রাজপাট – ৩৮

৩৮

ফালকুনো বসন্তের বাও 
কুয়িলার ডাক। 
বিয়ার ডামাডোল খালি 
ঝাইন শানাইয়ের হাঁক।। 
আকয়া বকায়া কাম 
থাকে যত ইতি। 
হক্‌কোল তাত মন দেইন 
চাইয়া পাঞ্জি পুথি ॥ 
জায়-জোগড়ে চাইবো ভার 
বমগোল্লা ফুটে। 
জামাই কন্যার যাওয়া দেখাত 
পুয়াপুড়ি ছুটে।।

.

কলাই বুনেছে কেউ, কেউ মুগের চাষ দিয়েছে। সোনালি মুগের চেয়ে পান্নাই বেশি। কারণ পান্নার ফলন অধিক। অনেকে পন্থমুগ বা সম্রাটও লাগায়। কলাইয়ের মধ্যে রয়েছে কালিন্দী ও সারদা। ফলন বেশি বলে ক্ষুদ্র ও মধ্যমানের চাষিরা সারদার চাষই করে বেশি। মুগের ফসল উঠতে বৈশাখের শেষ। আর কলাই উঠবে আরও পরে। মধ্যজ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে যেতে হবে কলাইয়ের শস্য পাবার জন্য। 

সবে বোনা হয়েছে বলে আবাদভূমিতে রং লাগেনি এখনও। মাটির কোল ঘেঁষা চারাগাছগুলির ওপর দিয়ে উন্মাদ ফাগুন, হা-হা ফাগুন ধাবমান। পলাশ গাছগুলি তেতে আছে যেন। পত্রবিহীন শাখা-প্রশাখায় চোখ ঝলসানো অগ্নিময় ফুল। 

আখড়ার গায়েই রয়েছে দুটি পলাশের গাছ। আম-কাঁঠাল গাছের পাশে পাশে। আর তারা দুলুক্ষ্যাপার চিত্তেরই মতো, দেহেরই মতো দহনে উন্মুখ। পলাশে লেগেছে ফাল্গুন আর দুলুক্ষ্যাপার হৃদয়ে লেগেছে ফাল্গুনী। হৃদয়ে লেগেছে, নাকি দেহে? এখনও সে তফাৎ করতে পারছে না। এখনও তার ঘোর ভাঙেনি। সে-ই তবে সঙ্গিনী তার? সবই গুরুর ইচ্ছা। 

ময়না বৈষ্ণবীর অবমানকর দেহান্তে সে পাগল হয়েছিল। এই গ্রাম, এই জনপদ – কিছুই সে সইতে পারছিল না। পালিয়ে যেতে যেতে, চলে যেতে, চলে যেতে সে ঠেকেছিল শান্তিনিকেতনে। কেন সে গেল ফিরে ওই শান্তিনিকেতনেই? কোনও কোনও জায়গা মানুষের হৃদয়ে বসত করে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো। কিংবা সুহৃদের মতো বলা যায়। হৃদয় যার সান্নিধ্য চায়। দৃষ্টি চায় যাকে অবলোকন করতে। দুলুক্ষ্যাপার কাছে তেমনই এই শান্তিনিকেতন। 

অনেক বেশি জনবহুল এখন বোলপুর। তবু সে গিয়েছিল। তবে বোলপুর ছাড়িয়ে, শান্তিনিকেতনের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল কাঁকইয়ে। কাঁকই, কোপাইয়ের ধারে এক শান্ত অনাড়ম্বর গ্রাম। সেখানে আছে যতীনক্ষ্যাপা। দুলুক্ষ্যাপার গুরুভাই। বন্ধু। কোপাইয়ের ধারে বসে কতদিন সে আর যতীন গঞ্জিকা সেবন করেছে। গান গেয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আলোচনা করেছে সাধনপদ্ধতি নিয়ে। বাউল সাধনার মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত কী পাওয়া যায়, এই জিজ্ঞাসার নিরসন হয়নি আজও। সঙ্গিনীবিহীন তার সাধনা কতকাল! যতীনের সঙ্গিনী আছে। লীলা। আর যাকে নিয়ে দুলু বাউল তার সাধন শুরু করেছিল, সে হারিয়ে গিয়েছে কোথায়। 

.

শর্বরী। তার নাম ছিল শর্বরী। দুলেন্দ্র নামে এক যুবকের সঙ্গে বাউল জীবন যাপন করবে, এমন অঙ্গীকার সে করেছিল। ‘আমরা ঘুরে ঘুরে বেড়াব। গান গাইব। ঘরে বাঁধা পড়ব না আমরা দুল’। বলত সে। আদর করে দুল বলত। তারই আকাঙ্ক্ষায় ও উল্লাসে সে সকল সংস্কার ও অজানিত ভবিষ্যৎ বিষয়ক নিরাপত্তার আর্তি ঝেড়ে ফেলে ভবঘুরে হয়ে ওঠার আদর্শ অভ্যাস করছিল। এক নারীর জন্য সবই করা যায় এ জীবনে। নিজের কাছে নিজের মতো তুচ্ছ আর কী! এক নারীই কেবল তুচ্ছতা থেকে তুলে এনে পুরুষকে করে দিতে পারে অর্থময়। সেই প্রাণময়ীর জন্য সব ভাসিয়ে দেওয়া যায়। সকল অর্থ, সংস্কার, সেই প্রাণময়ীর তুলনায় এই সকলই নিতান্ত মূল্যহীন। 

অতএব যেমন-যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছিল শর্বরী, তেমনই সে প্রস্তুত হয়েছিল। এই বীরভূমের রাঙামাটির ধুলো সে গায়ে মাথায় মেখেছিল। হঠাৎ মরে গিয়ে তার ভ্রাম্যমাণ জীবনের জন্যই আত্মত্যাগ করেছিলেন তার শেষ টান, তার বাবা। ঘর বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিল সে। পয়সাকড়ি যা পেয়েছিল, যথেষ্ট পরিমাণ, ব্যাঙ্কের তহবিলে রেখেছিল। সেই থেকে, আজও তার কোনও উপার্জনের পরোয়া নেই। কী-ই বা খরচ তার! গান গায়। হাত পাতে। যা মেলে তাই দিয়ে যতটুকু চলে। মাঝে মাঝে তহবিল হতে কিছু তুলে নেয়। তার ভাণ্ডার কমে না তবু। টাকায় টাকা বাড়ে। ব্যাঙ্ক তাকে দেয় শতকরা নয় টাকা হারে সুদ। 

অর্থ তার দুশ্চিন্তার কারণ নয়। জীবনও তাকে বিষাদগ্রস্ত করে না। সে যদি গৃহী হত, যেমন হয়েছে যতীন আর লীলা, তা হলে শেষ পর্যন্ত শহরের সামাজিক পরিস্থিতিতে কোনও এক জীবিকার চাপে, সে এক গতানুগতিক জীবনযাপন করত। কারণ যতীনের মতো তার বাড়ি গ্রামে ছিল না। তার চেয়ে এই ভাল। এই অনাড়ম্বর জীবন। দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে, সমাজের কোণ-ঘেঁষা এই বেঁচে থাকা— এই ভাল। কেউ তাকে চেনে না, সে-ও চেনে না কারওকে! চেনাচিনির দরকার কী। পথে যাকে সঙ্গে পাবে, সে-ই তোমার আপনজন। হাতে হাতে বেঁধে থাকাই সেরা বন্ধন। যে-বাঁধন সহজে খুলে যায়, প্রাণ তাকেই আঁকড়ে ধরে বেশি! তাই দুলুক্ষ্যাপার ভালবাসা ডোবার পাঁকে গাঁথে না। কুঁয়োর শ্যাওলা মাখে না। তার ভালবাসা সর্বজনের। মুক্ত। বিরাট। বিরাট এই ভালবাসার সাধন ছাড়া কী-ই বা আছে মানুষের! থাকা উচিৎ-ও নয়। কিন্তু সে বোঝে ক’জনা? তার এই মধ্যচল্লিশের ব্যাপ্ত দেখায় হাতে গোনা গুটি কয়। তাদের মধ্যে সেরার সেরা একজন। ক্ষ্যাপা তাকে বুঝতে পেরেছিল। তাদের মধ্যে তফাৎ ছিল, তবু ছিলও না। সে কে? কে? সে ওই। ওইজন। যাকে দেখলে দুলুক্ষ্যাপার বুকে দোতারা আপনি বেজে ওঠে। যে আশ্চর্যময়ী পৃথিবীতে বিরাজ করে বলে সে প্রেমে ভিজে আছে সারাক্ষণ। সে আনন্দে আছে। 

না। আনন্দে ছিল। ময়না বৈষ্ণবীর মৃত্যু তাকে উথাল-পাথাল করেছে। তার সহজ আনন্দ উধাও হয়ে গিয়ে এসেছে দীর্ঘ বিষাদ। এই বিষাদের থেকে পরিত্রাণ পেতে সে যতীনের কাছে গিয়েছিল। যতীনের চেয়ে বেশি করে আর কেউ তাকে বুঝবে না। যতীনই বলেছিল, যখন শর্বরী তাকে ছেড়ে চলে যায়— এখান থেকে চলে যাও তুমি। অন্য কোথাও থাকো। 

—কোথায় যাব? 

সে অসহায়ের মতো প্রশ্ন করেছিল। তার মাথার ঠিক ছিল না। তার মনে হয়েছিল, শর্বরী ছাড়া সে তো অর্থহীন। অসম্পূর্ণ। পাগল-করা প্রেম যে নিজেকে ভুলিয়ে দেয়। নিজেরও আছে এক অস্তিত্ব, অর্থ, ব্যঞ্জনা—তা ভুলিয়ে দেয়। মনে হয়, সে আমাকে ছেড়ে গেছে—এই মাত্ৰ নয়, সে শূন্য করে গেছে সব—জীবনে পরিত্যক্ত হওয়ার বেদনা যে জানেনি, সে জানবে না কত তীব্র এই আঘাত। এবং এই না জানা এক আশীর্বাদ। দুলেন্দ্র এই আশিস পায়নি। শর্বরীর বিশ্বাসঘাতকতায় সে মর্মাহত, বিপর্যস্ত তখন। সে ওই নারীকে বিশ্বাস করেছিল। হয়তো-বা তার জীবনের তরণীই ছিল ওই নারী। সে ছেড়ে চলে গেলে, দুলু বাউল পড়ল অথৈ জলে। দমবন্ধ হয়ে গেল তার। সে ডুবতে ডুবতে দেখেছিল এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না। সাঁতরে পারাপার হতে গিয়ে দেখেছিল একুল নেই, ওকূল নেই। দুঃখে দ্রবণ হয়ে সে তখন জলই যেন—বা। 

তখন যতীন বলেছিল- তোমার যাবার জায়গার অভাব কী ভাই? সংসার ছেড়েছ। যেখানে যাবে, যেখানে থাকবে, সে-ই তোমার জায়গা। শান্তিনিকেতনের এই চারিপাশ তোমার কাছে বিষময় এখন দুলেন্দ্র। এখানে তুমি যত থাকবে, শর্বরী তত বেশি করে গ্রাস করবে তোমাকে। 

ঠিকই বলেছিল যতীন। এ অঞ্চল ত্যাগ করার পর ধীরে ধীরে সে আত্মস্থ হতে পেরেছিল। শর্বরীকে ছাড়া, একা, বেঁচে উঠছিল সে। শুধু আর কারওকে সাধনসঙ্গিনী করতে পারেনি। আর কারও সঙ্গে করেনি যৌথক্রীড়া। সে, যতই ঝেড়ে ফেলুক সংস্কার, আশৈশবলালিত অভ্যস্ত সমাজের বাহুল্য, যতই সে হয়ে উঠুক এক আদ্যন্ত বাউল, তবু আজও দেহের উপযোগেই দেহকে গ্রহণ করতে পারেনি সে। শিক্ষার যে পরিশীলন তার হৃদয়ের ভাগে সেখানে মন এক বড় বস্তু। মন প্রেমের আধার। সেই প্রেম বোঝা সহজে সম্ভব হবে না। কিন্তু তার স্বীকৃতি বড় প্রয়োজন। সে যতক্ষণ না বলেছে— আমি চাই— ততক্ষণ দুলেন্দ্র বাউল নিজেকে তরল করেনি। 

.

ময়না বৈষ্ণবী ছিল তার মনের বান্ধবী। সে যদি সম্মত হত তা হলে তারা গড়তে পারত যৌথ সুন্দরের অলীক ভুবন। হল না। হল না তেমন। ময়না বৈষ্ণবীর মন কোন শ্রীচরণে নিবেদিত ছিল, জানা হল না আজও। জানা যাবে না আর কোনও দিন। স্বয়ং কালাচাঁদই সেই ভাগ্যবান? সে আপন মনে বুঝ মানে। তাই হবে। না হলে অত শক্তি সে পেয়েছিল কেমন করে? শুধু এই পার্থিব পুরুষকে প্রেম করে অত বড় আকাশ হয়ে ওঠা যায় না। বৈষ্ণবী যদি একটু আলগা দিত, একটু কাছে আসত তার, সে নিত না, ওই কালাচাঁদকে দেওয়া প্রেমের নৈবেদ্য নিত না কেড়ে সে বৈষ্ণবীর পায়ে মাথা দিয়ে পড়ে থাকত। ওই সুঠাম দেহে সে দিত আপন অঞ্জলি। প্ৰাপ্য চাইত না। কেবল দিত ভরিয়ে। যদি এক হত দু’জনে, তা হলে এমন ঘটত কী? ঘটত না। ঘটত না। তার অন্তরাত্মা বলে ঘটত না। মনের মতো হল না তো কিছুই। তারা দু’জন সঙ্গীবিহীনভাবে একা হওয়া সত্ত্বেও মিলল না পরস্পর। অথচ ঘটল আরও কী সব, তার থই পাচ্ছে না সে এখনও। 

এক নারী একদা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। সেই পরিত্যাগের মধ্যে অপমান মিশিয়ে গিয়েছিল। তখন, বেদনার সঙ্গে মিশে ছিল দুর্বহ প্রদাহ। মনে হত, আমাকে ছেড়ে গেল? আমাকে? তখন শর্বরীর জন্য কষ্ট পেতে পেতে দুলেন্দ্র কিছু-বা ছিল আমি-প্রধান। আজ আর এক নারী তাকে ছেড়ে গেছে। দুদশকের অধিক সময় পার করে দিয়ে দুলুক্ষ্যাপার মনে আর ‘আমি’ নেই। কেবল সে, কেবল কষ্ট। দুর্বহ কষ্ট। আজও অপমানে অন্তর্দাহ হয়, কিন্তু সে-দাহ নিজের জন্য নয়, তার জন্য। তার করুণ ও অবমানিত মৃত্যুর জন্য! 

সেইসময়, শর্বরীর থেকে ত্রাণ পেতে সে ছেড়েছিল বোলপুর। আজ সে ত্রাণ পেতে চায় না। সে কোথায় যাবে? এ বিশ্বচরাচরে ময়না বৈষ্ণবী সর্বত্র বিরাজমান। ময়না বৈষ্ণবী এ জগতের বিশুদ্ধ শ্বাসবায়ু। তবু শোক, তবু সন্তাপ, মানুষ তার থেকে মুক্তি চায় আপনার অজানিতে। আর বাউল—সে তো শোকসাগর পেরিয়ে যাবে বলেই বাউল। এইসব শোককাতরতার মধ্যে মিশে যাওয়া তাকে মানায় না। 

.

কাঁকই গ্রামে যখন উপস্থিত হল সে, সে যে স্ববশে নেই, বরং কিছু উদ্‌ভ্রান্ত, তা বুঝেছিল যতীন। তাদের মধ্যে নগরসুলভ এমন তফাৎ নেই যে, কী হয়েছে তা যতীন জানতে চাইবে না। এবং সেও বলবে না মন খুলে। সকল কথা জানাশোনার পর, যতীন বলেছিল— এখানে থাকো যতদিন ইচ্ছে দুলেন্দ্র। আমাদের দুটি সন্তান রয়েছে। ফুলের মতো শিশু দুটি। তাদের সঙ্গ করো। সারা শীতকাল ধরে এবং গ্রীষ্ম অবধি রোজ সন্ধ্যায় গান হয় এখানে। আরও সব বাউল আসে। এসে জোটে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীগুলি। তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। দেখো। 

সে কোনও প্রত্যাশা বিনাই যতীনের জীবনযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। নিজের জমিতে চৌরির আবাদ করেছে যতীন। কিছু শ্বেত সরিষা। আমনের এই মরশুমে তৈলবীজের চাষই করেছে যতীন, কারণ তৈলবীজ ইদানীং দাম পাচ্ছে অধিক পরিমাণ। অর্থের হিসেব ভালভাবেই করছে যতীন এখন। কারণ গৃহী বাউলকে হতেই হয় হিসেবি, দায়িত্বশীল। আর গৃহী হওয়া কিছু দোষেরও নয় বাউলের পক্ষে। তবে একটি-দুটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার বাউল দম্পতি রত হবে সাধনায়, তা বাঞ্ছনীয়। 

সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার বাউলচর্যায় রত হয়েছে যারা, তারা বরং গর্বিত একপ্রকার। কারণ তারা প্রমাণ করেছে তারা বাঁজা নয়, খোজা নয়। বরং জন্মদানের পরবর্তী পর্যায়ে, তারা সফল মূলবস্তু ধরে রাখার সাধনায়। 

.

বিজলি আসেনি এখানেও। সন্ধ্যায় লণ্ঠন জ্বেলে দিয়েছে লীলা। এরপর আর গানের বৈঠকে সরাসরি অংশ নেয়নি সে। শিশুসন্তানগুলিকে আগলেছে ঘরে বসে। তবু আসরে লোকের অভাব ছিল না। গোল হয়ে বসে ছিল বাউলের দল। গাঁজার গন্ধে ভরা যতীনের উঠোন। এবং সন্ধের কিছু পরেই এসেছিল তারা। পাঁচজনের একটি দল। চারটি ছেলে ও একটি মেয়ে। গান শুনছিল তারা। গাঁজাও সেবন করছিল। লণ্ঠনের আলোয় মেয়েটিকে দেখছিল দুলু বাউল। দেখছিল উপস্থিত সকল পুরুষ। কেন না সে ছিল ঝরঝরে। প্রাণবন্ত। বেপরোয়া। নজর-কাড়া সুন্দরী সে ছিল না। তবু তার দুটি চোখ উজ্জ্বল। নিঃসংকোচ ব্যবহারে সে তার উপস্থিতি সরব করেছিল। মাঝে মাঝে সে গেয়ে উঠছিল তার মিঠে স্বর পুরুষ-হৃদয়ে আড়ি পাতছিল বুঝি। এমনকী নাচছিল সে যখন ওই পুরুষভুবন মাতোয়ারা। সকলেরই দিব্য চোখ তার বরতনু ঘিরে। এবং সেইসব চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারছিল দুলুক্ষ্যাপা। তারা বলছিল— হে নারী! তুমি কবে রজঃস্বলা হও? 

এতে কোনও দোষ খুঁজে পায়নি সে। নারীর শরীর পুরুষের দর্শনের বস্তু। নারীর মধ্যেই পুরুষের ভুবন। ওই দেহমন্দিরেই আছেন সাধনের দেবতা। নারীর দেহমন্দির-দ্বারে পুরুষ যে প্রণত হয়, যে-আরতি সে করে তা সৃষ্টির সাধন, আনন্দের সাধন। নারীর রজঃবিকাশ অমাবস্যার পর চাঁদের পূর্ণিমা। তার আলোয় জগৎ বিভাসিত। নারীর দুই কুম্ভ, দুই পয়োধরে এ জগতের তৃষা-নিবারক সুধা। অতএব নারী দেখে চোখ লেগে রয়। দৃষ্টি লেগে রয়। চোখ বয়সের বাধা মানে না। অবস্থানের বাধা মানে না। নারীর শরীরে লেগে রয়। 

ওই মেয়েও এক নারী। সহজ সপ্রতিভ নারী। ভাব দেখে লাগে এমনই— এ জগতের কোনও নিষেধ, যা নারীর জন্য, তাতে তার পরোয়া নেই। 

সে নাচতে নাচতে উন্মাদিনী যখন, দোপাট্টা খসে পড়েছে, এক যুবক তার বাহু স্পর্শ করল। বলল— বুড়িয়া, পাগলামি করিস না। 

–তুই ধরলি কেন আমাকে? 

ফুঁসে উঠেছিল সে। তার দু’চোখে আগুন। ভঙ্গিতে সাপিনী। হাত দুটি উপরে তোলা, স্থির, ফণারই তো। বলেছিল— ধরলি কেন? আমার ইচ্ছে আমি নাচব। 

–এবার মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। 

–যাই তো যাব। তোর কী! 

–বুড়িয়া! 

–দ্যাখ শোভন, আমার ওপর গার্জিয়ানগিরি ফলাস না। আই হেইট গার্জিয়ানস। 

তালবাদ্য ঝিমিয়ে পড়েছিল। সুরে লেগেছিল ভাটা। বরং এক খেয়ালখুশি রমণীর বিদ্রোহের দিকে সকল চোখ। দুলুক্ষ্যাপার হৃদয়ের বিষাদ এই অনুর্বর পরিস্থিতি সইতে পারছিল না। সে ঝিমোনো কলকেয় দিয়েছিল টান এবং তার প্রিয় লালনকে আশ্রয় করেছিল। 

লীলা দেখে লাগে ভয়।
নৌকার উপর গঙ্গা বোঝাই 
ভাঙ্গায় বেয়ে যায়। 
আবহায়াত নাম গঙ্গা সে যে
সংক্ষেপে কেউ দেখে বুঝে 
পলকে শুকায়।
ফুল ফোটে তার গঙ্গা জলে
ফল ফলে তার অচিন দলে 
যুক্ত হয় সে ফুলে ফলে 
তাতে কথা কয়। 
গাঙ্গ জোড়া এক মীন ওই গাঙ্গে 
খেলছে খেলা পরম রঙ্গে 
লালন বলে জল শুকালে 
মীন যাবে হাওয়ায়! 

চোখ বন্ধ করে গাইছিল সে। তার এসেছিল তন্ময়তা। বন্ধ চোখের আলোয় তার বিপরীতে শ্রোতা হয়ে ছিল ময়না বৈষ্ণবী। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে, হৈমন্তী সকালে, শুষ্ক লাগছিল তাকে, তার মন ভাল ছিল না। তার ক্লিষ্ট মুখের জ্যোতি ছিটে-ফোঁটা লেগে যাচ্ছিল দুলুক্ষ্যাপার গায়ে এবং এখন তার হৃদয়জোড়া আলো, এমতাবস্থায় সে চোখ খুলেছিল এবং দেখেছিল তাকে। সে, আর বিদ্রোহিনী নয়। কখন সে বসেছে নিশ্চুপ। দু’চোখে আবেশ তার। দু’জানুর উপর রাখা মুখ। যেন ময়না বৈষ্ণবী কুড়ি বছর পিছিয়ে গিয়ে বসে আছে আনমনা! নাকি এ শর্বরী! কোনও স্থির সময়ের গর্ভ হতে উঠে এসে, বহু যাতনার পর, বসেছে মুখোমুখি। তার বুকে কাঁপন লেগেছিল। এবং সে চোখ সরাতে পারছিল না। সাদা-মাটা মেয়েটিও ছিল অনিমেষ। ঘোর ভেঙে গেলে ‘সাধু সাধু’ বলেছিল তারা। সেই মেয়ে, বুড়িয়া নামের কচি-কুসুম মেয়ে, তাকে আরও গাইবার জন্য অনুরোধ করেছিল। এবং অন্যরাও। সে গেয়েছিল পরপর। আসর ভাঙলে, রাত্রি প্রায় দশটায়, সকলে বিদায় নিলে, যতীন বলেছিল— তোমার স্বরে জাদু লাগিয়েছ দুলেন্দ্র। 

সেই রাতে, সে শুনেছিল এক মধুর শব্দ। কারও পায়ের ছান্দিক ধ্বনি। কেউ আসছে। সে জানত না, যে আসছে সে কে। কেন আসছে এতকাল পর, যখন মধ্যমবয়সও তার গড়িয়ে চলেছে! এ এক অদ্ভুত লীলা এ জীবনের। 

এবং, সে এল দুপুরবেলা। একা। লীলার পরিপাটি আয়োজনে মধ্যাহ্নভোজের পর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সে আর যতীন। লীলার গলা পেয়েছিল তারা— ওমা! কে গো! আমাদের বুড়িয়াদিদি এই দুপুরবেলায়? সাইকেল বাইরে রেখো না। ছেলেপিলে দেখতে পেলে চালাতে নিয়ে যাবে। 

সাইকেল চালিয়ে এসেছিল সে। বলেছিল— উনি কোথায়? 

–কে গো? 

–ওই যে উনি? আপনার বাড়িতেই তো উঠেছেন শুনলাম। 

–কাকে খোঁজো গো? কোন পাগল? 

লীলা বুঝেছিল ঠিক। কিন্তু রহস্য করছিল। রহস্যের মধ্যে সকল রসের লীলা জমে ভাল। যতীন বেরিয়ে এসেছিল তখন। সাদরে বলেছিল— এসো বুড়িয়াদিদি, এসো। কাকে খুঁজছ? ক্ষ্যাপা আমাদের ঘরের মধ্যে। 

সে এসেছিল। নিকনো ঘরের মেঝেয় রেখেছিল খালি পা। পাতলা বাঁশপাতার মতো দুটি পায়ের দিকে চেয়ে ছিল দুলুক্ষ্যাপা তখন। ভাবছিল, ময়না বৈষ্ণবীর পা এমন ছিল না। এত মসৃণ, এত নির্মল ছিল না। চওড়া পা ছিল তার। ধূলিধূসর। আর শর্বরীর পা? তার মনে পড়ল না কিছুতেই। বিস্মরণে গিয়েছে সেই পদদ্বয়, সেই জানু জঙ্ঘা স্তন। 

সে এসে বসেছিল তার সামনে। মুখোমুখি। যতীন, কে জানে কী ভেবেছিল, চলে গিয়েছিল ঘর ছেড়ে। জানু পেতে, যেন-বা প্রণামের পূর্বভঙ্গীতে সে বলেছিল— আমাকে আপনার সঙ্গে নিন। 

সে, তার মৃত্যুর আদেশ সমুপস্থিত হলে বুঝি এত বিস্মিত হত না, বলেছিল— আমার সঙ্গে? কোথায়? 

— আপনি যেখানে যাবেন, যেখানে থাকবেন। 

সে তৎক্ষণাৎ খারিজ করেছিল প্রস্তাব। এত অসম্ভব, অবাস্তব এত এই আবেদন যে সম্ভব-অসম্ভব ভেবে দেখার অবকাশও সে নিজেকে দেয়নি। জোর করেনি সে। ওই বুড়িয়া নামের মেয়েটি। চলে গিয়েছিল। যাবার আগে লীলা ও যতীনের সঙ্গে কথা বলেছিল কিছুক্ষণ। এবং সন্ধেবেলা বন্ধুদের সঙ্গে আবার এসেছিল আসরে। পূর্বদিনের মতো কোনও উন্মাদ লক্ষণ দেখা যায়নি তার মধ্যে। বরং সে ছিল তার স্বভাব-বহির্ভূতভাবে অচঞ্চল। কিংবা, কে জানে তার স্বভাব কী! স্থির এবং অস্থির— এই দুই ভাবই তার মধ্যে বিরাজমান কি না, আজ এই তিনমাস কাল ধরেও তিনি ঠাহর পাননি। সেদিন সন্ধ্যায় সেই মেয়ে দুলুক্ষ্যাপার চোখ থেকে সরায়নি তার নয়নজোড়া। মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠছিল যখন— সরু ও সুরেলি তার কণ্ঠ। সেই কণ্ঠ নিয়ে সে এসেছিল আবার পরের দিন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসেছিল আবার। আবার। আবার। এবং তাদের মধ্যে বাক্যমালা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তার আবেদন এবং দুলুক্ষ্যাপার প্রত্যাখ্যান মিলে অলক্ষ্যে গড়ে উঠছিল সহযাত্রা। কেন-না দুলুক্ষ্যাপার হৃদয়ে এবং দৈহিক রূপরেখায়, অস্থি-মজ্জা-ত্বক-শিরা-উপশিরায় জেগে উঠছিল অনির্বাণ। জেগে উঠছিল এক অগ্নিময়, যা ধাবন ঘটিয়ে দিচ্ছিল তার চেয়েও অন্তত পঁচিশ বৎসরের ছোট মেয়েটির প্রতি। ক্রমাগত হতে থাকা অভীপ্সা! তবু, যতক্ষণ পারে, এই সবই সে প্রতিহত করছিল প্রাণপণ। বলেছিল— কুটিরবাসী আমি। থাকি বড় সাধারণ। কারণ দারিদ্রই আমার সম্বল। তার মধ্যে থাকতে আপনি পারবেন না। 

–পারব। 

বলেছিল সে। বুড়িয়া। দৃঢ়চেতা। একরোখা। 

দুলুক্ষ্যাপা বলেছিল— কেন যেতে চান আপনি? 

–জানতে।

–কী জানতে?

–বাউলের ধর্ম। 

–বাউল কোনও ধর্ম নয়। বাউল হল চর্চা। যে-কোনও ধর্মের মানুষই বাউল হতে পারে। নিজের ধর্ম বজায় রেখেই পারে। 

–আমি চাই সেই চর্চা। 

–কেন? 

–জানতে চাই কী পাওয়া যায় ওই চর্চার মধ্যে? কোন আনন্দ? 

— আনন্দ যে পেতে চায়, আনন্দ ধরা দেয় তারই কাছে। তাকে জানা যায় না। অনুভব করা যায়। উপলব্ধি করা যায়। 

— আমি আনন্দ ধরতে পারি। কিন্তু বাউলচর্চার মধ্যে দিয়ে তা ধরতে চাই। 

–বাউল নিয়ে বহু গ্রন্থ লিখা হয়েছে। আপনি লিখাপড়া জানা মানুষ, আপনি পাঠ করুন।

–বাউলতত্ত্ব আমি পড়িনি কে বলল? 

–তা হলে তো সবই আপনার জানা। সবই তো হল। 

–না। হল না। আমি শুধু কেতাবি জানা চাই না। আমি চাই সাধনমাধ্যমে বুঝতে। 

–এ বড় কঠিন সাধনা বুড়িয়া। একে সহজ ভাবা ঠিক নয়। 

–সহজ হলে, সহজ ভাবলে আমি কেন আপনার কাছে আসতাম ক্ষ্যাপা? আমি নারায়ণমূর্তির সঙ্গে বাউলচর্চা করতাম। শোভনের সঙ্গে করতাম। প্রেমাংশু, অভিজিৎ, অংশুমানের সঙ্গে করতাম। 

–যদি না পারেন শেষ পর্যন্ত, চারচন্দ্রচর্চা নগর-সংস্কার ভেঙে গ্রহণ করা সহজ নয়।

–আপনি কী করে পারলেন? 

–আমি? আমার প্রশ্ন ওঠে কেন? 

–আপনি নগরবাসী ছিলেন না? শিক্ষিত নন আপনি? 

–এসব কথা… আপনি…. 

–আমি কী করে জানলাম? কেন যতীনক্ষ্যাপার কাছে। লীলাদির কাছে শুনেছি। শুনেছি আরও। ক্ষ্যাপা, আমার লজ্জাবস্তু নেই। লজ্জা জয় করেছি আমি। তাই স্পষ্ট বলি, আপনার সঙ্গিনী নেই জানি বলেই আমি এসেছি। আমাকে সঙ্গে নিন। 

–পূর্বজীবন আমি ভুলে গিয়েছি বুড়িয়া। আমি তার স্মরণ চাই না। 

–আর স্মরণ করাব না। করাতে চাইনি আমি। আপনি বললেন নাগরিক সংস্কারের কথা, তাই। 

–আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমাকেই কেন নির্বাচন করলেন! এখানে এত বাউল, সাধন তো আপনার এঁদের কারও সঙ্গেই হতে পারত! 

–আপনি কি মনে করেন, চাইলেই যে কারওকে সাধনসঙ্গী মানা যায়? মনের কোনও দাবি নেই। 

–আছে। মনের দাবি আছে। 

–আপনাকে দেখামাত্র আমি চিনেছি, আপনিই সে। 

–প্রথম দর্শনেই চিনে নেওয়া কঠিন। 

–আমি কঠিনকে সহজ করে নিতে জানি। সেই শক্তি আমার আছে। 

–আপনার বয়স অল্প। 

–আমি জানি। কিন্তু আমি প্ৰাপ্তবয়স্ক।

–ওই জীবন আপনি যদি মেনে নিতে না পারেন! 

–ফিরে আসব। আমি স্বাধীন। আমি আপনার সঙ্গে গেলেই আপনার অধীন হয়ে উঠব কি? 

–না। বাউল নারীকে অধিকার করে না। নারীর শক্তি তার কাছে পূজ্য। নারী তার কাছে স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি। 

— আর কী রইল তা হলে? 

–রইল আপনার ভবিষ্যৎ। আপনি কী পড়েন জানি না আমি। তবে… 

–আমি চিত্রকলা বিষয়ে পড়াশোনা করি। উচ্চতম বিভাগের ছাত্রী। কিন্তু ক্লাসে যাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমি মনে করি, ওখান থেকে আমার আর কিছুই শেখার নেই। এবার আমার নিজের চর্চা। তা ছাড়া, আমি জানি না, আমি শেষ পর্যন্ত কী চাই। নৃত্য, না সংগীত, নাকি চিত্রকলা! নারায়ণমূর্তি বলে, নাচই আমার করা উচিত ছিল। আমি যখন নাচি, তখন মনে হয় সংগীতই আমার পথ। যখন গাই তখন মনে হয় ছবি, ছবির প্রতিই আমার সর্বাধিক টান। আমাকে বুঝতে হবে। শেষ পর্যন্ত কী চাই আমি। হয়তো, এই পরিচিত জগৎ ছেড়ে, অন্য এক জীবন, অন্য এক চর্চার মধ্যে দিয়ে আমি পেয়ে যাব আমার ইচ্ছার সন্ধান। 

–কিন্তু, ধরুন, আপনার আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাঁদের মতামত আছে। তাঁরা পুলিশে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন। বলতে পারেন আমি আপনাকে জোর করে নিয়ে গেছি। 

— আমি যে নিজেই আপনার সঙ্গে যেতে চাই, সে-কথা লিখে দেব কি কাগজে? 

–না না। তার দরকার নেই। 

–আমার জন্য কেউ কোথাও অভিযোগ করবে না। আমি তো প্রাপ্তবয়স্ক। তা ছাড়া আমি স্বাধীন। শিল্পীমাত্রই চিত্তে স্বাধীন। 

–চিত্তে স্বাধীন। কিন্তু সমাজে? প্রত্যেক মানুষেরই সংশ্লিষ্ট সমাজ তাকে অধিকার করে রাখে। 

–আমি কোনও সমাজের অধীনস্থ নই। আমি একা। যে-সমাজকে আমি স্বীকার করব, তারই অস্তিত্ব থাকবে আমার কাছে। 

যতীন শুনে বলেছিল— এ বরং ভালই হল। তোমার সাধন হবে এবার। 

সে কিছু বিমর্ষ ছিল, কিছু দ্বিধ, বলেছিল— এ-কোন নতুন মায়ায় জড়াতে চললাম! আমার ভয় এখনও কাটেনি যতীন। ছেড়ে যাবার বেদনা আবারও কি সইতে পারব আমি, এই বয়সে? 

— এ তো ঠিক কথা হল না দুলেন্দ্র। এই বয়সে আবার নতুন করে ধরতে চাও কাকে? এ জগতে কিছুই কি ধরে রাখা যায়? জানো না! কম বয়সে মনে আঁকশি ভরা থাকে। মন যাকে পায়, তাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। কিন্তু এই বয়সে, যাকে ধরবে তাকে ছেড়ে দিয়েই ধরবে। অচিন পাখি পিঞ্জরে ধরে রাখলে আর আনন্দ কী! সে যদি আপনি ধরা না দেয়, তা হলে তাকে চেনা যায় না। 

–সে কী করে থাকবে ওখানে বলো? 

–কোন মানুষ কী পারে, কে বলবে দুলেন্দ্র? 

–গুরুকে বলি একবার? 

–তা বলো। 

সে গিয়েছিল গুরুর কাছে। বলেছিল সব। অজয় নদের ধারে, মহম্মদ সাঁইয়ের আখড়ায় গিয়ে নিবেদন করেছিল। 

.

মহম্মদ সাঁই বার্ধক্যে নত, তবু দীপ্যমান। বহুদিন পর তার সঙ্গে দেখা হল দুলুক্ষ্যাপার। তিনি সকল শিষ্যের খোঁজখবর নিলেন। গণি মিঞার অসুস্থতার সংবাদ তাঁকে শোকাতুর করল। তিনি বললেন— ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। নিয়ে যাও। দিয়ো তাকে। আর শোনো, নিত্য মাটি দাও। তার নিজেরই মাটি দাও কনিষ্ঠাঙ্গুলির করাগ্র পরিমাণ। সে কি এইগুলি গ্রহণ করছিল না? একটি কদলীর সঙ্গে মাটি মিশিয়ে তাকে দেবে। আমি ছ’মাস পরে যাব। তুমি দীক্ষিত। চর্চাপদ্ধতি জানো। সে যখন আপনি এসেছে, তাকে নাও। দেখো সে কেমন আধার। যদি সে দীক্ষায় আগ্রহী থাকে, আমি যাব ছ’মাস পর। তখন দীক্ষা দেব। তুমি তাকে সকল পদ্ধতি অবহিত করাবে। দীক্ষা-পদ্ধতি অবহিত করাবে। 

ছ’মাসের তিনমাস পেরিয়েছে। আরও তিনমাস পর, জ্যৈষ্ঠে আসবেন গুরু। জ্যৈষ্ঠেই ভাল। কারণ আষাঢ়ে বর্ষা নামলে তেকোনার পথঘাট অগম্য হবে। 

গুরুর দেওয়া ওষুধগুলি গণি মিঞাকে খাওয়াচ্ছে এখন জাহিরা। গুরু মহম্মদ সাঁই বলেছিলেন— সে কি মূলবস্তু অপচয় করেছে? ধরে রাখেনি? সময়মতো স্নানখাওয়া করেনি? 

সে কী বলবে? গণি মিঞা মূলবস্তুর অপচয় ঘটিয়েছে কি না তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে খণ্ডিত মূলবস্তুই দেহে আনে জরা, ব্যাধি ও ক্ষয়। তাই মূলবস্তু নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করাই বাউলের সাধনা। তবে মূলবস্তু নির্গমন সম্পূর্ণ বন্ধ করা অসম্ভব বলে মাসে একবার মাত্র পুরুষ ও নারী পরস্পরের মূলবস্তু গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এ বড় কঠিন কাজ। বড় কঠিন। সেই কঠিনের মধ্যে দিয়ে এখন গমন করছে বুড়িয়া নামের মেয়েটিকে নিয়ে দুলুক্ষ্যাপা। সে কী করবে? বাউল সাধন গুরুর সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। সে তার শিষ্যত্বগ্রহণের আদিপর্বে, শিখেছিল সাধন, শিখেছিল বজোলি মুদ্রা। কিন্তু সে জানে, যতক্ষণ বুড়িয়া দীক্ষিত হয়ে উঠবে না, ততক্ষণ সম্পূর্ণ হবে না সাধন। সে যতই বলুক, অতীত জীবনচর্চা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়া সহজ নয়। গুরুর অনুমতিক্রমে সে এই মেয়েটিকে গুহ্য সাধনার বিষয়গুলি জানিয়ে দিচ্ছে। এ এক ব্যতিক্রম। গুরু কি শর্বরীর পরিণতি মনে রেখেই এ ব্যবস্থা নিলেন? সে আজও রত আছে অহং বিলোপের সাধনায়। কিন্তু এই মেয়েটি কি পারবে? শুধু তো কিছু মুদ্রা নয়, শুধু কিছু সাধনরীতি নয়, বাউলকে হতে হবে গুরুর অহং-বিবর্জিত দাসানুদাস। কারণ গুরু শিষ্যকে দেন গুপ্ত জ্ঞান। গুপ্ত জ্ঞান মানুষকে দেয় অধিক্ষমতা। 

এই তিনমাসে, একত্র শয়ন করলেও তারা সঙ্গম করেনি। আলিঙ্গনও করেনি কারণ সম্ভবত প্রেমের আকুল আকর্ষণ তারা অদ্যাবধি বোধ করেনি পরস্পরের প্রতি। কিংবা, দুলুক্ষ্যাপার হৃদয়ে যে তীব্র আকর্ষণের সঞ্চার, তা এখনও বিস্ময়বোধ দ্বারা আচ্ছন্ন। তার জন্য বরাদ্দ ক্ষুদ্র ঘরখানিতে, এক নির্মোহ শয্যায় সে যে শয়ন করেছে সহজেই, এও এক বিস্ময় দুলুক্ষ্যাপার। এবং একই শয্যায় পার্শ্বে নারীকে নিয়ে শয়ন করার মধ্যে যে বুভুক্ষা রচিত হয়, নারীর মধ্যেও রচিত হয় যে-ইচ্ছা, তাকে সংযত করার শক্তি দুলুক্ষ্যাপার যেমন আছে, আছে তারও। ওই ক্ষুদ্র মেয়েটির! এবং সে এই পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে সহজেই। তাকে দেখে মনে হয়, সে ছিল এখানেই বরাবর, জন্মাবধি। সংসারের কাজে সে হাত লাগায়নি তাই বলে। সে, ওই ছোট ঘরটিতে ছড়িয়ে নিয়েছে আঁকার সরঞ্জাম। সেইসব আনতে ঘোড়ার গাড়ি নিতে হয়েছিল দুলুক্ষ্যাপাকে। তবে সালোয়ার-কামিজ ত্যাগ করে শাড়ি পরেছে সে। এবং দর্শনে স্বাতন্ত্র্য নেই বলে তাকে বেমানান লাগছে না, যদিও জাহিরা ও পারুলবালার সঙ্গে তার পার্থক্য পরিষ্কার। এই পার্থক্য কি চলে যাবে? যায় কখনও? সে জানে না। সে এক বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে বসে আছে এখন। আগুনে পলাশ তার হৃদয়ে মাতন লাগিয়েছে। আজ, আজই তাদের প্রথম রাত্রি। সহযাত্রার তিনমাস অতিক্রম করে আজ সে, ওই বুড়িয়া নামের মেয়ে রজঃস্বলা হয়েছে। 

আখড়ার নিজস্ব তিনবিঘে জমিতে চাষ করেছে জসিম বাউল ও পারুলবালা। মাগনে যায় না তারা। আবাদ করে বরং। গণিমিঞা যখন সুস্থ ছিল, মাঝে মাঝে মাগনে যেত, মাঝে মাঝে সাহায্য করত জসিম বাউলকে। দুলুক্ষ্যাপা আবাদ শিখল না আজও। তার পক্ষে বরং সহজ হয়েছে গান গেয়ে ভিক্ষে করে ফেরা। লোক দেখে সে। জীবন দেখে। ভ্রাম্যমাণ সময় তাকে দেয় কিছু নির্লিপ্ততা। কেন-না বাউল, নির্লিপ্ত থাকা ধর্ম তার। ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ারহিত হয়ে যাওয়া তার সাধনা। যা ঘটে তা ঘটে, তার জন্য বিকারগ্রস্ত হওয়া বাতুলতা। এই নির্বিকার ভাব আপন শক্তিতে জন্মে, কিন্তু তাকে অভ্যাস করতে হয়। দুলুক্ষ্যাপাও অভ্যাস করে। কিন্তু সফল যে হয়নি সে, তার প্রমাণ সে পেয়ে যাচ্ছে ইদানীং। 

এখন সে ভাবছে, নতুন করে আবাদ অভ্যাস করবে কি না। সে আর মাগনে যেতে চায় না। সে বরং থেকে যেতে চায় বুড়িয়ার সান্নিধ্যে। যদিও বুড়িয়া নিজেই গান গেয়ে ভিক্ষে করতে চায়। ভিক্ষার অভিজ্ঞতা সে অর্জন করবে বলে একদিন বেরিয়েছিল দুলুক্ষ্যাপার সঙ্গে। কাঁধে ঝুলি নিয়েছে, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। নানারঙের কাপড়ের টুকরো তাপ্পি দেওয়া ঝোলায় কিছু শুকনো মুড়ি, পরনের শাড়ি একখান, কোথায় কখন থাকতে হয়! কলকাতাগামী ট্রেনে তারা উঠে পড়ল। সুরঋদ্ধ জাদুকণ্ঠে দুলুক্ষ্যাপা গায়, সুরেলা কণ্ঠ ছড়িয়ে বুড়িয়াও গায়। দ্বৈত সুললিত সঙ্গীতের অধিকারীদের লোকে ফিরে ফিরে দেখে। পয়সা দেয়। বুড়িয়া হাসিমুখে আঁচল পেতে দেয়। এমনি করেই ট্রেনের কামরায় বুড়িয়ার চেনা একজন। সে উৎসাহে আনন্দে দিশেহারা। চেঁচিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল— বুবুলদিদি, তুমি! কী আনন্দ যে হচ্ছে… 

মেয়েটি এক ঝটকায় সরিয়ে দিল তাকে। চিৎকার করল— আমি তোমাকে চিনি না…! চলে যাও, চলে যাও! 

বুড়িয়া হতভম্ব! বলছে— বুবুলদিদি, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমাকে? 

এরপর খিলখিল হেসেছিল সে। হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। বলেছিল— বুঝেছি বুবুলদিদি। আমি বাউল হয়ে ভিক্ষে করছি তো তাই চেনা দিচ্ছ না। 

দু’ হাত তুলে নাচ ধরেছিল সে। গেয়েছিল—

আমার গায়ে ছ্যাঁকা লেগেছে 
আমার পোড়া মন আর পোড়ে না 
আগুন নিভে যায় 
ছাইয়ে কি লাগে আগুন 
ও পোড়া মন বলো না! 
তাই সকল ছ্যাঁকা লেগে গায়ে
সকল ছ্যাঁকা গায়ে লেগে 
ফোস্কা পড়েছে। 

দুলুক্ষ্যাপা দোতারা সঙ্গত করে তার গীতকে সঙ্গীত করেছিল। নিজে গায়নি। ওই গান তার জানা ছিল না। পরে যখন জিগ্যেস করেছিল— ওই গানের রচক কোন ওস্তাদ! 

বুড়িয়া রহস্যভরে হেসেছিল। বলেছিল— জানতে চান সত্যি? 

–চাই। 

— ওস্তাদের নাম শ্রীমতী বুড়িয়া দাসি। 

— আপনি! 

— তক্ষুনি বাঁধলাম। বুবুলদিদি আর আমি রাত জেগে কথা কয়েছি গো। জড়িয়ে ঘুমিয়েছি। চিনতে পারল না, তাই ছ্যাঁকা লাগল বড়। 

দুলুক্ষ্যাপা আপন মনে হেসে ওঠে। তার মন সহসা ব্যাকুল হয়ে যায় বুড়িয়া নামের মেয়েটির জন্য। হৃদয় স্নেহার্দ্র হয়ে ওঠে। মনে মনে আলিঙ্গন করে সে বুড়িয়াকে। বলে— ক্ষেপি! পাগলি! বুড়িয়ার মাথায় কোঁকড়ানো চুলগুলি ঘন নয়। টেনে চুল বাঁধলে তার সিঁথির দু’ পাশের চুলের তলায় দেখা যায় খুলিত্বক। চওড়া কপালে নেমে আসা কুচো চুলে তবু ঠোঁট রাখে দুলু বাউল। তার মন আনন্দে কানায় কানায় ভরে ওঠে। কতদিন পর আজ সে নারীসঙ্গ করবে! 

.

এবং হঠাৎ তার মন বিষাদে ভরে যায়! ময়না বৈষ্ণবী বিনা অন্য নারীতে গমনের এই অভিপ্রায় বুঝি-বা তাকে ভ্রষ্ট করেছে! কেন এমন মনে হয়? কেন? তারা তো কথা দেয়নি পরস্পরকে! কোনও অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়নি! 

দুলুক্ষ্যাপা টের পায়, আসলে, ভালবাসার মানুষের জন্য সৎ থাকতে ইচ্ছে করে মানুষের। তোমাকে ছেড়ে যাব না কখনও—এমন অঙ্গীকার, তোমাকে ছাড়া আর কারওকে ভালবাসব না—এমন প্রতিজ্ঞা, প্রেম স্বয়ং করিয়ে নেয়। সে তারই অভীপ্সা! 

কিন্তু দুলুক্ষ্যাপা কী করে? ময়না বৈষ্ণবী তাকে ধরেনি, কিন্তু ছেড়ে গেছে। না। সে ভাবে। ময়না বৈষ্ণবী তাকে ধরে আছে আত্মার ভিতর। 

তা হলে? 

জীবন শোকসাগরে ভেসে চলেছে। তাকে ভোলা চাই। সে ফুলে ফুলে ভরা পলাশের দিকে দেখে। এই ফুল আপনি ফুটেছে। আজ ফুটেছে। কাল আর থাকতে না-ও পারে। বুড়িয়া তার কাছে আপনি এসেছে। কাল আর থাকতে না-ও পারে। আরও কত নারী তার সান্নিধ্য কামনা করে, আর সে এক সুন্দর পুরুষ, করে প্রত্যাখান। কিন্তু বুড়িয়াকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করতে সে পারেনি। কেন পারল না? কারণ হয়তো সে কালক্রমে বুঝবে। এখন সে গ্রহণ করবে। 

এ-পর্যন্ত সে বুড়িয়াকে কেবল রসপানের অভ্যাস করিয়েছে। তার নিজের রসই সে পান করে কেবল। রসপানে দেহ শুদ্ধ হয়। রোগভোগ কমে। মন শান্ত হয়। দেহরসের দুর্গন্ধ কমে যায়। কিন্তু রসপানের অভ্যাস করানো সহজ হয়নি। প্রথম প্রথম বমন করে ফেলত সে। কড়োয়া শুদ্ধ করে রাখা রস ফেলে দিত ঘৃণায়। এখন শুধু রাত্রির রস পান করে। তারা দু’জন একই জায়গায় মুত্রত্যাগ করে এখন। এমন জায়গা, যেখানে বৃষ্টির জল পড়বে না। আচরণের জল যাবে না। ক্রমে সেই স্থানের মাটি হয়ে উঠবে পবিত্র। গুরুদেব তা দিয়ে ওষুধ প্রস্তুত করবেন। 

আজ সে সঙ্গমে রত হবে, অতএব গুরুধ্যান করার জন্য সে প্রস্তুত হয়। মনে মনে স্মরণ করে গুরুদেহের মস্তকাকৃতি, ঘাড়, বাহু, মুখ, পায়ের গড়ন এবং পেট, বুক, চোখ ও পায়ের পাতা। এ দেহ গুরুরই দেহ— এমন ভাব আনার চেষ্টা করে মনে। আজ সে, প্রকৃত বাউলের মতোই, গুরুর ভাবমূর্তি আপন ব্যক্তিত্বে প্রবেশ করিয়ে সাধন করবে। 

বুড়িয়া তার সঙ্গে আসায় বড় করুণ হয়ে গেছে জাহিরার মুখ। যদিও সে নিজেকে লুকোতে চেয়েছিল প্রাণপণ। বলেছিল— তা ভাল। শেষ পর্যন্ত সাধিকা জুটল তোমার। 

ঈর্ষা নেই কি তার মধ্যে? জ্বলন নেই? দুলুক্ষ্যাপা বুঝতে পারে না। হতে পারে, নারীসঙ্গ সম্পূর্ণ হয়নি বলে আজও নারীকে সে বুঝতে পারে না। বুড়িয়ার মুখ, তার কোমল তনু, তার ক্ষীণ স্তনগুলি চোখে ভাসে তার। এবং ভীতও হয় সে। এই আকুলতা তার, সে স্খলিত হবে না তো? ভ্রষ্ট হবে না তো সাধনে? ভুলে যাবে না তো বজ্রোলি মুদ্রা? সে দৃঢ়চিত্ত হওয়ার চেষ্টা করে। সংকল্প করে, এবারে গুরু এলে সে মাটি সাধনা করার বাসনা প্রকাশ করবে। মাটি সাধনা কঠিন। এমনকী মাটি গ্রহণও সহজ নয়। গুরুর আদেশ জেনেও, গুরুর আদেশ অমান্য করা যায় না জেনেও গণিমিঞা প্রথমে মাটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে জোর করা হয়েছে। তার মল সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিয়েছে জাহিরাই। এবং কলায় পুরে খাওয়াচ্ছে প্রত্যহ। 

.

সন্ধে হল। ন’টার মধ্যে গভীর রাত্রি নামল তেকোনা গ্রামে। ক্ষুদ্র ঘরখানিতে মুখোমুখি দাঁড়াল মধ্য পঁয়তাল্লিশের দুলুক্ষ্যাপা ও একুশবর্ষীয়া বুড়িয়া। এই প্রথম পরস্পরকে আলিঙ্গন করল তারা। বুড়িয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল— আপনি কী সুন্দর! 

লন্ঠনের আলোয় সামান্য কাঁপছিল ছায়াগুলি। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল শ্লেষ্মাজড়িত কাশির শব্দ। দুলুক্ষ্যাপা দু’হাতে বুড়িয়ার মুখ ধরে বলল— সুন্দর। আপনি ও 

বুড়িয়াকে নির্বস্ত্র করতে থাকল সে। বুড়িয়া নিজের মুখ ঢাকল না। অঙ্গ ঢাকল না। লজ্জার জড়িমা তাকে ঘিরল না এতটুকু। যেন এ তার রোজকার কাজ— এমনই সহজ সে। এই গ্রামে, এই আখড়ায়, বড় বেমানানভাবে নিম্নতটে অন্তর্বাস পরিহিতা সে। অন্তর্বাসের মধ্যে রজঃশোষক বিজ্ঞানসম্মত তুলাপিণ্ড। দুলুক্ষ্যাপা থমকাল। বুড়িয়া অপেক্ষা করছিল। তার ক্ষীণ স্তন। সরু দেহ। চোখ দুটি ছাড়া আর সমস্তই সাধারণের চেয়েও সাধারণ। দুলুক্ষ্যাপা এখনও তার স্তনপীড়ন করেনি। সে অন্তর্বাসের মধ্যেকার তুলাপিণ্ড দেখতে দেখতে সরিয়ে রাখল সযত্নে। তুলাপিণ্ডে লালের ছোপ। বুড়িয়াকে শুইয়ে যোনিতে প্রণাম রাখল সে। তারপর বলল—এই তুলাপিণ্ড আমার। এ আমি রক্ষা করব। 

বুড়িয়া জিগ্যেস করল – কেন? 

–কুমারীর রজঃ পবিত্র। গুরুকে দান করব এ তুলাপিণ্ড। 

–আমি কুমারী নই। 

–কী! 

–আমি কুমারী না হলে কি আপনি আমাকে গ্রহণ করবেন না? আপনি কি অদ্যাবধি ব্রহ্মচারী? 

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল দুলুক্ষ্যাপা। তারপর বলল—না। আমি কুমার নই। আপনি কুমারী না হলেও আপনাকে গ্রহণ করলাম আমি। 

নিজেকে মুক্ত করল সে। এবং বুড়িয়ার মধ্যে গমন করল ধীরে। এতকালের ক্ষুধাতাড়িত চিত্ত ও দেহে সে এখন গুরুর অংশ মাত্র। চোখ বন্ধ করে গুরুদেহের কল্পনার মধ্যে সে নিজেকে সংযত রাখতে চাইল। রজঃকালে সে নারীশরীরের ভিতরে শুক্রবীজ প্রবেশ করাতে পারে। উভয়ের মূলবস্তু বড় পবিত্র। তবু, সে আত্মহারা হতে চায় না। প্রায় কুড়ি বৎসর পর নারীসঙ্গ করতে গিয়ে কাঙালপনা করতে চায় না। এতকাল আপন মূলবস্তু সে আপনার মুখে সংগ্রহ করেছে। তার জন্য বিশেষ অভ্যাস প্রয়োজন। মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বাকিয়ে মুখবিবর লিঙ্গাগ্রভাগে এনে শোষণ করা সহজ ছিল না। সেই কঠিনকে সে আয়ত্ত করেছিল। এখন যোনিপথের তারল্য এবং উষ্ণতা, নরম কামড় তাকে মুহূর্তে স্খলিত করে দিতে চাইছে। গুরুদেহের পরিবর্তে চোখের পাতায় এসে দাঁড়াচ্ছে বুড়িয়ার নগ্নতা। সে গমন করছে। বুড়িয়া শব্দ করছে। সে যুদ্ধ করছে। বুড়িয়া শব্দ করছে। সে নয়, সে নয়। গুরুই করছেন এ সাধন, এমন ভাবনার মধ্যে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে করতে সে অবশেষে সকল সংযম ভেঙে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছে শুক্রবস্তুর তীব্র নির্গম। সে আঁকড়ে ধরছে বুড়িয়ার দেহ। এবং শিথিল হয়ে যাচ্ছে তার লিঙ্গ। বুড়িয়া দুই জানু দিয়ে আঘাত করছে তার শরীরকে। বলছে— কী করছেন! কী করলেন? 

হাহাকার উঠে আসছে সেই স্বরে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *