রাজপাট – ১৮

১৮ 

অঘ্রানে ধানের ভরা গোলা
রেখেছিলাম আগল খোলা 
কে যেন সব ধান নিয়েছে লুটে 

রাত্রি গড়িয়ে গেল মধ্যরাত্রির দিকে। বলাই মণ্ডলের দু’চোখের পাতা এক হল না। চোখ বন্ধ করলেই কেবল চোখের সামনে ফাটাফাটা মাটি। অর্ধচন্দ্রাকার গহ্বর। নদীই পাড় ভাঙছে না কেবল। আমবাগানই কেবল গ্রাস করতে উদ্যত হয়নি মহাশক্তি। ভাঙন তাঁর অস্তিত্বে। তাঁর চতুষ্পার্শ্বে। তাঁর সংসারেও। বালির বস্তা দিয়ে, স্পার করে, বাঁধ দিয়ে এ ভাঙন আটকানো যায় না। আজ তিনি তাঁর সন্তানতুল্য কানাইকে এক নতুন রূপে দেখেছেন। এ মূর্তি তাঁর চেনা দায়। এক প্রলম্বিত শ্বাস তাঁর বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে এল। মায়ার সান্নিধ্য আকাঙ্ক্ষা করছেন তিনি। রমণ নয়, সঙ্গম নয়। কেবল এক শান্তির স্পর্শের জন্য কাতর হয়ে আছে চিত্ত। কিন্তু ভাঁড়ার ঘরের এক চিলতে মেঝেয় ওই সান্নিধ্যটুকুর মধ্যে নিরুদ্বিগ্ন সমর্পণ নেই। 

তিনি ভাবছেন কেবল। কানাই এত পালটে গেল কবে? কখন? তিনি তো টের পেলেন না কিছু! আসলে ভাঙনের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না কখনও। মানুষকে ঘিরে তা রচিত হয় কেবল। সশব্দ হোক, আর নিঃশব্দ— সে কেবল অতর্কিত আচরণে। কিংবা কে জানে, পৃথিবীর কোনও কিছুই হয়তো পূর্বাভাস ছাড়া ঘটে না। যেমন ঝড়ের আগে টের পায় পিঁপড়েরা, তেমনই, জগ‍ৎ‍ সংসারের সকল ভাঙনের ছবি ধরা পড়ে কোথাও না কোথাও। কেবল তিনিই থাকেন অসতর্ক, অন্ধ ও বধির। 

বড় অসহায় লাগে তাঁর। মনে মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। যদি হঠাৎ বড় বড় আকারে ভাঙে মাটি? যদি তাঁর প্রিয় সহকারগুলি নদীর গর্ভে চলে যায়! তাঁর বুক ধকধক করে। প্রাণ দাপিয়ে মরে কণ্ঠায়। ভয়ংকর! ভয়ংকর ওলটপালট হা-হা শব্দে নাচে, ঠা-ঠা শব্দে ভয় ছড়িয়ে দেয়। আর বলাই মণ্ডল শয্যা আঁকড়ে ধরেন। ওই ওলটপালটের মধ্যে প্রাণ নিয়ে, কেবল সন্তান-সন্ততি নিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চান। কাঙালের মতো প্রার্থনা করেন জীবন। 

তখন, দূরের নদীর শব্দ বুকে এসে বাজে। অন্ধকারে ভেঙে পড়া, খসে পড়া মাটির কান্না আসে কানে। ধড়ফড় করে উঠে বসেন তিনি। তীর্থও উঠে বসে সঙ্গে সঙ্গে। বলাই মণ্ডলকে  স্পর্শ করে বলে- বাবা! 

বলাই মণ্ডল ফিসফিস করে বলেন—নদী পাড় ভাঙছে। শুনতে পাচ্ছিস? 

তীর্থও ফিসফিস করে বলে—কোথায় বাবা? কোনও শব্দ তো নেই। 

—চল যাবি? 

—কোথায়? 

চুপিসাড়ে পিতা-পুত্র পরস্পরকে প্রশ্ন করে। এবং উত্তর দেয়। 

—আমবাগানে। যাবি? পাড় দেখে আসি। 

—চলো। 

সন্তর্পণে নেমে আসেন তাঁরা শয্যা হতে। নিঃশব্দে দোর খুলে বাইরে এসে দাঁড়ান। আঙিনায় জ্যোৎস্না নেই কৃষ্ণপক্ষীয় এই রাতে। বলাই মণ্ডল টর্চ হাতে আগে আগে চললেন। কনকনে ঠান্ডা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তীর্থর মনে হল, সাদা কাপড়পরা কে যেন বাবার আগে আগে চলেছে। তার ভয় করল। বলাই মণ্ডলের চাদর আঁকড়ে ধরল সে। ফিসফিস করে বলল— কে যায় বাবা? 

বলাই মণ্ডল ছেলের হাত ধরলেন। বললেন— ভয় পেতে নেই বাবা। অমন দেখা যায়। আমার সঙ্গে সঙ্গে চল। 

তীর্থ মনে সাহস আনার চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে আর কোনও বিভ্রম নেই। তবু তৃতীয় কোনও উপস্থিতি তার সঙ্গে সঙ্গে চলে। আমবাগানে প্রবেশ করেন দু’জনে। নিচু শাখাগুলিতে কপাল লেগে যায়। শিশিরে ভেজা পাতা ভিজিয়ে দেয় ত্বক। এক-একটি গাছ তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো। কোনওটার বয়স তীর্থের মতো পনেরো। কিংবা সুমির মতো দশ। 

বাগানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাড়ের দিকে টর্চ ফেলেন বলাই মণ্ডল। তীর্থ সামনের দিকে যায়। বলাই মণ্ডল ফিসফিসিয়ে বললেন— বেশি কাছে যাস না। 

—না। 

বাড়েনি ফাটল। যেমন দুপুরে ছিল, তেমনি রয়েছে। তবু এক আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাবা আর ছেলে। টর্চ নেভানো। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসছে ক্রমশ। মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক আর নদীর ছলাৎছল সির-সির সির-সির। কারা সব লঘু পায়ে চলে যায় পাশ দিয়ে। কতটা সময় কোনও হিসেব নেই। মাথার ওপর অগ্রহায়ণের ঝকঝকে আকাশ। কুয়াশায় ঢেকে আছে পেতনির  চর। 

ফিরে চললেন দু’জনে। আমবাগানে এসে একটি গাছ স্পর্শ করল তীর্থ। সে জানে বাবা আমগাছগুলির নাম রেখেছেন। 

সে বলল—এ গাছের নাম কী বাবা? 

— অমল। 

—ওই গাছ? 

—ওর নাম সন্দীপ। তোকে আমি সব গাছ চিনিয়ে দেব তীর্থ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *