৩
কার্তিকে কালিয়দমন
খেলেন বনমালী।
কালিদহে ঝাঁপ দিয়ে
বৰ্ণ হল কালী ॥
যতদূর চোখ যায় সবুজ ক্ষেত। ধানের শিষে ভারী গাছ দুলছে হাওয়ায়। যখন সর্ষে লাগানো হয় তখন আদিগন্ত শুধু হলুদ সর্ষের ফুল। সবুজ ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে চৌকো চৌকো হলুদ সর্ষের খেত অপরূপ বর্ণময়তা তৈরি করে। রোদ্দুর হতে বহুগুণ ঔজ্জ্বল্য ঠিকরোয়। আর শুধু সর্ষেই বা কেন, কার্তিক মুসুর ডাল বপন করারও সময়। মুসুর, মটর, সর্ষে, তিসি সমস্তই ভাগাভাগি করে লাগানো হয়ে থাকে এই সময়। আর পৌষের শেষাশেষি সোনালি সর্ষের ফুলে ভরে যাবে ক্ষেত। ডাল ফুল, মটরের ফুল। শস্যক্ষেত্রকে তখন দেখায় যেন কানায় কানায় ভরা। এই আবাদভূমির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। যদিও মসৃণ নয়। মাঝে মাঝে খোয়া উঠে গেছে। ছোট বড় বহু গর্তে আবিল।
রাস্তার ধারে মাঝে-মধ্যে বাড়ি। কাঁচা অথবা পাকা। অথবা কোথাও পথ ছুঁয়ে বহু দূর চলে গেছে ক্ষেত। দূরে-দূরে দেখা যায় গৃহের সীমানা। দু-চারিটি দোকান বিপণি হয়তো-বা মাঝে-মধ্যে। অধিক দোকান পেতে গেলে যেতে হবে শহরে। গঞ্জে বা সদরে। যেমন এখানকার নিকটবর্তী সদর হরিহরপাড়া। এর চেয়েও বড় শহর যদি চায় কেউ, কোর্ট-কাছারি যদি করতে হয় তো যেতে হবে আরও উত্তরে শহর বহরমপুরে। আসা-যাওয়ার অসুবিধা নেই। বাস পাওয়া যায়।
তবে কিনা এইসব পথ, পিচে বাঁধানো রাস্তা গিয়েছে শহরের অস্থি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। একটু দুরের গাঁয়ে যেতে হলে প্রথমে কিছুক্ষণ ইটের গুঁড়ো ফেলা পথ, তারপর পাথর ফেলা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। শেষ পর্যন্ত এই পথ হয়ে উঠবে মাটির। বর্ষায় তাতে জমে যাবে পায়ের গোছ অবধি কাদা। ঘোড়ার গাড়ি অবশ্য এই পথে অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারে। গোরুর গাড়িও। কারণ ঘোড়া বা গোরু কেউ-ই খুব একটা কাদার পরোয়া করে না। শুধু যখন ঘাসের মধ্যে থেকে উঠে আসে জোঁক আর গোক্ষুরের মাঝখানে ঢুকে গিয়ে রক্ত পান করে, তখন গোরুগুলি খানিক থমকে দাঁড়াতে চায়। খর জিভ দিয়ে চেটে বার করে দিতে চায় জোঁক। এ ছাড়া আর কোনও অসুবিধে তারা বোধ করে না। আর ঘোড়াগুলি পোকা-মাকড়-কীট সম্পর্কে উদাসীন কারণ মানুষের কাছে গোরুর তুলনায় তারা কিছু বাড়তি যত্ন পায়। কীট-পতঙ্গ মানুষই খুঁটে বার করে তার গা থেকে।
এইসব পথে মুশকিলে পড়ে মোটরগাড়ি। এবড়ো-খেবড়ো পথে এরা কাত হয়ে যায় অথবা উঁচু পাথরে ধাক্কা খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাল-তাল কাদার ফাঁদে আটকে স্তব্ধ হয়ে গেছে গাড়ি, এ-দৃশ্যও দেখেছে এই অঞ্চলের মানুষ। অবশ্য এইসব অঞ্চলে মোটরগাড়ি আসে কালে-ভদ্রে। কখনও সেচ দপ্তরের কোনও পূর্তবিদ হয়তো ভাঙন দেখতে এলেন। কিংবা ভোটের আগে-আগে এলেন কোনও নির্বাচন-প্রার্থী। অথবা অপরাধের খোঁজে পুলিশের জিপ। অবশ্য মাঝে-মধ্যে ধনী পরিবারগুলিতে অতিথি আসেন গাড়ি চেপে। ধুলোয় ধুলো হয়ে যায় তাঁদের পোশাক-আশাক, চুল। কারণ বর্ষায় বানভাসি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কেউ এখানে আসে না। আসে হেমন্তে, শীতে, এমনকী গ্রীষ্মেও।
এ পথেই যেতে যেতে ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দুলুক্ষ্যাপার। ‘জয় গুরু’ বলল সে। তারপর দু’ হাত জড়ো করে ঝুঁকে দাঁড়াল বৈষ্ণবীর সামনে। বৈষ্ণবী হেসে হাতের খঞ্জনিতে ঝংকার তুলে বলল, জয় রাধে। কেমন আছ গো ক্ষ্যাপা?
পানের রসে লাল ঠোঁট বৈষ্ণবীর। কপালে ও নাকে গঙ্গামাটির অলকা-তিলকা। গলায় তুলসীর মালা। হাতেও তেমনই মালা জড়ানো। পরনে আধময়লা সাদা শাড়িটি। কাঁধে ছোট কালো ঝোলায় ভিক্ষের চাল এবং হয়তো আরও অন্য কিছু। ত্বকে হালকা ভাঁজ পড়েছে বৈষ্ণবীর। অথচ শরীর টানটান। তীব্র।
বৈষ্ণবীকে যতবার দেখেছে ক্ষ্যাপা, চোখ ফেরাতে পারেনি। আজও পারল না। এমন মানুষ থাকে, যারা কাছে এলে অন্য সব ভুলে যেতে চায় মন। এই শেষবেলায়, যখন আকাশে অস্তরাগ আর ছায়া দ্রুত নেমে আসছে আবাদভূমিতে, যখন গাছের ডালে পাখিরা শেষবেলার কথাগুলি কয়ে নিচ্ছে, তখন বৈষ্ণবীর আঁট করে বাঁধা চুল বড় এক কাণ্ড ঘটিয়ে দিচ্ছে দুলুক্ষ্যাপার মনে।
সে-ও প্রৌঢ় হল। তবু মনের মতো নারীর সন্দর্শনে সে পাগল হয়ে যায়। আর এই রমণী তাকে উন্মাদ করতেই যেন ঘুরে বেড়ায় যথা-তথা আর তাকে দর্শন দিয়ে মিলিয়ে যায়। এই মধ্য-চল্লিশের জীবনে দুলুক্ষ্যাপা জানে মনের মানুষীর দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়াই স্বভাব। তারা কখনও সম্পূর্ণ ধরা দেয় না। আর দুলুক্ষ্যাপা, কী এক প্রাণের টানে সেই অধরার উদ্দেশে ঘুরে বেড়ায় আজও।
সে বড় স্পষ্ট চোখে তাকায় বৈষ্ণবীর দিকে। বলে, বড় সুন্দরী দেখাচ্ছে গো তোমায় বৈষ্ণবী। বড় রসবতী হয়েছ।
ময়না বৈষ্ণবী পানের ছোপ ধরা দাঁত সম্বলে হাসে। সেই ছোপ দুলুক্ষ্যাপার চোখে এতটুকু বিসদৃশ লাগে না। খুঁত নিয়ে, ক্ষয় নিয়েই মানুষের সৌন্দর্য, সে জানে। খুঁতে ধরা মানুষকে আরও বেশি আপনার লাগে তার। সে শুনতে পায়, ময়না বৈষ্ণবী বলছে, হ্যাঁ গো রসিক, তুমি তো চিরটাকাল আমায় সুন্দরী দেখে এলে। তো চল না, বাউলে-বৈষ্ণবে ডেরা বাঁধি।
দুলুক্ষ্যাপা হাত জোড় করে কপালে ঠেকায়। বলে, তুমি মন করলেই হয়। তবে কিনা তোমার রসিক ছেড়ে তুমি আমার কাছে আসবে সে ভরসা নেই। তবু লোভ হয় গো বৈষ্ণবী! তোমার জন্য বড্ড লোভ!
বেমক্কা একটি খাঁটি কথা বলে ফেলে কানে হাত দেয় দুলুক্ষ্যাপা। তারপর হাত জোড় করে যেন এক অপরাধ করে ফেলে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি। ময়না বৈষ্ণবী হাসে তখন। হাসতে হাসতে খঞ্জনি বাজায়। বাস্তবিক, তার রসিক স্বয়ং কেষ্ট। তাকে ছেড়ে সে যায় কোথা?
তাদের পাশ দিয়ে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে চলে গেল গোরুর গাড়ি। ধুলো উড়ছে। পড়ন্ত আলোয় গোধূলি দুটি প্রৌঢ় মানুষকে নিয়ে দৃশ্যপট করে তুলছে মায়াময়। হাসির দমকে বৈষ্ণবীর শরীরে লাগছে দোলা, আর ওই দোল দেখে দুলুক্ষ্যাপার হৃদয় দুলে উঠছে। বৈষ্ণবী বলছে, স্বপনে দিন কাটে গো মোর, স্বপনে দিন কাটে। চলি গো রসিক। সন্ধ্যা লাগছে। সেই মরালী হতে ফিরছি।
—মরালী গিয়েছিলে? তেকোনা যাওনি?
—না। আজ আর যাইনি।
—বেশ বেশ। তেকোনা গেলে আখড়ায় পায়ের ধুলো দিয়ো।
—দেব গো দেব। আসি তবে? জয় রাধে।
—জয় গুরু।
দুজনে দুই জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বিপরীত মুখে যাত্রা করে। আর সন্ধ্যা ক্রমশ গাঢ় হতে চায়। ময়না বৈষ্ণবী পা চালায় দ্রুত। গ্রামদেশে অন্ধকার নেমে গেলে চলাফেরা করা মুশকিল। আঁধার এত জমাট হয়ে থাকে যে এক হাত দূরের বস্তু ঠাহর করা যায় না।
মাধুকরী করতে বেরিয়েছিল ময়না বৈষ্ণবী। তার চাহিদা অল্প। হরিহরপাড়ার ঘোষপল্লিতে একটি ছোট বৈষ্ণব মঠে সে থাকছে এখন। মহাপ্রভু গোপীদাসের মঠ। থাকে সেখানে আরও অনেকেই। হরির দয়ায় মঠে অন্নের অভাব নেই। ভক্তের দল নিত্যই দিয়ে যাচ্ছে চাল, শাক-সবজি, ফল, দুধ। সঙ্গে কাঁচা টাকা। প্রাচীন এই মঠে শিষ্য ও ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তা সত্ত্বেও যে ময়না বৈষ্ণবী মাধুকরী করতে বেরোয় তা মঠের অনেকে পছন্দ করে না। কিন্তু কারও ভাল-মন্দ লাগা পরোয়া করে না সেই মহিলা। ঘুরতে তার ভাল লাগে। নানান গ্রাম-গঞ্জ সে পাড়ি দেয় কেবল ভ্রমণের টানে। পরের শাসনই যদি মানবে, তা হলে আর বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে পড়া কেন! মাধুকরী বোষ্টমের ধর্ম। ভক্তের দেওয়া অন্ন যদি এতই উদ্বৃত্ত হয়ে থাকে, তা হলে সমস্তই নিজেদের ভোগে না লাগিয়ে দরিদ্রকল্যাণে বিতরণ করে দেওয়া যায় না?
বৈষ্ণবীর ভাবনায় যুক্তি আছে। সে-যুক্তি খণ্ডাবে কে? ঘুরে ঘুরে সে দেখেছে আসলে দারিদ্র্য বলে কাকে। সে নিজে দরিদ্র নয়। মঠ দরিদ্র নয়। তাদের অনুষঙ্গের স্বল্পতা, তাদের রিক্ততা এক স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত। এ-জীবন তারাই নির্বাচন করেছে। ভোগবিলাসিতাবিহীন জীবনে হরিনাম সংকীর্তনই তাদের মোক্ষ। গুরুনামে কল্যাণ আর ভগবতীর পূজায় পাপস্খালন। এ এক আশ্চর্য কথা যে হরিনামের উন্মাদেরা ভগবতীর সাধন করে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও তা সত্যি। মহাপ্রভু গোপীদাসের এমনই বিধান।
সে গৃহস্থের দুয়ারে গেলে গৃহস্থ তাকে সহাস্যে বসতে দেয় দাওয়ায়। বলে, ‘একটু নাম শোনাও দিদি, বড় মিঠে গলা তোমার।’
গৃহস্থের ঘরে ফলে ওঠা পেঁপে, কাঁচকলা, কুমড়ো সে পেয়ে যায় অনায়াসে। এই হল মাধুকরী। নাম-গান শুনিয়ে পাওয়া ভালবাসার দান। আর এই দানের বিষয়ে ময়না বৈষ্ণবী কখনও লোভ করে না। এক দিনেই সে দোরে দোরে ঘোরে না। সকল ঘরে যায় না সে। এক-এক গাঁয়ে আছে দু’ঘর বা তিন ঘর এমন গৃহস্থ যাদের সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। যাদের এমনকী ভাল-মন্দেরও সে অংশীদার। ঘুরে ঘুরে আন্তরিকতার আঘ্রাণ সে সহজেই পেয়ে যায়। সম্পন্ন, দরিদ্র বা হতদরিদ্র—যেমনই হোক না কেন, ময়না বৈষ্ণবীর বাছ-বিচার নেই। অবস্থার বাছ-বিচার নেই। সে চায় মনের মতো মানুষ। সে মনে-মনে স্বীকার করে যে সে সখ্যের কাঙাল। গৃহ ছাড়লেও গৃহস্থের পরিমণ্ডল তাকে শান্তি দেয়। গৃহস্থের ঘরে সে শান্ত হয়ে বসবে দাওয়ায়। তার কোলের কাছে আসবে গৃহস্থের ছানাপোনাগুলি। তার খঞ্জনিতে মারবে টান। ঝোলায় উঁকি মেরে দেখবে কী আছে ভেতরে। গৃহিণী তাদের মৃদু ধমক দেবে। আর এসে বসবে তার কাছে। বলবে সুখ-দুঃখের কথা। সেও দেবে নানা গাঁয়ের নানা খবর। আর এভাবেই জীবন চলে যাবে নদীতে ভেসে ভেসে যাওয়া ডিঙি-নৌকোর মতো।
ময়না বৈষ্ণবী খঞ্জনি বাজাতে গিয়ে পাথরে ঠোকর খেল। বেকায়দায় বেঁকে গেল তার ডান পা। যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেল। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। বসে পড়ল রাস্তায়। হাতড়ে হাতড়ে পা থেকে খুলে যাওয়া হাওয়াই চটি হাতে নিয়ে দেখল ফিতে ছিঁড়ে গেছে। পায়ের ব্যথায় হাত বুলিয়ে উবু হয়ে বসল সে। ‘আহা! ছিঁড়ে গেল চটিটা!’ স্বগতোক্তি করল। একটা ফিতে পরালেই আবার সুস্থ হয়ে যাবে চটিজোড়া—এমনই ভাবতে ভাবতে আঁচলের তলায় হাত ঢুকিয়ে ব্লাউজ থেকে একটি সেফটিপিন খুলে লাগিয়ে নিল চটিতে। চলে যাবে আপাতত। এবার উঠে দাঁড়াল সে। আর উঠেই ব্যথা টের পেল। এখন গতি ধীর হয়ে যাবে। সে পা টেনে টেনে চলল। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু পা নিয়ে ভাবিত হল না সে। সামান্য ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে সে ভাবে না বেশিক্ষণ। দেহ থাকলেই থাকবে রোগ-ব্যাধি-জরা-মৃত্যু। তাকে ভয় পেলে চলবে কেন! অতএব কোনও কিছুই তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে না। সদা প্রসন্ন সে। শোকের ঊর্ধ্বে যাবে বলেই সে বৈরাগ্য গ্রহণ করেছিল।
হঠাৎ তার দুলু বাউলের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল বাউলের চোখ আর তার হাসি পেল। দুলু বাউল লোক খারাপ না। তবে কিছু ক্ষ্যাপাটে। আর তার চোখ দুটি বড় কামনাতুর চোখে চোখ রাখলে বুকের তলা সিরসির করে। দেখতেও তাকে চমৎকার। সে যে এই মুর্শিদাবাদের আদি মানুষ নয় তা তার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়। কোথাকার মানুষ কে জানে! তার মাথার পাগড়ি আর কাঁধের ঝোলা, বিচিত্রবর্ণের আলখাল্লার আড়ালে দীর্ঘ সুগঠিত শরীর ও চওড়া কাঁধ চোখে পড়ে। টানা তীক্ষ্ণ নাক, বড় বড় লালচে চোখ আর গৌরবর্ণে বড় বেশি আকর্ষণ ভরা। তাকালে ঘনিষ্ঠ হতে বড় ইচ্ছে যায়। আর স্বর শুনলে শ্রবণে মধু ঝরে। ‘হরি হরি’–দু’ হাত কপালে ঠেকায় ময়না বৈষ্ণবী। ‘বন্ধন আর দিয়ো না প্রভু।’ সে পা টেনে টেনে চলে। সেফটিপিনের খোঁচা লাগে তার পায়ের আঙুলের মাঝে। সে খঞ্জনি বাজায়। প্রতিটি পদক্ষেপে টনটন করে অস্থি। সে গান করে—
কুম্ভশ্রেণী শিরে ধরি বাজীকরগণ।
রজ্জু দিয়া নেচে করে গমনাগমন ॥
দৃষ্টি তার রহে পদে কুম্ভে রহে মন।
সে লাগি তাহার শির না নড়ে কখন ॥
অতএব রজ্জু হৈতে কুম্ভের সহিত।
পতন তাহার নাহি হয় কদাচিৎ ॥
তৈছে জীব মায়ারজ্জু পদেতে বাঁধিয়া।
বিষকুম্ভশ্রেণী শিরোপরেতে রাখিয়া ॥
পদে দৃষ্টি রাখি আর কুম্ভে রাখি মন।
অভদ্র সংসারে সদা করিছে ভ্রমণ ॥
ময়না বৈষ্ণবী জাত মানে না। ছোঁয়াধর্মও মানে না। কিন্তু শুদ্ধাচারী বৈষ্ণবের সঙ্গেও তার তফাত। এ তফাত গড়েছেন মহাপ্রভু গোপীদাস স্বয়ং। বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বন করেছেন ভগবতীকে কোলে বসিয়ে। ঘুচিয়েছেন জাতিবিচার। স্বয়ং কৈবর্ত গোপীদাস প্রথমে হাড়ি, ডোম, কৈবর্ত, হেলে, জেলেদেরই আরাধ্য ছিলেন। ক্রমে শিক্ষিত, উচ্চবংশজাত মানুষও তাঁর শিষ্যত্ব নিয়েছিল। মহৎ মানব তিনি, ভক্তজনে তাঁর মহত্ত্ব চিনতে ভুল করেনি। তিনি বলতেন, মানুষের জন্মমৃত্যু জাতি-ধর্ম নিরপেক্ষ। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশু কি জানবে তার জাত কী, ধর্ম কী! মানুষ আপনার দল বাড়াতে ভালবাসে বলে শিশুর গায়েও জাতি-ধর্ম দেগে দেয়। মানুষের জাত হল তার চর্চা। তার হৃদয়। কর্ম করো আর ঈশ্বরের চরণ ধরে থাকো। এ ছাড়া আর মানুষের কী করার থাকতে পারে! আর ওই চরণ ধরার জন্যই মার্গ অবলম্বন করতে হয়। তুমি বৈষ্ণবই হও আর শাক্ত, তুমি হিন্দুই হও আর মুসলমান—সব পথ গিয়ে থামবে একখানে।
ময়না বৈষ্ণবীর হল ওই মহাপ্রভু গোপীদাসের ধারাই অবলম্বন। ঈশ্বরের চরণ ধরে থাকতে চায় সে। তার হল ঈশ্বরভক্তি।
বাউলের ধারার প্রতি তার ভক্তি নেই। যেমন সংসারে তার মন লাগেনি কোনও কালে, তেমন বাউলেও লাগেনি। নইলে সে যেমন জন্মবৈরাগী, তাতে বাউল হয়ে যাওয়াই তার উচিত ছিল। তার জন্ম যেখানে, বাঁশুলি গ্রামে, সে-গ্রাম মুর্শিদাবাদ জেলান্তর্গত হলেও বীরভূমের গায়ে গায়ে। বাউল তার গা সওয়া। ছোটবেলায় বা তরুণ বয়সে সে বাউলে আর বৈষ্ণবে তফাত করতে পারত না। তখন সে বীরভূমে যেত তার পিসির বাড়ি আর নিকটবর্তী বাউলের আখড়ায় চলে যেত। তার মনে হত, সেখানকার মানুষ-মানুষী সব কেমন ছন্নছাড়া। বাউলসাধনের থই পাওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। কিন্তু সে যখন তার বাবার সঙ্গে পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে গিয়েছে তখন ওখানকার পূজা, কর্মশৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতায় যে-শান্তি পেয়েছে, তার কণামাত্রও পায়নি বাউলের আখড়ায়। ময়না বৈষ্ণবী, সে বড় মানসিক লোক। যেখানে মন লাগে না, সেখানে তার ঠাই কই। তার মনে হয়, বাউল বড় বেশি ইহবাদী। তীব্র তাদের ইহবোধ।
পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে সে অনায়াসেই যত দিন খুশি থাকতে পারত। ওই মঠের শিষ্য ছিল তার বাবা, বাঁশুলি গ্রামে চার বিঘে জমির মালিক নিরঞ্জন দাস। ময়না নিজেও ধর্ম নিয়েছিল ওই মঠেই। কিন্তু বছর দশেক থাকার পর আর মন ধরাতে পারেনি। তবে এই দশ বছরের শ্রীপাটবাসে তার অন্তর্জালা শমিত হয়েছে অনেকখানি।
ষোলো বছর বয়সে তাদেরই মতো এক চাষি পরিবারে তার বিয়ে হয়েছিল। সব দিক দিয়েই সেই গৃহ ছিল তাদের পাল্টি ঘর। এমনকী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ করা ময়নামতীর স্বামী ছিল সপ্তম শ্রেণি পাশ। ময়নার বৈরাগী মন স্বামীকে আঁকড়ে যখন প্রায় বশীভূত ও স্থিত হতে চলেছে তখন এক বর্ষার দুপুরে খোলা মাঠে বজ্রাঘাতে মারা গেল তার লোকটি। সেই যে কাজকর্ম মিটিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল ময়না, আর যায়নি।
সে এক সময় গেছে তার। ঘরে মন বসে না। যখন-তখন কান্না পায়। ঘরে মন বসে না বলে মাঠে যায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঠাকুর, আমাকেও দাও আরও এক বজ্রাঘাত।’ সবুজ ধান ভরা ক্ষেতের আলে বসে চারদিক চেয়ে দেখে। তাকে পাক খেয়ে উড়ে যায় ফিঙে পাখি। তার মনে হয় শূন্য। সব শূন্য। কোথাও কিছু নেই। এই সবুজে আর সবুজ লেগে নেই। পাখির রব হতে কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে সুস্বর। দুর্ভেদী শূন্যতায়, অসহ্য স্তব্ধতায় তার প্রথমে দম বন্ধ হয়ে আসত। তারপর বুক উথাল-পাথাল করত। অবশেষে চোখ ফেটে জল আসত। ‘কোথায়? তুমি কোথায়? আমাকে ফেলে তুমি কোথায় চলে গেলে? কেন গেলে?” এক তরুণ মুখের স্মৃতিকে সে পাগলের মতো এই প্রশ্নগুলো করত। তারপর মাঠ সহ্য করতে না পেরে ফিরে আসত ঘরে।
ঘরে জ্বালা বাহিরে জ্বালা
কোথায় আমি রই।
কালা আমায় করলে পাগল
সকল দুঃখ সই ॥
শেষ পর্যন্ত সেই তরুণের মুখ আর কালাচাঁদ কৃষ্ণের মুখ একাকার হয়ে গেল তার কাছে। এক দিনে হয়নি। ক্রমে ক্রমে সয়ে সয়ে হয়েছে।
মা গিয়েছিল শৈশবেই। শেষ পর্যন্ত বাবাও গেল। সে বাবার গৃহে অন্তরালবর্তিনী থেকে অসহ বিচ্ছেদযন্ত্রণা ভোলার কিছু সময় পেয়েছিল। শেষে যখন একেবারে একলা তখন ওই চার বিঘের বিত্তবাহুল্য না রেখে সে সব শ্রীপাটকে দান করে। শ্রীপাটের হয়ে ক্ষুদু মণ্ডল এখন জমিটার দেখাশোনা করে।
এখন ময়না বৈষ্ণবী মাঝে মাঝে পঞ্চবুধুরি আশ্রমে যায়। আর যায় বাঁশুলি গ্রামে। ভ্রমণ তার প্রিয়। ওই দুই স্থানও তার প্রিয়। এই দুই জায়গায় সে দু ভাবে আত্মস্থাপন করেছিল। সে যখন বৈরাগ্যই মনস্থ করে তখনও সে মনে মনে তার স্বামী, এক তরুণের কামিনী। ধীরে ধীরে এই কাম চিরতরুণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সঞ্চারিত হয়েছে। ধর্মোচিত দ্বিধাবিভক্ত করেছে সে তার বৈষ্ণব-জীবন। স্বামীকে দিয়েছে প্রেম, ঈশ্বরকেও দিয়েছে সেই একই প্রেম। প্রেম, কাম, কামনা তার কাছে গর্হিত হয়নি কখনও। বরং, তার মনে হয়েছে, কাম ঈশ্বরের এক আশ্চর্য প্রসাদ। কামবিহীন প্রেমের কথা জানে না সে। শুধু জানে কামচর্চায় চাই সংযম। সেই সংযমের শক্তি থাকা চাই মানুষের। কাম যত্র-তত্র বিলিয়ে দেবার নয়। পদাবলীর অপূর্ব আসরে গায় সে নিত্যই আর সেই গানের মর্মে প্রাণ ঢেলে দেয়।
মুখে হাস্য মাখা তার চক্ষে বহে নীর।
জাগিয়া ঘুমায় সেই বচন সুধীর ॥
পিতামাতাভ্রাতা আদি বিহীন সে জন।
তথাপি তাদের সঙ্গে রহে অনুক্ষণ ॥
কামশূন্য হঞা করে কামের করম।
সাপের মাথায় ভেক করায় নর্তন ॥
নিজেকেই নিজে শিক্ষা দিতে বহু অন্ধকার রাত্রে সে দাঁড়িয়েছে নিজের মুখোমুখি। চাইলে সে পেয়ে যেত একজন পুরুষসঙ্গী। সে জানে, তার শরীর একজন পুরুষের কাছে বড় আকর্ষণের। সে নিজেও যে দুলু বাউলের মতো এমন মধুর পুরুষ আর দেখেনি এমন নয়। কিন্তু আরও মধুরের জন্য সে স্বল্প মধুরকে জয় করেছে। সে ওই পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে যা কিছু শুনেছে নাম, গান, পদাবলী সেগুলি কণ্ঠস্থ করেছে। আর যে-সত্য দেখেছে স্বচক্ষে, সেগুলি উপলব্ধি করেছে। গাঢ় অন্ধকারে আরও সব বৈষ্ণবীদের সঙ্গে চাটাই পেতে শুয়ে সে মনে মনে বলেছে—ওঁ শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণায় নমঃ।
তুমি কে? আমি জীব।
তুমি কোন জীব?
আমি তটস্থ জীব।
থাকেন কোথা?
ভাণ্ডে।
ভাণ্ড কীরূপে হইল?
তত্ত্ববস্তু হৈতে।
তত্ত্ববস্তু কী?
পঞ্চ আত্মা। একাদশেন্দ্র। ষড় রিপু। ইচ্ছা। এই সকল এক যোগে ভাণ্ড হইল।
ভাণ্ডের জীব, ভাণ্ড হতে সদা মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়। সে নিজেও ব্যাকুল হয়েছে। এখন আর সে কোনও কিছুই ভয় পায় না। এমনকী ভয় পায় না এই দ্রুত নেমে আসতে থাকা অন্ধকারকেও। হৃদয়ে যার আন্ধার নেই, বাইরের অন্ধকার তার কী করবে! যদিও শ্রীপাটে সর্বদাই শ্রীরাধাকৃষ্ণের রতিরঙ্গেই সকলে তুষ্ট থাকেনি। নিজেরাও সকাম হয়েছে।
বৈষ্ণব সমাজে প্রেম নিন্দনীয় নয়। কাম অশুচি নয়। প্রেম ও কাম সমন্বয়েই চারিত্রিক শুচিতা বজায় রাখা সম্ভব এমনই ধারণা। অনেকের মতে শ্রীচৈতন্য দুই রকমের বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যাস করতেন। প্রথমটি বাইরের ধর্ম, দ্বিতীয়টি অন্তরের। রসরাজ তত্ত্ব অন্তরঙ্গ বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্ব। রসরাজ কৃষ্ণ সব রসের উৎস। এবং সমস্ত রসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শৃঙ্গাররস। এই রসের বত্রিশটি লক্ষণ আছে।
আদ্যরস শৃঙ্গারের বত্রিশ লক্ষণ।
আর সে বত্রিশ বিপ্রলম্ভের গণন ॥
চমৎকার রস এই চৌষট্টি প্রকার।
আশ্রয় বিষয় হয় রসরাজ সার ॥
কৃষ্ণের রতিক্রীড়া নিরন্তর। কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ। কৃষ্ণেই অদ্বৈততত্ত্ব স্বতঃস্ফূর্ত। রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। কৃষ্ণের পাঁচটি অংশ। ব্রহ্মণ, আত্মন, ভগবান, গুরু ও ভক্ত। এর মধ্যে গুরু দেব গুরু মৃত্যুহীন। গুরুর পায়েই সঁপে দিতে হয় জীবন। গুরুনিন্দা মহাপাপ। সে পাপ স্বমুখে কখনও করেনি ময়না বৈষ্ণবী। তার মনের কথা মনেই থেকেছে সবসময়। কেননা ময়ন বৈষ্ণবীর কানে এসেছে এই যে তার গুরু এবং পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটের প্রধান শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজি মহারাজ গোপনে বিশাখা বৈষ্ণবীর বিলাসী।
সত্য-মিথ্যা জানে না সে। জানার চেষ্টাও করে না। কিন্তু ওই গোপনীয়তা, ওই চৌর্যবৃত্তি তাকে আহত করে। তাদের আদিগুরু মহাপ্রভু গোপীদাস কখনও ব্রহ্মচর্যকে আবশ্যিক বলেননি। বস্তুত, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত উদার। স্বয়ং ভগবতী স্ত্রীভাবে লীলা করেছিলেন মহাপ্রভু গোপীদাসের সঙ্গে। নারীকে তিনি কখনও বলেননি অস্পৃশ্য। বলেননি কামিনীরূপই তার পরিচয়। তিনি বলতেন, নারী নইলে পুরুষ অর্ধ, পুরুষ নইলে নারী। দুইয়ে মিলে তবে না পূর্ণাঙ্গ মানুষ!
কেউ ব্রহ্মচারী হতে চাইলে বাধা নেই। গোপীদাস-প্রবর্তিত মতে তা অবশ্যকর্তব্য নয়। কিন্তু কালের নিয়মে অন্য প্রভাবও প্রতিষ্ঠালাভ করে। অতএব শুদ্ধাচারী বৈষ্ণবের নানা ধৰ্ম এই মঠেও এখন প্রাধান্য পায়। শুদ্ধাচারীরা মহাপ্রভু গোপীদাসকে কখনও পূর্ণ বৈষ্ণব মনে করেননি। পূর্ণ সম্মানও দেননি কখনও। এখন গোপীদাস-মতাবলম্বীরা অনেক ক্ষেত্রে শুদ্ধাচারীর মত অনুসরণ করছে। হিন্দু সংস্কৃতিতেই আছে ব্রহ্মচর্যের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। সেই শ্রদ্ধা এখানে ও সঞ্চারিত এমনই বিপুল যে তার জন্য ছলনাও করতে হয়।
পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে প্রায় দশ বছর ছিল ময়না বৈষ্ণবী। বিশাল কর্মকাণ্ডের এই শ্রীপাটে সে ছিল একজন নামকরা কর্মী। ভোর হতে কাজ শুরু করত সে। থামত রাত গভীরে গড়ালে।
ভগবানগোলার এই পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজি। তিনিই এই মঠের প্রধান। তবে মঠ পরিচালনার প্রধান সহায়ক এখন ব্রহ্মচারীরা। মঠের পরিচালনা কর্মে এই ব্রহ্মচারীদের প্রাধান্যও সাম্প্রতিক ভাব। মহাপ্রভু গোপীদাসের এমন নির্দেশ ছিল না। কোনও বিধানও ছিল না ব্রহ্মচর্য স্খলিত হলে তার শাস্তি হিসেবে। কিন্তু এখন সকল বিধান আছে।
ব্রহ্মচর্য পালন করা সত্ত্বেও দু-একজনের পদস্খলন হয়েই যায় বৈষ্ণবীদের সান্নিধ্যে। জানাজানি হলে শাস্তি একটাই। মঠ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাধারণ কর্মী করে দেওয়া হবে। কেউ কেউ বৈষ্ণবীর সঙ্গে কণ্ঠীবদল করে মঠ ছেড়ে গিয়ে গৃহী হয়। পদাবনতির অবমাননা মানতে না পেরে অনেকে একলাই চলে যায় মঠ ছেড়ে।
মহাপ্রভু গোপীদাস যে কয়েকটি মতে কঠোর ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল বহুগমন। এর ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। এক সঙ্গী বা সঙ্গিনী বর্তমান থাকতে গোপনে বা প্রকাশ্যে অন্যগমনে তিনি পাপ দেখেছিলেন। শোনা যায়, বহুবিবাহকারী পুরুষ শিষ্যত্ব অভিলাষী হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন।
স্বয়ং ভগবতী ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তাঁর সাধনসঙ্গিনী। নারীকে তিনি চিরকাল পূজা করেছেন মহাশক্তিরূপে। নারীর অবমাননা যাতে কোনওভাবে না হয় তার বিধান দিয়ে গেছেন। একই গৃহে নারী ও পুরুষের একত্র বসবাস, কর্ম, সাধনভজনও তাঁর কাছে নিন্দনীয় ছিল না। তিনি বলতেন, একত্রে থাকলে তবেই সংযমের শক্তি পরীক্ষা করা যায়। তাঁর মতাবলম্বী মঠগুলিতে একই গৃহপ্রাঙ্গণে আলাদা আলাদা ব্যবস্থায় বসবাস করে শিষ্য ও শিষ্যারা। পরিচালন শৃঙ্খলার জন্য রাত্রি নটার পর শিষ্যাদের ঘরে অন্তরীণ হতে হয়।
পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে আছে জগন্নাথ গোস্বামী অবধূতের লেখা চৈতন্যচরিতকথার পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপির জন্যই এই মঠ শ্রীপাট আখ্যা পেয়েছে। এখানকার প্রধান বিগ্রহ বালগোপাল, গৌরগোপাল, গৌরগোবিন্দ এবং জগন্নাথ। মহাপ্রভু গোপীদাসেরও পাথরের মূর্তি একখানি আছে, সেই সঙ্গে আছেন দেবী ভগবতী। এক ভাস্কর ভক্ত গড়ে দিয়েছিল।
ময়নার প্রত্যেকদিনের প্রথম কাজ ছিল রোজ ফুল তুলে এই বিগ্রহগুলির জন্য মালা গাঁথা। এই কাজটি সে করত সম্পূর্ণ মনোযোগে। প্রতিদিন সে গাঁথতে চাইত আলাদা আলাদা রকমের মালা। এরপর সে যেত নিত্য দরিদ্রসেবা কর্মশালায়। প্রতিদিন অন্তত পঞ্চাশজন দরিদ্রনারায়ণের সেবা হয় শ্রীপাটে। আয়োজন সামান্য। ডাল, ব্যঞ্জন আর ভাত। কিন্তু খিদের মুখে সে-ও অমৃত। এই সামান্য আয়োজনটুকুও বৃহৎ পর্বে হত বলে সেখানে পরিশ্রমের অন্ত ছিল না।
শ্রীপাটে আছে আরও সব কর্মযজ্ঞ। আছে গরিব ও অনাথ ছাত্রদের থাকা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা। আছে অসহায় বৃদ্ধদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। একশত কুড়ি বিঘে জমি আছে এই শ্রীপাটের। ময়নার জমির মতো এমন উৎসর্গ করা জমিও আছে অনেক। আস্তে আস্তে বিধিব্যবস্থা মেনে সেগুলি শ্রীপাটের খাস সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত হবে। জমির ঊর্ধ্বসীমা সম্পর্কে নানাবিধ আইন হয়ে যাওয়ায় শ্রীপাটকেও এখন রীতিমতো হতে হয় বৈষয়িক। বয়স্কসেবা, ছাত্রসেবা, দরিদ্রনারায়ণসেবা, বিগ্রহসেবা প্রভৃতির জন্য আলাদা আলাদা ট্রাস্ট করে জমির মালিকানা ভাগাভাগি করে নিতে হয়। শ্রীপাটের ওই বিশাল ক্রিয়াকর্মের খরচ শুধু জমির আয়ে যেমন চলে না তেমনই শিষ্যদের অনুদানেও চলে না পুরোপুরি। উপার্জনের উৎস হিসেবে লাগে দুই-ই। এবং, এত কালের এই শ্রীপাট, দরিদ্র আতুর অনাথের নির্ভরস্থল, তাকে গুটিয়েও আনা যায় না। ব্রহ্মচারী পরিচালকবর্গকে ঈশ্বরভজনার পাশাপাশি তাই বিষয়কর্ম নিয়েও ভাবতে হয়। সাহায্য নিতে হয় পেশাদারি পরামর্শদাতা ও আইনজ্ঞের, হিসেবরক্ষকের। বৈরাগ্য নামেই। নইলে মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিন তাকে প্রকারান্তরে জড়িয়ে থাকে জগৎসংসার।
অতএব শুধুমাত্র জমির আয়ে এতবড় কর্মযজ্ঞ চলতে পারে না, এখানেও আছে শিষ্যদের দানের অর্থ—এই বাস্তব উপলব্ধি হতে একথা অস্বীকার করা যায় না যে প্রধান মোহন্ত বাবাজির শিষ্যসংখ্যা যত বেশি হয়, মঠের আয় তত বাড়ে। এর আগে নারায়ণদেব মোহন্ত মহারাজের শিষ্যসংখ্যা ছিল দশ হাজার। এখন শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজির শিষ্যসংখ্যা ছ’ হাজার স্পর্শ করেছে।
মঠের বিশাল কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য প্রয়োজন অনর্গল অর্থের যোগান। প্রভূত আয়ের জন্য প্রচুর শিষ্য প্রয়োজন ঠিকই। তবে ময়না বৈষ্ণবীর গুরু শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজি মহারাজ অধিক শিষ্যত্বদানের বিরোধী। তিনি বলেন—
অবৈষ্ণব সঙ্গত্যাগ, বহু শিষ্য না করিবে।
বহু গ্রন্থকলাভ্যাস ব্যাখ্যান বর্জিবে ॥
বহু শিষ্য করতে না চেয়েও ছ’ হাজার সংখ্যাটি বড় কম নয়। তা ছাড়া শিষ্যসংখ্যার হিসাবে মহাপ্রভু গোপীদাসের কোনও নিষেধ নেই। তিনি বলতেন, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তর করা বা দীক্ষা দেওয়া পাপ। নইলে মানুষ মুখাপেক্ষী হলে শিষ্যত্ব দিতে বাধা কী!
শিষ্যের সংখ্যা বৃহৎ হওয়ার জন্য গুরুরও গুণ কিছু বৃহৎ হওয়া চাই। যে-গুরু নিজেই তার গুণপনার সীমা বোঝে, সে বহু শিষ্য করার সংকল্প নিয়েও আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারে। গুরুনিন্দা মহাপাপ। তবু ময়না বৈষ্ণবী সত্যের খাতিরে মনে মনে স্বীকার করে, এই মত হল নারায়ণদেব মহারাজের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজির দ্বন্দ্ব। শ্রীকৃষ্ণপাদ প্রভুজি কোথাও কোথাও নায়ায়ণদেব মহারাজের তুলনায় নিজের বিশেষত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। শ্রীকৃষ্ণপাদের চেয়ে নারায়ণদেব অনেক বেশি খ্যাতিমান এবং জনপ্রিয় ছিলেন।
একবার এক বয়স্ক শিষ্য প্রশ্ন করেছিলেন—অধিক শিষ্য না করলে আস্তে আস্তে ভক্ত সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে না কি প্রভুজি মহারাজ?
প্রভুজি মহারাজ বলেছিলেন—ভক্ত ঈশ্বরে প্রণত। গুরুর শিষ্যসংখ্যা বৃহৎ হল কি না তাতে কিছু এসে যায় না।
—কিন্তু ভক্ত ও গুরু দু’জনেই তো শ্রীকৃষ্ণের রূপ। তাই নয় কি? ব্রহ্মণ, আত্মন, ভগবান, গুরু ও ভক্ত। ভক্তের সঙ্গে সংযোগ মানে কি ঈশ্বরেরই এক রূপের সঙ্গে সংযোগ নয়? এ তো যত বেশি হয় ততই ভাল। তা ছাড়া মহাপ্রভু গোপীদাস কখনও অধিক শিষ্যত্বে নিষেধ করেননি। তিনি বলপ্রয়োগের বিরোধী ছিলেন।
—শোনো, রূপ গোস্বামীর ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে আছে, ন শিষ্যাননুবণীত গ্রন্থান, নৈবাভ্যসেদ্বহন্—অর্থাৎ বেশি শিষ্য করো না, বেশি বই পড়ো না। স্বয়ং রূপ গোস্বামীর ভাষ্য এটা। আমার কথা নয়। আমি অনুসরণ করছি মাত্র।
সেই বয়স্ক শিষ্য বিনীত প্রশ্ন তুলেছিলেন আবার—স্বয়ং প্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের তো বহু শিষ্য ছিল। আমাদের মহাপ্রভু গোপীদাস বহু শিষ্য লাভ করেছিলেন। তা ছাড়া, মহাপ্রভু গোপীদাসের মত তো সর্বদা শুদ্ধাচারী বৈষ্ণবকে অনুসরণ করেনি। তাঁর মার্গ মৌলিক। তাঁরই নির্দেশ আমাদের মান্য করার কথা। বৈষ্ণব হয়েও আমরা শক্তির আরাধনা করি কেন?
—এখানে কিন্তু বহু শিষ্য না করা বলতে অনধিকারী শিষ্যের কথা বলা হয়েছে। বহু গ্রন্থ বলতে ভগবৎবহির্ভূত গ্রন্থ পাঠ না করতে বলা হচ্ছে।
—অনধিকারী কারা? শ্রীচৈতন্যদেব তো জাতি-ধর্ম মানেননি। মহাপ্রভু গোপীদাসও মানেননি। তাঁর একমাত্র নিষেধ ছিল বহুগামী মানুষের বিষয়ে।
—তবু তাঁরও নিশ্চয়ই বিচার ছিল। যথেষ্ট অন্ত্যজশ্রেণির কাছে মহাপ্রভু গোপীদাস যাননি। লালন ফকির, সিরাজ সাঁই যেখানে পৌঁছেছেন সেখানে ভগবান চৈতন্যদেব কোথায়?
—ক্ষমা করবেন মহারাজ গুরুদেব। এ আপনি কী বললেন? অস্পৃশ্য নিচুশ্রেণির মানুষকে শিষ্যত্ব দিয়েই তো মহাপ্রভু গোপীদাস তাঁর সাধক জীবনের সূচনা করেন। বহুদিন উচ্চবর্গীয় মানুষ তাঁকে ব্রাত্য করে রেখেছিল। সিরাজ সাঁই ও লালন সম্পূর্ণ পৃথক চিন্তার ধারা। বৈষ্ণবের সঙ্গে তার কিছু মিল থাকলেও অমিলই বেশি। কিন্তু কথা তা নয়। কথা হল, সিরাজ সাঁই, লালন যেখানে পৌঁছতে পেরেছিলেন, সেখানে পৌঁছবার উদ্দেশ্য নিয়েই কি শ্রীচৈতন্যদেবের যাত্রা শুরু হয়নি? এতদিনে কি তাঁর সেখানে পৌঁছে যাবার কথা ছিল না? তাঁর কাছে সকল মানুষই ছিল সমান। মানুষের স্তরভেদ করেছেন পরবর্তী গোস্বামী মোহন্তরা। কিন্তু জাতিভেদ করা তো অবৈষ্ণবীয়। আমি বলব, বৈষ্ণবীয় পথ থেকে কিছুটা সরে এলেও মহাপ্রভু গোপীদাসই একমাত্র ভগবান চৈতন্যের আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন।
—এ তথ্য তুমি কোথায় পেলে? এ কি তোমার ব্যাখ্যান? তা হলে কি তুমি বলতে চাও মোহন্তরা অবৈষ্ণবীয় কর্মে লিপ্ত? তুমি কি জান গুরু শিষ্যের বিচার করার অধিকারী?
—হ্যাঁ। কিন্তু গুরু স্বয়ম্ভূ নন। তাঁকে মানতে হবে আদর্শ। মানতে হবে মহাপ্রভুর বিধান। মূল মত থেকে, মূল আদর্শ থেকে সরে গেলে গুরুকে অস্বীকার করা হয়। ঈশ্বরকে লঙ্ঘন করা হয়।
—তুমি কী বলতে চাইছ? মূল আদর্শের বিচ্যুতি হচ্ছে কোথায়?
—আমি জানি মহারাজ, আমার অপরাধ মাপ করবেন, শিষ্যত্ব দেবার আগে আপনি জাত বিচার করেন। পুরসভায় ডোমের চাকরি করে বলে একজনকে আপনি শিষ্যত্ব দিতে অস্বীকার করেছেন। আর বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কে যে কথাগুলি আমি বললাম, তার কোনওটাই আমার কথা নয়। নারায়ণদেব মহারাজের সময় থেকে আমি এখানে আসছি। তাঁর ব্যাখ্যা শুনেছি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি শিষ্যত্ব দেবার পক্ষপাতী ছিলেন।
—তুমি কি জানো সেই ব্যক্তির উপপত্নী আছে? তুমি কি জানো আমার বহু শিষ্য নিম্নবর্গীয়? —এ যুগে কারওকে নিম্নবর্গীয় বললে মানুষ অপমানিত হয় মহারাজ। তা ছাড়া ওই ব্যক্তিকে আমি চিনি। তার কোনও উপপত্নী নেই। তাকে এ অপবাদ দেওয়া হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি জানি শুদ্ধবাদী মঠ সংখ্যায় ও ক্ষমতায় বিপুল। তাদের সংস্পর্শে এলে এই মঠেরও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মহারাজ, যারা আমাদের ভগবানকে অস্বীকার করেছে, মহাপ্রভু গোপীদাসকে যারা শুদ্ধচিত্ত স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের অনুসরণ করতে চাওয়া গর্হিত অপরাধ। নারায়ণদেব মহারাজও তা-ই মনে করতেন।
অন্য ভক্তরা উসখুস করছিল। গুরুদেবের সঙ্গে তর্ক করার কথা তারা ভাবতে পারে না। এই শিষ্য বৃদ্ধ এবং সৌম্য। বহুদিন ধরে মঠে যাতায়াত করছেন কিন্তু মন্ত্র নিয়েছেন অল্পদিন হল। মঠের যারা পুরনো কর্মী তারা প্রত্যেকেই এই ব্যক্তিকে চেনে।
শ্রীকৃষ্ণপাদ মহারাজ এই ব্যক্তির কথায় জ্বলে উঠেছিলেন। তাঁর মুখ-চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করছিল। তিনি ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলেছিলেন—তুমি কার শিষ্য? আমার, নাকি নারায়ণদেব মোহন্তর? আমাকে এত কথা বলার স্পর্ধা তোমার হয় কী করে?
সেই শিষ্য প্রণত হয়ে বলেছিলেন—আপনার শিষ্য আমি প্রভু। তা ছাড়া মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের থাকা উচিত। আমারও আছে। স্বাধীন মতের অধিকার না থাকলে সংগঠন লোপ পায়। আমি যদি অন্যায্য বলে থাকি আপনি দয়া করে খণ্ডন করুন। আমি মাথা পেতে নেবা
—তা হলে আমার ব্যাখ্যাই তোমাকে মানতে হবে। শ্রীপাটে এখন আমিই প্রধান। আমার কথাই নিয়ম।
বৃদ্ধ হাত জোড় করে বলেছিলেন- তা ঠিক। শিষ্যত্বের অধিকারের বিচার গুরুর। নিত্যানন্দ বণিকদের দীক্ষা দিয়েছিলেন। নরোত্তম দত্ত ব্রাহ্মণ ডাকাতদের উদ্ধার করেছিলেন। গুরু রামকৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন স্বয়ং কৈবর্ত জাতীয়। আমাদের মহাপ্রভু গোপীদাসও তো কৈবর্ত।
শ্রীকৃষ্ণপাদ মোহন্ত বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর শরীর কাঁপছিল। গলা কাঁপছিল। ময়না বৈষ্ণবী সহ সব শিষ্যরা স্তব্ধ হয়ে দেখছিল ওই দৃশ্য। পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটের ওই সন্ধ্যা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল কোনও অঘটনের প্রতীক্ষায়। শ্রীকৃষ্ণপাদ বলেছিলেন—তুমি যে-ই হও, তুমি দুর্বিনীত। তুমি অসম্ভব অহংকারী। তোমার স্পর্ধা সহ্যাতীত। তোমার মঠে আসার অধিকার আমি কেড়ে নিলাম।
সেই বৃদ্ধ মানুষটিও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন— গুরু দেবতা। গুরু কৃষ্ণের অংশ। ভগবতীর অংশ। গুরুনিন্দা মহাপাপ। কিন্তু যে-গুরু উপদেশ এবং সদাচার দ্বারা শিষ্যকে মুক্তি দিতে পারেন না তাঁকে ত্যাগ করতে হয়। আমি আপনাকে ত্যাগ করলাম।
—তুমি তুমি, তুমি…
শ্রীকৃষ্ণপাদ মহারাজের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় টলতে টলতে তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিলেন। শিষ্যদের মধ্যে কোলাহল উঠেছিল। গুরুর অপমানে অনেকেই আহত হয়েছিল। প্রচুর গোলমাল সহকারে তারা বৃদ্ধকে অর্ধচন্দ্র দ্বারা শ্রীপাটের বাহির করতে চেয়েছিল। চেনা মানুষগুলির ওই উগ্রচণ্ডাল মূর্তি ময়না বৈষ্ণবীকে হতবাক করেছিল। যদিও কয়েকজন শান্তিকামীর প্রচেষ্টায় ওই উগ্রতা ব্যাপক হতে পারেনি। সব মানুষই একযোগে শুভবুদ্ধি হারায় না বলে পৃথিবীতে আজও কল্যাণ সম্ভব হয়। সেইদিন শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ নিজেই চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে একবার বিগ্রহগুলিকে প্রণাম করতে চেয়েছিলেন। সেই অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি।
সেই রাত্রে ঘুম আসেনি ময়না বৈষ্ণবীর। একটা মানুষকে বিগ্রহ প্রণাম করতে দেয় না যারা তারা কীসের ব্রহ্মচারী, কীসের বৈষ্ণব! কোথায় তাদের বৈরাগ্য? জিতক্রোধ না হলে কীসের গুরু?
গুরুনিন্দা মহাপাপ! ময়না বৈষ্ণবী দু’ হাত কপালে ঠেকিয়েছিল। কিন্তু সত্যের খাতিরে একথা সে না ভেবে পারেনি যে গুরু আসলে মানুষের দেহধারী। তাঁরও আছে ক্ষমতার প্রতি লোভ, যশের প্রতি আকাঙ্ক্ষা। শ্রেষ্ঠত্বের মোহ ও ঈর্ষা। শ্রীকৃষ্ণপাদ মহারাজ যে জিতকাম, জিতরিপু নন তার পরিচয় তো স্বয়ং বিশাখা বৈষ্ণবী!
সেই রাত্রে ময়নার শ্রীপাটে থাকার ইচ্ছে একেবারে চলে যায়। মন তার লাগছিল না অনেকদিনই। কিন্তু সে সারাক্ষণের কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। সে-রাত্রে ভেবেছিল— আর কেন? এবার বেরিয়ে পড়ার উপযুক্ত সময়। যৌবনে সহায়হীন ময়নার আশ্রয় দরকার ছিল। এখন সে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায়। আর ভয় কীসে! মঠে বহু পুরুষের আহ্বান সে উপেক্ষা করেছে। উপেক্ষা করার শক্তি তার আছে। এসবে আর ডর করে না। সংযম তার করায়ত্ত।
কিন্তু শ্রীপার্ট ছাড়ার কথা সে পরদিনই বলতে পারেনি। গুরুদেবের মন বুঝে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে বলেছিল। সে ঘুরে বেড়াতে চায়। মাধুকরী করে জীবিকার্জন করতে চায়। সে তখন মনে মনে গুরুর অন্ধ অনুগামিনী থাকতে পারছিল না। গুরুনিন্দা মহাপাপ—এই বাণীও তাঁর চিন্তনকে রুখতে পারেনি। তা ছাড়া, ওই বৃদ্ধের মতো গুরুত্যাগ করার ভাবনা তার পক্ষে কল্পনাতীত ছিল। সে জানে, অতখানি ক্ষমতা নেই তার।
অবশেষে ময়না পেয়েছিল তার বাঞ্ছিত মুক্তি। আর ঘোষপল্লির মঠে যে সে বেপরোয়া ও প্রকৃত অর্থে স্বাধীন—এই প্রতিপত্তি পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে।