২৭
পোষ মাসে ফতেমা গো
ইন্নছ থানের ভাও।
কোল ছাড়িয়া কোলের যাদু
কোন থানে যাও॥
কোল ছাড়িয়া কোলের যাদু
কোলের লইল মনি।
দেখিলে প্রাণ জোরাজুরি
না দেখিলে মরি ॥
কলাবাগানের পাশে নদীর ধারে সে একলা বসে আছে। শীতের স্তিমিত নদী পাড় বরাবর অর্ধচন্দ্রাকারে ভেঙে নিয়েছে খানিকটা জমি। ঠান্ডা হাওয়া তার কানে এসে লাগছে।— সে পরোয়া করছে না। সে ভাবছে, এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ! কিছুই করার ক্ষমতা তার নেই। এখনও সুকুমার পোদ্দারের মত বা অনুমোদন সংগ্রহ করার মতো কিছুই সে করতে পারেনি। বুকের মধ্যে সেই সাহস অর্জিত হয়নি এখনও। আর সাহস না পেলে সে কী করতে পারে! মনে মনে তার বাবার সঙ্গে সে কথা বলেছে অনেকবার। নানাভাবে। নানা ভঙ্গিতে। রাগ করে। শান্ত হয়ে। কিন্তু বাবার মুখোমুখি এলে মাথা নামিয়ে চলে যাচ্ছে। এবং সুকুমার পোদ্দার সরাসরি তাকে একটি প্রশ্নও করেননি। কিংবা তাঁর ব্যবহারেও প্রকাশ পায়নি এমন কিছু, যা থেকে সে শঙ্কিত হতে পারে। কিন্তু তাঁর আপত্তির কথা সে মায়ের কাছ থেকে শুনেছে। এমন নয় যে সুমিত্রা এসে সরাসরি তাকে কিছু বলেছেন। খুব সাবধানতার সঙ্গে কথা শুরু করেছিলেন তিনি। সুমিত্রার কথায় সেই সাবধানতা রয়েছে বরাবর। সে জানে না, তার বাবার ব্যক্তিত্বই এর কারণ কি না। তার সদাই মনে হয়, মা কেবল তার বাবার মুখপাত্র হয়েই রয়ে গেলেন এ সংসারে। অথচ মাকে কোনও অনুযোগ করতে কখনও শোনেনি সে। হতে পারে, সুমিত্রার নিজের ভূমিকা বিষয়ে তৃপ্তিবোধ রয়েছে। কিংবা যে-মানুষ নিজের জোরে সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি আনয়ন করে, তার প্রতি সকলেরই থাকে সম্ভ্রম। সঙ্গে ঈর্ষা থাকলেও থাকতে পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু সম্ভ্রম থাকবেই। এমনকী তারও রয়েছে সুকুমার পোদ্দারের প্রতি অসীম সম্ভ্রম। যদিও তার ওপরে বহরমপুরের চালের আড়ত দেখাশোনার দায়িত্ব ন্যস্ত আছে, এবং এই দায়িত্ব একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার প্রথম পদক্ষেপ, তবু সে জানে, সে কোনওদিন পুরোপুরি সুকুমার পোদ্দার হতে পারবে না। তার আছে অশেষ দুর্বলতা। সে নিজেকে সুকুমার পোদ্দারের জায়গায় কল্পনাও করতে পারে না। অবশ্য সে জানে না, সুকুমার পোদ্দার বরাবরই এমন ছিলেন কিনা। পুরনো আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে একদিন সে পেয়েছিল একটি খাতা। পদ্য লেখার প্রচেষ্টা বহুবিধ চিহ্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিল তাতে। হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলোয় লেগে থাকা ফিকে নীল কালিতে লেখা বর্ণগুলি তার বাবার চরিত্রের যতেক প্রাগিতিহাস ধরে রেখেছে। সেখানে কি কোথাও সেই সুকুমার নামের তরুণটির জোতদার, আড়তদার, ব্যবসায়ী ও কূট রাজনীতিক হয়ে ওঠার আভাস ছিল? ছিল না! মানব চরিত্র ভাঙে গড়ে ভাঙে গড়ে। এই গড়াপেটার কোনও ঋজু লেখচিত্র নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে দূরের দিকে তাকাল। ছোট ছোট ডিঙি ভেসে রয়েছে জলে। এখন তার বহরমপুরের আড়তে থাকার কথা। কিন্তু সে এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে পারছে না। কবে যেতে পারবে তা-ও সে জানে না। পনেরো দিন হল তুলতুলির সঙ্গে দেখা নেই তার। তুলতুলির কোনও খবরও সে জানে না। কে তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে! এ গ্রামে তার কোনও বন্ধু নেই। সে যতদিন ছোট ছিল ততদিন তার বন্ধু ছিল অনেক। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব বন্ধুরা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কেউ পড়াশোনা ছেড়ে চাষে মন দিয়েছে। তাদের বন্ধুর সঙ্গে কথা কইবার সময় নেই। কেউ তার সামাজিক অবস্থানের জন্য সরে গেছে। বিত্তের প্রাবল্য তাকে হয়তো কিছু স্বার্থান্বেষী লোক জুটিয়ে দিতে পারবে চারপাশে, যেমন তার বাবার আছে। কিন্তু বন্ধু কোথায়? সারা গ্রামে প্রতিটি বয়স্ক মানুষের মুখ খুঁজে খুঁজেও সে এমনও একজনকে পায়নি যাকে সুকুমার পোদ্দারের বন্ধু বলা যেতে পারে।
একমাত্র সম্ভ্রম যাকে করেন সুকুমার পোদ্দার, তাঁর নাম বলাই মণ্ডল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বলাই মণ্ডলকে সম্মান করে। কারও সাতে-পাঁচে না থাকা নির্বিরোধী মানুষ। নির্বিরোধী এবং জ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান যে তাঁর কথায় ফুটে বেরোয় এমন নয়। চিত্রিত হয় তাঁর জীবনযাপনে এ গ্রামের সত্তর শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। বাকি ত্রিশ শতাংশের কম-বেশি অক্ষরজ্ঞান আছে বা পাঠজ্ঞান। কিন্তু নিয়মিত পঠন-পাঠন করেন এই একটিমাত্র মানুষ। এমনকী কলেজ শেষ করেই অনির্বাণ নিজেও পাঠাভ্যাস বর্জন করেছে। তবে সে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। যেমন পড়েন সুকুমার পোদ্দার। তাদের বাড়িতে দৈনিক আজকাল এবং গণশক্তি আসে নিয়মিত। তা ছাড়াও পঞ্চায়েত দপ্তরের কাছাকাছি গণশক্তির জন্য একটি বোর্ড করা হয়েছে। প্রতিদিনের কাগজ ওই বোর্ডে লাগিয়ে রাখা হয়। এই বোর্ডের জন্য, যারা সাক্ষর তাদের মধ্যে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে। তাতে লাভ কিছু হয়েছে কি না সে জানে না। এ গ্রামের যে কোনও সিদ্ধান্তে সুকুমার পোদ্দারের অভিমতই, আজও পর্যন্ত, শেষ কথা। সে নিজেও তা টের পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার নিজের জীবনও এমনকী দাঁড়িয়ে আছে সুকুমার পোদ্দারের একটি সম্মতি বা অসম্মতির ওপর।
সে দু’হাতে নিজের চুলগুলো মুঠো করে ধরল। কী করবে সে! কী করবে! সুমিত্রা বলেছিলেন—উনি তো তোর জন্য পাত্রী দেখছেন।
আচমকা কথাটি বলেছিলেন সুমিত্রা। আর সে অবাক হয়েছিল। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলেছিল— পাত্রী?
—হ্যাঁ। বয়স হচ্ছে। পাত্রী দেখতে হবে না?
সে বলেছিল-পাত্রী দেখার আগে আমাকে একবার জিগ্যেস করলে না মা?
—কী বলছিস তুই অনু? ওঁর কথার ওপর কথা বলবি তুই?
—বিয়েটা তো আমার হবে মা।
—তো তাতে কী? তুই কি নিজের পাত্রী নিজেই সন্ধান করবি নাকি?
—আমি এখন বিয়ে করব না মা।
—তা বললে তো হবে না। সময়ের কাজ সময়ে করতেই হবে। আমাদেরও বয়স হচ্ছে অনু।
সে চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে জানে মায়ের বক্তব্য এ-সংসারে খাটে না। তবু মাকেই খড়কুটোর মতো করে আঁকড়ে সে নিজের বক্তব্য তার বাবার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল-বাবাকে পাত্রী দেখতে বারণ করে দাও মা।
—কেন বল?
—আমি নিজে একজনকে পছন্দ করেছি মা।
—সে পছন্দ খাটবে না সেটা বুঝতে পারছিস না তুই অনু?
—তুমি জানো?
—সহদেব দাস বাড়িতে এসেছিল অনু। তোর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
—সে কি!
এত তাড়াতাড়ি সহদেব দাস বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হবেন, সে ভাবেনি। সে তুলতুলির পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করছিল। সুকুমার পোদ্দারের সঙ্গে সহদেব দাসের কী কী কথা হয়েছে জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল সে। কিন্তু মাকে সরাসরি একথা জিগ্যেস করতে বাঁধল তার। সে এমন আশঙ্কাও করছিল, সুকুমার পোদ্দার সহদেব দাসের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেননি। স্বার্থে আঘাত লাগলে সুকুমার পোদ্দার চূড়ান্ত নিষ্ঠুর হতে পারেন।
তবু, প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, এটুকুই তার খানিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে। প্রাথমিক আপত্তি পরে কেটে যেতেও পারে। সে আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করে। সে কোনওক্রমে বলে—তুমি কি ছিলে?
—কোথায়?
—যখন কথা হয়।
—না। আমি থাকব কেন? পরে শুনেছি সব
—সহদেবকাকা কি একেবারে, মানে, ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল মা?
—ব্যাপারটা ভাল হয়নি। তোর বাবা একেবারে না বলে দিয়েছেন।
—কেন মা? তুলি কি খারাপ?
—সে আমি জানি না বাবা তুলি ভাল না খারাপ। তবে তোরা বড্ড বাড়াবাড়ি করেছিস অনু। আমবাগানে, কলাবাগানে! ছি ছি! এসবের কি খুব দরকার ছিল? আমাদের মানসম্মান নিয়ে একবার ভাবলি না?
—মা, অসম্মানজনক কিছু তো…
—থাক, থাক। আর বলিস না। গ্রামে সামান্য কিছু হলেই লোকে সাতকাহন করে বলে। আর তোরা তো… মেলামেশা করেছিস, একটু রেখে-ঢেকে করলে কী হত! সে মেয়ে তো শহরে পড়তে যায়। বহরমপুরে ওর সঙ্গে দেখা করিসনি তুই?
সে মাথা নেড়েছিল। লজ্জায় ও ভয়ে কণ্ঠরুদ্ধ ছিল তার। সে চেয়েছিল লোক-মাধ্যমে তার বাবা ব্যাপারটা জানুন। খুব প্রচার হোক। যাতে অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরে বাবা অসম্মতির কথা না বলতে পারেন। কিন্তু তার সুকুমার পোদ্দারকে চেনার বাকি ছিল সে উপলব্ধি করতে পারছিল। সুকুমার পোদ্দার নামে মানুষটা, যিনি তার পিতাও, শুধু কি ব্যবসায়ী একজন? শুধু কি গ্রামের একচ্ছত্র শক্তিধারী পঞ্চায়েতের মাথা? একই সঙ্গে মানুষটা কি অসম্ভব বেপরোয়া ও নন? বেপরোয়া না হলে কেউ শক্তি অর্জন করতে পারে না।
তাকে নির্বাক দেখে সুমিত্রা বলেছিলেন— তো দেখাসাক্ষাৎটা ওখানেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারতিস। গ্রামে টেনে নিয়ে এলি কেন? মেয়েটিকেও বলতে হবে অত্যন্ত নির্লজ্জ।
—মা!
—ঠিকই বলছি। বেহায়া মেয়ে। বাপ-কাকার সামনেও ঢলাঢলি করতে লজ্জা নেই? ছি, ছি! লেখাপড়া শিখে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
—মা ওর দোষ নেই।
—চুপ কর। চুপ কর অনু। ও, ও ও! আর বেহায়াপনা করিস না। ওখানে মন দেবার রুচি হল কী করে তোর? কোথাও তো আমাদের সঙ্গে মেলে না।
অনির্বাণ দু’হাতে চোখ চাপা দিয়ে শুয়েছিল বিছানায়। সুমিত্রা বসেছিলেন তার পাশে। ছেলের এই ভঙ্গি হয়তো-বা তাঁর কাছে লেগেছিল করুণ। বহু তিরস্কারের পর মাতৃহৃদয় কোমল হয়ে এসেছিল। তিনি ছেলের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন—জানিস তো ওঁকে। কেন এসব করতে গেলি? এরকম বাড়াবাড়ি না করলে আমি ওঁকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলতাম। হয়তো কোনও ফল হত। কত লোক কতরকম কথা বলে কান ভাঙায়। আকথা বলার লোকের তো অভাব নেই। তোর বাবার মন বিষ করে দিয়েছে বলে বলে। সেদিন সহদেব দাস আসার পর থেকে একেবারে ক্ষেপে গেছেন।
সে আর কিছুই বলতে পারেনি। তুলতুলির বিষয়ে খারাপ মন্তব্যগুলি নিয়ে সারাক্ষণ গুমরেছে। এবং সে আর পারছে না। তুলতুলিকে না দেখে থাকতে পারছে না। কোনও কিছুতে মন লাগছে না তার। কাজ খারাপ লাগছে। খেতে খারাপ লাগছে। শুতে খারাপ লাগছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব—সবই তার খারাপ লাগছে। ব্যর্থ-ব্যর্থ-ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। সর্বাংশে। সে ভেবেছিল একরকম। তার ফল হয়েছে উল্টো। সত্যিই যদি সুমিত্রার ওপর নির্ভরশীল হত সে, তা হলে কি ভাল হত! সে বুঝতে পারে না। সকল অসহায়তা নিয়ে একা বসে থাকে।
—একা একা কী করছ এখানে বসে?
চমকে তাকাল অনির্বাণ। তার সামনে একটি মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। লুঙ্গি পরা। রোগা, লম্বা। পেতে আঁচড়ানো চুল। সে যেন লোকটিকে দেখেও দেখছে না। নিজের জগৎ হতে এই লোকটির দিকে মন তুলে আনার কোনও শক্তিই তার নেই। তার মুখ ফ্যাকাশে। দৃষ্টি শূন্য।
লোকটি বলল—আজ আড়তে যাওনি? হে হে।
এতক্ষণে লোকটা চেনা হয়ে ধরা দিল তার কাছে। মোবারক আলি। জেলেপাড়ার আকবর আলির ভাই। আকবর আলি প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসে বলে তাকেই সে চেনে ভাল করে। কিন্তু মোবারক আলির সঙ্গে তার কথা হয়েছে কালেভদ্রে। সে মুখের বিমর্ষতা অটুট রেখেই বলল—না। যাইনি। শরীর ভাল নেই।
জবাব দিয়েই সে ভাবল, এই কথা সে না বললেও পারত। কেন বলল কে জানে। হয়তো তার মন এই মুহূর্তে কথা বলতে চাইছিল।
মোবারক আলি খৈনি ডলছিল। ঠোটের ভাঁজে দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল—তা শরীরের আর কী দোষ?
সে অবাক হয়ে তাকাল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, শেষ যেদিন সে আর তুলতুলি এখানে বসেছিল সেদিন নদীর বাঁকের কাছে বসেছিল এই লোকটাই। সেদিন সে লোকটাকে অগ্রাহ্য করেছিল। আজও তেমনই অগ্রাহ্য করার ইচ্ছে হল তার। এখন কোনও অপ্রিয় অজানা মানুষের সাহচর্য সে সহ্য করতে পারছে না। সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাবার জন্য সে বলল-এদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলে বোধহয় মোবারকচাচা?
—আরে চাচা কী! চাচা কী! মোবারক বল, মোবারক। আমি আর তোমার চেয়ে কত বড়! তা ছাড়া তোমার বাবা হলেন গাঁয়ের মাথা।
সে অবাক চোখে তাকাল। এইসব কথাবার্তার নাম আমড়াগাছি। গায়ে-পড়া ভাব লেগে আছে এতে। মোবারক আলির কোনও উদ্দেশ্য আছে সে বুঝতে পারছিল কিন্তু কী উদ্দেশ্য হতে পারে তা ভেবে দেখতে তার ইচ্ছে করছিল না। তার অনুমতি না নিয়েই মোবারক আলি বসে পড়ল তার সঙ্গে কিছু তফাৎ রেখে। সে বলল-তোমার দাদাকে তো চাচাই বলি। তাই…
—আরে ছি ছি! দাদা অনেক বড়।
—তুমি কোনও কাজে যাচ্ছিলে?
—কাজ? না না। তোমাকে একা বসে থাকতে দেখে এলাম। তোমার মনের অবস্থা তো জানি। এদিকে তো তার মা তাকে মেরে মুখ ফুলিয়ে দিয়েছিল।
—কী! তুমি কী করে জানলে?
জানব না কেন? গ্রামের সবাই জানে। পোদ্দারবাবু তো সহদেব দাসকে না বলে দিয়েছেন। সেই শুনে দাসের বউ মানে তুলতুলির মা রেগে আগুন। মেরে হাত-পা ভেঙেই দিত। শেষ পর্যন্ত পাড়ার বউরা গিয়ে আটকাল।
কাপতে শুরু করল অনির্বাণ। সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণা ছেয়ে গেল তার। তুলতুলির শরীরে নেমে আসা প্রত্যেকটি মার একে একে উঠে আসতে লাগল তার ওপর। সে বড় বেদনায় মুখে হাত চাপা দিল। তার খেয়াল রইল না যে সামান্য আলাপি মোবারক আলির সামনে এই বিহ্বলতা প্রকাশ করা উচিত হচ্ছে না। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ছটফট করছিল। তার বুকের মধ্যে খানখান হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, এখুনি, এই মুহূর্তে গিয়ে তুলতুলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তার ব্যথার জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয়। শুধুমাত্র একটিবার অন্তত দেখতে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাকে উন্মাদ করতে থাকল। সে ব্যাকুলভাবে মোবারক আলির দিকে তাকাল। বলল—ওকে কি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে?
মোবারক আলি বিড়ি খাচ্ছিল। দু’বার জোরে জোরে টান দিয়ে বলল—রেখেছিল এই ক’দিন। চব্বিশ ঘণ্টা মা পাহারা দিয়ে রাখছিল। কিন্তু আজ দেখলাম।
—কোথায়, কোথায় দেখলে?
—বাস ধরল। বহরমপুরের বাস। বোধহয় কলেজ গেল।
—কলেজ?
সে উঠে দাঁড়াল। সেও চলে যাবে বহরমপুর। তাকে তুলতুলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। মোবারক আলিও উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে।
—তুমিও যাবে নাকি বহরমপুর?
সে থমকে দাঁড়াল একমুহূর্ত। এই লোকটা কি বাইরে বলে বেড়াবে যে সে তুলির সঙ্গে দেখা করার জন্য বহরমপুর গেছে? একবার ভাবল, মোবারক আলি যাতে কারওকে কিছু না বলে তার জন্য সে অনুরোধ করবে। কিন্তু তার ভাবনা স্থায়ী হল না। মোবারক আলি তার অনুরোধ মান্য করতে বাধ্য নয়। সে বরং, কিছু গাম্ভীর্যের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল—মোবারক মিঞা। চলি। খবরটা দেবার জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমি।
বিগলিত হাসল মোবারক আলি। চোখ দু’টি ঝলসে উঠল তার। বলল—যে কোনও কাজে আমাকে ডাকলেই আসব। যদি মানে, ইয়ে, তুলতুলির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে হয়।
সম্মতি জানিয়ে এগোতে লাগল সে। রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তাকাল চারপাশে। গ্রামের সীমানায় এই রাস্তা গ্রামের সমতল থেকে বেশ উঁচু। রাস্তায় দাঁড়ালে গ্রামের অনেক ভেতর থেকে দেখা যায়। কেউ কি তাকে নজর করছে? এটা সে বুঝেছে, গ্রামের লোক, বাইরে থেকে তাদের দেখলে মনে হবে শান্ত, কোনও দিকেই হুঁশ নেই নিজের কাজটি ছাড়া, কিন্তু তলে তলে তারা সব দেখেশুনে রাখবে আর লাগিয়ে দেবে যথাস্থানে। কারণ খবর দিতে পারার মধ্যে নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা যায়। আর শুধু গ্রামের লোকই বা কেন, শহরের মানুষের মধ্যেও এ চরিত্র সে দেখেছে। আসলে মানুষ খবর জানাতে উৎসুক হয়ে থাকে এবং খবর শুনতেও উৎসাহী। যথাযথ খবরই মানুষকে দেয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা।
ভাবতে ভাবতে সে একটি বাসে উঠে পড়ে। এবং চারপাশে তাকায়। এই ভেবে সে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে যে তার নিজের ব্যবসার কাজেও তার বহরমপুর যাবার কথা। সে স্থির করে, প্রথমে একবার সে আড়তে যাবে। সেখানে নিজের উপস্থিতি জাহির করে তারপর সরাসরি কলেজে গিয়ে তুলতুলির সঙ্গে দেখা করবে। একবার পকেটে হাত রাখল সে। টাকা-পয়সা যা আছে, হয়ে যাবে। কোথাও বসতে হবে তুলতুলিকে নিয়ে। কোনও ঘেরা জায়গায়। সে বাসস্ট্যান্ডের দিকে নতুন হওয়া মহুয়া রেস্তোরাঁর কথা ভাবতে থাকল। কেবিন করা আছে। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে। কিন্তু হঠাৎই হতোদ্যম হয়ে যায় সে। এত আয়োজন করে তুলতুলিকে সে কী বলবে! সে তো কোনও সমাধান করতে পারেনি এখনও। তার ভালবাসার পরিচয় হিসেবে সাহসের স্বাক্ষর রাখেনি কোথাও। যদি তুলতুলি জানতে চায়— তুমি কী ব্যবস্থা করেছ অনুদা—সে কোনও কিছুই বলতে পারবে না। বলতে পারবে না, সুমিত্রা তাকে বলেছেন, বিয়ের সম্বন্ধের কথা। তা হলে সে কী বলবে? সে শুধু দেখবে তুলিকে। শুধু বোঝাতে চাইবে যেন সে ধৈর্য ধরে। যেন হঠাৎ অন্য কোথাও বিয়েতে মত না দিয়ে ফেলে। সে একটা ব্যবস্থা করবেই। দরকার হলে তুলতুলিকে জোর করবে রেজিস্ট্রি বিয়ের জন্য। বলবে- যদি ভালবাস আমাকে, মত দাও।
সে আড়তে যায়। কাজকর্ম তদারকি করে বা তদারকির ভানমাত্র করে। জানতে পারে, সুকুমার পোদ্দার বেশ কয়েকবার এখানে এসে ঘুরে গেছেন। প্রচুর চালের বস্তা বোঝাই হচ্ছে একটা লরিতে, সে সেই বস্তাগুলির পরিবহণ সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর করে বেরিয়ে পড়ে এবং একটা রিকশা নিয়ে নেয়।
কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল সে। কোথায় ক্লাস হচ্ছে তুলতুলির সে জানে না। সে স্থির করল, প্রথমে ক্যান্টিনে যাবে। এক কাপ চা খেতে খেতে নজর রাখবে সামনের চত্বরে। তুলতুলি কি আশা করবে না তার আগমন? ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে যায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে ক্যান্টিনেই আবিষ্কার করে ফেলে তুলতুলিকে। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল তুলতুলি। যেন সে জেনেশুনেই বসে ছিল অনির্বাণের আগমন-সম্ভাবনা। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল। মুখে লালের আভা। অনির্বাণের গালে বাসি দাড়ির দিকে তাকিয়ে তুলতুলির কান্না পেয়ে গেল কারণ সে জানে অনির্বাণ পরিচ্ছন্ন ও প্রসাধিত থাকতে পছন্দ করে। আর তুলতুলিকে দেখে অনির্বাণের মনে হল, এই শরীর কত আঘাত সহ্য করেছে শুধু তারই জন্য। এই মন শুধু তাকেই ভালবেসে হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণাকাতর। তার ইচ্ছে হল, এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী যদি কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়ত, জেগে থাকত কেবল সে আর তুলতুলি, বড় ভাল হত। সে তা হলে তুলতুলিকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে ফেলতে পারত।
তখন তুলতুলি এগিয়ে এল তার দিকে। বলল চল।
কলেজ থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিল তারা। কেউ কোনও কথা বলছিল না। রিকশাওয়ালাকে কোথায় যেতে হবে বলে তুলতুলির দিকে তাকাল অনির্বাণ। তুলতুলি মুখ শক্ত করে বসে আছে। কী ভাবছে তার কোনও কিছুই অনুমান করতে পারল না সে। এ শহরে এভাবে গেলে তারা কোনও পরিচিত লোকের চোখে পড়ে যেতে পারে। তবু এই ঝুঁকি তাদের নিতে হল। রিকশার ছাতনা তুলে দিল সে। তুলতুলির গায়ে তার গা ঠেকে আছে। এই মুহূর্তে তারা কত কাছাকাছি। তবু যেন তারা বসে আছে পৃথিবীর দু’ প্রান্তে। তার ইচ্ছে করল তুলতুলির হাতখানি হাতে নেয়। তাকে কাঁধে মাথা রাখতে বলে। কিন্তু সমস্ত অনুচ্চারিত থেকে হু-হু ছুটে চলেছে রিকশা। নেতাজি মূর্তির পাশ দিয়ে হুড়মুড় করে বাঁক নিচ্ছে। সে কিছুটা বেপরোয়া হওয়ার চেষ্টা করতে থাকল মনে মনে এবং মহুয়া রেস্তোরাঁর সামনে নেমে পড়ল। একটি কোণের কেবিন বেছে বসল তারা। মুখোমুখি। তাদের পাশে একটি খোলা জানালা। সেই জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাস টার্মিনাসের কিছু অংশ। তুলতুলি সেদিকে তাকিয়ে আছে। একটি সবুজ চাদর সে গায়ে জড়িয়েছে। অনির্বাণ কিছুক্ষণ দেখল তুলতুলির অন্যমনস্ক মুখ। তারপর টেবিলে রাখা হাতখানিতে চাপ দিল। তুলতুলি তাকাল না। সে বলল—কী খাবে?
—কিছু না।
—কিছু তো খেতেই হবে তুলি। না হলে ওরা বসতে দেবে কেন?
—তোমার যা খুশি বলে দাও।
মেনু কার্ড রেখে গিয়েছিল বেয়ারা। অনির্বাণ নিজেই উঠে গিয়ে নানারকম খাবারের ফরমাশ দিল। ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ কাটলেট, চিপস। বেশি করে খাবার বললে তারা বসতেও পারবে বেশিক্ষণ। ফিরে এসে তুলির হাত দুটি ধরল সে। টের পেল তুলি কাঁপছে। এখনও বাইরের দিকে ফেরানো তার মুখ। সে তাকাল। তুলতুলি ঠোঁট চেপে আছে। এবার তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে দেখল সে। সে ঝুঁকে বসল। জোর করে তুলির মুখ ফিরিয়ে নিল নিজের দিকে। তার হাতে পড়ল টুপটাপ অশ্রুবিন্দু। তুলি, তার দিকে তাকিয়েই চাপা কান্না নির্বাধ করে মুখ ঢাকল। সে শুধু স্খলিত গলায় বলতে পারল–তুলি। তাকাও। তুলি। লোক আসবে।
এই পনেরো দিনে অনেক কান্না জমেছিল। অনেক কথা জমেছিল। কিছু অভিযোগও ছিল তার মধ্যে। ছিল ভয় ও আশঙ্কার অনুলিপি। ভেবেছিল, দেখা হলে সব বলবে। একটি একটি করে বলবে। কিন্তু এখন এক নির্বাধ রোদন তাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে সব। কিন্তু পৃথিবীতে কাঁদবার জন্যও চাই কিছু বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য স্থান। এই রেস্তোরাঁ তেমন নয় এমন ধারণায় চাদর দিয়েই মুখ মুছে নিল তুলি। চোখ নিচু করে বলল—আমি যে… আমি যে… তোমাকে ছাড়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছি না অনুদা।
—ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন তুলি?
—তুমি জানো না? বাবা গিয়েছিল পোদ্দারজেঠুর কাছে।
—জানি।
—তা হলে? পোদ্দারজেঠু কী ভীষণ অপমান করেছে বাবাকে তুমি জানো? আমার জন্য বাবার এত অপমান। কিন্তু আমি কী করব বলো! কতবার ভেবেছি, আর তোমার সঙ্গে কথাও বলব না। কিন্তু পারছি না। আমি পারছি না।
—তুলি, শান্ত হও। বাবা একবার না বলেছে মানেই যে সব শেষ হয়ে গেল তা তো নয়।
—তোমার সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। সবাই জানে। সবাইকে জানিয়ে শুনিয়েই দেখা হচ্ছে।
—তোর সম্বন্ধও তো দেখা হচ্ছে তুলি। তাতে কী? আমরা তো অন্য কারওকে বিয়ে করছি না।
—কতদিন বলো, কতদিন ঠেকিয়ে রাখব? আমি মরে যাব অনুদা। ঠিক মরে যাব।
—তুমি যদি মরে যাও, আমিও বাঁচব না তুলি। তোমাকে ছাড়া আমিও বাঁচব না।
তাদের খাবার এল। তারা ছুঁয়েও দেখল না তখন। ঠান্ডা হতে থাকা খাবার নীরবে শুনল সব কথা। তুলতুলি বলল— মা বলেছে, আমি যদি আর তোমার সঙ্গে মিশি তা হলে গলায় দড়ি দেবে।
—মা তোকে মেরেছে তুলি?
—খুব লেগেছে, না?
—তুমি কী করে জানলে?
—জানলাম। তুই এতটুকু কষ্ট পেলেও আমি টের পাই।
—মার খেতে ভয় পাই না আমি। তোমার জন্য একটু মার খাব, তাতে কী! কিন্তু বাবার অপমান হলে আমার খুব কষ্ট হয়।
—তা তো হবেই।
—কিছু করতে পারো না তুমি অনুদা?
—রেজিস্ট্রি বিয়ে করবি তুলি?
—বিয়ে? তারপরেও যদি সে-বিয়ে না মানেন জেঠু?
—–সে পরে দেখা যাবে। বিয়ে করা থাকলে আমরা দু’জনেই অনেক জোর পাব তুলি।
তুলতুলি চুপ করে তাকিয়ে রইল জানালা দিয়ে। তারপর সেদিকে তাকিয়েই, মুখ না ফিরিয়েই বলল—অনুদা, জেঠু বলেছেন, তোমাদের অনেক টাকা, তাই বাবা আমাকে তোমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে।
—ছিঃ!
সংকুচিত হয়ে গেল অনির্বাণ। তুলতুলি বলে চলল —যদি বিয়ে করে নিই, সকলেই বলবে আমার বাড়ির লোক ইচ্ছে করে এ বিয়ে সমর্থন করেছে। টাকার লোভে। তা কি আমি হতে দিতে পারি? আমার বাবা-মাকেও যে খুব ভালবাসি আমি।
—ওঃ!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনির্বাণ। তুলতুলি বলল—বিয়ে করলেও বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়। জেঠু চাইলে তা করতে পারেন। পারেন না বলো?
অনির্বাণ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকল। তার বলা হল না-যদি ভালবাসিস আমাকে তা হলে রাজি হয়ে যা। সে-কথা নীরবেই মাথা কুটে মরল ভিতরে। এটা ঠিক যে কাগজের বিয়ে অস্বীকার করার জন্য সুকুমার পোদ্দার অনেক দূর যেতে পারেন। কতদূর সে আন্দাজ তার নেই। কিন্তু এটাও ঠিক, রেজিস্ট্রি বিয়ে করে তা টিকিয়ে রাখার লড়াই করার মতো সাহসও তার নেই। বড় হতাশ লাগল তার। কিছুই করতে পারে না সে। কিছুই না। তার মরে যাওয়াই উচিত। মরা, মরা। মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু। সহসা সে সোজা হয়ে বসে। তুলির দুই হাত শক্ত করে ধরে। বলে—আমাকে তুমি খুব ভালবাস তুলি?
—খুব ভালবাসি অনুদা। তুমি জানো না?
—আমার জন্য তুমি সব করতে পারবে?
—সব। সব। শুধু তোমাকে ছেড়ে যেতে বোলো না।
—মরতে পারবি আমার জন্য তুলি? যদি বলি চল আমরা একসঙ্গে মরি, পারবি?
তুলি বিহ্বল হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর অনেক দূরের গলায় বলল— পারব অনুদা।
—এ ছাড়া আমার আর রাস্তা নেই রে তুলি। মৃত্যুর পর যদি তোকে পাই! তোকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা না-থাকা সমান।
এরপর নীরবে আহার করল তারা। আহার শেষে চা খেতে খেতে মৃত্যুর পরিকল্পনা করল। ঠিক দুপুর একটার সময় যে দূরপাল্লার রেলগাড়িটি বহরমপুর স্টেশন অতিক্রম করে যায়, তার সামনে তারা ঝাঁপ দেবে। একসঙ্গে।
এবং সিদ্ধান্ত নিতে পেরে বড় নিরুদ্বেগ বোধ করল তারা। নির্ভীক হয়ে উঠল। আর মাত্র একটি রাত্রি তাদের আয়ু। টেবিলের ওপর দিয়ে কাছাকাছি মুখ এনে তারা চুম্বন করল পরস্পরকে। অধরে-ওষ্ঠে জড়াজড়ি করে রইল অনেকক্ষণ। এই প্রথম তারা পেল পরস্পরের জিহ্বার স্বাদ। জিহ্বা শোষণ করতে হয় শিখিয়ে দেয়নি কেউ। কিন্তু সহজাত প্রেরণায় একের জিহ্বা প্রবেশ করল অপরের মুখগহ্বরে। পরস্পরের স্বাদ মেখে, লালা মেখে, নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল তারা। খেয়াল রইল না তাদের খোলা জানালার কথা। কয়েকজন বাসকর্মী দেখে ফেলল এই চুম্বনদৃশ্য এবং রসাল মন্তব্য করল নিজেদের মধ্যে তারা জানতেই পারল না। কথা রইল, পরদিন ঠিক এগারোটায়, এখানেই তারা দেখা করবে। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো কিছুক্ষণ একান্তে কাটাবে।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল তারা। তুলতুলি বলল— কলেজে আরও দুটো ক্লাস আছে, করি?
—কর।
—তুমি কোথায় যাবে?
—আড়তে যাব একবার।
আবার একটি রিকশায় উঠল তারা। তুলতুলিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে অনির্বাণ চলে এল আড়তে। লরিতে তখনও চালের বস্তা উঠছিল। সে দাঁড়াল সেখানে, আর টের পেল, তার মন আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছে। আর কোনও দুঃখ নেই। ক্ষোভ নেই। হতাশা নেই। সে তাকাল চারপাশে। এইসব আর দেখতে পাবে না সে। শেষবার। এই শেষবার। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। তার সারা মুখে লেগে আছে তুলতুলির জিভের স্বাদ। সে তুলতুলির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল গভীর।
.
সে ঘুমোল। কিন্তু নির্ঘুম রাত জেগে থাকল তুলতুলি। বাবার জন্য, মায়ের জন্য, ভাইদের জন্য কান্না পেল তার। বুক মুচড়ে কান্না পেল। এই ঘর, এই বালিশ-বিছানা, তার পড়ার বইগুলি— যা কিছু তার প্রিয়, তার আপন, সব সে ফেলে চলে যাবে কাল। আর দেখা হবে না। আর কোনওকিছু দেখা হবে না। সে না থাকলে কি বাবা-মা কষ্ট পাবে না? খুব পাবে। কিন্তু সে কী করতে পারে! অনির্বাণকে ছাড়া সে বাঁচবে না। দারুণ কষ্টের মধ্যেও সে মনে মনে নেড়ে চেড়ে দেখল অনির্বাণের স্বাদ, গন্ধ, উষ্ণতা। তার ইচ্ছে করল ওই মুখ বুকে চেপে ধরে। একবার বুকে চেপে ধরে। ‘অনুদা, অনুদা, তোমাকে আমি ভীষণ ভালবাসি বলতে বলতে সে টের পেল ভোর হচ্ছে। কাক ডাকছে জড়ানো স্বরে। আর একটু পরেই উঠে পড়বে মা-বাবা। সে উঠে চাদর জড়িয়ে দাঁড়াল। তার পাশেই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে তার দুটি ভাই। সে উঠোনে এল। হিম পড়ছে। কুয়াশায় মুড়ে আছে চরাচর। সে উঠোনে ঘুরল ফিরল। রান্নাঘরে গেল। গোহালে গেল গোরুগুলির কাছে। গোরুগুলির নাম রেখেছিল সে। জোড়া বলদ দুটি ভোলা আর শম্ভু। গাভী দুটি শ্যামলী আর মন্থরা। হাঁসের খাঁচায় হাত রাখল। এখানে আছে প্যাক-প্যাক হাঁস, ফুটি-ফুটি হাঁস, শৈল আর মরাল। উঠোনের কোণে তারই লাগানো শিউলিগাছের কাছে গেল। কুড়িয়ে নিল দু-একটি ফুল। এই শীতেও তারা ফুটেছিল। আর পড়েছে ঝরে।
আকাশে সাদার ছোপ লাগছে। সে ঘরে গেল। তার ইতিহাসের খাতা নিয়ে লিখল— মা, আমি চলে যাচ্ছি। চিরতরে।
আবার কান্না পেল তার। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে আরও একটি পাতায় সে লিখল- বাবা, আমি তোমার অভাগা মেয়ে। আমাকে ক্ষমা কোরো।
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। বাবা বাবা বাবা। খাতা বুকে জড়িয়ে সে ঠান্ডা মেঝেয় বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবার খাতা খুলল। অন্য পাতায় লিখল—আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
কলেজে বেরোবার আগে একটা কাগজে লুকিয়ে একটু সিঁদুর নিল সে। তারপর মাকে প্রণাম করল। আশা অবাক হলেন। সে বলল—আমার ইতিহাস পরীক্ষা আছে মা।
—এখন কীসের পরীক্ষা?
—ক্লাস টেস্ট।
—ভাল করে পড় মা। তোর ওপর আমাদের কত আশা।
গলার কাছে টনটন করে উঠল তুলতুলির। তার মনে হল সে ভেঙে পড়বে। সে এখুনি বলে ফেলবে—মা। আমি আজ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু অনুদা? ‘না অনুদা। তোমার কাছে যাব আমি।’ ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ল সে। আর পেছনে তাকাল না। ইতিহাসের খাতা সে রেখে এসেছে সবার ওপরে। যাতে খুঁজলেই তার চিঠিগুলি পাওয়া যায়। বাসে উঠে তার আর কান্না পেল না। বরং আশ্চর্য আনন্দে ভরে গেল মন। সে একজনকেই ভালবেসেছে। সেই তার সব। তার মা তাকে শিবের পুজো করিয়েছেন ছোটবেলা থেকে। এ পূজিলে কী হয়? সে জানে—নির্ধনীর ধন হয়, সাবিত্রী সমান স্বামী-আদরিণী হয়। পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে, মরণ যেন হয় গঙ্গাজলে। তার কপাল খারাপ। সে স্বামীকে পুত্র দিতে পারল না।
এক ঘণ্টা মহুয়া রেস্তোরাঁর কোণের কেবিনে হাতে হাত রেখে বসে রইল তারা। বিশেষ কথা বলতে পারল না। অনির্বাণ জিগ্যেস করল— ভয় করছে, তুলি?
—তুমি তো আছ। অনুদা?
—বল।
—আমার মাথায় একটু সিঁদুর পরিয়ে দেবে না?
—সিঁদুর?
—আমি এনেছি।
সে ব্যাগ থেকে মোড়ক বার করল। অল্প সিঁদুর নিয়ে তুলতুলির সিথিতে ছুঁইয়ে দিল অনির্বাণ। তুলতুলি হাসল। পরস্পরকে চুম্বন করল তারা। আজ তারা জানালার পর্দা টেনে দিয়েছে। পরস্পরের জিভের স্বাদ নিতে নিতে অনির্বাণ টের পেল তার শরীর, এই মৃত্যুপর্বেও জেগে উঠছে দারুণ। সে ব্যাকুলভাবে বলল-তুলি।
ঘন শ্বাসের সঙ্গে তুলতুলি বলল—বলো।
—আমাকে দেখাবি একবার?
—কী?
—এটা?
সে তুলির স্তন স্পর্শ করল। তুলতুলির মুখ রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়। কিন্তু এখন সে স্ত্রী। পরলোকগামিনী। কী অদেয় থাকবে অনির্বাণকে! চাদরের নীচে একটি একটি করে সে অনর্গল করল বুক। পিঠে হাত দিয়ে খুলে দিল বুকের বন্ধনী। একবার ভীরু চোখে ঝোলানো পর্দার দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল আবরণ। অপলক দেখল অনির্বাণ। আলতো স্পর্শ করল বামস্তন। দক্ষিণ স্তন। আবেশে বন্ধ হয়ে আসছে তুলতুলির চোখ। চাদর টেনে অনির্বাণ নিজেই আবরণ দিল। বিহ্বল গলায় বলল—কী সুন্দর! তুলি! এই দেখে আর মরতে ইচ্ছে করে না রে। আগামী জন্মে আবার তোকে চাই আমি তুলি।
তুলতুলি বলল—খুব লাগবে অনুদা?
—কখন?
চাদরের তলায় হুক লাগাতে লাগাতে তুলি কথা বলছিল।
—যখন ট্রেন… মানে…..
—জানি না তুলি। শুনেছি শেষ মুহূর্তে দেহে যন্ত্রণা থাকে না। ভয় করছে, না রে?
—না।
স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল তারা। তুলতুলি দাঁড়াল যেদিক থেকে ট্রেন আসবে সেদিকেই মুখ করে। দাঁড়াল একেবারে ধারে। অনির্বাণ দাঁড়াল তুলতুলির পাশে। সামান্য তফাতে। কারওকে বুঝতে দেওয়া যাবে না তাদের উদ্দেশ্য। সে তাকাল চারপাশে। ভালই লোক আছে এসময়।
ট্রেন আসছে। তুলতুলি এক ঝলক তাকাল অনির্বাণের দিকে। অনির্বাণ হাসল। সামান্য একচিলতে হাসি। মনে মনে প্রস্তুত হল তারা। ঝাঁপ দেবে। ট্রেন এলেই দেবে। শব্দ এগিয়ে আসছে। আসছে। ট্রেনের তীব্র শিসে কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে সব এলোমেলো। ট্রেনের কালো বিরাট মুখ—ঝাঁপ, ঝাঁপ, ঝাঁপ দিল! স্পষ্ট দেখল অনির্বাণ—তুলতুলি ঝাঁপ দিল। সবুজ চাদর উড়ে গেল। তার শরীরের ওপর দিয়ে নিমেষে চলে গেল গাড়ি—অনির্বাণের শরীর ঘুলিয়ে উঠল—হইচই হচ্ছে, লোক ছুটে আসছে, গতিতে রাশ টানতে চাইছে ড্রাইভার—প্রবল শব্দ হচ্ছে। কী দেখছে লোক? কী দেখছে? একজন ঝাঁপ দিল, অন্যজন দিল না? বুঝতে পেরেছে! বুঝে গেছে সবাই! না না না! বোঝেনি! না না না! প্রবল চিৎকার, তার মাথায়, তার মস্তিষ্কে—সে আবিষ্কার করল সে ভিড়ের থেকে বেরিয়ে পড়ছে, বেরিয়ে ধাপে ধাপে উঠে পড়ছে ওভারব্রিজে— তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যাচ্ছে প্ৰাণপণ।