2 of 3

রাজপাট – ৫৮

৫৮ 

আষাঢ় মাসের দিনে
মন বরিষণ। 
গরিব হউহুড়ির ঘর 
বিনাই কান্দন ॥ 
পেটো নাই ভাত কেউরর 
পিন্নো নাই তেনা। 
কন্যার বাড়ি দিত কিতা 
নিজেরঅই জোটে না ॥ 
দারুণ বেয়াইনে নু মনো 
বুঝ না পায়। 
আমকাবলীর লাগিয়া পুতোর 
বউরে খুচায় ॥

ধারা বরিষণে ক্লান্ত আকাশ হতে ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছিল রাত্রি। দিনের পারাবারের নিকট যখন সে, তখন এ ধরণীর গায়ে নীলের আভাস লাগে। এই সকালের আগে, প্রত্যুষেরও আগে ওই নীলের বেলায় ছিল কিছু প্রলম্বিত অন্ধকার। কারণ অত বড় আকাশের দেহ আঁকড়ে তখনও ভাসমান ছিল খণ্ড খণ্ড মেঘ। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। সরাল গাঁয়ের জন্য ধরিত্রী এনেছিল এক বিষাদসকাল। 

বসির খানের গল্প যখন থেমে যায়, তখনও রাত্রির অনেক চলা বাকি। 

এই সকল গল্পই, কিংবা গল্প না বলে যদি কাহিনী বলা যায়, এই সকলই, জানা ছিল সিদ্ধার্থর। কারণ সে এক ইতিহাসবিদের পৌত্র এবং স্বয়ং সে পাঠ করেছিল ইতিহাস। তা ছাড়া, জেলা মুর্শিদাবাদে নবাবি আমলের সকল কাহিনী আজও বাতাসে বাতাসে ফেরে। এবং ফিরবে ততদিন, যতদিন নবাবি আমলের একটিও ইট থাকবে মহাকালের নির্দিষ্ট পরিণাম হতে নিজেকে বাঁচিয়ে। 

তবু এই সকল কাহিনীই আবার শোনা যায়। গানেরই মতো এই সকল কাহিনী। একই সংগীত, গায়কের গায়কি ভেদে যেমন নতুন হয়ে ওঠে, তেমনই, বলার ভঙ্গিতেও পৃথক মহিমা নিয়ে কাহিনীগুলি সেজে ওঠে নতুন করে। 

সেই কাহিনীও যখন থেমে গেল, দুলু বাউলের শ্রীকণ্ঠেও যখন আর সুর গুনগুনিয়ে উঠল না, বৃষ্টি থেমে এল, কেবল সিক্ত পাতাগুলি, শাখা-প্রশাখাগুলি, বাসস্থান ছেয়ে থাকা খড়ের আঁটিগুলি আপন ছন্দে জল ঝরাতে থাকল তখন ঘুম নেমে এসেছিল তাদের চোখে। তারা পরস্পর গায়ে হেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন। 

এই ভারী বর্ষণে জল হয়েছে গঙ্গায়। কানায় কানায় হয়ে উঠেছে ফরাক্কার নদী। ঘোলা স্রোতে উঠছে ঘূর্ণিপাক। সিদ্ধার্থ দেখছে, কনক ডুবে যাচ্ছে, সে সাঁতরাচ্ছে, কনককে তুলে নেবার জন্য সাঁতরাচ্ছে, অথচ তার হাত এত ভারী, পা এত ভারী, দেহ এত জমাট যে একটি হাত তুলতেই তার কেটে যাচ্ছে এক যুগ। আর কনক, তার হাতের কাছে এসেও ফসকে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, ভেসে উঠছে, ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে…! 

দম আটকে আসছিল তার। সে চিৎকার করছিল—কন-ও-ও-ও-ক 

সরাল গ্রামের কাক, ভেজা নীড় হতে বেরিয়ে তখন ধরা গলায় ডাক দিচ্ছিল। সে জাগল তন্দ্রা ভেঙে। এ গ্রামের প্রান্তে বয়ে গেছে গঙ্গা। পাড় ভাঙছে সে। ভূমি গ্রাস করছে। মাটি-কাটারা তাকে আবাহন করছে আরও। কোনওদিন এই অবধি এসে যাবে নদী? চৌকাঠে এসে সাপটে সুপটে খেয়ে যাবে গৃহস্থের অন্ন? 

সকালে ঘরে জলের চিহ্ন দেখে বারে বারে ক্ষমা চাইলেন অশ্বিনী। প্রাতরাশ হিসেবে চা-মুড়ি খেয়ে তারা অশ্বিনীর সঙ্গে এল চণ্ডীতলায়। সিদ্ধার্থ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল লোক জমা হয়ে আছে সেখানে। এরই মধ্যে তার আগমন প্রচারিত হয়েছে গ্রামে। যাঁরা এসেছেন তাঁদের বয়সের রকমফের আছে। অধিকাংশই কৃশ, কালো, বিষণ্নমুখী। কারণ অশ্বিনী হালদারের সমস্যা তাঁদেরও করেছে জর্জরিত। একই দুখে তাঁরা দুখী। 

এঁরা সকলেই রাজনৈতিক নন। তবু রাজনীতি নিয়ে কিছু পরিমাণ ভাবনাচিন্তা করতেই হয় সাধারণ মানুষকেও ইদানীং। কারণ পঞ্চায়েতে বিপুল ক্ষমতা এসে যাবার পর গ্রামীণ জীবনের মান, উন্নয়ন, এমনকী দুঃখ-সুখ পঞ্চায়েতি সততা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

তারা যখন নমস্কার বিনিময় করছে, তখন মোটরবাইক হাঁকিয়ে এল একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। বাইক থেকে নেমেই হাঁক-ডাক শুরু করল সে। 

—আরে নমস্কার করো তোমরা। নমস্কার করো। ইনি কে তা জানো? 

অতঃপর বিগলিত-হাস্য লোকটি এসে দাঁড়াল তার সামনে। হাতজোড় করে বলল—আমি সমীর সাউ। সি পি এম-এর হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবার। মানে এ গ্রামের আমিই নির্বাচিত প্রতিনিধি। 

নমস্কার বিনিময় করল সিদ্ধার্থ। সমীর সাউ বলল—শুনলাম আপনি অশ্বিনীদার বাড়িতে ছিলেন। একটু আগে খবর পেলে আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম। কোনও অসুবিধে হত না আপনার। 

সিদ্ধার্থ দেখল অশ্বিনী হালদার সরে যাচ্ছেন সামনে থেকে। সে বলল—আমার তো ওখানে কোনও অসুবিধা হয়নি। 

—তা ঠিক, তা ঠিক। 

এবার কাছে এল সে। গলা নামিয়ে বলল—আপনি ঠিক কী বিষয়ে বলবেন? মানে আপনার কাজটা এখানে ঠিক কী? 

সিদ্ধার্থ বলল—সেটা জানতে হলে আপনাকে এখানে থাকতে হবে। 

—না মানে বলছিলাম, আগে জানলে লোক জমিয়ে দিতাম আমি। 

—আমি তো লোক জমাতে চাই না। 

সে সমীর সাউকে উপেক্ষা করে এবং উপস্থিত মানুষগুলিকে বলে—আপনারা আজ্ঞা করলে আমি বসতে পারি। 

চণ্ডীতলার বাঁধান বারান্দা পরিষ্কার। শুকনো। হয়তো ভেজা ছিল, কেউ মুছে দিয়ে গেছে। বসতে গেলে বারান্দার মেঝেতে বসা ছাড়া কোনও উপায় নেই। উপস্থিত ভদ্রজন হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। সমীর সাউ চিৎকার করল—মোড়া মোড়া। 

সিদ্ধার্থ বসে পড়ল বারান্দায়। বসির খানকে নিয়ে দুলুক্ষ্যাপা বসল এক প্রান্তে। সিদ্ধার্থ বলল—বসুন, আপনারা বসুন। আমি এখানে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি জানতেও চাই না এই গ্রামে কোন দলের আধিপত্য। কে কোন নীতিতে বিশ্বাস করেন। হ্যাঁ, আমি নিজে একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। কিন্তু আমি চাই আমার কাজে দলমত নির্বিশেষে লোক যোগদান করুক। কারণ যে-কাজ করার পরিকল্পনা আমি নিয়েছি তা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আমি কারওকে জোর করব না। শুধু সকলের কাছে এই অনুরোধ রাখব, আপনারা আমার প্রস্তাব ভেবে দেখবেন। কারও কিছু বলার থাকলে বলবেন। আমি প্রত্যেকের মতামত শুনতে আগ্রহী। 

সিদ্ধার্থর বলার মধ্যে আছে আন্তরিকতা, আছে জোর। আছে আত্মবিশ্বাসের আলো। এই সবই আছে কারণ সে যে-উদ্দেশ্যর কথা বলছে, তা-ই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য। এর মধ্যে কোনও ছলনা নেই। কোনও সুবিধা নেবার গোপন পরিকল্পনা নেই। এমনকী তার পরিকল্পনাকে সে নির্বাচনমুখী করতেও রাজি হয়নি। সে ধীরে, শান্তভাবে, তার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে। বলতে থাকে—প্লাবন নিয়ন্ত্রণ বা ভাঙন প্রতিরোধ কোনও চটজলদি পদ্ধতি নয়। নদীকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তার জন্য চাই সময়। চাই অর্থ। চাই বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং তার প্রণয়ন। আমাদের প্রত্যেককে তা বুঝতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে। আমরা যদি চটজলদি সমাধানের প্রলোভন পরিত্যাগ করে, অবৈজ্ঞানিক বাঁধ ইত্যাদির সাময়িক অব্যাহতিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি, তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে আমরা যে-ফল পাব তা সুদূরপ্রসারী হবে। অন্যথায় কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ হবে। কিন্তু প্লাবনও থাকবে। কোটি টাকা ব্যয়ে স্পার হবে। কিন্তু ভাঙনও চলতে থাকবে পাড় বরাবর। আপনারা যে কষ্ট পাচ্ছিলেন, তার থেকে মুক্তি মিলবে না। 

.

প্রথমে ছিল ত্রিশজন প্রায়। এখন লোক বাড়ছে। মাথার ওপর ঘন মেঘ নিয়েও চণ্ডীতলার বারান্দা ঘিরে আছে অন্তত পঞ্চাশজন লোক। একজন দু’জন করে আসছে আরও। দাঁড়াচ্ছে। একজনের কাঁধের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছে অন্যজন। চণ্ডীতলার বারান্দায় আর বসার জায়গা নেই। 

সিদ্ধার্থ এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে তার বক্তব্যের সাফল্য বলে ধরছে না। গ্রামে জীবনের বৈচিত্র্য কম। কিছু ঘটছে জানলেই লোক সেখানে উঁকি মারে। দাঁড়ায়। অতএব, সে জানে, এই কথা বলা তার কাজের সূচনামাত্রও নয়। তাকে বারবার আসতে হবে। বারবার বলতে হবে। বলতে বলতে মনে গেঁথে দিতে হবে বক্তব্যের সারবস্তু। তখন, হয়তো এই পঞ্চাশজনের মধ্যে তিনজন অনুপ্রাণিত হবে। ওই তিনজনের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে আরও শক্তি বর্ধনে। ব্যবস্থাপনায়। জনসংযোগের মাধ্যমে কোনও দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে এ ছাড়া পথ নেই। 

সে বলতে থাকে—আপনাদের মনে করতে হবে, এ এক আন্দোলন। 

ওসমান গনি নামের একজন কৃষক হাত তোলেন। বলেন—আপনার পরিকল্পনাগুলি কী কী? 

সিদ্ধার্থ বলে—কিছুদিনের মধ্যে আমরা জেলাভিত্তিক কমিটি গঠন করব। কমিটিতে যাঁরা থাকতে চাইবেন, তাঁদের স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে। কমিটি তৈরি হলে আমরা নদীবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেব এবং এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ সঙ্গে রেখে পরিকল্পনা করব। কিন্তু তার আগে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু সমাধান, প্লাবন ও ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কী কী হতে পারে, তার কিছুটা ধারণা আপনাদের দিই। 

একফোঁটা-দু’ফোঁটা বৃষ্টি নামে তখন। চণ্ডীতলার ছাদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল যারা, তাদের কয়েকজন ছাতা খুলল। একই ছাতার নীচে দাঁড়াল দু’ তিনজন। কিন্তু কেউ চলে গেল না। সিদ্ধার্থ বলল—প্রথম কথা হল, বন্যা নিয়ন্ত্রিত হলে ভাঙনের অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আসে। নদীর দু’পাড় উঁচু করে বাঁধিয়ে দিলে নদীর জলধারণের ক্ষমতা বাড়ে। এ হল বন্যা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। কিন্তু এই কাজটি সুপরিকল্পিত হতে হয়। যে-মাটিতে পাড় তৈরি হয়, দেখতে হয় তার গুণাগুণ। এবং মাটির বাঁধ সবসময় নদীর তীব্র স্রোত সহ্য করতে পারে না। 

—হ্যাঁ পারে না। আমাদের এ-গাঁয়ের প্রান্তে বাঁধ ছিল একদা। নদীর স্রোতে ধুয়ে ধুয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। 

বললেন ওসমান গনি। 

অপর একজন কথা বলল এবার। তারপর আর একজন। 

—হ্যাঁ, তার ওপর মাটি কেটে নদীকে এদিক পানে টেনে আনছে। 

—সেচ করা যাচ্ছে না। আমাদের জমি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। 

সমীর সাউ চিৎকার করে আরে বলতে দাও। ওঁকে কথা বলতে দাও। তোমাদের কথা কে শুনতে চাইছে? 

—আমি শুনতে চাইছি। 

সিদ্ধার্থ শান্ত গলায় বলে। ঝিরঝিরে বারিপাত রুদ্ধ হয়ে যায় আবার। সিদ্ধার্থ বলে- আপনারা কথা বলবেন নিশ্চয়ই। আপনাদের অভিজ্ঞতা, মতামত, প্রশ্ন—যা থাকে বলবেন। 

ভিড়ের মধ্যে ব্যঙ্গ ওঠে—আরে সাউয়ের পো, ভাগ। 

—কে? কে বলল কথাটা? 

—শালা মাটিমাফিয়ার চামচা! 

–কে? কে? কে? 

সমীর সাউ জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে চারপাশে তাকায়। জনতা নিরীহ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমীর সাউ রুমাল বার করে ঘাড় মোছে বারবার। অশ্বিনী হালদার দু’হাত তুলে বলেন-আরে রও তোমরা। কথা শুনতে দাও। 

সিদ্ধার্থ শুরু করে আবার। সে টের পায়, জনগণ এখন তার কথায় মনোযোগী। সে বলে চলে—হ্যাঁ, মাটির দেওয়াল নদীর স্রোত সহ্য করতে পারে না বলে বাঁধ দিতে হয় নদীর পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মোটামুটিভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে-ব্যবস্থাগুলি করা হয়, সেগুলি হল—

নদীর পাড়ে দেওয়াল নির্মাণ—এক 

নদীর বুকে জলাধার নির্মাণ— দুই 

খাল খনন করে অতিরিক্ত জল অন্য খাতে বইয়ে দেওয়া—তিন 

নদীর পাড়ের ক্ষয়রোধ—চার

জলনিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি সাধন—পাঁচ 

খালের সংস্কার সাধন—ছয় 

পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর বুকে জমা বস্তু খুঁড়ে নদীর অববাহিকা গভীর করে তোলা—সাত 

নিচু গ্রামগুলিকে উঁচু জায়গায় স্থাপন—আট 

এ ছাড়া ভূমিক্ষয় রোধের জন্য গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে এবং প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। বনসৃজন করে সবুজ করে ফেলতে হবে চারিদিক। এখন, কথা হচ্ছে, একই নদীর সঙ্গে এক- এক জায়গায় এক-এক আচরণ করতে হয়। নদীর কোন অংশে কোন আচরণ প্রয়োজন, তা নির্দিষ্ট করবেন বিশেষজ্ঞরা। আপনারা জানেন বন্যা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। ভাঙনও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। নদী এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে। এর কোনও ব্যত্যয় নেই। কিন্তু ভাঙনের হাত থেকে কিছু নিষ্কৃতি পেতে আমরা দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আন্দোলন করতে পারি—

মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলি বন্ধ করা—এক 

পুনর্বাসনের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা করা—দুই 

ওসমান গনি বললেন—আপনি বলছেন জলাধার নির্মাণের কথা। জলাধারগুলি থেকে যখন বাড়তি জল ছাড়ে তখনও তো বন্যা হয়। তা ছাড়া এই যে ফরাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে, তার জন্যও ভাঙন বাড়ছে শুনতে পাই। 

সিদ্ধার্থ বলে—ঠিক কথা। এই সমস্যারও সমাধানের উপায় আমাদের খুঁজতে হবে। 

অন্য একজন বলে—বাঁধের কাজ যে সেখানে ঠিকমতো হয় না, লোকে ভুষিমাল দেয়, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করে নেতারা লাখ টাকা কামায়, তার কী হবে! 

—তার বিরুদ্ধে আমরা একজোট হব। 

—আপনিও একজন নেতা। আপনাকে আমরা বিশ্বাস করব কেন? কিছুদিন পরে এসে আপনিও ভোট চাইবেন। 

—ভোট চাইতেই পারি। 

সমীর সাউ বলে—কাকে কী বলছিস? এই নিয়ামত। কাকে কী বলছিস? 

সিদ্ধার্থ হাত তোলে। বলে—ভোট চাইতে তো পারিই। তার সঙ্গে কাজের তো কোনও বিরোধ নেই। নির্বাচনে যে দাঁড়ায়, সে জনপ্রতিনিধি। জনগণ সমর্থন দিয়ে তাকে ক্ষমতাসীন করে। লোকবলেই জনপ্রতিনিধির বল। এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ক্ষমতার অপব্যবহার যদি কেউ করে জনগণই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। এখন কথা হল, আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন কেন? নিশ্চয়ই। করবেন না। আপনারা আমাকে দেখুন। বুঝুন আমি কেমন। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনারা আমার কথাগুলো নিয়ে ভাবুন। ভেবে দেখুন আমি ঠিক বলছি কি না। আমি চাই ব্যাপক আন্দোলনের জন্য সংহত শক্তি। আপনাদের উপলব্ধিই সেই শক্তির জন্ম দিতে পারে। তা ছাড়া, নেতৃত্বের কাছে সততার প্রত্যাশা ন্যায়সঙ্গত। অধিকারসম্মত। যখন রাজতন্ত্র ছিল, জনপ্রতিনিধি বলে কিছু ছিল না। রাজাই ছিলেন নায়ক। সমস্ত ক্ষমতার অধীশ্বর। এই রাজার কাছেও প্রজাদের ন্যায় ও সততার প্রত্যাশা ছিল। এই বাঁধের প্রসঙ্গেই বলি। তামিলনাড়ু রাজ্যে চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি, অর্থাৎ আজ থেকে ছয়শো বৎসরের বেশি আগেকার একটি জলাধার পাওয়া গেছে। তার নাম অনন্তরাজ সাগর জলাধার। এই জলাধার থেকে বেয়াল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় আজও জলসেচ হচ্ছে। 

একজন বলে—ছয়শো বৎসর ধরে বাঁধ অটুট রয়েছে? 

—ছয়শোরও বেশি। প্রায় সাতশো বলা যায়। ওই জলাধারের কাছাকাছি একটি মন্দিরে দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। 

—শিলালিপি কী হয়? 

—পাথরে খোদাই করে রাখত অনেক কথা আগের মানুষ।

—হ্যাঁ, পাঁচথুপি গ্রামে ছিল এমন, না?

—হ্যাঁ, পাঁচথুপিতে ছিল। 

—তা সেই শিলালিপি না কী বললেন, তাতে কী লেখা ছিল? 

—লেখা ছিল জলাধারটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দু’বছর। এক হাজার শ্রমিক তা নির্মাণ করেছিল। জলাধার কেমন জায়গায় হবে, তার কিছু নির্দেশ লিখে রেখেছিল ওখানকার লোকেরা। সেই নির্দেশের প্রথমটি কী ছিল জানেন? 

–কী? 

—দেশের রাজা হবেন সৎ, ধনী, সুখী ও যশোপ্রার্থী। দেখুন এখানেও চাই রাজার সততা। কারণ রাজকোষের ধনভাণ্ডার তো প্রজারই অর্থ। প্রজারই দেওয়া খাজনা। সেই অর্থ, রাজা সৎ হলে, বিলাস-ব্যসনে ব্যয় না করে, প্রজাহিতে ব্যয় করবেন। রাজাকে হতে হবে ধনী ও সুখী। অর্থাৎ রাজাকে হতে হবে সুশাসক। তাঁর শাসনে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকবে না। চুরি-ডাকাতি, ক্ষয়-মহামারী থাকবে না। গৃহযুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহ ধননাশ করে। মৃত্যু-মহামারী, অন্যায় সুখ নাশ করে। এগুলি সামলাতেই যদি রাজার দিন যায়, তা হলে রাজা কল্যাণবিধান করবেন কখন? আবার রাজার শুধু ধনী ও সুখী হলেই চলবে না। যশের আকাঙ্ক্ষা যদি না থাকে, তা হলে তিনি প্রজার মনোরঞ্জন করতে চাইবেন না। দেখুন, এর প্রায় সবই কি আজও প্রযোজ্য নয়? আজ রাজা নেই, জনপ্রতিনিধি আছেন। কিন্তু লোকহিতের জন্য আজও দেশে চাই শান্তি, যুদ্ধবিহীনতা, সমৃদ্ধি। 

কয়েকজন হাততালি দেয়। মেঘ ফাটিয়ে রোদ্দুর ওঠে সামান্য। সিদ্ধার্থ বলে—এক গেল। এবার বাকি আর কী লেখা ছিল, বলি? 

—বলেন বলেন। 

—দেশে নদীবিদ্যায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি থাকা দরকার— দুই 

জলাধারের ভূমি হবে শক্ত মাটির—তিন 

অন্তত চব্বিশ মাইল দূরত্বে মিষ্টি জলবাহী নদী থাকবে—চার

বাঁধের দু’পাশে সংযোগকারী পাহাড় প্রয়োজন—পাঁচ

বাঁধ হবে শক্ত পাথরের। অনতিদীর্ঘ কিন্তু শক্তিশালী—ছয়

বাঁধের দু’পাশে ফলের বাগান থাকা বাঞ্ছনীয় নয়–সাত

জলাধার হবে গভীর ও প্রশস্ত—আট 

শক্ত পাথরের খনি কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন—নয় 

বাঁধের কাছাকাছি নিচু, উর্বর, সেচযোগ্য জমি থাকা প্রয়োজন—দশ 

ঘূর্ণিযুক্ত পাহাড়ি নদী থাকা দরকার—এগারো 

জলাধার নির্মাণের কাজে অভিজ্ঞ একদল কারিগর প্রয়োজন— বারো 

জনতা হর্ষধ্বনি করে। এত আগে এইরকমই সব ভাবা হত? বিস্ময় জাগে তাঁদের। ওসমান গনি বলেন—কেন? তার কত বৎসর আগে ভগীরথ গঙ্গা এনেছিলেন, সে কি এমনি? তাঁরও এমনি কোনও উপায় জানা ছিল। 

অশ্বিনী হালদার বলেন—মারাঠা রুখতে আলিবর্দি খাঁ যে-খাল কাটালেন, সেই গোবরনালাও তো সেচের কাজে লেগেছে। 

—লোকে আগে আরও বুদ্ধিমান ছিল। 

—তা ছিল। 

সিদ্ধার্থ বলে—আপনারা ভাবুন। আমি আবার আসব। 

—আসবেন, আসবেন। 

ধ্বনি ওঠে। সমীর সাউ হাত কচলায়। হেঁ হেঁ করে। 

সিদ্ধার্থ বলে—এমনি করে সকল গ্রামে যাব আমি। বলব। তারপর আন্দোলন গড়ে তুলব।

লোকে বলে—গড়ে তুলব, গড়ে তুলব। 

ঠিক শ্লোগানের মতো শোনায় না তাদের কথা। তারা যেন কীসের প্রত্যাশা করছিল, কোনও এক পদধ্বনির, শুনতে পাচ্ছে তার অস্পষ্ট আওয়াজ। 

অশ্বিনী হালদার বলেন—নদীর পাড়ে যাবেন না? দেখবেন না? 

সিদ্ধার্থ প্রতিবাদ করে—আপনি আমাকে তুমি বলেছিলেন কাল। পুত্রতুল্য বলেছিলেন কাকা।

অশ্বিনী হাসেন। তাঁর মুখে চিন্তার অকাল বলিরেখাগুলি স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন— আঁধারে যারে ইচ্ছা করে, দিনমানে তারে আর সহজ লাগে না বাবা। তুমিই বলব, তুমিই বলব। তোমার কথা শুনে প্রাণে বাতাস লাগে। এমন আগে হয় নাই। 

সমীর সাউ এগিয়ে এল। বলল—নদীর পাড়ে যাবেন নাকি সিধুদা? আমার বাইকে আসুন।

অশ্বিনী বললেন—যাও। আমরা হেঁটে যাচ্ছি। যাও। বসির ভাই, তুমিও যাও। হয়ে যাবে তিনজনার। 

এতক্ষণে দুলুক্ষ্যাপার দিকে নজর পড়ে সকলের। লোকের চোখে-মুখে আনন্দের বিভা জেগেছিল, দুলুক্ষ্যাপাকে দেখে তা উদ্ভাসিত হয়। হইচই ওঠে—আরে বাবাজি, আপনি এখানে কী মনে করে? 

দুলুক্ষ্যাপা হাসে। বলে—লোক দেখলাম, বসে পড়লাম। আর ইনি যা বলেন ভাল, একেবারে এঁটে গেলাম যেন। 

—গান হোক, গান হোক। 

বলল একজন। সমস্বরে গানের অনুরোধ এল অতঃপর। সিদ্ধার্থ দুটি গান শুনে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করল। দুলুক্ষ্যাপাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল জনতা। দুলু বাউল ঝোলা হতে ঘুঙুর নিয়ে বাঁধল একপায়ে। আজ আর বসে বসে গান নয়! আজ ধরল সে নাচও। তার চোখ দীপ্ত। মুখে উজ্জ্বলতা। দোতারায় শব্দ তুলে পায়ে তাল দিয়ে দিয়ে গাইতে শুরু করল সে—  

আমার মন বলেছে আমি পাপী 
পাপের নড়ি গলায় ধরি 
পাপের রঙে বসন ছাপি 
পাপ ধরেছে ষোলো আনা
তাঁহার চরণ ছুঁতে মানা
অমানিশি কেটে গেল
অমাবস্যে কেটে গেল
তবু, পুণ্যিমে তো হল না
পাপের তীর্থ কণ্ঠে ঝোলে 
মন কেন না গুরু বলে
মহম্মদ সাঁই গুরু বলে
পাপের সঙ্গী গুরু ভজনা
দুলু বলে পাপী তাপী
চাঁদের আশায় রাত্রি যাপি
এই ভবের তলে নাই ঠিকানা
মন কারেও পাপী ভেবো না 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *