রাজপাট – ১৯

১৯ 

ভরন্ত কইন্যার পারা 
ভরা শস্যক্ষেত। 
অঘ্রান মিটাইয়া দিয়ো 
সকল প্রভেদ।।
ধনীর ঘরেত দ্যাও 
সোনা ধানের কণা।
কাঙালের ঘরে দিয়ো
পিঠার আল্পনা।।

যে-ভাঙন নদীর পাড়ে, তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে কেবল ভূমির শক্তি। যে-ভাঙন সংসারে লাগে তাকে ঠেকাবার সাধ্য কারও নেই। বলাই মণ্ডল এই ভাঙন স্থগিত করতে পেরেছেন কেবল পৌষমাস পর্যন্ত। 

অঘ্রানের আর কয়েকটা দিন। তারপর পৌষ। ভাদ্রে আর পৌষে লোকে কুকুর-বেড়াল পার করে না। 

নদী ভাঙে। পাড় ভাঙে। মাটি গলিয়ে স্থলভাগ ক্ষইয়ে দেয়। আবার গড়েও দেয় অন্য স্থলভাগ। কিন্তু সংসারের ভাঙনে কেবলই আছে ক্ষয়। ক্ষইতে ক্ষইতে শূন্য অবলম্বন। বলাই মণ্ডল কতই তো দেখলেন। বাপের কুড়ি বিঘে জমি, চার ছেলে ভাগাভাগি করে পেল পাঁচ বিঘা  এই পাঁচ বিঘা আবার ভাগাভাগি হল পরের প্রজন্মের মধ্যে। তারা যা পেল তা না-পাবার সমান। এককালের ভূমিস্বত্ব ভূমিহীনতায় পৌঁছল। 

এই সময়টা কানাই কাজে লাগাচ্ছে অন্যভাবে। তার নিজের পছন্দমতো। প্রথমেই আমবাগানের মাঝবরাবর একটি বেড়া তুলেছে সে। এখন জমি জরিপ করার জন্য পঞ্চায়েতে যাওয়া-আসা করছে। বলাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভাগাভাগির কাজ তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। 

এই দু’দিনের মধ্যেই যে এতখানি উদ্যোগ নিয়ে নেবে কানাই, বলাই মণ্ডল ভাবতে পারেননি। অবশ্য যা ঘটছে, তার কতটুকুই বা তিনি ভাবতে পেরেছিলেন। কানাই জিগ্যেস করেছিল তাঁকে। কোনও বিশেষ জমি নিতে বলাই মণ্ডল পছন্দ করবেন কি না। তিনি বলেছেন—আমার কাছে সব জমিই সমান। তোর যা পছন্দ, তুই নে। 

জরিপ হয়ে গেলে পুরনো দলিলের সঙ্গে মিলিয়ে আধাআধি ভাগ হবে। যেমন হয়েছে আমবাগান। কাগজে-কলমে হতে দেরি আছে। কিন্তু বেড়া দিয়ে কানাই এই ভাগাভাগিকে বিজ্ঞাপিত করেছে। 

আর বেড়া দিয়েছে সে নদীর সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। নিজের জন্য সে রেখেছে পূর্বভাগ, পাড়সংলগ্ন পশ্চিমভাগ রেখেছে বলাই মণ্ডলের জন্য। অর্থাৎ ভাঙন যদি বাগান অবধি পৌঁছয় তবে প্রথমে বলাই মণ্ডলের বাগান আগ্রাসনে যাবে। সমস্ত বাগান পার করে কানাইয়ের অংশে পৌঁছতে সময় লাগবে নদীর। 

বলাই মণ্ডল এই নিয়ে বিবাদে যেতে পারতেন। কিন্তু সব দেখেশুনে তাঁর সকল অন্তর ছিছিক্কারে ভরে গিয়েছে। বিভেদ তিনি চাননি। বিবাদও তিনি চান না। ভাই চলে যাচ্ছে পৃথক হয়ে। তার চেয়ে অধিক হতে পারে কি জমিজমা? 

তীর্থ দেখে বিস্মিত হয়েছিল। বলেছিল—বাবা! কাকা আমাদের শুধু পাড়ের দিকটাই দিল!

বলাই মণ্ডল থামিয়ে দিয়েছেন তাকে। বলেছেন—তোর সামনে পরীক্ষা। তুই পড়ায় মন দে তীর্থ। 

তীর্থ আর কথা বলেনি। কিন্তু বলাই মণ্ডল জানেন, তীর্থ বড় হচ্ছে। সে এখন প্রশ্ন করবেই।

আজ এই সকালেই তিনি এসেছেন আমবাগানে। কেন যে তাঁর আসতে ইচ্ছে করল, তিনি জানেন না। বেড়ার এ-পারের গাছগুলি দেখে বুক ভার হয়ে গেছে তাঁর। ওরা আর তাঁর কেউ নয়। ওই কল্যাণ, ওই মাধব, ওই শৈবলিনী—ওরা আর কেউ না। ওদের স্পর্শ করা যাবে না আর? যাবে না? তিনি পায়ে পায়ে বেড়ার কাছে আসেন। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেন মাধবকে। কে যেন আত্মগত হয়ে কেঁদে ওঠে তখন। অশরীরী নয়ন হতে শরীরী অশ্রুর বিন্দু এসে বলাই মণ্ডলের গায়ে পড়ে। শিহরণ জাগে তাঁর। কানাই কি কেটে ফেলবে? এইসব গাছ কেটে ফেলবে? তাঁরও কান্না পেয়ে যায়। দুই দেহী ও বিদেহীর কান্না মিলেমিশে ঝরে পড়ে ভুঁয়ে। তিনি বেড়া ডিঙিয়ে এই পারে আসেন। জড়িয়ে ধরেন মাধবকে। কাঁদেন। শাখা-প্রশাখাগুলি আন্দোলিত হয় তখন। 

কান্না অবসানে কিছু-বা নির্ভার বলাই মণ্ডল পায়ে পায়ে চলে গেলেন পাড়ে। জল নেমে গেছে। মাটি ক্ষয়ে এবড়ো-খেবড়ো পাড়। নরম রোদ্দুর বিছিয়ে আছে জলে। মৃত্তিকায়। জেলেরা চলেছে ডিঙি নিয়ে। এখন জোয়ারের সময় বুঝি। এক গ্রাম্য সকাল। তাঁর মনে পড়ছে একটি ছড়া। গ্রাম্য সকালের ছড়া। সূর্যোদয়ের সময় হতে গ্রামের কোণে কোণে ঘুম-ভাঙা কর্মসঞ্চার। মাঘমণ্ডলের ব্রতে অনুঢ়া মেয়ে তারই বর্ণনা করে। 

সূর্য ওঠে কোন দিয়া?
সূর্য ওঠে পুবদিক দিয়া।
উঠো সূর্য উদয় দিয়া, 
ব্রাহ্মণের ঘরের কোণ ছুঁইয়া।
ব্রাহ্মণের মাইয়া বড় সেয়ান,
পইতা কাটে বেয়ান বেয়ান।
উঠো সূর্য উদয় দিয়া,
বইদ্যের ঘরের কোণ ছুঁইয়া।
বৈদ্যের মাইয়া বড় সেয়ান, 
ব্রত করে বেয়ান বেয়ান। 
উঠো সূর্য উদয় দিয়া,
ধোপার ঘরের কোণ ছুঁইয়া।
ধোপার মাইয়া বড় সেয়ান, 
কাপড় কাচে বেয়ান বেয়ান। 

বলাই মণ্ডল নদীর পাড় হতে বেরিয়ে, আমবাগান পেরিয়ে, জেলেপাড়ার ধার ঘেঁষে জমির দিকে চললেন। এবার পুরো জমিতে তাঁকে ফসল ফলাতে হবে না। তা হলে মুনিষের সংখ্যা কমাতে হবে। কাকে বাদ দেবেন তিনি? কাকে বলবেন, তুমি আর এসো না? গভীর চিন্তামগ্ন, বিষাদগ্রস্ত তিনি হেঁটে যান, আর ভোরের ছড়া তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যায়। 

উঠো সূর্য উদয় দিয়া, 
ভুঁইমালির ঘরের কোণ ছুঁইয়া।
ভূঁইমালির মাইয়া বড় সেয়ান,
খোলা চাঁছে বেয়ান বেয়ান। 
উঠো সূর্য উদয় দিয়া, 
তেলির ঘরের কোণ ছুঁইয়া। 
তেলির মাইয়া কমলারানি, 
খাড়ার আগে ঢালে পানি। 
ঢালে পানি না লো চাল ধোয়ানি, 
চাল ধোয়ানি না লো মেলে পাতা,
উঠো সূর্য জগন্নাথ— 
জগন্নাথের হাঁড়ি, 
সুবর্ণ নবান্নে প্যাট ভরি। 

আপাতদর্শনে কোনও ছন্দপতন নেই। মায়া সংসার সামলাচ্ছেন। রানি ইচ্ছেমতো তাঁকে সাহায্য করছে কিংবা করছে না। সুমি ও তীর্থ মনোনিবেশ করেছে পড়াশোনায়। সারাদিনের কাজের শেষে বলাই মণ্ডল বসছেন তাঁর লেখা নিয়ে। পাঠাভ্যাস নিয়ে। গ্রামে বিজলি আসার পর এই সুবিধা হয়েছে। সন্ধ্যার পর বই পড়তে অসুবিধা হয় না। এই সময় তাঁর বিশ্রামকাল। এই বিশ্রাম বলাই মণ্ডল পেয়ে যান তাঁর কাব্যচর্চায়। 

তাঁর ঘরে দু’ আলমারি ভর্তি বই। অনেক পড়া। অনেক না-পড়া। একই বই অনেকবার করে তিনি পড়েন। বহু পাঠের মধ্যে দিয়েই আসে উপলব্ধি—এমনই তাঁর বিশ্বাস। দু’দিন হল কবিতা আসছে একের পর এক। সারাদিন মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে নানা শব্দ, বাক্যবন্ধ। এখন তাঁর আরাধনার সময়। হৃদয়ের আঘাত কাব্যলক্ষ্মীর রূপ ধরে ধরা দিচ্ছে কলমে। বলাই মণ্ডল তন্ময় হয়ে থাকছেন। প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করছেন সেই শ্রেষ্ঠ কবিতার—যা লেখার পর তাঁর জীবন ধন্য হবে। কবে আসবে সে? কবে? সেই শ্রেষ্ঠতমা? সেই তারুণ্যে—যখন প্রথম কবিতা ধরা  দিয়েছিল, তখন থেকে অপেক্ষা করে আছেন। কবে আসবে সে? কবে? সে কি আসে? নাকি শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে অপেক্ষা ঘটিয়ে যায় সারাটি জীবন? 

গতকাল তাঁর বেছে রাখা বেশ কয়েকটি কবিতা তিনটি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছে তীর্থ। আর সারাদিন মাঠে কাজ করতে করতে তিনি ভেবেছেন, তিনি কি প্রচারের আকাঙ্ক্ষা করছেন? নিজেকে বোঝা সম্ভব হয়নি। মানুষ ছবি আঁকে কেন? লেখে কেন? গান গায় কেন? কেন? নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। নিজেকে কোথায় প্রকাশ করার জন্য? কার কাছে? এই বিশ্বচরাচরের কাছে। এই মহাবিশ্ব সদাই প্রস্ফুটিত। রহস্য ও প্রকাশ নিয়ে তার নিত্য অভিব্যক্তি। এই গান, এই কবিতা, এই ছবি—সমস্তই ওই প্রস্ফুটিত মহাবিশ্বের সঙ্গে, ওই বিশাল আমির সঙ্গে ক্ষুদ্র আমির যোগ। এই সংযোগ না ঘটাতে পারলে বড় কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্ট একান্তভাবে নিজের। অন্য কেউ তার সন্ধান পায় না। তা হলে সকল প্রকাশই শুধু নিজের জন্যে? 

জীবনযাপনের জন্য শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি অপরিহার্য ছিল না। তবু কোনও এক অপার্থিব প্রেরণায় মানুষ গুহার দেওয়ালে ছবি এঁকেছিল! হয়তো এরই মধ্যে লুকনো আছে পত্রিকায় কবিতা পাঠাবার ইচ্ছা। 

নানারকম গভীর ভাবনায় ডুবে থাকে বলাই মণ্ডলের মন। আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। শান্তির প্রার্থনায় শান্তি বিঘ্নিত হয়। আর শান্তি বিঘ্ন হলে তিনি ইতিহাসের দিকে ফেরেন। মানুষের কীর্তির ইতিহাস। মানুষের শোষণ সংগ্রাম অত্যাচারের ইতিহাস। ইতিহাস না জানলে বর্তমানকে জানা যায় না। নিজেকে জানা যায় না। তিনি বিশ্বাস করেন, কোনও ব্যক্তিমানুষ বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। তার পশ্চাতে রয়েছে মানবেতিহাসের দিগন্তবিস্তৃত পথ। 

এখন চোখ বন্ধ করলেই তিনি দেখতে পাচ্ছেন ভরা ফসলের খেত। এই খেত অর্ধেক হয়ে গেলে তাঁরও পরিশ্রম অর্ধেক হয়ে যাবে। যে-সব মুনিষ তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে, বাধ্য হবে যেতে, তারা কী করবে? এই গ্রামে কাজ পাবে? লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। তাই গ্রামে মজুর উদ্বৃত্ত। অনেকেই, বিশেষত যুবকেরা শহরে চলে যায় কাজ পাবার অভিপ্রায়ে। কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কেউ অন্য কিছু। অন্য কিছু কী? বহুবিধ ন্যায়নীতিহীন কাজ। সীমান্তে মানুষ পারাপার করা। গবাদি পশুর চালান। নানাবিধ দ্রব্যাদির আনা-নেওয়া। এমনকী মাদক এ জেলা সীমান্তবর্তী। আর সীমান্তের চোরাপথে নিত্য পারাপার হয় পাপ এবং আবর্জনা। এসবের জন্য দোষ দেওয়া যাবে না কারওকেই। অবাধ দারিদ্র যেখানে, পাকস্থলী নিংড়ে খিদের উদ্গীরণ; প্লাবনে, বিপর্যয়ে, এমনকী পৈতৃকসূত্রে পাওয়া নিঃস্ব নিরবলম্ব অবস্থায় উপার্জনের হাতছানি মানুষকে ছুটিয়ে মারে। অধিক উপার্জনের আহ্বান প্রলুব্ধ করে অনায়াসে। তখন কে কাকে শেখায় ন্যায়-নীতি। প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল সরকার ভূমিবণ্টনরীতি পালটেছে। শুরু হয়েছে বর্গাদারকে জমির অধিকার দেওয়ার কাজ। তবু এখনও বহু ভূমিহীন কৃষক জমি পায়নি। এই বাংলায় অসংখ্য কৃষক শুধুমাত্র ক্ষেতমজুর হয়েই বেঁচে থাকে আজীবন। 

.

পশ্চিমবাংলা ভূমিসংস্কার আইন অনুযায়ী চলছে জমি জরিপ ও ভূমি সংস্কারের কাজ। বহু যুগ ধরে শোষিত, দারিদ্রের নিম্নসীমায় বসবাসকারী ক্ষেতমজুর ও ভাগচাষিদের বর্গাদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল এই আইন। রায়তদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব নির্ণয় করতে চেয়েছিল। এই সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য : জমিদার, জোতদার ও মধ্যস্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করে ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বন্টন করা। তাতে যে-সামান্য সংখ্যক কৃষক উপকৃত হয়েছিল, তার বাইরে থেকে গিয়েছিল অনেক বেশি। তার কারণ সংস্কারের কাজ যথার্থভাবে পরিচালিত হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রভূত বেনামি জমির অধিকারীকে আড়াল করেছে। দুর্নীতি এবং কর্মীদের ঔদাস্য এই আইনকে প্রতিবন্ধী করেছে। 

জমিদারশ্রেণির বিলোপ করা হলেও গ্রামে আজও আছে জোতদারশ্রেণির ভূস্বামী। এসব জোতদারই গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সুকুমার পোদ্দারকে অবশ্যই এই শ্রেণির জোতদার বলা যায়। 

গ্রামের ছোট চাষিরা নানা কারণে এইসব জোতদারের কাছে ঋণী থাকে এবং অনেকসময় জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। সরকারি উদ্যোগে জমি পেয়েছে এবং পুনর্বার ভূমিহীন হয়েছে, এই দৃষ্টান্ত গ্রামে-গ্রামান্তরে বিরল নয়। এইসব সমস্যার সঙ্গে আছে জমির বিভাজন। এখন বলাই মণ্ডল নিজে যার কবলিত। 

খণ্ডীকরণ আটকাবার জন্য সমবায় কৃষি সমিতির ওপর জোর দিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু তা সফল হয়নি। 

.

সমস্ত দেশেই থাকে ভূমিব্যবস্থার দীর্ঘ ইতিহাস। এই দেশ ভারতবর্ষের অঙ্গ শস্যশ্যামলা বাংলারও আছে তেমন ইতিকথা। সেই ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে চাষিদের করুণ কাহিনি। ধানের পল্লবে পল্লবে তা লেখা আছে। লেখা হয় নতুন করে। বসুন্ধরা আজও বীরভোগ্যা। তবে বীরত্বের সংজ্ঞা বদলে গেছে। বর্তমানের বীর কোনও একাকী বাহুবলী নয়। অর্থ তার প্রধান ক্ষমতা। রাজনীতি তার বল। পোষ্য অনুচরবৃন্দ তার হাতিয়ার। জোর যার জমি তার— এমন আদিম প্রয়োগ এখনও আছে গ্রামে, শহরেও। সতেরোশো তিরানব্বই সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিলেন, আজও তা রয়ে গেছে জনমানসে। 

মুর্শিদাবাদে চাষযোগ্য ভূমিব্যবস্থার বহু ইতিহাস ছড়ানো-ছিটানো আছে প্রাচীন গ্রামগুলিতে। প্রাচীন গ্রামগুলির সংখ্যাও কম নয়। বাজারসাউ, মহলন্দি, পাঁচগ্রাম, কালিকাপুর, বারকোনা, অমৃতকুম্ভ, ভগবানগোলা, মুনিয়াডিহি, সাগরদিঘি, ইন্দ্রাণী, ত্রিমোহিনী, পাঁচথুপি, ব্রাহ্মণগ্রাম ইত্যাদি। 

ত্রিমোহিনী এবং পাঁচথুপিতে পাওয়া গেছে যে-প্রস্তরলিপি তাতে মুর্শিদাবাদে সেন ও পাল আমলের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও পাওয়া গেছে অন্যান্য লিপি ও মুদ্রা। সে-কালেও মুদ্রার মাধ্যমেই রাজস্ব দিতে হত কৃষককে। আবাদযোগ্য ভূমিতে উৎপাদিত শস্য থেকে যে আয় হত, তার অঙ্কের ওপর নির্ভর করত ভূমিকর। পাল আমলে কর হিসেবে কৃষককে দিতে হত এক ষষ্ঠাংশ পরিমাণ শস্য। এই রাজস্ব সংগ্রহের ভার দেওয়া হয়েছিল যাদের ওপর, তারা ক্রমশ হয়ে উঠেছিল নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী। সামন্তশক্তির ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটেছিল তখন। তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে-বিদ্রোহের কথা ইতিহাসে লেখা আছে, তার নাম কৈবর্ত বিদ্রোহ। সে সময় রাজকর্মচারীদের নিষ্কর জমি প্রদান করার রেওয়াজ ছিল। মাসিক বেতনের পরিবর্তে তাঁরা বরং ভূমির অধিকারী হতেন। পাঁচশত পরিবার নিয়ে তৈরি হত একটি গ্রাম। গ্রামের অধিপতি পেতেন এক কুল নিষ্কর জমি, যেখানে বারোটি ষাঁড় ভূমি কর্ষণ করতে পারে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের প্রথা তো ছিলই। 

হিন্দু শাসকদের মতো বাংলার তুর্কি আফগান সুলতানরাও সুফি-সন্ত, মুসলমান ধর্মপ্রচারক বা মুসলমান ধর্ম-শিক্ষকদের নিষ্কর আয়মা জমি প্রদান করতেন। মোগল সম্রাটেরা দান বজায় রেখেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেই দান ফেরত নেবার পথও খোলা ছিল। তাঁদের খেয়ালমতো আয়মা জমি পরিবর্তিত হত খালিসা জমিতে। 

সুলতানি আমলেই প্রথম উদ্ভূত হয় জায়গিরদার শ্রেণি। কিছু অভিজাত ব্যক্তি কেন্দ্ৰীয় রাজশক্তিকে সামরিক সাহায্য করত এবং জায়গিরদারি পেত। এরাই প্রথম স্বত্বভোগী ভূস্বামী। জায়গিরদার বা জমিদারের সঙ্গে এল আরও এক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। তার নাম ইজারাদার। সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে দেবে, এই শর্তে তারা নিযুক্ত হত। 

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময় দিল্লির মসনদকে প্রচুর রাজস্ব দিয়েছিল সুবা বাংলা। কিন্তু এই রাজস্ব বৃদ্ধির অন্তরালে কৃষকদের শোষণ করা হত চূড়ান্তমাত্রায়। 

নবাবি আমলের পর ব্রিটিশরাজ রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠল খুব। সতেরোশো নব্বই খ্রিস্টাব্দে ব্যবস্থা হল দশ বৎসরের জমিদারি। এর তিন বছর পর লর্ড কর্নওয়ালিশ দশ বৎসরের ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করে দিলেন। হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। জমিতে রায়তের কোনও অধিকার রইল না। জমিদার হল জমির মালিক। সে যদি ধার্য রাজস্ব সময়মতো দিয়ে যেতে পারে, তা হলে তার মালিকানায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। এখন এই রাজস্ব দেবে কে? দেবে রায়তরা। খরা হোক, বন্যা হোক, যথেষ্ট ফসল উৎপাদিত হোক বা না হোক— খাজনা দিতেই হবে রায়তকে। এর ওপর সতেরোশো নিরানব্বই সালে হল এক আইন। তাতে বলা হল—রাজস্ব বাকি পড়লে রায়তের যে-কোনও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং রায়তকে গ্রেপ্তার করার অধিকারী হল জমিদার। 

মুসলমান আমলে যেভাবে জায়গিরদার শ্রেণির সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছিল মধ্যস্বত্বভোগী ইজারাদার শ্রেণি, ঠিক সেরকমভাবেই জমিদারের সঙ্গে সঙ্গে এল পত্তনিদার। জমিদারকে একটি নির্দিষ্ট হারে খাজনা দেবার শর্তে তারা পেল খাজনা আদায়ের ভার। আবার পত্তনিদারের অধীনে সৃষ্টি হল দরপত্তনিদার। এবং এতগুলি উপস্বত্বভোগী শ্রেণীর খাঁই মিটিয়ে চাষির হাতে যা রইল তাতে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান সম্ভব হয় না। 

আঠারোশো সাতান্ন সালের মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনব্যবস্থা প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করল ব্রিটিশ সরকার। এ বছরেরই আগস্ট মাসে পাশ হল ‘ভারত শাসন আইন।’ ইংল্যান্ডে তখন মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমল। এর পরের বছর তৈরি হল খাজনা আইন। এই আইনে জমিদারের দাপট কিছু কেটে-ছেঁটে দেওয়া হল। বলা হল, একাদিক্রমে বারো বছর যদি কোনও রায়ত কোনও জমি দখল করে তা হলে সে দখলিস্বত্ব পেয়ে যাবে। জমির পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পায়, শস্যের মূল্য যদি বাড়ে, কোনও রায়তের প্রদেয় খাজনা যদি প্রচলিত খাজনার হারের চেয়ে কম হয়, তা হলে জমিদার খাজনা বাড়িয়ে দিতে পারবে। আবার জমির পরিমাণ কমে গেলে বা শস্যের মূল্য হ্রাস পেলে খাজনার হার কমানোর ব্যবস্থাও হল। খাজনা না দেওয়ার জন্য উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা হবে একমাত্র দেওয়ানি আদালতে, তা-ও বলা হল। 

এরপর জমিব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধনের জন্যও তৈরি হল আইন এবং আঠারোশো পঁচাশি সালে প্রবর্তিত হল বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন। এই আইনের ফলে রায়তের ভূমির ওপর অধিকার বৃদ্ধি পেয়েছিল। জমিদারের অত্যাচারী হাত ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল আরও খানিকটা। এবং এই আইনের মাধ্যমে, জমিদারের অনুমতি ছাড়াই জমি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার লাভ করেছিল রায়ত। 

এবার ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের কাছে জমি হস্তান্তরিত হতে শুরু করল। শুরু হল জমির কেন্দ্রীভবন। ছোট চাষি বা ক্ষুদ্র ভূম্যধিকারী বিবিধ বিপর্যয়ে, দারিদ্রে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল এবং পরিণত হল ক্ষেতমজুরে। অর্থবান শ্রেণি সমস্ত জমি কিনে নিতে লাগল। উঠে এল নতুন জোতদার গোষ্ঠী। 

স্বাধীনতার পর উনিশশো চুয়ান্ন সালে জমিদারি অধিগ্রহণ আইনে জমিদারি প্রথার বিলোপ হল। কিন্তু রয়ে গেল জোতদার শ্রেণি। উনিশশো পঞ্চান্ন সাল থেকে তৈরি হয়েছে বিবিধ ভূমিসংস্কার আইন। এইসব আইনের বলে এখন কৃষি ও অকৃষি উভয়প্রকার জমির সদ্ব্যবহারকারীরা জেলা সমাহর্তার অধীনে রায়তিস্বত্বে ভোগদখলিকার হিসেবে চিহ্নিত যে-কোনও শ্রেণির জমি নিয়ে কোনও প্রজাস্বত্ব সৃষ্টি সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকারি উদ্যোগে অতিরিক্ত জমি বণ্টিত হয়েছে ভূমিহীনদের মধ্যে। বর্গাদারদের নাম সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে। জমির মালিক এবং বর্গাদারের মধ্যে উৎপন্ন ফসলভাগের শর্তও এখন অনেক বেশি সুশৃঙ্খল। তবু, এর থেকে প্রমাণিত হয় না কিছুই। নিরন্ন, অর্ধভুক্ত কৃষক পরিবার গ্রামে গ্রামে রয়ে গেছে আজও। 

ন্যায়ের দণ্ড হাতে স্থবির পড়ে থাকে ন্যায়। ইতিহাস পড়ে থাকে ইতিহাসের মতো। আর মানুষ আইন সৃষ্টি করে আবিষ্কার করতে থাকে আইন অমান্য করার ছল, বল, কৌশল। 

.

বলাই মণ্ডলের বড় ক্লান্তি আসে এইসব ভাবনায়। অন্যায়, প্রতারণা এবং অসত্যের ভাবনায়। বিছানায় শুয়ে তিনি চোখ বন্ধ করেন। তাঁর বুকের মধ্যে বাজে ছলাৎছল ছলাৎছল নদী। আমবাগান তাঁকে আহ্বান করে নিরন্তর। যেন বলতে চায়— এসো। থাকো আমাদের কাছে। ভরসা হও। কখন গ্রাস করবে নদী! কখন চলে যাব জলের তলায়! আর দেখা হবে না কখনও আমাদের তখন! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *