১৫
জীবনের মুখ চেয়ে সেইদিনো রবে জেগে,—জানি!
জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি,—
ঘুমন্ত ফুলের মতো নিবস্তু বাতির মতো ঢেলে
মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায়,— তুমি তারে জ্বেলে
চোখের তারার ‘পরে তুলে লবে সেই আলোখানি!
সেদিনের ঘটনার পর এই একমাস। এখনও স্বাভাবিক হয়নি হরিহরপাড়ার পরিস্থিতি। কেন-না সেদিন মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা আরও একটি বৃদ্ধি পেতে পারত যদি গুলি সিদ্ধার্থর কাঁধের ত্বক ছিঁড়ে বেরিয়ে না গিয়ে ঢুকে পড়ত আরও দু’ ইঞ্চি নীচে!
সেদিন গুলি চালানো কতখানি যুক্তিযুক্ত ছিল তার তদন্তের জন্য জেলাশাসকের নিয়োজিত উপদল বা পরিদর্শন সমিতি অদ্যাবধি সক্রিয় আছেন। সময়মতো একটি প্রতিবেদন তাঁরা পেশ করবেন জেলাশাসকের কাছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল, উন্মত্ত জনতার হাতে ছ’জন পুলিশের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ায় বড়বাবু শ্রীতরুণতপন বসু গুলি চালাতে বাধ্য হন। গণদাবি অনুসারে বলরাম বাবাজিকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু মঠে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি পলায়ন করেছিলেন।
এই সমস্ত বিবৃতি নানা আলোচনা ও বক্তব্য সমেত প্রায় দশদিন খবরের কাগজগুলি অধিকার করেছিল। এখন এই বিষয় নিয়ে কোনও খবর প্রকাশিত হচ্ছে না। যদিও ময়না বৈষ্ণবীর মৃত্যুর কোনও কিনারা হয়নি। রহস্যটি সমাধা হওয়ার জন্য অদ্যাবধি কাগজে-কলমে অপেক্ষমাণ। আরও হাজার রহস্যের মধ্যে সে ঢুকে যাবে একদিন এবং হয়তো কোনওদিন সমাধা হবে না।
এই ঘটনার পর হরিহরপাড়ার প্রতিবাদী মানুষ আগুন লাগিয়েছে ঘোষপাড়ার মঠে। ভাঙচুর করেছে এবং মেরেছে মঠের যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই। কিন্তু বলরাম বাবাজি ও কেশব বাবাজিকে কোথাও খুঁজে পায়নি।
হরিহরপাড়ার সেই অস্বাভাবিকতা আজও বিদ্যমান। যদিও এর মধ্যে কোনও উন্মত্ততা নেই। নৃশংস ঘটনাগুলির প্রতিবাদে, সাধারণ মানুষ, খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে থানা বয়কট করেছে। সবজিওয়ালা থানার একজনকেও সবজি বেচছে না, মাছওয়ালা মাছ বেচছে না, মুদিখানা থেকে মিলছে না তেল, নুন, মশলাপাতি। চালওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ধোপা তাদের কাপড় ধুচ্ছে না। চুল কাটতে গেলে সেলুনের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে নাপিত। পথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করছে না, সম্মান জানাচ্ছে না কেউ। এক স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ অভিসম্পাতের মতো, ঘৃণ্য থুতুর মতো এসে পড়ছে থানার কর্মীদের ওপর।
যেমন ঘোষপাড়া মঠ পড়ে আছে পরিত্যক্ত, দরজা-জানালা ভাঙা, আধপোড়া, চোর এসে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বস্তুগুলি, লোকে দেখেও দেখছে না—তেমনই জনমানব সমেত পরিত্যক্ত থানা।
এই সমস্ত পদক্ষেপ নেবার জন্য কারওকে নেতৃত্ব দিতে হয়নি। সাধারণ মানুষের সত্যিকারের ঘৃণা ও প্রতিবাদ আপনার পথ আপনি খুঁজে পেয়েছে।
সিদ্ধার্থর ক্ষত যদিও গভীর ছিল না, তবু দলীয় অভিভাবকত্বে তাকে সরকারি হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল সাতদিন। জেলাশাসকের তদন্তকারী উপদল তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। তার বিরুদ্ধে পুলিশ এই অভিযোগ তুলেছে যে সে জনতাকে উন্মত্ত করে তুলেছিল। আর এইসব বাদ-প্রতিবাদ, অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে হেমন্ত ঋতু অগ্রহায়ণে এসে গেছে। সিদ্ধার্থ বুঝতে পারছে, বৈষ্ণবীর বিষয়ে তার আর কিছুই করার রইল না। যদিও প্রতিজ্ঞা আছে তার, নারীপাচার চক্রের বিরুদ্ধে সে আন্দোলন গড়ে তুলবে। কোনও দিন, হাতে ক্ষমতা এলে নতুন করে খুঁজতে শুরু করবে বৈষ্ণবীর হত্যাকারীদের। সে এখন তার পরবর্তী কর্মসূচিগুলি বুঝে নেবার চেষ্টা করছে। বেশ ক’দিন মোহনলাল ও হারাধন তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। মোহনলাল প্রায় সারাদিন ছিল। হারাধন আসত কাজ থেকে ফিরে। চাকুরিতে যোগ দিয়ে সে ব্যস্ত মানুষ একজন।
কথা ছিল, মোহনলাল বহরমপুরেই থেকে যাবে। কাপড়ের দোকানে বসে সোমেশ্বরকে সাহায্য করবে এবং সুবিধেমতো দলের কাজ করবে। কিন্তু এখন সে তার পরিকল্পনাকে নতুন করে সাজাতে চায়। সে চেয়েছিল রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই কাটিয়ে দেবে জীবন। সিদ্ধার্থর মতো। কিন্তু সোমেশ্বর তার পরিকল্পনা সমর্থন করেননি। পারিবারিক ব্যবসাই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। এবং মোহনলালও জানে, অর্থাগম না হলে রাজনীতি করার স্বপ্ন রং হারাবে। সম্পূর্ণ সময় রাজনীতি করার জন্যও আর্থিক সহায়তা দরকার। আবার ব্যবসা ভালভাবে করতে গেলেও সম্পূর্ণ সময় দেওয়া দরকার। সোমেশ্বরের ইচ্ছে, মোহনলাল কিছুদিন দোকানে বসে কাজটা ধরে নিক। তারপর তিনি গ্রামে থাকবেন। মাঝে মাঝে আসবেন।
কিন্তু এখন মোহনলাল ভাবছে ঠিক বিপরীত কথা। সে নিজেই থেকে যেতে পারে গ্রামে। ওখানে দলের ভিত আরও শক্ত করার কাজে সে আত্মনিয়োগ করতে পারে। সে বুঝতে চাইছে না, সোমেশ্বর অশক্ত হয়ে পড়লে সে হঠাৎ ব্যবসার হাল ধরতে সক্ষম হবে কি না। বরং তার মধ্যে দেখা দিয়েছে এক গোপনতম লোভ। সে-লোভ নেতৃত্বের। যে-ভাবে খবরের কাগজগুলিতে উঠে এসেছে সিদ্ধার্থর নাম, যে-ভাবে সে গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে অপরিসীম, তা, এই এতকাল বাদে মোহনলালের মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে। কিংবা, কে জানে, তারও অজ্ঞাতে কোনও গোপন সহস্রপদী ঈর্ষা, সিদ্ধার্থর প্রতি, তার অন্তরে জন্মে, লালিত হয়েছিল। সুযোগ বুঝে ঘটিয়েছে প্রকাশ। বর্ধমানের দুটি বছর ছাড়া স্কুল থেকেই সে সিদ্ধার্থর অনুগামী হতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু এখন সে পৃথক হতে চায়। সে কেন পারবে না সিদ্ধার্থ হতে? সিদ্ধার্থর কী আছে, যা তার চেয়ে বেশি? সে ভেবে দেখেছে, এই বহরমপুরে থেকেই যদি সে দলের কাজ করে তা হলে সিদ্ধার্থকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। অতএব তাকে গ্রামে যেতে হবে। রাসুদা বলেন, মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলিতে শিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন আছে।’ সে জানে, প্রয়োজন শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান কর্মীর। এই কথারই সূত্রে সে রাসুদাকে তার ইচ্ছের কথা জানাল একদিন। রাসুদা অবাক হলেন। খুশিও হলেন। বললেন—খুব ভাল কথা। তোমার মতো ক’জন আর নিজের গ্রামে থেকে কাজ করতে চায়! হরিহরপাড়ায় অমরেশদা আছেন। তা ছাড়া সিধু মাঝে মাঝে গিয়ে তোমাকে সাহায্য করবে।
সে খুশি হয়নি। কিছু বলতেও পারেনি। সিদ্ধার্থ কেন তাকে সাহায্য করবে? কী সাহায্য করবে? সে তার মনোভাব গোপন করে হেসেছিল। সিদ্ধার্থ এসেছিল তখন। আর সিদ্ধার্থর সঙ্গে সঙ্গেই আরও একজন। তার নাম বদরুদ্দিন আহমেদ। গোরাবাজার ঈশ্বরচন্দ্র ইন্সটিটিউশনের নতুন ইংরাজি শিক্ষক। সিদ্ধার্থ বা মোহনলালের সঙ্গে পরিচয় ছিল না তার। পরিচয় হল। রাসুদা সিদ্ধার্থকে বললেন—তুই এখন থেকে নিয়মিত গ্রামে জনসংযোগ করবি। এই বদরুদ্দিন চতুষ্কোনার ছেলে। ওর সঙ্গে চতুষ্কোনা যাবি। ওখানকার পঞ্চায়েত আমাদেরই দখলে আছে। তেকোনায় যাবি, মোহনলাল ওখানে থেকে কাজ করবে। এবং আরও সব গ্রাম।
—মোহনলাল ওখানে থেকে কাজ করবে! তুই বহরমপুরে থাকছিস না?
—না। গ্রামে আমার অনেক কিছু করার আছে।