১৭
গৃহস্থ বধূ দেয় তুলসীর গোড়ে বাতি,
ঘুরি আসি তোমার সাথ কাঁধে লইয়া
ছাতি অঘ্রান মাসে নয়া হেউতি ধান,
কেউ কাটে কেউ মারে কেউ করে নবান।
ধান কাটা হতে আর সপ্তাহখানেক বাকি। এরপর ভূমিকে বিশ্রাম দিয়ে, সার দিয়ে, কর্ষণ করে আবাদযোগ্য করে তোলার কাজ। অঘ্রানের রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে গাছে। আকাশ গভীর নীল। বর্ষণরিক্ত মেঘ ছেঁড়া-ছেঁড়া ভেসে যাচ্ছে দুরে। আসছে এক ব্যস্ততার সময়।
পরিপুষ্ট ধানের ভারে গাছগুলি নুয়ে আছে। সন্তানবতী নারীর সঙ্গে এর চিরকালের তুলনা। ধানগাছগুলির দিকে তাকিয়ে বলাই মণ্ডলের যাবতীয় মনখারাপ ভাল হয়ে যেতে থাকল। একবার আমবাগানে যাবার সংকল্প নিয়ে জমি থেকে উঠে তিনি পশ্চিমমুখে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর মনে হল ছেলেকে একবার আমবাগান বিষয়ে সাবধান করে দেবেন। বন্ধুদের নিয়ে সে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। কখন পাড় খসে পড়বে। আর তখন যদি সে উপস্থিত থাকে!
ভাগীরথীর পাড় বরাবর, গ্রামের এই পশ্চিমপ্রান্তে কেবলই আমবাগান ও জেলেপাড়া। জেলেপাড়া শেষ হলে কিছুদূর কলাবাগানের বিস্তার। তারপর আবার ধানিজমি। এই জেলেপাড়াতে বলাই মণ্ডলের কিশোর ছেলেটির বন্ধুর অভাব নেই। তীর্থ তার নাম। শান্ত সে, কিন্তু ঘরকুনো মোটেও নয়। দশম শ্রেণিতে পড়ছে সে এখন। অষ্টম শ্রেণিতে যখন পড়ত তখন থেকে নিজে সাইকেল চালিয়ে সে বহরমপুরের স্কুলে যায়। তার আগে একজন মুনিষ তীর্থকে নিয়ে বাসে আসা-যাওয়া করত। ব্যয়সাপেক্ষ ছিল সেই পদ্ধতি। এবং একজন মুনিষের সেবা হতে আবাদভূমিকে বঞ্চিত করা। এখন এই সাইকেলে আসা-যাওয়া করার মধ্যে দিয়ে তীর্থ দায়িত্বশীল এবং সপ্রতিভ হয়ে উঠছে।
এ গাঁয়ে শুধু প্রাথমিক স্কুল। আশেপাশের গ্রামগুলিতেও তাই। আবার সব গ্রামেই যে প্রাথমিক স্কুল আছে তা-ও নয়। কোথাও স্কুল আছে কিন্তু পড়ানোর লোক নেই। স্কুলবাড়িতে মাকড়সার জাল। বারান্দায় রোদে-জলে বিশ্রাম নেয় গবাদি পশু। অধিকাংশই নিরক্ষর মানুষের গ্রাম কিংবা সই করতে পারার মতো বিদ্যে। কোথাও মক্তব-মাদ্রাসা কিছু-বা শিক্ষা দেয়। কিন্তু ছেলে-মেয়েকে নিয়মিত স্কুলে বা মাদ্রাসায় পাঠাবার অভ্যাস নেই বাবা-মায়ের। সেই তো চাষ করে খাবে শেষ পর্যন্ত। মাছ ধরে খাবে। গোড়া থেকে এই বিদ্যেই শিখিয়ে দেওয়া ভাল। গ্রাম চতুষ্কোনা বহরমপুর শহরের নিকটবর্তী বলে এ গ্রাম কিছু-বা শিক্ষাপ্রবণ। এবং বলাই মণ্ডল যে তীর্থকে উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া মনস্থ করেছেন তা-ও এই জোরেই যে ছেলেকে দূরে পাঠাতে হবে না।
বলাই মণ্ডলের আমবাগানের পাশেই সুকুমার পোদ্দারের বাগান। এ বাগান আরও অনেক বেশি বড়। এ গ্রামে পোদ্দারই সবচেয়ে বেশি জমির মালিক। শোনা যায়, নামে-বেনামে এ গ্রামের অর্ধেক জমিই তাঁর। এমনকী পাঁচকুড়া গ্রামেও ছড়িয়েছে তাঁর জমির সীমানা। কমিউনিস্ট পোদ্দার একটি চালকলের মালিক। এ ছাড়া তিনি একজন চালের আড়তদার। বহরমপুরে এই চালের আড়ত ছাড়া তাঁর আছে একটি পেতল-কাঁসার দোকান। বলাই মণ্ডল পরের সম্পদে লালায়িত নন। আপন সম্পদে তিনি তুষ্ট। এ গ্রামে সুকুমার পোদ্দারের প্রতিপত্তিও তিনি সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন। এখন তাঁর ও পোদ্দারের স্বার্থ বাঁধা কারণ ভাঙন বৃদ্ধি পেলে সমস্ত আমবাগান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ভাবতে ভাবতে আমবাগানে প্রবেশ করলেন বলাই মণ্ডল। নিচু ঝুপসি বাগানের মাটিতে সূর্যের আলো অল্পই পৌঁছয়। মাটি তাই ঠান্ডা। স্যাঁতসেঁতে। এইসব আমবাগানে বাস করেন বিদেহী আত্মারা। ভেদী শরীর জুড়ে তাঁরা কখনও অস্পষ্ট রেখার মতো দৃশ্যমান। এমন মায়া এই ভুবনজোড়া—ভূতগ্রস্ত মানুষ কী প্রকারে মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে! বলাই মণ্ডলের একবুক সহানুভূতি তাঁদের ওপর। এই মুহূর্তে হয়তো ঘটে যাচ্ছে শাখাপ্রশাখায় তাঁদের নিঃশব্দ নিরবয়ব বিচরণ! বলাই মণ্ডল আশে-পাশে দেখেন। কোনও সন্ধ্যায়, কোনও গাঢ় অন্ধকারে, অনধিকারীর মতো করুণ প্রকাশ ঘটিয়ে এসে দাঁড়ান তাঁরা।
আমবাগান ঝাঁট দেওয়া হয় প্রতিদিন। পরিষ্কার রাখা হয়। গাছের গোড়া পরিষ্কার না রাখা হলে তাদের শ্বসন রুদ্ধ হয়ে আসে। অপরিচ্ছন্নতায় বৃক্ষের উৎপাদনধর্ম ব্যাহত হয়। গাছে এবং ফলে পোকা লাগে। মানুষের মতোই গাছেরও চাই যত্ন ও পরিচ্ছন্নতার আশ্বাস। অতএব বলাই মণ্ডলের আমবাগানের ভূমিতল গৃহস্থের উঠোনের মতো পরিচ্ছন্ন তকতকে।
ভিতরে খানিক এগিয়ে বলাই মণ্ডলের মনে হল মেয়েলি গলায় হালকা হাসির শব্দ পেলেন। অবাক লাগল তাঁর। এই সময় আমবাগানে কে? আমের ফলনের সময় বাগানে এত উপদ্রব হয় যে প্রহরা দিতে হয়। কিন্তু এই শীত-লগ্নে সেইসব প্রত্যাশিত নয়। তিনি এগোলেন। গাছের পাতায় মাথা লেগে সরসর শব্দ হল। দেখলেন, দ্রুত পায়ে আমবাগান থেকে বেরিয়ে জেলেপাড়ার দিকে চলে যাচ্ছে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। চিনতে পারলেন বলাই মণ্ডল। সহদেব দাসের মেয়ে তুলতুলি আর সুকুমার পোদ্দারের ছেলে অনু, অনির্বাণ। কলেজ পাশ করে ব্যবসা দেখাশোনা করছে ছেলেটি, বলাই মণ্ডল জানেন। এবং তুলতুলি বহরমপুরের কলেজে পড়ছে। এ গ্রামে এখন একমাত্র সে-ই কলেজে পড়া মেয়ে। আসা-যাওয়ার অসুবিধার জন্য প্রাথমিক স্কুলের পর আর পড়া হয় না মেয়েদের। কয়েকজন বাড়িতে পড়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয়। আর অধিকাংশই পড়া ছেড়ে বিড়ি বাঁধে। ষোলো-সতেরোয় বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়।
ছেলে-মেয়ে দুটি এ সময় আমবাগানে কী করছে বলাই মণ্ডল বুঝলেন। মাথা নাড়লেন তিনি। প্রেম এক অনিবার্য বিষয়। আসবেই। যৌব অভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে তার বিকাশ। তাঁরা সকল প্রেম রাঙিয়ে দিতেন কল্পনায়, কেন-না প্রেমের পাত্রী সুলভ ছিল না। তাঁদের সময় গ্রামের মেয়েরা এত বাইরে আসত না। অনূঢ়াও থাকত না আঠারো-কুড়ি পর্যন্ত।
তাঁদের সময়? বলাই মণ্ডল ভাবেন। তিনি কি খুব আগের? ঊনচল্লিশ বছর বয়স এখন তাঁর। বিবাহ করেছেন ষোলো বছর আগে। পশ্চিমবঙ্গের সেই উত্তাল সময় তখন। চলছে নকশাল আন্দোলন। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও সে-সময় বলাই মণ্ডল অশান্ত হয়ে উঠেছিলেন যখন বহরমপুর জেলে নয়জন নকশাল বন্দিকে গুলি করে মারা হল। নকশালদের প্রতি কোনও সমর্থন বা বিরূপতাও তাঁর ছিল না। কিন্তু ওই হত্যা, একজন মানুষ হিসেবে, ঘৃণা করেছিলেন। সকল হত্যাকেই ঘৃণা করেছিলেন তিনি। তখন রাজনৈতিক দলগুলি এবং পুলিশের মিলিত হানাহানিতে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গার মতো মুর্শিদাবাদের মাটিও রক্তাক্ত হয়েছিল। বহরমপুরের পশ্চিমপারের গোয়ালজান গার্লস স্কুলে বোমা তৈরি করত নকশালরা। স্কুলের সম্পাদক অরুণ পুশিলাল তার প্রতিবাদ করেছিলেন। পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করে আবেদন করেছিলেন তিনি। সাহায্য পাননি। বরং, খোলা জায়গায়, দিনের আলোয় তিনি খুন হয়ে গেলেন।
কোনও সৃষ্টির স্বপ্ন বুকের ভিতর থাকলে এত হত্যা এত ধ্বংস কীভাবে সম্ভব হয়? বলাই মণ্ডল বুঝতে পারেন না। তখন, ওই অস্থির সময় তাঁকে গ্রাস করেছিল অর্ধেক। এবং সম্পূর্ণ গ্রাস থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন মায়া। তিনি তেইশ। মায়া সতেরো। দেহপ্রেমে দ্রব হয়েছিলেন তিনি। বাহিরের সকল উপদ্রব হতে মুখ ফিরিয়ে মন কেবল নিবিড় হয়ে ছিল পত্নীপ্রেমে। বড় মধুর, উথাল-পাথাল সেই প্রেম। আঃ! হাজার হাজার কবিতা আসত তখন। মাঠে, ঘাটে, শুতে, খেতে সকল সময় কবিতার ঝোড়ো আগমন। বড় দেহগন্ধ ছিল। সকল বাক্যে। সকল ব্যঞ্জনায়। অন্য কিছু আসা আর সম্ভবই ছিল না।
এই সময়ের মধ্যে গ্রামের জীবন অনেক পালটে গেছে। মেয়েরা অনেক বেশি সহজ। ছেলেরা অনেক খোলামেলা। তা ছাড়া রাজনীতি এখন সকল গৃহের চৌকাঠ পেরিয়ে অন্দরে বসত করে। পড়-আনপড় সকল লোকই ভাবতে শিখে যাচ্ছে কোন রন্ধ্রে প্রবেশ করলে রাজনীতি মাধ্যমে কিছু স্বার্থ লাভ করা যায়। হিন্দু-মুসলমান নয়, ধনী-গরিব নয়, উঁচু জাত-নিচু জাতও নয়। গ্রাম এখন ভাগ হয়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা। আগে অর্থবলই ছিল ক্ষমতার উৎস। এখন অর্থবলের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা। এ গ্রামে এই দুই ক্ষমতারই সর্বোচ্চ পর্বে রয়েছেন সুকুমার পোদ্দার।
বলাই মণ্ডল চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনির্বাণ ওই তুলতুলিকে বিবাহ করবে তো? ওরা নিশ্চয়ই এত আধুনিক হয়ে যায়নি যে বিবাহের অঙ্গীকার ছাড়াই পরস্পর ঘনিষ্ঠ হবে? রাজনীতি যতই ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়ুক, গ্রামীণ সমাজ আজও শহরের মতো নয় পুরোপুরি। এই আমবাগানে, আধো আলোর এই ঝুপসি নির্জনে ওরা ছোঁয়াছুঁয়ির খেলায় মেতে উঠেছিল— এমনটাই স্বাভাবিক। এ বয়সেই তো তিনি আর মায়া একত্র হয়েছিলেন? এ বয়সেই প্রণয়ের রামধনু স্পর্শের উন্মুখ-কাতরতা রচে! যদি সুকুমার পোদ্দার রাজি না হন?
সহদেব দাস সাধারণ চাষি। সামান্য। সুকুমার পোদ্দারের পালটি-ঘর নন। এমনকী হতে পারে তিনি সুকুমার পোদ্দারের কাছে ঋণী। কারণ বছর দুই আগে সাবেকি ধান, সর্ষে, ডাল, কালোজিরের চাষ ছেড়ে সূর্যমুখীর চাষ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সহদেব দাস। কোনওভাবেই তিনি সুকুমার পোদ্দারের পালটি-ঘর নন।
বলাই মণ্ডলের বুকে কাঁপন লাগল। তাঁর নিজের মেয়েটি বড় হচ্ছে। তাকে আগলে রাখতে হবে। এই সমস্ত মানুষ অর্থবান ক্ষমতাশালী—এঁদের নিয়ে বড় ভয়। এঁদের নিকট আত্মসম্মান হারানোর ভয়। তিনি সাধারণ। সামান্য সম্পদে দিন কাটে, আপন সম্মানে উঁচু শির। গাছপালা, মাটি, ফসল, নদী আর ইতিহাসের ভিতর তাঁর জীবন। এর বাইরে তিনি বড় অসহায়। দুর্বল। যদি সহদেব দাসের জায়গায় তাঁরই মেয়ে হয়, আর যদি সুকুমার পোদ্দার দোষারোপ করেন— সম্পদের লোভে শেষ পর্যন্ত মেয়েকে লেলিয়ে দেওয়া…!
ওঃ ভগবান! সুকুমার পোদ্দারের কাল্পনিক ভাষ্যে বলাই মণ্ডল অস্থির বোধ করেন। স্বেদগ্ৰস্ত হয় তাঁর শরীর। সহদেব দাসের জন্য, তুলতুলির জন্য আশঙ্কায় ভারী হাতখানি তিনি রাখলেন একটি আমগাছের গায়ে। বড় মায়াময়, বড় স্নিগ্ধ শীতল মনে হয় এই স্পর্শ। সহকার। উচ্চারণ করেন তিনি। সহকার। এখানকার সব গাছের একটি করে নাম দিয়েছেন তিনি। অমল, কাজল, স্বপ্নময়, সন্দীপ, শ্যামলী, স্নিগ্ধা। এইসব সহকারদের তিনি বোঝার চেষ্টা করেন। আজ তাঁর মনে হচ্ছে, তারা যেন শীত পেরিয়ে যাবার জন্য উন্মুখ। বসন্ত এলে গাছে-গাছে বউল ধরবে। সে এক আশ্চর্য সময়। নদীর পাড়ে তখন আমের বউলের গন্ধ ম-ম করে। হাওয়ায় হাওয়ায় গ্রামে ছড়িয়ে যায়। প্রাণ ভরে যায় সেই গন্ধে। তিনি এক-একটি গাছ স্পর্শ করতে করতে নদীর দিকে এগিয়ে যান। কনকনে হাওয়ায় শীত বোধ হয়। কাঁপন লাগে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তিনি কেঁপে উঠলেন নদীর পাড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে। সেখানে সরু সরু চিড়। টের পাচ্ছেন তিনি, জল গ্রাস করছে মাটি। তলায় তলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে আর আলগা হয়ে যাচ্ছে ভূ-ত্বক। ধসে যাবে যে-কোনও দিন, যে-কোনও মুহূর্তে। পাড় হতে আমবাগানের সামান্য দূরত্ব, পঁচিশ ফুট পরিমাপ প্রায়, অতিক্রম করতে কতখানি সময় নেবে গঙ্গা? দু’দিনও নিতে পারে, আবার দু’বছর। নদীর মতি-গতি কে বুঝবে! যদি দ্রুতই সে এসে পড়ে, মাটি খেয়ে নেয়, জলের কেন্দ্রাতিগ বল যদি উন্মুক্ত ধাক্কায় খসিয়ে দেয় মাটি আর আগ্রাসন নিমেষে পৌঁছে যায় আমবাগান পর্যন্ত, তবে হয়তো প্রথম শিকার হবে বলাই মণ্ডলের প্রিয় দুটি গাছ –– স্বপ্না ও বিমলা। তাদের পাশেই দিবা আর নিশি।
তাঁর মনে হল, তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন গাছগুলির ভয়ার্ত আবেদন— ‘করো! কিছু করো! নদীগর্ভ আর দূরে নয়!’ গাছের গায়ে গাল চেপে ধরলেন তিনি। এ বিমলা। মাটিঘাঁটা, হাল ধরা, নিড়ানি সামলানো রুক্ষ হাতের ত্বক দ্বারা চেপে চেপে স্পর্শ করলেন তাকে। ফিসফিস করে বললেন- “করব। নিশ্চয়ই কিছু করব যা আমার সাধ্য।’ হঠাৎ মনে হল পেছনে কে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব কাছে। পিঠের ওপর কার গাঢ় শ্বাসপতন। ঘুরলেন। সাদা শাড়ির আভাস। মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। তাঁর পাঁজর জুড়ে ছমছমে বোধ। কে? বলছেন তিনি—কে? তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো তো? ভরসা করো তো আমার ওপর?
নির্বাক সকল সহকার। কেবল হাওয়া এল ভাগীরথী হতে আর শনশন খসখস শব্দ হল। শীতের ঠান্ডা নেমে আসা জলতলে শব্দ হল ছপাৎ সল্স ফ্লুক্! বলাই মণ্ডল ক্লান্ত চোখে নদীর দিকে তাকালেন। দূরে দৃশ্যমান পেতনির চর। যখন মানুষ বসত করেনি তখন ওই চরে ঘুরে বেড়াত দু’চোখে আগুন জ্বলা পেতনির দল। পিছপয়ের। শাঁকচুন্নি। গোটা চর জুড়ে নারীশক্তির বিচরণ ছিল কেন বলাই মণ্ডল জানেন না। সেই বালকবেলায় নদীপাড়ে বসে থাকতেন তাঁরা প্রেতিনী দেখার প্রত্যাশায়। তখন তাঁর প্রাণের বন্ধু জেরাত আলি এক পিছপয়েরকে বিবাহ করার ইচ্ছে প্রকাশ করত। সে বলত পিছপয়ের। তিনি বলতেন শাঁকচুন্নি। আদতে বস্তু দুই-ই এক। সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই ঠিকঠাক, শুধু পায়ের পাতা উল্টো। জেরাত আলি বোঝাত তাঁকে। পিছপয়ের বিয়ে করা শক্ত, কিন্তু করতে পারলে সুফলপ্রসূ। ওরা তোমায় নানারকম লোভ দেখিয়ে, মায়াজাল রচনা করে, জলে নামানোর চেষ্টা করবে। তখন, নিয়ম হল, তাকে চেপে ধরে তার ঊরু চিরে ফেলতে হবে, সেই চেরা ঊরুতে ঢুকিয়ে দিতে হবে চুল। ব্যস! সে চিরকালের জন্য তোমার বশ হয়ে থাকবে। ধনে-সম্পদে ভরে উঠবে তোমার সংসার। জেরাত আলি স্বপ্ন দেখত এক পিছপয়ের নারীর। ভাবত সে কবজা করবে সেই নারীকে আর বিয়ে-সাদি করে সমৃদ্ধি আনবে সংসারে। শেষ পর্যন্ত জেরাত আলি দুটি মানবীকেই বিবাহ করে। ছোট চাষি সে। ছ’টি ছেলেপুলে নিয়ে দারিদ্রে দিন কাটায়।
পেতনির চর থেকে ডিঙি আসছিল একখানা। সারাদিনই যায় আসে। দ্বীপের মতো জেগে ওঠা এই চর সাময়িক দ্বিধাবিভক্ত করেছে ভাগীরথীকে। এই চর পেরোলে ভাগীরথীর অপর শাখা। তার পর পশ্চিমপাড়। চর পড়ে যাওয়ায় পশ্চিমপাড় এখান থেকে দেখা যায় না। পদ্মার তুলনায় ভাগীরথীর বিস্তার কিছুই নয়, তবু এক-একবার বর্ষায় মনে হয়, এ নদীর শেষ নেই, কূল নেই। সমুদ্রে মেশার আগে গঙ্গা নিজেই এক মহাসমুদ্র তখন। এইসব সময় আমবাগানে জল ঢুকে যায়। ঘর মাঠ উঠোন খামার জলে থই-থই করে। এমন হালকা বন্যা বুকে করেই বাঁচে মুর্শিদাবাদের মানুষ এবং বৃহত্তর বন্যার দুঃস্বপ্ন নিয়ে ঘুমোয়। কারণ ভয়াবহ বন্যার মুখে কখনও পড়েনি, এমন মানুষ এ জেলায় পাওয়া যাবে না। সেই বন্যার স্মৃতি গভীর দাগ এঁকে দেয়। আর বর্ষার পর, বন্যার পরই আসে আশঙ্কার পালা। বন্যা যা কিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা যায় চোখের সামনেই। কিন্তু সে মাটি আলগা করে দিয়ে যায়। ভাসিয়ে দেয় নদীপাড়ের মাটি। যেমন বর্ষায়। ভরা জলের তলায় আলগা হতে থাকা মাটি জল নামলে ভেঙে ভেঙে পড়ে। আলগা মাটির তলায় ঢুকে যায় জল আর মাটির ওপরের স্তর স্থির রেখে প্রথমে নীচের স্তর গ্রাস করে। নীচের শূন্যতার জন্য ওপরের স্তরে ধরে ফাটল। তারপর ভেঙে পড়ে মাটি, সঙ্গে নিয়ে গাছপালা বাড়িঘর যা-কিছু থাকে তার ওপর।
সুকুমার পোদ্দারের বাগানের দিকে তাকালেন বলাই মণ্ডল। এবং পোদ্দারের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যগ্রতা বোধ করলেন। আমবাগান থেকে বেরিয়ে জেলেপাড়ার দিকে হাঁটলেন তিনি। অনেকদিন ওদিকে যাননি। ওদিকেও ভাঙন লাগার কথা।
ভাঁটির সময় এখন। জেলেপাড়ার পুরুষরা ঘরে আছে। প্রথমে হারুনের সঙ্গে দেখা হল বলাই মণ্ডলের। বাড়ির উঠোনে বসে সে জাল মেরামত করছিল। শীত এলে জেলেপাড়ায় অনটন বৃদ্ধি পায়। কারণ এ সময় মাছের উৎপাদন কম। জালে ধরা পড়ে যা, অতি সামান্য। তাই দিয়ে উদরপূর্তি হয় না। এ সময় অনেকেই চাষের কাজে নেমে পড়ে। রবিশস্য চাষের মরশুমে কৃষকের সঙ্গে তারা হাত লাগায়।
বলাই মণ্ডলকে দেখে হারুন বলল—কোথায় চললেন বড়ভাই? এই ভরদুপুরে?
বলাই মণ্ডল চুলে হাত বুলিয়ে বললেন—আমাদের বাগানের দিকটায় মস ধরেছে। তোদের পাড়াটা তাই দেখতে এলাম রে হারুন।
—চলেন ওই ধারে। দেখবেন। নদী এগিয়ে আসছে এদিকে।
হারুনের সঙ্গে জেলেপাড়ার পিছনের দিকে চলে গেলেন বলাই মণ্ডল। এ পাশে গাছপালা নেই বলেই বোধহয় পাঁচ ফুট এগিয়ে এসেছে নদী। নৌকার তলায় তলায় এবড়ো-খেবড়ো পাড়। হারুনের দিকে শূন্য চোখে তাকালেন বলাই মণ্ডল। বললেন—কী হবে বল তো হারুন?
—ভাবি না বড়ভাই। যতদিন না নদী এসে ঘরের দেওয়ালে লাগছে, ততদিন মাটি কামড়ে পড়ে থাকব। এর মধ্যে যদি স্পার করে দেয়। চরা পড়লেই বাঁক নেয় নদী। পেতনির চরের জন্যই আমাদের গ্রাম ভাঙছে এখন। কী হবে কে জানে! শুনছি পঞ্চায়েত মিটিং ডাকবে শিগগির।
সন্ধেবেলা সুকুমার পোদ্দারের বাড়ি গেলেন বলাই মণ্ডল। পোদ্দার তখন নিজেও খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। নদীর পাড়ে ভাঙন লেগেছে। আমবাগান ছাড়াও জেলেপাড়া ছাড়িয়ে তাঁর অনেক জমিজমা। এ ছাড়া ছেলের প্রেমিক হয়ে ওঠার সংবাদ তাঁর কানে গেছে। তিনি এক সম্পদশালী ক্ষমতাবান মানুষ এবং কমিউনিস্ট। ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিয়ে সম্পদ বৃদ্ধি করার বাসনা তাঁর নেই। কিন্তু তাই বলে একেবারে হাইলা দাসের মেয়ে আনতে হবে! ঋণে ধারে জর্জরিত সহদেব দাসকে কোনওভাবেই আপন বৈবাহিক ভাবতে পারছিলেন না তিনি। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে থাকছিল। বলাই মণ্ডলকে দেখে মনটা একটু নরম হল পোদ্দারের। এই মানুষটির প্রতি সমীহ আছে তাঁর। কারণ সুকুমার পোদ্দার শুনেছেন, কাব্য লেখেন বলাই মণ্ডল। সে তো সহজ কাজ নয়। তারুণ্যে তাঁরও শখ হয়েছিল কবি হওয়ার। মনে ভাব আসত। লিখেও ফেলতেন দু’চার ছত্র। কিন্তু বানানশুদ্ধিও হল না। তাঁর সেই লাজুক দুর্বলতা এই মানুষটির চর্চার বস্তু হয়ে আছে আজও। নিজের হাতে চাষ-বাস করেন এবং ঘরে ফিরে বই পড়েন। সুকুমার পোদ্দার, বিপুল ধনভাণ্ডারের মালিক হওয়া সত্ত্বেও, বলাই মণ্ডলকে শ্রদ্ধা না করে পারেন না অতএব।
প্রসঙ্গটা বলাই মণ্ডলই তুললেন। সুকুমার পোদ্দার বললেন- আমিও তো সারাক্ষণই ভাবছি। কী করা যায়। সরকার থেকে যদি বেডবার বা স্পার করে দেয়, তা হলে একরকম রক্ষা হবে। এ ছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই। একটা মিটিং ডেকেছি আমি। জেলাশাসকের কাছে আবেদন করতে হবে সবাই মিলে। তোমাকেও থাকতে হবে তার মধ্যে।
—থাকব।
আরও কিছুক্ষণ এ কথা ও কথা বলে উঠে পড়লেন বলাই মণ্ডল। কোনও নির্দিষ্ট পথ পাওয়া গেল না। ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরি হয়েছে প্রায় দু’ দশক হতে চলল। গঙ্গায় পলি জমছে ক্ৰমাগত এবং সে অস্থির হয়ে উঠছে। ফরাক্কা প্রকল্প রূপায়ণের জন্য পাল্টে গেছে মুর্শিদাবাদ জেলার নদী মানচিত্র। ত্রিমোহনী, কানলই, বাগমারি ও মাধবজানি নামের নদীগুলির গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। আগে এগুলি পদ্মায় মিশে যেত। ভাগীরথীকে সমৃদ্ধ করার জন্য এবং ফরাক্কা ব্যারেজের সুবিধার্থে যে ভরনিখালটি কাটা হয়েছে, ত্রিমোহনী, কানলই ও মাধবজানি মিশেছে তাতেই। চেষ্টা চলছে যাতে বাগমারির জল একটি সাইফনের মাধ্যমে পদ্মায় ফেলা যায়।
নদী শুধু জলই বহন করে না। পলিও তার সঞ্চয়। যন্ত্রের সাহায্যে নদীর পলি তুলে তার প্রবাহপথ গভীর করে দিলে প্লাবনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। কিন্তু এ কাজের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। রাজ্য সরকার সে অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম নয়। কেন্দ্রীয় সরকার এ খাতে যে ব্যয় বরাদ্দ করে তা-ও যথেষ্ট নয়। এবং সেই অর্থ যথাযথ ব্যয়িত হয় না। দশভূতে মিলে লুটে-পুটে নাশ করে ভবিষ্যৎ।
নদী একটি নির্দিষ্ট ব্যাপ্তির মধ্যে গতিপথ পরিবর্তন করে। এই ব্যাপ্তি হল প্লাবনভূমি। প্লাবনভূমিতে পলি সঞ্চিত হলে নদী তার প্রবাহপথ সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে।
হতে পারে, এমন হতেই পারে যে, ভাগীরথী চাইল তার প্রবাহপথ পাল্টে যাক। আর গ্রাম শহর জনপ্রাণী ভাসিয়ে সে চলল এক নতুন পথে।
.
কিছুদিন হল বিজলি এসেছে এ গ্রামে। সব ঘরে যায়নি। যারা একটু সম্পন্ন, তাদের ঘরেই কেবল। বলাই মণ্ডলের বাড়িতেও এসেছে। তবে এ আলোর তেজ কম।
বাড়ি যখন পৌঁছলেন বলাই মণ্ডল, বাড়ির হাওয়ায় অশান্তি টের পেলেন। হয়তো মায়ার সঙ্গে রানির কিছু হয়েছে। তিনি কারওকে কিছু জিগ্যেস করলেন না। মায়ার কষ্ট তাঁরও বুকে বাজে। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে কারও পক্ষাবলম্বন তাঁকে মানায় না। যদিও মনে মনে অস্বীকার করতে পারেন না মায়ার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব। মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা অসম্ভব।
নিজের ঘরে মাথা নিচু করে টেবিলের সঙ্গে চোখ লাগিয়ে পড়ছিল তীর্থ। বলাই মণ্ডলের পায়ের শব্দ শুনে তাকাল। বলল—বাবা, আজ বদরকাকা তোমাকে একটি খবর দেবার জন্য আমাদের স্কুলে এসেছিল।
—কী বলল?
—পরশু তোমাদের পঞ্চায়েতের মিটিং আছে। তাতে বদরকাকা থাকবে। সঙ্গে পার্টির একজন আসবে।
—ও।
—বাবা। আমি তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।
কী?
তীর্থ কয়েকটি ছোট বই এগিয়ে দিল। বলাই মণ্ডল হাতে নিয়ে দেখলেন কয়েকটি ছোট ছোট পত্রিকা। কোনওটা বহরমপুর থেকেই প্রকাশিত। কোনওটা কলকাতার। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধের বই। এ ধরনের পত্রিকা মাঝে-মাঝে তিনি আনতেন। এখন শুধু বই পড়ে দিন কাটে। বদরুদ্দিন কখনও তাঁকে আধুনিক কবিতার বই এনে দিয়েছে। তরুণ কবিদের লেখা। কিছু ভাল লাগে। কিছু লাগে না। কিন্তু নতুন নতুন ভাবনা, কবিতার নতুন নতুন ধরনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তীর্থ এ পত্রিকা কোথায় পেল! তিনি বললেন-তোকে কি বদর দিল?
—না না। আমি কিনলাম।
—পয়সা পেলি কোথায়?
—মা টেস্ট পেপার কেনার জন্য ষাট টাকা দিয়েছিল। আমার লাগল আটচল্লিশ টাকা। বাকি টাকায় কিনলাম।
বলাই মণ্ডলের ভাল লাগল। তবু পিতৃসুলভ গাম্ভীর্যে বললেন—বই কিনেছ ভাল কথা। কিন্তু পয়সা পেলে বাজে খরচ কোরো না।
—না। বাজে খরচ করি না তো। এই পত্রিকাগুলোয় তুমি লেখা পাঠাবে বাবা। তোমার লেখা।
—আমার লেখা? আমার লেখা ওঁরা ছাপবেন কেন? আমি তো নিজের মনে লিখি।
—আমি পড়েছি তোমার লেখা বাবা। ওরা ঠিক ছাপবে। তুমি পাঠাও। নীলাঞ্জন আছে আমাদের ক্লাসে, ওর বাবা কলেজে পড়ায়। কবিতা লেখে। কত পত্রিকায় ছাপা হয় সেইসব। তোমার কেন হবে না?
বলাই মণ্ডল লাজুক হয়ে উঠলেন। এত বৎসর ধরে লিখেছেন। খাতার পর খাতা। বদরের মতো কয়েকজনকে পড়িয়েছেন। সঙ্কোচে কোথাও কখনও পাঠাননি। যদি ছাপা না হয়! আপন অন্তরের কবি সে-গ্লানি সইতে পারবে না। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, ছেলে বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের কবিতাগুলি যেন উন্মুখ হয়ে উঠল আত্মপ্রকাশের ইচ্ছায়। তা হলে কি লুকনো ছিল এই অভিপ্রায়? অবচেতনে ছিল? ছেলের নিকটে বসলেন তিনি। বললেন—তুই পড়েছিস আমার
—লেখা? কবে?
—রোজ পড়ি বাবা।
—রোজ?
—একদিন এমনি উল্টে দেখছিলাম। কিছু বুঝিনি। পরদিন মনে হল, দেখি তো কী লিখেছ! পড়লাম। এবার রোজ রোজ ইচ্ছে করল। একটা খেলার মতো। এবার মনে হল, সবকিছু না বুঝেও যেন একটু একটু বুঝে যাচ্ছি।
—কবিতা ভাল লাগছে তোর?
—হুঁ।
—অন্য কারও লেখা পড়েছিস?
—হুঁ। ওই তোমার বইগুলো। তা ছাড়া নীলাঞ্জনও দেয়। ওদের অনেকরকম কবিতার বই আছে।
ছেলের মাথায় হাত রাখেন বলাই মণ্ডল। আবেগরুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠ। মাথা নিচু করে ভাবেন। কবিতাকে যে ভালবাসে তার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে। কিন্তু কবিতা বড় কষ্ট দিয়ে ভরিয়ে রাখে বুক। সে-কষ্টের কোনও নাম নেই। রূপ নেই। জগতের আর কোনও কষ্টের সঙ্গে তার সাদৃশ্য নেই। আনন্দের সহোদর যেন সে। সহজন্মে ধরা। কিন্তু আনন্দ নয়। সে কেবল
তীব্র অধিকারবোধে সারাক্ষণ থাকে কেবল এবং মানুষকে একা করে দেয়। ক্রমশ তার বন্ধু হয় নির্জনতা, প্রকৃতি কিংবা তীব্র আবেগ। এ আবেগ মথিত করে। পাগল-পাগল করে।
তীর্থ পড়ায় মন দিয়েছিল। তিনি দেখছিলেন। কেমন হবে ও? কী করবে? বড় ছোট ও এখন। বলাই মণ্ডল মাঝে মাঝে ওকে মাঠে নিয়ে যান। সম্পর্ক স্থাপন করে দিতে চান ভূমি ও শস্যের সঙ্গে। শ্রম এবং উৎপাদনের সঙ্গে। মাটির থেকে দূরে-দূরে থাকলে, তোলা-তোলা থাকলে, যদি কৃষি ভাল না বাসে ও? ভাল না বেসে দূরে চলে যায় যদি কানাইয়ের মতো?
কিছুই বলা যাবে না ওর সম্পর্কে এখন। কত পাল্টে যাবে। তীর্থ তাকাল আবার। বলল— বাবা, তুমি পাঠাবে তো?
হাসলেন বলাই মণ্ডল। শান্ত অপ্রতিভ হাসি। বললেন— যদি না ছাপে? কখনও তো কোথাও পাঠাইনি। বড় অপমান লাগবে রে।
—কে জানবে বলো? শুধু তুমি আর আমি। আমি কাল খাম আর ডাকটিকিট কিনে আনব বাবা।
—অপমান অন্যের কাছে লাগে না রে, লাগে নিজের কাছে। নিজেকেই করুণা করার পরিস্থিতি দুঃসহ। তবু তুই বলছিস যখন, ভেবে দেখি।
—না। তুমি পাঠাবে। আমি জানি, ছাপা হবেই।
—আচ্ছা বেশ। তুমি এখন পড়ো।
—তুমি আজই কয়েকটা কবিতা বেছে রাখো। আমি খামে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেব।
—বেশ। বেছে রাখব। তুই এখন পড় তীর্থ।
সে পড়ায় মন দিল। সামনে পরীক্ষা। স্কুলে সে মোটামুটি ভাল ছেলে। তার কোনও প্রতিযোগিতা নেই। সে শুধু জানে তাকে কলেজের গণ্ডি পেরোতে হবে। এটা বাবার গোপন ইচ্ছা, সে অনুভব করেছে। বলাই মণ্ডল তাকে কখনও বলেননি—‘তীর্থ তোকে বি এ এম এ করতেই হবে।’ কিন্তু তীর্থ জানে, বলাই মণ্ডলের তীব্র ইচ্ছা ছিল কলেজে পড়ার। হয়নি। কানাইকে পড়াবার চেষ্টা করেছিলেন, সে-ও হয়নি। পিতৃহৃদয়ের অভীপ্সার স্পন্দন সন্তানকে স্পর্শ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে কি না সে জানে না। কারণ তা হলে তাকে দুরে যেতে হবে। নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান বা কলকাতায়। গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। সে যেতে চায় না। এই গ্রামখানির মধ্যেই সে আবদ্ধ করে নিতে চায় তার জীবন।
রাত্রে খেতে বসে কথাটা তুলল কানাই। বলল—আমার কিছু টাকার দরকার।
—টাকা? কত?
বলাই মণ্ডল মুখে গ্রাস পোরার আগে হাতে ভাত নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
—পঞ্চাশ হাজার।
—প-ঞ্চাশ হা-জা-র?
হাতের গ্রাস হাতেই রইল। মুখে উঠল না। বলাই মণ্ডল চোখ কপালে তুলে বললেন- করবি এত টাকা দিয়ে?
—তোমাকে তো বলেছিলাম। ব্যবসা করব।
বলাই মণ্ডল এবার মুখে গ্রাস তুললেন। কিছুক্ষণ খাদ্যবস্তু চর্বণের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। এবার তিনি বললেন—অত টাকা আমি পাব কোথায়? তা ছাড়া সংসারের কত বড় বিপর্যয় আসছে তা জানিস?
—কী হয়েছে?
—পাড় ভাঙছে? আমবাগানের কাছে এসে গেছে নদী। দেখেছিস?
—কয়েকদিন যাওয়া হয়নি।
—কেন যাওয়া হয়নি? আমবাগানটা তো তোরই দায়িত্বে?
—শীতকালে কি বাগানে গিয়ে ভূত দেখব?
—কী অবস্থায় আছে গাছগুলো দেখবি না? পাড় ভাঙছে। তারও তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ভাঙন আরও বাড়লে কিছু বালির বস্তা যদি ফেলা যায়।
—সে কি তোমার কাজ নাকি? সে তো সরকার করবে। আর পাড় যখন ভাঙছে, ওই আমবাগান রেখে লাভ কী? বরং এখনও বিক্রি করে দিলে কিছু টাকা আসবে। হাজার পঞ্চাশেক তো আসবেই। অন্তত কুড়িটা পুরনো গাছ আছে আমাদের।
বলাই মণ্ডল স্থির হয়ে গেলেন। কানাই এরকম প্রস্তাব করতে পারে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনি ধরা গলায় বললেন—আমবাগান বেচে দেব? বলিস কী?
—কেন বেচবে না? ও বাগান আজ না হোক কাল নদীর পেটে যাবেই। আরে শুধু গাছগুলো কেটে বিক্রি করে দিলেও তো কাঠের দামটা পাওয়া যাবে।
—গাছ কেটে বিক্রি? ফলন্ত গাছ কেটে কাঠ বিক্রি?
বলাই মণ্ডলের মনে হল, কানাই মণ্ডল যেন তীর্থ বা সুমিকেই খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলার প্রস্তাব দিচ্ছে। তাঁর আর খাবার রুচি হচ্ছিল না। বললেন—তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস কানাই? কে তোকে এসব বুদ্ধি দিচ্ছে?
—বুদ্ধি আমার ধার করার দরকার নেই। আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি।
তখন কথা বলে উঠল রানি। কিছুদিন আগে বহরমপুরে গিয়ে সে ভ্রূ তুলে এসেছে। কাঁধ পর্যন্ত ছোট করেছে চুল। বলাই মণ্ডল তাকালেন। রানি বলছে—ঠিকই তো বলেছে ও। আর কিছুদিন পরে তো আমবাগান থেকে কানাকড়িও পাবেন না। এখন যদি ও বেচে দেবার লোক পায়, আপনি আপত্তি করছেন কেন?
বলাই মণ্ডল কঠিন চোখে তাকালেন। তারপর ধীরে-সুস্থে জল খেয়ে বললেন –একটা কথা সবাই শুনে রাখো। ওই বাগানের পুরনো আমগাছগুলি আমাদের পিতৃ-পিতামহের মতো। নতুন গাছগুলি সন্তানের মতো। আর শুধু আমবাগান কেন? যদি আমাদের সমস্ত জমিজমা গঙ্গাগর্ভে চলে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা হলেও এক ইঞ্চি জমি আমি বেচব না।
কানাই হঠাৎ খাওয়া ফেলে সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়াল। এঁটো হাত উপরের দিকে তুলে বলল— বেচব না, বেচব না! তুমি না বলার কে? তুমি কি সম্পত্তির একা মালিক? জমি আমার নয়? বাগান আমার নয়? আমি কেউ নই? আমার কথার কোনও দাম নেই?
বলাই মণ্ডল শান্ত হয়ে বলেছিলেন—বোস। খেতে বোস। অন্নকে অবহেলা করিস না। সম্পত্তি তোর নয় কে বলল? আর তোর কথার দামও আছে নিশ্চয়ই। তবে দেখতে হবে, তুই কথাটা কী বললি!
মুখ গম্ভীর করে আবার পিঁড়িতে বসে পড়ল কানাই। খেতে থাকল। বলাই মণ্ডল বললেন— কীসের ব্যবসা করবি তুই?
—শাড়ির আর রেডিমেড জামার। একটা জায়গা পেয়েছি বহরমপুরে। দোকান দেব। আর রানি একটা বিউটি পার্লার খুলবে।
—শাড়ির দোকানের তো অনেক খরচ। পঞ্চাশ হাজার টাকায় কী হবে?
—অশোক, বাবুল আর মোবারক আছে আমার সঙ্গে।
—অশোক, বাবুল, মোবারক? তুই না হয় আমবাগান বেচে টাকা দিবি। ওরা কী বেচে দেবে?
—সেটা ওদের ব্যাপার।
ব্যবসার চিন্তা ছাড় কানাই। আমি কিন্তু আমবাগান বেচব না।
—সত্যি বেচবে না?
—এতক্ষণ ধরে আর কী বললাম আমি?
খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। জল খেলেন বলাই মণ্ডল। হাত ঝাড়ছেন ওঠার আগে। রানি বলল—বলো না, বলো। যেটা বলবে বলবে করছ সেটা বলো এখন।
রানির স্বরে তাড়া। যেন আজই, এখুনি বলে না ফেললে তার কোনও দিনই বলা হবে না। বলাই মণ্ডল তাকালেন। কী বলবে ওরা?
কানাই তখন, গলা গোঁজ করে, মাথা নিচু করে, ছোটবেলার মতো, খেলনার জন্য বায়না করার মতো বলল—তা হলে সমস্ত সম্পত্তি তুমি ভাগ করে দাও দাদা।
—কানাই!
এইটুকু। ব্যস, এইটুকু মাত্র বলতে পেরেছিলেন বলাই মণ্ডল। স্তম্ভিত মুখে, ধীর পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধুতে। সব শুনতে শুনতে মুখে আঁচল চেপে উঠে গিয়েছিলেন মায়াও। কান্না পাচ্ছিল তাঁর। কানাইকে কতখানি ভালবাসেন তাঁর স্বামী, তিনি জানেন। জানেন, আজ আর মানুষটার চোখে ঘুম আসবে না। চোখের জল মুছে নিজের ও রানির জন্য ভাত বাড়লেন। দুই জা খেতে বসলেন মুখোমুখি। একজন বিচ্ছিন্নতাকামী, অন্যজন বিচ্ছিন্নতার বেদনায় কাতর। খেতে খেতে মায়া ভাবলেন, কে জানে আর কতদিন এমন একসঙ্গে খাওয়া! হয়তো ক’দিন পরেই পৃথক হয়ে যাবেন। একই উঠোনে বেড়া পড়বে। আলাদা হয়ে যাবে হেঁসেল। যদি সত্যিই দোকান খুলে বসে কানাই, আর রানি সৌন্দর্যের ব্যবসা শুরু করে, তা হলে তারা হয়তো থাকবেই না গ্রামে। ভাবতে ভাবতে দু’ফোঁটা জল পড়ল তাঁর ভাতে। ডালের সঙ্গে সাপটে সেই ভাত তিনি মুখে পুরলেন। মনে হল, ঝগড়া-ঝামেলা হয় ঠিকই, রানি অশাস্তিও করে, তবু সংসারে দু’জনে ছিলেন তো একসঙ্গে।
আর রানি ভাবছিল, শেষ পর্যন্ত কথাটা বলতে পারল তবে লোকটা। রাম ভিতু, রাম ভিতু। দাদার মুখের ওপর কথা বলার একটু সাহস নেই! এবার আর চিন্তা নেই। ফোঁস যখন একবার করেছে কানাই, বাকিটা সে নিজেই পারবে। তারপর বহরমপুর চলে যাবে তারা। আঃ! কত স্বপ্ন তার শহরে থাকার। কলকাতায় ছোটমাসির কাছে সে ছিল এক বছর। গ্রামের ছেলে ইমরানের সঙ্গে তার প্রেম ছাড়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিল মা। সত্যিই সেই প্রেম ছেড়ে গিয়েছিল। ইমরানও এখন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। তখন কলকাতায় গিয়ে একটাই লাভ হয়েছিল তার। মাসি যে-পার্লারে কাজ করত, সেখানে সে-ও যেত। এটা-ওটা করতে করতে শিখেছে অনেকখানি। সে অত্যন্ত পরিতোষের সঙ্গে ভাতের গ্রাস মুখে পুরল। বড় জায়ের চোখে জল দেখে ভাবল, ভাগাভাগি হলে উপার্জন কমে যাবে, তাই দুঃখ। বড় করে শ্বাস ফেলল সে। শ্বশুর নেই, শাশুড়ি নেই, কিন্তু এই বড় জা আর ভাসুরই যেন তার সে জায়গা নিয়েছিলেন। এবার সে মুক্তি পাবে। মুক্তি। সুস্বাদু কাঁচাকলার বড়ার ঝোল মুখে দিয়ে হঠাৎই তবু বড় জায়ের জন্য একটু কষ্ট হল তার। মানুষটা ভাল। মনে মনে অন্তত স্বীকার করল সে। মধ্যবয়সের ধূসরতা তাঁর গালে। অথচ কী-ই বা বয়স বড় জায়ের। দেহের যত্ন করেন না। হাত-পাগুলি ফাটা ফাটা। স্নান করেই ভেজা চুলে খোঁপা বেঁধে ফেলেন বলে চুলে ভ্যাপসা গন্ধ। কোনও ব্লাউজে হুক নেই। সেফটিপিন লাগিয়ে চলে যায় নিরবধিকাল। তবু স্নান করে এসে যখন সিঁদুরের টিপ পড়েন, সিঁথি টানেন লম্বা করে, লাবণ্যে ভরে যায় মুখ। আসন্ন স্বপ্নপূরণের আলোয় উজ্জ্বল রানি বলে বসল – দিদি, কাল তোমার চুলে একটু জবাফুলের রস লাগিয়ে দেব আর মুখ মেজে দেব ব্যাসন দিয়ে। কী ছিরি করেছ!
মায়া ম্লান হাসলেন। বললেন—এখন আর ছিরি দিয়ে কী হবে!
মনে ভাবলেন, আগে তো সে বলেনি কখনও। কেবল মুখ করেছে। এখন আর ওপর-সোহাগ দেখিয়ে কী হবে! কারও মন বুঝতে তো তাঁর বাকি নেই। একটু ভাল ব্যবহার ছাড়া আর কীই-বা প্রার্থনা ছিল তাঁর রানির কাছে। কিন্তু কথার হুলে বিক্ষত হয়েছেন তিনি। কথা। এই তো এক জিনিস যা সম্পর্ক বাঁধে। আবার ভাঙেও। তিনি নীরবে খাওয়া শেষ করেন অতঃপর। বাসন মাজতে মাজতে ভাবেন—
কথার গুণে তরি, কথার দোষে মরি।
কথার নাম মধুবাণী, যদি কথা কইতে জানি।।
কথার দোষে কার্য নষ্ট, ভিক্ষায় নষ্ট মান।
গিন্নির দোষে গৃহ নষ্ট, লক্ষ্মী ছেড়ে যান।
অবশেষে রাত্রির সব কাজ সেরে মেয়ের পাশে শুতে এলেন মায়া। অনেকদিন হল এই ব্যবস্থা। মায়া শোন মেয়েকে নিয়ে, বলাই মণ্ডল ছেলেকে নিয়ে। শরীর কখনও সমর্পণ চাইলে, সবদিক দেখেশুনে ভাঁড়ারের এক চিলতে মেঝেকেই আশ্রয় করেন তাঁরা।
আজ শরীর জাগেনি। তবু, মায়ার ইচ্ছে করছে, স্বামীকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। এই ইচ্ছার নাম ভালবাসা। এই ভালবাসা দিয়ে মায়া টের পাচ্ছেন বলাই মণ্ডলের দু’চোখ বিনিদ্র হয়ে আছে। যেমন হয়ে আছে তাঁর। তিনি পাশ ফিরে সুমিকে জড়িয়ে হু-হু করে কাঁদেন। সুমি মায়ের কান্না টের পায়। মাকে শক্ত করে ধরে থাকে সে। এবং কোনও পূর্বসিদ্ধান্ত বিনাই খুব কান্না পায় তার। বাবার মুখ মনে পড়ে আর কান্না পায়।