2 of 3

রাজপাট – ৫৪

৫৪ 

পাড়াগাঁর দু’ পহর ভালোবাসি-রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে
স্বপনের;— কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো— কেবল প্রান্তর
জানে তাহা, আর ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে 
যেন এ-জনমে নয়—যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে 
এ হৃদয়—

এমনকী শষ্পহীন ছিল সে প্রান্তর। তৃণহারা। শুকনো খটখটে। জ্যৈষ্ঠে যে বারিপাত হয়েছিল তার সব জল শুষে ফের চিৎকৃত নিদাঘে শুকিয়ে কঠিন সে মাটি। আষাঢ়ের প্রথম, দ্বিতীয় দিবস গিয়েছে। মেঘ নেই। আউশের আবাদ যারা শুরু করেছিল, তাদের কচি চারাগাছগুলি দিশেহারা। তবুও ওই গাছের অস্তিত্ব অভিশপ্ত করে দেয়নি ভূমি, যেমন এখানে। এখানে এসে তারা থমকে দাঁড়িয়েছে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যায়। ধু-ধু ভূমি। লোকমাত্র নেই। অতদুর পথ হেঁটে যেতে-যেতে তারা বুঝি সুস্থ ছিল না আর। তৌফিকের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। সিদ্ধার্থ বলেছিল—চল ফিরি। 

—ফিরবে? 

—হ্যাঁ। এভাবে হবে না। একদিনে গিয়ে ফিরে আসা, হবে না এভাবে। গ্রামে গ্রামে রাত্রিবাস করতে হবে তৌফিক। 

—সময় যে অল্প। 

—হোক না। 

—রাসুদা যেমন বলছিলেন, ব্লকের পার্টি অফিসগুলিতে যোগাযোগ করে বললেই গ্রাম থেকে লোক আনার ব্যবস্থা ওরা করবে। 

—সেভাবেই লোক আসে। সেভাবেই মিছিল হয়। সমাবেশ হয়। যান্ত্রিকভাবে হয়। কী লাভ তাতে? আমি এরকম চাই না। আমি চাই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া। সংযোগ। তার জন্য নিজেদের যেতে হবে। গ্রামের সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। ওদের সমস্যা নিজের করে ভাবতে না পারলে ওই একদিনের মিছিল করেই কাজ ফুরিয়ে যাবে। আন্দোলন তাকে বলে না। আন্দোলন একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার। তার প্রস্তুতিও দীর্ঘ হওয়া দরকার। 

—তিনমাসে আমরা কতদূর কী করতে পারব? 

—কাজ করতে শুরু না করলে তার ওজন বোঝা যায় না। যদি তিনমাসে না হয়, আমরা সময় নেব আরও। এ বিষয়ে রাসুদার সঙ্গে কথা বলতে হবে আবার। 

ফিরছিল তারা। তৌফিকের জ্বর আসছিল। ফেরার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল তৌফিকের জন্যই। তৌফিক লজ্জিত হয়ে উঠেছিল। বলছিল—বারবার বাধা আসছে। 

—বাধা তো আসবেই। সবকিছু কি সহজে হবে? 

বরকত আলির মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হলে তারা ভেবেছিল কয়েকটি গ্রাম ভ্রমণ করবে। বৃষ্টির জন্য তা সম্ভব হয়নি। এখন নিদাঘ তাদের নিরস্ত করেছে। এই রোদ্দুরে তৌফিক হয়ে উঠেছে জ্বরতপ্ত। সে বলছে—আমরা যদি ওই তারিখের মিছিল করে দিই কোনওভাবে, তারপর, মানে তুমি যেভাবে বলছ, সেভাবে কাজটা করি আবার। 

—না। যা প্রয়োজন, তার সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে তার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে চাওয়া বৃথা। নিজের আবেগ যেখানে জড়িত নয় সেখানে লোকে অর্থের বিনিময়ে আসে, চাপে পড়ে আসে। তা কেবল লোক-দেখানো প্রয়াস। সেরকম কত মিছিল তো হয় আমাদের। প্রতীকী কোনও কিছুই করতে গেলে হাস্যকর লাগে। হাসপাতালের সামনে চিৎকার করে আইন অমান্য, আমরণ অনশন শুরু করে চব্বিশঘণ্টায় হাসি-হাসি মুখে শরবত খেয়ে নেওয়া, আধঘণ্টায় বেরিয়ে আসবে জেনেও কারাবরণ, পয়সা দিয়ে লোক এনে সমাবেশের শক্তি প্রদর্শন, এগুলো মনে হয় হাস্যকর। ছেলেমানুষি। 

—সবাই তো এই পথ ধরেই কাজ করে। সব দল। 

—আমিও করেছি। করি। কিন্তু এখন আর মন মানে না। এই প্রবঞ্চনার বাইরে থাকতে ইচ্ছে করে। সত্যিকারের ভাল কিছু করতে মন চায়। রাজনীতিতে আমার কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই রে তৌফিক। কিংবা হয়তো ভুল বললাম। আমি এমনভাবে রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছি যে আমার আর আলাদা কোনও স্বার্থ নেই। রাজনীতিই আমার অস্তিত্ব। কিন্তু আমি দ্বিতীয় এক মিহির রক্ষিত হতে চাই না। আমি রাসুদাও হতে চাই না। রাসুদার ছেলে ঠিকেদারি করছে এখন। মিহিরদার দু’ ভাই ঠিকেদার। ছেলেটাও বড় হয়ে উঠল। হয় ঠিকেদারি করবে, নয় রাজনীতি। নিজেদের পরিষ্কার রেখেছে ওরা। কিন্তু ভেতরে কী হয়, আমরা জানি তো। 

—কোন পার্টিকে বাদ দেবে তুমি? কংগ্রেসের আনিসুর রহমানের শ্যালককে জানো তো? 

—জানি। মালদার নামকরা ঠিকেদার হাসিনুর চৌধুরী। 

—তা হলে? 

—সাধুখাঁদের কোনও ঠিকেদার আত্মীয় নেই। 

—ওদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও নেই। 

—তা হলে? তৌফিক, সবাই বিষিয়ে যায়নি। আমাদের পার্টিতেই আছেন এমন অনেক নেতাব্যক্তি, যাঁদের বিরুদ্ধে অন্তত অসততা বা লোভের অভিযোগ নেই। মুশকিল মধ্যমমানের নেতৃত্ব নিয়ে বা একেবারে নীচের স্তরের পার্টিকর্মীদের নিয়ে। প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে মানিয়ে চলাটাই একমাত্র প্রবণতা হয়ে না দাঁড়ায়। 

— যেমন? 

—রাজনীতি কিছু কূটকৌশল অবলম্বন করে। কোথাও কোথাও তার দরকার আছে। কিন্তু রাজনীতির একটা নৈতিক দায়িত্বও আছে। যে-আন্দোলন মানুষের অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠবে, তাতে কোনও ফাঁকি চলে না। 

তৌফিককে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিল। নিজের ঘরে বসে কাজ করছিল। ইতস্তত না ঘুরে সে চাইছিল ভাগীরথী ও পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম ও শহরগুলির একটা তালিকা করে নিতে। সঙ্গে ছোট নদীগুলি, যেমন ভৈরব, যা ভাঙন দ্বারা অসহায় করছে জনজীবন, তাদেরও দেখে নিতে পর-পর। আর এই ভাঙন-কবলিত গ্রাম-শহর দেখতে দেখতে সে জানে, তার দেখা হয়ে যাবে গ্রামের আরও সকল বিষয়। দেখা হয়ে যাবে সেইসব গ্রামও, যা নদীর ধারে নেই। 

বিকেলে সে একবার তৌফিকের বাড়িতে গেল। তৌফিকের বাবা এবং দাদা দু’জনেই স্কুলে পড়ান। তৌফিক কোনও কাজকর্মের সন্ধান না করে শুধুই পার্টি করে বেড়ায়, এ বিষয়ে তার দাদার আপত্তি আছে। কিন্তু তৌফিকের বাবা নিহারুল ইসলাম সহনশীল মানুষ। স্বাধীনচিত্ত। কারও স্বাধীন সিদ্ধান্তে বাধা দেওয়া তাঁর স্বভাব নয়। 

রুগ্‌ণ দেখাচ্ছিল তৌফিককে। ইতিমধ্যে ডাক্তার দেখানো হয়েছে তাকে। তাপ লেগে এই জ্বর। সিদ্ধার্থ কিছুক্ষণ বসল তৌফিকের কাছে। তাদের কথা হয়েছিল, সপ্তাহের প্রথম তিন দিন তারা বেরিয়ে গ্রামে যাবে। চার দিন শহরে থেকে যাবে। আবার দু’দিন পরে ওই যাবার দিন স্থির হয়ে আছে। তৌফিক বলল—তুমি কি যাচ্ছ সিধুদা? 

—যাব। 

—আমি যাব না? 

—পরের বার যাবি। সেরে ওঠ। 

—কাকে নিয়ে যাবে? 

—দেখি। কারওকে না পেলে একাই যাব। 

—রাসুদার সঙ্গে কথা বলবে তো? 

—হুঁ। আজই বলব। ফোন করেছিলাম। রাসুদা যেতে বলেছেন। 

তৌফিক চোখ বন্ধ করে। রোগক্লান্তি ঘিরে ধরছে তাকে। সিদ্ধার্থ উঠে পড়ল। দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছে শুনল রাসুদা তাকে তাঁর বাড়িতে ডেকেছেন। জরুরি প্রয়োজন। সে রাসুদার বাড়িতে গেল। মিহির রক্ষিত ছিলেন সেখানে। সঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকজন। নির্বাচনী প্রচারের কর্মসূচী নিয়ে কথা হচ্ছিল। যে কয়েকমাস এখনও বাকি আছে তার মধ্যেই কয়েকটি জরুরি সভা, সমাবেশ ও পদযাত্রার আয়োজন করা দরকার। অন্যান্য দলগুলি যে- বিষয়গুলিকে নিয়ে সভা করবে, সেগুলি বাদ দিতে হবে। কংগ্রেস অনুপ্রবেশ রুখে দেবার জন্য আন্দোলনের আয়োজন করছে। আর এস পি স্বকৃত উন্নয়ন তুলে ধরার জন্য কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং বি জে পি-র হিন্দুত্বপরায়ণতাকে বিষয় করেছে। অতএব সি পি আই এম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির ওপর কেন্দ্রের বিমাতাসুলভ মনোভাবকেই নতুন করে প্রচার করবে আবার কংগ্রেসের আমলে যা ছিল, এখন মোর্চা সরকারের পদক্ষেপও একই পথ অনুসরণ করে, একথাই বলবে তারা। প্রমাণ হিসেবে তারা তুলে ধরবে তাদের দাবি। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কেন্দ্রের নজর কাড়তে চাইবে তারা। ভাঙন দুর্বিপাক শুধু জেলা মুর্শিদাবাদেরই সমস্যা নয়। পদ্মা ও ভাগীরথীর মধ্যে কমে আসছে দূরত্ব। ফাজিলপুরের কাছে পদ্মা ও ভাগীরথীর দূরত্ব এখন মাত্র দু’ কিলোমিটার। পদ্মা ও ভাগীরথী মিলেমিশে গেলে মুর্শিদাবাদের গঙ্গা-পদ্মার পাড় থেকে কলকাতার হুগলি নদী পর্যন্ত গোটা অঞ্চলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। অতএব বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙনরোধের দাবি নিয়ে পদযাত্রা একাত্ত প্রয়োজনীয়। 

রাসুদা বললেন—যোগাযোগগুলো করা হয়েছে তো সিধু? 

সিদ্ধার্থ বলল—না। 

—কেন? 

—আপনি আমাকে গ্রামে ঘুরে কাজ করতে বলেছিলেন।

—হ্যাঁ, বলেছিলাম। 

—গ্রামগুলো ঘুরে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এই আন্দোলন গড়ে তুলতে আরও সময় লাগবে রাসুদা। 

—গ্রামে ঘোরার প্রয়োজনীয়তা আছে সিধু। সেটাই আমাদের কাজের পদ্ধতি। সমস্ত স্তরেই আমরা সংগঠনকে জোরদার করতে চাই। সেটা আমাদের সারাজীবন ধরেই করে যেতে হবে কিন্তু এই মিছিল আমাদের পয়লা অক্টোবর করতেই হবে। এটা নির্বাচনী কর্মসূচীর অঙ্গ। 

—রাসুদা, লোককে আন্দোলনের উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। না হলে এই আন্দোলন করে কী লাভ! 

—আন্দোলনের লাভ সবসময়ই আছে। তুই ব্লকস্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এক-একটা ব্লক থেকে পাঁচশো লোক এলেই আমাদের আন্দোলন সফল হবে। আমাদের প্রত্যেকের জন্য কাজ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। তোকে এবার এ কাজটা করতে হবে। 

—রাসুদা, আমার সময় লাগবে। এটা মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত। তাড়াহুড়ো করে, কোনওরকমে একটা প্রতিবাদ কিংবা জাগরণী আন্দেলন করে লাভ কী! 

—শোন, আমরাই এটা নিয়ে প্রথম কাজ করছি না তো। মুর্শিদাবাদে নদীও কিছু নতুন পাড় ভাঙছে না। এটা পুরনো সমস্যা। লোককে আলাদা করে তো কিছু বোঝাবার নেই। 

—আছে। বোঝাবার আছে। সাধারণ মানুষের ধারণা বাঁধ দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমরাও এই দাবিই করি। কিন্তু এটা সার্বিক সমাধান নয়। কোথাও কোথাও বাঁধ আরও বড় ক্ষতি করে। 

—সেটা তাদের বোঝাবার দরকার নেই। কোথায় কী দরকার তার জন্য সেচদপ্তর আছে। তাদের বাস্তুকাররা আছেন। বিশেষজ্ঞ আছেন। আমাদের দরকার আন্দোলন করে কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা আদায় করা। 

—টাকা যা আসে, সঠিক উপায়ে খরচ হয় কি? 

—মানে? 

—বাস্তুকার বা বিশেষজ্ঞের মতামতের ওপর সাধারণ মানুষ চাপ সৃষ্টি করে। চটজলদি সমাধান পেতে তারা বাঁধ দিতে বাধ্য করে সেচ দপ্তরকে। আমরাও তাতে ইন্ধন জোগাই। এই জায়গাটাই বোঝাতে হবে প্রথমে। না হলে টাকা আসবে। খরচও হবে। সমস্যার সমাধান হবে না। 

রাসুদার মুখ শক্ত দেখাল। ধীরে ধীরে তিনি এই ছেলেটির ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছেন। আজ্ঞা যিনি করেন, তিনি চান বিনা প্রশ্নের আজ্ঞাবহ। প্রশ্নের স্পর্ধা দু চারবার ক্ষমা করা গেলেও একসময় তা দুঃসহ ঠেকে। অতএব রাসুদা বললেন—তোমাকে যা করতে বলা হচ্ছে, তুমি তা-ই করো। তোমার বক্তব্য আমরা পরে ভেবে দেখব। 

সিদ্ধার্থ বলে—পরে কবে? রাসুদা? আপনিই বললেন এটা পুরনো বিষয়। এটা নিয়ে অনেক মিছিল, সভা, আন্দোলন, লেখালিখি হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কেন? তার কারণ এই যে, কেউ বিষয়টা নিয়ে তলিয়ে ভাবছে না। এটা একটা ইসু মাত্র। ইসু। যা নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত হয়। 

উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল সে। তার মুখ লাল দেখাচ্ছিল। উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন রাসুদাও। তিনি বললেন— দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর কথা বলার অধিকার তোমার নেই। আমরা সকলে মিলে ভেবেচিন্তে এই কর্মসূচি নিয়েছি। তোমাকে যা বলা হয়েছে করো। না হলে ছেড়ে দাও। আমরা আর কারওকে দায়িত্ব দেব। এবং সে ক্ষেত্রে তোমাকে মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে বড় কোনও কাজের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হবে কি না তা আমাদের বিবেচনাধীন। 

কান গরম হয়ে উঠেছিল তার, এক মুহূর্ত বাকরুদ্ধ হয়েছিল সে। রাসুদা যা বললেন তা একরকম অপমানবিজড়িত আদেশ। সে যদি রাজি হয়, তা হলে সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করা হল। যদি রাজি না হয়, তা হলে দলের মধ্যেই সে ব্রাত্য হয়ে গেল। এই মুহূর্তে তাকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা নিয়ন্ত্রণ করবে তার ভবিষ্যৎ। দলে নিজের অবস্থিতির ক্রমোত্থান অভীষ্ট হলে তার উচিত রাসুদার সুনজরে থাকার চেষ্টা করা। হ্যাঁ এবং না-এর মধ্যে দোলায়িত হচ্ছিল সে। তার অহং সজাগ হয়ে উঠছিল। সে অযৌক্তিক বলেনি একটি কথাও। তা হলে সে বশ্যতা স্বীকার করবে কেন? 

তখন কথা বললেন মিহির রক্ষিত—দেখ হে ছোকরা। তুমি নিজেকে বেশি বড় নেতা মনে করতে শুরু করেছ। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হলে এরকম হয়। শুনে রাখো, দল তোমাকে জায়গা না দিলে তোমার কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। সবসময় নিজের মত ফলানোটা তোমার বদভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। 

সে উঠে দাঁড়াল। বলল —রাসুদা, আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।

মিহির রক্ষিত বললেন—রাসুদা, আপনি আমাকে দায়িত্ব দিন।

রাসুদা বললেন—বোস। যাচ্ছিস কোথায়? 

সে বসল। আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিল সে। কিন্তু তার বিপরীতে, তার পাশে বসে থাকা, মুখগুলি আবেগরহিত। পোড়খাওয়া। শাসনের তর্জনী তোলার আকাঙ্ক্ষায় কঠিন। সে সামলে নিল নিজেকে। রাসুদা তাকে দিলেন সভা বা পদযাত্রাগুলির প্রস্তুতির কাজ। এ কাজ তার চেনা। সে মেনে নিল। 

ফেরার পথে আরও একবার তৌফিককে দেখতে গেল সে। কী কথা হল জানতে চেয়েছিল তৌফিক। সে বলল। তৌফিক বলল—মিহির রক্ষিত তোমাকে কোনও কাজ করতে দেবে না সিধুদা। লোকটা তোমাকে ঈর্ষা করে। 

—কে জানে! 

সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। ভার হয়ে থাকছিল তার মন। তৌফিক বলল— আরও একজন ঈর্ষা করে তোমাকে। 

—কে? 

—মোহনদা। 

—না না। জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল বকিস না তৌফিক। আমার আছে কী যে ঈর্ষা করতে যাবে? 

—করে। তুমি বোঝো না। কারণ তোমার মনে কোনও ঈর্ষা নেই। 

—ঈর্ষা? কেন ঈর্ষা তৌফিক? ঈর্ষা করে কী পাবে? 

—সেটা তুমি ভাবো। অন্যরা তা ভাবে না। তুমি এখনই এত পরিচিত হয়ে উঠেছ, ওরা মানতে পারে না। 

—সেই পরিচিতির জন্য তো আমার কোনও অবদান নেই তৌফিক। 

—তুমি মনে করো নেই। 

—যাক ওসব। আমি ও নিয়ে ভাবি না। পরিচিতি হল বুদ্বুদের মতো। যতক্ষণ নানা ঘটনাক্রমে কেউ চোখের সামনে আসছে, তাকে লোকে মনে রাখছে। কোনওভাবে সরে গেলেই লোকে ভুলে যাবে। পণ্যের বিজ্ঞাপনের মতো। তবে এটা ঠিক, কাজ করতে গেলে পরিচিতি সহায়ক হয়। 

—তা হলে? তোমার পরিচিতি ওদের ঈর্ষার কারণ হবে না কেন? 

—জানি না তৌফিক। এসব ছেড়ে আমাদের কাজের কথা ভাবতে হবে এখন। রাসুদা যে কাজ দিয়েছেন, করি। 

—তা হলে আর যাচ্ছ না এখন গ্রামে? 

—কেন যাব না? 

—যাবে? 

—যাব। শহরগুলোয় যাব না। শুধু গ্রামে। এ বরং একপক্ষে ভাল হল তৌফিক। গ্রামগুলো চেনা হবে। শুধু ঘুরব। শুধু দেখব। গ্রাম না চিনলে এ দেশের কিছুই চেনা হয় না। 

—আমাকে নেবে তো সঙ্গে? 

—নেব। সুস্থ হয়ে ওঠ। 

.

বাড়ি ফিরে বোধিসত্ত্বের কাছে গেল সে। ভোরবেলা ওঠেন এবং ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি, এই নিয়মেই বোধিসত্ত্ব চলেছেন চিরকাল। রাত্রি দশটার পর আর জাগ্রত থাকেন না। ইদানীং মাঝে-মধ্যে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়। কারণ সিদ্ধার্থর সঙ্গে তাঁর কথা বলার সময় ওই রাত্রিটুকুই। প্রতিদিন কথা হয় না। যেদিন সিদ্ধার্থ আসে, সেদিনই কেবল। বোধিসত্ত্ব তখন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটান। তারও মধ্যে আছে এক সুখ। আজকের পার্টির সিদ্ধান্ত বোধিসত্ত্বকে জানাল যখন সিদ্ধার্থ, বোধিসত্ত্ব বললেন—তুমি ভালই করেছ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে। ওরা ওদের মতো করে কাজ করুক। তুমি আস্তে আস্তে তৈরি হও। মানুষের প্রথম আনুগত্য কার কাছে থাকা দরকার জানো? 

—নিজের কাছে। 

—হ্যাঁ। নিজের কাছে। নিজের চিত্তবৃত্তির কাছে। স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। কিন্তু তার মাত্রার তারতম্য আছে। স্বাধীন চিন্তা বিকাশের শক্তি থাকে না সকলের। যার থাকে সে গড়ে তোলে। সে নেতৃত্ব দেয়। সে আবিষ্কার করে। তোমার আছে সেই শক্তি। প্রশ্নহীন আনুগত্য তোমার স্বভাব নয়। মানুষ অনুগত হয় স্বার্থে অথবা সম্মোহনে। তুমি সম্মোহিত হতে পারবে না। ক্ষুদ্র স্বার্থও তোমার নেই। অতএব চিন্তা কোরো না। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছ, সেই মতো কাজ করো। অধিকার কী? সামান্য বেঁচে-বর্তে থাকার মতো সংস্থানও যাদের জোটে না তারা সামান্যকে আঁকড়ে তাকেই মনে করে চরম অধিকার। সেই সামান্যর বোধ থেকে তাকে বের করে আনাও সেবা একরকম। এবং একরকম বিপ্লব। তুমি সেই বিপ্লবের পথে যাও। 

সিদ্ধার্থ দেখছিল বোধিসত্ত্বকে। আশ্চর্য এই মানুষ। সিদ্ধার্থকে তিনি কখনও গৃহমুখী হতে পরামর্শ দেননি। ব্যক্তিজীবন নাশ করে জনসেবকের কাজে জড়িত হওয়া থেকে নিবৃত্ত করেননি। বরং প্রবৃত্ত করেছেন। ভালমানুষির সহজ পরামর্শও তিনি দেননি। বোধিসত্ত্ব কি জানেন না, আধুনিক রাজনীতি নিষ্কলুষ নয়? জানেন। কারণ রাজনীতি কখনও কলুষতাহীন ছিল না। রাজনীতি জনসেবার পথ। কিন্তু রাজনীতি দ্বন্দ্ব, হিংসা, হানাহানি, কাপট্য এবং ছলনার পথও বটে। চিরকাল। এখানে নির্ভেজাল ভাল থাকা যায় না। একশো ভাগ সৎ হওয়া যায় না। এখানে যত আলো তত অন্ধকার। আলোর বৃত্তে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টার মধ্যেও কখন অন্ধকার ছুঁয়ে দিয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। এ সমস্তই, একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে, একজন সচেতন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে বোধিসত্ত্ব জানেন। সিদ্ধার্থও জেনে যাচ্ছে ক্রমশ। এবং বোধিসত্ত্ব সিদ্ধার্থর লব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে সঞ্চার করতে চাইছেন মহত্তর বোধ। বৃহত্তর প্রতিজ্ঞা। বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করেছেন কত অনায়াসে! অথচ বোধিসত্ত্ব নিজে সম্পূর্ণ গৃহস্থ মানুষ। কিংবা হয়তো তাঁরও মধ্যে ছিল এক নেতৃত্বচেতনা। পরিস্থিতি তাঁকে গৃহস্থ হতে বাধ্য করেছিল। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত। জনপ্রিয় ব্যক্তি। যত ঝড় তাঁকে সইতে হয়েছে তার পরেও এই বিকাশ ধর্ম তাঁকে রেখেছে প্রাণবান। সিদ্ধার্থ বার বার উপলব্ধি করে বোধিসত্ত্ব তার শক্তি। তার অবলম্বন। সে বলল— তুমি তা হলে এবার শুয়ে পড়ো দাদু। 

বোধিসত্ত্ব বলছিলেন- সম্প্রসারণ, সম্প্রসারণ। 

–কী দাদু? 

—নিজেকে ছড়িয়ে দাও ভাই। আমৃত্যু নিজেকে ছড়াতে ছড়াতে চলো। প্রসারণ ধর্ম নাও। জীবন যত বড় হয়ে উঠবে, তোমার আমিও ততই বেড়ে উঠবে। মানুষ কত বড় হতে পারে, তার সীমা নেই। 

সে বোধিসত্ত্বের দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে—তোমার চোখ কেমন আছে? 

বোধিসত্ত্ব বলেন—পর্দা পড়েনি। দেখতে পায়। 

—কান কেমন আছে? 

—পর্দা ওঠেনি। শুনতে পায়। 

–নাক কেমন আছে? 

—গন্ধ পায়। 

—জিহ্বা কেমন আছে? 

—রসবোধসহ দিব্য আছে। আজ খেয়েছি মাছের মুড়ো দিয়ে ভাজা মুগের ডাল। 

—ত্বক কেমন আছে? 

—খানিক কুঞ্চিত হয়েছে ভাই। তাকে টেনেও আর টান টান করা যাচ্ছে না। 

সিদ্ধার্থ হা-হা করে হাসে। বোধিসত্ত্ব হা-হা করে হাসেন। দু’জনের সম্মিলিত হাসিতে রাত্রির নৈঃশব্দ্য ভেঙে যায়। জনবিরল বাড়িটিকে মনে হয় জনবহুল। 

সিদ্ধার্থ ছোট ছিল যখন, পঞ্চ ইন্দ্রিয় বোঝাতে এই খেলাটি বোধিসত্ত্ব শুরু করেছিলেন। পরে এই সংলাপ তাদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের প্রতি অনুভূত আবেগ এই সংলাপের মধ্যেই তারা বোঝায় পরস্পরকে। বোধিসত্ত্ব বলেন—যাও ছোটবাবু, খাওয়া সারো। ওই মহিলাটি তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন। 

সে উঠল। টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসেছিলেন সাবিত্রী। সে বলল—তোমার খাওয়া হয়েছে? 

সাবিত্রী বললেন— হ্যাঁ, বাড়ির ছেলে খেল না, আমি খেয়ে বসে থাকি। 

—আমার জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করেছি তোমাকে। 

—রাখো তো তুমি। 

সেই একবস্ত্রে এসেছিলেন সাবিত্রী। আর যাননি স্বামীর ঘর করতে। খোঁজ-খবর রাখেন। ছেলে-মেয়েরা দেখা করে। তিনিও গিয়েছেন দু’চারদিন। কিন্তু থাকেননি। বলেন—পেটের ছা সব। ফেলতে তো পারব না। কিন্তু ওই বাড়িতে আর না। এই ভাল আছি। এখন ছেলেমেয়েরা এসে খোঁজ করে। 

খেতে খেতে সিদ্ধার্থ বলল—তোমার সত্যবান কেমন আছে সাবিত্রীদি? 

—ভাল না। 

বিমর্ষ মুখে বলেন সাবিত্রী। 

—কেন? কী হল? 

সে জিগ্যেস করে। 

—ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। নেশা-ভাঙও কম করত না। দেহে ক্ষয় লেগেছে। 

—চলছে কী করে তোমার বাড়িতে? 

—ছেলেটা কাজে লেগেছে। রিকশা টানছে। বড় মেয়েটাও ইস্কুলে আয়ার কাজ পেয়েছে।

—কোন স্কুল? 

—ওই যে নতুন হয়েছে গো? বাচ্চাদের ইশকুল! 

—বেশ। 

— দাদা। 

—বলো। 

—তাকে একটু সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে? 

—হাসপাতালে তো এমনি ভর্তি করবে না। ডাক্তার দেখে যদি মনে করে ভর্তি করা দরকার, তবেই। 

—লোকটা বাঁচবে না গো। 

সাবিত্রীর চোখ থেকে জল পড়ে। সিদ্ধার্থ দুঃখিত বোধ করে। সাবিত্রীর প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। এই মহিলা বড় করুণাময়ী, সে এবং বোধিসত্ত্ব দৈনন্দিন জীবনে তা টের পায়। যে-লোকটা নিত্য অত্যাচার করত, ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল যে, তার জন্য সাবিত্রী নামের মহিলা কাঁদছেন এখন। সে বলে—ছেলেকে বলো, নতুন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার সুখেন্দু সরকারের কাছে আমার নাম করতে। উনি দেখে দেবেন। 

সাবিত্রী চোখের জল মোছেন। সিদ্ধার্থ খাওয়া শেষ করে উঠে যায়। আজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিল বলে খবরের কাগজ পড়া হয়নি। সে খবরের কাগজ সামনে নিয়ে বজ্রাসনে বসল। তখন ফোন বাজল তার। সারা দিনে এমন ফোন আসে অনেক। কিছু কাজের। কিছু খবরের। কিছু যোগাযোগের। সে কথা শেষ করে এসে বজ্রাসনে বসল আবার। আসন শেষ করে খবরের কাগজে চোখ রাখল। তার মন এখন শান্ত। স্থির। সে জানে সে কী করবে এখন। প্রথম পদক্ষেপের পরিকল্পনা সমাপ্ত তার। আগে এ মাটিকে জানতে হবে, তারপর নতুন পরিকল্পনা। 

খবর দেখতে দেখতে সে এক জায়গায় থামে। খুঁটিয়ে পড়ে প্রতিবেদন। গণসঙ্ঘ নামে একটি গোপন সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি রাজ্যে। সশস্ত্র তাদের অভ্যুত্থান। দরিদ্র, অনুন্নত মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও সুরক্ষার দাবি নিয়ে তারা মুখ তুলেছে। এরা কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের আশ্রিত নয়। কোনও মতবাদের চেনা ছকে তাদের ধারণ করা যাচ্ছে না। এরা প্রতিবাদী—এই মাত্র। হয়তো কোনও শোণিত পিপাসু রাষ্ট্রের প্ররোচনা এবং সহায়তায় এই অভ্যুত্থান-এমন সব অনুমান করা হচ্ছে। যাদের নিয়ে এত কথা, তাদের দাবি, বঞ্চনার যে-পর্ব থেকে সাধারণ মানুষও বিদ্রোহী হতে শুরু করে, সে-পর্বে এই সংগঠনের জন্ম। সন্দেহ করা হচ্ছে, এই গণসঙ্ঘের নেতৃত্ব দিচ্ছে মাত্র সাতাশ বছরের এক যুবক। তার নাম নীলমাধব। কোন রাজ্যের অধিবাসী সে, জানা যায়নি। ভারতের কোন ভাষা তার মাতৃভাষা, জানে না কেউ। লোকে বলে, আটটি ভাষায় সে মাতৃভাষার মতোই সাবলীল। খবরের কাগজে তাকে জঙ্গি নেতা বলা হয়েছে। কিন্তু যে-অঞ্চলে তার ক্রিয়াকলাপ, সেখানকার মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। 

সিদ্ধার্থ প্রতিবেদনের মধ্যে ডুবে থাকল কিছুক্ষণ। এ ধরনের সশস্ত্র অভ্যুত্থান জনমানসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। কিন্তু সে সন্ত্রাস সমর্থন করে না। গোপন সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার অর্থ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এত বৃহৎ যে এই অভ্যুত্থানগুলি তারাবাজির মতো ঝলক দিয়েই মিলিয়ে যায়। কিংবা এই সংগঠনগুলি আত্মরক্ষার্থে এত ব্যস্ত থাকে যে প্রকৃত জনসংযোগের উপায় তাদের থাকে না। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কোনও আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব বলে সে মনে করে না। যদিও খবরের কাগজ পড়ে এই দলটির কর্মপদ্ধতি সম্যক অনুধাবন করতে পারছে না সে। এটাও ঠিক, কিছু জনসমর্থন না পেলে যে-সব এলাকায় এদের সক্রিয়তা, তা ঘটিয়ে তোলা সম্ভব হত না। অতএব, একেবারে জনসংযোগ নেই, বলা যাবে না তা। স্বাধীনতার আগে কমিউনিস্ট সংগঠন সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ভারতের স্বাধীনতায় তার অবদান ব্যাপক স্বীকৃতি পায়নি, কিন্তু তাতে কী এসে যায়! সত্তরে নকশাল আন্দোলন কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই একটি বৃহৎ শাখা হিসেবে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল। সেই প্রজ্জ্বলন সঠিক কি বেঠিক, সে জানে না। কিন্তু তার স্বপ্নকে, লক্ষ্যকে সম্মান করে। সশস্ত্র অভ্যুত্থান মানেই সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতা এমন ভাবলে একমুখী সরলীকরণ হয়ে যায়। ছোট শক্তি থেকেই বৃহৎ শক্তির জন্ম হতে পারে। সিদ্ধার্থ নিজের মনকে খোলা রাখতে প্রয়াসী হয়। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন… ইত্যাদি ভেবে সে কি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রচারিত গতানুগতিক ভাবনার মধ্যেই বাঁধা পড়ছে না? মানুষের ওপর আস্থা রাখতে চায় সে। একা একজন মানুষের নেতৃত্বক্ষমতা গোটা দেশে পরিবর্তন আনতে পারে। সে বেরিয়ে পড়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে এবং ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে চোখে। পূর্ণশক্তিতে ঘুরতে থাকা পাখার নীচে শরীর জুড়ে ঘনিয়ে আসে বিশ্রামের মুহূর্ত। সাবিত্রী এসে শাসন করেন। মশারির তাল নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলেন—আমাকে ডাকবে তো, মশারি টাঙিয়ে দেব! 

সে কথা না বলে উপুড় হয়ে শোয়। সাবিত্রী মশারি টাঙিয়ে গুঁজে দিয়ে যান চারপাশ। এই যুবকের বাপ-মায়ের কথা মনে করে তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে যান। আহা! সে বড় অশান্তি ছিল তখন! এই বাড়িকে লাগত শাপগ্রস্ত। তাঁরা গত হয়েছেন, শূন্য লাগে। আবার স্বস্তিও। সাবিত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ঈশ্বর স্মরণ করেন—ঠাকুর, এমন নিষ্ঠুর পথে কারওকে স্বস্তি দিয়ো না! 

দরজাঘণ্টি বেজে ওঠে তখন। সিদ্ধার্থ জেগে যায়। সাবিত্রী দরজা খোলার জন্য এগিয়ে যেতে থাকলে সেও যায় সঙ্গে। বলে—তুমি শুয়ে পড়ো সাবিত্রীদি। আমারই কেউ হবে। 

—রাত-বিরেতেও তোমার কাজ কমে না। 

সাবিত্রী আপন ভগিনীর মতোই গজগজ করে ফিরে যান। এবং সিদ্ধার্থ দরজা খুলে বসির খানকে দেখতে পায়। সে বলে—জরুরি দরকার ছিল দাদা। 

—এসো। 

তারা ভিতরে আসে। সিদ্ধার্থ দরজা বন্ধ করে দেয়। তাকায় বসির খানের দিকে। তাকে দেখাচ্ছে কিছু ফ্যাকাশে। ঘোর বিপদগ্রস্ত যেন-বা। সে রুমালে মুখ মুছে বলে—দাদা, বাঁচান আমাকে! 

—কী হয়েছে? 

সে জিগ্যেস করে। বসির খান আফরোজার কথা বলে তখন। আফরোজা তার বোন। এবার দশম শ্রেণিতে পড়ছে। সন্ধেবেলা গিয়েছিল টিউটোরিয়ালে পড়তে। রোজই যায়। পাড়ার আরও দুটি মেয়ের সঙ্গে যায়, আসে। আজ সে একা পড়তে গিয়েছিল। কারণ দুটি মেয়ের একজন যায়নি। একজন তার প্রেমিকের সঙ্গে গঙ্গার পাড়ে গিয়েছিল। আফরোজা পড়া করে ফিরে আসার সময়, কথা ছিল, তার বান্ধবী লীনা তার সঙ্গে পথে দেখা করে নেবে। সেইমতো লীনা দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায় আর আফরোজা হেঁটে আসছিল তার দিকে, তখন একটি মারুতি গাড়ি তার সামনে দাঁড়ায় আর নিমেষে আফরোজাকে গাড়িতে তুলে নেয়। নির্জন সে পথে লীনা চিৎকার অবধি করতে পারেনি। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে তখন প্রথমেই বসির খানের কাছে আসে এবং কিছুই না লুকিয়ে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে দেয়। বসির খান লীনাকে এই অনুরোধ করেছে যে সে যেন কারওকে না বলে একথা। সঙ্গে সঙ্গেই সে এসেছিল সিদ্ধার্থর কাছে। কিন্তু সিদ্ধার্থ ছিল না তখন। 

সিদ্ধার্থ মুখ শক্ত করে শুনছিল। এবার বলল—কারওকে সন্দেহ করো? 

বসির খান বলে—এ ওদের কাজ সিধুদা। ওরা ছাড়া কেউ নয়। 

—তুমি বলেছিলে দীপেন হাজরার দলের একজন তোমার বোন মেহেরকে উত্ত্যক্ত করত।

—আমার চার বোন। আফরোজা সবার ছোট। মেহের তার আগে। 

—পুলিশের কাছে যেতে হবে বসির খান। 

বসির খান তার হাত চেপে ধরে। কাতরভাবে বলে—পুলিশ নয় দাদা। পুলিশের কাছে গিয়ে আগেরবার তো কিছু হয়নি। 

—ক্লাব তোলা বন্ধ হয়েছিল তো। 

—কিছুদিনের জন্য। আবার তুলছে। আমরা যাতে কিছু না করি তাই ওরা আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। 

—আবার তুলছে তুমি তো জানাওনি। 

—খুঁজেছি আপনাকে বলার জন্য। পাইনি। আবার আমি আসতাম। তার আগেই এটা ঘটে গেল।

—এমন একটা ঘটনা পুলিশকে না জানালে চলবে কী করে! 

—দাদা, পুলিশকে জানালে কী হবে বুঝতে পারছেন? পাঁচকান হবে। আমার তিন বোনের এখনও বিয়ের বাকি। তাদের বিয়ে দিতে পারব না। 

সিদ্ধার্থ বসির খানের কথা উপলব্ধি করে। ধীরে ধীরে ক্রোধ উঠে আসে তার হৃদয়ে। আর হৃদয় হতে মস্তিষ্কে জুড়ে যায়। আগেরবার বসির খানের জন্য সে কিছুই করতে পারেনি দলীয় স্বার্থের চিন্তা করে। এবার সে দীপেন হাজরাকে ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারছে না। সে নীরবে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল—চলো। 

একবার ওপরে গেল সে। সাবিত্রীকে বলল—আমি বেরুচ্ছি। কখন ফিরব জানি না। আমি না ডাকলে রাত্রে আর কারও জন্য দরজা খুলবে না। 

—কোথায় যাচ্ছ? 

—কাজ আছে। 

পোশাকও পাল্টায় না সে। বাড়িতে পরিধেয় পাজামার ওপর শার্ট গলিয়ে বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে পথে হাঁটতে থাকে দু’জন। সোজা স্টেশনের দিকে যেতে থাকে। ঠুনঠুন শব্দে একটি রিকশা এসে দাঁড়ায় তাদের কাছে। রিকশাওয়ালা বলে— সিধুবাবু, কোথায় যাবেন? উঠে আসুন। 

সে রিকশার দিকে তাকায়। লোকটিকে চেনা লাগে। নাম মনে নেই। তাতে কিছু এসে যায় না। এ শহরের রিকশা ইউনিয়নকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছিল সে। গত বছর দু’দিন রিকশা ধর্মঘট করে রিকশাওয়ালার দৈনিক মজুরির হার সে এই শহরের অনুপাতে বৃদ্ধি করেছিল। এ শহরের রিকশাওয়ালারা অধিকাংশই রিকশার মালিক নয়। দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে তাদের রোজগার। রিকশার মালিকরা কেউ বাস-ট্রাকের মালিক। কেউ অন্য বড় ব্যবসাদার। কংগ্রেসের এক উদীয়মান নেতা রঞ্জুল ইসলামও এরকম বেশ কিছু রিকশার মালিক। তবু রিকশার মালিক ও চালকের মধ্যবর্তী চুক্তি চালকদের পক্ষে সন্তোষজনক ছিল না। সিদ্ধার্থর উদ্যোগে আয়বৃদ্ধির পর রিকশাওয়ালাদের মধ্যে সে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। 

সে বসির খানকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় উঠে বসে এবং স্টেশনের দিকে যেতে চায়। এই সময়, এই কাজের জন্য একমাত্র মির্জাকেই মনে পড়ছে তার। যদি কেউ কিছু করতে পারে, তবে সে-ই পারবে। 

প্রকাশ্যে সমাজবিরোধীদের মদত দেয় বলে মিহির রক্ষিতের বদনাম আছে। এ বদনাম তারও হতে পারত। হয়নি একমাত্র এ কারণেই, মির্জা তার কাজের এলাকা সীমিত রেখেছে। সাধারণ জনজীবনকে সে বিপর্যস্ত করেনি। সে ঠিকাদারের থেকে তোলা নেয়। কয়েকটি বড় দোকান থেকে তোলা নেয় এবং কিছু চোরাচালান সে করে থাকে। কিন্তু তার এলাকাকে সে রাখে সুরক্ষিত। সিদ্ধার্থর আশ্রয় সে লাভ করেছে বলে পুলিশ সহজে তাকে ছুঁতে পারে না। এবং পুলিশকেও সে দিয়ে থাকে ভাগ-বখরা। সিদ্ধার্থকে সে এনে দিতে চায় কিছু পরিমাণ অর্থ। সে রাজি হয়নি প্রথমে। কিন্তু দেখেছে, বহু উপকার আটকে থাকে অর্থের অপেক্ষায়। বহু দুঃখী মানুষের চিকিৎসা। মেয়ের বিবাহ। দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্রের পড়া। ইদানীং বিবিধ উন্নয়নকল্পে, এই টাকা সে প্রত্যাখ্যান করছে না। শম্ভু পালিত তাকে যে মাসোহারা দেয়, তাতে তার চলে কেবল নিজের এবং সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে দল থেকে সে পায় কিছু পরিমাণ। হাজার টাকা মাত্র। হাতখরচ হিসেবে টাকার পরিমাণ ভালই। কিন্তু হাতখরচেই থেমে থাকে না তার ব্যয়। তার দলের কয়েকজন, যেমন তৌফিক, তাদের কিছু না দিলে সবসময়ের কর্মী তারা হয়ে ওঠে কী প্রকারে! দলে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে তারা তালিকাভুক্ত নয়। হতে পারে তৌফিক ভবিষ্যতে কোনও পেশায় নিযুক্ত হবে। তখন তাকে বা তার মতো আরও যারা, তাদের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে গণ্য করা হবে না। তখন পেশাভিত্তিক উপার্জন তাদের অবলম্বন হবে। কিন্তু এখন তাদের কিছু দিতেই হয়। অলিখিত কিছু মাসোহারা। 

প্রথম দিকে টাকা নেবার ব্যাপারে সে ছিল কুণ্ঠিত। অনাগ্রহী। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে অর্থমুখী করেছে। তবে লোভী সে নয়। টাকার উৎস সম্পর্কে বাছ-বিচার কিছু করে। যদিও মির্জা যা তাকে এনে দেয়, তা সততার অর্থ নয়। কিন্তু সেদিক থেকে দেখলে এই অসৎ উপার্জনের থেকে তার মুক্তি নেই। যারা টাকা দেয়, অসৎ উপার্জন থাকে বলেই তারা রাজনীতির আশ্রয় খোঁজে। সাদাসিধা মাটির মানুষের কোনও আড়াল লাগে না। সে জানে দলীয় তহবিলও এভাবেই উপচে ওঠে। শুধুমাত্র সদস্যদের প্রদেয় বার্ষিক অর্থ খরচসাপেক্ষ তহবিলের পক্ষে যথেষ্ট হয় না। ব্যবসায়ীরাই সকল দলের উপার্জনের উৎস। যত বড় ক্ষেত্র তত বড় চুক্তি। জেলাস্তরে, রাজ্যস্তরে, কেন্দ্রে ব্যবসায়ীর কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে পর্যায়ক্রমে। অর্থের অঙ্কও বাড়তে বাড়তে যায়। এর বাইরে থেকে কিছুই করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর দলীয় তহবিল শুধু বৃদ্ধি করলেই হয় না। ব্যক্তিগত উপার্জন না থাকলে বহু কাজ পিছিয়ে যায়। সে জানে, বিষ্ণুপুর বিল বুজিয়ে যে কোটি টাকার আবাসন প্রকল্প করছে রত্নেশ্বর আগরওয়াল, তা সম্ভব হচ্ছে দলীয় তহবিলে লক্ষ টাকার অনুদান সে দিয়েছে বলেই। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয় না কোনও দল। যে-দল ক্ষমতায় থাকে, তারা পায় সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ। তারপর, ক্ষমতার বিচারে তহবিলের অনুদান বৃদ্ধি পায়। সব ধাপে ধাপে সাজানো। নিখুঁত অঙ্কের মতো অকাট্য। 

দলের যেমন শ্রেণি আছে, নেতারও আছে প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারির বিভাজন। সেই অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের প্রদত্ত অর্থের একভাগ দলীয় তহবিলে যায়, অন্য ভাগ নেতার ভাণ্ডারে। নেতা তাঁর মর্জিমতো জনকল্যাণে তা ব্যয় করেন। দল ব্যয় করে প্রচারে, কর্মীদের পালন-পোষণে। তবে অর্থের উৎস সর্বত্রই ব্যবসায়ীরা। এই চক্র থেকে মুক্ত নয় কেউ। পৃথিবীর কোনও দেশ। অতএব ব্যবসায়ীরাই পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। সিদ্ধার্থ তার বাইরে যাবে কী প্রকারে? 

মির্জা তার বন্ধু। মির্জার কাছ থেকে কোনও অর্থ সে নিতে চায়নি প্রথমে। জোর করেছে মির্জাই। বলেছে—আমার টাকা তোমাকে দিচ্ছি না। আমার উপার্জনের টাকাও না। ব্যবসার বখরাও না। আমি মাল আনি ঠিকাদারের থেকে। আমার এলাকা বাড়ছে সিধুভাই। তোমার জন্যই বাড়ছে। তোমার জন্য আলাদা করে টাকা তুলব আমি। তোমার টাকার দরকার আছে। শোনো, এ হল জনগণের টাকা। ঠিকাদাররা জনগণের টাকা মেরে মুনাফা করে, আমরা ঠিকাদারের টাকা নিই। আর তোমাকে টাকা তুলে দিলে তুমি তো ভাল কাজে লাগাবে। জনগণের টাকা তাদের সেবায় যাবে। 

.

স্টেশনে পৌঁছেও সে রিকশা ছেড়ে দিল না। বসির খানকে দাঁড়াতে বলে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গেল। কাগজের হকার ছেলেটি এত রাত্রে থাকে না। মির্জার খবর দিতে পারে চা-ওয়ালা একজন। সে চা-ওয়ালার সন্ধানে এদিক-ওদিক দেখছিল। প্ল্যাটফর্মের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে ভিখিরির দল। আলো জ্বলছে। তবু শান্ত হয়ে আছে স্টেশন। সে ভাবল, একবার সরাসরি মির্জার বাড়িতে চলে যাবে কি না। যদিও সবসময় বাড়িতে পাওয়া যায় না নির্জাকে। 

চেনা লোকটিকে দেখতে না পেয়ে সে ফিরে আসছিল। তখন, প্ল্যাটফর্মের দূরের আঁধার হতে লোকটি এসে দাঁড়াল তার সামনে। মির্জার একটি কয়লার দোকান আছে শহরে। কয়লা ও কেরোসিন। এই লোকটি দিনেরবেলায় সেখানে কাজ করে। চার ফুট উচ্চতা। কিন্তু সুগঠিত এর পেশি। নিজের নজর মোল্লা নামটি পছন্দ নয় বলে একটি পোশাকি নাম সে ব্যবহার করে, বলে, আমার নাম মেহতাব আনসারি। দূরপাল্লার ট্রেনে সে উঠে পড়ে। চা বিক্রি করে। ফিরে আসে আবার। সে একজন দক্ষ বিক্রেতা। মঙ্গলবার কয়লার দোকান বন্ধ থাকে। সেদিন নজর মোল্লা সারাদিন চা বেচে। একদিনের কথা সিদ্ধার্থর মনে আছে। যে-ট্রেনে সে উঠেছিল, সে-ট্রেনে নজর মোল্লার চা-ও উঠল। সিদ্ধার্থকে দেখেই সে সপ্রতিভভাবে বলল— সেলাম বাবু। 

—সেলাম। 

অভিবাদনের পালা চুকিয়ে সে হাঁকল— 

খান বাবু খান। 
মেহতাব আনসারির স্পেশাল চা। 
এমনটি আর পাবেন না। 
যদি আনসারি সাহেব নীচে নেমে যান। 

তার স্বর তখন হয়েছিল অন্যরকম। তীব্র। তীক্ষ্ণ। সিদ্ধার্থ দেখছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর নজর মোল্লা এসে দাঁড়িয়েছিল তার কাছে। দুটো স্টেশন পর সে নেমে যাবে। আবার ফেরার ট্রেন ধরবে। তার আগে প্ল্যাটফর্মে বসে আবার বানিয়ে নেবে এক কেটলি চায়ের জল। সে সিগারেট খাবে বলে নজর মোল্লার সঙ্গে ট্রেনের দরজার কাছে এসেছিল। তখন শুকনো মুখে এল আর একজন। নজর মোল্লা বলল—কীরে আজ্জু? বিক্রি হল না? 

লোকটা ডিম বিক্রি করছিল। এখনও অনেক পড়ে আছে। সে শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। বলল—সব টাটকা ডিম। সকালে সেদ্ধ করেছি। লোকের কেবল সন্দেহ। 

নজর মোল্লা বলল—দে আমাকে। ভাবলাম নেমে যাব, তা তোর জন্য… সে এগিয়ে গেল। সিদ্ধার্থ দেখল, ছোট-খাটো শক্ত হাত নেড়ে সে বলছে— 

ডিম খান দিদি দাদা। 
মেহতাব আনসারির ডিম। 
নেমে গেলে আর পাবেন না।
পেট খিদেয় হিম। 

সে কীভাবে বিক্রি করে দেখার জন্য সিদ্ধার্থ গিয়েছিল তার সঙ্গে। একজন বলল—ভাই, চা বিক্রি করছিলে, ডিম পাড়লে কখন? 

সে হেসে বলল—আমি না, আমার মুরগি। আপনাদের জন্য সেদ্ধই পেড়েছে দাদা। খেয়ে দেখুন। 

হাস্যরোল উঠেছিল। ডিম বিক্রিও হচ্ছিল। সে ফিরে এসেছিল। কিছুক্ষণ পর নজর মোল্লাও এসেছিল। সব ডিম বিক্রি হয়ে গেছে। আজ্জুকে টাকা বুঝিয়ে দিল সে। পাই-পয়সা। সিদ্ধার্থ বলল—তুমি কিছু নিলে না? 

—না বাবু। লাইনের লোক আমরা। 

—তা ডিমও তো বেচতে পারো তুমি। 

—পারি। কিন্তু বেচি না। আমার হল চায়ের লাইন। আহা! গন্ধেই কিশোরদাকে মনে পড়ে যায়। শুনেছেন সেই গানটা? এক কাপ চা, হাতে তুললেই, মনে পড়ে যায়… কী ফাটাফাটি গলা। আমি দাদা কিশোরের ভক্ত। আপনি? 

সে বলেছিল—আমিও ভালবাসি কিশোরকুমারের গান। তা তুমি এই যে এত পরিশ্রম করো, তোমার বিশ্রাম হয় কখন? 

—কয়লার দোকানে যে পরিশ্রম হয়, চা বিক্রির সময় তাতে বিশ্রাম মেলে। আবার চা বিক্রিতে যে-খাটুনি, কয়লার দোকানে গেলে তার বিশ্রাম হয়। হা-হা-হা! কাজই বিশ্রাম। এই যে আপনারা রাত-বিরেত জেগে কাজ করেন, তা কেন? 

—ঘরে কে আছেন তোমার মোল্লা? 

—মা। বুড়ি মা। আমি একা মানুষ।

—তুমি বিয়ে করোনি? 

একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল। সে তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বলেছিল—তুমি নামবে তো? নেমে যাও। 

তাকে অবাক করে দিয়ে নজর মোল্লা বলেছিল—না। যাই আর একটু। 

—তোমার ক্ষতি হবে না? 

—হোক। কথা বলি। ভাল লাগে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। ওখানে তো হয় না। 

সে বলেছিল— আমারও ভাল লাগবে তুমি থাকলে মোল্লা। বলো তোমার কথা বলো। বিয়ে কেন করোনি? 

ট্রেনের চলন্ত বায়ু ঝাপটা মারছিল তাদের। চাকায় আর বিবিধ যন্ত্রে শব্দ উঠছিল। দরজার কাছে নজর মোল্লার পাশে সিদ্ধার্থও বসে পড়েছিল উবু হয়ে। নজর মোল্লা হাঁ-হাঁ করে উঠেছিল—আরে আরে আপনি এখানে বসবেন নাকি? 

—ওতে কিছু হয় না মোল্লা। ওখানে তো তোমার বসার জায়গা হবে না। নজর মোল্লা বলেছিল—বিয়ে করেছিলাম বাবু। বিবিটা ভেগে গেছে। 

–সে কি! 

—আমার এই ফিরোজ খানের মতো চেহারা পছন্দ হয়নি। 

হা হা করে হেসেছিল সে। সিদ্ধার্থ বলেছিল—আবার নিকে করতে পারতে। 

—নাঃ। মেয়েজাতের আর বিশ্বাস নেই। 

—তা বললে হয়? তোমার মা-ও একজন মহিলা। 

—তা ঠিক। তবে মায়ের মতো বিবি পাওয়া যদি না যায়! 

—ওসব ভেবে লাভ নেই। নিকে করো। ভাল রোজগার করছ।

–না। আরও রোজগার করব। দুটো সাধ আছে বাবু জীবনে।

–কী? 

—পাকা বাড়ি করব। নিজের। আর ভোটে দাঁড়াব একবার।

—ভোটে দাঁড়াবে? বলো কী? 

—হুঁ। দাঁড়াব। নির্দলপ্রার্থী। আরে জিততে না পারি, কিছু ভোট কাটব তো! আমার চেনা কম নেই বাবু। তখন পার্টিগুলো আমাকে সাধাসাধি করবে তাদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য। টাকা দেবে আমাকে। এই। ব্যস। তখন দুই বিবি রাখব বাবু। এই চার ফুটিয়া নজর মোল্লাকে তারা তখন ফিরোজ খানই ভাববে। 

.

নজর মোল্লা এসে দাঁড়াল সিদ্ধার্থর সামনে। বলল—কাকে খুঁজছেন বাবু? 

—তোমাকেই। 

—কেন বাবু? 

—মির্জাকে চাই। খুব জরুরি দরকার। 

—আপনি যাবেন, না আমি ডেকে দেব? 

—আমিই যাই। 

—আজ কয়লার দোকানে পাবেন। মাল আসার কথা আছে। 

রিকশা নিয়ে মির্জার দোকানে গেল তারা। খবর ঠিক ছিল। দোকানেই ছিল মির্জা। ট্রাকে কয়লা এসেছে। সে মাল খালাস করছিল। সিদ্ধার্থ ডাকল তাকে। বলল সব। শুনতে শুনতে চোখ দুটি জ্বলছিল তার। সে বলল—তুমি বললে আমি জান লড়িয়ে দেব। কিন্তু একা তো এ কাজ হবে না। লোক লাগবে। 

সিদ্ধার্থ বলল—নদীর ওপারে গোপালনগরে ওদের একটা ঠেক আছে। 

—জানি। আমারও মনে হচ্ছে ওখানেই যেতে হবে। তুমি এখানে বস সিধুভাই। আমি আসছি। 

আধঘণ্টারও কম সময়ে একটি সাদা অ্যাম্বাসাডার নিয়ে এল মির্জা। তাতে চালকসহ আরও তিনজন। মির্জা বলল—তুমি বসিরভাইকে নিয়ে চলে যাও। আমরা দেখছি। 

–না। 

সে বলল। 

—আমি যাব। 

—দেখো, দীপেন হাজরার দল ভাল নয়। ওখানে ঝামেলা হতে পারে। 

—আমি যাব মির্জা। বসিরভাই তুমি বাড়ি যাও। 

বসির খান বলল—তা কি হয় দাদা? আমার বোনের জন্য আপনারা যাবেন, আমি যাব না? হঠাৎ মির্জা বলল–চালাতে পারবে? 

—কী? 

একটি ছোট অস্ত্র দেখাল সে। আগ্নেয়াস্ত্র। এর পেটে চাপ দিলে গুলি বেরিয়ে আসে, তা একটি শিশুও জানে। কিন্তু সে কোনওদিন ব্যবহার করেনি, তার পক্ষে এ বস্তু উল্কাপিণ্ডেরই মতো ভারী ও গরম। বসির খান বলল—আমি ছুরি চালাতে জানি। লাঠি খেলতেও পারি। 

—ভাল। খোকনা—

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানো ছেলে তিনটিকে চেনে সিদ্ধার্থ। মির্জার দলে কাজ করে এরা। তাদেরই একজন বলল—জি ভাইজি। 

—ওকে ছুরি দাও একটা। সিধুভাই, তুমি এটা রাখো। এই দেখো, এভাবে ধরবে, এখানে টানবে। সামনে কারওকে লাগাতে হলে ফসকাবে না। দূরে কারওকে লাগাতে হবে না। সেদিকে আমরা নজর রাখব। দীপেন হাজরার ছেলেগুলো খতরনাক। 

সে দু’হাতে অস্ত্রটি ধরে, ব্যবহার-কৌশল জ্ঞাপন করে বস্তুটি সিদ্ধার্থের হাতে দেয়। সিদ্ধার্থ এই প্রথম ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে তার দুর্ভেদী শীতলতায় কেঁপে ওঠে একবার। মেরুদাড়ায় শিরশিরানি টের পায়। তার অলক্ষ্যে জীবনদেবতা লিখে রাখেন এই মুহূর্তের কথা। গাছপালা উত্তেজনায় উষ্ণ নিশ্বাস ফেলে। বাতাসে বারুদের গন্ধ রটে যায়। সিদ্ধার্থ সে, সহসা প্রভূত শক্তির অধিকারী বোধ করে নিজেকে। পৃথক, অচেনা, অজ্ঞাতপূর্ব অনুভবে ভরে যায় তার হৃদয়। সে, জীবনে এই প্রথম, অস্ত্র ছুঁয়ে উপলব্ধি করে, অস্ত্র মানুষকে দেয় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। 

মির্জা বলে—খুব দরকার হলে চালাবে। 

নীরবে গাড়িতে উঠে বসে তারা। চালকের পাশে বসে সিদ্ধার্থ। তার পাশে দরজার দিকে মির্জা। পেছনে মির্জার দলের লোকেদের সঙ্গে বসির খান। অন্ধকারের বুক ঝলসে দিতে থাকে আলোর তীব্র রেখা। পূর্ণ গতিতে গাড়ি ছোটে। কথা বলে না কেউ। আফরোজা মেয়েটির বিষয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় তাদের মন ভার হয়ে থাকে। উত্তেজনা কণ্ঠ অবধি এসে আছাড়ি-পিছাড়ি খায়। যেন, যে-কোনও একজন কথা বলার জন্য মুখ খুললেই তারা ঝাঁপ দেবে আর টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ভাঙা কাচের মতো। ভাগীরথী ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গাড়ি গোপালনগরের পথ ধরে। একটি বাজার এলাকার ঘিঞ্জি পথের মুখে এসে দাঁড়ায়। 

পথবাতি আছে এখানে। কিন্তু ম্লান তার আলো। বাজারের জঞ্জাল ছড়ানো ছেটানো চারপাশে। টিনের ঝাঁপ-ফেলা দোকানে গাড়ির আলো পড়ে ঝলসে উঠল। সে-আলো নিভিয়ে দিতেই ম্লানিমায় ভরে গেল চরাচর। চারটি কুকুর দূরে দাঁড়িয়ে শব্দ করল মৃদু। কিছু না বুঝেই লেজ নাড়ল অতঃপর। 

সোজা পশ্চিমে যে-রাস্তা গিয়েছে, সে-পথেই দীপেন হাজরার ডেরা। খোকনা চেনে সে-বাড়ি। গাড়ি নিয়ে ঢোকা যাবে কিন্তু দ্রুত গাড়ি ঘোরাবার প্রয়োজন হলে অসুবিধে হবে বলে চালকের সঙ্গে একজনকে রেখে তারা রাস্তায় ঢুকল। পাঁচজনের দৃঢ় পদধ্বনিতে কেঁপে-কেঁপে উঠল সে-পথ। বাজার ছাড়িয়ে তারা একটি বসতি অঞ্চলে এল। গা ঘেঁষাঘেষি পুরনো বাড়িগুলির মাঝখানে একটি সম্পূর্ণ নতুন ঝকঝকে দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াল খোকনা। ফিসফিস করে বলল—এই বাড়ি। 

দাঁতে দাঁত পিষল মির্জা—শালা হারামি, হেরোইন পাচার করে বাড়ি হাঁকিয়েছে দেখ।

সিদ্ধার্থর দিকে তাকাল সে। বলল—তৈরি থাকো। 

সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে ছিল টান-টান। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত করে তার স্নায়ুতন্ত্র তাকে আপাতত রেখেছে সজাগ। স্থির। তার হাত কাঁপছে না। পা কাঁপছে না। মনে কোনও দ্বিধা উঁকি মারছে না। আফরোজা মেয়েটিকে পাওয়া গেলে সে যা কিছুই করতে পারে এখন। তার মনে হচ্ছে না এই প্রথম সে এরকম কোনও কাজে এল। পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল সে। দীপেন হাজরার বাড়ি একেবারে অরক্ষিত থাকবে না নিশ্চয়ই। 

ভাবামাত্রই দুটি লোক অন্ধকার ফুঁড়ে দাঁড়াল তাদের সামনে। মির্জা বলল—চার্জ খোকনা…

সিদ্ধার্থ দেখল, দুটি স্প্রিং-এর মতো লাফ দিল দু’জন। আর লোক দুটিকে নিয়ে পড়ল মাটিতে। ওদের হাত থেকে যেগুলি ছিটকে পড়েছে, সেগুলি লাফিয়ে কুড়িয়ে নিল মির্জা ও বসির খান। সে ধস্তাধস্তি করতে থাকা একজনের মাথায় নল ঠেকিয়ে ঝুঁকে বলল— আওয়াজ করলেই মারব। 

সে দেখল অন্য লোকটির মাথায় অস্ত্র ধরে আছে মির্জা। খোকনা পকেট থেকে সরু নাইলনের দড়ি বার করে বাঁধল দু’জনকে। গোটা ব্যাপারটা সিদ্ধার্থর মনে হল, ঘটে গেল নিমেষের মধ্যে। এবার সে ভাল করে দেখল দু’জনের মুখ। রাস্তার ধুলোবালি লেগে গেছে মুখে। তবু সে চিনতে পারল। দীপেন হাজরার সঙ্গী এরা। বসির খান এসে দাঁড়াল একজনের সামনে। সবল ঘুষি মারল তার মুখে। এ সেই, যে মেহেরকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। খোকনা একটা ঢিল ছুঁড়ে নিভিয়ে দিল পথবাতি। ছেলে দুটিকে ঠেলে দুটি বাড়ির মধ্যবর্তী সরু অন্ধকার ফালি জায়গায় নিয়ে এল তারা। সিদ্ধার্থ বলল— মেয়েটা কোথায়? 

ছেলেটা তুতলে গেল—বি-বিশ্বাস করুন সি-সিধুদা, আ-আমরা জা-জা— 

সে চড় মারল একটা। মির্জা বলল—এতে হবে না। 

একটা লাথি কষাল সে ছেলেটার তলপেটে। ওঁক শব্দ করে উবু হয়ে বসে পড়ল ছেলেটা।

হঠাৎ দ্বিতীয় ছেলেটা চিৎকার করল— দীপেনদা, দীপেনদা! 

মুহূর্তে কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। অন্ধকারে সিদ্ধার্থ দেখল ছেলেটা পড়ে যাচ্ছে। একটা শরীর ঝাঁপ দিচ্ছে তার ওপর। তারপর একটি হাত উঠল কেবল আর নেমে এল সজোরে। 

দীপেনের গলা পাওয়া গেল ওপরে—আনিস, আনিস! রাজু। কী ব্যাপার?

সিদ্ধার্থ দ্রুত বলল—ডাক ওকে। বল দরকার আছে। 

দীপেন বলছে—কী ব্যাপার? সাড়া দিচ্ছিস না? 

সিদ্ধার্থ বলল—বল, সাপ। সাপ। 

—কী বলছিস রাজু? 

— সা-সা-সাপ। দী-দীপেনদা। সা-সা—

—সাপ কোথায়? আনিস কোথায়? সাপ দেখে ঘাবড়ে গেলি! মারতে পারছিস না? 

—ওকে…ওকে…. 

—কেটেছে নাকি? দাঁড়া। আসছি আমি। আরে বাইরের আলোটা কী হল! 

নেমে আসছে দীপেন। মির্জা জোরে মারল রাজুর মাথায়। রাজু শুয়ে পড়ল। দরজা খোলার শব্দ হল। দীপেন বেরিয়ে আসছে। হাতে টর্চ। অন্য হাতে লাঠি। বলছে—কোথায় তোরা? গলিতে নাকি? রাজু, রাজু। 

কিছুক্ষণ আগেকার এক মুহূর্তের মতোই, ঠিক বা একই ভঙ্গিতে একটি বৃহৎ স্প্রিং উঠল আর পড়ল দীপেনকে নিয়ে। মির্জা দু’হাতে অস্ত্র চেপে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আর যদি কেউ আসে, তাহলে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। সিদ্ধার্থ দীপেনের মাথায় অস্ত্র ঠেকাল আগের মতোই। বলল— মেয়েটা কোথায়? 

—কে? কে? সিধুদা! 

—মেয়েটা কোথায় দীপেন? 

—কোন মেয়ে? কে? 

সিদ্ধার্থ বুঝতে পারল না কী হয়ে গেল তার। একতাল বারুদ স্ফুরিত হয়ে উঠল মাথায়। কী এক বিস্ফোরণ হল। তার সহজ ডান পা দিয়ে সজোরে সে লাথি মারল দীপেনের মুখে। কাতর শব্দ করল দীপেন। সে তার অস্ত্রের অগ্রভাগ ঢুকিয়ে দিল দীপেনের মুখবিবরে আর সরল বাঁ পা তুলে দিল বুকে। দোতলার বারান্দায় একটি নারীকণ্ঠ বাজল—শুনছ, কোথায় গেলে? 

মির্জা বলল—এখানেই আছে দীপেনদা। চিন্তা করবেন না বউদি। 

—কে? রাজু? 

—হ্যাঁ। 

—সাপটা দেখতে পেলে? 

—হ্যাঁ। আপনি ঘরে যান। আমরা ব্যবস্থা করছি। 

—আপনি! আমাকে হঠাৎ আপনি বলছ রাজু! এ কি ঢঙ! তোমার স্বরটাও অন্যরকম লাগছে! 

মির্জা কোনও জবাব দিল না। খোকনা দীপেনকে বাঁধছিল। 

সিদ্ধার্থ বলল —বল। বলবি কি না। 

গোঁ-গোঁ শব্দ করল দীপেন। অন্ধকারেও তার বিস্ফারিত দুটি চোখে ত্রাস দেখতে পেল সিদ্ধার্থ। দীপেনের মুখ থেকে অস্ত্র বার করে নিল সে। বলল— কোথায়? 

—আ-আ-আমি করিনি। আ-আ-আমি… 

—কোথায়? 

গর্জন করল সিদ্ধার্থ। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অন্য মানুষ। কোমল নয়। অহিংস নয়। শান্ত নয়। সে বলল—আর একবার জানতে চাইব। কোথায়? 

দীপেন বলল—এ-এখানেই আছে। 

—কোথায়? 

–নীচের বাথরুমে। 

—ওঠা 

খোকনা টেনে দাঁড় করাল দীপেনকে। বসির খানকে নিয়ে মির্জা আর সিদ্ধার্থ ঢুকল ভিতরে। 

খোকনা তার সঙ্গীকে নিয়ে বাইরে পাহারায় রইল। পায়ের শব্দ পেয়ে নারীকণ্ঠ নেমে আসছিল নীচে। 

সিদ্ধার্থ বলল—ওঁকে নীচে আসতে বারণ কর। 

দীপেন ঘরঘরে গলায় বলল— জ্যোতি, তুমি নীচে এসো না। 

— কেন? 

—বলছি এসো না। আমাদের কাজ হচ্ছে। 

—ওঃ! আবার সেই! তোমরা মরবে একদিন। নয় জেলে যাবে। 

পায়ের শব্দ ওপরে চলে গেল। সিদ্ধার্থ বলল—বাথরুম কোথায়? 

—ওই দিকে। 

বসির খান দ্রুত এগিয়ে গেল স্নানঘরের দরজার দিকে। মির্জা বলল —সাবধান। 

সেও এগিয়ে গেল সঙ্গে এবং ফিরে এল আবার। সিদ্ধার্থ দীপেনকে একা সামলাতে পারবে বলে তার ভরসা হচ্ছিল না। সে বলল-তুমি যাও সিধুভাই। আমি থাকছি। 

বসির খান ছিটকিনি খুলছে। তার হাত কাঁপছে। কী দেখবে! কেমন দেখবে! সিদ্ধার্থ টের পেল তারও হাত কাঁপছে। বুকের মধ্যে শব্দ হচ্ছে ধক ধক, ধকধক। মাথা থেকে কপাল বেয়ে, গলা বেয়ে, বুক অবধি নেমে আসছে স্বেদবিন্দু। বসির খান দরজা খুলে ফেলছে। ভিতরে অন্ধকার। সিদ্ধার্থ আন্দাজে হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বেলে দিচ্ছে। আর কাতর শব্দ করছে বসির খান। খোদাতাল্লাকে স্মরণ করছে। স্কার্ট আর টপ পরেছিল মেয়েটা। এখন তার উর্ধ্বাংশ খোলা। সারা গায়ে কালশিটে। মুখ বাঁধা, হাত-পা বাঁধা সে পড়ে আছে মেঝেয়। আলোর ঝলকে বড় বড় চোখ মেলে তাকাচ্ছে। চোখ ভরে উঠছে জলে। 

—আফরোজা! 

কান্নাভেজা গলায় ডাকছে বসির খান। 

—আফরোজা! কোনও ভয় নেই বোন! 

সে নিজের শার্ট খুলে ঢেকে দিচ্ছে মেয়েটির খোলা গা। উঠে যাওয়া স্কার্টের ফাঁকে বেরিয়ে থাকা লম্বা-লম্বা আঁচড়ের ফালি আড়াল করছে সেই স্কার্টই নামিয়ে দিয়ে। ছুরি দিয়ে বাঁধন কাটছে সে। সিদ্ধার্থ দেখছে চুরিতে লেগে আছে লালের ছোপ। মোছা, কিন্তু পুরো মোছা নয়। কান্না পাচ্ছে তার। হু-হু কান্না পাচ্ছে। ময়না বৈষ্ণবীর কথা তার মনে পড়ছে। আফরোজার অনাবৃত, কালশিটে পড়া তরুণ শরীর তাড়া করছে তাকে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে সে। কেন এত নিষ্ঠুরতা পৃথিবীতে! কেন! আর বসির খান বোনকে বুকে তুলে নিচ্ছে। পাঁজাকোল করে এসে দাঁড়াচ্ছে সিদ্ধার্থর কাছে। তার হাতের ওপর এলিয়ে আছে আফরোজা। সিদ্ধার্থ বলছে— ওকে গাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে? 

বসির খান মাথা নাড়ছে পারব। 

প্রায় ছ’ফুট দীর্ঘ, চওড়া কাঁধ তার! লম্বা চুল পিছনে গুছি করে বাঁধা। একটি পুতুলের মতো আফরোজাকে নিয়ে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধার্থ কিছুক্ষণ যাওয়া দেখল তার। বলল— মির্জা। এর মুখ বাঁধতে হবে। 

পকেট থেকে বড় রুমাল বার করল মির্জা। সিদ্ধার্থর হাতে দিল। সিদ্ধার্থ শক্ত করে মুখ বাঁধল দীপেনের। বিপুল আবেগ সংহত করে নিয়েছে সে। তার চোখে টলটলে জল। হাতে অমিত শক্তি। সে জানত না সে কী করবে, কেমন হয়ে উঠবে। সে জানে না। তার স্নায়ু শক্ত। শান্ত। কিন্তু বিবিধ আবেগ, বিবিধ রাগ, ঘৃণা, দ্বেষ, প্রতিহিংসা, বেদনা, যন্ত্রণা তাকে গড়ে তুলছে এক অন্য মানুষ। এবার কাজ করার পালা। দীপেনের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে বেরিয়ে আসছে তারা। সিদ্ধার্থ বলছে—বাকি দু’জন? 

—আনিসকে মেরে দিয়েছে বসির খান। 

—রাজু? ওটাকে নিয়ে যেতে হবে। 

খোকনা আর তার সঙ্গী বহন করতে থাকল রাজুকে। রাজুর জ্ঞান ফেরেনি তখনও। আনিস রক্তাক্ত পড়ে থাকল গলিতে। গাড়ির কাছে পৌঁছে রাজুকে মাল নেবার ডিকিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। দীপেনের পা-ও বেঁধে দিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল পিছনের আসনের নীচে পা রাখার জায়গায়। এবার চালকের পাশে বসল খোকনা ও তার দুই সঙ্গী। পিছনে দীপেনের শরীরে পা রেখে বসল মির্জা, সিদ্ধার্থ ও বসির খান। আফরোজাকে শুইয়ে দেওয়া হল তিনজনের কোলের ওপর দিয়ে। এই মুহূর্তে সে ছিল অচেতন। নীচে দীপেন গোঁ-গোঁ শব্দ করছিল। গাড়ি চলতে থাকায় সে-শব্দ আর শোনা গেল না। বসির খানের ঠিক পায়ের তলায় দীপেনের মুখ। ওই মুখে বসির খান পায়ের চাপ দিতে পারত। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে সব প্রতিহিংসা। কাঁদছিল সে। তার ইচ্ছে করছিল গলা ফাটিয়ে কাঁদে। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। সিদ্ধার্থ দ্রুত ভাবছিল। এবার কী! আনিস খুন হয়ে না গেলে একরকম ছিল। এখন? 

অন্ধকারকে আলোর দ্বারা চিরে ভাগীরথী ব্রিজে উঠে এল গাড়ি। সিদ্ধার্থ বলল—মির্জা, ব্রিজে দাঁড়াও। 

গাড়ি দাঁড়াল। সিদ্ধার্থ ও মির্জা নেমে এল। নেমে এল মির্জার দলের ছেলেরা। সিদ্ধার্থ ব্রিজের রেলিঙে ঝুঁকে দেখল নীচে জলের পরিমাণ। ভরনিখাল হতে জল পেয়ে ভাগীরথী এখনও, এই অনাবৃষ্টির আষাঢ়েও জলপূর্ণা। হয়তো আষাঢ়েও বৃষ্টি না হলে জল শুকিয়ে আসবে। সিদ্ধার্থ আকাশের দিকে তাকাল। নির্মেঘ আকাশে কত তারা। ওখানেই কোথাও আছে ওই মানুষ। ওই ময়না বৈষ্ণবী। সে মনে মনে বলল— তোমার হত্যাকারীকে যদি কোনওদিন পাই… 

.

মির্জা বলল—সিধুভাই, সময় নেই। 

সময় নেই, সময় নেই ধ্বনিত হল সিদ্ধার্থের মাথায়। সে মির্জা ও তার দলের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল—ওদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। 

—না। 

প্রতিধ্বনি তুলল মির্জা। 

–না। যাবে না। 

সিদ্ধার্থ, শান্তভাবে, আবেগহীন, নিরুত্তাপ, কেটে-কেটে বলল—ওদের মাছের খাবার করে দাও। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *