রাজপাট – ৪৮

৪৮

জ্যৈষ্ঠি না মাসের দিনে 
গাছে পাকে আম। 
জামাই কন্যায় আম খাওয়াইতে 
কত ধুমধাম ॥ 
কেউ আনে নিজের বাড়িত 
কেউ পাঠায় ভারে। 
আরিপরি খাইয়া তারা 
খুশি আমোদ করে ॥ 
আমকাঁঠাল খাইয়া গায় 
বেয়াইর পাঞ্জালি। 
কন্যার মায় উশাস ছাড়ে 
কোর অইছে খালি ॥  

.

জ্যৈষ্ঠের প্রথম কয়েকদিন শুখা গেল। ডালশস্য নির্বিঘ্নে ঘরে তোলা গেছে। আউশ বোনার পালা চলবে এবার। যারা ডালশস্য আবাদ করেনি, তাদের জমিতে আউশের কচি সবুজ শির উঠেছে। এ মাসে মাঝে-মধ্যে বর্ষণ ফসলের পক্ষে ভাল। সবচেয়ে ভাল, রাতে বর্ষণ হবে, দিনে থাকবে রোদ্দুর। 

প্রথম কয়েকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় গাঁয়ে গাঁয়ে কৃষাণবধূরা মেঘরানির কুলো নামিয়েছিল। জলের ঘট নিয়ে সকল গৃহস্থ ঘরে ঘোরা। আগে যাবে কুলো। তারপর জলের ঘট। গৃহস্থবাড়ি হতে অল্প অল্প জল নিয়ে ঘট পূর্ণ করা। তারপর সেই ঘটপূর্ণ জল ফেলে দিতে হবে জলাশয়ে। কুলোর বাতাস দিয়ে বলতে হবে— 

হ্যাদে লো বুইন ম্যাঘারানি। 
হাত পাও ধুইয়া ফ্যালাও পানি ॥ 
ছোট ভুঁইতে চিনচিনানি 
বড় ভুঁইয়ে আডু পানি ॥ 
ম্যাঘারানির ঘরখানি পাথরের মাঝে।
কোন রাজত্বে গ্যালা বুইন কোন হুনা কাজে ॥ 
 ম্যাঘারানি ঘটের পানি কোন ঘরেতে রাখে?
হেই বৃষ্টি ঘট ভাইঙ্গা নাম লো ঝাঁকে ঝাঁকে ॥ 
ও ভাই কাইলা ম্যাঘা, ধইলা ম্যাঘা 
বাড়ি আছ নি? 
গোলায় আছে বীজ ধান 
বুনাইতে পারো নি? 

.

এমন আকুল আহ্বানে কৃষাণ-বউয়ের বোন মেঘরানি ঘট দিলেন উপুড় করে। জ্যৈষ্ঠে এমন বৃষ্টি, গলে যাবে শিশু ধানগাছ। গলে যাবে বীজ। পুষ্ট পুরম্ভ কলাইয়ের শটি খসে যাবে গাছ হতে। চাষিরা কালো আকাশ দেখে মুখ ব্যাজার করছে এখন। এ যেন আগবর্ষা নামল। কথায় বলে—

জ্যৈষ্ঠে মারে আষাঢ়ে ভারে।
কাটিয়া মারিয়া ঘর ভরে ॥  

অল্প-স্বল্প বৃষ্টি দিয়ে জ্যৈষ্ঠ যাবে শুকনো আর আষাঢ়ে নামবে ধারাবৃষ্টি। তা হলে ভূরি পরিমাণ শস্য উৎপন্ন হবে। যদিও প্রকৃতি প্রতি বৎসরই শাস্ত্র মেনে ঋতুবিন্যাস করে না, অতএব চাষিকেও ধৈর্য ধরতেই হয়। তাদের শঙ্কা এখনও বড় হয়ে ওঠেনি। এবং শঙ্কার ছোঁয়া লাগেনি উৎসবাদিতে। কথায় বলে জ্যৈষ্ঠ হল রসঋতু। খরদাহের তীব্রতা সত্ত্বেও ফলত্বকের আবরণের তলায় কী মিষ্ট রস! আমে রস, জামে রস, কাঁঠালে রস, লিচুতে রস। আর তেমনই শুখা মাটির বুক চিরে উঠে আসে জীবনের সুঘ্রাণ। জুঁই, বেল, মল্লিকা, চাঁপা আশ্রয় করে প্রকৃতি ঘর্মক্লান্ত দেহে ঢেলে দেয় সুবাসিত আবেশ। 

এমন রসের মাসে, এমন সুগন্ধের মাসে, মন উতলা হবে না কার! 

বসন্ত হৃদয় উদাস করে। দেহ পাগল করে। চেতনাকে রঙিন ভাবনা দ্বারা আচ্ছন্ন করে দেয়। বসন্ত রটায় মিলনোন্মাদনা। ফাল্গুনের জ্বলন দেহী। দেহব্রতী। আর জ্যৈষ্ঠের উদাসীনতায় স্নেহ ভরা। উন্মাদক নয় সে। বরং আকুলকরা। সে আকুলেও আছে দেহবোধ কিন্তু তা শান্ত। এ হল রসভাগের কাল। সুগন্ধ ভাগের কাল। ফাগুনের বৈধতার সীমা ছাড়ানো হাতছানি নয়, বরং ঘরের কোণে তাঁকে মনে পড়ে। রেকাবে রাখা জুঁইফুল কার প্রতীক্ষায়? বালিশের পাশে রেখে দেওয়া বেলের মালা কার প্রতীক্ষায়? থরে-বিথরে ছড়ানো রসভরা ফলগুলি তার পাতে না দিয়ে খায় কী করে মানুষ! 

জ্যাট মাসে ডালিম গাছে হয় দ্যাকো কলি। 
তখন ক্যানে যান তিনি বাণিজ্যেতে চলি ॥ 
গাছে ত হইল অসের ডালিম কাঁইবেন ধরে তারে। 
পচইয়া পইড়ব ডালিম তুমি না থাকিলে ঘরে ॥  

এমন ফলফুলের মরশুম, জামাইরা আসছেন শ্বশুরবাড়ি। কোথাও কোথাও বিয়ে-সাদির ধুম উৎসব। যেমন বরকত আলির গৃহে এখন লোকে লোকে ভরা। আত্মীয়-কুটুম্বের সমাগম। বরকত আলির বিবি আর ছেলেদের নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। বরকত আলি চতুর্দিকে দেখে বেড়াচ্ছেন। কোথাও যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে। গৃহসংলগ্ন সবজিবাগানে হয়েছে ভোজের আয়োজন। 

চার দিন ধরে ফিরোজাকে হলুদ মাখানো চলছে। পাত্রের বাড়ি থেকে হলুদ, তেল, সাবান, তোয়ালে, কাপড় প্রভৃতি এসেছে। এসেছে মিষ্টি ও মাছ। কয়েকজন আত্মীয়া, তাঁরা গানে নিপুণা, আচরণে সরসা, বাচনে প্রগলভা— ফিরোজাকে তাঁরা অস্থির করে তুলছেন। বিধবা কয়েকজন, তাঁরা গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানে দূরত্ব বাঁচিয়ে রাখছেন। কিন্তু ফিরোজাকে ঘিরে গীত গাইছেন সকলেই। পাড়ার প্রতিবেশিনীরাও যোগ দিয়েছেন। সকল প্রতিবেশীর এ অধিকার নেই। মানে আর বরকত আলির সমান কে! ধনেও বরকত আলির বড় কেবল চাটুজ্যেরা। বাকি সব চার-ছয় বিঘার চাষি। তবু তাদের মধ্যে যারা সচ্ছল, যারা বরকত আলির রাজনৈতিক সহযোগী, এসেছেন তাঁদের ঘরের বিবিরা। গান হচ্ছে। 

উঁচু ঘরের চৌরঙ্গি উসারা 
আরিল কাঠের ক্যাওট যে 
সেই না উসারায় বসে নয়ালাল 
বিয়ার লিখন লিখে যে 

উঁচু ঘরের প্রশস্ত, উঠোন, তাতে আবলুশ কাঠের কপাট দেওয়া দোর। সেই উঠোনে বসে নবরর প্রেমলিপি লিখছে। 

লিখিতে লিখিতে হাতের কলম 
গেল পড়ে যে 
কুথায় গেলে ওগো কামিনী 
দাও না কলম গুড়ায়ে 

লিখতে লিখতে বরের হাত থেকে লেখনি পড়ে গেল। বর তখন নববধূকে উদ্দেশ করে বলছে—হে প্রিয়তমা, গেলে কোথায়? আমার কলমটা কুড়িয়ে দিয়ে যাও। 

কী কাণ্ড! যার উদ্দেশে প্রেমপত্র রচনা— তাকেই নাকি কুড়িয়ে দিতে হচ্ছে কলম! বিবি ও তেমনি টেটিয়া। বলছে— 

বাবাজি দিয়েছে সাত বাঁদি 
কেমনে কলম গুড়াইব 

বধূ বলছে—আমার বাবা সাতবাঁদি পাঠিয়েছেন না? আমি কী করে কলম কুড়োই? 

তুমার হাতের কলম হলে গো কামিনী 
লিখন হবে মোর ভাল যে
বাঁদির হাতের কলমে কামিনী 
লিখন হবে মোর বাঁকা যে 

বর বলছে—বাঁদি যদি কলম কুড়িয়ে দেয়, লেখা আমার বাঁকা হবে। একমাত্র তুমিই যদি কুড়িয়ে দাও প্রেয়সী, তবেই আমি স্বর্ণাক্ষরে লিখব। অর্থাৎ কলম কুড়িয়ে দেওয়া ছল। আসল উদ্দেশ্য বিবিসাহেবার সান্নিধ্য পাওয়া। পরস্পরের চেনাজানা এখনও তেমন মেলেনি কিনা, তাই ছলচাতুরির আড়াল লাগছে! 

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু মধুযামিনীর গানে ফিরোজার কান গরম হয়ে উঠতে লাগল। আত্মীয়াদের হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করছিল সে। কিন্তু মহিলারা ছাড়বেন কেন? গাঁয়ের বিয়েতে এটুকুই তো আমোদ আহ্লাদ। আর আহ্লাদের মধ্যমণি কনে। অতএব মধুযামিনীর গানে পাগল হল সবাই। 

সোনার পালঙ্কে শুয়ে সোলেহার 
রূপোর পালঙ্কে পাও যে 
সরে শোও না গো ওগো সোলেহার 
তোমার গরমিতে জুও ঘেমে ওঠে যে 

পালঙ্ক জুড়ে কনে শুয়ে আছে। একেবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যেন সোনার খাটে শুয়ে রুপোর খাটে তুলে দিয়েছে পা। বর বলছে—সরে শোও। তোমার শরীরের আঁচে আমার শরীর যে ঘেমে উঠল। 

ইরবুঝ দামাদের নিরবুঝ কথা 
কবে আক্কেল হবে যে 
নারীর গরমিতে পুরুষ 
কখনও ঘামে যে 

হায়! কী বেআক্কেলে বর! তার বুদ্ধি হবে কবে। নারীর মধুর উষ্ণতায় পুরুষ স্বেদক্লিষ্ট হয় কখনও? 

সোনার পালঙ্কে শুয়ে সোলেহার 
রুপোর পালঙ্কে পাও যে 
সরে শোও না গো ওগো সোলেহার 
তোমার গরমিতে জুও ঘেমে ওঠে যে 
ইরবুঝ দামাদের নিরবুঝ কথা 
কবে আক্কেল হবে যে 
যে ডালেতে পাখি বসে 
ডাল কখনও ভাঙে যে 
যে পুকুরে মাছ থাকে 
পুকুর কখনও কাঁপে যে 

কী বোকা এই বর। কবে তার বুদ্ধি হবে। পাখির ভারে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে নাকি কখনও? মাছের সাঁতারে পুকুরের জলে আলোড়ন ওঠে? 

এইসব গানের মর্মানুধাবন করছিল না ফিরোজা। তার ষোলো পূর্ণ হওয়া হৃদয় বিচ্ছেদের বেদনায় ভারাক্রান্ত ছিল। চলে যেতে হবে এই গ্রাম ছেড়ে। বাবা-মাকে ছেড়ে। ভাই, ভাই-বউ, তাদের ছোট ছোট সন্তানগুলি ছেড়ে। এই ভৈরবের কিনার হতে সে পৌঁছবে ভাগীরথীর কিনারে। তেকোনা থেকে যাবে চতুষ্কোনায়। কেমন সেখানকার মানুষজন? কেমন তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, অন্যান্য পরিজন? 

গ্রামে ফিরোজার চেয়েও ছোট মেয়েরা বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। ঘর-কন্না করে। পনেরো বা ষোলোতেই মা হয়ে যায়। প্রধান জনাব বরকত আলি একজন আলোকপ্রাপ্ত আধুনিক মানুষ বলেই তাঁর কন্যা এই পূর্ণ ষোলো অবধি ঘরে থাকতে পারল। তবু বিষাদ-বেদনা তাকে আচ্ছন্ন করেছে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে, এই তার নিয়তি। এর অন্যথা হলে কি তার ভাল লাগত? গ্রামের পড়শিরা, আত্মীয়েরা নিন্দায় তিষ্ঠোতে দিত না। তৎসত্ত্বেও, যেখানে জন্মেছে, বড় হয়েছে, যাঁদের বুকের উত্তাপে সে হয়ে উঠেছে পূর্ণ ষোলোর ফিরোজা আজ, তাঁদের ছেড়ে যেতে প্রাণ কাঁদে। মন হু-হু করে। 

সকাল-সকাল তাকে স্নান করিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সালঙ্কারা এখন সে। সেজেগুজে বসে আছে। বিয়ে বসবে দুপুর একটায়। এগারোটার মধ্যে বরের চলে আসার কথা। বরকে মনে মনে কল্পনা করেছে সে। দেখেনি। তার বর। তার দুলহা। বিষাদ ফাটিয়ে কখনও-বা এক আনন্দের শিরশিরানি জেগে ওঠে অন্তরে তার। কেমন সে? প্রেমিক পুরুষ কি? তার আব্বাজানের মতো? তার আম্মিকে ছাড়া যেমন চলে না আব্বার একটি দিনও, তার বরও কি তেমনি জাপটে নেবে তাকে জীবনে? হয়তো তারই নাম সুখ, যার সন্ধানে সে যাচ্ছে। তারই প্রার্থনায় সকল মেয়েই পিতৃগৃহ ছেড়ে যায়। ডিঙিয়ে যায় আজন্মের চেনা চৌকাঠ! দু’হাতের দুই করতলে হরষ আর বিষাদ নিয়ে বসে আছে ফিরোজা নামের ষোড়শবর্ষীয়া কিশোরী। মহিলারা তাকে ঘিরে আছে। 

এই বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে সিদ্ধার্থ এসেছে বহরমপুর থেকে। এবার তৌফিক এসেছে তার সঙ্গে। কারণ বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হলে তারা নদীপাড়ের গ্রামে গ্রামে যাবে। সিদ্ধার্থ তৌফিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল বরকত আলির। তৌফিক বলল— বিনা দাওয়াতেই চলে আসলাম মামা। 

সে আবিষ্কার করেছে, কোন দূর সম্পর্কের সূত্রে বরকত আলি তার মামা হয়ে ওঠেন। কত সম্পর্ক পড়ে থাকে এমন। কত সম্পর্ক বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায়। সে সেই সম্পর্কসূত্র ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে বরকত আলিকে। বরকত আলি শুনতে শুনতে খুশি হয়ে উঠছেন। তিনি তৌফিকের হাত ধরছেন। সিদ্ধার্থর হাত ধরছেন। আজ তাঁর আনন্দের দিন। দুঃখের দিন ও বটে। তিনি বারবার উদাসী হয়ে উঠছেন। খুশি বেগমের দম ফেলার সময় নেই। আজ সকাল হতে সারা দিবসের জন্য তিনি উপবাসী। মেয়ে চলে যাবে বলে তাঁরও প্রাণ কেঁদে উঠছে। কিন্তু কাঁদবার সময় কোথায়? বরং বরকত আলির উদাসী ভাব দেখে ছেলেদের ডেকে তিনি বলছেন—আব্বাকে গিয়ে বলো একটু বিশ্রাম নিতে। 

এরশাদ এসে দাঁড়াল কাছে। বলল— আব্বু, মা তোমাকে বললেন একটু বিশ্রাম নিতে।

বরকত আলি এই ফাঁকটুকু চাইছিলেন। বললেন—তা তোমরা একটু দেখেশুনে নাও। আমি একটু আসি। 

সকাল সাড়ে ন’টা। বর আসতে দেরি আছে। আত্মীয়-স্বজন এসে পড়ায় বরকত আলি প্রত্যেককে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। বড় শ্যালককে বলেছেন—আপনি পাকশালের দায়িত্ব নেন। 

ছোট শ্যালককে বলেছেন—আপনার ওপর ভাঁড়ারের ভার রইল। 

কেউ বরযাত্রীর দেখভাল করবেন। কেউ ভোজনের আয়োজন দেখবেন। কন্যার পিতা হিসেবে তিনি থাকবেন সর্বত্রই। তবু একটু ফাঁক, একটু অবসর তাঁকে আরাম দিল। সিদ্ধার্থ ও তৌফিককে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভিড়ের বাড়ি হতে বেরিয়ে পড়লেন। বড় স্বস্তি বোধ হল তাঁর। বাইরের কাজে যারা অভ্যস্ত, ঘরের কাজে তাদের অধিকক্ষণ মন লাগে না। 

আকাশে মেঘ আছে। বৃষ্টি হলে কাজের বাড়িতে বড় অসুবিধা হয়। তা ছাড়া হরিহরপাড়ার পর থেকেই রাস্তা খারাপ। মরালী পর্যন্ত তবু যা হোক, কিন্তু মরালী হতে তেকোনার পথ আর পথ থাকে না বর্ষা হলে। কাদামাটির তাল হয়ে যায়। হরিহরপাড়া থেকে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা আছে যদিও, আর মোহনলাল বরকত আলির মেজ ছেলে হাসনাতকে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বর আনতে গেছে, তবু বরকত আলি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। তিনি বললেন— তোমরা এসেছ, আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে বিবশ লাগে। মেয়ে আমার সুখী হবে তো? সিদ্ধার্থ বলল—নিশ্চয়ই হবে। কেন ভাবছেন চাচা? আমার দাদু বলেন, শুভদিনে শুভ ভাবতে হয়। 

বরকত আলি মাঠের পথ ধরেন। সেদিন তাঁর জমিসংলগ্ন কাঁঠালগাছের তলা তাঁর দেহ-মনকে স্নিগ্ধ করেছিল এমন, তিনি পরের দিনই মজুর দিয়ে বাঁশের বেঞ্চ গড়েছিলেন ওখানে। আহা! কী স্নিগ্ধ ছায়া! কী পাখির ডাক! বাতাসের কী মিষ্টতা! প্রকৃতি যেন এমন সম্ভাষণ তাঁকে করেনি কখনও আগে। নিজেকে সবার থেকে, সবকিছু থেকে আলাদা করে এমন একাকী দেখা আগে কখনও ঘটেনি। এখন বয়স যত তাঁকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে, তত যেন মাটির ভাষা বুঝতে পারছেন। জনাব বরকত আলি পঞ্চায়েত প্রধান থেকে জনাব বরকত আলি এম এল এ পর্যন্ত টইটম্বুর স্বপ্নের বাইরেও থেকে যাচ্ছে আরও কিছু, একা বসে যার সন্ধান করতে হয়। 

এখন বরকত আলি সেই কাঁঠালতলার দিকে চলেছেন। পায়ে কাদা মাখামাখি হয়ে গেছে প্রত্যেকেরই। পরিষ্কার পাজামায় মাটির ছোপ ধরছে, শিরাবরণে লেগে যাচ্ছে জলের ফোঁটা। তবু চলেছেন। 

সিদ্ধার্থর মনে পড়ছে, বরকত আলি প্রথম যেদিন তাকে গ্রাম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন কত দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। আগাগোড়া ভদ্রতা ও সমীহে মোড়া একটি স্বার্থপূর্ণ আলাপ হয়েছিল সেদিন। কিন্তু এখন যেন তার মনে হচ্ছে সে বরকত আলির ঘরের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে। যা সে হতে চায়। মানুষের অন্তরের আত্মীয় হতে না পারলে নেতৃত্ব গড়ে তোলা যায় না। নেতাকে হতে হবে ঘরের ছেলে। আপনজন। সে ভাবে, সে কি নেতা? যে- অর্থে মানুষ নেতা বোঝে, সে তা নয়। তার কোনও সিংহাসন নেই। মাটিতেই তার আসন। কিন্তু যে-কাজগুলি সে করতে চলেছে, যে-আন্দোলন গড়ে তুলতে চলেছে, তাতে সে নেতৃত্ব দেবে। এ নিয়ে তার কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। বিনয় নেই। 

কাঁঠালগাছের নীচে বাঁশের আসন দেখে ভাল লাগল সিদ্ধার্থর। সে বসতে বসতে বলল—বাঃ চমৎকার। 

বরকত আলি বললেন—একটু ভেজা আছে। 

—থাক। 

—চা খাবে তোমরা? 

—এখানে চা কোথায় পাওয়া যাবে? 

—নদীর পাড়ে ইসমাইলের দোকানে চা করে এই সময়। আনতে পাঠাই? 

—বেশ। 

—ইদরিশ। এই এই ইদরিশ। 

বরকত আলি হাঁক পাড়েন। মাঠের কাজ ফেলে একটি যুবক ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে—জি।

—মেহমান এসেছেন। চা খাওয়া ইদরিশ। 

পকেট থেকে টাকা বার করে দেন তিনি। 

~কেটলির মুখ এঁটে নিয়ে আসবি। গরম থাকে যেন। 

ইদরিশ চলে যায়। বরকত আলি বলেন—বড় বদনসিব এই ছেলে। ছোট একটা মেয়ে ছিল। মরে গেল। 

বরকত আলি সংক্ষেপে মাসুদার মেয়ে ফরিদার মরণকাহিনি বর্ণনা করলেন। তৌফিক শিউরে উঠল। সিদ্ধার্থ জানত এ-ঘটনা। তবু আরও একবার বিদীর্ণ হল সে। বরকত আলি বললেন-কার কপালে কী লেখা আছে! ভাবলে মন বিবশ হয়ে যায় হে। ফিরোজার মা বড় ভাবনায় আছে। অতগুলো টাকা দিলাম। 

সিদ্ধার্থ জিগ্যেস করে—কী টাকা? 

—বুক ভারী হয়ে আছে। গ্রামের কারওকে তো একথা বলা যায় না। তোমাকে বলি। তোমাকে বলতে ইচ্ছা করে। মুসলমানের বিয়েতে বরপণ ছিল না। এখন হিন্দুদের দেখাদেখি ঢুকেছে। শিক্ষিত জামাই আনতে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে আমার বরপণের জন্য। 

—পঞ্চাশ হাজার? 

—জামাই আমার ভাল। স্কুলে চাকরি করে। এমএ পাশ। তা খরচ করলাম। ফিরোজা তো লেখাপড়া জানে না। তবে হ্যাঁ, দেনমোহরের পনেরো হাজার ওরা ওই পণের টাকা থেকেই দেবে। অর্থাৎ আমাকে দিতে হল পঁয়ত্রিশ হাজার। পণ হিসাবে তো নেয় না! বলে, মেঝে পাকা করতে হবে। শেষ অব্দি তো আপনার মেয়েই থাকবে। তার পাকা মেঝেতে থাকা অভ্যেস। কথাও ভুল না। তা দেনমোহরের চাঁদি, সে-ও আমার মেয়ের থাকবে। আমি কিছু নিব না। কিন্তু খরচ তো এই এক না! এত লোকের খাওয়া-দাওয়া। মেয়ের অলংকার। চাষির ঘরে টাকা আর কতটুকু জমে! ছেলেদের বিয়ে দিয়েছি। সংসার চালিয়েছি কোনও কাপর্ণ না করে। জমা টাকা কিছু ছিল না তেমন। চারবিঘা জমি বেচে দিলাম। আর তিরিশ হাজার টাকা কর্জ নিয়েছি চাটুজ্যের কাছে। তা সোম আমার বন্ধু মানুষ। বিনা সুদেই সে টাকা দিয়েছে। কিন্তু কী জান, ঋণ মানুষকে নিচু করে, নত করে, দুর্বল করে। রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে আমাকে এবার সিদ্ধার্থ। 

—কেন একথা বলছেন? ঋণ নিয়েছেন, শোধ হয়ে যাবে। রাজনীতি ছাড়বেন কেন? আপনাকে কত প্ৰয়োজন! 

—ঋণ নিয়েছি বলেই তো মোহনলাল আমাকে অবজ্ঞা করে। আমার ওপর কথা বলার সাহস পায়। অপমান হই আমি। কারওকে কিছু বলতে পারি না। যা সব শুরু হয়েছে, এর মধ্যে আমি থাকতে পারব না। 

—ঋণ তো আপনি মোহনের কাছ থেকে নেননি চাচা। এটা সোমকাকার সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া। 

—তা বললে কি চলে? মোহনের মধ্যে তার প্রকাশ দেখা যায়। যা সব শুরু হয়েছে, তোমাকে বলব। সব বলব। সিদ্ধার্থ, তুমি মোহনের বন্ধু। কিন্তু আমাদের কাছে এখন আর সেইটা তোমার একমাত্র পরিচয় না। আমরা একই পার্টির সদস্য, সেইটা একটা বড় পরিচয়। আসলে তুমি কী জানো? এইসব সত্ত্বেও কিন্তু আসলে তুমি নেতা। আমি লেখাপড়া জানি না। কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে আমার। অনেক বড় হবে তুমি। তাই তোমার সব জেনে রাখা দরকার। মোনাজাত করি আমি তোমার জন্য। মোনাজাত করি। 

কেটলি আর কাচের গ্লাস এনেছিল ইদরিশ। চা দিল। সিদ্ধার্থ বলল— পঞ্চরসের আসরে তুমি লালনের গান করেছিলে না? 

—জি।

—খুব ভাল গেয়েছিলে। 

—জি, আপনাদের দোয়া। 

বরকত আলি বলেন—গুণী ছেলে। কিন্তু পাগল। কাজে মন দেয় না। তোর বিবি ভাল আছে তো ইদরিশ? 

—জি। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। 

—আহা! যা ইদরিশ, কাজে যা তুই। খোদার ওপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ দুপুরে দাওয়াত নিতে ভুলিস না। বিবিকে আনিস সঙ্গে। 

—জি। 

কান্না ভুলে কি কেউ দাওয়াত নিতে আসে? আসে না। সন্তানের মৃত্যুশোক, অকালমৃত্যু হয়ে, অপমৃত্যু হয়ে যা নেমে এসেছিল, সেই শোক, পোড়ায়, পেষে, এফোঁড়-ওফোঁড় করে। তবু স্বাভাবিক সজ্জিত জীবনের আহ্বান থাকে তার জন্য। এ হল সান্ত্বনার বাক্য। সকলেই বোঝে। ইদরিশ মাঠের দিকে যায়। বরকত আলি বলেন —মোহন আমাকে কী বলে শোনো। বলে রেশমকুচিতে কংগ্রেস জেতে নুর মহম্মদের জন্য, ওর ডানা ছেঁটে দেন। ওই বর্ডার পার হওয়া উদ্বাস্তুগুলি ঘাঁটি করেছে, বলে ওদের টাকা দেন, কাজ দেন, ভোটে ওরা কাজে লাগবে। বলে, তিন লক্ষ টাকা খরচ দেখাবেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে রাখবেন তার থেকে। ভোটের জন্য খরচ করবেন। চুরি তো আমার ধর্ম নয়। আমি কী করে পারব! যত ছেলে সীমান্তে চোরাচালান করে, তাদের জুটিয়েছে। আমি কখনও ওদের পাত্তা দিই নাই। সে দিচ্ছে। শিক্ষিত ছেলে। তাদের পরিবারের কত সম্মান। তাকে কি মানায় এইসব? তার বাপের সঙ্গে আমার ভাইয়ের সম্বন্ধ। সেকথা মনে রাখতে চায় না সে। আমার বিরোধী যত আছে, তাদের সঙ্গে দল গড়েছে। পয়োস্তি বণ্টনের কাজটা পর্যন্ত ভেস্তে দিল এই করে। নেতা হতে চায়। মোহন চাটুজ্যে নেতা হতে চায়। কিন্তু তার জন্য ধৈর্য ধরতে জানে না। 

তৌফিক বলল— মোহনদা এরকম কবে হয়ে গেল সিধুদা? 

—আমিও জানি না তৌফিক। চাচা, আপনাকে শক্ত হতে হবে। শুধু এখানে না। সব জায়গায় এই হচ্ছে। এটা আমাদের দলের সমস্যা। উপরতলার নেতৃত্বের ভাবমূর্তি খুব পরিষ্কার। কিন্তু জেলাস্তরে বা গ্রামস্তরে স্বার্থপরতা ছেয়ে গেছে। অধিকাংশই হয়ে উঠছে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর শুধু আমাদের দল কেন! অন্য দলের অবস্থা দেখুন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পর্যন্ত ঘুষ নেবার দায়ে অভিযুক্ত। সর্বত্র লোভ ও স্বার্থের রাজনীতি। কিন্তু তার জন্য আপনি রাজনীতি ছাড়বেন কেন? আমরা আমাদের কাজ যতখানি সম্ভব করব। আমাদের লড়াই তো একমুখী নয়। বহুমুখী। দলের ভিতরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। ভিন্ন দলের থেকে ক্ষমতা অধিকার করার জন্য আমাদের লড়াই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় লড়াই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তার জন্য আপনি থাকবেন না? আপনি তো চেয়েছিলেন ভৈরবের পাড় বাঁধিয়ে দিতে, ভাঙন রুখতে। 

—তোমাকে সত্যি কথা বলি। আজ আমার মেয়ের বিয়ে। মিছে বলব না। সম্পূর্ণ সৎ আমিও নই। কিছু কিছু বাড়তি সুবিধা আমি নিয়েছি। কিন্তু টাকা নয়ছয় করিনি আমি। 

—আপনি থাকুন। লড়াই করুন। আমরা সবাই একসঙ্গে লড়ব। ভাঙনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে শুধু দু-একটা পাড় বাঁধালে চলবে না। আমাদের দাবিগুলি অন্যভাবে সাজাতে হবে। কারণ নদীর ভাঙন স্বাভাবিক ঘটনা। তাকে আটকানো যায় না। কিন্তু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায়। বন্যা যাতে কম হয়, তার পদক্ষেপ নেওয়া যায়। আমরা তার জন্যই আন্দোলন করব। আপনাকে আমাদের দরকার। আমরা বারবার জনসমাবেশ করব। মিছিল করব। 

কথা বলতে বলতে সিদ্ধার্থ আবেগদীপ্ত হয়েছিল। যেন বহু কথা আর ভেতরে থাকতে পারছে না বলে বসে ছিল কণ্ঠ জুড়ে। কিন্তু ঘড়িতে চোখ পড়ল তার। বর আসবার সময় হয়েছে। তাদের ফেরা দরকার। সে বলল—কথা পরে হবে। এখন বোধহয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। 

বরকত আলি উঠলেন। হাঁক মেরে বললেন—ইদরিশ, কেটলি, গ্লাস সব ফেরত দিস।

ইদরিশ সাড়া দিল-জি। 

ফিরে চলল তারা যে-পথে এসেছিল সে-পথেই। সরু পথে পাশাপাশি চলার উপায় নেই। পরপর হাঁটছিল তারা। সিদ্ধার্থর মনে পড়ল, এ গ্রামের একটা দোকানে চুল্লু বিক্রি হয় জেনেছিল সে। সে বলল— চাচা, নদীর পাড়ে যে-দোকানগুলো আছে, তার একটাতে মদ বিক্রি হয়। আপনি জানেন? 

—যেখান থেকে চা এল, সেই ইসমাইলের দোকানেই হয়। জানি। জেনে কী করব। মরালীতে একটা ফাঁড়ি আছে, সেখানে একবার খবর দিয়েছিলাম। পুলিশ এসে দোকানে দেখনাই ভাঙচুর করে গেল। কিন্তু খবর তো সবই আসে। ইসমাইল ওই ফাঁড়িতেও চুল্লু দিয়ে আসে। এই গ্রামে আরও অনেক কারবারই হয়। পাশেই ডোমকল আছে। আশেপাশের সব গ্রামেই বিবিধ কারবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে ডোমকল। 

সিদ্ধার্থ সীমান্তের এই সমস্যাগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু গ্রামের একেবারে মধ্যিখানে বসে কেউ চুল্লু বিক্রি করবে, এ তার ভাল লাগল না। তবু কথা বাড়াল না সে। কথা বাড়ানোর সময়ও এটা নয়। বাড়ি ফিরে পা পরিষ্কার করে নিল তারা। এই লোকজনের মধ্যে না থেকে তারা মোহনের বাড়িতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। বর এলে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু বেরুবার মুখে বৃষ্টি নামল চড়বড় করে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল বাড়িতে। এটা সামলাতে হবে। ওটা আগলাতে হবে। সিদ্ধার্থ ও তৌফিক আরও কয়েকজন অতিথির সঙ্গে একটি ঘরে গিয়ে বসল। বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে মেয়েদের গলার গান এসে পৌঁছচ্ছিল সেখানে। সিদ্ধার্থ সেই গানগুলি বোঝার চেষ্টা করছিল। 

আমার মা বলেছে বিয়া দিব রে 
দামাদ আমার কী করে 
বহরমপুরের মাঠে গোরু চরায় রে 
আমার মা বলেছে 
বুকে বুকে ভিড়িয়ে শুব রে 
ও মা গো দামাদের 
কী কড়া মোচ 
গালে গাল লাগলে যেন ফুটে 
পাকা বাঁশের চোঁচ 
আমার মা বলেছে বিয়া দিব রে 
আমার মা বলেছে 
বুকে বুক লাগিয়ে চুমা খাব রে 
দামাদের কী ফালা ফালা চোখ রে 
চোখ দেখে ডর লাগে 
আমি চুমা খাব কী করে। 

তখন ঘোড়ার গাড়িগুলি দুয়ারে এসে লাগল। খেলাত পরে বর এলেন। বরের সঙ্গী-সাথীরা এলেন। বৃষ্টির মধ্যে অভ্যর্থনা জুড়ে কেবল ছাতার পর ছাতা। অবশেষে বর-সহ বরযাত্রীরা গুছিয়ে বসলে বরকত আলি সিদ্ধার্থ ও তৌফিককে ডাকলেন সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। এবং বরকত আলিকে অবাক করে দিয়ে বর জড়িয়ে ধরল সিদ্ধার্থকে। সিদ্ধার্থ মুখের হাসিতে বিস্ময় লুকোতে লুকোতে ভাবল—বদরুদ্দিনই তা হলে সেই পাত্র যে গোপনে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পণ নেয়! মন খারাপ হয়ে গেল তার। বদরুদ্দিন একজন নির্ভরযোগ্য কর্মী। তার মধ্যে এমন অনাদর্শ সিদ্ধার্থ আশা করেনি। সে সকলের ব্যস্ততার ফাঁকে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। তৌফিক আসতে চাইছিল সঙ্গে। 

সে বলল—তুমি থাকো তৌফিক। তুমি থাকলে ভাববে আমিও আছি। আমি একটু ঘুরে আসব। 

সে যখন মোহনলালের বাড়ির দিকে যাচ্ছে তখন পথে দেখা হল নয়াঠাকুমা ও সোমেশ্বরের সঙ্গে। তাঁরা বরকত আলির বাড়িতেই চলেছেন। সিদ্ধার্থ বলল—আরে আমি তো আপনাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। 

—যাও। নন্দিনী আছে বাড়িতে। 

সোমেশ্বর বললেন। 

সিদ্ধার্থ বলল—তিনি এলেন না? 

নয়াঠাকুমা বলে উঠলেন—সকলে বাড়ি ছেড়ে এলে চলে কী করে? 

সিদ্ধার্থ হাসল। এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। তার মনে হল, সোমেশ্বরের সঙ্গে নন্দিনীর আসাটাই অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত ছিল। বন্ধ দরজার কড়ায় শব্দ করল সে। নন্দিনী ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন—কে? 

সিদ্ধার্থ নীচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল। নন্দিনী বললেন—ওমা তুই! 

প্রায় বালিকার মতো লঘুপায়ে নীচে নেমে এলেন তিনি। দরজা খুলে দিলেন। বললেন- আয়। 

উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল নন্দিনীকে। পাট-ভাঙা কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছেন। তাতে জরি বসানো পাড়। কপালে নিটোল সিঁদুরের টিপ। পাড়েরই অংশ হয়ে বুকের ওপর নেমে এসেছে স্বর্ণহার। সিদ্ধার্থ বলল—কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে কাকিমা। 

—যাঃ! বুড়ো হয়ে গেলাম। আয়। তোর বন্ধুর পাত্রীদের কয়েকটি ছবি এসেছে। দেখাই তোকে। 

নন্দিনী উঠতে লাগলেন। সে অনুসরণ করতে থাকল। হঠাৎ সে বলল—তোমাকে দেখে আমার মাকে মনে পড়ে যায়। 

নন্দিনী সিঁড়ির শেষ ধাপে। ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন—আমি তোর মা নই? 

সে হাসল শুধু। নন্দিনী বললেন—তুই তো আমার আরেক ছেলে সিধু। মোহনের সঙ্গে যদি তোর সম্পর্ক ঘুচেও যায়, তবুও তুই আমার কাছে আসিস। 

—কাকিমা! 

—তোদের সেই আগের বন্ধুত্ব আর নেই, না রে? 

ঘরে পৌঁছেছিল তারা। নন্দিনী একটি সন্দেশ এনে সিদ্ধার্থর মুখে গুঁজে দিলেন। বললেন- আমি করেছি। খা। 

—ক্ষীরের? 

–হুঁ।

—অনেকদিন পরে খেলাম। 

—আমি বহরমপুর যাই, তোকে কত কী যে খাওয়াব! 

—সত্যি যাবে তো? 

—যাব। তুই আসবি তো? আমার কাছে? 

–হুঁ।

—যদি মোহনের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব না থাকে? 

—থাকবে না কেন কাকিমা?

—আমার কাছে লুকিয়ে কী লাভ সিধু?

—আমাদের তো কিছু হয়নি। 

—না। বাইরে হয়নি। ভাল হল আজ তোকে একা পেলাম। আমার যে কত কিছু তোকে বলতে ইচ্ছে করে। কত কথা! আমার কথা শোনার তো কেউ নেই। অথচ ভেতরে একবুক কথা জমে আছে। একদিন সব বলব। 

—শুনব কাকিমা। 

—আমার শুধু ভয় করে। 

—কী ভয়? 

—মোহনের ওপর অভিমান করে তুই যদি আর না আসিস? 

—তোমাকে দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে কাকিমা। মা এমনি করে সব আগে থেকে বুঝে যেত। এমনি তাঁতের শাড়ি পরত। 

—আমার মনে আছে। তোদের স্কুলের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। 

—হ্যাঁ। মা যেত। প্রতিবার। 

—যাবে না? আমি মা বলেই বুঝি; তোকে নিয়ে তোর মায়ের কত গর্ব ছিল! 

—আমার অনেক কথা বলার আগেই মা বুঝতে পারত। 

—আমিও তো বুঝি তোকে। বুঝি না! 

— হুঁ। 

নন্দিনী চেয়ারে বসেন। সিদ্ধার্থ নন্দিনীর পায়ের কাছে বসে জানুতে মাথা পেতে দেয়। নন্দিনী তাঁর হাত রাখেন সিদ্ধার্থর মাথায়। সেখানে মাতৃস্নেহ বর্ষিত হয়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে থাকে তখন। নন্দিনী বলেন—আমি তোকে বুঝি। আর মোহনকে বুঝব না? ও তো আমার পেটের ছেলে। খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে রে ও। এত দ্রুত যে মাঝে মাঝে ওকে অচেনা লাগছে আমার। কোনও দিন তো ওর ওপর আমার কোনও অধিকার ছিল না। যদি থাকত, এমন হতে দিতাম না আমি। এই পরিবারে আমার ভূমিকা কেবল তামিল করবার। 

তিনি কথা বন্ধ করেন। স্তব্ধতা ফাটিয়ে কেবল বৃষ্টি ঝরে পড়ে অবিশ্রাম। সিদ্ধার্থর ভিতরে এক সুখ মেশানো কষ্ট দাপাদাপি করে বেড়ায়। কতদিন—কতদিন পর সে এমন মাতৃস্পর্শ পাচ্ছে, তাই সুখ! আর কষ্ট? তার রকম সে জানে না। তার মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বুদ্ধদেবের জন্য। বোধিসত্ত্বের জন্য, নন্দিনীর জন্য, মাসুদা ও ফরিদার জন্য। ইদরিশ ও নিসারের জন্য। যে- সন্ন্যাসীর গোমুখদর্শন হল না—তাঁর জন্য। বরকত আলির জন্য। বদরুদ্দিনের জন্য। এমনকী, এমনকী তার ও মোহনের সম্পর্কের জন্যও। কষ্ট এসে, ঝাঁঝাল নিষ্ঠুর জ্বালাময় কষ্ট এসে ভরিয়ে দিচ্ছে তার চোখ। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সিদ্ধার্থ অস্ফুটে বলল-মা, মাগো 

নন্দিনী তার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। দু-এক বিন্দু নীরব অশ্রু ঝরে পড়ল তাঁরও চোখ থেকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *