রাজপাট – ৪৫

৪৫

বৈশাখ মাসের দিনে। 
বছর নবীন। 
বিয়ার মামলা ঝামলা 
কমে দিন দিন! 
আখতা ঝুমঝরি কোনদিন 
মেঘপানি পরিয়া। 
একেই ঝরিয়ে ভাই 
অইয়া যাইব বাইরা 
বাইরা আইলে আলদল 
নানান জারি কাম। 
এরি লাগি বৈশাখে নাই 
বিয়া শাদির নাম ॥ 

.

বিশাখা নক্ষত্রের চান্দ্রমাসে সূর্য মেষরাশিতে অবস্থান করেন। এই সময় হল বৈশাখ। প্রচলিত বঙ্গাব্দের গ্রীষ্মঋতুর এই হল সূচনাপর্ব। গ্রীষ্ম হল শুখা মরশুম। এই সময় সূর্য হয়ে যায় ইটভাটির আগুনের চুল্লি। গনগন করে মাথার ওপর জ্বলে আর পুড়িয়ে-ঝুরিয়ে দেয়। 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে ফসল উঠবে মুগ আর কলাই। বাগড়িতে ডালশস্য হয় ভাল। যারা ফাল্গুনেই মুগ-কলাই বুনেছিল, তারা জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি সম্পূর্ণ উৎপাদন করে তুলতে পারবে নিশ্চিতই। কেন-না মুগ ফলতে লাগে দু’মাস আর কলাই নেয় আড়াই-তিনমাস সময়। 

হরিহরপাড়া এলাকায় ডালশস্য উৎপাদন বাড়াবার জন্য রাজ্য সরকারের কিছু প্রকল্প আছে। একা রাজ্য সরকার নয়, কৃষিক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যেক’টি যৌথ প্রকল্প আছে, তার মধ্যে ডালশস্য উন্নয়ন প্রকল্প একটি। ডালশস্যের চাষ করতে চাইলে কৃষকের এক বিঘা জমির অনুপাতে তাকে দেওয়া হয় ডালশস্যের শংসিত বীজ মিনিকিট। এ ছাড়া ডাল উৎপাদনকারী কৃষকের পাবার কথা বিনামূল্যের জৈব সার এবং ভরতুকিতে কীটনাশক, যন্ত্রপাতি। কিছু প্রশিক্ষণ নেবার ব্যবস্থাও রাখা আছে কৃষকের জন্য। কিন্তু ব্যবস্থা ব্যবস্থামাত্র। এবং প্রকল্পও একটি আদর্শ সংকল্প। এই সকল ব্যবস্থার ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং সুবিধাভোগ নির্ভর করে স্থানীয় শক্তির ওপর। কৃষক বার্ধক্য ভাতা প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। ষাটোর্ধ্ব কৃষক, যাঁর আর কর্মক্ষমতা নেই, তাঁকে মাসে সত্তর টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। সত্তর টাকায় কোনও ব্যক্তির সারা মাসের কী সংস্থান হয় তা চিন্তার বিষয়। তবে যেখানে কৃষকের অন্ন জোটে না দু’বেলা, পরিধানের কানি কিনতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, সেখানে সত্তর টাকা মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে। আর বৎসর দশেক শেষ হলেই বিংশ শতাব্দীর গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে। অথচ এখনও সত্তর টাকার বিরাট মূল্য কারও কাছে সহায়। কারণ অসহায় বৃদ্ধের তালিকাও তৈরি হয় বিশেষ কিছু শর্ত মাথায় রেখে। 

বাগড়ির এ ভড় অঞ্চল বড়ই উর্বরা। এই উর্বরতার জন্যই শক্তিমানের শক্তি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। যেখানে উর্বরতা নেই, ফসল ফলে না, গৃহস্থের আঙিনায় উঁচু হয়ে ওঠে না ধানের পালুই, যেখানে বলদ মারা গেলে ধ্বংস হয়ে যায় জীবন কারণ পুনরায় বলদ কেনার সামর্থ্য নেই কারও, বছরের অধিকাংশ সময় জলে ডুবে থাকা গ্রামে নেই পথঘাট, নেই ধান ঝাড়াই বা চাল করার যন্ত্র, যেখানে এখনও ঢেঁকিই সহায়, সেখানে রাজনীতি ও শক্তিমানেরা কেবল নির্বাচনের বার্তাবহ। তেমন অঞ্চল হল কালান্তর। হরিহরপাড়ার সীমান্ত থেকে পলাশি পর্যন্ত বেলডাঙা ও জলঙ্গী নদীর অন্তর্গত ভূখণ্ড। ময়না বৈষ্ণবীর প্রিয় ছিল এ অঞ্চল। কিন্তু তা এক ব্যতিক্রম। এখানে নেই এমনকী সংগঠিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। বছরের চারমাস গ্রাম যেখানে থাকে জলের তলায়, একফসলি জমি কোনওমতে দেয় কিছু মোটা ধান আর বসবাসকারী মানুষগুলি প্রায় জঙ্গলে বসবাস করার মতোই অশিক্ষিত ও দরিদ্র, নানাবিধ জীবিকা তাদের এমনকী চুরি, ছিনতাই পর্যন্ত, তারা পরোয়া করে না নির্বাচনী অধিকারের। তারা ভারতীয় নাগরিক, তা-ও জানে না। নাগরিক সুবিধা কী কী পাওয়ার কথা, আদৌ পাওয়ার কথা কি না, কিছুই তারা ধারণা করে না। কালান্তরের মানুষ জানে, তারা দরিদ্র। না খেতে পাওয়া। তাদের দৈনিক উপার্জন এমনকী শূন্য হতে পারে। গ্রামোন্নয়ন বা গঠনের প্রকল্প নিয়ে পৌঁছয় না কেউ সেখানে। কেবল বিধানসভা বা লোকসভার বড় নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ এক উপার্জন-পন্থা। রাজনৈতিক শক্তি সেখানে পৌঁছয়, বলে, এই ছাপে ছাপ দিয়ে আসবে, মাথা পিছু পাঁচ টাকা, আর দুপুরের খাবারের প্যাকেট। আঃ! পাঁচ টাকা! কী বিশাল উপার্জন। কী চমৎকার নাগরিক অধিকার! 

তো, বাগড়ির বিশাল ও উর্বরা জীবন হতে কালান্তর বাদ দেওয়াই ভাল। বরং এই যে হরিহরপাড়া থানা, তার সকল পঞ্চায়েতের এক পঞ্চায়েত মরালী, আর তার প্রধান বরকত আলি, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ও কল্যাণ ভোগ করতে পারবে কারা, তার তালিকা কীভাবে নির্ণীত হয়, তা জানেন। আপনি বাঁচলে নিয়ো বাপের নাম। আপনকার লোকগুলিকে তুষ্ট কর, যারা তোমাকে ছাপা দিয়ে সিংহাসনে বসিয়েছে! তারপর যদি কিছু থাকে তো অন্যদের, এমনকী কৃষিঋণ, হুঁ হুঁ বাবা! সে-ও পাবে পুষ্যিরাই। তো, তারপর যদি কিছু থাকে, এই নির্ণয়ে দেখা যায়, তারপর কিছুই আর থাকে না। এমনকী নিজের দলের সকল লোককে তুষ্ট করা হয় না শেষ তক। তখন আসে অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। অগ্র অধিকার কার? এ হল গরিবের সরকার। গরিবের পঞ্চায়েত। এ হল কম্যুনিস্ট রাজ। এখানে যে যত দরিদ্র, তার তত অগ্রে অধিকার! ধুর ধুর! সে হল বাসি লুচি! পচা মাংস! সে হল বস্তায় পচা বইয়ের পাতা! অগ্রাধিকার তার যার পেশি শক্ত, স্কন্ধ বৃষতুল্য। হরদুনিয়ায় এই-ই নিয়ম। দিন-দুনিয়ার যে মালিক, সে-ই তো সর্বশক্তিমান, নাকি যে নিঃস্ব, শক্তি তার! 

এই স্বাভাবিকতাকে বরকত আলি মান্য করেছেন। তাঁর কাছে যা অন্যায় বা অনাচার বোধ হয়, তা তিনি নামাজ পড়ার পুণ্যকর্ম দ্বারা প্রশমিত করে নেন। তথাপি, নতুন চরের বিলি-বণ্টন হতে কংগ্রেসি আইনুল মোল্লাকে বাদ দিতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু মোহনলাল জেদ ধরে বসে আছে। 

প্রধান বরকত আলি মোহনলালকে এতখানি গুরুত্ব দিচ্ছেনই বা কেন! একরকমভাবে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যায়। তার বাহ্যিক কারণ, মোহনলাল গ্রামে এসেই জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে। ধনী এবং বনেদি পরিবার হিসেবে চাটুজ্যেরা এলাকায় বিখ্যাত। তা ছাড়া মোহনলাল বহরমপুরের কেন্দ্রস্থল হতে অনুমোদনপ্রাপ্ত পার্টিকর্মী। তাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরকত আলি যাবেন কোথায়? তিনি টের পাচ্ছেন, এলাকায় যারা তাঁর দলভুক্ত কিন্তু তাঁর অনুগত হতে চায় না, তারা ধীরে ধীরে মোহনলালের নেতৃত্বকে উসকে তুলছে। তাঁর পক্ষে এ এক বিধ্বংসী সম্ভাবনা। তাঁর স্বপ্ন, পঞ্চায়েতশীর্ষে থেকে যাবেন আজীবন। স্বপ্ন, পাড় বাঁধিয়ে, জনপ্রিয়তা বর্ধন করে, যদি বিধায়ক পদের জন্য দরবার করা যায়। বরকত আলি এম এল এ। আহা! আহা! কেয়াবাত! কিন্তু এ জীবনে কি আর হবে। বিশেষত, মোহনলালের সঙ্গে যেখানে তাঁর গোড়া থেকেই দেখা যাচ্ছে অবনিবনার সম্ভাবনা। বরকত আলি চিন্তিত থাকেন ইদানীং। যদিও আর একমাস মাত্র পরে তাঁর মেয়ের বিয়ে। ফিরোজা। তাঁর প্রাণের ধন। কত খুঁজে একজন উচ্চশিক্ষিত পাত্র তিনি এনেছেন মেয়ের জন্য। তেকোনার বৈবাহিক চতুষ্কোনার ছেলে সে। বদরুদ্দিন আলি। এম এ পাশ। বহরমপুরে স্কুলে পড়ায়। বাপও প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। এমনকী বদরুদ্দিন সি পি আই এম-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী ওই গ্রামে। সেদিক থেকেও মিলেছে চমৎকার। মেয়েটা এখন সুখে থাকলেই তাঁর সুখ। কারণ বদরুদ্দিনকে জামাই করে আনতে তাঁকে দিতে হচ্ছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। অবশ্য বরপক্ষ থেকে দেনমোহর হিসেবে কনে পাবে পনেরো হাজার টাকা। কিন্তু তাতে কী! বিয়েতে খরচ তো আছে। প্রধান হিসেবে পরিচিতি তাঁর। তাঁর বাড়িতে বিয়ে-শাদি লাগলে লোকে নিমন্ত্রণের প্রত্যাশা করবেই। কাকে ছেড়ে বাদ দেবেন কাকে! অতএব তৈরি হয়েছে এক দীর্ঘ তালিকা। তা ছাড়া মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হবে অলঙ্কারে! তাঁরা তো শিক্ষিত পরিবার নন। ফিরোজাও নয় এমনকী স্কুল পাশ। কোনও মতে নাম লিখতে পারে। ছোটবেলায় মক্তবে গিয়ে মুখস্থ করেছে নামাজের সুরা, ব্যস ওই পর্যন্তই। যদিও বরপণের কথা ঘোষিত নয়। এ হল নবযুবক বদরুদ্দিনকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা। আর তাও গোপনে। কারণ বদরুদ্দিনের কল্যাণ-অকল্যাণের সঙ্গে জড়িত ফিরোজারও কল্যাণ-অকল্যাণ। 

বিয়ের এইসব খরচ ছাড়াও আছে মোট এগারো দিনের বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনের খরচ। তা-ও কি কম? 

অতএব ষোলো বিঘা জমির মালিক, কৃষিজীবী গ্রামপ্রধান বরকত আলি তিরিশ হাজার টাকা ঋণ নিচ্ছেন চাটুজ্যেদের থেকে। চার বিঘে জমিও বিক্রয় করে দিচ্ছেন তাঁদের কাছে। সচ্ছল কৃষক বরকত আলি এতকাল এই ষোলো বিঘা থেকেই দাপটে চালিয়েছেন সংসার। তিন ছেলের মধ্যে দুটির বিবাহ দিয়েছেন। এখন তিন ছেলের জন্য রইল বারো বিঘে জমি। তারা একত্রে থাকতে পারলে ভাল চলবে। ভাগাভাগি হয়ে গেলে ভাগাভাগি হয়ে যাবে বরকত আলির পারিবারিক সচ্ছলতাও। কারণ, সরকার প্রদত্ত শংসিত বীজ-মিনিকিটের সুবিধা নিলেও, বিনামূল্যের জৈব সারের সুবিধা নিলেও বরকত আলি তাঁর আড়াই বৎসরের রাজত্বকালে পঞ্চায়েতে প্রদত্ত সরকারি অনুদান আত্মসাৎ করতে শেখেননি। বহু লোভীজন বহু চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে এ কাজে। অতএব বরকত আলিরও আছে শত্রুশ্রেণি। আছে তাঁকে অপছন্দ করা গোষ্ঠী। তিনি যদি বাৎসরিক অনুদান হতে অন্তত পঁচিশ হাজার টাকা করেও আত্মসাৎ করতে পারতেন, তা হলে বদরুদ্দিন জামাইয়ের কল্যাণার্থ উপার্জন হয়ে যেত। কিন্তু সুবিধা নেওয়া এক আর টাকা নেওয়া অন্য। সরাসরি চুরি সেটা। আর চুরিকম্মো বরকত আলির দ্বারা অন্তত হবে না। তওবা তওবা! 

অতএব মূল্যবান জামাই আনতে তাঁকে ঋণ নিতে হয়েছে। বেচতে হয়েছে জমি। এ বিষয়ে ছেলেদের মনোভাব বোঝা যায়নি। কিন্তু আপত্তি করেছিলেন কন্যার মাতা স্বয়ং। নাম তাঁর খুশি বেগম, কিন্তু বেজায় অখুশি হয়ে তিনি বলেছিলেন—মেয়ের জন্য ছেলেগুলোকে পথে বসাবা তুমি? 

বরকত আলি বলেছিলেন—ওইরকম জামাই, ও কি আমাদের ঘরে সহজে মেলে? আরে, ছেলেদের দুলাভাই কত সম্মানের বলো! আমি হলাম প্রধান। আমার একটামাত্র মেয়ের বিয়ে কি যেখানে-সেখানে হতে পারে? 

খুশি বেগম বলেছিলেন—কেন? আবদুস মল্লিকের বড় ছেলেটার সঙ্গে তো মানাত আমাদের ফিরোজাকে। ভালই তো পয়সা আছে ওদের। কোলের মেয়ে কোলে থাকত। দু’বেলা চোখে দেখতে পেতাম। তোমাকেও সর্বস্বান্ত হতে হত না। 

বরকত আলি আপত্তি করেছিলেন—কী যে বলো! কোথায় এম এ পাশ বদরুদ্দিন আলি আর কোথায় আনপড় নাসের মল্লিক! 

— পড়া দিয়ে হবেটা কী শুনি! তুমি কোন বিদ্যেধর? তুমি কি আমাকে খারাপ রেখেছ? তা ছাড়া ওদের আছে কী! আমাদের মতো দোতলা বাড়িও নেই। তুমিই বলেছ তাদের কাঁচা মেঝের বাড়ি। 

—কাঁচা মেঝে পাকা করতে ক’দিন! 

—হুঁ। তোমার টাকাতেই পাকা করবে। তারপর যদি কোনও ছলে মেয়েটাকে তালাক দিয়ে দেয়, কি একটা নিকে করে বসে! 

—শিক্ষিত ছেলে ওসব করে না। তা ছাড়া আমি ক’টা নিকে করেছি? তোমায় ক’বার তালাক দিয়েছি? 

—হুঁ! তোমার মতো সব মানুষ! 

বরকত আলি ভুল করছেন এমন ভাবছেন না। মেয়েটা সুখী হবে। নিশ্চিতই। শিক্ষার একটা মূল্য আছে না! এই যে মোহনলালের প্রতি তাঁর রয়েছে একপ্রকার সমীহ, তা তো এ কারণেও যে ছেলেটা উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিমান 

হ্যাঁ। ঋণের জাল বেঁধে ফেলেছে তাঁকে। আর ঋণ করা খুব সুকর্মও নয়। ঋণের গুরুভারও দেয় কিছু মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে এবং তিনি এখন আনত-পৃষ্ঠ মানুষ। কিন্তু সেইভাবে ভেবে দেখতে গেলে তাঁর মোহনলালের কাছে কী-ই বা কৃতজ্ঞতা! তিনি ঋণ নিয়েছেন সোমেশ্বরের কাছে। সোমেশ্বর বন্ধু মানুষ। বন্ধুর কাছে বন্ধু দরকারে ঋণ নেয় না? ছেলেদেরও হিম্মত থাকতে হবে। ইচ্ছে থাকলে, হিম্মত থাকলে বারো বিঘা জমিকে চব্বিশ করবে তারা। 

তবু কিছু অবমাননা ঘটতেই থাকল তাঁর। তেকোনার পাশের গ্রাম রেশমকুচি গিয়েছিলেন মোহনলালের সঙ্গে। দেখছিল মোহনলাল। চেনাচিনি করছিল। তেকোনার চেয়েও অনুন্নত এ গ্রাম। কারণ সেচের জন্য এরা পায় না ভৈরবের মতো অফুরান জলের নদী। চূড়ান্ত গ্রীষ্মে ভৈরব শুকিয়ে খটখটে তো হয়ে যায় না কখনও। সরু নালি কেটে বা জল ছেঁচে গ্রীষ্মে জমি সরস রাখার চেষ্টা অন্তত করা যায়। কিন্তু রেশমকুচি নদীবিহীন গ্রাম। একখানি পুকুর সম্বল আর নলকুপ তিনটি। নলকূপের দ্বারা সম্পূর্ণ সেচন সম্পন্ন হয় না। সে কেবল পানীয় ও নিত্য আচরণকর্মের জল। পুকুর থেকে যতখানি সেচন সম্ভব। তাতে সামান্য চাহিদাও মেটে না। অতএব বর্ষা না আসা পর্যন্ত রেশমকুচি বা অন্য আরও গ্রাম নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে। এখানে সব দু’ বিঘে, আড়াই বিঘের চাষি। পাম্প কিনবে বা ভাড়া করবে সে সামর্থ্য নেই। সংসারে লোকসংখ্যা কারও কম নয়। এক-একজনের পাঁচটি-ছ’টি করে ছেলেপিলে। রাস্তার ধুলো মেখে নোংরা বাচ্চাগুলি ন্যাংটোপোঁদে রাতদিন কলরব করে। বছর দশ-বারো হতেই কামকাজের ফিকির খুঁজবে। 

আধুনিক সেচন ব্যবস্থার জন্য সেচদপ্তরের বাবুরা আসা-যাওয়া করছেন অনেকদিন হল। কিন্তু কাজের কাজ এখনও কিছু হয়নি। শোনা যাচ্ছে মরালী পর্যন্ত খুব তাড়াতাড়ি বসে যাবে বিদ্যুতের খুঁটি। কিন্তু, খুঁটি বসা আর বিদ্যুৎ পৌঁছনর মধ্যে দিয়ে চলে যাবে বর্ষক্রম। তারপর তেকোনা বা রেশমকুচি অবধি পৌঁছতে আরও কত বৎসর! গ্রামে ক’জনই বা নিতে পারবে বিদ্যুতের লাইন! 

রেশমকুচি বা তার আশেপাশের গ্রামে গড়ে উঠছে একরকম ঘিঞ্জি বসতি। গ্রামের স্বাভাবিক গা-ঘেঁষাঘেঁষি কর্দমপথের পাশে জেগে থাকা বসতির সঙ্গে তার তফাত চোখে পড়ে। গ্রামের হতদরিদ্র বাড়িটিরও উঠোনে ঝাড়ু পড়ে। কোণে থাকে আম-কাঁঠালের গাছ। হাঁস-মুরগি চলে-ফিরে বেড়ায়। অন্তত একটি গোরু বা ছাগল সম্পদ থাকে, যাকে প্রয়োজনে বিক্রয় করে দেওয়া যায়। দরিদ্র বধূটির চুলে তেল পড়ে অন্তত। কিন্তু এই নয়াবসতগুলি বড় শ্রীহীন। প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া বাঁশের বেড়ার ঘর তাদের। রুক্ষচুলের মেয়েগুলি কলহপরায়ণ। চুরির স্বভাব আছে তাদের এমনও ধরে নেয় গ্রামবাসী। তাদের পুরুষদেরও চোখ তীব্র, লোলুপ। শিশুদের তারা প্রহার করে নির্মম। সারাদিন ঝিমোয়। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে ফেরে। কোথা হতে আসে এরা? বসে কার জমিতে? কে তাদের বসবাসের অনুমতি দেয়? 

গ্রামে গ্রামে দালাল আছে তাদের জন্য। সীমান্ত পার করিয়ে লোক আনে তারা। কিছু শহরে যায়। কিছু গ্রামে-গঞ্জে বসে। পরিত্যক্ত জমি কিংবা সরকারি রাস্তার দু’ধার ঘেঁষে খোলার বেড়া ও প্লাস্টিকের ছাউনি তুলে শুরু করে বসত। অথবা কারও দাক্ষিণ্য পায়। যেমন চতুষ্কোনায় সুকুমার পোদ্দার লোক বসিয়েছেন আপন জমিতে। এখানে নুর মহম্মদও দিয়েছেন কিছু জমি। সামান্যই। কিন্তু দালালের কাছ থেকে লাভ করেছেন ভাল। তখন টাকার প্রয়োজন ছিল তাঁর। তাই জমি ছেড়েছিলেন। এখন মাঝে মাঝে তাঁর আফসোস হয়। লোকগুলিকে সংগঠিত করে দলের কাজে লাগাবেন তেমন শক্তি বা উদ্যম নেই তাঁর। এ গ্রামে একমাত্র তাঁরই আছে নয় বিঘা জমি। দশ ছিল। এক বিঘা বসতে দিয়েছে। রাস্তার লাগোয়া এ জমিটির সমস্যাও ছিল কিছু। সরকার গ্রামীণ রাস্তাগুলিকে চলাচলের যোগ্য করতে চায়। কিছু মাপের কাজ হয় মাঝে-মাঝে। পঞ্চায়েত রাস্তা গড়ার দায়িত্বে। পথ চওড়া করলে নুর মহম্মদের এ জমিতে কোপ পড়তই। তবু সবটা যেত না। কিন্তু এখন ভেবে লাভ নেই। নির্বাচনের সময় দালাল আখতার তাঁকে সাহায্য করেছিল। বিনিময়ে এই সুবিধেটুকু তিনি দিয়েছেন। 

কংগ্রেসি হলেও নুর মহম্মদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বরকত আলির। মোহনলালের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁরই উঠোনে বসে কথা হচ্ছিল তাঁদের। মোহনলাল দেখছিল চারপাশ। বেরিয়ে এসে বলেছিল—এই পঞ্চায়েতে একমাত্র ইনিই কংগ্রেসি বিজেতা, তাই না? 

বরকত আলি বলেছিলেন—হ্যাঁ। তবে নুর সাহেব লোক খারাপ না। গত বৎসর এ গ্রামে দুটি নলকুপ বসিয়েছি। 

–কী লাভ? 

—জলের বড় কষ্ট ছিল এখানে। 

—তার জন্য কি ওরা আপনাকে ভোট দেবে? 

—তা তো জানি না। 

—এই সংসদে আমাদের প্রার্থী কে ছিল? 

—ছিল না। একজন মুসলিম লিগ সমর্থককে আমরা নির্দল হিসেবে পেয়েছিলাম। 

—তা হলেই ভাবুন। এই গ্রামে আপনি নলকূপ বসালেন। একটা চার বছরের বাচ্চাও একথা শুনে হাসবে। 

বরকত আলির কান গরম হয়ে উঠেছিল। তিনি নীরব ছিলেন। দল বুঝে বা কংগ্রেসি-প্রধান এলাকা বুঝে তিনি কোনও উন্নয়ন ঘটাবেন না, এ মানসিকতা তাঁর নেই বলেছেন বহুবার। তিনি যখন ক্ষমতায় আছেন তখন উন্নয়ন সর্বত্রগামী করাই তাঁর মহত্ত্ব। যে-কোনও ক্ষমতাসীন দল বা মানুষের পক্ষেই তা মহত্ত্ব। কিন্তু এই নিয়ম পালটে যাচ্ছে। বরকত আলির নিজেকে মনে হচ্ছে এক অন্য যুগের মানুষ। কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য যুগেরই-বা কেন! তাঁর ভাবনার সমর্থন তিনি সিদ্ধার্থর কাছে পেয়েছেন। সিদ্ধার্থ তো অন্য যুগের মানুষ নয়। মোহনলাল তখন বলেছে—এই এলাকা দখল করতে হবে। 

তিনি বলেছেন—সম্ভব না। এখানে কংগ্রেসি যারা তারা পুরনো কংগ্রেসি। কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে। রাজ্যে তারা কোণঠাসা। তবু কোথাও কোথাও এই দলটা টিঁকে আছে শুধু ঐতিহ্যের জন্য। মানুষের মনে এখনও আছে পুরনো টান। এমনকী আঞ্চলিকভাবেও নতুন নেতৃত্বের উত্থান না হলে এখানে কংগ্রেসের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তারা যতটুকু আছে, তা ভাঙা সহজ নয়। 

—সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভব কি? 

—মানে? 

—নুর মহম্মদ এ গ্রামের একমাত্র শক্তি। যদি তাঁর ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়?

—কীভাবে? 

—সেটা ভেবে দেখতে হবে। উনি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবস্থাপন্ন, তাই না? অবস্থাই তাঁকে দিয়েছে ক্ষমতা। তাঁর ক্ষমতার চেয়েও অধিক ক্ষমতা দেখাতে হবে কারওকে। আর ওই পরিবারগুলো ব্যবহার করুন। 

—কোনগুলো? 

–যারা নতুন এসেছে। ওদের টাকা দিন। সম্ভব হলে কাজ দিন অল্প-স্বল্প। দলে টানুন।

—টাকা কীভাবে দেব, মোহন? তুমি জান আমার সঙ্গতি নাই। আর কাজই বা কী দেব! 

—টাকা কি নিজের পকেট থেকে দিতে হয় চাচা? টাকার উৎস দেখতে হয়।

—সেটা শহরে হয়। সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ী আছে। এখানে কী আছে? 

—আপনার তিন লক্ষ টাকা অনুদান আছে। সেটা তো আপনার হাত দিয়েই খরচ হবে।

—সেটা উন্নয়নের টাকা। তার খরচ দাখিল করতে হবে আমাকে। 

—সেটা এমন কী কঠিন! ওই টাকায় রাস্তা করবেন, করুন না। পাকা রাস্তা তো করবেন না। সে টাকাও নেই। 

—না না। গেল বর্ষায় মাটি ধুয়ে গেছে অনেক জায়গায়। সেখানে আবার নতুন করে মাটি দিয়ে ইট বসাব। 

—খুব ভাল। ইট ভাঙার কাজে ওদের লাগান। 

—গ্রামের কাজ। গ্রামের বেকার লোকগুলোকে দিয়েই তো করানো ভাল। কিছু টাকাও পাবে সব। 

—গ্রামের কিছু নিন। ওদেরও কিছু নিন। গ্রাম আপনার হাতে আছে। 

—ওরা বহিরাগত। আমি জানি। সব পয়সা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসে। ওদের জন্য গ্রামের লোকগুলোকে বঞ্চিত করব আমি? 

—ওরা আজ বহিরাগত। কাল আপনার ভোটদাতা হবে। আরে সমস্ত আসন আমাদের হয়ে গেলে কত ক্ষমতা বাড়বে বুঝতে পারছেন? আমাদের পঞ্চায়েত থেকে কংগ্রেসকে আমরা লুপ্ত করে দেব। তিন লাখ টাকার মধ্যে আড়াই লক্ষ খরচ হবে। পঞ্চাশ হাজারের হিসেব থাকবে ওই খরচের মধ্যে। কিন্তু আসলে টাকাটা লাগবে আমাদের কাজে। 

বরকত আলি প্রতিবাদ করতে ভরসা পাননি। কিন্তু তাঁর মন সায় দিচ্ছে না। অসহায়তার মধ্যে তিনি বারবার বিষণ্ন হয়ে পড়ছেন। কাল দুপুরে গ্রাম সংসদের বিশেষ সভা ডাকা হয়েছে। বলা হয়েছে একান্ত আস্থাভাজন কয়েকজনকে। বরকত আলি ভাবতে ভাবতে চলেছেন। দেখছেন, ইসমাইলের দোকানের সামনে বসে আছে ছেলের দল। কালু মিঞা, মফিজ মিঞা, সমিরুদ্দিন, মাতিন শেখ, ফকরুদ্দিন, হাসান, হাবিব এবং তাদের মধ্যমণি মোহনলাল। 

এই দলটিকে বরকত আলি পছন্দ করেন না। এদের কখনও আমল দেননি তিনি। অথচ মোহনলাল এদের গুরুত্ব দিচ্ছে। ছেলেগুলো সীমান্তে মাল পাচার করে। লোক পারাপার করে অর্থের বিনিময়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। গ্রামে একটি নতুন রাজত্ব উঁকি দিচ্ছে। সেখানে শক্তি আছে। কিন্তু কল্যাণ কোথায়? বরং কল্যাণের তহবিল ভেঙে চলছে শক্তি অর্জনের চেষ্টা। তিনি কী করবেন? 

ডোমকল থেকে মাত্র দশ-বারো কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা। ওখানে ভারত সীমান্ত। সীমান্তে আছে বৈদুলিপুর গ্রাম। বৈদুলিপুর চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্র। ডোমকলের রাজু শেখ এবং রহমত মোল্লার নাম জানে সবাই। চোরাচালানের জন্য তাদের আছে নিজস্ব ট্রাক। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে নদিয়ার সাধন সরকার। বৈদুলিপুরের ঘাট দিয়ে নিত্য চালান হয় গবাদি পশু, লবণ, চিনি, চাল, মুসুর ডাল, কলাই ডাল, ওষুধ। বিশেষত বেনাড্রিল, ফেন্সিড্রিল। আর এদেশে আসে সোনার বিস্কুট। সিন্থেটিক কাপড়। বিদেশি টর্চ, গ্যাস লাইটার, ইলেকট্রিক দ্রব্যাদি, ব্লু ফিল্মের ক্যাসেট এবং হেরোইন জাতীয় ভয়ংকর নেশার ওষুধ। এ কাজে সহায়তা করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। সহায়তা করে পুলিশ। সহায়তা করে অন্যান্য সরকারি কর্মচারী। ইদানীং নিয়মিত হাট বসছে ভাদুরিয়াপুরে। সীমান্ত বৈদুলিপুর থেকে যার দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। অথচ নিয়ম, সীমান্তের দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হাটবাজার বসবে না! সবাই জানে, রাজু শেখ, রহমত মোল্লা বা সাধন সরকার বামদলের আশ্রিত। দলীয় তহবিলে তারা মোটা অর্থ জোগায়। বিনিময়ে পেয়ে যায় রাজনৈতিক ক্ষমতার ঢাল। বরকত আলি তার কী করতে পারছেন! বরং এটাই স্বাভাবিক যে, ক্রমশ এই তেকোনা, মরালী ও রেশমকুচি ও চোরাচালানের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কারণ বহেরা থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ডোমকলের সীমান্ত। তেকোনা আর বহেরা এক্কাদোক্কা খেলার ঘরের মতো পাশাপাশি। 

অতএব দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বরকত আলির। তিনি নিজের আবাদি জমির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ান। আর সাতদিন পর চরের জমি জরিপ হবে। ভাগাভাগি হবে ভূখণ্ড। কী হবে সেইদিন? তিনি জানেন না কী হবে! আগামীকালের সভায় ওই তালিকাও নির্ধারিত হবে। হয়তো কংগ্রেসের আইনুল মোল্লার নাম কেটে দেবে মোহনলাল। হয়তো অৰ্জুন সেন এ নিয়ে প্রতিবাদ করবেন। মারামারি হবে কি? রক্তারক্তি? চরের দখল নিয়ে তা-ও তো হয়েছে। 

তবু ফসল ফলবে মাটিতে। শস্যভরা গাছ দুলবে হাওয়ায়। বরকত আলি সেই হাওয়ায় দোলা সবুজ শস্যক্ষেত্রের দিকে চেয়ে থাকেন। তাঁর চার বিঘা জমি চলে গেল। জমির জন্য কষ্ট হয়। কুড়ি বিঘা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। বড় ছেলের কঠিন অসুখ হল একবার। শহরে নিয়ে রাখতে হল দু’মাস। তখন চার বিঘা বিক্রয় করেছিলেন। এখন আবার চার বিঘা। যাক। মেয়েটা সুখী হোক। তাঁর চোখে জল আসে। মেয়েটা চলে যাবে দূরে। ভরসা একমাত্র, বদরুদ্দিনের শিক্ষা-দীক্ষা ভাল। তবু মেয়েদের কপাল। 

জোহরের নামাজের সময় হয়েছে। এখনই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না বরকত আলির। কাঁধে ফেলা গামছাখানি পেতে নিলেন তাঁর ক্ষেতের প্রান্তে একটি কাঁঠালগাছের ছায়ায়। সময় বিশেষে এই গামছাই হয়ে ওঠে তাঁর জায়নামাজ। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নিয়েত করে নিলেন। তারপর নামাজে বসলেন। 

চারপাশে বৈশাখের ছড়ানো রোদ্দুর। গাছের শিকড় প্রাণপণে টেনে নিচ্ছে রস। হাওয়া নদী হতে জলকণা বয়ে সিক্ত করে দিতে চাইছে তাদের দেহ। সেই সিক্ততা, ওই কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসে, কিছু-বা ভাগ পেলেন বরকত আলি। কাঁঠালগাছের ঘন পাতার মধ্যে যেন ঢুকতে পারেনি বৈশাখি তপ্ততা। দু’খানি গোরু ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে পড়েছে। বসে আছে এই কাঁঠালগাছের ছায়ায়। বরকত আলি নামাজ শেষ করে দাঁড়ালেন। একটি কিষাণ ডেকে সাবধান করে দিলেন। গোরুগুলি যেন ক্ষেতে না ঢুকতে পায়। সর্বনাশ করে ফেলবে শস্যভরা গাছগুলির। কিষাণটি বলল—খেদিয়ে দিই ওদের। 

উদাস হয়ে গেলেন বরকত আলি। বললেন—থাক। ছায়ায় বসেছে। লক্ষ রাখিস একটু। 

তাঁর নিজেরও এই ছায়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বড় স্তব্ধ, বড় শান্ত এই জায়গা। ফিঙে পাখি ওড়াউড়ি করছে। বুলবুলি উড়ছে দল বেঁধে। কাঠঠোকরা সন্ধান করে ফিরছে একটি পছন্দমতো বৃক্ষকাণ্ড। এখনও শিস দিয়ে চলেছে কোকিল। একটি কাঁঠালপাতা এসে পড়ল তাঁর মাথায়। তিনি উপরে তাকালেন। কাঁঠাল ফলেছে অনেক। এই জমিরই লাগোয়া চার কাঠা তিনি বিক্রি করেছেন। এবারের ফসল উঠলেই লেখাপড়া হয়ে যাবে। তিনি পশ্চিমমুখে তাকালেন। ফসলের ক্ষেত পশ্চিমে হারিয়ে ফেলেছে সীমা। বড় পবিত্র লাগে তাঁর ওই দৃশ্য। আঃ! কী সুন্দর! পৃথিবী কী সুন্দর! ওই প্রান্তে যখন সূর্য অস্তে যেতে বসে, জমে থাকা ধুলোয় এসে লাগে সূর্যাস্তের চাপ চাপ লাল রং, গোটা গ্রাম তপ্তকাঞ্চন বর্ণে ভরে যায় যখন, কোনও রাজনৈতিক কুটিলতা সেই সৌন্দর্যকে হত্যা করতে পারে না 

বরকত আলি ভাবতে থাকেন। তাঁর সামনে এখন দুটি মাত্র পথ। কোনওক্রমে এই দুই বৎসর কাটিয়ে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো। অথবা এই মোহনলালের সঙ্গে সামিল হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া আর পথ কী! নেই নেই। 

বাড়ি ফিরতে থাকেন তিনি। সরু পথ ধরে যেতে যেতে ইসমাইলের দোকানের সামনে দেখতে পান দুটি বিবদমান কুকুর। একটি আরেকটির ঘাড় কামড়ে আছে। টানছে। যেন টুটি ছিঁড়ে নেবে। অপরটি নড়তে পর্যন্ত পারছে না। সকলেই দেখছে দাঁড়িয়ে। কেউ কুকুর দুটিকে ছাড়িয়ে দিচ্ছে না। মজা দেখছে। তিনি ঢিল কুড়োলেন। মারলেন তাক করে। কুকুরটি ঘাড় কামড়ে আছে। টানছে। ছিঁড়ছে। তিনি আবার মারলেন। মোহনলাল বলল—চাচা! থাক না! যার শক্তি বেশি সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে। 

বরকত আলি দেখলেন, বাকিরা হাসছে। নিঃশব্দ। দাঁত বের করা হাসি। তাঁর কীরকম অপমান বোধ হল। রোষে বলে ফেললেন—দাঁত বাইর করিস না। ছাড়া। 

কেউ এগিয়ে এল না। মোহনলাল নিজেই একটি জ্বলন্ত দেশলাই ছুঁড়ে দিল ঘাড় কামড়ে ধরা কুকুরের গায়ে। চমকে সরে দাঁড়াল কুকুরটা। হো-হো হা হা শব্দে হেসে উঠল ছেলেগুলি। কামড় খেয়ে দ্বিতীয় কুকুরটি টলছে। দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে। প্রথম কুকুরটি দাঁত বার করে আবার এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। বরকত আলি আর দাঁড়ালেন না। বাড়ির পথ ধরলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *