রাজপাট – ৫০

৫০ 

এই মাস গেল কন্যা 
না পুরিল আশ। 
লহরী যৌবন ধরি 
আসিল জ্যৈষ্ঠ মাস।। 
আম খাইলাম 
কাঁটাল হে খাইলাম। 
আরও গাভীর দুধ—
কতদিনে খণ্ডিবে বলো 
বিরহিণীর জ্বালা 
আর অভাগীর মনের দুখ।। 

.

বাউলের কাছে বৃহস্পতিবার হল গুরুবার। বুড়িয়াকে দীক্ষা দেবার দিন এই বার দেখেই নির্ধারিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবার আগ্রহ ছিল বুড়িয়ার। কিন্তু মহম্মদ সাঁই গুরুকে দেখে তার অবিকার হৃদয়েও কুঞ্চন ঘটে গেল। দীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি সে কিছু জানে। অতএব নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল সে অবিরল। সে কি পারবে না? শেষ পর্যন্ত পারবে না কি? 

মহম্মদ সাঁইয়ের বয়স প্রায় পঁচাত্তর বৎসর। তাঁর ত্বক লোল হয়েছে। পক্ককেশ মাথায়। কিন্তু দেহের খাঁচাটি সটান। চোখে গঞ্জিকা সেবনের লালিমা। কিন্তু দৃষ্টি তীব্র। জ্বলজ্বলে। বুড়িয়া দেখছে তাকে, আর ভাবছে, এ তবে সেই? 

মহম্মদ সাঁই গানে মজে আছেন সারাক্ষণ। তাঁকে ঘিরেই আখড়ার জীবন কাটছে এখন। মহম্মদ সাঁইয়ের সঙ্গিনী হরিমতি জাদুকরীর মতো চোখে দেখছেন বুড়িয়াকে। আরও দুই বাউল এসেছে সঙ্গে সাধিকা নিয়ে। সেই দুই নারীর পানে ছোপানো ঠোঁট। দাঁতগুলি কালো। তাদের ভাষায় অসংস্কৃত শব্দের অধিক ব্যবহারে বুড়িয়া ক্লান্ত বোধ করছিল। এ পর্যন্ত যত বাউলসঙ্গ সে করেছে, এমন অপভাষা কারওকে ব্যবহার করতে শোনেনি। সে মন ফেরাবার জন্য মহম্মদ সাঁইয়ের গানে ধ্যান দিতে চেষ্টা করছিল। 

এসে অবধি গণিমিঞাকে নিয়ে বারবার আক্ষেপ করেছেন গুরু—পাগলটা এমন ক্ষয় করে ফেলল নিজেকে! 

বিশেষ ঔষধ এনেছেন তিনি। আপন মাটিতে গড়া ঔষধ। তা ছাড়া গণিমিঞার নিজের মাটি গ্রহণের নিদানও বজায় আছে। বুড়িয়া গণিমিঞার ঘরে কখনও ঢোকেনি। সে নীরব হয়ে আছে। নারায়ণমূর্তির কথা বড় বেশি মনে পড়ছে তার। এই সমস্ত ছেড়ে চলে যাবার জন্য তার চিত্ত অধীর হয়েছে। যেমন স্বভাব তার যেমন অস্থিরতা—কোথাও, কোনও সম্পর্কেই সে পারে না প্রোথিত করতে নিজেকে! যখন সম্পর্কে জড়ায়, মনে হয় এ না হলে এই জন্ম বৃথা। কখন আবার সমস্তই বাহুল্য হয়ে যায়! আর দুলুবাউল! দুলেন্দ্ৰ! বুড়িয়া জানে, জানত, সে কেবল চরিতার্থ করবে এক গোপন অভিলাষ, সিদ্ধ হবে অদৃষ্ট অভিজ্ঞতায় এবং চলে যাবে। যাবেই। দুলুবাউল তার কে? দুলেন্দ্র? সে দুলুক্ষ্যাপাকে দেখছে ফিরে ফিরে। কী সুন্দর মানুষটা। কাটাল কী এক জীবন! সে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে—এ জীবন কি খারাপ? 

না। কোনও জীবনই তার কাছে খারাপ নয়, ভালও নয়। কারও ক্ষতি না করে যার যেমন ইচ্ছে জীবন-যাপন করুক না। সে নিজেও, কারও ভাল-মন্দ লাগার পরোয়া না করে তার নিজের জীবন পরিচালিত করছে। দুলু বাউলও তার নিজের জীবন নিয়ে তৃপ্ত নিশ্চয়ই। পূর্ণ বাউল হয়েও এতকাল সে নারীসঙ্গ করেনি। তার খোঁজার এই শক্তিকে, এই সংযমকে প্রণাম জানায় বুড়িয়া। 

দুলু বাউল মহম্মদ সাঁইয়ের প্রিয় পাত্র। তিনি সম্বোধন করছেন তাকে—আমার পাগল ছেলে। 

বুড়িয়া নজর করে দেখে। দুলুক্ষ্যাপার মুখে হাস্যোজ্জ্বলতা নেই, যা থাকার কথা ছিল। সে এখন গুরুমায়ের কোল ঘেঁষে বসেছে। মহম্মদ সাঁই বলছেন—উন্মাদ হয়ে যা রে। উন্মাদ হয়ে যা সব। আরে উম্মাদ না হলে কি সাধন হয়? আবার সাধন পূর্ণ হলেই উন্মাদ অবস্থা আসে। সাধনায় একনিষ্ঠ হও, প্রেমে তীব্রতা আন। প্রেমই তো সাধন। তার চেয়ে বড় সাধনা আর কী! মানুষের চরম বোধ প্রেমের বোধ। পাগল না হলে প্রেম সিদ্ধ হবে না। আবার প্রেমে সিদ্ধ মানুষ পাগল হয়ে যাবে। 

তাঁর কথা শেষ হয় এবং গান শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে গঞ্জিকার সেবা ফেরে হাতে হাতে। 

সে এক রসের পাগল বাঁধাল গোল 
মনের মাঝে দেখ রে তোরা 
মনের ঘরে নয়ন ফেরে কোথায় তবে 
আলোকের তোড়া 
পাগল রসে ডুব দিয়ে দেখ 
এ পাগল মন সে আলোয় ভরা 
আমি পাগলের সঙ্গে যাব পাগল হব 
হেরব নবরসের গোরা 

বুড়িয়া এই ক্ষেত্র হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চায়। সে যে এসেছিল দুলু বাউলের সঙ্গ করতে, তা পূরিত হয়েছে। আজ দীক্ষা নেবার রাত্রি এক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পার হওয়া কি এমনই কঠিন? সে সাহসে ভরসা করতে চায়। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় মনে মনে। এই তিন মাসের জীবনে সে যা যা অভ্যাস করেছে তার কিছুই তার সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। এক উন্মাদনায়, আবেগে সে ওই অচেনা পথ পেরিয়ে এসেছে। হয়তো অজানা ছিল না বলেই সম্ভব হয়েছে এই অতিক্রম। গুপ্ত সাধনার সঙ্গী হয়েছে সে। এবার সদস্য হবে। 

এই আসর জাগিয়ে তোলা মানুষগুলিকেই তার মনে হয় উন্মাদ একপ্রকার। তারা চূড়ান্ত কামসাধক, আবার চূড়ান্ত ইন্দ্রিয়নিয়ন্ত্রণকারী। বুড়িয়া প্রথমদিকে দুলু বাউলের এই নিয়ন্ত্রণের পরিচয় পায়নি। অনভ্যাসে সে বারংবার স্খলিত হয়েছিল। তখন বস্তুরক্ষা হত তার নিজেরই। ইদানীং দুলু বাউলের সংযম তাকে বিস্মিত করছিল। তাকে দেখে মনে হয় যেন ঘোর স্বপ্ন থেকে সে জাগ্রত হয়েছে। দশ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন যিনি, তিনিই বাউল। চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক এই পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়। এবং বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ এই পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়। জ্ঞান ও কর্মের এই দশযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বাউল চলে। বুড়িয়ার সহসা মনে হয়, ইন্দ্রিয় হল চৌদ্দটি। সেই বাকি চার প্রকার নিয়ে বাউল ভাবিত নয়। 

সে মহম্মদ সাঁইকে দেখে। এই মানুষটি আজ রাত্রে তার গুরু হয়ে উঠবেন। অথচ তাঁকে দেখে তার মধ্যে ভক্তি বা আনুগত্যের বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। বুড়িয়া, সে এমনই মেয়ে, যার মধ্যে আনুগত্য জাগে না। ভক্তিকে সে ধরে পরীক্ষণীয়। সে মহম্মদ সাঁইকে বলে একটি নিবেদন আছে আমার। 

—বলো, বলো। অমাবস্যায় চন্দ্রোদয় ঘটেছে তো? আজকের দিনে তা আবশ্যিক। 

বুড়িয়া তীব্র চোখে তাকায়। সর্বসমক্ষে এ কী প্রশ্ন! কিন্তু সংযত থাকে সে। তার চেনা ভদ্র সমাজের সঙ্গে এ-সমাজের বিরোধ সে রেখেছিল সংগোপনে। সেগুলিকে অন্তত আজ মুখ তুলতে দেওয়া যায় না। বিশেষত, এই সমস্ত কিছুই তার স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত। তবু কী এক ক্রোধ তাকে চালিত করে। হয়তো এ ক্রোধ নিজের প্রতি নিজের। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে। বলে— বাউলের সাধনা দশেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু ইন্দ্ৰিয় প্রকৃত পক্ষে চৌদ্দ। 

—চৌদ্দ? 

মহম্মদ সাঁই বড় করে দম নেন কলকে হতে। বলেন—চৌদ্দ! 

গুরুমুখী বিদ্যা তাঁর। অধ্যয়ন করেননি কখনও। শুনেছেন যা, তা শিখেছেন। কিছু আপন অভিজ্ঞতা ও চিন্তায় সংযোজন ঘটিয়েছে। কিন্তু চৌদ্দ ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে তিনি অজ্ঞাত। তিনি ভাষাহীন চোখে দেখেন—চৌদ্দ! 

 বুড়িয়া হাসে। এই মানুষটিকে দেখামাত্র জেগে-ওঠা ক্রোধ তৃপ্তি পায়। সে বলে—জানেন না?

দুলু বাউল কথা বলে তখন—হ্যাঁ। চারিটি অন্তরিন্দ্রিয়। মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত। এইগুলিকে একযোগে একটি ইন্দ্রিয়ই ধরা হয়। তাকে মনও বলা যায়, বুদ্ধিও বলা যায়। বৈষ্ণব মতে মানুষের আছে একাদশেন্দ্রিয়। দশ ইন্দ্রিয়কে যে বশ করতে পারে, তার চিত্ত আপনিই বশ হয়। বুদ্ধিই হল মন। মনই চিত্ত। চিত্তই অহংকারের আধার। 

মহম্মদ সাঁই এতক্ষণে ধরতাই নেন। বলেন—এই হল কথা। মন। দেহ বশ হলেই মন বশ।

বুড়িয়া বলে—মন বশ হলে দেহ বশ, এমন ভাবা যায় না? 

কেন যাবে না? সে অন্য মার্গ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট সকল ধর্মেই মন বশ করার কথা বলা হয়েছে। 

এ উত্তর দুলুক্ষ্যাপার। কথাগুলি বলে সে বুড়িয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সরাসরি। তীব্রভাবে। যেন বলতে চাইছে, আপনার কেতাবি বিদ্যা থাক। এ এক অন্য জগৎ। এখানে পুস্তক টেনে কী লাভ! 

মহম্মদ সাঁই গান করেন—

নয় লক্ষ দশ ধর্ম বাউলের ঘরে। 
আদ্যাবীজ হতে বাউল মহাবীজ ধরে ॥
বাউলের ধর্ম আজ কে করে গণন।
অদ্যাবধি তাই মোরা করি নিরূপণ ॥
কামবীজ কামগায়ত্রী তটস্থ লক্ষণ। 
ইহাদের পরে আছে বস্তু লয় কোন জন ॥ 

গান শেষ হলে চোখ বন্ধ করেন তিনি। বলেন— আউল, বাউল, দরবেশ ও সাঁই, এ হল সাধনার চার স্তর। বিদ্যালয়ে যেমনি তোমরা নিচু শ্রেণি হতে উচ্চশ্রেণিতে ওঠ, তেমনি বাউল সাধনায় শ্রেণি অতিক্রম করতে হয়। সারা জীবনের এই সাধনা। এ সাধনা যুগলরূপী। এর সূচনায়, দেহমিলনের পূর্বে রজঃরসাদি ব্যবহার করে, দমের কাজের মাধ্যমে দেহমার্জনা করে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। প্রথম স্তরে মুখ দিয়ে রসগ্রহণ, নাকে বায়ু নিয়ন্ত্রণ। এই সময় দেহমিলন হবে না। হলেও সামান্য হবে। এইসময় নারী হিজড়ে আর পুরুষ খোজা। বাউল জানে, মন্ত্র পূজা ধ্যানে মন স্থির হয় না। মন স্থির হয় মনের মানুষের সঙ্গে মিলনে। মৈথুনযোগে চিত্তে জাগে শক্তি। বল তো রে পাগল। ক্ষ্যাপা। দুলুচন্দ্র। বল তো। 

দুলুক্ষ্যাপা পাদপূরণ করার মতো বলে—মৈথুনযোগে চিত্তে জাগে হ্লাদিনী ভাব। হ্লাদিনী শক্তি। এই শক্তি স্বয়ং শ্রীরাধিকা। এই শক্তির বলে দেহ নিজে আনন্দিত হয়, অপর দেহকেও আনন্দিত করে। এককেন্দ্রিক অনুভবে নিত্যানন্দের আস্বাদন হয়। স্খলনহীন দীর্ঘ দেহমিলনে সকল পাপচিন্তা বিদূরিত হয়। এমনকী আত্মপর ভেদ অবলুপ্ত হয়ে যায়। দুই দেহ মিলনে একদেহে রূপান্তরিত হয়। সাধক জানে শুক্রবস্তু রক্ষার মহিমা। বস্তুর দর জানে বলে সাধনার তৃতীয় স্তরে সাধক হয় দরবেশ। আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই তারা বাহ্যসম্পদে উদাসীন কিন্তু দেহের সম্পদ রক্ষায় যত্নশীল। 

মহম্মদ সাঁই গান করেন— 

দরদর ভাব ভাবের স্বভাব দরদর বহে ধারা
চারিচন্দ্র ফুটে এ দেহগগনে গ্রহণে পাগল পারা
সহজ সাধন লোক করি মন আনন্দপানে চাই
পাগল পাগল বলিয়া ফিরিল সাধু দরবেশ সাঁই 

তিনি কথা বলে চলেন। শিষ্যরা শোনে। শিষ্যারা শোনে। বুড়িয়া অস্থির হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ। মহম্মদ সাঁই বুঝি-বা তার অস্থিরতা টের পান। অভিজ্ঞতার তৃতীয় নয়নে বুড়িয়াকে ভেদ করেন তিনি। তার উদ্দেশে বলেন—শোনো। বসো এখানে। একই গুরুর শিষ্যেরা একই পরিবার। এখানে কোনও সংকোচ নাই। তোমার মন প্রস্তুত তো? 

বুড়িয়া মাথা নাড়ে। সে নিজের কাছে নিজেই সংকুচিত। কারণ সে জানে, কত বড় প্রবঞ্চনার জন্য সে প্রস্তুত। মহম্মদ সাঁই বলেন—যুগল সাধনায় পরস্পরের প্রতি অনুগত ও তুষ্ট থাকতে হয়। নারী-পুরুষ দু’জনেই অনুগত থাকবে। ব্যভিচারী নারী না হয় কাণ্ডারী, তা মানবে। 

বুড়িয়ার স্বাধীন চোখ প্রজ্জ্বলিত হয় এ কথায়। সে বিস্মিত হয় এই উপলব্ধিতে যে এই বাউল সমাজেও বহুগামী নারী বহুগামী পুরুষের চেয়ে শতগুণে বেশি নিন্দিত। গুরু মহম্মদ সাঁই বলে চলেন—সাধিকা নারীকে কিছু গুপ্তবিদ্যা শিক্ষা করতে হয়। ক্ষেপি হরিমতি, তুমি ওকে গুপ্তবিদ্যা দাও। 

হরিমতি বুড়িয়াকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যান। অবহিত করান কিছু গুপ্তবিদ্যা। আজ তার দীক্ষার দিন। শিক্ষার দিন। দুলু বাউলের সাধিকা সে। বিংশতি বর্ষ পার করে দুলু বাউল সঙ্গিনী লাভ করেছে। বুড়িয়ার তাই গুরুত্ব সমধিক। সে শোনে—তৈলসেবা শিখতে হবে তোমাকে। আপন রস সর্ষের তেলে মিশিয়ে নিজের রসিকের দেহে মালিশ করবে। গুরু এলে গুরুর দেহে মালিশ করবে। এ ছাড়া সাধুসঙ্গী পেলে অর্ধবাহ্য সেবা করবে। দেহ দেবে না। অর্ধবাহ্য সেবা হল জিহ্বাশৃঙ্গার। মুখমেহন। শোনো, নারী হল স্বয়ংসিদ্ধা। আলাদা করে তার সাধনা শেখার দরকার নেই। কিন্তু শ্বাসের কাজ শেখা দরকার। দেহবস্তু রক্ষার প্রণালী শেখা দরকার। নারীই পুরুষকে সাধনপথে অগ্রগামী করে। আর ওই সাধনমুদ্রা শেখা সহজ নয়। ওই শিষ্যরা সব এসেছে। তারা গুরুর সামনে সঙ্গম করে সাধনমুদ্রা অভ্যাস করবে। দীক্ষা দিয়ে সূচিত হয় বাউলের সাধনা। কিন্তু তুমি দীক্ষাপূর্বেই তা আরম্ভ করেছ। অন্য সমাজের মানুষ তুমি। তোমার মন প্রস্তুত করার জন্যই গুরু এই অনুমতি দিয়েছিলেন। এবার তোমাকে অতীত জীবনচর্চা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে হবে। 

.

অবশেষে সেই সময় এসে যায়। রাত্রি আঁধার হলে গুরু ও গুরুমার সঙ্গে এসে বসে দুলুক্ষ্যাপা ও বুড়িয়া। বুড়িয়ার প্রাণ কাঁপছে। পারবে তো? সে পারবে তো? আজ তার একক দীক্ষা। তাদের ঘিরে একে একে বাকি সকলে এসে বসে। মহম্মদ সাঁই বলেন—তুমি কি প্ৰস্তুত আছ? 

বুড়িয়া বলে—আছি। 

–এই সভাকে তুমি মান্য করো? 

–করি। 

—তুমি কি জানো, এই দীক্ষায় তোমার পূর্বের সামাজিক সত্তার মৃত্যু ঘটবে? 

—জানি। 

—তুমি কাকে গুরু ধরতে চাও? 

—গুরু মহম্মদ সাঁইজি। 

~~তুমি গুরুর অনুগত থাকার প্রতিজ্ঞা করো? 

–করি। 

—তুমি গুপ্তচর্যার সকল গোপনীয়তা রক্ষা করতে সমর্থ? 

—হ্যাঁ। সমর্থ। 

–বাউল শিক্ষার চারধাপ। স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। সকলেই সাধক, কিন্তু গোড়ায় স্থূল সাধক। তোমার স্কুল সাধনা শুরু হবে তুমি জানো? 

—জানি। 

–এক গুরুর কাছে দীক্ষিত হলে গুরুর অনুমতি বিনা অন্য গুরুর দীক্ষা নেওয়া যাবে না। এই মর্মে এই সভায় প্রতিজ্ঞা করো। 

বুড়িয়া প্রতিজ্ঞা করে। তার স্বর কেঁপে যায়। দুলু বাউল এক দৃষ্টিতে বুড়িয়াকে দেখছে। স্বেদসিক্ত হয়ে যাচ্ছে সে। হরিমতি নিজের হাতে দুলু বাউলের হাত নিয়েছেন। ধরে আছেন শক্ত করে। বিংশতি বর্ষাধিক একটি ঘটনা তাঁদের মনে পড়ে যাচ্ছে। গুরু মহম্মদ সাঁইয়েরও কি মনে পড়ছে না? পড়ছে নিশ্চিতই। এমনই ছিল সেই দিন। শুধু উপস্থিত লোকগুলি ছিল আলাদা। দুলুক্ষ্যাপার অন্তর অস্থির হয়ে উঠেছে। সে কেবলই ভাবছে, কে এই মেয়ে? এতগুলি বর্ষ পার করে এ কে এল? এর সঙ্গে কার মিল? কার? তখন হরিমতি দুলুক্ষ্যাপার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসেন। বলেন—আমার বড় ভাবনা হচ্ছে দুলেন্দ্র। 

–মা! 

—ওকে দেখে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে তাকে। 

—কাকে মা! 

—তাকে রে। যে তোকে একলা করে দিয়ে চলে গেছিল। 

—ওর সঙ্গে মিল পাও? 

—না। 

—আমিও পাই না। 

—তবু আমার ওকে মনে পড়ে কেন? 

—শর্বরী কি অন্য রূপে ফিরে এল মা? 

—জানি না বাছা। কী কপাল করে তুমি এসেছ! 

—তুমি কপাল বলছ মা? 

—না। কপাল বলতে নেই। 

দু’জনেরই হৃদয় হতে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। এমনই দিনে শর্বরী গুরুকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই যে চলে গেল সে, আর ফিরল না। কোনও সম্পর্ক রাখল না দুলেন্দ্রর সঙ্গে। তার যে-ঠিকানা ছিল দুলেন্দ্রর কাছে, তা সত্য ছিল না। শর্বরী মিথ্যাচার করেছিল। এই মেয়ের সঙ্গে শর্বরীর কোনও মিল নেই। তবু মাঝে মাঝে কোনও কোনও ভঙ্গি চেনা লাগে কেন? সকল নারীই কি কোনও কোনও ভঙ্গিতে পরস্পর মিলে যায়? মহম্মদ সাঁই বলছেন—তোমার দীক্ষার জন্য পিতা-মাতার অনুমতি আছে? বুড়িয়া বলে—আমার পিতা জীবিত নেই। 

—মাতা? 

—মাতা জীবিত নেই। 

হরিমতির হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দুলু বাউল। তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপে। ভরা বর্ষার মেঘজলের মতো আবেগ আছড়ে পড়তে চায়। কেন সে জানে না। বুঝতে পারে না। মহম্মদ সাঁই মুখ মোছেন। খানিক গাঁজা টানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বলেন—একটু গীত হোক। তারপর বাকি কাজ। গা তো ক্ষ্যাপা। দুলুক্ষ্যাপা। বেটা, গা তো। 

দুলু বাউল মুখ নিচু করে। বলে—কী গাইতে আজ্ঞা হয় গুরুজি? 

—যা প্রাণে চায় বেটা। যা প্রাণে চায়। 

দুলু বাউল সুর লাগায়। তার গলা ধরে আছে। স্বর ভেঙে ভেঙে নির্গত হয় কণ্ঠ হতে। গান গায় স্বর। সেই স্বর তার আবেগে কাঁপে। 

সামান্যে কি তার মর্ম জানা যায়! 
হৃদকমলে ভাব দাঁড়ালে 
অজান খবর আপনি হয়। 
দুগ্ধে জল মিশাইলে 
বেছে খায় রাজহংস হলে 
কারো সাধ যদি যায় সাধন বলে 
হয় সে হংসরাজের ন্যায়। 

মানুষে মানুষের বিহার
মানুষ হলে দৃষ্ট হয় তার
সে কি বেড়ায় দেশ-দেশান্তর 
পিঁড়েয় পেড়োর খবর পায়। 
পাথরেতে অগ্নি থাকে 
বের করতে হয় ঠুকনি ঠুকে 
দরবেশ সিরাজ সাঁই দেয় অমনি শিক্ষে 
বোকা লালন সং নাচায় 

‘সাধু সাধু’ রব দেয় সকলে। বুড়িয়া বসে আছে ধ্যান-গম্ভীরের মতো। তার বুকের তলে মোচড় লাগছে। দুলুক্ষ্যাপা বড় সুন্দর পুরুষ। কিন্তু দুলুক্ষ্যাপার পাশে দাঁড়ায় তার নাট্যকার প্রেমিক। তার কৈশোরের প্রেমিক, তার কুমারীত্ব হরণ করা মায়ের বন্ধু, বাবার বন্ধু অমিতেশ কাকু। দাঁড়ায় কৌশিক, স্নেহাংশু, তারিকুল-এদের সকলের সঙ্গে সে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছে। প্রেমের নেশায় পাগল হয়েছে প্রত্যেকেরই জন্য। আবার সকলকে ছেড়ে এসেছে সাবলীল। সে ছেড়ে যাবে। দুলুক্ষ্যাপাকে ছেড়ে যাবে। ছেড়ে কোথায় যাবে? তখন সকল আড়াল করে দাঁড়ায় নারায়ণমূর্তি। রিচার্ড নারায়ণমূর্তি। দুটি সরল চোখ তুলে সে ডাকে— বুড়িয়া! 

মহম্মদ সাঁই বলেন—তোমার পিতৃ-মাতৃস্থানীয় কে? 

বুড়িয়া উত্তর দেয়—আমি কারওকে পিতৃ-মাতৃস্থানীয় হওয়ার যোগ্য মনে করি না।

এই উত্তরে উপস্থিত সকলে বিমূঢ় বোধ করে। মহম্মদ সাঁই বলেন-তোমার অভিভাবকের অনুমোদন দরকার। 

—আমিই আমার অভিভাবক। 

–বেশ আমি তবে আয়োজন শুরু করছি। 

জাহিরা একগ্লাস জল ও একটি রেকাবে সামান্য চাল তুলে ধরে। গুরুকে দেয়। গুরু চাল গ্লাসে ফেলে চাল-জল করেন। তাঁর উচ্ছিষ্ট জল চালসহ গ্রহণ করে প্রত্যেকে। তারপর গুরুকে প্রণাম করে একে একে বেরিয়ে যায়। ঘরে থেকে যায় কেবল গুরু স্বয়ং। গুরুমা। বুড়িয়া ও দুলুক্ষ্যাপা। 

মহম্মদ সাঁই বলেন—তোমরা কি বিবাহ করতে চাও? 

দুলু বাউল কোনও উত্তর দেয় না। বুড়িয়া বলে না। 

—কেন? 

—বিবাহকে আমি সম্পর্কের সূত্র বলে মানি না। 

—বেশ। দক্ষিণা আনো। 

এক কোণে গুছিয়ে রাখা ছিল সব। বুড়িয়া একে একে সব গুরুর হাতে তুলে দেয়। একটি নতুন থালায় পাঁচ পোয়া চাল। পাঁচটি সুপারি। পাঁচটি পান। পঞ্চাশ টাকা ও কাপড়। এই সবই কিনে এনেছে দুলু বাউল একজন যথার্থ গৃহস্বামীরই মতো। মহম্মদ সাঁই বুড়িয়াকে বামপার্শ্বে বসান। মুখ নিয়ে যান কানের কাছে। বুড়িয়া চোখ বন্ধ করে। শুরু হল। এবার শুরু হল। সে অল্প অল্প কাঁপে। মহম্মদ সাঁই বলেন—বলো কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধে কৃষ্ণ রাধে। 

সে চোখ না খুলেই বলে—কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাধে কৃষ্ণ রাধে। 

তাকে নাভি থেকে শ্বাস নিতে শেখান মহম্মদ সাঁই। নাভি থেকে উত্থিত বায়ুকে ঊর্ধ্বগামী করে তোলা এক দিনের কাজ নয়। গুরু তাঁর ‘পদ্ধতি প্রদর্শন করেন মাত্র। এবং এইভাবে শ্বাস টানার আগে জপমন্ত্র বলে দেন— 

রতির ঘরে রতন কালা
রতির তরে লিঙ্গারতি 
রতির ঘরে যোনির প্রদীপ 
সঙ্গমে ঘোর আগুন জ্বালা 

বুড়িয়া উচ্চারণ করে। কিন্তু জানে সে, মন্ত্র বাউলের কাছে প্রধান নয়। মন্ত্র শুধু গুরুকে মনে জাগিয়ে রাখার উপায়। দীক্ষায় গুরু জ্ঞানের শলাকা ছুঁইয়ে শিষ্যের দৃষ্টির উন্মীলন করেন। বাউলের দীক্ষা শুধু মানসিক জ্ঞানে পূর্ণ হয় না। মহম্মদ সাঁই বললেন—আজ তোমার মাসিকের কোন দিন? 

বুড়িয়া বলল—দ্বিতীয় দিন। 

—এঃ! 

মহম্মদ সাঁই মুখবিকৃত করেন। বলেন- আজ তা হলে দীক্ষা পূর্ণ হবে না। কাল তোমাকে শেখাব কী করে দীর্ঘস্থায়ী দেহমিলন সম্ভব হয়। 

বুড়িয়া ভাবছিল, সে যে এইসময় রজঃস্বলা থাকবে, তা এই ব্যক্তি কী করে জানলেন! তাঁকে কি এই মর্মে খবর দেওয়া হয়েছিল? 

তখন মহম্মদ সাঁই দু’হাতে তার মুখ ধরেন। বলেন—জিহ্বা দাও। 

সে ইতস্তত করে। ঘরে কোনও শব্দ নেই। লণ্ঠনের আলোয় মহম্মদ সাঁইয়ের বলিরেখাযুক্ত মুখে ছায়া পড়ে। কালো ওই মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়িয়ার কণ্ঠ শুকিয়ে যায়। গুরুর দেহের কটু ঘ্রাণ তাকে বিপর্যস্ত করে। তবু জোর করে সে। পারতে হবে তাকে। পারতেই হবে। 

বাইরে জসিম বাউলের গলা শোনা যায়—এসো, জব্বারভাই এসো। 

জব্বার কিছু বলে। বুড়িয়া ঠিক ধরতে পারে না। মহম্মদ সাঁই আবার বলেন—জিহ্বা দাও।

তাঁর স্বর প্রায় ধমকের মতো শোনায়। বুড়িয়া চোখ বন্ধ করে জিহ্বা এগিয়ে দেয়। গুরু তার জিহ্বা আপন মুখবিবরে ধারণ করেন। প্রায় তার জিহ্বামূল অবধি গিলে ফেলে শোষণ করতে থাকেন। বুড়িয়ার কান্না পেয়ে যায়। এ কোন দায় সে নিয়েছিল? কেন নিয়েছিল? অতীতের কোনও এক অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেবার এ জঘন্য দায় কেন নিল সে। সে হাত মুঠো করে সহ্য করে। সহ্য করতে থাকে। দুলু বাউল সঙ্গমকালে যেভাবে তার জিহ্বা শোষণ করেছে, তার মাধুর্য এখানে অনুপস্থিত। তার দম আটকে আসে। নাকে মহম্মদ সাঁইয়ের দাড়ি ঢুকে যায়। সে ছটফট করে ওঠে। তখন গুরু তার জিহ্বা ছেড়ে দিয়ে কড়োয়া পেতে বলেন—রজঃ দাও। 

সে দাঁতে দাঁত চাপে। কড়োয়া ধরে তার যোনিস্থলে। আধুনিক ব্যবস্থায় সেখানে তুলোর আড়াল। মহম্মদ সাঁই বলেন—অবস্তু সরাও। রজঃ দাও। 

সে এক টানে খুলে নেয় তার ছোট্ট রঙিন শহুরে আবরণ। তার লজ্জা, সংকোচ, শিক্ষা, সংস্কার সবই সেই আবরণের সঙ্গে নির্গত হয়ে যায়। রক্ত নিঃসরণ কড়োয়ায় ধরে দিতে দিতে সে দুলু বাউলের দিকে দেখে। পাথরের মতো বসে আছে লোকটা। সহসা তার ক্রোধ জন্মায়, ঘৃণা জন্মায় মানুষটির ওপর। কোনও পুরুষ কী করে তার নিজস্ব নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গমে দেয়? হোক গুরু! তবু তবু তবু! 

সে কড়োয়া দেয় মহম্মদ সাঁইয়ের হাতে। তিনি সেই রজঃবস্তু মুখে মাখেন। তারপর পরিধেয় খুলে দাঁড়ান। আদেশ করেন বুড়িয়াকে— পরিধেয় মুক্ত হও। 

সে দ্রুত খুলে ফেলে পোশাক-আশাক। তিনটি মানুষের সামনে নগ্নদেহে দাঁড়ায় সটান। মহম্মদ সাঁই বলেন—মুখমেহন করে গুরুবস্তু এই কড়োয়ায় ধরো। তারপর এই মিশ্রণ গ্রহণ করো। মুখে ধরে তোমার সাধনসঙ্গীকে দাও। এই হল গুরুবীজ রোপণের পদ্ধতি। এভাবেই তোমরা হবে আমার অযোনিসম্ভব সন্তান। 

গুরু শয়ন করেন। সে বসে। গুরুলিঙ্গ এই বার্ধক্যেও দীর্ঘ, পুরু এবং সবল। সে স্পর্শ করা মাত্র তা উত্থিত হয়। সে চোখ বন্ধ করে লিঙ্গে মুখ রাখে আর দেহ কাঁপিয়ে, সত্তা আলোড়িত করে, বিকট বিকৃত শব্দ করে। বমি উঠে আসে তার। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সে আর বমন করে টানা। চোখ থেকে জল পড়ে তার। একসময় তার মাথা ভার হয়ে আসে। সে চৈতন্য হারাতে থাকে। নিজেরই বমিবস্তুতে পড়ে তার মুখ। মাখামাখি হয়ে যায়। গুরুর লোলচর্মাবৃত নগ্ন দেহেও লাগে তার ছিটে। হা-হা করে কেঁদে ওঠে দুলু বাউল। গুরু মহম্মদ সাঁইয়ের পায়ে পড়ে মুখ ঘষতে থাকে সে। ক্ষমা করুন। আমাকে ক্ষমা করুন গুরুজি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *