৩৭
বন্দো মাতা সুরধুনী পুরাণে মহিমা শুনি
পতিত পাবনী পুরাতনী
বিষ্ণুপদ উপাদান দ্রবময়ী তব নাম
সুরাসুর নরের জননী।
.
পরিতৃপ্ত নারদ। গর্বিত। দেবমধ্যে মহেশ্বর ব্যতীত তাঁর তুল্য সংগীতজ্ঞ আর কে?
যুগের পর যুগ ধরে, কালের পর কাল সিদ্ধ করে, বীণা সাধন করেছেন তিনি। সুর সাধন করেছেন। ত্রিভুবনে তাঁকে জানে না কে? সত্য এই, তাঁর ও মহেশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব কোনও কালে নির্ণয় হল না। এ কথা স্মরণ করে নারদ বক্রিম হাসেন। প্রতিযোগিতা হলে তার ফল কী, নারদ জানেন। কেবল দেব এবং ঋষির অবস্থান পার্থক্যই এই ঘটনা গড়ে উঠতে দেবে না।
বুকের গভীরে, অন্তরালে, এক তীব্র জ্বলন লুক্কায়িত। শিল্পীমাত্রেরই যে থাকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পাবার বাসনা!
প্রতিদিন তিনি গেয়ে চলেন একটি করে রাগ। ভৈরব, ভৈরবী, কাফি, খাম্বাজ, পূর্বী, মারোয়া, জয়জয়ন্তী। আপন স্বরে আপনি মাতোয়ারা। তালবোধে মোহিত। আপন সংগীতে আপনি পুলকিত।
তাঁর স্বরে জেগে উঠছিল এক-একটি রাগ, মেতে উঠছিল রাগিণী। আকাশ জুড়ে, মহাকাশ জুড়ে, তাদের কী অপরূপ বিভঙ্গ! কী মহান সৌন্দর্য তাদের। তারা জাগল আর আলো ফুটল। তারা নাচল আর হেসে উঠল ফুলেরা। তারা দোলাল অপূর্ব ছন্দে ছন্দে দেহের তটরেখা আর পাখিরা শিস দিল সূর্যের দিকে তাকিয়ে। এত সব রাগ-রাগিণী, ছয় রাগ আর ছত্রিশ রাগিণী, তারা পূর্ণ হতে হতে, সুন্দরতর হতে হতে, হায়, আর্তনাদ করে উঠল হঠাৎ। বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে লাগল তারা। এ কী হল! এ কী হল! ত্রিভুবনে নিজেকে যিনি শ্রেষ্ঠ মনে করেন, সেই সুরশিল্পীর এ কী স্খলন-পতন-ত্রুটি! বহু ত্রুটিযুক্ত সেই সংগীতগুলি বিকলাঙ্গ করে দিল রাগরাগিণীদের। নারদের গমনপথে সারে সারে দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে লাগল তারা। নারদ সেই বিলাপধ্বনির দিকে অগ্রসর হয়ে দেখলেন অপূর্ব মুখশ্রী, সুদেহী দেবনিন্দিত নারী ও পুরুষ সারে সারে দণ্ডায়মান। কিন্তু কারও হস্ত বিকল, কারও পদ সরু ও অশক্ত, কারও গলগণ্ডযুক্ত কণ্ঠদেশ, কারও দেহ চর্মরোগে আবৃত। যেন চিরসুন্দরের উপর নেমে এসেছে কুৎসিত ও কদাকারের অভিশাপ। এমত দৃশ্যে তাঁর আতঙ্ক উপস্থিত হল। তিনি প্রশ্ন করলেন— কে তোমরা?
তারা কথা না বলে বিলাপ করে যেতে লাগল- হা ঈশ্বর! হা ঈশ্বর! অহো, কী যন্ত্রণা! কী বেদনা!
নারদ পুনরায় প্রশ্ন করলেন— কে তোমরা? তোমাদিগের এমতাবস্থা কে করিল?
নর-নারীবেশী রাগরাগিণীর দল, কেউ বিকল অঙ্গ নাড়তে নাড়তে, কেউ ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে, কেউ উন্মত্ত চিৎকার করে বলল— আমরা রাগরাগিণীর দল।
–রাগরাগিণী?
–হ্যাঁ।
–হে চিত্তমন্থনকারী রাগিণীগণ, হে হৃদয় উদ্বেলকারী রাগগণ! তোমাদিগের এই অবস্থা কে করিয়াছে?
—এক পাষণ্ড, এক অক্ষম, দাম্ভিক, আত্মগর্বী, ঈর্ষাকাতর শিল্পীর এই কীর্তি!
–কে তিনি? এইরূপ নিন্দনীয় শিল্পীর অপযশ এবং অবস্থান ত্রিভুবনে স্থাপিত হইলে সংগীত ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবেক!
–ধ্বংসের সূচনা হইয়াছে মুনিবর। আমাদিগে দেখুন। আমরা গলিত, বিকলাঙ্গ, রোগগ্রস্ত। এই প্রহরে মরিব!
–ধিক, ধিক্ সেই শিল্পীকে যিনি দম্ভ ও ঈর্ষার শিকার। ধিক্ তাঁহাকে যিনি শিল্পী হইয়াও শিল্পের ধ্বংস আহ্বান করেন। হে রাগরাগিণীগণ, সেই পামরের নাম আমার নিকট জ্ঞাপন করো। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তাহার যথাবিধি প্রতিকার করিয়া তোমাদিগে সুস্থাঙ্গী এবং অবিকার পুনঃপ্রদান করিব!
রাগরাগিণীগণ বললেন – নারদ নামে একজন ঋষি আছেন। তিনি।
নারদ আতঙ্কিত হলেন। কিন্তু মনোভাব গোপন রেখে বললেন— নারদ? তিনি কীরূপে এমত দুষ্কর্ম করিলেন?
–তিনি ধারণা করেন, দেবমধ্যে মহেশ্বর ব্যতীত তাঁহার তুল্য সংগীতজ্ঞ নাই।
–হে প্রিয়গণ, হে কল্যাণিগণ, আমি শ্রবণ করিয়াছি তাহা সত্য। এ বিষয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন হয় নাই অদ্যাবধি কে শ্রেষ্ঠ! নারদ, নাকি মহেশ্বর! শ্রুতি আছে— নারদই শ্রেষ্ঠতর প্রমাণিত হইবেন।
— না। তাহা সত্য নহে। তিনি সংগীতের কিছুই জানেন না। তাঁহার ত্রুটিপূর্ণ সংগীতের প্রহারে আমরা বিকলাঙ্গ হইয়া পড়িয়া আছি। হা ঈশ্বর! হা ঈশ্বর! এ বিকটাঙ্গ লইয়া আমরা কী করিব? আমরা শীঘ্র মরিব।
নারদ বললেন— রাগরাগিণীগণ শ্রবণ করো। তোমাদিগের বিলাপে আমার মনোযন্ত্রণা উপস্থিত হইতেছে। কী করিলে তোমরা পূর্বের ন্যায় সুস্থ হইবে তাহা বলো।
রাগরাগিণীরা বলল— একমাত্র দেবাদিদেব যদি আমাদিগকে গীত করেন, তাহা হইলে আমরা সুস্থ হইব।
নারদ বিবশ চিত্তে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করলেন। মহাদেব সকাশে সকলই বিবৃত করলে মহাদেব ঈষৎ হাস্য করে বললেন— গীত করিব। সেই গীতের উপযুক্ত শ্রোতা কই। এই স্থানে মুনিবর আপনি এবং আমি বিনা অন্য কেহ নাই।
নারদের সকল আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হওয়ার উপক্রম হল। ইতিপূর্বে শ্রবণ করেছেন, তিনি সংগীতে পারদর্শী নন, এখন জানলেন, তিনি এমনকী সংগীতের উপযুক্ত শ্রোতাও নন। এই কি তাঁর শিক্ষার ফল? এই কি তাঁর সাধনার পরিণাম? হ্যাঁ, তিনি জানেন, সংগীত সার্থক গীত করা যেমন সুকঠিন, তেমনই শিক্ষার ও সিদ্ধির প্রয়োজন সংগীতের শ্রবণে রস সম্যক গ্রহণ করার জন্য। তবে কি তাঁর কোনও কিছুই সিদ্ধ নয়? পূর্ণ নয়? তাঁর পায়ের তলায় স্বর্গীয় বিভায় আঁধার নামল। তিনি বিনীতভাবে মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন— হে প্রভু। কে আপনার সংগীতের উপযুক্ত শ্রোতা বলুন। আমি আপনার ইচ্ছা তাঁহাদিগের নিকট নিবেদন করিব। তাঁহারা নিশ্চয়ই আপনার সংগীত শুনিতে সম্মত হইবেন।
মহাদেব বললেন— বিষ্ণু। বিষ্ণুই আমার সংগীতের উপযুক্ত শ্রোতা। তবে ব্রহ্মাকে সঙ্গে আনিতে পারেন।
নারদ শত বৎসর কঠোর তপস্যার মাধ্যমে বিষ্ণুকে প্রসন্ন করলেন। বিষ্ণু নারদের নিবেদন শ্রবণ করে বললেন— তথাস্তু! ঋষিবর। আপনি ব্রহ্মাকে সম্মত করাইলেই আমরা যাত্রা করিব। নারদ, পুনরায়, দ্বি-শত বৎসর কঠোরভাবে ব্রহ্মার তপস্যা করলেন। ব্রহ্মাও যারপরনাই তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু সমভিব্যাহারে মহাদেবের গান শুনতে যেতে সম্মত হলেন।
ব্রহ্মা ও বিষ্ণু মহেশ্বরের নিকট উপস্থিত হলে মহেশ্বর অতি বিশুদ্ধভাবে রাগরাগিণীর সংগীত করলেন। এক-একটি রাগ ধরেন এবং সম্পূর্ণ শুদ্ধতায় পরিবেশন করে আবার অপর রাগের মধ্যে প্রবেশ করেন। অনলস, নিরন্তর এই সংগীত। সহস্র সহস্র বৎসর ধরে তা গীত হতে লাগল। মহাবিশ্ব কী এক প্রেমে, কী এক আবেগে থর-থর কাঁপতে লাগল। সকল প্রাচীন সৃষ্টি, নতুন রূপে সজ্জিত হয়ে পুলক-স্বেদে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সংগীতের মহিমায় সকল বিকলাঙ্গ রাগ-রাগিণী সুস্থ দেহে সেখানে উপস্থিত হল। মহাদেব যে রাগ-রাগিণী সংগীত করলেন তার কিছুই ব্রহ্মা উপলব্ধি করতে পারলেন না। তবে মহাদেবের সুকণ্ঠ তাঁকে কিছু মোহিত করল বটে। সুকণ্ঠেরও আছে এক বিমল প্রসাদ, যার দ্বারা সংগীতে অশিক্ষিত হৃদয়েও জাগে দোলা, লাগে মোচড়। আর যার আছে শ্রুতি ও রসগ্রহণের শিক্ষা ও সাধনা, তার তুলনীয় সুখী কে? ব্রহ্মার সকল সংগীত উপলব্ধ হল না। কিন্তু বিষ্ণুর গভীর উপলব্ধি আনন্দে পরিণত হল। আনন্দের আতিশয্যে তিনি দ্রবীভূত হলেন। বিষ্ণুর দ্রবণ বহে যায় দেখে ব্রহ্মা দ্রবীভূত তরল বিষ্ণুকে আপন কমণ্ডলুতে ধারণ করলেন। সেই কমণ্ডলু-স্থিত দ্রবীভূত বিষ্ণুই গঙ্গা।
পাপাপহারি দুরিতারি তরঙ্গধারি
শৈলপ্রচারি গিরিরাজগুহাবিদারি।
ঝঙ্কারকারি হরিপাদরজোবিহারি
গাঙ্গ্যং পুনাতু সততং শুভকারিবারি ॥
—পাপনাশক, দুষ্কর্ম প্রতিষেধক, তরঙ্গায়িত, পর্বতবিহারী, হিমালয়ের গুহাবিদারী, ঝঙ্কারকারী, হরপদের ধূলিতে প্রবহমাণ এবং মঙ্গলময় গঙ্গাবারি সর্বদা পবিত্র করুক।
.
গঙ্গাই একমাত্র নদী যিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল— এই তিন স্থানে প্রবাহিতা। এজন্য তিনি ত্রিপথগা নামে পরিচিতা।
গঙ্গামূর্তি মকরবাহিনী, শুক্লবর্ণা, চতুর্ভুজা। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে গঙ্গার পূজা হয়। গঙ্গাপূজার দিন গঙ্গাস্নান করলে মানুষের দশবিধ পাপ বিনষ্ট হয়, তাই গঙ্গার অপর নাম দশহরা। গঙ্গাপূজার তিথিরও নাম দশহরা
সহস্রাধিক বৎসর ধরে গঙ্গা ভারতীয় জীবনের অঙ্গ। গঙ্গার প্রভাব ধর্মের বিচারাশ্রয়ী নয়। শ্রেণির বিভাজনকেন্দ্রিক নয়। ধর্মীয় আচরণের অনেক ঊর্ধ্বে গঙ্গা ভারতীয় জনজীবনে এক বিপুল প্রভাব। মুসলমান কবি দরাফ খাঁ লিখেছিলেন গঙ্গাস্তোত্র—
পয়ো হি গাঙ্গ্যং ত্যজতামিহাঙ্গং
পুনর্ন চাঙ্গং যদি বৈতি চাঙ্গম্।
করে রথাঙ্গং শয়নে ভুজঙ্গং
যানে বিহঙ্গং চরণে চ গাঙ্গ্যম্ ॥
—জল মানে গঙ্গা, গঙ্গা! যদি তাঁরই দেহে আমার দেহের সকল মেশে, যদি তাঁরই কোলে আমার মৃত্যু হয়, তবে আর আমার পুনর্জন্ম ঘটবে না। আমি মিশে যাব বিশালে, বিরাটে। আমি মিশে যাব শ্রীহরির সত্তায়। আমিও হয়ে উঠব শ্রীহরি স্বয়ং। আঙুলে আমার চক্র থাকবে, বাসুকির ফণায় মাথা রেখে শয়ন করব আমি। বিহঙ্গযানে চেপে চলে যাব যেখানে খুশি। আমি, শ্রীহরি, আমারই চরণ থেকে বেরিয়ে আসবে নিরন্তর বহুমানা গঙ্গা!
জেলা মুর্শিদাবাদের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে পদ্মা। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা বা ভাগীরথী। লোকের কথায় পদ্মাই এখন গঙ্গা। আসলে এই দুই নদীই গঙ্গা নামে অভিহিতা। আর সারা জেলা জুড়ে গঙ্গার শাখানদী, উপনদী। যেমন ভৈরব, যেমন জলঙ্গী। আর এইসব নদ-নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে জনজীবন। গড়ে উঠেছে গ্রাম। তেকোনা। চতুষ্কোনা। মরালী। বহেরা। গোমুন্ডি। বাঘান। কলাবিবি। এবং আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে গেলে, জলঙ্গী নদী যেখানে নদীয়া আর মুর্শিদাবাদকে পৃথক করেছে সেখানে আছে মরাল, মাঝিগাঁও, রাতুলপুকুর, ওসমানদিঘি। আছে গরান, চন্দ্রকোনা, ধুলামুঠি। দরিদ্র গ্রাম সব। পথ-ঘাট নেই। কালান্তরের অন্তর্গত হওয়ায় উর্বর ভূমি নেই। শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার উপায় নেই। কেবল আছে বেঁচে থাকা। কেবল মাটি কামড়ে ভাগ্যনির্ভর হয়ে অর্ধভুক্ত বেঁচে থাকা বছরের পর বছর।