৪৩
চৈত্রে বিচিত্র সব
বসন্ত উদয়।
লোচন বলে বিরহিণীর
মরণ নিশ্চয়।।
সন্ধ্যায় বরকত আলির সঙ্গে বসেছিল তারা। নির্বাচনের আগে কিছু কাজকর্ম করা দরকার। কিন্তু আর্থিক সংস্থান নেই। তেকোনার বসতি এলাকা জুড়েই ভাঙন লাগিয়েছে ভৈরব। দু’খানি পয়োস্তি পড়েছে অন্য পাড়ে। আখড়ার উলটোদিকে একখানি। সেটি আকারে বড়। এবার শরতে তাতে ফুটেছিল কিছু কাশফুল। এখনও চরা চাষযোগ্য হয়নি। কিন্তু অন্য কেউ দখল নেবার আগে তেকোনার লোকেদের মধ্যে চরা বিলিব্যবস্থা হয়ে যাওয়া দরকার। ছোট চরাটি গড়ে উঠছে এখনও। জব্বারের জমি যেদিকে ভেঙে পড়ল তার উলটোদিকে তৈরি হচ্ছে অল্প অল্প করে।
চরা যাদের মধ্যে বিলি-বণ্টন হবে তাদের তালিকা করিয়েছেন বরকত আলি। জমি তো অনেকেরই গেছে। কিন্তু যারা একেবারে ভূমিহীন হয়ে গিয়েছিল তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে করা হয়েছে এই তালিকা। মোহনলাল তালিকা দেখতে চাইল একবার। নামগুলি দেখে কোনও মুখ তার মনে পড়ল না। সে জিগ্যেস করল—এরা কোন দলের?
ছ’ জনের তালিকা। সিদ্ধার্থ বরকত আলির উত্তরের অপেক্ষা করছিল। কারণ, যারা জমি পাবে, তার বিচারে, ভূমিহীনতাই তাদের জমি পাবার যোগ্যতা। তারা রাজনৈতিক না অরাজনৈতিক, কোন দলের সমর্থক, তা বিচার্য নয়। বরকত আলি বললেন—এরা পার্টি করে না কেউ।
—তা আবার হয় নাকি?
মোহন ধমকের সুরে বলে।
—চাচা। সরাসরি পার্টি না করতে পারে। কিন্তু ওঠা-বসা তো করে। ভোট তো দেয়।
–ভোট কাকে দেয়, কী করে বলি! আর গ্রামে তুমি থাক, বুঝবে, ওঠা-বসার জন্য দলাদলি নাই। ওই ভোটের আগে যা একটু। দলভাগ, ঝগড়াঝগড়ি। দু’দিন বাদে সব মিটে যায়। যে যার সমর্থন মনে মনে রাখে।
সিদ্ধার্থ এবার কথা বলে—তা ছাড়া, এই প্রসঙ্গে দলনিরপেক্ষ হওয়াই উচিত।
মোহনলাল বলেছিল তখন—দলনিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না। আর আমার মতে, যে আমার দলের নয়, তাকে কোনও সুবিধা দেওয়ারও কোনও মানে হয় না। তা হলে সে অন্তত এটা বুঝবে যে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার।
সিদ্ধার্থর ভাল লাগেনি এই মন্তব্য। এ তো পাইয়ে দেওয়া রাজনীতির শস্তা চমক। সৰ্বত্ৰ এই চলছে। তুমি কি আমার দলের? তা হলে তুমি এটা পাবে। হাত ঘোরালে নাড়ু পাবে, নইলে নাড়ু কোথায় পাবে! মোহনলাল অভিনব কিছু বলেনি, আলাদাও কিছু বলেনি। কিন্তু মোহনলাল অন্যরকম বলছিল। সিদ্ধার্থ, মোহনলালের মুখে এরকম কথা আগে শোনেনি। বরং তারা তিন বন্ধু—সে, মোহনলাল ও হারাধন, রাজনীতির বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস করত। লোকহিতে বিশ্বাস করত। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধীদল সবসময়ই থাকবে। তার জন্য বিদ্বিষ্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিরোধীদলের সদস্য হলেই বা সমর্থক হলেই সে ঘৃণ্য নাকি! বিরোধ একমাত্র মতে। আর সবই তো এক। একই দেশের অধিবাসী সকলে। একই হিতৈষণা। সে মিহির রক্ষিতের মধ্যে দেখেছে এই বিদ্বেষ। ওরা বিরোধী দল, ওরা আমাদের শত্রু। এভাবে ভাঙতে ভাঙতে মানুষ শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে কোথায়? আলাদা ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। আলাদা বর্ণের প্রতি বিদ্বেষ। একই ধর্মের বিবিধ সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ। পৃথক দেশ হলে বিদ্বেষ। এমনকী একই দেশের মধ্যে ভিন্ন প্রদেশের অধিবাসী হলেও ছড়িয়ে দেওয়া পরস্পরের প্রতি ঘৃণা। বিদ্বেষের বিষ নামতে নামতে ঢুকে গিয়েছে এ-পাড়া ও-পাড়ায়। চৌকাঠ ডিঙিয়ে পৌঁছে গেছে গৃহে ভাইয়ের প্রতি ভাই, স্বামীর প্রতি স্ত্রী অসম্ভব বিদ্বিষ্ট পরস্পর। এভাবে কোথায় পৌঁছবে মানুষ! সংগঠিত সমাজ প্রতিদিন মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ—যা মানুষ নিজের অজ্ঞাতেই বয়ে বেড়ায় সারাজীবন। ওই বিষের দাসত্ব করে।
মোহনলাল এতখানি পালটে গেল কবে! মাঝখানে এম এ পড়ার দু’ আড়াই বছর মোহনলাল তার সঙ্গে নিয়মিত থাকেনি! এরই মধ্যে এত!
বরকত আলি মোহনলালের কথা শুনে বলেছিলেন—এ কথা তো ঠিক বললে না তুমি মোহন। সব দলের লোককেই সুযোগ দিতে হবে। না হলে অন্য দল ছাড়বে কেন?
—ছাড়তে বাধ্য হবে। সেখানেই তো সংখ্যাগরিষ্ঠের জোর।
সিদ্ধার্থ ভাবছিল, ধরা যাক এমন হল, দল বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত গোটাগুটি একটিমাত্র দলে পরিণত হল। কোনও বিরোধী দল রইল না। রাজ্য জুড়ে, দেশ জুড়ে একটাই মাত্র পার্টি। তখন সুবিধা দেবার ভিত্তি কী হবে? এক ক্ষমতাবানের সঙ্গে আর এক ক্ষমতাবানের প্রতিযোগিতা। চেনা মুখ চলে আসবে প্রথম সারিতে। চাটুকার বসবে উচ্চাসনে। বৃহত্তর দল খণ্ড খণ্ড উপদলে বিভাজিত হয়ে ধ্বংস করবে পরস্পরকে। মোহনলালের জন্য এক বিস্ময়মিশ্রিত বেদনা অনুভূত হল তার। সে বলল—কবে হবে এই বিলিব্যবস্থা?
—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা আশেপাশে নজরদারি রেখেছি যাতে চর দখল না হয়ে যায়। সেটেলমেন্ট অফিসারকেও বলা হয়েছে। কাল রমজান শেষ হলেই এই নিয়ে বসা হবে। গত কয়েক বছরে ভূমিসংস্কার প্রশাসন পরিকাঠামোয় বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে ভূমিসংস্কার প্রশাসন জেলাস্তর থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে পৌঁছেছে একেবারে পঞ্চায়েত পর্যন্ত। পঞ্চায়েত স্তরে যিনি ভূমিসংস্কার বিষয়টি দেখাশোনা করেন, তিনি রাজস্ব পরিদর্শক। পঞ্চায়েতে বসেই তিনি নকশা তৈরি করেন জমিজমার, নথি সংশোধন ও অন্যান্য সংস্কারমূলক কাজ দেখাশোনা করেন।
সিদ্ধার্থ বুঝতে পারছিল না, এই সমস্ত কথাই তাকে কেন বলছেন বরকত আলি। এক্ষেত্রে তাঁর আলোচনা হওয়া উচিত উপপ্রধানের সঙ্গে। গ্রাম সংসদের সভায়। পঞ্চায়েতের মাসিক বৈঠকে। তখন কথা বলেন বরকত আলি—আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আমরা আরও প্রায় দু’ বৎসর সরকারি অনুদান পাব। এক বৎসর পর বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেলেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হবে। তার অন্তত ছ’ মাস পরে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এখানে লোকজন চোখের সামনে কাজ দেখতে চায়। আমরা যদি এই এক বৎসরের মধ্যে পাড়টা বাঁধিয়ে দিতে পারি তার ফল বিধানসভা নির্বাচনেও পাব, পঞ্চায়েতেও পাব। এ বৎসর আমরা সরকারি অনুদান পেয়েছি তিন লক্ষ টাকা। গত তিন বৎসর আমাদের অনুদানের টাকা দিয়ে আমরা ভিতরের গ্রামগুলিতে অর্থাৎ যেখানে নদী নেই সেখানে নলকূপ বসিয়েছি। কয়েকটি ছোট পুল করেছি। এ বৎসরের টাকা এখনও খরচ হয়নি। লোকে বলে প্রধানের গ্রামে কাজ হয় না। ভাবছি রাস্তা তৈরি করব। কিন্তু তিন লক্ষ টাকায় আর কতটা রাস্তা হয়? আরও দু’ বৎসরের অনুদান দিয়ে যদি কিছুটা এগোনো যায়। কিন্তু কথা হল অন্য। আমাদের পঞ্চায়েতে আছে মোট পনেরোটি গ্রাম। শিশুদের নিয়ে লোকসংখ্যা কুড়ি হাজার মতো। কুড়ি হাজার হলে এক-একটি পরিবারে সাতজন লোক ধরলে পরিবারসংখ্যা হয় আড়াই হাজারের অধিক। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার পরিবারের জীবন নদীর জন্য বিপন্ন। শুধু তেকোনা গ্রামেই তো নয়, অন্যান্য গ্রামেও নদীতে ভাঙন লাগছে। ভূমিহীনদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে নিত্য। এ নিয়ে কি কিছু করা যায় না?
মোহনলাল বলেছিল—আমরা আন্দোলন করব। ভুখ হরতাল করব। মিছিল করব।
সিদ্ধার্থ বলল—এ ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছা আছে আমার। আমি গ্রামগুলি ঘুরে ভাঙন প্রতিরোধ সমন্বয় সমিতি গড়ে তুলতে চাই। রাঢ় ও বাগড়ি অঞ্চলের সমস্ত ভাঙন-কবলিত মানুষকে একত্রিত করে তৈরি হবে আন্দোলন। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি গ্রাম বা পঞ্চায়েত এলাকার জন্য কাজ করে হয়তো সাময়িক কিছু কাজ হবে কিন্তু তাতে দীর্ঘস্থায়ী লাভ হবে না।
বরকত আলি বললেন—রাসুবাবু এ বিষয়ে কী বলেন?
—রাসুদা আমাকে এ কাজের প্রাথমিক পরিকল্পনা করতে বলেছেন। ভাঙন প্রতিরোধের যে বিপুল খরচ, তা বহন করার ক্ষমতা রাজ্যের হাতে নেই। এই অর্থ আসবে কেন্দ্র থেকে। কেন্দ্ৰে যাতে বিষয়টা গুরুত্ব পায় তার জন্য বড় করে তৈরি করতে হবে এই আন্দোলন।
—এই একবছরের মধ্যেই কি হবে?
মোহনলাল বলল—এর জন্য ঘোরাঘুরির কী আছে? যে-কোনও একটি দিন ঠিক করে বহরমপুরে মহামিছিল করলেই তো হয়। লোকাল পার্টি অফিসকে বলে দিলেই হবে ওই দিন লোক নিয়ে যাবার জন্য।
—অর্থাৎ এতকাল যেভাবে কাজ হয়েছে। যেভাবে জনসমাবেশ তৈরি হয় কোনও বড় নেতা এলে বা বড় সভা দেখাবার প্রয়োজন হলে। যারা আসে তারা কেন আসে তা-ই জানে না। লোকাল নেতারা তাদের সভায় বা মিছিলে যেতে বাধ্য করে। কিংবা নিছক মাথাপিছু পাঁচ টাকা ও এক প্যাকেট খাবারের লোভ দেখায়। যারা আসে তাদের একদিনের ঘোরাও হয়। প্রাপ্তিও হয়। ওদিকে সভায় বা মিছিলে উপস্থিত লোকসংখ্যার হিসেব দেখিয়ে প্রচার করে দলগুলো।
—তুই কি নিজেও এই দলের মধ্যেই নেই? তুই কি আলাদা?
—আমি আলাদাভাবে কাজ করতে চাই। একটা পদ্ধতি চলতে থাকলে তাকে সংশোধন করা যায়। দ্যাখ, আমি বিশ্বাস করি, যা প্রয়োজন, তার সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে তার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে চাওয়া বৃথা।
মোহনলাল গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল এসবই ন্যাকামি। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। জনগণের চেতনা উন্মোচনের ভার যেন বিশ্বসুদ্ধ লোক একা সিদ্ধার্থর ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে। ঘুরে ঘুরে সমন্বয় সমিতি করবে। আরে সমিতির কি অভাব আছে? ভাঙন প্রতিরোধ নিয়ে কোনও কাজই কি হয়নি এতদিন? নাকি সব অপেক্ষা করেছিল সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য! তার মন বিষিয়ে যেতে থাকছিল। মনে হচ্ছিল, সিদ্ধার্থ কে? এই অঞ্চলে ও তো বহিরাগত। এখানকার ভূমিপুত্র যদি হয় কেউ, তা হলে সে নিজে। এখানে যদি করার থাকে কিছু, জনগণকে বোঝাবার থাকে কিছু তা হলে সে-ই তা করতে পারে। কিন্তু এসব কিছুই মুখে বলা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। কারণ সে নিজের মধ্যেকার ঈর্ষাবিষে নিজেই জ্বলে কেবল এবং সন্তর্পণে গোপন রাখতে চায়।
সিদ্ধার্থ তখন বলে—আন্দোলন হওয়া উচিত গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়ে। ফরাক্কা থেকে শুরু করে কালান্তর পর্যন্ত। এমনকী মালদহের মানুষকেও এর মধ্যে সামিল করা উচিত। কিন্তু তার জন্য সময় দরকার, প্রাথমিকভাবে আমরা কেবল বাগড়ি অঞ্চল নিয়ে কাজ করব। ভাগীরথী-তীরবর্তী রাঢ়ের কিছু গ্রামেও যাবার চেষ্টা করব। আমি দেখেছি, আপনার পঞ্চায়েত আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে। আপনি ডাকলে একদিনে পাঁচশো লোক চলে আসতে পারে। সুতরাং বিশ হাজারের মধ্যে অন্তত পাঁচহাজার লোক একত্রিত করা আপনার পক্ষে কিছুই না। আমি আপনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখব। এ পর্যন্ত আপনি যেভাবে কাজ করছেন, এখন সেভাবেই করতে থাকুন। মোহন গ্রামে থাকছে। আপনার তাতে সুবিধা হবে।
বরকত আলি বিনীত হেসেছিলেন। সিদ্ধার্থের প্রশস্তি তাঁকে এমনই আত্মবিশ্বাস দিচ্ছিল, যাতে মনে হচ্ছিল, পাঁচ কেন, তিনি দশ হাজার জনকে এক ডাকে একত্রিত করতে পারেন। দশ হাজার। দশ হাজার লোক একত্রিত করা কি খুব বড় ব্যাপার?
মোহনলাল অধৈর্য হয়ে উঠছিল। তার ভাল লাগছিল না। যে-কাজে সে নেই সে কাজের পরিকল্পনা শুনে তার কী হবে? সে বলল—তা হলে আজ উঠি। সামনে গ্রাম সংসদের বার্ষিক সভা আছে তো। আপনার পরিকল্পনাগুলি ওখানেই তা হলে স্থির হবে।
তার কথায় রূঢ়তা। এই রূঢ়তা সিদ্ধার্থর শ্রুতিগোচর হল। সে বিস্ময়ে তাকাল মোহনলালের দিকে। তখন বরকত আলি বললেন— গ্রাম সংসদের সভায় তুমি এসো সিদ্ধার্থ। তোমার পরিকল্পনার কথা কিছু এদের বলবে। এভাবে তোমার কাজের কথা ভাবতে পারো। গ্রাম সংসদের সভায় তুমি সবরকম লোকই পাবে। সব দলের। তাদের বোঝাতে পারবে। কী কী ধরনের বিরোধিতা আসতে পারে, তারও আন্দাজ পাবে।
সে মেনে নিয়েছিল এই পরামর্শ। বস্তুত, কারওর মতকে বা সৎ পরামর্শকে সে অগ্রাহ্য করে ঠেলে দেয় না। নিজের মধ্যে ছড়িয়ে রাখে মূল্যবান মণিমুক্তোর মতো। কারণ সে বিশ্বাস করে, সাধারণ মানুষের ভূয়োদর্শন ও বীক্ষা থেকেই তৈরি হয়ে যায় পথনির্দেশ। কোনও এক বিশেষ ব্যক্তি সেগুলি সংকলিত করে, পরিমার্জিত করে মাত্র। জনমতকে উষ্ণীষ করে পথ চলার নামই নেতৃত্ব। কোনও দার্শনিকতাই ব্যক্তিমাত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে সহজাত দার্শনিক বোধ। আপন জীবনের অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে তার প্রতিফলন ঘটে কথায়। তাই মানুষকে বলতে দিতে হয়। সিদ্ধার্থ নিজে বেশি বলার পক্ষপাতী নয়। সে আগে বলে, তারপর শোনে। সে চূড়ান্তভাবে পরমতসহিষ্ণু। এবং এর ঋণ সে স্বীকার করে বোধিসত্ত্বের কাছে। বোধিসত্ত্ব তাকে শেখাতেন—ভাল শ্রোতা হও। তা হলে তুমি অনুধাবন করতে পারবে। ভাল শ্রোতা হও, তা হলে তুমি উপলব্ধি করতে পারবে। তোমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। এমনকী তুমি যদি ভাল শ্রোতা হও, তা হলে তুমিই হতে পারবে ভাল বক্তা।
সে তদবধি শ্রবণকে দিয়েছে সম্মান। কথা মানুষের ভাব বিনিময়ের পথ। কিন্তু তা শুধু নিজের কথা নয়। কথা বিনিময়।
মোহনলাল বরকত আলির প্রস্তাব শুনে বলেছিল—চাচা, ও যদি এই হারে তেকোনায় আসতে থাকে তা হলে বহরমপুর ওকে ভুলে যাবে।
সিদ্ধার্থ বলেছিল— যাক না। তেকোনা আমাকে চিনবে। এভাবেই তো চলে।
মোহনলাল একথার উত্তর দেয়নি। বলেছিল—তা হলে ভূমিবণ্টনের তালিকা নিয়ে আর কোনও কথা নেই বা অনুদানের টাকা কীভাবে খরচ হবে, তা নিয়েও কোনও কথা নেই।
বরকত আলি বলেছিলেন—আছে। এখানেই সমস্ত পরিকল্পনা করে গ্রামসংসদের বিশেষ সভা ডেকে পরিকল্পনাগুলি পাস করিয়ে নিতে হবে। নিয়ম হল গ্রাম সংসদের সভায় এক দশমাংশ উপস্থিত থাকতে হবে। আমি যা করি, তা হল, নিজের কিছু লোককে খবর দিয়ে পরিকল্পনাগুলি পাস করিয়ে নিই। না হলে মহা গোলমাল হয়। নানারকম কোন্দল ও বিরোধিতা আসে। এবারে অনুদানের অর্থ পৌঁছেছে ষান্মাষিক সভা হয়ে যাবার পর। সুতরাং বিশেষ অধিবেশন ডাকতে কোনও অসুবিধা হবে না।
—যারা জমি পাবার তালিকায় আছে তাদের কার কী দল বলেননি এখনও চাচা!
—চারজন আমাদের। একজন মুসলিম লিগ। একজন কংগ্রেস।
—কংগ্রেসের লোকটাকে বাদ দিতে হবে।
—তা বললে হবে না। অর্জুন সেন ছাড়বে কেন? আমার বিরুদ্ধে প্রচার বাড়বে।
এ নিয়ে ভাবতে হবে চাচা। পরে কথা বলব আবার।
সিদ্ধার্থ তাকিয়েছিল মোহনলালের দিকে। সুরাসুরের বোধ মানুষের সহজাত। কিন্তু তারতম্য আছে তার পরিমাণে। সিদ্ধার্থ নামের এই যুবক, তার অনুভূতি তীব্র বলেই সে দেখে স্বপ্ন, সে জানে প্রতিবাদ। এবং অনুভূতি তীব্র বলেই সে বুঝেছিল তার বন্ধু মোহনলাল এই মুহূর্তে তাকে অভিপ্রেত মনে করছে না। মোহনলালের অভিজ্ঞতার দ্বারা সে পরিচালিত হবে না নিশ্চিত। কিন্তু এই ব্যবহার তাকে পীড়া দিয়েছিল। জীবনের কোনও প্রিয়ত্বই স্থায়ী নয় সে জানে। তার নিজের জীবন তাকে ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে তা বৃহৎ করে। অতএব সে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই আঞ্চলিক সমস্যাগুলোয় তার মত গ্রাহ্য হল কি না ভেবে তার এই মুহূর্তে কোনও লাভ নেই। বরং মোহনলালের সিদ্ধান্তগুলোই সে দেখতে চায়। দেখা তার নিজের জন্য প্রয়োজন। কারণ পৃথিবীতে যে সামান্য কয়েকটি সম্পর্ককে সে ব্যক্তিগত বলে আজও মনে করে, তার মধ্যে আছে মোহনলালের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। এই প্রিয়ত্ব যদি হারায় তা হলে একমাত্র বোধিসত্ত্ব ছাড়া তার আর কোনও ব্যক্তিগত টান রইল না। সে বরং একপক্ষে ভাল। এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত লোপ পেলে সে বরং বহির্জগৎকেই করে তুলবে বিপুল আকারে ব্যক্তিগত। এখন যারা শুধুই তার কাছের মানুষ, তারা তখন প্রাণের মানুষ হয়ে উঠবে অচিরেই। তখন লক্ষ মানুষ প্রাণের জন হয়ে উঠলে সে এমনকী কারও বিচ্ছেদবেদনায় কাতর অবধি হবে না। এক আঁকড়ালে অপেক্ষা করে থাকে শূন্যতা। লক্ষ আঁকড়ালে অপেক্ষা করে থাকবে লক্ষাধিক।
অতএব সে নিশ্চিন্তে শয়ন করেছে মোহনলালের পাশে। কথা বলেছে পূর্বেকার মতো। বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। অসন্তোষ প্রকাশ করেছে মিহির রক্ষিতের দল যে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে। জমি দখল করার উদ্দেশ্য নিয়ে বসির খানের বাবা মহম্মদ খানের চোখ উপড়ে নেওয়ার ঘটনাকে নিন্দে করেছে সে। মোহনলাল নিজেও বলেছে মিহির রক্ষিতের বিরুদ্ধেই। এবং কথা বলতে বলতে একসময় কথা ফুরিয়ে গেল যখন, সিদ্ধার্থ নীরব হয়ে গেল। তার ঘুম আসছিল না। সে ভাবছিল, কথা ফুরিয়ে গেল তাদের। কত তাড়াতাড়ি। অথচ এর আগে কত রাত তারা পার করে দিয়েছে শুধু কথা বলে। কত অর্থপূর্ণ ও অর্থহীন কথা। কত প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় কথা। ফুরোেত না তবু। আবার সারা দিন ধরে কথা হত। দুটি মানুষের মধ্যে কখন দূরত্ব এসে যায়, গোচরে থাকে না সব ক্ষেত্রে। তা হলে কি তার ও মোহনলালের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল? কবে তৈরি হল? কখন? মোহনলাল যখন বর্ধমানে পড়তে গিয়েছিল, তখন? অদর্শনের দূরত্ব! তা হলে কি তাদের বন্ধুত্ব ছিল শুধুই এক অভ্যাস! সংসর্গের অভ্যাস! হায়! সম্পর্ক এমনই এক নিরাকার বস্তু যাকে না পুবমুখী বলা যায়, না পশ্চিমমুখী। সিদ্ধার্থ নিজে তার কী ব্যাখ্যা দেবে! সে স্থির করে, সে নিষ্ক্রিয় থাকবে। সে সরেও যাবে না। কাছে আসবারও চেষ্টা করবে না। সে সময় দেবে। এ হল সময় দেবার জিনিস। একদিন সে জেনে যাবে, দেখে নিতে পারবে পরিণতির ভাষা! অতএব সে শুয়েই থাকল ঘন অন্ধকারে চৈত্রের ঝাঁঝ গায়ে মেখে। দেখতে দেখতে তার ঘুম পেল। দু’চোখ বন্ধ করার আগে সে দেখে নিল জানালায় টাঙানো ফিকে আলো। নিজস্ব আলো তমসার।
মোহনলাল অপেক্ষা করছিল এই রাত্রির। কথা বলতে তার ভাল লাগছিল না। সে জানে, এই কথোপকথন রাত্রি শেষ করে দিতে পারে। তার লাগছিল সবই অর্থহীন, সবই প্রলাপ। এইসময় গ্রামে সিদ্ধার্থর আগমন তার পছন্দ হয়নি। বরকত আলি সিদ্ধার্থকে যে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা-ও তার পছন্দ হয়নি। এটা ঠিক যে রাসুদার সঙ্গে সিদ্ধার্থর ঘনিষ্ঠতা আছে। কিন্তু সে নিজেও রাসুদার কাছের লোক। রাসুদা তার গ্রামে থাকার সিদ্ধান্তকে প্রশংসা করেছেন। সে নিজেই তাদের আঞ্চলিক সমস্যাগুলি নিয়ে রাসুদার সঙ্গে কথা বলতে পারে। তার জন্য সিদ্ধার্থকে প্রয়োজন হবে কেন! তবু সিদ্ধার্থকে দেখলেই জ্বলজ্বল করে উঠবে বরকত আলির চোখ। সে জানে। তার ভাল লাগে না এইসব। পছন্দ হয় না। সে মনে মনে নিজেকে অনেক শক্ত করে বাঁধে। তাকে তৈরি হতে হবে। দ্রুত তৈরি হতে হবে। তাকে হতে হবে একটি নাম। নাম। মোহন। মোহন চ্যাটার্জি। ও কার লোক? ওকে চটিয়ো না ভাই, ও মোহন চ্যাটার্জির লোক। তাকে ঘিরে হবে সভা। তাকে নিয়ে হবে লম্বা মিছিল। ভোট দেবেন কাকে? মোহন চ্যাটার্জি আবার কে?
চৈত্রের ঝাঁঝ গায়ে মেখে সে ভাবতে থাকে। এবং ভাবতে ভাবতে সব ছাপিয়ে সে এসে দাঁড়ায়। সেই নগ্নবতী। সেই জিন-পরি। সেই অপ্সরা স্বয়ং। কেন-না চৈত্র মাসের অপর নাম মধুমাধব। বসন্তের উষ্ণতা ও দহনজ্বালা ফিরি করে বেড়ায় সে। দেহের কোষে কোষে উন্মাদ-জারক বিনিময়ে সে মাশুল গুনে নেয় নর-নারীর মিলনরসে ভেজা মাটির কাছে। আর মোহনলালের বুকের তলায় জাগে সেই আকাঙ্ক্ষা। জিন-পরির মাতাল করা নিশিডাক তাকে অস্থির করে। সিদ্ধার্থ পাশে শুয়ে আছে। সে স্থির করতে পারে না সে বেরোবে কি না। জিন- পরির অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের মুখে সিদ্ধার্থকে তার মনে হয় এক অবিচল প্রতিবন্ধক। অতএব সিদ্ধার্থর বিরুদ্ধে তার লঘু ঈর্ষা অতৃপ্তকামনার কড়াপাকে গুরুবিদ্বেষ হয়ে ওঠে। যাকে বহরমপুরে রেখে তেকোনায় এলে তার হৃদয় বিষণ্ণ হত, তাকে এখন অসহ অবাঞ্ছিত মনে হয়। সে একবার এপাশ ফেরে, আবার ওপাশ। আবার এপাশ। চোখ একবার খোলে, বন্ধ করে একবার। দেখতে পায়, নদীর পাড়ে, নগ্ন সেই নৃত্যপর নারীকে। তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠা পুরুষাঙ্গ ধারণ করে সে নিঃশব্দে উঠে বসে। এ ছাড়া সে নিরুপায়। সম্পূর্ণ নিরুপায়। সে তীব্রতাঘন দৃষ্টিতে তাকায় সিদ্ধার্থর দিকে। অনুমান করার চেষ্টা করে সে ঘুমিয়েছে কি না। সে উঠে বসেছে কেন, এই প্রশ্ন না আসায় তার মনে হয়, সিদ্ধার্থ ঘুমিয়েছে নিশ্চিতই। এবং সে সন্তর্পণে শয্যা হতে নামে। তার ইচ্ছে করে, উড়ে চলে যায় তেকোনার দক্ষিণপ্রান্তে। নদীর পাড়ে। এই দু’দিন সে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে ওই দিকে। যদি দেখা পায় তার। কার মেয়ে সে? কোন মেয়ে? নাকি কারও বধূ। সঙ্গমে যত অনায়াস সে, তাতে বোঝা যায় সে অভিজ্ঞা। অতএব বধূ হওয়াই তার পক্ষে সম্ভব। তা হলে কি তার পুরুষ নেই, সে বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা! সে ভেবে কূলকিনারা পায়নি। দেখাও পায়নি সে-নারীর। দিনের আলোয় যদি দেখা হয়ে যেত তার সঙ্গে, সে কি চিনতে পারত! সে জানে না। সে নিশ্চিত নয়। এমনকী সে ধরাও দিত না তার কাছে, এমনও সম্ভব। তবু সে খুঁজেছিল প্রাণপণ। এখন তার আশঙ্কা হচ্ছে, সে যদি চলে যায়। ফিরে যায় যদি! সে স্মরণ করে, সে বলেছিল, চারিচন্দ্রের সাধনা করি আমি। তুমি আমার চন্দ্র।
এই কথার মধ্যেই তার ঠিকানা লুকনো ছিল কি? সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বিয়ে নেমে যায় নীচে। ঘুমজড়িত চোখে তাকে দোর খুলে দেয় মুনিষ দু’জন। বাইরে বেরিয়ে ফিরে তাকায় সহসা মোহনলাল। কড়া স্বরে বলে— অ্যাই, শোন।
মুনিষ দু’জন ফিরে তাকায়। বলে—জি।
—আমি রাতে বাইরে যাই এ কথা কাকে বলেছিস?
অন্ধকারে মুনিষ দু’জনের শুকনো মুখ আঁধারতর হয়। তারা বলে—জি। কারওকে না।
—হুঁ। বলবি না কিছু।
—জি।
সে এগিয়ে যায়। এবং ফিরে তাকায় আবার। দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এখন। সে ফিরে দরজায় টোকা দেয়। দরজা খুলে যায় সঙ্গে সঙ্গে। সে বলে—সজাগ থাকবি। আগের দিন ডাকতে হয়েছে অনেকবার।
তারা মাথা নাড়ে। উঠোন ঘিরে প্রাচীর। প্রাচীরের গায়ে বাইরে যাবার শেষ দরজা এটাই। বন্ধ করলেই জগৎ বিচ্ছিন্ন। কারণ উঁচু প্রাচীরে গাঁথা আছে কাচের টুকরো, তীক্ষ্ণমুখ লোহার শলাকা। দুই নারী এবং গৃহসম্পদ এইসব সুরক্ষার ভরসাতেই রেখে যান সোমেশ্বর। সঙ্গে মুনিষ ও প্রতিবেশীদের ভরসা। তা ছাড়া প্রয়োজনে-বিপর্যয়ে অভিভাবকের মতো আছেন আবুদস মল্লিক। তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা সোমেশ্বরের কাছে প্রশ্নাতীত। এমনও হয়েছে, বন্যায় গ্রাম ডুবে গেছে, দ্বীপের মতো জেগে ছিল দালান বাড়িগুলি। সোমেশ্বর বহরমপুরে বসে অস্থির হয়ে উঠেছেন। কিন্তু গ্রামে আসার পথ পাননি। তখন আবদুস মল্লিক নিজের পরিবারের চেয়েও অধিক গুরুত্বে রক্ষা করেছিলেন সোমেশ্বরের স্ত্রী ও মাকে। আবদুস মল্লিক এভাবেই তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসছেন। সোমেশ্বরও প্রয়োজনে সাহায্য করেছেন আবদুস মল্লিককে। মোহনলালের মধ্যে এই কৃতজ্ঞতা জাগেনি। সে জানে আবদুস মল্লিক ভূমিহীন কৃষক হয়ে গিয়েও ভূমি লাভ করেছেন সোমেশ্বরের দাক্ষিণ্যে। সহায়তায়। তদুপরি, তিনি এই পরিবারের কর্মচারী। আগের জমিদারের যেমন নায়েব থাকত, তেমনই একজন। তিনি কাজ করছেন, তার বিনিময়ে বেতন পাচ্ছেন। সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। তাঁকে মনে করা হয় আত্মীয়সম। কিন্তু না মনে করলেও কিছু যায় আসে না। বেতন ও কর্তব্যের মধ্যেও যে থেকে যায় কিছু অমূল্য বিষয়, থেকে যায় বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, মায়া, নির্লোভ আচরণ—মালিক ও কর্মচারী, এই মনোভাবের বস্তুগত প্রচ্ছায়ার বাইরেও যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিতর সখ্য গড়ে উঠতে পারে- এই বোধ তার হয়নি। তার নেতা হয়ে ওঠার ইচ্ছা এক প্রভুত্বকামনাই—মানুষ যাকে বয়ে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলেই লুকনো অস্ত্রের মতো হঠাৎ উন্মোচিত করে। অতএব তার পদভারে মেদিনী কাঁপে এখন। একটি নারী শরীরের আকাঙ্ক্ষায় নিশিগমন করে সে। তার বধু হয়ে আসার জন্য যে-কুমারী মেয়েটি সততার সঙ্গে কোথাও প্রতীক্ষা করে আছে, তার কথা ভেবে নিজেকে সৎ ও সুকুমার রাখার দায়িত্বও সে বোধ করে না অন্তরে। সে যায়। কেবলই চলতে থাকে। এবং চলতে চলতে পাড়ার প্রান্তে একটি গৃহ হতে আগত ক্রন্দনধ্বনি শুনে থমকে দাঁড়ায়। কার গৃহ? তার মনে পড়ে যায়। ইদরিশ নামে লোকটি, যে গান গায়। যার শিশু মেয়েটি খুন হয়ে গেল এক বালিকার হাতে। মামাতো বোন হত্যা করল খালাতো বোনকে। এখন কাঁদছে ওই খুন হয়ে যাওয়া শিশুর মা। স্বাভাবিক। কাঁদবেই। শিশু মারা গেলে মা কাঁদবেই। সে বিচলিত হয় না। বরং নদীর পাড়ে দেখে। সে নেই। সে আবাদি জমির দিকে তাকায়। নেই। চরাচরে মৃদু আলোমাখা ক্লান্ত শূন্যতা। সে অকারণে চাঁদের দিকে তাকায়। সে কি সত্যি এক জিন-পরি? সত্যি নেমে এসেছিল চাঁদের প্রান্ত থেকে? এই রাত্রির মোহময়তায় তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে জিন-পরির কথা। সে পায়ে পায়ে পূর্বদিনের সঙ্গমস্থলে এসে দাঁড়ায়। নগ্ন শরীরিণীর দৃশ্য কল্পনায় সে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে হতাশভাবে তাকায় চারিদিকে আর তার কাছে এসে তাকে শোঁকাশুঁকি করে লেজ নাড়ে একটি কুক্কুরী। ঘর-ঘর শব্দ করে গলায়। তার উত্তেজনা অস্থিরতা তুঙ্গ হয়ে ওঠে। সে উবু হয়ে বসে পড়ে মাটিতে। তখন একটি হাত নেমে আসে তার পিঠে। সে চমকে তাকায়।
সেই নারী। যার পাখা গুঁড়ো-গুঁড়ো। যার হাত-ডানা নাচতে চায় কিন্তু জানে না নাচের মুদ্রা। যার শরীর নগ্ন নয় আজ। সে দেখে এবং ঝটিতি উঠে দাঁড়ায়। অবয়বে সাধারণ মেয়ে কিন্তু চোখে তীব্র কামনা নিয়ে সে হাঁটে। পিছু ফিরে চায়। হাঁটে। মোহনলাল সম্মোহিত অনুসরণ করে তাকে। সেই নারী আরও দক্ষিণে হাঁটে এবং একটি ঝোপঝাড় পেয়ে তার আড়ালে দাঁড়ায়। মাথার ওপর একফালি পাকা কুমড়োর মতো চাঁদ দৃশ্য দেখে দোল খায়। মোহনলাল নারীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার ধাঁধা লেগে যায়। এ কি সে-ই? এ কি সে-ই? তখন আবরণ খুলে ফেলে নারী। মুক্ত করে ভারী স্তন। মোহনলাল এবার তাকিয়ে থাকে। যেন প্রথম দেখল সে আজ। যেন প্রথম জানল। ওই বস্তু কত মোহময়। কী অপার্থিব। যেন দুটি ফুটে থাকা চাঁদ। সে আকর্ণ তপ্ত হয়ে ওঠে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। সে হাত বাড়ায় চাঁদের দিকে আর ছলনা করে চাঁদ। ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। সে প্রথমে পাগল হয়ে ওঠে। তারপর উন্মত্ত হয়। এবং তার উন্মাদ অবস্থা দেখে নারী চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। ধরা হয়ে শুয়ে পড়ে। চাপা গলায় বলে—চাঁদ! আমার চাঁদ! এস! কর্ষণ করো আমায়!
আগ্রহে অধীর হয়ে ওঠে নক্ষত্ররাজি। টুপটাপ খসে পড়ে ভুঁয়ে। গাছের পাতায়, জলের বুকে শব্দ তুলে মধুমাধবী সারং বাজায় বায়ু। আর নারী-পুরুষ যৌথভাবে পা দাপায়। ভূমিতে আছড়ে পড়া সেই দাপানো পায়ের ছন্দ সঙ্গত করে বায়ুসংগীতকে। নারীর সুগোল শ্রোণি ঘষে যায় কৰ্কশ জমিনে। পুরুষটির দিব্য জানু ছড়ে গিয়ে রক্ত লাগে ধুলিকণায়। তবু সংসর্গ চলতে থাকে ছন্দে ছন্দে গানে-গানে। নিরন্তর কালের ভাষা হিসেবে চলতে থাকে যোগ-বিয়োগ। যোগ-বিয়োগ। যোগ-বিয়োগ।