রাজপাট – ৩২

৩২ 

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!— কোনও নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?—প্রাণের আহ্লাদ 
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার! 

.

মৌসুমি অদ্যাবধি হারাধনের জীবনে এক আনন্দের দীপশলাকা হয়ে আছেন। এবং তিনিই একমাত্র আনন্দ। হারাধন সারাক্ষণ পায়ের তলায় যে শূন্যতা বোধ করে, তার নির্বাপণ একমাত্র সম্ভব হয় মৌসুমির সান্নিধ্যে এবং জ্বলে ওঠে আনন্দ। তখন এক স্বাদ পায় সে। জীবনের স্বাদ। যেন সে এক মানুষ, তার এক ঠিকানা রয়েছে। এই পৃথিবীর কোথাও এক ঠিকানা রয়েছে। ঠিকানাবিহীন সে যে, শিকড়বিহীন, এই কষ্ট তাকে ছেড়ে যায়। কিন্তু সে সাময়িক মাত্র। সে যতক্ষণ এই শহর বহরমপুরে থাকে, যতক্ষণ কাজে ডুবে থাকে, যতক্ষণ তার নাকে লাগে মৌসুমির ঘ্রাণ—ততক্ষণ। পেতনির চরে যেখানে তাদের বাসা, সেখানে সকল ভাসমান। সকল অস্তিত্ব ভাসমান। আজ যখন সে ভারত সরকারের কর্মী, তখনও, পায়ের তলায় শূন্যতা কেবল। তাদের বাসস্থান, পেতনির চরের কোনও অস্তিত্ব নেই কোথাও। 

যা চোখে দেখা যায়, তা-ই স্বীকারের যোগ্য হয় না। পেতনির চরের যে-আকার, তার ভূমির যে-পরিমাণ সবটাই ক্ষণিক। এবং এই ক্ষণকালের বয়স হল তিরিশ বৎসর। 

পয়োস্তি নয়। ভাগীরথীর বুকে জেগে ওঠা চরা মাত্র। একটি ছোট দ্বীপ হয়ে সে জেগে আছে। তাকে ঘিরে ভাগীরথী বয়ে যায় নিরন্তর। যে-কোনও সময়, খেয়াল হলেই, এই চরকে সে ডুবিয়ে ভাসিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে। সরকারিভাবে এই চরকে বাসযোগ্য ভূমি বলা হয়নি। তবু এখানে মানুষ বসত করেছে। গড়েছে আবাদ। শস্য ও ফসলের ক্ষেত। ছোট একটি গ্রাম ও সামান্য সে জমি। এ চরের লোক প্রত্যহ ভেসে যাবার আশঙ্কা নিয়ে ঘুমোতে যায়, প্রত্যহ ডুবে যাবার ভয় নিয়ে জাগে। এভাবেই চলতে চলতে আজ তিরিশ বৎসর। নদী হয়তো-বা করুণাপরবশ, আজও ভাসায়নি চর। 

কিন্তু এই চরের কোনও ঠিকানা নেই। চিঠি লিখলে সরকারি ডাকপিয়ন সেখানে পৌঁছয় না। কোনও কোনও বর্ষায় চরাচর জলে ডুবে গেলে যখন খাদ্যাভাব দেখা দেয় তখন নদীপাড়ের মূল গ্রামগুলির সামান্য সহায়তা ভরসা। কোনও সরকারি সাহায্য, ত্রাণের ব্যবস্থাপনা সেখানে যায় না। সেখানে যত মানুষ বসবাস করে, তারা সব নেই-মানুষ। আর সে, হারাধন বসাক, এক নেই-মানুষেরই সন্তান। তার বাবা, পাঁচ সন্তানের জনক, নারান মুদির বড় ছেলে। 

কী করে সে হয়ে উঠল মেধাবী এবং তার মেধাবস্তু টের পেয়ে নারান মুদি তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। প্রাথমিক স্কুলের পাঠ সে নিয়েছিল নৌকা করে নদী পেরিয়ে চতুষ্কোণা গ্রামে। সেই থেকে এক অনুগ্রহের জীবন সে ভোগ করে আসছে। দরিদ্র মুদির সন্তান সে, শিকড়বিহীন। শিক্ষকরা তাকে দয়া করেছেন। বন্ধুরা তার প্রতি সাহায্যের সম্পর্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। 

তার মেধাবস্তু টের পেয়ে নারান মুদি তাকে স্কুলে দিয়ে দেবার পর আর কোনও দায়িত্ব নিতে পারেনি। চরে একমাত্র তার ভিটে সম্বল ও ওই সামান্য দোকান। তাই দিয়ে বড় সংসারের খাওয়া-পরা চলে না। হাঁ-মুখ দারিদ্র্য সেখানে খড়ো চাল হয়ে, বাঁশের বেড়া হয়ে ঘর সংসার রচনা করেছে। কিন্তু হারাধনের তার জন্য কোনও অসুবিধে হয়নি। তার মেধাবস্তুর কারণেই সে পেয়ে গেছে খাতা বই পোশাক। পেয়েছে প্রাথমিক স্কুলের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। আর এইসব সাহায্যের মাধ্যমেই সে ওই শৈশব থেকেই পেয়ে গিয়েছে দারিদ্র্য থেকে পলায়নের পথ। এবং কিছু-বা স্বার্থপরতা। সে বুঝেছিল, ওই নারান মুদির মতো জীবন তার জন্য নয়। সে পেয়ে যাবে এক সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যতের কোথাও নারান মুদি ও তার আরও সব সন্তানের জন্মের যোগ নেই। এ বিষয়ে সে বহুবার নিজের মুখোমুখি হয়েছে এই চাকরিটি পেয়ে যাবার পরে। তার ভেতরকার বোধের জিজ্ঞাসার কাছে সে এক কুঁকড়ে যাওয়া মানুষ। 

.

তা হলে তুমি কি তোমার জন্ম অস্বীকার করতে চাও? 

না, না। তা সম্ভব নয়। 

তুমি ত্যাগ করবে তোমার মা-বাবা-ভাই-বোনের সংস্রব? 

না, ঠিক ত্যাগ নয়। তবে আমি নিজের চেষ্টায় দাঁড়াতে পেরেছি। আমার কি অধিকার নেই বলো, একটু ভালভাবে বাঁচার? আমি, শুধুমাত্র নারান মুদির বড় ছেলে বলেই কি কাঁধে নেব ওই বিপুল কর্তব্যের ভার এবং ধুঁকতে ধুঁকতে চলব সারাজীবন? 

ওই নারান মুদি তোমার বাবা। আর যে-মহিলা অর্ধাহারে কাঠি হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে আজও সংসারের মঙ্গলের কথা ভেবে উঠোনে গোবর-ছড়া দেয়, সে তোমার মা। 

শুধু জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কী কাজ ওদের বলো? 

আর কিছু নয়? স্নেহ ভালবাসা মঙ্গলকামনা কিছু নয়? 

যারা আমার কেউ নয়, কোনও রক্তের সম্পর্ক নয়, তারাও আমাকে দিয়েছিল স্নেহ, ভালবাসা, মঙ্গলকামনা। সেইসব ভালবাসা আরও অনেক বড়। সেইসব মঙ্গলকামনা আরও অনেক নির্মোহ, নিঃস্বার্থ। 

তা হলে কি ছেড়ে যাবে? ওইসব ছেড়ে যাবে? মা-বাবা-ভাই-বোন? 

না। ছেড়ে যাব কেন? দূর থেকে সাহায্য করব যতটা পারা যায়। জীবন জড়াব না।

তোমার শিকড়? সে তো জড়ানো ওখানেই। 

.

ভাবনার এই পর্বে এসে সে বিমূঢ় হয়ে যায়। তার শিকড়? কোথায় আছে? কোথায়? আসলে সে আজও এক ভাসমান শিকড়ের মানুষ। বৃক্ষ লতা গুল্ম নয়। এমনকী তৃণও নয়। সে বরং কিছুটা কচুরিপানার মতো। যেখানেই ঠেকে, ফুলে পত্রে বিস্তার রটিয়ে দেয়। কিন্তু ভেসে যায় ফের। 

সে যখন স্কুলে পড়ত, তার ঠিকানা ছিল রথীন স্যারের বাড়ি। চর থেকেই সে আসত নৌকায়। কোনওদিন, প্রয়োজন হলেই থেকে যেত বন্ধুদের বাড়ি। কোনও বাড়িতেই কোনও অসুবিধে হয়নি তার। সবখানেই সে পেয়ে গেছে অনুকম্পার চোখ— আহা! গরিবের ছেলে কষ্ট করে পড়ছে! 

এই আহা তাকে ভেলার মতো ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে এতদূর। এই আহা-ই তাকে পৌঁছে দিয়েছিল অসিত স্যারের কাছে। এবং যথারীতি মেধাবী দারিদ্র্য ও সহায়সম্বলহীনতা অসিত স্যারের হৃদয়ে স্নেহ উৎপন্ন করেছিল। তিনি বলেছিলেন—বইপত্র যে-কোনও দরকারে আমার বাড়িতে চলে এসো। 

কোনও কোনও উচ্চারণ কারও জীবনে অমোঘ নির্ধারণ করে ভবিষ্যৎ। সেদিন অসিত স্যারের ওই আহ্বানের অন্তরালেই তার জীবন বৃহৎ হয়ে ছিল। সে তা জানেনি। বোঝেনি। ভবিষ্যতের ইঙ্গিত ভবিষ্যৎ পার করলে তবেই বোঝা যায়। 

অসিত স্যারের কথাগুলো হারাধন নিয়েছিল অন্যান্য করুণাময় মানুষের সাহায্যের মতোই। সাহায্য নেবার অভ্যাসে অকুণ্ঠিত সে গিয়েছিল অসিত স্যারের বাড়ি। 

সে গিয়েছিল। আর পেয়েছিল মৌসুমিকে। অসিত স্যারের স্ত্রী মৌসুমি। সন্তান নেই তাঁদের। অতএব, সে এক সভ্য ও কাতর তরুণ, ভদ্র এবং স্নেহের অপেক্ষক, এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে চাওয়া এবং শিকড় চাড়িয়ে দিতে চাওয়া ছাত্র, মেধাবীও, সে হয়ে উঠেছিল সন্তানপ্রতিম। আজও সে সন্তানপ্রতিম। মৌসুমী তাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। অসিত স্যার এই ধারণকে প্রশ্রয় দিয়েছেন আগাগোড়া। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ দিয়েছিলেন অসিত স্যার। 

অতএব, সে কী করবে যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নারান মুদির থেকে? যদি পেতনির চর আর না টানে তাকে, সে কী করবে? সে যে সকলের অনুগ্রহে অনুগ্রহে সবাকার জন। এমনকী পেতনির চরে সে এক গর্বের বস্তু। লোকে বলে –নারানের ছেলে আমাদের গর্ব। 

সে আর কী করবে যদি তার গর্বের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে আরও এক পেতনির চর? সে সেখানেই বসবাস করবে আর নারান মুদির কাছে যাবে না। যেমন সে ওই চরে থাকাকালীনও পিছলে পিছলে গিয়েছে কেবল। সে লেখাপড়া করে বলে তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে ভরপেট এবং ভাইবোনদের কম কম দেখেও সে নিয়েছে তার ভোগ এবং শুধুই মোটা চালের সেদ্ধ বা পান্তা খেতে খেতে সে তার মনকে নিয়ে গিয়েছে পুস্তকে নিবদ্ধ, যেন-বা সে এক অশরীরী, খাদ্য ও তৎসম্পর্কিত বিষয়ে সম্পূর্ণ অনাগ্রহী। এমনকী, ওই দারিদ্র্যের মধ্যেও সে শোবে বলে ঝেড়ে পুছে রাখা শয্যা ও সে পরবে বলে ক্ষারে-কাচা পরিষ্কার পোশাক—এ-সবের কোনওটাই তাকে নারান মুদি ও তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতাভাজন করেনি বরং এই সবই এক স্বাভাবিক অধিকার এবং যদি-বা থাকে কিছু ঋণ, সে শোধ করবে এবার, করবে, এই তো চাকরি পেল আর টাকা পাঠাবে। পাঠাবে আর কী করে, নিজেই যাবে কিংবা এসে নিয়ে যাবে নারান মুদি বা তার ছেলে। এই তো চায়? এই তো? মঙ্গলকামনার ঋণের বিনিময়ে এই তো শোধ? এর বেশি আর কী প্রত্যাশা তার কাছে? 

মৌসুমি বলেছিলেন—আমাকে মা ডাকবি? 

এ হল সেই সময় যখন সে প্রায়ই যাচ্ছে অসিত স্যারের বাড়িতে। আর মৌসুমি তাকে যত্নে বেড়ে দিচ্ছেন আধফোটা জুঁইফুলের মতো ভাত। আর অসিত স্যার বলছেন—পেতনির চরে তো বিদ্যুৎ নেই। 

—না স্যার। 

—ওখান থেকে রোজ আসা-যাওয়া করে তুমি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছ? 

—মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাড়িতে থেকে যেতাম। আসা-যাওয়াও করেছি। 

—এভাবে তুমি আটষট্টি শতাংশ পেয়েছ! ভাবো মৌসুমি। হারাধন কষ্ট করেছে কীরকম।

সে মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। আর তার বুকের খাঁচায় সেঁধিয়ে আছে পুলক। সে প্রত্যাশা করছে, এখুনি, এখুনি আসবে কোনও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। সে জানে, চেনে এইসব লক্ষণ। 

তখন মৌসুমি বলছেন—এখনও আসা-যাওয়া করছ তুমি? 

সে মাথা নাড়ছে। মোচার ঘণ্ট দিয়ে মেখে নিচ্ছে ভাত। মোচার মধ্যে ছোট ছোট চিংড়ি। তার প্রিয়। অতি প্রিয় চিংড়িগুলি সে খেয়ে ফেলছে না। থালার পাশে সরিয়ে রাখছে সবার শেষে খাবে বলে। মৌসুমি, হয়তো এইসব লক্ষ করেই, তার পাতে দিচ্ছেন আরও খানিক মোচার তরকারি। সে না বলছে। লজ্জিতভাবে না বলছে। অসিত স্যার বলছেন— কাল একবার এসো তুমি। প্রাচীন ইউরোপীয় ইতিহাসের ওপর একটা ভাল বই দেব তোমাকে। এসো। 

সেদিন শনিবারের পর সে ছিল এক রবিবার। সে গিয়েছিল। অসিত স্যার বলেছিলেন— শোনো হারাধন, তুমি হস্টেলে থেকে যাও। এতে তোমার পড়া ভাল হবে। খরচ যা আমি দিয়ে দেব। কিন্তু এমনি-এমনি নয়। তুমি আমার বাজার-টাজার মাঝে মাঝে করে দেবে। আমার বইপত্রগুলোর দেখাশোনা করবে। বউদি কোথাও যেতে চাইলে নিয়ে যাবে। 

—বউদি! কে বউদি! 

ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন মৌসুমি। 

—আমি ওর মায়ের মতো। ও আমাকে বউদি বলবে কী! আমাকে তুই মা ডাকিস হারাধন। সেই মুহূর্তে তার কোনও আবেগ ছিল না। পরের সাহায্য পেতে অভ্যস্ত সে এইসবই ভেবেছিল দারুণ স্বাভাবিক। তাকে সাহায্য করার জন্য পৃথিবীতে অনেক মানুষ। 

অথচ, সে যখন স্থিত হয়ে গেল, মৌসুমিকে মা ডাকলে আর জড় হল না জিহ্বা, তখন তার মধ্যে এল আবেগ। নিঃশব্দে। গোপনে, অল্পে অল্পে। সেই আবেগের নাম কী, সে জানে না। জানে না আজও। 

হস্টেলে নামমাত্রই, অধিকাংশ সময় তার কেটে গেছে অসিত স্যারের বাড়িতেই। আজও, এই চাকরি পেয়ে যখন সে এক মেসকে আশ্রয় করেছে, তখনও অধিকাংশ সন্ধ্যা ও ছুটির দিন তার কেটে যায় ওখানেই। না গেলে মৌসুমি অভিমান করেন—আমাকে ভুলে যাচ্ছিস, না? 

আর সে নিজেকে জানে। মৌসুমিকে না দেখলে তারও চলে না। এ এক অমোঘ আকর্ষণ। এই আকর্ষণই তার নির্মল আনন্দের উৎস। একে সে জানে সেইসময় থেকে। সেইসময়, যখন সে অসিত স্যারের বাড়িতে স্থিত। অসিত স্যার দাবা খেলতে চলে যান রোজ সন্ধ্যায়। সে থাকে। পড়ে। কথা বলে মৌসুমির সঙ্গে। সে যেভাবে থাকত ওই বাড়িতে তাতে হস্টেলে না থেকে ওখানেই বাস করতে পারত অনায়াসে। কিন্তু অসিত স্যার সে-কথা বলেননি। কেন সে জানে না। এমনকী মৌসুমিও বলেননি। এখন, এই চাকরি পাবার পর যখন সে মেস নিয়ে থাকছে, মৌসুমি বলেন—এটাই তোর বাড়ি। কিন্তু তোকে যে থাকতে বলব, চারপাশে যা লোকজন! 

সে বলে—তুমি ভেবো না মা। আমি তো আসছিই। 

এবং অসিত স্যার দাবা খেলতে চলে যান আজও। সে যায়। থাকে মৌসুমির সঙ্গে। হাতে হাত রেখে বসে থাকে পাশাপাশি। কোলে শুয়ে থাকে। কখনও সে চায়, কখনও মৌসুমি— তারা শুয়ে পড়ে বিছানায়। তারা মা ও ছেলে, শুয়ে পড়ে বিছানায়। মৌসুমি সঘন শ্বাসে বলেন—কাছে আয়। আয় না। 

সে কাছে চলে যায়। খুব কাছে। আর মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে। বুকে গুঁজে দেয় মুখ। একটি পা মৌসুমির গায়ে তুলে দেয়। মৌসুমি শাড়ি সরিয়ে দিয়ে বলেন—এইখানে, ঠিক এইখানে মুখ রাখ আমার। 

এক সন্তানহীনা নারী ডাক দেয় তরুণ পুত্রবৎ হারাধন ছেলেটিকে। সন্তানস্পৃহা মানবের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা। প্রাকৃতিক। অতএব বুক জুড়ে না থাকলে কেউ, বুক খাঁ-খাঁ করে। হাহাকার চলতে থাকে, তীব্র ইচ্ছার অপূর্ণতায়, অতৃপ্তিতে। নারী সে, সন্তান-প্রতিমকে দেখায় শূন্যতা। 

সে খুলে দেয় ব্লাউজের একটি-দুটি হুক। আর মুখ ডুবিয়ে দেয় সেই গহনে। শরীরে শরীর লেগে যায়। সে এক আশ্চর্য আনন্দের ঘ্রাণ পায় সেখানে আর ঘ্রাণ নিতে নিতে টের পায় ওঠা-নামা। টের পায় হৃদস্পন্দনের দ্রুততা। হৃদয়—হৃদয়! তারা পরস্পরকে কী নামে ডাকে? কী চোখে দেখে? সম্বোধনে হায়, কিছুই লেখা থাকে না সম্পর্কের। এমনকী নিজের কাছেও স্বীকারের সকল তাড়নার আড়ালে নিঃশব্দে মুখ তোলে দৃঢ় অনিবার্য ইচ্ছা। দুটি ডানা ঝাপটানো হৃদয় তখন পরস্পর সংলগ্ন থেকে যায় দীর্ঘসময়। একসময় সে মুখ তোলে। সে-মুখ কাতর। সে ঝুঁকে পড়ে মায়ের মুখের পরে। গালে গাল রাখে। আর হাত দিয়ে হুক লাগিয়ে দেয়। মৌসুমি বলেন——ইচ্ছে করে, সারাক্ষণ তোকে এরকম বুকে চেপে রাখি। তুই আমার একমাত্র আনন্দ। 

সে মায়ের নাকে নাক ঘষে দেয়। চুমু খায়। তার শরীরের অর্ধাংশ উঠে আসে মায়ের শরীরে। গাঢ় স্বরে সেও বলে—তুমিও আমার একমাত্র আনন্দ মা। 

মা ও ছেলের এ এক অপরূপ একান্ত সময়। মা ও ছেলে। নাকি মৌসুমি ও হারাধন। তারা নিজেরাও জানে না সে-কথা। তারা জানে পরস্পর ঘনিষ্ঠতম এ বন্ধন। একজন পঁচিশ বয়স্ক যুবক ও পঁয়তাল্লিশ বয়স্কা নারী। তারা যখন কাছাকাছি আসে, যুবকটি ভুলে যায় সে ভাসমান। নারী ভুলে যায় সে সন্তানহীনা। একটা সম্পর্ক পরস্পরকে এর চেয়ে বেশি আর কী দিতে পারে! 

মাঝে মাঝে হারাধন শরীরে কষ্ট পায়। অনিবার হয়ে ওঠে রক্তস্রোত। এই পাঁচটি বছরে সে এই স্রোতকে সংযত করেছে। উত্তাপে পুড়ে যেতে যেতেও পোড়া ত্বক ভিজিয়েছে সন্তান হয়ে ওঠার আমূল সংস্কারে। ‘মা’ এই ডাক তাকে দিয়েছিল শক্তি। সে যখন বহরমপুরে পড়ত তখন দৈনন্দিন দেখা-সাক্ষাতে, পরিচিত পরিবেশের অনুচ্চারিত নিষেধে এক অনিবার্য আকর্ষণের মধ্যে বসেছিল প্রাচীর। মাঝখানে, অদর্শনের তারল্যে, সে যখন ছিল বর্ধমানে, তাদের সেই বায়বীয় প্রাচীর সম্ভবত উড়ে যায়। যে-কল্পনা সে বহরমপুরে কখনও করেনি, সে-কল্পনা অনায়াসে দিয়েছিল বর্ধমান তাকে। স্থান বদলে গেলে সম্পর্ক নতুন মর্মে ধরা দিতে পারেও বুঝি বা। তবু তারা, এই মতো ধারণা নিয়ে থাকছিল যে যেখানে যেমন ছিল, সকল নিষেধ ও মান্যতা, আছে তা-ই। কিন্তু সেদিন যে কী হল! সে কি চেয়েছিল এমনই, নাকি মৌসুমি চেয়েছিলেন! নাকি তারা দু’জনেই চেয়ে আসছে এবং প্রবল পরাক্রমে গড়ে তুলছে সেই বায়বীয় প্রাচীর! 

আজ এই শনিবার সে চলেছে চর অভিমুখে। আর ভাবছে। কী বলবে সে! জানে না। কিন্তু বলতে তো হবেই। না বলে পারবে না সে। মায়ের আদেশ। 

শীতের গঙ্গার হাওয়া। কনকনে তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে গায়ে। পারাপারের ডিঙিতে বসে সে দেখছে দূরে পেতনির চরে নেমে আসছে অন্ধকার। নিথর হয়ে আছে গাছপালা, বাড়িঘর। ধোঁয়া জমে আছে স্তরে স্তরে। এই দৃশ্যে তার মন ভিজে উঠছে। চরের অনিশ্চিত জীবনেও আছে এক ছবির মতো সুন্দর ও শান্ত সন্ধ্যা। 

গত শনিবার, এমনই সন্ধ্যায় সে গিয়েছিল মায়ের কছে। অসিত স্যার বেরোচ্ছেন তখন। বললেন—এই যে, চাকুরিজীবী! যাও। তোমার মা আছেন। 

সে ঘরে গিয়ে দেখল শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে আছেন মৌসুমি। একটি বেতের চেয়ারে গা এলানো। চোখ-মুখ থমথমে। টিভি চলছে না। সে মৌসুমির কোলের ওপর হাত রেখে বসে পড়েছিল। গাঢ় স্বরে ডেকেছিল—মা। কী হয়েছে? 

—দু’দিন আসিসনি কেন? আমায় ভুলে যাচ্ছিস হারাধন? 

—আসতে পারিনি। মোহন এসেছিল। আমি, মোহন আর সিদ্ধার্থ আড্ডা মারলাম দু’দিন সন্ধ্যায়। 

মৌসুমির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে হাত দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে জল। বলছে—মা। তুমি জানো না তোমার কাছে না আসতে পারলে আমার ভাল লাগে না? বর্ধমানে থাকতে কত কষ্ট হয়েছে আমার! 

—আমার ভয় করে। খুব ভয়ে ভয়ে থাকি রে আমি। যদি আমাকে ছেড়ে তুই চলে যাস। 

—তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না মা। মা, তুমি কী সুন্দর তুমি জানো? 

—যাঃ। 

মৌসুমি কিশোরী মেয়েটির মতো রক্তিম হয়েছিলেন। তাঁর অধর স্ফুরিত হয়েছিল। শীতের পোশাকের নীচে উষ্ণ শরীর হয়েছিল উষ্ণতর। তিনি হারাধনের হাত দুটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন—ইস, কী ঠান্ডা। হাতমোজা পরিস না কেন? 

হারাধন বলেছিল—তুমি গরম করে দাও। 

মৌসুমি হাত দুটি নিয়ে এসেছিলেন শীতের পোশাকের নীচে। নরম পেটে স্থাপিত করেছিলেন। ঠান্ডার ছ্যাঁকা লাগছিল তাঁর। বলেছিলেন— তোকে দু’জোড়া হাতমোজা করে দেব আমি। ইস্! আগে কেন আমার মনে হয়নি একথা? 

আর হারাধনের হাতে লাগছিল আগুনের আঁচ। সে বলেছিল—কী সুন্দর! কী নরম তুমি! 

–না। 

—হ্যাঁ। তোমার মতো সুন্দর আমি কারওকে দেখি না। তোমার মতো ভালও আর কেউ নেই মা পৃথিবীতে। তুমি আমার দেখা এক শ্রেষ্ঠ মানুষ। 

পৃথিবীর তাবৎ সন্তান তার মাকে যেমন দেখে, যেমন বলে, মাগো, তুমিই শ্রেষ্ঠ, তোমার চেয়ে সুন্দর আর কী থাকতে পারে! হারাধনের কথায় তারই প্রতিধ্বনি। মৌসুমি বলেছিলেন তখন—তুই পাগল! 

—না। আমি পাগল না। 

—ও ঘরে চল। আমার বুকে একটু শুয়ে থাক। মাঝে মাঝে ভাবি, তোকে যদি বদলি করে দেয় অন্য কোথাও! 

—সে-কথা এখন ভাবতে হবে না মা। চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। 

—আমাকে নিয়ে? কীভাবে? 

সে উঠে দাঁড়ানো মৌসুমিকে তুলে নিচ্ছে দুহাতে আর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে। নামিয়ে দেবার কাতর আবেদন জানাচ্ছেন মৌসুমি। সে হাসছে। বলছে—আর রাগ করবে? আর দুশ্চিন্তা করবে? 

শুইয়ে দিচ্ছে সে মৌসুমিকে। আলতো করে শুইয়ে দিচ্ছে। মৌসুমি তাকে কাছে টেনে নিচ্ছেন। উত্তাল রক্তস্রোত আকর্ণ উষ্ণ করে দিল তাকে তখন। সে মুখ ঘষতে লাগল মায়ের বুকে–মা, মা, মা! 

বলছে সে-মা, মা, মা! 

মৌসুমির হাঁটু দুটি ভাঁজ করা। চাদর সরে গেছে গা থেকে। হারাধনের চুলগুলি তিনি আঁকড়ে ধরেছেন প্রাণপণ। তখন একটা মিছিল যাচ্ছিল বাড়ির সামনের পথ দিয়ে। মিছিল কী বলছিল সে বুঝতে পারছিল না। বোঝার কোনও আগ্রহও ছিল না। হয়তো এই মিছিলে ছিল তার দুই বন্ধু, সিদ্ধার্থ ও মোহনলাল। সে তখন হুক খুঁজছে। ব্লাউজের হুক খুঁজছে। এবং দুটিমাত্র নয়। যা সে এতকাল অধিকার করেছে, সেই দুটি মাত্র নয়। সে খুলে চলেছিল একের পর এক, ক্রমাগত এবং সম্পূর্ণ। ব্লাউজের নীচে বুক দুটি আগলে থাকা অন্তর্বাসে লেগে তার মুখ জ্বালা করছিল। খুলতে হয়, কী করে খুলতে হয় জানে না সে, কিছু পেতে হাঁকপাঁক করছিল। মৌসুমি তখন নিজেই দু’ হাত পিঠে নিয়ে হুক আলগা করে দেন। বিশ্বস্ত নাইলনের ফিতে ছিটকে উঠেছিল তাতে। যেন তাদের পাহারাদারি অপসারিত করে অনর্গল করা হল দুর্গদুয়ার। সে ঠেলে দিয়েছিল বন্ধন। তা উঠে গিয়েছিল মৌসুমির গলার দিকে। যেন গলা জড়িয়ে ধরতে চায়। তার হাতে এসেছিল দুটি স্তন। ভরাট ও উন্মুখ। সে নাভি পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া পিপাসায় মুখ রেখেছিল বৃত্তে। জিহ্বা, ওষ্ঠ এবং দত্ত দ্বারা সে পর্যায়ক্রমে মথিত করেছিল। মাঝে মাঝে থামছিল। দেখছিল। শক্ত ও ফুঁড়ে-ওঠা কালচে বৃত্তদ্বয় শ্বেতাভ স্তম্ভের পর জেগে ছিল উন্মুখ প্রত্যাশায়। সে দেখতে দেখতে, মুগ্ধ হতে হতে বলেছিল—কী সুন্দর তুমি! 

—উঁ 

—কী সুন্দর তুমি মা। 

—উঁ 

তার মাথা শক্ত করে ধরেছিলেন মৌসুমি এবং চেপে রেখেছিলেন বুকে। বলছিলেন—বল, আমাকে ছেড়ে যাবি না বল। 

—যাব না, যাব না, যাব না। 

—এই সব তোর। তোর। তোর। যাবি না বল। যাবি না। 

–না না না। 

সে বলছে আর তার হাত নেমে যাচ্ছে। ক্রমশ নেমে যাচ্ছে কোনও এক রহস্যের দিকে। মৌসুমি কঁকিয়ে উঠছেন তখন— না, হারাধন না। আর না। মরে যাব আমি। 

সে থমকে গিয়েছিল। 

—মরে যাবে? মরে যাবে কেন? 

—সে তুই বুঝবি না। 

—কেন বুঝব না? 

—না। উঠে আয়। 

সে, হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পুরুষ তখন, মায়ের বুকদুটিতে আরও একবার হাত স্থাপন করে অন্তর্বাসে আচ্ছাদিত করেছিল। ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়েছিল হুক। তখন মৌসুমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—তুই বিয়ে করলে আমার দারুণ হিংসে হবে জানিস। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *