়ে চিটচিটে গামছা জড়ান। মাথায় রোদের আড়াল দেবার জন্য টোকা। হাতে-পায়ে-মুখে-গায়ে লেগে আছে মাটি। পায়ের হাওয়াই চপ্পল খুলে রাখা ছিল এক জায়গায়। মাটি সমেত পা তাতে গলিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। টোকা খুলে হাতে নিলেন। বললেন—কী রে! 

এতক্ষণ দেখেননি। এবার চোখে পড়ল। তীর্থর হাতে একটি বই। তীর্থ বই তুলে বলল— তোমার কবিতা বেরিয়েছে বাবা। একসঙ্গে ছ’টা। ইনি নিয়ে এসেছেন। 

বলাই মণ্ডল দেখলেন। ছোটখাটো মানুষটি। মাথাজোড়া টাক রোদে চকচক করছে। শ্যামলা রঙে ফুটে উঠেছে রোদ্দুরের তাত। আধময়লা শার্ট-প্যান্ট পরা। কাঁধে ঝোলা একটি। গালে দু’দিন ক্ষৌরি না করা বাসি দাড়ি। গোলগাল দেহে মাখা আছে ঔদাসীন্য। প্রথম দর্শনে মানুষটিকে ভাল লেগে গেল বলাই মণ্ডলের। তিনি বললেন-নমস্কার। 

প্রতিনমস্কার করলেন ভদ্রলোক। বললেন-আমি উজ্জ্বল পরামানিক। এই পত্রিকার সম্পাদক। 

বলাই মণ্ডল কী বলতে হয় ভেবে না পেয়ে বললেন –আহা! কতদূর হেঁটে এলেন এই রোদ্দুরে! তীর্থ! বাবা তুমি ওঁকে বাড়িতে বসিয়ে এলে না কেন? 

তীর্থ বলল—উনি তো… 

উজ্জ্বল পরামানিক থামালেন তাকে। বললেন—ওর দোষ নেই। ও বলেছিল। আমি বললাম, যাই। আহা! দেখে মন ভরে গেল। 

কান গরম হয়ে গেল বলাই মণ্ডলের। অকারণে আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। বললেন—মেঘ নেই। বৃষ্টি নেই। এই রোদ্দুর। এই মাথায় করে… আসুন। বাড়িতে আসুন। 

একবার আবাদি ভূমির দিকে ফিরলেন তিনি। তাজুমিঞার উদ্দেশে বললেন চাচা, আমি বললেন—চাচা, বাড়ি যাচ্ছি। 

তাজুমিঞা মাথা নাড়েন। বলাই মণ্ডল আল ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। কেউ কোনও কথা বলে না। বৃষ্টিহীন নিদাঘ সবাইকে নির্বাক করে রাখে বুঝি। কিংবা কোনও বিস্ময়! 

তীর্থ আনন্দ বোধ করছে। তার বাবার কবিতা ছাপা হয়েছে। যত সে পাঠিয়েছিল, সব ইদানীং সে আর বলাই মণ্ডলের বেছে দেবার জন্য অপেক্ষা করছে না। তার যা ভাল লাগে, তা-ই পাঠায়। অনেকগুলি পত্রিকার নাম-ঠিকানা সে সংগ্রহ করেছে। 

বলাই মণ্ডল বিস্ময় বোধ করছিলেন উজ্জ্বল পরামানিকের কথা ভেবে। কোথা থেকে এসেছেন মানুষটি? আহা! এই তপ্ত সকালে কত দূর থেকে এসেছেন! বড় লাজুক হয়ে ওঠে তাঁর হৃদয়। শুধু তাঁরই জন্য এতদূর কষ্ট করে আসা— ছিছি! তিনি লজ্জায় স্বেদ ঝরিয়ে পথ চলেন। উন্মত্ত দাহে বিচলিত সাপেরা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। চলাফেরা করছিল। মানুষের পথ চলার কম্পনে তারা লুকাল ঝোপে ঝাড়ে। বর্ষা নেই, জল নেই। ভেককুলের প্রজনন স্থগিত আছে। কীট-পতঙ্গের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সাপেরা কী খেয়ে বাঁচে! পাখিরা কী খেয়ে বাঁচে। মানুষ খাদ্যসম্পদ জমিয়ে রাখে। প্রাণীকুল মরে অনাহারে। 

উজ্জ্বল পরামানিকও চলেছেন টইটম্বুর বিস্ময় বুকে করে। এমনটি তিনি ভাবেননি। এ যে পরম বিস্ময়! কবিতাগুলি তাঁর ভাল লেগেছিল। শুধু ভাল লাগা নয়। মুগ্ধ করেছিল। এই কবির লেখা আগে পড়েননি কোথাও। অথচ বুঝতে পারছিলেন, দীর্ঘ চর্চা না থাকলে এমন লেখা যায় না। কৌতূহল হয়েছিল। কে ইনি? এতদিন কোথাও এঁর লেখা পড়েননি কেন? ইনি কি তরুণ, না বৃদ্ধ! ঠিকানা দেখেছিলেন, গ্রাম চতুষ্কোনা, জেলা মুর্শিদাবাদ। এ কোন গ্রাম? কোথায়? শহর থেকে দূরে একজন এমন কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন অজ্ঞাতবাসে প্রায়। কবিতার শক্তি তাঁকে টেনে এনেছিল। ভেবেছিলেন, কবি হয়তো কোনও স্কুলের শিক্ষক। কিংবা সরকারি কর্মী। মেলেনি। মেলেনি কিছুই। সারা গায়ে মাটি মেখে, খালি গায়ে, হেঁটো ধুতি পরে প্রায় মাটি থেকে উঠে আসছেন কবি, এ দৃশ্য তাঁর কাছে অকল্পনীয় ছিল। 

কেন? কেন ছিল? তিনি বোঝার চেষ্টা করেন। থাকার কারণ কৃষক সম্পর্কে কিছু বদ্ধমূল ধারণা। কবি সম্পর্কেও। কবি শিক্ষক হতে পারেন, বাস্তুকার হতে পারেন, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, করণিক, হিসাবশাস্ত্রবিদ, এমনকী ঘুষখোর শুল্ক বিভাগের কর্মী হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু যে-লোকটা হাল-বলদ নিয়ে লাঙল চষে, রেলগাড়ি চালায় যে, কিংবা পাড়ার নাগরিক জঞ্জাল সাফাই করে, এমন সব মানুষকে কবি হিসেবে কল্পনা করা যায় না মোটে। 

ধরে নেওয়া হয়, কৃষক কেবলই কৃষিই জানবেন। জানবেন সার, বীজ, বৃষ্টির হিসেব। ফসলের পরিমাণ। জানবেন গোরু-গাভীগুলির রোগ। গো-বসন্ত, এঁষো, তড়কা, বজবজিয়া, গলাফোলা। গায়ে গো-মহিষাদির গন্ধ মাখা, মাটি-ছানা মানুষ লাঙল-ধরা কর্কশ হাতে কবিতার কলম ধরে কী প্রকারে! 

তলিয়ে দেখলে এমন ভাবনার কোনও অর্থ নেই। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের অভ্যাসে মানুষ শ্রেণিবিভাজন করতে পছন্দ করে। সামান্য বৈষম্য, সামান্য বিভেদ অবলম্বন করে গড়ে তোলে নতুন নতুন গোষ্ঠী। এই সমস্ত ধারণা দৃঢ় হয়ে ওঠে ওই গোষ্ঠীপ্রবণতার অনুকরণ করেই। 

.

বলাই মণ্ডলের পাকা বাড়ি। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। উজ্জ্বল পরামানিক সাগ্রহে এ বাড়ি দেখেন। বলাই মণ্ডল তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করেন ঘরে। গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ ঘরে বৈঠকখানার রেওয়াজ নেই। বলাই মণ্ডল তাঁর ও তাঁর ছেলের ঘরখানিতে সম্পাদককে নিয়ে তোলেন। কানাইয়ের ঘরখানি খালি পড়ে আছে এখনও। 

বলাই মণ্ডল বলেন-আপনি এসেছেন। দুপুরে আহার করে যাবেন। 

—না না। 

—না বললে হবে না। আমরা আনন্দ পাব আপনি দুটি খেলে। সামান্য ডাল-ভাত। 

উজ্জ্বল পরামানিক আন্তরিক আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেন না। তিনি গুছিয়ে বসতে থাকেন। তীর্থ তাঁর দিকে একটি দাঁড়ানো পাখার বাতাস ব্যবস্থা করে। তারপর পত্রিকা নিয়ে বসে। পাতা উল্টে উল্টে সে কেবল থেমে যায় বলাই মণ্ডল লেখা অংশে। দেখে। চোখ ভরে দেখে। ছাপা অক্ষরে তার বাবার নাম। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না তার। সে স্থির করে, এই পত্রিকা নিয়ে গিয়ে নীলাঞ্জনকে দেখাবে। এখনও একই ক্লাসে পড়ছে তারা। নিয়েছে একই বিষয়। যদিও নীলাঞ্জন অনেক বেশি নম্বর পেয়েছে তার থেকে। 

বলাই মণ্ডল হাত-মুখ ধুয়ে, লুঙির ওপর পরিষ্কার পাঞ্জাবি চাপিয়ে ঘরে আসেন। পেছনে মায়া আসেন প্লেটে চা বিস্কুট আর মুড়ির মোয়া সাজিয়ে। বলাই মণ্ডল স্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদকের পরিচয় করিয়ে দেন। সলজ্জ হেসে নমস্কার করে পালিয়ে যান মায়া। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রান্নার আয়োজন করতে যান তিনি। 

তুলতুলি মারা যাবার পর থেকে মেয়েকে রোজ স্কুলে পাঠান না বলাই মণ্ডল। চরম ভীতি জন্মেছে তাঁর। সকল ঔদার্য ছাপিয়ে, যুক্তি ছাপিয়ে এক আশঙ্কা তাঁকে তাড়িত করেছে। যদি সুমিও এমন ভুল করে! যদি চোখ ধাঁধানো পৃথিবীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারে সে! যদি এমন বীভৎস মরণ বেছে নেয়! না। সহ্য হবে না তাঁর। সহদেব দাসের শূন্য চোখ তিনি দেখেছেন। বিপন্ন অসহায়, বেদনাতুর সেই চোখ সহ্য করা যায় না। তুলতুলির মৃত্যুর জন্য কারওকে দায়ী করেননি সহদেব। কারও কাছে অভিযোগ করেননি। কারওকে বলেননি অনির্বাণই তাঁর মেয়ের মৃত্যুর কারণ। মূক পশুর মতো একা-একা সয়েছেন সব। রমেশ হালদার এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। তুলতুলির মৃত্যু ঘিরে সুকুমার পোদ্দারের বিরুদ্ধে একটা হই-চই, একটা গোলমাল বাঁধিয়ে তোলা। সি পি আই এম নেতৃত্ব কীভাবে সামাজিক সন্ত্রাস ছড়ায়, তার উদাহরণ হতে পারত এই মৃত্যু। কিন্তু সহদেব দাস রাজি হননি। বলেছিলেন—আমার মেয়ে ফিরে আসবে না রমেশ। 

মেয়ে ফিরে আসবে না। আসবে না আর। হায়! কী এক দলাপাকানো হাহাকার ছিল সেই উচ্চারণে! সেই স্বর মনে পড়লে, সেই চোখ মনে পড়লে, বলাই মণ্ডলের অস্থির লাগে। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কী এক আশঙ্কা ঘনিয়ে ওঠে হৃদয়ের দু’কূল জুড়ে। অতএব সুমিরও প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃত কারণ কারওকে বলেননি বলাই মণ্ডল। বললে যেন পরাজয় প্রকাশিত হবে। নিজের যুক্তির কাছে, ঔদার্যের অহংকারের কাছে পরাজয়। ঘটে যাওয়া সেই পরাজয় গোপন রাখেন তিনি। স্নেহ যে সকল পথ জুড়ে বসে। সকল দৃষ্টি অন্ধ করে দেয়। তিনি কী করবেন! 

কারণ দেখান তিনি। রোজ নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে, যেমন নিয়ে যেত তীর্থকে, অত মুনিষ কই আর। জোত-জমি কমে গেছে। আয়ও কমে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। সেদিকটাও ভাবতে হয়। 

কেউ আপত্তি করেনি। বলাই মণ্ডলের নিজেকে মনে মনে অপরাধী লাগে। যদি সুমি অন্তত আপত্তি করত একবারও, যেন এক সংঘর্ষের সুযোগে অপরাধবোধ কিছু কম হত তাঁর। কিন্তু তেমন হওয়ার নয়। মায়া মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছেন এমনই। সহনের শিক্ষা। প্রশ্ন না করার, আপত্তি না করার শিক্ষা, মেনে নেওয়ার গুণ তাঁর মধ্যে থেকে সুমিতে সঞ্চারিত হচ্ছে। তিনি জানেন, একালের ভাব আলাদা। তিনি রানিকে দেখেছেন। সহনশীলতা আর এখন প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু মায়ার শিক্ষায়, মায়ার চেতনায় শীলতা যাকে বলে, তাকেই তিনি সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। 

অতএব সুমিকে বাড়িতে থেকে যেতে হয়। বাড়িতেই পড়বে সে আরও অনেকেরই মতো স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। মায়া তাকে নিয়ে গৃহকাজ সারেন। আর বলাই মণ্ডল বসেন সম্পাদকের মুখোমুখি। তিনি এখনও জানেন না এই বই কোথা হতে প্রকাশিত হয়। এরই একটি সংখ্যা এনেছিল তীর্থ, তিনি মনে করতে পারছেন। কিন্তু কোথাকার পত্রিকা তা মনে নেই। 

উজ্জ্বল পরামানিক বলেন-দেখুন পত্রিকাটি। পছন্দ হয়? 

বলাই মণ্ডল লাজুক মুখে হাসেন। পত্রিকা হাতে নিয়েও আবার রেখে দেন তিনি। বলেন— দেখব। 

—কতদিন লিখছেন? 

জিগ্যেস করেন উজ্জ্বল পরামানিক। 

—সে অনেকদিন। 

হেসে বলেন বলাই মণ্ডল। তীর্থ চুপ করে শোনে। তার ইচ্ছে করে বলতে – অনেক খাতা আছে বাবার। তাতে আছে অনেক কবিতা। 

কিন্তু বলে না সে। প্রগলভতা তার চরিত্র নয়। উজ্জ্বল পরামানিক বলেন—আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি আপনার কবিতা পড়ে। মুগ্ধ হয়েছি। কলকাতার একটি ব্যাঙ্কে কাজ করি আমি। নিজের গরজে আজ দশ বৎসর হল এই পত্রিকাটি প্রকাশ করছি। বছরে দুটি সংখ্যা করি। কোনও স্বার্থ নেই। শুধু ভালবাসার থেকে করা। বন্ধুরা এই ভালবাসাকে মর্যাদা দেয়। কিছু বিজ্ঞাপন পাই। বাংলার মানুষ, বুঝলেন, আজও কবিতা ভালবাসে। আজকের বহু বিখ্যাত কবি খ্যাতিমান হওয়ার আগে লিখেছেন আমার কাগজে। নতুন নতুন কবির আবিষ্কার আমার নেশার মতো। জানেন তো, বাংলার গাছ, মাটি, পাথরও লেখে কবিতা 

বলাই মণ্ডল বলেন—গাছ, মাটি, পাথরে কবিতা আছে বলেই কবিতা লেখা হয়।

—এই। এই হল কথা। 

বলেন পরামানিক। 

—গাছ মাটিকে চেনা সহজ নয়। তার কবিতা বোঝা সহজ নয়। যে বোঝে, সে কবি সত্যিকারের কবি। কিন্তু দুঃখ কী জানেন, বাংলা আজ নকল কবিতে ভরে গেছে। এই দশ বৎসরে অনেক দেখেছি। নকলনবিশ সব। একে ওকে দেখে টোকে আর খ্যাতির আশায় দৌড়য়। কী অভিমান এক একজনের! প্রত্যেকেই ভাবে, আমিই সকলের চেয়ে সেরা। হায়! সেরার সেরা যে, তাকে মানুষ আপনি চিনে নেয়। আত্মঘোষণার প্রয়োজন কী তার! 

—তা ঠিক। 

বলাই মণ্ডল আর কোনও কথা খুঁজে পান না। নিন্দাবচন তাঁর সয় না। তাঁর হাতে নতুনদের যা লেখা আসে তার অধিকাংশই স্পর্শ করে না হৃদয়। মস্তিষ্ক আলোড়িত করে না। তিনি বিশ্বাস করেন, শুধু হৃদয় নয়, কবিকে রচনা করতে হয় মস্তিষ্ক দিয়েও। ভাবানুভূতিই একমাত্র বিষয় নয়। কবির থাকতে হয় যুক্তিবোধ। কবিতায় সেই যুক্তিবোধ প্রচ্ছন্ন থেকে যায় আগাগোড়া। সব শব্দের পৃথক অর্থের প্রয়োজন নেই, কারণ ধ্বনি একটি আবহও গড়ে তোলে। কবিতার ভাব ধারণ করে ওই আবহ। তেমনি কবিতার প্রতিটি বাক্যকেও আলাদা করে বুঝতে চাওয়া যায় না। এক বা একাধিক বাক্যসমূহের মধ্যে কেবল চালিত হয় কবিতার প্রকৃতি। এই প্রকৃতিই কবিতার প্রাণ! এই প্রাণের প্রতিষ্ঠা যুক্তি ছাড়া হয় না কখনও। কবিতার কোমল বৃত্তির সঙ্গে যুক্তির কর্কশ বৃত্তির আপাত বিরোধ আছে মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত সকল শৈল্পিক আবেদনই যৌক্তিকতা দাবি করে। বিমূর্ত কবিতা বা বিমূর্ত শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। অনুভূতির প্রকাশ পূর্ণতা পায় যৌক্তিকে। অযৌক্তিকের মধ্যে যে ভান আছে তা রস নষ্ট করে। সৃষ্টিকে নকল মনে হয়। 

তিনি চুপ করে থাকেন। বোঝার চেষ্টা করেন এই সম্পাদকের বক্তব্য। এ কি নিন্দার উদগার, না ক্ষোভের উদ্গীরণ! 

উজ্জ্বল পরামানিক বলে চলেন—আমি নিজেও একটু-আধটু লিখি। কিন্তু সে হয় না। চারপাশের অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, বন্ধ করে দিই পত্রিকা। কিন্তু এই যে আপনার কবিতা পেলাম, কী সুন্দর! পড়তে পড়তে যেন শিউলির গন্ধ পেলাম। দিনাজপুরে বাড়ি ছিল আমার। ছোটবেলায় সেখানে থেকেছি। আমাদের উঠোনে একটা শিউলি গাছ ছিল। বর্ষা শেষ হতে না হতেই তাতে ঝেপে ফুল আসত। রাতে ফোটা ফুল ভোরবেলা বিছিয়ে থাকত উঠোনে। কী আশ্চর্য টাটকা গন্ধে ছেয়ে যেত ঘর-উঠোন। ভাল কবিতা পড়লে, জানেন, আজও সেই গন্ধ আমি পাই। 

বলাই মণ্ডল লজ্জায় মাথা নিচু করেন। এই বয়সেও বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড ধকধক করে উত্তেজনায়। কী বলবেন, কী বলা উচিত ভেবে পান না তিনি। উজ্জ্বল পরামানিক বলেন—শোনাবেন? 

—কী? 

—কিছু কবিতা? থেকে গেলামই যখন, ক্ষোভের কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ কী! 

বলাই মণ্ডল কিছু বলার আগেই তীর্থ বলে— আমি খাতা এনে দিচ্ছি বাবা। কোন খাতা আনব? 

—পাঁচ নম্বরটা আন। আর এখন যেটায় লিখছি। 

তীর্থ চলে যায়। পরামানিক বলেন—মোট ক’টি খাতা? 

—এখন লিখছি বারো নম্বর। 

–ক’টি কবিতা আছে? এক-একটি খাতায়? 

—আশি, নব্বই, একশো। 

—তার মানে সহস্র পেরিয়েছেন আপনি। সাধু সাধু! এতদিন চেপে ছিলেন কী করে? চাপে তো আপনার দম বন্ধ হয়ে যাবার কথা। 

বলাই মণ্ডল হাসেন। কথা খোঁজেন। বলেন—ওই মানে, অনেকদিন হল, ওই আর কী!

তীর্থ খাতা নিয়ে এল। হাতে সেলাই করা সাদা পাতার খাতা। পরিচ্ছন্ন মলাট লাগানো। উজ্জ্বল পরামানিক একটি খাতা হাতে তুলে দেখলেন। পাতা ওলটালেন। বললেন—পড়ুন। 

বলাই মণ্ডল পড়ছেন। থেমে থেমে। ধীরে ধীরে। পাঁচ নম্বর খাতা থেকে পড়ছেন। চোখ বন্ধ করে শুনছেন উজ্জ্বল পরামানিক। শুনছে তীর্থ। শব্দের মায়ায়, ছন্দের রূপে, বিষয়ে বিভায় বার বার গড়ে উঠছে নতুন জগৎ। উজ্জ্বল পরামানিক বলছেন- সাধু! সাধু! কী রচনা! 

তাঁর কখনও মনে হচ্ছে সবুজ ফসলভরা প্রান্তর একটি কবিতা হয়ে ফুটে আছে। কখনও এই অনাবৃষ্টির শ্রাবণ ভরা বাদর হয়ে ঝরে পড়ছে। কখনও হৃদয় ঝালাপালা করে দিচ্ছে ব্যথাতুর উচ্চারণ। উজ্জ্বল পরামানিক আবেগে ভরে উঠছেন। বলাই মণ্ডলের দু’হাত চেপে ধরেছেন তিনি। বলছেন—হে কবি। আপনি ধন্য। 

তাঁর চোখ দুটি সিক্ত হয়েছে। এ এক যথার্থ আবেগ। এর সন্ধান কতকাল পর তিনি পেলেন। তিনি বিস্ময়ে অভিভূত। এই মধ্যবয়স এখনও পেতে পারে এমন আবেগঘন মুহূর্ত! 

বলাই মণ্ডলের ঠোঁট তিরতির কাঁপছে। হাত কাঁপছে। বিপুল আবেগ সংযত করতে চাইছেন তিনি। পারছেন না। এই মুহূর্ত তাঁর জীবনের অনাস্বাদিতপূর্ব সময়। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের কাছে পাওয়া স্বীকৃতি! তিনি বিস্ময়াবিষ্ট! স্বীকৃতি এত আনন্দ দেয়! এত! 

বাইরে বদরুদ্দিনের গলা পাওয়া গেল বলাইদা। 

—এসো বদর। 

ডাকলেন বলাই মণ্ডল। এবং বাঁচলেন যেন। এক আবেগসিক্ত সময়ের লজ্জারুণ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে বেঁচে গেলেন। ডাকলেন তিনি—ভেতরে এসো বদর। 

বদরুদ্দিন এল। বলল—চলো বলাইদা। তোমাকে দরকার। 

—বসো বদর। 

–বসব না। কাজ আছে। মাঠে গেলাম। শুনলাম তুমি বাড়িতে।

—এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই বদর। 

উজ্জ্বল পরামানিকের পরিচয় পেয়ে বসল বদরুদ্দিন। বলল—আপনার পত্রিকা আমি পড়ি। খুব যত্ন নিয়ে করেন। তবে বহরমপুরে সব সংখ্যা পৌঁছয় না। 

–পৌঁছয়। অল্প পৌঁছয় তো। পাওয়া যায় না। এই পত্রিকায় এবার ওঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। 

—কার কবিতা? 

—ওঁর। 

—বলাইদার! বলেন কী! ওফ্ এ যে দারুণ ব্যাপার। কত বলেছি বলাইদাকে, এত ভাল লেখেন, পাঠান। কত পত্রিকাও এনে দিয়েছি। যাক্। শেষ পর্যন্ত যে… 

বলাই মণ্ডল লজ্জিতভাবে কথা কেড়ে নেন। যেন এই কবিতা পাঠানর মধ্যে দিয়ে কোনও শর্তভঙ্গ করেছেন তিনি। বলেন—আমি না। আমি না। এসব তীর্থর কাজ। 

—খুব ভাল তীর্থ। খুব ভাল করেছিস। 

বদরুদ্দিন তীর্থর মাথায় হাত রাখে। বলে—বলাইদা, তুমি আমাদের গ্রামের গর্ব। 

—তুমি কারওকে কিছু বোলো না ভাই। 

বলাই মণ্ডল সংকোচে গুটিয়ে যান। বদরুদ্দিন বলে—এটা কি না বলে পারা যায়? তুমি একদিন বিখ্যাত হবে বলাইদা। 

বলাই মণ্ডল কথা ঘোরাতে চান। বলেন—বদরভাই, ইনি আজ আমার গৃহে অতিথি। এঁকে ফেলে আমি তো যেতে পারব না। 

উজ্জ্বল পরামানিক বলেন—না না। আপনি যান। আমার জন্য কাজের ক্ষতি করবেন না।

বদরুদ্দিন বলে—না। ক্ষতি কিছু হবে না। আপনারা কথা বলুন। আমি বরং তীর্থকে নিয়ে যাই। যাবি তীর্থ? 

তীর্থর এই কবিতার পরিমণ্ডল ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু, আজকের সমস্ত কিছুই তাদের স্বার্থেও; উপলব্ধি করে উঠল। বলল—চলো। 

—আপনি আজ রাত্রিটা আছেন তো? 

উজ্জ্বল পরামানিককে বলল বদরুদ্দিন। উজ্জ্বল বললেন- না ভাই। আজ ফিরব। বহরমপুরে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। রাত্রে সেখানে থেকে ভোরের ট্রেন ধরব। 

—বহরমপুরে কে আপনার বন্ধু? 

–কলেজে পড়ায়। অসিত। অসিত কামিল্যা। চেনেন? 

—চিনি। আমি ওঁর কাছে পড়েছি। আজ আপনি যদি থেকে যেতেন, তা হলে ভাল হত।

—আবার আসব ভাই। পরিচয় হল যখন 

বদরুদ্দিন তীর্থকে নিয়ে চলে গেল। উজ্জ্বল বললেন—আপনার ক্ষতি করে দিলাম। 

বলাই মণ্ডল বললেন না, না। ক্ষতি কীসের? আজ সরকারি অফিসাররা আসবেন নদীর পাড় দেখতে। পাড় ভাঙছে তো। 

—পাড় ভাঙছে? 

—হ্যাঁ। আমারই আমবাগান স্পর্শ করেছে ভাঙন ॥ 

—বুঝেছি। 

–কী? 

—আপনার কবিতায় এত ভাঙনের কথা তাই। শুধু কল্পনা নয়। বাস্তবকে চুম্বন করে লিখেছেন আপনি। 

বলাই মণ্ডল চুপ করে থাকেন। তাঁর মন উদাস হয়ে যায়। প্রকাশিত কবিতার আনন্দ দলিত করে উপস্থিত হয় সহকার বৃক্ষগুলির জন্য বেদনা। এ বেদনা প্রায় শোকের মতোই। তবু শোক বলেন না তিনি। তারা যে বেঁচে আছে এখনও। স্বপ্না, বিমলা, সন্দীপ, কল্যাণী, দিবা, নিশি… যে বেঁচে আছে, তার জন্য শোক করা চলে না। তার মৃত্যু অনিবার্য জেনেও শোকের ভার লুকিয়ে রাখতে হয়। 

উজ্জ্বল পরামানিক বলেন— আমাকে নিয়ে যাবেন? 

—কোথায়? 

—আপনার আমবাগানে? 

—বেশ। খাওয়া-দাওয়া করে নিন। যাব। 

—আপনি বই করার কথা ভাবেন না? 

–বই? 

—হ্যাঁ। কবিতার বই। এমন অসাধারণ রচনা আপনার। কবিতার পাঠককে বঞ্চিত করতে পারেন না আপনি। 

—আমি তো ভাবিনি এসব 

—ভাবুন এবার। 

—কে করবে বই? আমি তো কারওকে চিনি না। তা ছাড়া কোথায় যেতে হয়, কাকে বলতে হয়, আমি পারব না স্যার। 

—স্যার কী! দাদা বলুন। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি ষাট-সত্তরটা কবিতা বেছে রাখুন। তারপর আমি দেখব। 

—ষাট-সত্তরটা! 

—হ্যাঁ। একটা চারফর্মার বই করুন। ছোট কবিতাগুলো একপাতায় দুটো করে দেব।

—চার ফর্মা? 

–ফর্মার হিসেব জানেন না? এই দেখুন। এগুলো জানতে হবে তো। ঠিক আছে পরে বোঝাচ্ছি। আগে অন্য কথা বলি। 

বলাই মণ্ডল তাকিয়ে থাকেন। উজ্জ্বল পরামানিক কথা বলে যান—আপনার কবিতা আমি কলকাতার একটি বড় প্রকাশকের কাছে নিয়ে যাব। ওঁরা যদি ছাপেন, আমার ধারণা ছাপাবেন, তা হলে তো হয়েই গেল। যদি না ছাপেন, আমি ছাপব। আমার প্রকাশনীও আছে। যদিও খুব বেশি বই আমি করি না। এ পর্যন্ত পাঁচটি বই করেছি। এক্ষেত্রে কবিকে কিছু খরচ করতে হয়। 

—খরচ? 

— হ্যাঁ। সামান্য। সেসব পরে হবে। আগে দেখি বড় প্রকাশক কী বলে। 

—পয়সা খরচ করে নিজের বই ছাপব? 

—কবিতার বই এভাবেই ছাপা হয় ভাই। তবে আমার আশা, আপনাকে তা করতে হবে না।

—আমি ভেবে দেখি। 

—হ্যাঁ ভেবে দেখুন। আর একটা কথা। 

–কী? 

—বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা পাঠাচ্ছেন, তা পাঠান। কিন্তু চট করে কারওকে অনেকগুলো কবিতা দিয়ে দেবেন না। ধরুন বলল বই করবে, তবু দেবেন না। 

—বেশ। দেব না। কিন্তু কারণ জানতে ইচ্ছে করছে। 

উজ্জ্বল পরামানিক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন—এগুলো বিশ্রী কথা। আপনাকে বলতে হচ্ছে বলে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনাকে যা বুঝছি, আপনি কিছুই জানেন না। এখনও শৈশবের পবিত্রতা আছে আপনার মধ্যে। আর সেজন্যই আপনার কবিতায় এই অসামান্যতা। শিশুর অভিব্যক্তিতে কোনও ছলনা থাকে না বলে শিশুর হাসি-কান্না দুই-ই সুন্দর। আপনার লেখাতেও কোথাও কোনও ছলনা নেই। সম্পূর্ণ সৎ আপনার লেখা। জানবেন আপনার লেখা-চোরের অভাব হবে না। 

—লেখা-চোর? 

—হ্যাঁ। লেখা-চোর। যেমন সুর চুরি হয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র চুরি হয়, তেমনি কবিতাও চুরি হয়। অখ্যাত লেখকের বিষয় চুরি করে লিখে দেন বিখ্যাত লেখক। এমনকী গোটা গল্প চুরি করে নিজের নামে ছেপে দিয়েছে এমনও হয়েছে। 

—সে কী! 

—হ্যাঁ। কবিতার চিত্রকল্প চুরি করা তো সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কবিতার বাক্যবন্ধও চুরি যায়। আমিই পাঠিয়েছিলাম কবিতা একটি বিখ্যাত পত্রিকায়। সে-কবিতা ছাপা হয়নি। কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে দেখলাম ওই পত্রিকার সম্পাদক স্বয়ং লিখেছেন যে-কবিতা, তাতে হুবহু আমার কবিতার কয়েকটি লাইন। 

—তারপর? 

—তারপর আর কী! খ্যাতির কাছে অখ্যাতির পরাজয় হল। কাকে বোঝাব আমি? কাকে বলতে যাব! এতে যে নিজেরও অবমাননা! 

—ওঃ ভগবান! 

—আমি জানি, এসবই আপনার কাছে ক্লেদ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কবি, ক্লেদ থেকেও তো কুসুম ফোটে। আমি শুধু আপনাকে সাবধান করে দিলাম। বহু লুব্ধ চোখ পড়বে আপনার কবিতা। যেটুকু ক্লেদ আপনাকে দিলাম আজ, তার থেকে কুসুম ফোটান আপনি। আমি সে-কুসুম জনদুয়ারে পৌঁছে দেবার দায় নিলাম। 

বলাই মণ্ডল হাসলেন। ম্লান সে হাসি। তাঁর মনে হল, যতদিন আড়াল ছিল, ততদিনই ভাল ছিল। সত্যিই এ ক্লেদ সহ্য হয় না। প্রকাশ তাঁকে এ কোথায় নিয়ে চলেছে! কিন্তু, কিন্তু এক ভাবনা ঘিরে ধরে তাঁকে, ওই যে মানুষটা, তিনি তো মিথ্যে নন, তাঁর কবিতাকে ভালবাসা তো মিথ্যে নয়, কবিকে খুঁজে খুঁজে তিনি পৌঁছেছেন এই অখ্যাত গ্রামে—তার মূল্য তো মিথ্যে নয়। 

তিনি উজ্জ্বল পরামানিকের হাত ধরেন। বলেন—আমি দেব আপনাকে কবিতা। কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব আপনাকে! 

উজ্জ্বল পরামানিক বলেন—কৃতজ্ঞতা নয়। আমি ধন্য কবি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *