2 of 3

রাজপাট – ৬০

৬০

কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর; 
কোথাও ভোরের বেলা রয়ে গেছে—তবে। 
অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে—অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয় 
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে; 
এ কোন সিন্ধুর সুর; 
মরণের—জীবনের? 
এ কি ভোর? 
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু। 

.

তিনজন শিক্ষিকা ও একটি আয়া নিয়ে নিবেদিতা বাগচীর ‘প্রথম পাঠ’। দোতলা এই বাড়িটা নিবেদিতা বাগচীর বাবা, অবসরপ্রাপ্ত কংগ্রেসি প্রধানশিক্ষক পশুপতি বাগচীর। একতলায় চারটে কক্ষের মধ্যে তিনটি ক্লাসের জন্য নেওয়া হয়েছে, একটি শিক্ষিকাদের বসার ঘর। দোতলার চারটি কক্ষের মধ্যে তিনটিতে বাবা-মা-মেয়ের বসবাস। একটি স্কুলের জন্য নেওয়া কেজি টু-এর ক্লাসটি এখানে নেওয়া হয়। ক্লাসের জন্যই সম্পূর্ণ আলাদা দেওয়াল তুলে কক্ষটিকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছে। 

গ্রীষ্মের ছুটির পর স্কুল খুলেছে ক’দিন হল। এখনও পড়া তেমন জমে ওঠেনি। দারুণ গরমে শিশুগুলি নেতিয়ে পড়েছিল। শিক্ষিকাদেরও গলা শুকিয়ে উঠছিল তাদের সামাল দেবার জন্য। 

এ-বাড়ির গায়েই একটি বিদ্যুতের খুঁটি। অনেকগুলি তার এই খুঁটিকে কেন্দ্র করে টানা হয়েছে চারদিকে। লম্বা-লম্বা টান-টান তার এ-বাড়ির ছাতের খুব কাছাকাছি। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ লম্বা মই লাগিয়ে দুটি লোক বিদ্যুতের খুঁটিতে কিছু কাজকর্ম করছিল। তাদেরই একজন নিবেদিতা বাগচীর কাছে এসে বলল—আপনাদের ছাতে যেতে হবে একবার। একটা তার টানতে হবে। ইলেকট্রিসিটি থেকে আসছি। 

নিবেদিতা তাকে যাবার অনুমতি দিয়েছিল। লোকটি ছাদে উঠে কী কাজ করছিল, নজর রাখার প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করেনি। অন্য একজন তাদের বাড়ির গায়েই মই ঠেকিয়ে তার হাতে করে উঠছিল, তা সত্যি। 

প্রতিদিন দুপুর একটায় টিফিন হয়। এ সময় দিদিমণিরা ঘরে বসে এটা-ওটা খান। শিশুদের দেখাশোনাও চলে। আয়া একজন মাত্র হওয়ায় তার ছোটাছুটির বিরাম নেই। বিশেষত নার্সারি ও লোয়ার নার্সারির শিশুদের নিয়েই তার ব্যস্ততা। এই সময়, খানিক বয়ঃপ্রাপ্ত এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ায় চার-সাড়ে চার বছরের কেজি টু-এর ছাত্ররা নজরদারি পায় না তেমন। দোতলার ঘরটিতে টিফিনের আধঘণ্টা তাদের খুশিমতো বিচরণ। বারবার তারা নেমে আসে জলবিয়োগ করার জন্য। একজন এলে পিছু পিছু পাঁচজন আসে। আবার হুটোপাটি করে উপরে উঠে যায়। বার বার ওঠা-নামার, এ-ও তাদের এক খেলা। কারণ উদ্দাম ছুটোছুটি করবে তার জন্য এক চিলতে মাঠও বরাদ্দ নেই। মাঠের অভাব তারা সিঁড়িতে পুষিয়ে নেয়। চাঞ্চল্য তারা রুখে দেবে—তা এ বয়সের ধর্ম নয়। অতএব চলে এই ওঠা-নামা নিরন্তর। 

এমনই তিনটি শিশু দিদিমণিদের ঘরের সামনে এসে বলেছিল—দিদিমণি, আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। 

—কে ঢুকতে দিচ্ছে না? 

জিগ্যেস করেছিলেন রোকেয়া দিদিমণি। তারা বলেছিল-দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, ঢুকতে দিচ্ছে না। 

—বলো খুলে দিতে। না হলে আমি গিয়ে মারব। 

—ওরাও খুলতে পারছে না। 

—সে কী! 

কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে ঘুরছিল তখন কেজি-টু-এর ভিতরে। আগুনের বলয় ঘিরে ধরছিল শিশুগুলিকে। রোকেয়া দিদিমণি যখন ওপরে পৌঁছলেন তখন দেখলেন, দরজা বন্ধ। ভিতরে অসম্ভব দাপাদাপি ও চিৎকার। 

—দিদিমণি দরজা খোলো! দরজা খোলো! 

—দিদিমণি আগুন আগুন! 

—ও মাগো! মা মা! 

—দিদিমণি! দিদিমণি! মা! মা! 

কচি স্বরগুলি ত্রাসে আতঙ্কে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ দরজার এ-পারে আগুন পৌঁছোয়নি তখনও। ধোঁয়াও নয় এমনকী। কারণ এ দিকে কোনও জানালা ছিল না। রোকেয়া দিদিমণি চিৎকার করেছিলেন ওপর থেকে শিগগির এসো তোমরা। সর্বনাশ হয়ে গেল। 

পাগলের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন তিনি। চিৎকার শুনে পশুপতি বাগচী অন্য দিক দিয়ে নেমে স্কুল দিয়ে ঢুকছিলেন। দিদিমণিরা সকলেই বিহ্বল ধাক্কা দিচ্ছিলেন দরজায়। কিছু করুণ চিৎকার। কাশির শব্দ। আতঙ্কের চিৎকার। যন্ত্রণার চিৎকার। অসহায়তার চিৎকার। কান্নার বীভৎস তীক্ষ্ণ ধ্বনি। 

জানালার খোলা পাল্লা দিয়ে আগুন বেরোতে দেখে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সিদ্ধার্থ ও তৌফিক ছুটে এল তখন। দিদিমণিদের সরিয়ে উন্মত্তের মতো তারা ধাক্কা দিল দরজায়। পশুপতি বাগচী ছুটছিলেন ফায়ার ব্রিগেড এবং পুলিশে ফোন করার জন্য। পাঁচটি লোক উন্মাদ ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। পুড়ে যেতে থাকা শিশুগুলির আর্তনাদ তারা শুনতে পাচ্ছে তখন। একবার। দু’বার। তিনবার। চারবার। সিদ্ধার্থ একটি বেঞ্চ নিয়ে এল নীচ থেকে। সকলে মিলে বেঞ্চ দিয়ে ধাক্কা দিল এবার। বিশাল শব্দ করে ছিটকে খুলে গেল দরজা। আর ভলকে ভলকে বেরিয়ে এল আগুন আর ধোঁয়া। সিদ্ধার্থ কোনও দিকে না তাকিয়ে ঝাঁপ দিল আগুনে। কণ্ঠ ছিঁড়ে চিৎকার উঠে এল সকলের মুখে। যেন এইবার নাড়ি ছিঁড়ে অতল থেকে উঠে আসবে ভলকে ভলকে রক্ত! তৌফিক বলল—জল! জল! 

পশুপতি এরই মধ্যে এনেছেন একটি বালতি। নীচ থেকে পাওয়া গেছে স্কুলের বালতিটিও। এক বালতি, এক বালতি জল ঢালা হচ্ছে। ধোঁয়া ও আগুনের মধ্য থেকে চার-পাঁচটি শিশুদেহ নিয়ে বেরিয়ে এল সিদ্ধার্থ। নিবেদিতা ও অন্য দিদিমণিরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন শিশুগুলির ওপর। সিদ্ধার্থ ঢুকে গেল আবার। তৌফিকও এবার গেল তার সঙ্গে। জল পড়ছে অবিশ্রাম। ইতিমধ্যে আরও লোক এসেছে। আরও বালতি। পশুপতি আবার ছুটলেন হাসপাতালে ফোন করার জন্য। অ্যাম্বুলেন্স চাই। সেই সঙ্গে পরমেশ্বর সাধুখাঁকেও ফোন করলেন তিনি। এখন ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে আসছে ফায়ার ব্রিগেড। 

একতলার শিশুদের সকলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটি কক্ষে। স্কুলের আয়া সুধন্যা সিদ্ধার্থর বাড়ি আগলে রেখেছে যে, তার মেয়ে, আতঙ্কিত শিশুগুলিকে নিয়ে বসে আছে একা। একটি কক্ষের বেঞ্চ পাশের কক্ষে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দ্রুত। আর ফাঁকা সেই ঘরে পাশাপাশি শুইয়ে দেওয়া হয়েছে পোড়া, আধ-পোড়া, অচৈতন্য শিশুদের। 

মোট পঁচিশটি শিশু আজ কেজি-টুতে উপস্থিত ছিল। হাসছিল। খেলছিল। ছুটছিল। টিফিন বার করেছিল খাবে বলে। তিনজন বাইরে ছিল বলে তারা জীবিত। বাকি বাইশটি দেহ শুয়ে আছে স্পন্দনহীন। সারি সারি। না। ওই তো, ওই তো কয়েকটি দেহে সামান্য স্পন্দন! বেঁচে আছে। ওই ও বেঁচে আছে। ও কে? শৌভিক। ওই তো, ওই তো মধুমিতা নড়ছে। আর ও, নাসেরা খাতুন, তারও চোখের পাতা নড়ে উঠল। পল্লব জল চাইছে, জল! একে একে দশটি প্রাণের লক্ষণ ফুটে উঠল দেহে। বাকি বারোজন নিথর। 

অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। পুলিশ এসেছে। পরমেশ্বর সাধুখাঁ, দেবেশ্বর সাধুখাঁ এবং রাসুদা এসেছেন। 

একটি একটি করে শিশু তুলে নিচ্ছে হাসপাতালের কর্মীরা। একজন, তার চুল পুড়ে গেছে সম্পূর্ণ। মুখ ঝলসে গেছে। একজন, তার মুখ নির্মল। অটুট। কিন্তু দেহ পোড়া। একজন, তার দেহে ঝলসানো ছাপ। 

একজন, তার কোনও পোড়া নেই। দাহ নেই। তার দম বন্ধ হয়ে গেছে। এবং এরকমই বাকি সব। পোড়া নেই। দাহ নেই। দম বন্ধ হয়ে গেছে। 

হাসি-খুশি প্রাণগুলি, খেলে বেড়ানো প্রস্ফুটিত প্রাণগুলি শব হয়ে ঢুকে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে।

খবর ছড়িয়ে গেছে শহরে। ভিড় উপচে পড়ছে এখন। বাচ্চাদের অভিভাবকরা চিৎকার করছে। কাঁদছে। পাগলের মতো আছড়ে পড়ছে মাটিতে। যার গেছে, সে-ও কাঁদছে। যার যায়নি সে-ও কাঁদছে। 

প্রায় সত্তরটি শিশুর শতাধিক উন্মত্ত অভিভাবকের আর্তনাদ ও বিলাপ জনতার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করেছে। চূড়ান্ত অবহেলার অভিযোগে নিবেদিতা বাগচীকে তারা ছিঁড়ে ফেলতে চায়। নিবেদিতা কাঁদছে। দিদিমণিরা কাঁদছেন। তবু শিশুগুলির শুশ্রূষা করে চলেছেন তাঁরা। 

পুলিশ অভিভাবকদের সামলানোর চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক নেতারা সামলানোর চেষ্টা করছেন। অ্যাম্বুলেন্স রওনা দেবার সঙ্গে সঙ্গে অর্ধেক জনতা হাসপাতালের দিকে ছুটল। পশুপতি অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন। পুলিশের একটি গাড়ি গেল অ্যাম্বুলেন্সের পিছনে। 

জনতা সামান্য হালকা হতে অন্য শ্রেণির শিশুগুলিকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দিতে শুরু করল আয়া সুধন্যা। কী এক অনুভূতিতে শিশুগুলি কাঁদছে। কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কেউ চিৎকার করে। কেউ ভয়ে বিবর্ণ। মাকে পেয়ে ভয়ে মুখ গুঁজে দিচ্ছে বুকে। 

এই নারকীয় পরিস্থিতিতে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। নির্বাক হয়ে গেছে পুলিশ। 

দ্বিতীয় দল নিতে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে আবার। দেবেশ্বর সাধুখাঁ চলে যাচ্ছেন শিশুগুলির সঙ্গে। তিনি সঙ্গে নিয়ে নিচ্ছেন সিদ্ধার্থকে। সিদ্ধার্থর গাল- কপাল ঝলসে গেছে। পুড়ে গেছে ডান বাহুর ওপরের দিক। ঝলসে গেছে পিঠ-বুক। কিন্তু এতটুকু যন্ত্রণাকাতর শব্দ সে করছে না। সম্পূর্ণ নির্বাক সে। 

তৌফিক যেহেতু ঢুকেছিল কিছু পরে, সেহেতু পোড়েনি সে। সামান্য ঝলসেছে। কিন্তু সেও নির্বাক। দগ্ধ, মৃত, অর্ধমৃত শিশুদেহগুলি টেনে টেনে বের করছে তারা! 

সিদ্ধার্থর চোখ দিয়ে জল পড়ছে এবার। তার মুখ বেঁকে-চুরে যাচ্ছে। দাঁতে ঠোঁট কামড়েও সে কান্না নিবারণ করতে পারছে না। তাকে এখনও ঘিরে আছে শিশুদেহগুলি। এরা স্পন্দনশীল। এরা জীবিত। এদের দেখে সিদ্ধার্থর কান্না পেয়ে যাচ্ছে মৃতদের জন্য। তার নিজের শরীরের সামান্য জ্বালা-যন্ত্রণাও সে বোধ করছে না। যদিও, হঠাৎ আগুনে ঢুকে পড়ায় সে দু’হাতে চোখ রক্ষা করেছিল কিন্তু তার ভ্রূ, তার চুলের কিছু অংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। সে গ্রাহ্য করছে না কিছুই। কান্নার বেগে শব্দ করছে সে। দেবেশ্বর হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার পিঠে। বলছেন—শান্ত হও। শান্ত হও। সিদ্ধার্থ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *